ওয়েডিং_স্টোরি পর্ব ৩৩+৩৪

#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_৩৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

— ” দুঃখজকভাবে, আপনি মেডিক্যালে চান্স পান নি। ”
কথাটা শুনে আভা পাঁচ সেকেন্ডের জন্যে ‘ থ ‘ হয়ে গেলো। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো তার। চক্ষে জমলো দু ফোঁটা জল! চোখের সামনে নিজের এতদিনের স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হতে দেখলো ও। আভা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— ” আ.আপনি সত্যি বলছেন? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। ”
আহনাফ বুঝলো, আভার মন ভেঙে গুড়িয়ে গেছে। এখন আরো নেগেটিভ কথা বললে হয়তো আভার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শোনা যাবে। আহনাফ চোখ বুজে লম্বা শ্বাস টানলো। ফোনের ওপাশ থেকে শান্ত সুরে বুঝালো,
— ” দেখো আভা, তোমার মার্ক খুব ভালো এসেছে। জাস্ট, পয়েন্ট ফাইভের জন্যে সরকারিতে চান্স হয়নি। ওয়েটিংয়ে আসতো। ওয়েটিং আসার কথা ছিল। কিন্তু, কেনো আসলো না, সেটাই বুঝতে পারছি না। এতে মন খারাপ করার কিছু হয়নি। তুমি চাইলে, ঢাকার নামকরা বেসরকারি মেডিক্যালে পড়তে পারবে। চিন্তা করো না। ”
আভা আর শুনলো না। ধাম করে ফোন কেটে দিলো। ফোন বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কতশত স্বপ্ন ছিলো তার, এই মেডিক্যাল নিয়ে। কিন্তু, এখন? চোখের সামনে তার হার যেনো খিলখিলিয়ে হাসছে। আঙ্গুল উঁচিয়ে জানান দিচ্ছে, ‘ তুমি হেরে গেছো, আভা। তুমি পারো নি। তোমার দ্বারা কিছুই হবে না। ‘ নিজেকে পরাজিত, ঘৃণিত মনে হচ্ছে। এমন হওয়া কি খুব দরকার ছিলো?
আহনাফ বেসরকারি মেডিক্যালে ক্লাস নিচ্ছিলো। মূলত, মেডিক্যালটা আহনাফের বাবার তৈরি। আহনাফ ঢাকা মেডিক্যালে থেকে পড়াশোনা শেষ করে এখানেই প্র্যাকটিস করছে। একটু আগে ক্লাস নেওয়ার সময়, দু-তিনজন কথা বলছিলো,অ্যাডমিশন রেজাল্ট নিয়ে। সেটা শুনেই আহনাফ আর দেরি না করে আভার রেজাল্ট দেখে। আভা চান্স পায় নি দেখে, আহনাফ কিছুটা হতবম্ব হয়ে পড়েছিল। আভার মার্ক যথেষ্ট ভালো। শুধু পয়েন্ট ফাইভের জন্যে আভার স্বপ্ন একদম মাঠে মারা পড়লো।
আহনাফ নিজের কেবিনে বসে আছে। হাতে ফোন। আভার ফোন কেটে দেওয়ার পর থেকে, কয়েকবার আভাকে কল করেছে। কিন্তু, বারবার বন্ধ দেখাচ্ছে। আহনাফ একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে ফোনটা পকেটে রেখে উঠে দাঁড়ালো। এই মুহূর্তে, আভার সাথে দেখা করাটা দরকার তার। না জানি, আভা কোন পরিস্থিতে আছে? এই মেয়েটা না যা করে! ওকে কখনো শান্তি দিবে না, পণ করে রেখেছে যেনো! আহনাফ আর দেরি করলো না। লিফট দিয়ে নিচে নেমে, পার্কিং এরিয়া থেকে বাইক বের করলো।
___________________
প্রায় আধ ঘন্টা যাবৎ আভা দরজা বন্ধ করে বসে আছে। রুমে বসে আছে চুপটি করে। দরজার বাইরে থেকে, সবাই কতবার ডাকলো, তার এক উত্তর, ‘ আমি ঠিক আছি। আমাকে সমবেদনা দিতে হবে না। ‘ আভার মা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আভাকে ডাকছেন বারবার। তার এই কথা,
— ” আভা, মন খারাপ করিস না, মা। বের হ। তোর মার্ক ভালো ছিলো। এত মন খারাপ করিস না। বের হ। ”
জুনায়েদ, রেহানাকে বুঝাচ্ছেন, ‘ আভা নিজেকে সামলালে এমনিই বের হবে। এখন ওকে একা থাকতে দেও। ‘
কিন্তু রেহেনা তা শুনতে একদম নারাজ। উল্টো, তিনি এসব বুঝার পরিবর্তে স্বামীর উপর ক্রমশ রেগে যাচ্ছেন। মেয়ে দরজা বন্ধ করে বসে আছে, বাবা সেখানে বলছে ‘ একা ছেড়ে দাও? ‘ কি পাষাণ দিল! আভার বাবা একসময় হাল ছেড়ে মা-মেয়েকে একা ছেড়ে রুমে চলে গেলেন। মিনহাজ বাসায় নেই। আরোহীকে ওর বাসায় পৌঁছে দিতে গেছে। আভার মা পড়েছেন মহা মসিবতে। তিনি জানেন, আভা চেষ্টা করেছে। তিনি নিজে অ্যাডমিশন নিয়ে আভাকে স্ট্রাগল করতে দেখেছেন। কিন্তু, সবই কপাল! আল্লাহ-তায়ালা যা লিখেছেন ভাগ্যে, তাই হবে। ভাগ্যকে খন্ডন করা কারো সাধ্য নেই।

কলিং বেল বেজে উঠলো। কলিং বেলের আওয়াজ শুনে রেহেনা ফুস করে এক নিঃশ্বাস ফেলে দরজা ছেড়ে বসার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। এখন আবার কে এলো? দরজা খুলে আহনাফের বিদ্ধস্ত চেহারা দেখে উনি যারপরনাই অবাক হলেন। আহনাফ অস্ফুট সুরে সালাম দিয়েই জিজ্ঞেস করলো,
— ” আন্টি, আভা কোথায়? ”
রেহানা দরজা ছেড়ে পাশে দাঁড়ালেন। বললেন,
— ” ভিতরে আসো, বাবা। আভা রুমেই আছে। দরজা বন্ধ করে বসে আছে কখন থেকে। আমি কতবার বললাম, খুললোই না। তুমি একটু দেখো তো। ”
আহনাফ ভিতরে প্রবেশ করলো। আভার মায়ের দিকে চেয়ে আশ্বস্ত করে বললো,
— ” আপনি চিন্তা করবেন না, আন্টি। আমি দেখছি। ”
আহনাফ কথাটা বলেই আভার রুমের দিকে পা বাড়ালো। আভার মা, আহনাফের পিঁছু পিঁছু আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে ভাবলেন, মেয়ে জামাই কে একা ছেড়ে দেওয়াই উত্তম। এই বয়সে আর লজ্জায় পড়ার ইচ্ছে তার নেই। আভার মা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। কিছু বানানো যায় কিনা, আপাতত সেটাই তার মুখ্য চিন্তা! মেয়ে জামাই এসেছে বলে কথা!
আহনাফ আভার রুমের সামনে দাঁড়ালো।এই মেয়ে কি কখনোই শুধরাবার না? পরপর দুবার দরজায় টোকা দিয়ে হাক ডাকলো,
— ” আভা, দরজা খুলো বলছি। ”
ভিতর থেকে আভার কান্নামাখা আওয়াজ ভেসে আসলো,
— ” আমাকে একা থাকতে দিন, প্লিজ। আই নিড সাম পিস। প্লিজ। ”
আহনাফ এবার গলার সুর কড়া করলো। বললো,
— ” আভা, আমি লাস্টবার বলছি। দরজা খুলো। নাহলে, আমি কি করে বসবো আমি নিজেও জানিনা। আই সে ওপেন দ্য ডোর, ড্যাম ইট। ”
আহনাফের ধমক শুনে আভা একপ্রকার কেঁপে উঠলো। এই ছেলে এমন কেনো? এই যে আভা কষ্ট পাচ্ছে, কোথায় এসে নরম গলায় কথা বলবে। তা না! এসেই ধমকা-ধমকি! এই বদ মানুষের কাছে এটাই আশা করা যায়, বৈকি! পুনরায়, ওপাশ থেকে আহনাফের রাম ধমক শুনে আভা ব্যান্ডেজকৃত পা নিয়ে কষ্ট করে দরজা খুললো।
আহনাফ আভার দিকে তাকালো। তার চোখে-মুখে রাগের স্ফুলিঙ্গ! যেকোনো মুর্হুতে, সেই স্ফুলিঙ্গে দাহ হয়ে আভা ছাই হয়ে যেতে পারে। আভা দরজা খুলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, ঠায়। মুখে কুলুপ এঁটে পা দিয়ে মাটি খুটছে। এখনো, কান্নার প্রভাব শরীর জুড়ে। আভার এমন ধ্বংসাত্বক অবস্থা দেখে আহনাফের তুমুল রাগ কমে হুরহুর করে শূন্যের কোটায় নেমে এলো। একদিন কি অবস্থা করেছে চেহারার! চোখ মুখে শুষ্ক মরুভূমির ন্যায়! তবে, এটাই কি ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ? আহনাফ শান্ত সুরে জিজ্ঞেস করলো,
— ” প্রবলেম কি তোমার? এভাবে দরজা বন্ধ করে কি প্রমাণ করতে চাইছো? টেল মি? ”
আভা কিচ্ছু বললো না। বরং, ব্যান্ডেজকৃত পা এক হাত দিয়ে ধরে বিছানায় এসে বসলো। আহনাফ আভার পিছু পিছু বিছানায় বসলো। বেশ কিছুসময় দুজনের মধ্যে চললো, নীরব খেলা! একসময় আহনাফ নীরবতা ভাঙতে যাবে তার আগেই আভা ভেজা কণ্ঠে বলে উঠলো,
— ” আমি হেরে গেছি, আহনাফ! পারি নি আমি। আমি অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু, পারি নি। আমার এক্সাম ততটা খারাপ ছিলো না। কিন্তু, কেনো এমন হলো? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আমি চেষ্টা করেছিলাম। ”

আহনাফ আভার কথা শুনে ব্যথিত হলো। একজন স্টুডেন্টের কাছে, অ্যাডমিশন এক্সাম কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা সে বুঝে। সেক্ষেত্রে, আভার এমন করে ভেঙে পড়া যুক্তিযুক্ত! কিন্তু, একটু আগে আভা আহনাফকে নাম ধরে ডেকেছে, অন্যমনস্ক থাকায় ব্যাপারটা আহনাফ প্রায় ভুলেই গেলো। সে আলতো করে আভার হাত নিজের মুঠোয় পুড়ে নিলো। আভা এখনো নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ ছোট্ট করে এক শ্বাস ফেলে বললো,
— ” ভুলে যাও এসব। সরকারি মেডিক্যালে পড়তে পারো নি ত কি হলো? জীবনে একজন ভালো ডাক্তার হতে পারাটাই কি মুখ্য নয়? আর কে বলেছে, তুমি হেরে গেছো? বেসরকারি থেকে ডাক্তার হও, আর সরকারি থেকে। দিনশেষে তুমি একজন ডাক্তার। সেটাই তোমার পরিচয়। এখন এসব নিয়ে মন খারাপ করে না, লক্ষ্মীটি। ভুলে যাও এসব। ওকে? ”
আহনাফের ওমন কথা শুনে কে মন খারাপ করে থাকতে পারে? ঠিক তাই, কেউ পারে না। তেমনই, আভাও পারে নি। আহনাফের দিকে চেয়ে আভা আলতো হাসলো। তবুও, যেনো দুঃখ সারে নি তার। মনে স্পষ্ট কিছু কষ্ট, চোখে ছলছল কিছু জল! তবুও, তার মুখে স্নিগ্ধ এক হাসি। আভার হাসিটা তবুও আহনাফের ভালো লাগলো। আহনাফের বুকের উপর থেকে এবার যেনো পাথর সরে গেলো। প্রিয়তমার হাসি যেনো শুধু হাসি নয়, আস্ত এক সুঁচ। হৃদয়কে ছিঁড়ে একদম এফোর-ওফোঁড় করে দেয়।
______________________
অবশেষে, সকল হারকে উপেক্ষা করে এবার শুধু জিতের পালা! আভার বাবা আর আহনাফের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আভাকে, আহনাফদের মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করানো হলো। পড়াশোনার ফাঁদে পড়ে, এবার থেকে সপ্তাহে ছয়দিন হবে, প্রিয়তমের সঙ্গে দেখা।আভার এই হার কি অন্য এক সুখকর জিতের কারণ? আভা-আহনাফ তবে কি এখন আরো কাছাকাছি আসতে চলেছে?
#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_৩৪
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

সময়ের গতিধারায় কেটে গেলো আরো দু সপ্তাহ! আভার এখন পুরোটাই সুস্থ, বলা চলে। শুধু, অতিরিক্ত হাঁটা চলা করলে পায়ে সামান্য ব্যথা হয়। তবে, ব্যথাটা ক্রমশ সহনীয়!
আভার সুস্থতার উপর ভিত্তি করে মিনহাজের বিয়ের তারিখ ঠিক করা হলো, পাঁচদিন পর। মিনহাজের কথামত, ডেস্টিনেশন ওয়েডিং হবে। আসলে, এই ডেস্টিনেশন ওয়েডিংয়ের প্ল্যানটা আভার। অনেকদিনের শখ তার, ভাইয়ের বিয়ে খুব ধুমধাম করে আয়োজিত হবে। সেজন্যেই, সবাই ব্যাগ-ট্যাক বাঁধাই করে বেরিয়ে পড়লো, কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। সেখানে, হোটেল বুক করা হয়েছে সবার জন্যে।

আভাদের বাসার নিচে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সবাই একে একে গাড়িতে উঠছে। বাড়ীর পুরুষেরা, সবগুলো গাড়িতে ব্যাগপত্র রাখছে।
এবার, যাত্রা শুরু করার পালা! সব কাজিন, আর আভার বন্ধুরা একটা গাড়িতে উঠলো। একজন আরেকজনের উপর একদমই ঢলে পড়ছে। গাড়িতে বিন্দুমাত্র জায়গা নেই বসার। তবুও, তারা বসবে। যত কষ্টই হোক, সবাই একসাথে জার্নি করার মজাটাই আলাদা! আভা সব কাজ শেষ করে গাড়ির দরজা খুললো। সঙ্গেসঙ্গে গাড়ীর মধ্যে এমন গাদাগাদি অবস্থা দেখে, আভার চোখ চড়কগাছ! সাথী খিলখিলিয়ে হেসে বললো,
— ” এই আবা, তুই জিজুর গাড়িতে করে চলে যা। এখানে জায়গা নেই, দেখছিস না? ”
আভা সবার দিকে একনজর চোখ দিলো। একজনের কোলের উপর আরেকজন বসে আছে। মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে খুব! কিন্তু, এতেই খুশি তারা! সবার কথার ভাঁজে, গাড়ির প্রতিটা কোণা মুখরিত! আভা তবুও দাঁত খিঁচালো। বললো,
— ” আমি কেনো উনার ওর গাড়ি করে যাবো। দেখি, বের হ তুই। আমি বসবো এই গাড়িতে। বের হ! ”
আভার কথা শুনে সাথীর মুখটা চুপসে গেল। মুখখানা যদি এক বেলুন হতো, তবে চুপসানোর সেই করুন শব্দও কানে আসতো! তারা গাড়ীর ভিতর থেকে মুখ দেখালো। এবং, স্বভাবসুলভ খোঁচা মারলো,
— ” তোমারে জামাইর সাথে বসতে দিসি, তাই ভাল্লাগেনা, তাইনা? একটা থাপ্পর মারবো, শরীর গিয়ে পড়বে আহনাফ জিজুর গাড়িতে। ঢং কম করো। যাও এখন! ”
আভা তারার কথা শুনে চোখ রাঙালো। এই মেয়েটা কেনো বুঝতে পারছে না, আহনাফের সাথে আভার ঝগড়া চলছে। তাও, যেনো তেনো ঝগড়া না। একদম, জবরদস্ত ধরনের ঝগড়া। দুজনেই যেন পণ করে বসে আছে, ‘ অপরপক্ষের সাথে যেঁচে কথা বলাটা পাপ! ঘোর পাপ! ‘ আর সেই পাপকে প্রশ্রয় দিয়ে আহনাফের গাড়িতে উঠবে ও? অসম্ভব! কোনোমতেই না! আভা নাছোড়বান্দার মত বললো,
— ” এই সাথী, তুই নাম। নাহলে, আজকে আমি তোর ওই ব্রেইনলেস মাথাটা এক মাইর দিয়ে ফাটিয়ে ফেলবে। নাম তুই। ”
সাথী যেনো শুনলই না সেকথা! বরং, আভার ওমন শক্তপোক্ত ধমকিকে এককথায় হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে সিনথিয়ার সাথে কথা বলতে লাগলো। আভা আর কোনো উপায় খুঁজে পেলো না। গাড়ির দরজা ধাম করে লাগিয়ে বিড়বিড় করলো,
— ” সবকটা স্বার্থপর! ‘

অন্যান্য গাড়ি বেরিয়ে পড়েছে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। শুধুই, আহনাফের গাড়িই বাকি আছে। আভা গটগট পা ফেলে আহনাফের গাড়িতে উঠে বসলো। দরজা ধাম করে বন্ধ করে চুপচাপ সামনে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ আভার এমন রাগ দেখে আড়ালে মিটমিটিয়ে হাসলো। গাড়ি চালু না করে খুব রয়ে সয়ে পকেট থেকে সেন্টার ফ্রুট বের করে মুখে পুড়ল। বেশ খানিকসময় পাড় হয়ে গেলো। গাড়ি চালু করার নাম নেই, আহনাফের। আভা একসময় বিরক্ত হলো। সেই বিরক্ত যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালো, তখন আভা আহনাফের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললো,
— ” গাড়িতে ঘুমানোর ইচ্ছা আছে? ”
আহনাফ মাথা নাড়ালো। যার অর্থ, না! আভা কণ্ঠে রাগের আভাস নিয়ে বলে উঠলো,
— ” তো গাড়ি চালাচ্ছেন না কেনো? ”
আহনাফ বাঁকা হাসলো। যা দেখে আভার রাগে শরীর জ্বলে অঙ্গার হলো। এই ছেলে নির্ঘাত মাথায় কোনো বদ বুদ্ধি আঁটছে! আহনাফের বাঁকা হাসি মানেই, আস্ত এক বদ বুদ্ধির কারণ! আভা আর কিছু বলবে তার আগেই আহনাফ গাড়ি চালু করলো। আভা মুখের কথা গলাধঃকরণ করে জানালার দিকে মুখ করে বসে রইল চুপচাপ।
গাড়ি শহর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। আভা মোবাইল থেকে গান ছেড়ে কানে হেডফোন গুঁজে দিলো। এবার শান্তি!
হঠাৎ গাড়ির স্পিড বাড়তে লাগলো! ধীরে ধীরে গাড়ীর স্পিড একশো ক্রস করলো। আভা গানের জগৎ ছেড়ে বাইরে তাকালো। ইয়া আল্লাহ! এত স্পিড! মুহুর্তের মধ্যে যেকোনো অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে! আভা পাশ ফিরলো। আহনাফ একহাত দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে, অপরহাত দিয়ে মাথার চুল ঠিক করছে। তার চোখ-মুখ অত্যন্ত স্বাভাবিক। আভা আহনাফের ওমন বেপরোয়া ভাব দেখে আর চুপ থাকতে পারলো না। দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠলো,
— ” গাড়ীর স্পিড কমান। ”
আহনাফ স্পিড কমালো না। বরং, তার উল্টোটা করলো। স্পিড বাড়িয়ে আরামসে মুখের সেন্টার ফ্রুট চিবুতে লাগলো। গাড়ীর এহেন স্পিড দেখে, আভার ভয়ে আত্মা লাফাচ্ছে। যেখানে, গাড়ীর স্পিড আশি ক্রস করলেই আভা ভয়ে জান শুকিয়ে যায়, সেখানে এই মুহূর্তে স্পিড একশো দশের উপরে। আভা ভয়ার্ত চোখে আহনাফের দিকে তাকালো। বললো,
— ” পাগল হয়ে গেছেন আপনি? গাড়ীর স্পিড কমান। আমার ভয় করছে। প্লিজ, স্পিড কমান। ”
আহনাফের চোখে কোনো ভয়-ডর নেই। সে নিতান্তই স্বাভাবিক ভাবে গাড়ী চালাচ্ছে। আভা পুনরায় একই কথা বললে আহনাফ এক অদ্ভুত কথা বলে বসে,
— ” স্পিড কমাবো এক শর্তে! ”
আভা কোনো দিগ্বিদিক চিন্তা করার অবকাশ পেলো না। উদ্ভান্তের মত বলে উঠলো,
— ” বলুন, বলুন কি শর্ত! আমি সব শর্ত মানবো। সব! ”
— ” বলো, আভা একটা নির্বোধ মেয়ে। তার নির্বুদ্ধিতার কারণে, আহনাফ কষ্ট পাচ্ছে। দি নির্বোধ বালিকা আভার উচিত, তার সব দোষ স্বীকার করে, সব রাগ ভুলে, আবারও আহনাফের সাথে কথা বলা। বলো এখন! ”
আহনাফের কথা শুনে আভার প্রচন্ড রাগ লাগলো। কি সাংঘাতিক লোক! আভা মুখ ফুলালো। বললো,
— ” কক্ষণো বলবো না। আপনি দোষ করেছেন তাই আমি রাগ করেছি। সো, আমি এসব বলবো না। ”
— ” ওকে, ফাইন! ”
আহনাফ ভাবলেশহীন ভাবে কথাটা বলেই গাড়ীর স্পিড বাড়াতে শুরু করলো। আভা পড়লো মহাফ্যাসাদে! এই ছেলে এত শেয়ানা কেনো? কখনই, নিজের দোষ স্বীকার করবে না। আর আভা যখন রাগ করে, তখন তো আরো না। বরং, সব দোষ আভার ঘাড়ে চেপে, নিজেকে মহান সাজিয়ে, কতশত অদ্ভুত উপায়ে আভার রাগ ভাঙাবে! এবারও তাই হলো। কিন্তু, আভা এবার কিছুতেই নিজের দোষ স্বীকার করবে না। বারবার, ও আহনাফের কাছে হেরে যাবে না। কিছুতেই না।
কিন্তু, আভার এই ভয়ঙ্কর পণ বেশিক্ষণ টিকলো না। বরং, আভার ভয়ার্ত মন সেসব পণকে জলাঞ্জলি দিলো। আভা জানালার দিকে তাকালো। আহনাফের গাড়ি বারবার ওভারটেক করছে। নিঃসন্দেহে, পরিস্হিতি ভয়াবহ! আর আভা ভয়ও পাচ্ছে। আভা একসময় চোখ খিঁচে একদমে বলে ফেললো,
— ” আভা একটা নির্বোধ মেয়ে। তার নির্বুদ্ধিতার কারণে আহনাফ কষ্ট পাচ্ছে। দি নির্বোধ বালিকা আভার উচিৎ, সব দোষ স্বীকার করে, সব রাগ ভুলে আবার আহনাফের সাথে কথা বলা। বলে দিয়েছি? এবার হয়েছে, শান্তি? এখন তো গাড়ির স্পিড কমান। প্লিজ! ”
আহনাফ বাঁকা হাসলো। ধীরে ধীরে গাড়ীর স্পিড কমে এলো।এবার, আভার প্রাণে যেনো পানি এলো। আভা সিটে হেলান দিয়ে লম্বা, লম্বা নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। আহনাফ তা দেখে হাসলো শুধু। গাড়ির সামনে থেকে একটা পানির বোতল নিয়ে আভার দিকে এগিয়ে দিলো। আভা বোতল দেখে চক্ষে স্ফুলিঙ্গ নিয়ে আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ বরাবরের মতন, ভাবলেশহীনভাবে বললো,
— ” শ্বাস নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে গেছো। পানি খাও। ঠিক হয়ে যাবে। ”
আভা পানি নিলো না। বরং, ত্যাড়াভাবে বলে উঠলো,
— ” আপনি জানেন, আপনি একজন প্রচন্ড খারাপ লোক? ”
আহনাফ হাসলো। আভার কোলে পানির বোতল রেখে দিয়ে বললো,
— ” আর তুমি সেই খারাপ লোককেই ভালোবাসো, মিস বউফ্রেন্ড! ”
আভা স্তব্ধ হয়ে গেলো। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হলো, অজস্র! আভা তো কখনো বলেনি আহনাফকে নিজের অনুভূতির কথা! তাহলে,আহনাফ তা জানলেন কি করে? তবে কি আহনাফ অন্তর্যামী?
— ” প্রেমিকার মন পড়তে পারে না যে ছেলে, সে আবার কিসের প্রেমিক? ”
পাশ থেকে আহনাফ বলে উঠলো। আভা চুপ হয়ে গেলো। ঠোঁটের কোনে ফুটলো গোলাপের ন্যায় এক হাসি! ইশ! কি সুন্দর সে হাসি! আহনাফ তো পাগল হয়ে গেলো! এক ভয়ঙ্কর সর্বনাশ ডেকে আনলো আহনাফের বুকে!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here