০১.
– বিয়ে টা কি সিঁদূর দিয়ে হবে?
– কখনো না! আমি মুসলিম হয়ে কখনোই ওই লাল রঙ মাথায় মাখবো না আমি ইসলামিক রীতিতেই বিয়ে করবো নইলে আমি এই বিয়ে করবো না!
– মা একটু বুঝ!
– কোনোকিছু বুঝতে চাইনা আমি আব্বুজান কি করে পারছো এতো বড় গুনাহ করতে বলতে পারো? কেন এতো বড় গুনাহর ভাগীদার করছো?
– ঠিক আছে এখানে তাহলে কাগজে কলমেই তোমাদের বিয়ে সম্পন্ন হবে।
কিছুক্ষণ আগের কথা,,,
আজ জাফিয়ার বিয়ে! বিয়ে উপলক্ষে চারপাশটা আনন্দ-উল্লাসে থাকা উচিত ছিলো কিন্তু তার পরিবর্তে চারপাশে সকলের আত্মৎনাৎ, বুক ফাটা কান্না। জাফিয়া বিয়ের আসরে বসতেই ৪ জন লোক তার ভাইকে কাফনের কাপড়ে জড়িয়ে সকলের সামনে রাখলো। জাফিয়া দৌড়ে তার ভাইয়ের কাছে এসে ভাইয়ের দিকে একপলক তাকায় তারপর লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”আ…আমার ভা..ভাইয়ের কি হয়েছে?”
জাফিয়ার মা ততোক্ষণে ফুয়াদের(ফায়রুজের ভাই)মাথার কাছে এসে মরণ কান্না জুড়ে দিলো। কোন মা-ই বা অকালে নিজের সন্তানের চলে যাওয়া সহ্য করতে পারে? যাকে আদর ভালোবাসা সোহাগ দিয়ে বড় করেছে সে এভাবে চলে যাবে সে যে কল্পনায়ও ভাবেনি। ফুয়াদ ১৬ বছর বয়সী! জাফিয়ার কথায় একজন লোক মাথা নিচু করে বলে,”আমরা ফুয়াদকে রক্তাক্ত অবস্থায় বাগানে পেয়েছি এর বেশি আমরা কিছুই জানিনা!”
লোকটার কথায় জাফিয়া আর নিজেকে সামলে উঠতে পারেনা! চিৎকার দিয়ে ধপ করে বসে পড়ে ভাইয়ের কাছে! এভাবে নিজের ভাইকে অকালে হারাবে কখনো সে ভাবেনি। উপস্থিত সকলের মাঝে শোকের ছায়া। কিছুক্ষণ কান্নার পর জাফিয়া মূর্তির মতো বসে রইলো। কথায় আছে না, “অল্প শোকে কাতর, অতি শোকে পাথর!” জাফিয়ার বাবা ফয়েজ দূরে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছে! জাফিয়ার ছোট চাচা দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খুবই ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,, “ভাইজান(জাফিয়ার বাবা) যীনাতের বর রোড এক্সিডেন্ট করেছে এবং ঘটনাস্থলে ছেলেটা আর তার বন্ধুরা নিহত হয়।”
চাচার এমন কথায় পুরো বিয়েবাড়ি যেনো নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।
★
বিয়ের দিনে এতো দুর্ঘটার জন্য মানুষ এখন জাফিয়ার দিকে আঙুল তোলা শুরু করলো। সকলে বলাবলি শুরু করে,”মেয়েটা একটা অমঙ্গলের বস্তা! দেখিস না বিয়ের দিনই ভাইটাকেও খেলো সাথে নিজের হবু স্বামীকেও! কেমন অপয়া হলে এভাবে মানুষ মারে চিন্তা করতে পারিস? এই মেয়ে আস্তা অলক্ষী! এ যেই ঘরেই যাবে তাদের সবাইকে মেরেই ছাড়বে, না বাপু এর থেকে দূরে থাকা লাগবে, না জানি কবে আমরা আবার এই মেয়ের ভাগীদার হই।”
সব কথোপকথন ফয়েজের কানে আসছে কিন্তু চেয়েও কিছুই বলতে পারছে না কি বলবে সে?সে নিজেও যে কোনোকিছু বলার মতো অবস্থায় নেই। ওইদিকে কাজী সাহেব তাড়া দেয়া শুরু করে বলে,”কি হলো ছেলে কই? বিয়ে তো দিতে হবে নাকি?”
এবার ফয়েজ কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। আজ যদি তার মেয়ের বিয়ে না হয় তাহলে সম্মান তো যাবেই সাথে মেয়েটার জীবনও নষ্ট হয়ে যাবে। অতি আদর ভালোবাসায় বড় করেছে মেয়েকে সে কষ্ট পাক তা যে কখনোই চায়না। ছেলেও কম আদরের ছিলো না কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন! উপায় না পেয়ে ফয়েজ সবার কাছে মিনতি করে যেনো কোনো যুবক ছেলে তার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয় কিন্তু কেউ ভয়ে এক পাও এগোলো না যদি কোনোভাবে এই মেয়ে তাদের জীবনে বীপর্যয় ডেকে আনে? তাই সবাই নাকোচ করে দেয়! ফয়েজ এবার না পেরে ধপ করে সবার মাঝে বসে পড়ে। কেঁদে কেঁদে কবলে,”হে আল্লাহ এ কেমন পরীক্ষা নিচ্ছেন আপনি আমাদের পরিবারের উপরে? কি দোষ করেছে আমার ছেলে মেয়ে দুটো যাদের জীবন এমন হয়ে গেলো! আমার ছোট ছেলে টা কে নিয়ে নিলেন এখন আমার মেয়েটাকে কেন সবার ঘৃণার পাত্রী বানাচ্ছেন? সে তো সবসময় আপনারই ইবাদতে মশবুল ছিলো!! তার প্রতিদান আপনি এভাবে দিলেন?”
বলেই হাটু গেড়ে বসে কাঁদতে লাগে! এমন সময়ই তার কাধে কেউ হাত রাখে ফয়েজ সাথে সাথেই চোখে অশ্রু নিয়ে পিছু ফিরে তাকায়। যিনি হাত রেখেছেন তিনি আর কেউ নন প্রভাবশালী মেয়র মিস্টার দেবনাথ দেব। বয়স তার ৭৭ এর কাছাকাছি। এই বয়সেও তিনি অনেক ফিট এবং পরশ্রমী। ফয়েজ উঠে দাঁড়ায় এবং দেবনাথ দেব কে বলে,”আপনি?”
– হ্যাঁ আমি সবটা দেখেছি এবং শুনেছি তোমাকে একটা প্রস্তাব দিতে চাই।
– কিসের চাচা?
– আমি আমার ছোট নাতিনের জন্য তোমার মেয়েকে চাচ্ছি! আমি চাই আমার নাতিনের সাথে তোমার মেয়ের এই মুহূর্তে বিয়ে হোক!
সকলে অবাক হয়ে দেবনাথ দেবের দিকে তাকায়! অবাক হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ দেবনাথ দেবের পুরো পরিবার সনাতন ধর্মের অনুসারী। কি করে একজন মুসলিম মেয়ে একটা হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করবে এটা যে চরম অপমান ইসলামের দৃষ্টিতে। দেবনাথ দেব সকলের প্রশ্ন বুঝতে পেরে বলে,”আমি জানি আপনাদের মনে কি প্রশ্ন আছে। তবে এইটুকু বলবো এখানে কোনোরকম কারো ধর্মকে অপমান করে বিয়ে হবে না মেয়েটার ধর্ম ঠিক থাকবে আর ছেলেরও।”
হঠাৎ একজন লোক বলে উঠে,”এটা কি করে সম্ভব মেয়র সাহেব? আপনারা বড় ঘরের মানুষ ঠিক আছে কিন্তু আপনাদের ধর্ম আর মেয়েটার ধর্ম সম্পূর্ণ আলাদা সেখানে আপনি কি করে…”
লোকটিকে বলতে না দিয়ে দেবনাথ দেব কঠোর ভাবে বলে,”এতো যখন আপনাদের ধর্ম নিয়ে চিন্তা তাহলে আপনাদের মাঝে থেকে কেউ কেন এগিয়ে আসলো না মেয়েটাকে বিয়ে করতে? জবাব দিন? হ্যাঁ আমরা মানুষ কিন্তু আপনারা আপনাদের অমানুষ রূপ টা দেখিয়েই চলেছেন। এখানে একজন মধ্যবয়সী লোক সবার সামনে কেঁদে বুক ভাসালো কই আপনারা কেউ তো তার দিকে এগিয়ে আসলেন না? আমরা অন্য ধর্মের হলেও নিজেদের মাঝে একটা মনুষ্যত্ববোধ আমাদের আছে! আর আমি আমার এরিয়াতে কোনো মেয়েকে এভাবে অপমান হতে দিবো না যেখানে আপনারা মেয়েটাকে অপবিত্র বলছেন! দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে স্বাভাবিক তাই বলে মেয়েটার কি দোষ এখানে? সবই উপরওয়ালার ইচ্ছা এখানে কারো হাত থাকে না। আর আমি যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আমার ছোট নাতিনের সাথেই জাফিয়ার বিয়ে দেবো মানে দেবোই। আমরা অন্য ধর্মের অনুসারী বলে কি মানুষ নই?”
সকলে দেবনাথ দেবের কথায় একদম চুপ হয়ে গেলো। এদিকে ফয়েজ কি বলবে কিছুই ভেবে পায়না। সকলকে চুপ থাকতে দেখে দেবনাথ দেব বলে,” আশা করছি এখানে কারো আপত্তি নেই!”
– আমার আপত্তি আছে!
সকলে জাফিয়ার দিকে তাকালো। জাফিয়া চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”আমার ভাই এখানে মারা গেছে সেখানে আপনারা আমার বিয়ে নিয়ে পড়ে আছেন? ”
– দেখো মা আমরা তো তোমার ভালোর জন্যই বলছি আজ যদি তোমার বিয়ে না হয় তোমার জীবন টা যে শেষ হয়ে যাবে মা।
– আব্বাজান আপনার সব কথা আমি শুনি কিন্তু এবার পারবো না! আমার ভাই….
বলে আবার ডুকরে কেঁদে উঠে। ফয়েজ মেয়েকে শান্তনা দিয়ে বলে,”এভাবে কাঁদিস না মা আল্লাহ যার আয়ু যতোটুকু রেখেছে তারা ততোটুকু সময়ই যে বাচবে সময় হলে তারা ঠিকই চলে যাবে। আর তোর ভাইটা যে কষ্ট পাচ্ছে! ফুয়াদের কতো ইচ্ছে ছিলো নিজের বোনের বিয়ে দেখবে এভাবে তার ইচ্ছা অপূর্ণ করো না!”
– কিন্তু বাবা আমি অন্য ধর্মের ছেলেকে কখনোই বিয়ে করবো না। এতে আল্লাহ আমার উপর নারাজ হবেন তা আমি কখনোই চাইনা।
একজন হিন্দু মহিলা বলে উঠে,”এতোই যদি তোমার আল্লাহকে নিয়ে ভয় তাহলে তোমার সেই আল্লাহ কেন তোমাকে এমন বিপদে ফেললো?”
জাফিয়া শত কষ্টের মাঝে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে,”আল্লাহ আমার ধৈর্য্যের পরিক্ষা নিচ্ছেন এবং তিনি কখনোই কারো খারাপ চান না। তিনি আমার তকদিরে যা লিখেছেন আমার সাথে তাই হচ্ছে এ নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আর আপনি অন্য ধর্মের অনুসারী হয়ে আমার প্রভুকে কটুকথা শোনানোর আগে ১০বার ভেবে নিবেন এখন চুপ থাকলেও পরের বার আল্লাহর কসম আমি আপনাকে কোনো প্রকার ছাড় দেবো না।”
জাফিয়ার এমন রুক্ষতা মহিলাটির গা জালিয়ে ছেড়েছে। দেবনাথ দেব শান্ত কন্ঠে বলে,”তোমার জন্য এখন এই পথ টাই খোলা আছে তাই বলছি রাজি হয়ে যাও!”
– ক্ষমা করবেন দাদু আমি কখনোই পারবো না নিজের ধর্মকে ত্যাগ করে আপনার নাতিনকে বিয়ে করতে!
– এখানে ত্যাগ করার বিষয় কেন আসছে? আমরা কেউ তো তোমার ধর্মকে ছাড়তে বলছি না শুধু বলছি তুমি আমার নাতিনকে বিয়ে করবে। আমি নিজে কথা দিচ্ছি কেউ তোমাকে কোনোরকম জোর করবে না তোমার ধর্ম বদলাতে! তুমি তোমার ইবাদত নিজের মতো করে করবে।
– আপনাকে আমি কি করে বোঝাই ইসলামে অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করতে নেই এটা দ্বন্দনীয় অপরাধ!
-(আর আমি তোমায় আমি কিভাবে বোঝাই যীনাত আমার নাতিনটা যে তোমার জন্য পুরোই যোগ্য! তোমার আগমন বিপদ থেকে জাইফই বাচাতে পারবে। আর জাইদ যে তোমার মতোই….নাহ কাউকে বলতে পারবো না আমি সত্যটা এতে করে যে আরও সমূহ বিপদ!)
এমন সময়ই জাফিয়ার শিক্ষক এলাকার ইমামসাহেব আসলেন। জাফিয়া সালাম দিলে তিনি সালামের উত্তর নিলেন। জাফিয়া ছোট থেকে তাকে খুব মানেন।তিনি সবটা শুনে কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলেন। একে তো ফুয়াদের জানাজাও বাকি তার মাঝে জাফিয়ার বিয়ে। হুজুর কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে শান্ত গলায় বলে,”আমি আপনার নাতিনকে দেখতে চাই সে কি বিয়েতে এসেছে?”
– হ্যাঁ এসেছে দাঁড়ান আমি এখনই তাকে সামনে আনছি!
বলেই তিনি অন্যদিকে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরেও এলেন এক সুদর্শন যুবক কে নিয়ে। যুবকটা এতোটাই সুন্দর যে চারপাশের মানুষ হা করে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার রূপের রশ্মি যেনো জ্বলজ্বল করে সকলকে জানান দিচ্ছে তার সৌন্দর্য! সকলে অনেকটাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
#ওয়ারদূন_আসরার
#লাবিবা_ওয়াহিদ
“০২”
——————————-
জাইফকে নিয়ে অলরেডি কানাকানিও শুরু হয়ে গেছে। হুজুরসহ জাফিয়ার পুরো পরিবারও হা করে তাকিয়ে আছে জাফিয়াও যেনো এর ব্যতিক্রম নয়। আদৌ এতো সুন্দর ছেলে আছে? সকলের এভাবে তাকিয়ে থাকাটা জাইফ পাত্তা দিলো না কারণ এরকম অনেক ঘটনার সম্মুখীন সে হয়েছে তাই নতুন করে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে চায়না সে। দেবনাথ দেব সকলের উদ্দেশ্যে বলে,”কি দেখেছেন আপনারা আমার নাতিকে?”
হুজুরের ধ্যান ভাঙলো দেবনাথ দেব এর কথায়। তারপর সে গলা পরিষ্কার করে বলে,”আপনার নাতির নাম?”
– জাইফ আহরার ইজায।
হুজুর যেনো আরেকটা শক খেলো। সে কিছুতেই যেনো কিছু মেলাতে পারছে না পরে সে দেবনাথ দেবকে বললো তার সাথে আলাদা কথা বলতে চায়। দেবনাথ দেব নির্ভিয়ে বলে,”চলুন আমার এতে আপত্তি নেই।”
তারপর হুজুর এবং দেবনাথ দেব কোথায় যেনো চলে গেলো আর জাইফ পড়লো আরেক ঝামেলায়। সে এখন কি করবে? জাইফ উপায় না পেয়ে মেইন দরজার দিকে তাকালো সেখানে জাইফের কিছু গার্ড আছে। জাইফ ইশারা করতেই তারা কয়েকজন ভেতরে আসে এবং তাদের বসকে সন্তুষ্ট করতে তার আশেপাশে থাকে আর জাইফ চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে আছে। জাইফ বেশ শান্ত স্বভাবের এবং বেশ ধৈর্যশীল। ছোট থেকেই সে কাউকে না মানলেও তার দাদুকে বেশ মানে এবং সম্মান করেন। দাদুর উপর তার সম্পূর্ণ বিশ্বাস এবং আস্তা আছে।
জাফিয়ার কোনোদিকে খেয়াল না করে তার ভাইয়ের পাশে গিয়ে আবার বসে। ফুয়াদের মাথায় রক্তে ভরা যেনো ফুয়াদের মাথায় ভারি কিছু পড়েছে। জাফিয়ার চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়ছেই। কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে ফুয়াদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। চোখের সামনে ভাইয়ের সাথে কাটানো প্রতিটা স্মৃতি ভেসে উঠছে। কতো দুস্টামি করেছে মায়ের হাতে মার খেয়েছে ফাইজলামির জন্য। শেষে দুজনে না কেঁদে খিলখিক করে হেসেছে। হাতে বা পায়ে ব্যথা পেলে দুইজন দুইজনের সেবা করতো। আর আজ! কি থেকে কি হয়ে গেলো। জাফিয়ার মা কিছুক্ষণেই জ্ঞান হারালো। জাফিয়া চিৎকার করে “মা” বলে উঠে। চাচীরা খালামনিরা সবাই মিলে জাফিয়ার মায়ের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে। আর জাফিয়া কেঁদে কেঁদে শুধু আম্মা আম্মা করছে। ফয়েজও চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। অনেক কষ্টে জ্ঞান ফেরালো। জ্ঞান ফিরতেই জাফিয়ার মাকে বেশ দূর্বল দেখালো। জাফিয়া তো বারবার বলছে,”আমি বিয়ে করবো না আমি এখানেই থাকবো আমি কোথাও যাবো না আমার ভাইকে ছাড়া।
আরও অনেক পাগলামি শুরু করে। শেষে সে নিজেও জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। ছেলে মেয়ে স্ত্রীর করুণ অবস্থা ফয়েজ কিছুতেই মানতে পারছে না। কি করবে সে আজ নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে তার। শেষে উপায় না পেয়ে জাফিয়াকে নিজের রুমে ধরাধরি করে নিয়া যাওয়া হলো। আর জাফিয়ার মাকেও টেনেটুনে জ্ঞরে নিয়ে যাওয়া হলো নইলে হীতে বিপরীত হতে পারে। তারা চলে যেতেই ফয়েজ চুপচাপ ফুয়াদের মাথার কাছে বসলো আর তার ভাইয়েরা তাকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করতে থাকে।
কিছুক্ষণের মাঝেই হুজুর আর দেবনাথ দেব আসলো। হুজুর যা বোঝার বুঝেছে তবে তাদের বলেছে যেনো বিয়েটি কিছুদিন পর করা হয় কারণ এমনেই আজ অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে জাফিয়া আর বড় ধাক্কা সহ্য করতে পারবে না। দেবনাথ দেব বুঝতে পেরে জাইফকে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসলো। তারা চলে যেতেই হুজুর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর ফয়েজকে বলে সকলকে যেতে বললো। ফয়েজ সকলকে বলে দিলো আজ কোনো বিয়ে হবে না আপনারা আসতে পারেন।
বিয়ে হবে না শুনে শুরু হলো তোলপাড়। মহিলারা ছাড়লো না ফয়েজকে কথা শুনাতে।
– তোমার মেয়ে একটা অভিশাপ তাই সব বিপদ ডেকে আনে কে জানে কবে তোমাদের কুড়ে খায়। পারলে একে ঠেঙ্গিয়ে বিদায় করো নাহয় বনবাসে পাঠিয়ে দাও তবুও বিপদ ডেকে এনো না।
জাফিয়ার ছোট চাচা এগিয়ে এসে বলে,”সেটা আপনাদের ভাবতে হবে না আপনারা নিজেদের মেয়েদের গিয়ে সামলান তারপর আমাদের মেয়েদের দিকে আঙুল তুলবেন! গিয়ে দেখেন আপনাদের মেয়েরা কেমন ফষ্টিনষ্টি করে আর আপনারা আসছেন আমাদের আম্মাজানকে কথা শুনাতে? আপনাদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে দোয়া দেয়ার জন্য কথা শুনানোর জন্য নয়! আপনারা আসতে পারেন আর কখনো যেনো আপনাদের বাড়ির ত্রিসীমানায় না দেখি!”
– কি বললে কি তুমি? দেখিও তোমাদের পরিবারের কখনো ভালো হবে না ওই মেয়ের জন্য!
– সেটা আমরা বুঝে নিবো।
মহিলাগুলো নিজেদের অপমান সহ্য করতে না পেরে চলে গেলো রাগে ফুসতে ফুসতে। একে একে আরও অনেকেই চলে যান। হুজুর এগিয়ে এসে বলেন,”ভাইজান আমার সাথে মসজিদে আসুন! আর আপনারা ফুয়াদের গোসলের ব্যবস্থা করুন আজকেই জানাজা পড়ানো হবে।”
হুজুরের কথামতো ফয়েজ হুজুরের সাথে মসজিদে আসে। ফয়েজ বলে,”আমাকে এখানে ডেকে নিয়ে আসার কারণ?”
– যীনাতের বড় বিপদ আছে সামনে। ফুয়াদ বা তাদের এক্সিডেন্ট কোনো দুর্ঘটনা নয় সবটাই পরিকল্পনা মাফিক কাজ!
ফয়েজ ভয়ে ভয়ে বলে,”এ.. এর মানে কি হুজুর?”
– যীনাতকে যেই বিয়ে করতে আসবে তারই প্রাণ যাবে আর ফুয়াদের মৃত্যু টাও স্বাভাবিক নয় তা আমি বেশ বুঝতে পারছি। শুনো তোমাকে বলি, যীনাতের বিয়ের উপর অনেক কিছুই ডিপেন্ড করে আছে যা আমরাও জানিনা। কিছু বছর আগের কথা মনে আছে? যীনাত নিজের স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলো তার উপর তাকে যে এই অবস্থা করেছে তাকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার কারণ আমিও জানি। তোমার থেকে একটা বিষয় গোপন রেখেছিলাম। যে যীনাতকে হাসিল করতে চেয়েছিলো তাকেও খুব নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এর মাঝের ঘটনা আমি বলতে পারবো না যে সে যীনাতের সাথে ঠিক কি করেছে। তা একমাত্র যীনাতই বলতে পারবে কিন্তু যীনাতেরই যে সেই স্মৃতি নেই। সে কোমায় চলে যাওয়ার কারণে তার মাঝের কিছু স্মৃতি মুছে যায়।
– এখন আমরা কি করবো হুজুর?
– দেখো কিছুদিন পরই যীনাতের ২২বছর পূরণ হবে তার আগে যেভাবেই হোক যীনাতকে বিয়ে দিতে হবে। কারণ যারা এসব ঘটনার পিছে আছে তাদের প্রথম টোপ যীনাত! যীনাতকে তাদের যেকোনো মূল্যেই চাই নইলে তারা সবকিছু ধ্বংস করতেও পিছপা হবে না। তাই ১০দিনের আগেই বিয়ে সম্পূর্ণ করতে হবে কারণ ১০দিন পরপরই যীনাতের ২২ বছর পূরণ হবে।
– কিন্তু হুজুর এই অবস্থায় কেই বা বিয়ে করবে আমার মেয়েকে? তারা যে আগেই সেইসব ছেলেকে মেরে ফেলবে।
– ছেলে আছে আর সেটা ওই জাইফ আহরার ইজায!
– মানেহ আবার সেই হিন্দু ছেলেটা?
– আহা!! হিন্দু কই পাচ্ছো তুমি? ওর নামটা বুঝতে পারছো না আদৌ কোনোরকম হিন্দু মনে হয় তাকে? সে যাইহোক তার দাদুর কাছে যা তথ্য পেয়েছি তাতে নিশ্চিন্তে ওদের বিয়ে দিতে পারো তবে সময় নাও।
– যদি তাকেও মেরে ফেলে?
– নিশ্চিন্তে থাকো আমার মন বলছে তেমন কিছুই হবে না উল্টো যীনাত সুরক্ষিত থাকবে। আর বাসার পরিস্থিতি ভালো না।
এবার ফয়েজ ফুয়াদের কথা ভেবে হু হু করে কেঁদে দিলো। হুজুর তাকে সামলানোর চেষ্টা করছে বারবার। একসময় হুজুরও নিজের চোখের জল আটকাতে পারে না।
[যারা নায়িকার নাম নিয়ে কনফিউজড তাদের জন্য, “নায়িকার নাম জাফিয়া যীনাত। পরিবারের সবাই তাকে যীনাত নামেই ডাকে আর জাফিয়া বাইরে প্রকাশ হয়।” আশা করি আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না।]
পরদিন সকালে,,
জাফিয়া একমনে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে কালকে ফুয়াদের মাথার রক্ত এখনো লেগে আছে। রক্ত গুলো শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। কাল রাতেই ফুয়াদকে দাফন করা হয়। জাফিয়ার রাতে ঘুম ভাঙ্গতেই সে আবার পাগলামি শুরু করে দেয়। পরে কোনো উপায় না পেয়ে জাফিয়াকে জোর করে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেয়া হয়। তাতে জাফিয়া আস্তে আস্তে ঘুমে ঢলে পড়ে৷ জাফিয়া সকালে উঠে চুপচাপ বসে আছে। পরে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ওযু করে নিলো। কাযা নামাজ পড়ে খুব কাঁদলো মোনাজাতে এবং ভাইয়ের জন্য দোয়া করলো৷ ঘন্টার পর ঘন্টা জায়নামাজে বসে চোখের জল ফেললো। একসময় আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জাফিয়ার ছোট চাচী জাফিয়াকে খাবার দিতে এসে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলো আর সাথে সাথে চিৎকার দিলো। সবাই রুমে আসে এবং চটজলদি জাফিয়াকে ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ডাক্তারকে ডাকা হলো। ডাক্তার এসে জাফিয়াকে চেকআপ করে বলে,”দেখুন কিছু বছর আগে জাফিয়ার ব্রেইনে খুব বড় সমস্যা হয়েছিলো তার উপর এখন এভাবে জ্ঞান হারাচ্ছে এটা কিন্তু মটেও ভালো লক্ষণ নয়। তাকে একা রাখবেন না কোনোকিছুতেই। এবং কোনোরকম কষ্ট দেয়ার চেষ্টা করবেন না সব ভুলাবেন তাকে নইলে স্পট ডেডও হতে পারে। যাইহোক আমি কিছু মেডিসিন লিখে দিচ্ছি তাকে খাওয়াবেন আর ঠিকমতো খাবার খাওয়াবেন উনি অনেকটাই দুর্বল।
বলেই ডাক্তার চলে গেলো।ফয়েজ মাথায় হাত দিয়ে ভাবছে সে কি করবে। মেয়ের যা করুণ অবস্থা তার উপর বেশি সময়ও নেই কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। জাফিয়ার মাও নিজেকে সামলে নিয়েছে মেয়ের জন্য তবুও পারে না বেশি শক্ত থাকতে। এক ছেলেকে হারিয়েছে এখন মেয়েকে হারাতে পারবে না।
এভাবেই কিছুদিন কেটে যায়। এই কয়েকদিনে প্রতিদিন দুবেলা করে কেউ না কেউ কথা শুনিয়ে গেছে। জাফিয়া বিষয়টা বেশ ভালোভাবে খেয়াল করেছে। তাই সে বুকে এক পাথর বসিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেছে। কারণ এমনেই তার পরিবার শোকাহত তার উপর এভাবে নিজের জন্য বাবামাকে বারবার অপমানিত হতে হচ্ছে এখন যদি জাফিয়া নিজেকে কন্ট্রোল না করে তাহলে আরও করুণ অবস্থা হবে। আজ সকালে জাফিয়া নিজেকে স্বাভাবিক করে সোফার রুমে চুপচাপ বসেছিলো এর মাঝেই জাফিয়ার সাথে যার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো তার মাসহ পুরো ফেমিলি এসে হাজির এবং অনেকরকম কথা শোনায় যা গায়ে লাগার মতো। জাফিয়া চুপচাপ মাথা নিচের দিকে দিয়ে অঝোরে চোখের জল ফেলছে। ছেলের মা দূরে জাফিয়াকে বসে থাকতে দেখে সে ছুটে জাফিয়ার কাছে যায় এবং জাফিয়ার গালে চড় বসিয়ে দেয়। জাফিয়া গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে মহিলার দিকে তাকায়। মহিলাটিকে আরও কিছু মহিলা ধরে রেখেছে যেনো জাফিয়ার কাছে ঘেষতে না পারে৷ ছেলের মা জোরে চিৎকার করে বলে,”তোকে আমি ছাড়বোনা। তোর জন্য আমার কোল খালি হয়েছে অকালে আমি আমার ছেলেকে হারিয়েছি। তুই যে এতোটা অভিশাপ আমাদের পরিবারে ডেকে নিয়ে আনবি তা জানলে আমি তোকে ছেলের বউ করা তো দূরে থাক কখনোই তোর দিকে ফিরেও তাকাতাম না।”
জাফিয়ার ছোট চাচা এবার হুংকার ছেড়ে বলে,”ব্যাস!! অনেক বলেছেন আপনারা। আপনারা কি মানুষ? আপনাদের সাহস কি করে আমাদের আম্মাকে এসব বলার তার কি দোষ এখানে? সবটা আল্লাহর ইচ্ছা কয়বার বলবো আপনাদের? নিজেদের বিবেককে ধরে বাচুন! এভাবে অন্য একটা মেয়েকে দোষারোপ করার কোনো মানেই হয়না। আপনারা কতোটুকু জানেন আমাদে রমেয়ে সম্পর্কে? আপনাদের প্রিয়জন হারিয়েছে আমাদের কি হারায়নি? এখনই আপনারা বের হোন বাড়ি থেকে নইলে আমি আপনাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করবো।”
মহিলাগুলো আরও কিছু বলে চোখের জল ফেলতে ফেলতে চলে গেলো। তারা চলে যেতেই জাফিয়া ধপ করে ফ্লোরে বসে কাঁদতে থাকে। দূরে জাফিয়ার মা আঁচলে মুখ গুজে কাঁদছে। সে যে সহ্য করতে পারছে না মেয়ের এমন অবস্থা। জাফিয়া চিল্লিয়ে শুধু এইটুকু বলে,”কিসের এতো পরিক্ষা নিচ্ছেন আপনি মাবুদ?”
——————————–
চলবে!!!
(
এই গল্পের বাকি পর্ব কই
দিয়েছি আপু