না_চাইলেও_তুই_আমার পর্ব শেষ

#না_চাইলেও_তুই_আমার
[ সিজান ৩ ]
#লেখিকা_সারজীন_ইসলাম
#পর্ব- শেষ পর্ব
ফেসবুকে ঢোকা মাত্র হাজারো নোটিফিকেশনের শব্দে। কোনটা রেখে কোনটা ওপেন করবে তোহা! সামনে থাকা দু-একটা নোটিফিকেশন চেক করে তোহা। কেউ বা তাকে তার বিয়ের জন্য ট্যাগ করে কংগ্রাচুলেশন জানাচ্ছে আর কেউ বা তাকে মেনশন করে কংগ্রাচুলেশন জানাচ্ছে। কাজী অফিসে কাগজপত্রে সিগনেচার করার সময় তোলা ছবি দিয়ে তুলি ও অন্যান্যরা ফেসবুকে আপলোড করেছে। কোন ছবিতেই মিরানের চেহারায় স্পষ্ট নয়। তোহার ফ্যান পেইজে তোহার ভক্তরা একাধিক মেসেজ পাঠিয়েছে মিরান কে দেখাবার জন্য। তোহা কিছুক্ষণ ভেবে অনন্যা কে হোয়াটসঅ্যাপে নক করে।

মিরান গাড়ি ড্রাইভ করছে আর আড়চোখে তোহার দিকে তাকাচ্ছে। মিরানের ফোন নিয়ে কী যেন করে যাচ্ছে তখন থেকে। মিরানের অবশ্য সেদিকে কোন খেয়াল নেই। তার যত খেয়াল শুধু তোহার দিকে। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে একটু একটু ঠোঁট নাড়িয়ে আপন মনে কিছু পড়া, আলতো করে চোখের পলক ফেলা। মুখের উপর পড়ে থাকা ছোট চুল গুলো যত্ন করে সরিয়ে দাওয়া। তোহা ফোন রেখে দিয়ে মিরানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,

—-” আমার দিকে না তাকিয়ে ড্রাইভ করার মন দাও।”

তোহার কথা শুনে মিরান হেসে দিয়ে বলল,

—-” কী করছিলে এতক্ষণ আমার ফোন নিয়ে?”

তোহা মুখ বাঁকা করে বলল,

—-” দেখছিলাম আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে তুমি আর কারো সাথে লটর পটর করছো কিনা?”

মিরান তোহার দিকে একনজর তাকিয়ে বলল,

—-” তা কী দেখলে?”

তোহা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,

—-” কী দেখলাম তা তো তুমি একটু পরে বুঝতে পারবে।”

মিরান আর কথা বাড়ায় না। গাড়ির ড্রাইভ করায় মন দেয়।

মিরান আর তোহা শপিংমলে এসেছে, তোহার জন্য কিছু কেনাকাটা করতে। আসলে গতকাল রাতে মিরান যখন তোহাকে সেন্সলেস করে নিয়ে আসে তখন তোহা টি-শার্ট আর প্লাজো পড়া ছিল। এই পোশাকে তো আর সারা শহর ঘুরে বেড়ানো যায় না তাই মিরান এসেছে তোহার জন্য কিছু কেনাকাটা করতে। মিরান তোহা কে গাড়িতে বসতে বলছিল কিন্তু সে বসবে না, সে মিরানের সঙ্গে যাবে। মিরান তোহা কে একটা লেডিস শপের সামনে এসে বলল,

—-” তোমার যা যা লাগবে এই দোকান থেকে নিয়ে নাও। আমি পাশের দোকানে আছি।”

তোহা মৃদু হেসে বলল,

—-” আচ্ছা।”

মিরান আর কিছু না বলে পাশের দোকানে ঢুকে যায়। আধাঘন্টা পর মিরান কেনাকাটা করে তোহার দিকে যায়। তখন থেকে মিরান একটা জিনিস খেয়াল করছে আশেপাশের সবাই কেমন আড়চোখে দেখছে ওকে। মিরান সেদিকে খেয়াল না করে তোহার কাছে চলে যায়। লেডিস শপে এসে মিরান তোহা কে খুঁজে পায়না। এদিক ওদিক তাকিয়ে মিরান তোহা কে খুঁজে। এরমধ্যে লেডিস শপের একটা মেয়ে এগিয়ে আসে মিরান কে বলল,

—-” ভাইয়া আপনি মিরান না?”

মিরান চোখ গুলো ছোট ছোট করে বলল,

—-” আপনি আমার নাম জানলেন কিভাবে?”

মিরানের কথা শুনে মেয়েটা খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,

—-” কি বলছেন ভাইয়া শুধু আমি কেন সিঙ্গার নওশীন তোহার সব ফ্যানরা আপনার নাম এমনকি আপনাকেও চেনে।”

মিরান বিস্ময় চোখে তাকায় তার দিকে। মিরানের বিস্ময় চোখে তাকানো দেখে মেয়েটা মৃদু হেসে বলল,

—-” আপনি কী সত্যি কিছু বুঝতে পারছেন না, না কী বুঝেও না বোঝার ভান করছেন।”

মিরান কিছু বলবে তার আগে পাশ থেকে অন্য আরেকটি মেয়ে এসে বলল,

—-” মিরান ভাইয়া আপনি এখানে আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি।”

প্রথম মেয়েটি ঠোঁটে হাসি এনে বলল,

—-” ভাইয়া আপনিতো তোহা আপুর ভালোবাসা। কাল তো আপনাদের পারিবারিকভাবে বিয়ে টা সম্পূর্ণ হয়েছে।”

দ্বিতীয় মেয়েটি মৃদু স্বরে বলল,

—-” কিছুক্ষণ আগে তো আপনার আর তোহা আপুর ছবি দিয়ে তোহার আপুর ফ্যান পেইজে একটা পোস্ট করেছে আপনাদের বিয়ে নিয়ে।”

মিরান ওদের উত্তরে কিছু না বলে পকেট থেকে ফোন বের করে তাড়াতাড়ি করে ফেসবুকে ঢুকে। মুহূর্তেই বড় বড় হয়ে যায় মিরানের। কংগ্রাচুলেশন জানাতে কেউ বাদ রাখেনি। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা ছবি তোহা মিরান কে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে আছে। ছবিটা দেখে মিরান হা হয়ে যায়। এই ছবিটা তো ময়মনসিংহ বাড়িতে বসে তোলা। আর ছবিটার উপরে বেশ বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘পরিবারের সবার উপস্থিতিতে বিয়ে টা হয়েছে আমাদের। আলাদা করে কাউকে জানানো হয়নি। খুব কাছের মানুষ ছাড়া কেউ উপস্থিত ছিল না বিয়েতে। দোয়া করবেন আমাদের জন্য। আমি যেন আমার ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গে সারাজীবন কাটাতে পারি।’ মিরান ওর বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে ফোন ঘাটাঘাটি করছিলো তখন কোথা থেকে তোহা দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে। ওই সময় ওদের গোপনে কে এই ছবিটি তুলেছেন? কিছুক্ষন চুপ করে ভাবে মিরান। কী উত্তর দিবে তাদের? মিরান ঠোঁটে হাসি এনে বলল,

—-” এবার বুঝতে পারলাম আপনাদের কথা।”

এরমধ্যে তোহা এসে মিরানের পিছনে দাঁড়িয়ে বলল,

—-” এখানে কী করছো তুমি?”

মিরান পিছন ফিরে তাকায়। মিরান তোহা কে দেখে মাতাল চোখে তাকিয়ে থাকে। কালো রঙের থ্রি পিস পড়া তোহা। মিরানের চোখে অসম্ভব রকম সুন্দর লাগছে তোহা কে। চোখ সরানো দায় হয়ে পড়েছে মিরানের জন্য। মিরান নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

—-” এইতো ওনাদের সাথে একটু কথা বলছিলাম। তুমি তো একদম রেডি হয়ে এসেছো। চলো এবার বেরোনো যাক।”

প্রথম মেয়েটা তোহার দিকে তাকিয়ে বলল,

—-” আপু একটা কথা জিজ্ঞেস করি আপনাকে যদি কিছু মনে না করেন?”

তোহা ধীর গলায় বলল,

—-” হুম করুন আপনি কি জিজ্ঞেস করবেন!”

মেয়েটা মৃদু স্বরে বলল,

—-” আপু আমি আপনার একজন ফ্যান বা ভক্ত বলতে পারেন, আমি আপনার প্রতিটা গান হাজার বার করে শুনি। আমি আপনার প্রতিটা বিষয়ে ফলো করি। আপনার লাইফ স্টাইল থেকে শুরু করে আমি সবকিছু ফলো করি। আজ সকালবেলা আপনার আর মিরান ভাইয়ার বিয়ের খবর জানতে পারি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে। কিন্তু আমার একটা বিষয় নিয়ে খুব কৌতুহল হচ্ছে। কারণ যেহেতু কাল মাঝরাতে আপনাদের বিয়ে হয়েছে তাই আজ এই সময় আপনারা শপিংমলে?”

তোহা মৃদু হেসে বলল,

—-” তেমন কিছু না আসলে তোমাদের ভাইয়ার ইচ্ছে ছিল আমাদের বিয়েটা ঘরোয়াভাবে হবে। আজ তোমাদের ভাইয়া আমাকে নিয়ে এই শহরের অলিগলিতে ঘুরবে আর আমার কিছু কেনাকাটাও ছিল তাই ভাবলাম ঘুরতে যাওয়ার আগেই সেগুলো কিনে নেই।”

দ্বিতীয় মেয়েটার গালে হাত দিয়ে বলল,

—-” আমাদের ভাইয়া তো দেখছি খুব রোমান্টিক। বিয়ের পরের দিনই বউকে নিয়ে একেবারে লংড্রাইভে!”

ওখানে দাঁড়িয়ে মিরান আর তোহা মেয়ে দুটোর সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা চলে যায় রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট করতে।

______________________________

মিরা সকালে মিরানকে ফোন করে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে বিয়েটা ওর ইচ্ছা অনুযায়ী হয়েছে। কিন্তু বধূবরণ থেকে শুরু করে অন্যসব রিচুয়াল্স মিরা তার ইচ্ছা অনুযায়ী করবে। এতে মিরানের কোন আপত্তি তিনি শুনবেন না। নিয়ম অনুযায়ী আজ সন্ধ্যায় তোহা শশুর বাড়ি যাবে। তাই মিরা কড়া নির্দেশ দিয়েছে সন্ধ্যার আগে মিরান বা তোহা কেউ যেন চৌধুরী বাড়িতে না যায়। তাই মিরান সিদ্ধান্ত নিয়েছে সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত ওরা দুইজনে ঘুরাঘুরি করবে। গতকাল রাতে মিরান তোহা কে নিয়ে কাজী অফিসে পৌঁছানোর আগেই মিরান ওর বাবা-মা এবং তোহার বাবা-মা কে কাজী অফিসে আসতে বলে। কারন প্রতিটা বাবা-মার তার সন্তানের বিয়ে নিয়ে অনেক ইচ্ছে থাকে। এসব ভেবে মিরান তাদেরকে কাজী অফিসে আসতে বলে।

মিরা মিহানের হই হুল্লোড় শেষ নেই। আজ তাদের ছেলের বউ বাড়িতে আসছে বলে কথা। হই হুল্লোড় তো হবেই। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বাড়িটা খুব সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলছে মিহান। অনন্যা আর টিয়া গেছে শপিংমলে ‌তোহা আর মিরানের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করতে। মিরা আজ নিজের হাতে সবার জন্য রান্না করছে। শান্ত আর মিরানের অন্যান্য বন্ধুদের উপর দায়িত্ব পড়েছে মিরান আর তোহার বাসর ঘর সাজানো। সবদিকেই জমজমাট পরিবেশ। আর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মিরান তার নতুন বউকে নিয়ে চৌধুরী বাড়িতে আসবে।

______________________________

সারাদিন ঘোরাফেরা করে সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে মিরান তোহাকে নিয়ে পার্লারে আসে। তোহার লেহেঙ্গা মিরানের পাজামা-পাঞ্জাবি মিরান সকালবেলার শপিং মল থেকে কিনে নিয়েছিল। মিরান তোহা কে পার্লারে ঢুকিয়ে দিয়ে, মিরান জেমস পার্লারে চলে যায় রেডি হতে।

ঘটা করে বধু বরণ করে মিরা ছেলে আর ছেলের বউ বাড়িতে এলে। মিরা একে একে সব রিচুয়াল্স পালন করে। সব রিচুয়াল্স ঠিকঠাক করতে করতে রাত দশটার বেশি বেজে যায়। অনন্যা আর টিয়া গিয়ে তোহা কে মিরানের রুমে বসিয়ে দিয়ে আসে। আর মিরান কে ওর বন্ধুরা সাথে আটকে রেখেছে। শান্ত মিরানের সঙ্গে কথা বলছে না। ওকে না জানিয়ে বিয়ে করার জন্য। মিরান অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্তর অভিমান ভেঙেছে। কিন্তু শান্ত শর্ত দিয়েছে কালকে ওর সঙ্গে জান্নাতের বাড়িতে যেতে হবে। এ বিষয়ে হ্যাঁ না কোন কথাই শুনবে না শান্ত। শান্তর কথা রাখতে মিরান রাজি হয়ে যায়। রাত বারোটার দিকে মিরানের বন্ধুরা মিলে মিরান কে ওর রুমের কাছে নিয়ে আসে। রুমের সামনে ছোটরা দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। মিরান ওদের সবার দাবি মেনে রুমে ঢুকে। তোহা ঘোমটা দিয়ে বসে আছে, মিরানের আসার শব্দ পেয়ে তোহা ঘোমটা দেওয়া অবস্থায় বিছানা থেকে নেমে আসে। তোহা যেই না মিরান কে সালাম করবে অমনি আচমকা মিরান তোহা কে কোলে তুলে নেয়। তোহা ভয় পেয়ে মিরানের গলা জড়িয়ে ধরে। মিরান তোহা কে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আলমারী খুলে একটা বক্স নিয়ে আবার বিছানায় আছে। বক্স থেকে একে একে মিরানের কেনা গয়নাগুলো পরিয়ে দেয় তোহা কে। তোহা নিঃশব্দে দেখে যাচ্ছে মিরান কর্মকাণ্ড। তোহা খুব ধীর গলায় বলল,

—-” এগুলো কখন কিনেছ তুমি?”

মিরান মৃদু হেসে বলল,

—-” আজ সকালবেলা।”

এইটুকু বলে মিরান তোহার উপর উঠে ওর বুকে মাথা রাখে। তোহা মিরানের পিঠে হাত দিয়ে বলল,

—-” কি হয়েছে তোমার?”

মিরান বুকে মাথা রাখা অবস্থায় মাথা দুলিয়ে বলল,

—-” উঁহু কিছু না।”

তোহা আর কিছু না বলে অন্য হাত দিয়ে মিরানের চুলে হাত বুলাতে শুরু করে। মিরান মাথাটা সামান্য একটু তুলে বলল,

—-” একটা কথার উত্তর দেবে আমায়?”

তোহা চোখ গুলো ছোট ছোট করে বলল,

—-” কী কথা?”

মিরান ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

—-” তুমি সোশ্যাল মিডিয়ায় তোমার আর আমার যে ছবিটা আপলোড করেছো, সেই ছবিটা কে তুলেছে?”

তোহা ঠোঁটে হাসি এনে বলল,

—-” জানবো না কেন অবশ্যই জানবো, আমার কাছে তোমার আর আমার একসঙ্গে কোন ছবি ছিল না তাই আমি মিরু কে বলি আমি তোমাকে আচমকা জড়িয়ে ধরলে সেই সুযোগ বুঝে মিরু যেন কয়েকটা ছবি তুলে নেয়। ঐদিন তুমি বেলকুনিতে উদাসীন ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলে আমি গিয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরলাম আর অন্যদিকে মিরু কয়েকটা ছবি তুলে নিয়েছিল।”

এইটুকু বলে তোহা শব্দ করে হাসতে শুরু করে। মিরান চোখ বড় বড় করে তাকায়। কী সাংঘাতিক মেয়ে রে বাবা! মিরানের এমন চোখ বড় বড় অবস্থা দেখে তোহা মিরানের নাক টিপে দিয়ে বলল,

—-” কিগো এমন করে তাকিয়ে আছ কেন?”

মিরান নিজেকে সামলে নিয়ে তোহার কপালে চুমু দিয়ে বলল,

—-” তেমন কিছু না তোমার বিয়ের আগের দুষ্টুমিগুলো কথা ভাবছিলাম।”

তোহা মিরানের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,

—-” আর কিছু ভাবতে হবে না তোমাকে। এবার ঘুমাও আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। কালকে রাতে এমনকি আজকের সারাদিনের দুচোখের পাতা এক করোনি তুমি।”

মিরান বাচ্চাদের মত করে বলল,

—-” কই কালকে তো তোমার সঙ্গে গাড়িতে ঘুমিয়েছি।”

তোহা ধমকের সুরে বলল,

—-“কী ঘুমিয়েছো আমার জানা আছে। চোখ দুটো একদম জবা ফুলের মত হয়ে আছে। নাও চোখ বন্ধ করে আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি!”

তোহার ধমক শুনে মিরান চোখ বন্ধ করে নেয়। সত্যি মিরানের চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করছিল না ঘুমানোর ফলে। চোখ দুটো বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম নেমে আসে মিরান চোখে। তোহা যত্নসহকারে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তোহা মিরান কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুলে আলতো করে চুমু দিয়ে বিড় বিড় করে বলল,

—-” ভালোবাসি।”

______________________________

মিরান ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকায়। তোহা ওর বুকের উপরে। তোহা আর মিরান দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। মিরান হালকা হেসে তোহার মুখের উপর পড়া চুল গুলো যত্নসহকারে ছড়িয়ে দিয়ে কপালে চুমু দেয়। তোহা একটু নড়ে ওঠে আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মিরান কে। এরমধ্যে মিরানের ফোন বাজতে শুরু করে। মিরান হাতটা লম্বা করে ফোনটা হাতে নেয়। হসপিটাল থেকে ফোন করেছে। ফোন রিসিভ করে মিরান। হসপিটালে যেতে হবে ওকে দশটার আগে। মিরান ফোন রেখে তোহার গালে স্লাইড করতে করতে মৃদু স্বরে বলল,

—-” পাখি উঠ সকাল হয়ে গেছে।”

তোহা মিরানের গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমধুম কন্ঠে বলল,

—-” হুম।”

মিরান তোহার কপালে আবার চুমু দিয়ে বলল,

—-” ওঠো পাখি আমাকে হসপিটালে যেতে হবে।”

তোহা চোখ খুলে মিরানের দিকে তাকায়। তোহা মন খারাপ করে বলল,

—-” আজকেও হসপিটালে যেতে হবে।”

মিরান ধীর গলায় বলল,

—-” হুম, এবার ওঠো, উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও। আর শোনো আমাদের রিসিপশন কিন্তু এখন হবে না। নানা ভাই আর নানু তো লন্ডনে আছে। তারা দুই সপ্তাহ পরে দেশে আসবে তখন আমাদের রিসিপশন হবে।”

তোহা মৃদু স্বরে বলল,

—-” ঠিক আছে।”

মিরান হাসি মুখে বলল,

—-” শোনো তুমি রেডি হয়ে থেকো। আজ আমাদের এক জায়গায় নিমন্ত্রণ আছে। আমার হসপিটালে থেকে আসতে একটু দেরি হবে তারপর তুমি আর আমি একসঙ্গে যাবো। কেমন!”

তোহা মৃদু হেসে বলল,

—-” আচ্ছা ঠিক আছে এবার তুমি ফ্রেশ হয়ে নেও।”

মিরান আবারো তোহা কে আলতো করে চুমু দিয়ে দিয়ে উঠে চলে যায়। আর তোহা মিরানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দেয়।

______________________________

জান্নাত আর জান্নাতের বান্ধবী কলি মিলে ঘরদোর সাজাচ্ছে। মিলা আর অন্যান্য বান্ধবীরা জান্নাতের মাকে রান্নার কাজে সাহায্য করছে। আজ শান্ত আর শান্তর বেস্ট ফ্রেন্ড এর পরিবার আসছে ওদের বাড়িতে। কে কোন খাবার খেতে ভালোবাসেন তা না জানায় জান্নাতের মা একটার পরে একটা রান্না করেই যাচ্ছে। জান্নাতের বান্ধবীরদের তো আর তর সইছেনা কখন তারা তাদের শান্ত ভাইয়া কে দেখবে সামনাসামনি। জান্নাত কে তো কিছুক্ষণ পর পর ওর বান্ধবীরা খোঁচা দিয়ে বলছে, ‘আজ জান্নাতের সুপার হিরো আসবে। জান্নাত তাকে দুচোখ ভরে দেখবো।’ এমন কথা শুনে জান্নাত প্রতিবারের ন্যায় লজ্জায় নুয়ে পড়ে। দুপুর সাড়ে বারোটা বাজার পরে জান্নাতের মা একে একে সবাইকে তাড়া দিয়ে গোসলে পাঠায়। জান্নাতের মায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী একে একে সবাই তৈরি হতে শুরু করে। এরমধ্যে জান্নাতের বাবা থানা থেকে বাড়িতে এসে জান্নাতের মাকে জানিয়ে দিয়েছে শান্তরা ইতিমধ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছে। জান্নাতের বাবা বাড়িতে আসলে বেশ খানিকক্ষণ পরে শান্তরা এসে পৌঁছায় জান্নাতদের বাড়িতে। শান্তরা বাড়িতে এসেছে পর থেকে জান্নাত আর রান্না ঘর থেকে বের হয়নি। অজানা এক উত্তেজনায় ঘিরে ধরেছে ওকে। এরমধ্যে মিরা আর শান্তর মা জান্নাতের খোঁজ নিতে শুরু করেছে। জান্নাতের মা বসার ঘরে বসে মিলাকে বলে জান্নাত কে ওখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মিলা রান্নাঘরে এসে জান্নাত কে দুষ্টুমি সুরে বলল,

—-” চলেন মহারানী আপনার ডাক পড়েছে বসার ঘরে।”

জান্নাত লাজুক স্বরে বলল,

—-” এই তোরা কি শুরু করেছিস বলতো?”

মিলা মৃদু হেসে বলল,

—-” তবে যাই বলিস না কেন দোস্ত, তোর হিরোকে দেখতে কিন্তু কোন মুভির হিরোর চেয়ে কম নয়।”

জান্নাত লজ্জা পেয়ে বলল,

—-” তুই যাবি এখান থেকে।”

মিলা জান্নাত কে আর না জ্বালিয়ে ওকে সাথে নিয়ে বসার ঘরে যায়। শান্তর মা সবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে জান্নাত কে তার বাড়ির ছেলের বউ করে নিয়ে যেতে চায় বলে প্রস্তাব রাখেন তিনি। এ বিষয়ে আগে থেকে শান্ত বাদে সবাই জানতো। তাই তাদের মুখে কোনো বিস্ময়তার ছাপ নেই। শান্ত চোখ বড় বড় করে তাকায় ওর মায়ের দিকে। এইমাত্র কী বলল ওর মা? ওকে ঠিক শুনেছেন নাকি ভুল শুনেছে? ভালো লাগার মানুষটার সঙ্গে বিয়ের কথা শুনে লজ্জায় নুয়ে পড়ে জান্নাত। মাথা তুলে আর কারো দিকে তাকায় না। ওনার কোন আঙ্গুলে একবার পেছাচ্ছে আর একবার খুলছে। অকারণে ঘামতে শুরু করেছে জান্নাত। এক কথায় দুই কথায় জান্নাতের বাবা শান্তর মায়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। যতই হোক শান্ত পাত্র হিসেবে খারাপ না। তার উপরে একজন পুলিশ অফিসার। এমন পাত্র তো আর সহজে হাত ছাড়া করা যায় না! ওদের কথার মাঝে কলিংবেল বেজে ওঠে। কলি উঠে যায় দরজা খোলার জন্য। কলি চিৎকার শুনে সবাই উৎসুক হয়ে দরজার দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ পর মিরান আর তোহা এসে বসার রুমে উপস্থিত হয়। জান্নাতের পরিবারের লোকজন চোখ বড় বড় করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। শান্ত ওদের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

—-” তোরা ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন এদিকে আয়।”

তোহা আর মিরান গিয়ে শান্তর পাশে বসে। শান্তর মা তোহা আর মিরানের সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দেয়। জান্নাতের বান্ধবীরা তো তোহা কে দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। বাড়ির বড়রা মিলে সামনের মাসে জান্নাত আর শান্তর বিয়ে ঠিক করে।

______________________________

রাতে ডিনার করে এসে অপেক্ষা করছে মিরান তোহার জন্য। কিছুক্ষণ পর তোহা রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল,

—-” এখনো জেগে আছো ঘুমাওনি?”

মিরান তোহার দিকে তাকিয়ে বলল,

—-” উঁহু ঘুম আসছেনা।”

তোহা দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল,

—-” কেন?”

মিরান এগিয়ে গিয়ে তোহাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,

—-” আমার পাখির জন্য।”

তোহা লাজুক স্বরে বলল,

—-” তাই!”

মিহান অস্পষ্ট স্বরে বলল,

—-” হুম।”

তোহা মিরানের সামনে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বলল,

—-” আচ্ছা শান্ত ভাইয়া কী জান্নাতের সঙ্গে হ্যাপি থাকবে?”

মিরান মৃদু স্বরে বলল,

—-” হ্যাঁ খুব হ্যাপি থাকবে। শান্ত সব সময় বলতো ও বিয়ের পর ওর বউকে ভালবাসবে। আমার মনে হয় ওরা দুজনেই খুব সুখী হবে।”

তোহা হাসিমুখে বলল,

—-” শান্ত ভাইয়ার বিয়ের পর ই তো মিরু-প্রতীক আর টিয়া-রাসেলের বিয়ে।”

মিরান মুখ গোমরা করে বলল,

—-” সবার কথা ভাবছো শুধু এই তোমার জানের কথাই ভাবছ না!”

তোহা মুখ টিপে হেসে বলল,

—-” কেন গো তোমার আবার কি হয়েছে?”

মিরান মুখ ভার করে বলল,

—-” রুমে এসেছো সেই কখন কিন্তু এখন পর্যন্ত একবারও কী তুমি তোমার জানকে আদর করেছো?”

তোহা আহ্লাদী কন্ঠে বলল,

—-” আহারে এইজন্য বুঝি আমার জানের খুব কষ্ট হচ্ছে?”

মিরান কিছু বলার আগেই তোহা মিরানের গালে শব্দ করে চুমু দিয়ে বলল,

—-” খুশি তো এবার?”

মিরান তোহা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

—-” ভালোবাসি পাখি, খুব বেশি ভালোবাসি।”

তোহা চোখ বন্ধ করে মিরানের হার্ট বিট গুনতে শুরু করে। মিরানের প্রতিটা হৃদ কম্পন যেন ওদের ভালোবাসার কথা বলছে।

সমাপ্ত —

[ অবশেষে শেষ হলো গল্পটা। গল্পটা থেকে আপনাদের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি তার জন্য আপনাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ। আশাকরি গল্পটা আপনাদের মন জয় করতে পেরেছে। জানিনা এই গল্পের শেষটা কেমন হয়েছে! কাটা হাত নিয়ে দুই দিন বসে শেষ পর্ব টা লিখেছি। গল্পটা আপনাদের কেমন লেগেছে জানাবেন প্লিজ। আর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সঙ্গে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাদের। কালকে থেকে জমিয়ে আড্ডা হবে গ্রুপে। 🍁 sarjin’s Stories 🍁 ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here