#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_১১
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
অনুষ্ঠানে সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলছে । ইফসি খেলা করছে মাহবুব সাহেব এর বাচ্চাদের সাথে । সে আজ অনেক খুশি । এমন মানুষজন পূর্ণ এলাকা তার খুব ভালো লাগে । তার উপর নিজের সমবয়সী পাওয়াতে খুব খুশি সে । ইফসির খিল খিল হাসিটাই সবার পছন্দ হয় । সবার মন কেড়ে নেয় ।
জুঁই একপাশে দাঁড়িয়ে আছে । সবার থেকে আলাদা হয়ে । মাঝে মাঝে দুজন স্টাফ রা আসে কথা বলে আবার অন্য পাশে যায় । নাফিস পুরো অনুষ্ঠান জুড়েই তার কাদম্বরীকে দেখে যাচ্ছে । আজ কেন যেন তার কাদম্বরীকে অন্যরকম সুন্দর লাগছিল । শাড়িটায় অনেক সুন্দর লাগছিল তাকে । এক সময়ের হাসিখুশী মানুষটা আজ চুপচাপ হয়ে গেছে । এটাই তার বুকে তীর হয়ে বিধছে ।
অনুষ্ঠানে সবাই নিজেদের মধ্যে নিজেরাই নাচ গান করছে । কেউ গান তো কেউ নাচ । নাফিস জানতো যে তার কাদম্বরী নাচ গান দুটোই পারে । জুঁইয়ের বেশিরভাগ সময় রবীন্দ্র সংগীত ভালো লাগতো । সে গাইতোও রবীন্দ্র সংগীত , আর নাচ টাও করতো সেই রকম । কিন্তু আজ তার সেই প্রাণচঞ্চলা নারীটি একেবারেই চুপ করে গেছে ।
কিছুক্ষণ পর মোহি এসে জুঁইয়ের পাশে দাঁড়ায় । তারপর তাকে উদ্দেশ্য করে বলে ,
– ম্যাম ,,,,,,,,?
– জ্বি ,
– ম্যাম আপনিও কিছু একটা করুন ,
– কি করবো ?
– গান অথবা নাচ ।
– নাহ ,
– কেন ম্যাম ?
– বাদ দিন , আপনারা যান এঞ্জয় করুন ।
– আপনি এইভাবে একা থাকবেন আমরা এঞ্জয় কিভাবে করি ম্যাম ।
– সমস্যা নেই , যান আমি আছি তো এখানেই ।
– ম্যাম , একটা কথা বলি ?
– অবশ্যই , বলুন না ।
– ম্যাম আপনাকে না আজকে অনেক সুন্দর লাগছে । শাড়িটায় অনেক দারুণ মানিয়েছে আপনাকে ম্যাম ।
– ধন্যবাদ , আপনাকেও অনেক সুন্দর লাগছে
– আমি ছেলে হলে আপনাকে তুলে নিতাম কিন্তু , এত শান্ত কিভাবে থাকেন ম্যাম । এত কিছু হওয়ার পরও কিভাবে নিজেকে এত স্ট্রং কিভাবে থাকেন ম্যাম ?
– আল্লাহ পাক এই ধৈর্য নামক জিনিসটা ভালো মতই দিয়েছে আমায় । আর কি করবো বলেন ।
– আমি দোয়া করি ম্যাম আপনি অনেক সুখী হবেন একদিন ।
– এখন আর সুখের চিন্তা করি না । আপনি যান এঞ্জয় করুন ।
– জ্বি আচ্ছা ।
মোহি গিয়ে আবারও সবার সাথে কথা বলায় মেতে ওঠে । আর জুঁই আবারও একা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এক পাশে । এখন আর এইসব ভালো লাগে না তার ।
প্রায় অনেক্ষন পর মাহবুব সাহেব সবার সামনে জুঁইকে ডেকে মিডেলে নিয়ে যায় ।
– জ্বি স্যার বলুন ,
– একটা গান গেয়ে শুনান ।
– স্যার আমি তো গান পারি না ,
– এইসব বললে হবে না । গান শুনাতেই হবে ,
– স্যার সত্যিই বলছি গান পারি না ।
– আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে না ।
তাদের কথার মাঝে মিসেস মাহবুবও অনেক রিকুয়েষ্ট করে জুঁইকে । যাই পারে না কেন একটা গান যাতে গায় । তখন জুঁই সবার অগোচরে নাফিসের দিকে তাকায় । আর নাফিসের দৃষ্টি তখন তার কাদম্বরীর দৃষ্টিতে । এ যেন এক তৃষ্ণা নিবারনের কৌশল তাদের । নাফিস বুঝে গেছে তার দিকে তাকানোর অর্থ কি ছিল । তার কাদম্বরী একমাত্র তার সামনেই গান গাইতো । এইবার সেটা একান্তেই হোক কিংবা সর্ব সম্মুখেই হোক নাফিসকে তার সামনে থাকতেই হতো । এটার ইংগিত দিচ্ছিলো তাকে তার কাদম্বরী । নাফিস লাষ্ট বার গান শুনেছিল তিন বছর আগে তাদের দূরত্বের প্রায় তিন মাস আগে । কলেজের একটা প্রোগ্রামে গেয়েছিল জুঁই । সেদিন নীল শাড়িতে , নীল চুড়িতে সেজেছিল নাফিসের কাদম্বরী । কাদম্বরীর নীলাভ আলোয় নিজেকে মিশিয়ে নিয়েছিল নাফিস সেদিন । সেই স্মৃতিগুলো যেন নিমিষেই চোখের সামনে ভেসে উঠে গেলো । হয়তো আজও সেই স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছে তার কাদম্বরী ।
তখন সবার সামনে দিয়ে একটু এগিয়ে যায় জুঁই । জুঁইয়ের সব থেকে প্রিয় গানটাই গাওয়া শুরু করে জুঁই ,
যেতে যেতে একলা পথে
নিভেছে মোর বাতি
ঝড় এসেছে, ওরে, এবার
ঝড়কে পেলেম সাথি
জুঁইয়ের কন্ঠে এই গান শুনে কলিজা কেঁপে ওঠে নাফিসের । গানটার মিনিং ছিল অনেক । যা পুরোটা শুধুই নাফিসকে ইংগিত করছে । আর অন্যদিকে জুঁই গেয়ে যাচ্ছে ,
আকাশ-কোণে সর্বনেশে
ক্ষণে ক্ষণে উঠছে হেসে
প্রলয় আমার কেশে বেশে
করছে মাতামাতি
নাফিসের দৃষ্টি তার কাদম্বরীর দিকে । আর তার কাদম্বরীর দৃষ্টি তার দৃষ্টিতে । এরা যেন বহু বছরের অতৃপ্ত বাসনার তৃষ্ণা নিবারনের চেষ্টায় মগ্ন । যেন এদের চারপাশে কেউ নেই । যেন এক বাগানে এরা কেবলই একলা । জুঁই যেন গাইছিল না নিজের কলিজাকে কেটে নাফিসের সামনে পরিবেশন করছিল । সেখানে উপস্থিত সবাই অবাক এবং মুগ্ধ ভাবে জুঁইয়ের গান শ্রবণ করছিল । নাফিসের তো ভাঙাচোড়া অবস্থা । এরই মাঝে জুঁইয়ের শেষ পারায় এসে সবার মন আরও নড়ে ওঠে ,
যে পথ দিয়ে যেতেছিলেম
ভুলিয়ে দিল তারে
আবার কোথা চলতে হবে
গভীর অন্ধকারে
বুঝি বা এই বজ্ররবে
নূতন পথের বার্তা কবে
কোন্ পুরীতে গিয়ে তবে
প্রভাত হবে রাতি
উফফফ , চোখে পানি আর ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি রেখে গানটা গাইতে গাইতে নিজের মেয়েকে কোলে তুলে নেয় জুঁই । মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মেয়ের ঘাড়ের কোণায় নিজের চোখের পানি লুকায় জুঁই । বাচ্চাটা কিছুই বুঝে নাই । শুধু কানে শুনেছে তার মা গাইছে । উপস্থিত সবাই স্তব্ধ হয়ে যায় জুঁইয়ের গান শুনে । মনে হচ্ছিল পরিবেশটা একদম থমথমে হয়ে গেছে । নাফিসের চোখ দিয়ে অনর্গল পানি ঝরে পড়ছিল । কারণ শেষ পারার পুরোটাই জুঁই নাফিসের চোখের দিকে পলকবিহীন ভাবে তাকিয়ে গেয়েছে । আর এখানেই নাফিসের মন মস্তিষ্ক আরও একবার মার খেয়ে গেছে জুঁইয়ের কাছে ।
সবাই এক সাথে হাত তালি দিয়ে উঠে । সবার নজর জুঁইয়ের দিকে । যেহেতু জুঁই বাকি স্টাফদের থেকে সিনিয়র তাই তারা শুধু হাত তালি দিয়েই তাদের মনের আকুলতা উপস্থাপন করে দিলো । জুঁই যেন গান গায় নি , ৪ মিনিটের জন্যে নিজেকে নিজ হাতে উপস্থাপন করে রেখে দিয়েছে সবার সামনে সে । যার পুরোটাই নাফিস বুঝে যায় । তখন একজন স্টাফ বলে উঠেন ,
– কি গাইলেন ম্যাম এটা ? এত সুন্দর কিভাবে হলো ।
– আমি ভালো গাই না ভাই ,
– কি বলছেন ম্যাম , অসাধারণ হয়েছে ।
হঠাৎ মাহবুব সাহেব এবং তার স্ত্রী জুঁইকে বলেন ,
– অসাধারণ গাইলেন কিন্তু ।
– ধন্যবাদ স্যার , ধন্যবাদ ম্যাম ।
এইসবের মাঝে সবার দিক থেকে একদম আলাদা হয়ে এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে নাফিসকে দেখে যাচ্ছে মোহি । নাফিসের চোখের পানি থেকে শুরু করে নাফিসের ঠোঁটের কোণে কষ্টের হাসি পর্যন্ত পুরোটাই দেখে মোহি । একদম এক নজরে তাকিয়ে থাকে সে নাফিসের দিকে । কোথাও একটা ক্লু খুঁজে চলছে এই মেয়েটা । মনে তার হাজারো প্রশ্ন , কিন্তু উত্তর জানার কোন রাস্তা নেই । কারণ নাফিস তার সিনিয়র । কি আছে নাফিস আর জুঁইয়ের মাঝে ।
– যতবার তারা এক হয়েছে ততবারই কিছু না কিছু আমার নজরেই পড়েছে । তাদের তাকানোর ভঙ্গি এমন কেন । তাদের মাঝে কিছু তো আছে ?
প্রশ্ন গুলো মোহি নিজের মনে সাজাতে পারলেও নাফিসের সামনে উপস্থাপন করতে পারে নি । করতে পারে নি বললে ভুল হবে , এতটা সাহস তার হবে না ।
– কিন্তু নাদিরা ম্যামের গানের সাথে নাফিস স্যারের চোখে পানি আসার কারণ কি ? উফফ সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে কেন ?
এইদিকে মোহি হিসেব মেলাতে ব্যস্ত অন্যদিকে নাফিস তার কাদম্বরীকে পাওয়ার নেশায় মরিয়া আর তার কাদম্বরী নাফিসের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আবার মিলনের পথে কাটা দেয়ায় ব্যস্ত ।
রাত প্রায় ১১ টার উপর হয়ে গেছে । এখানের কার্যক্রমও মোটামুটি শেষ । খাওয়া দাওয়ার পর্বও চুকে গেছে । এদিকে ইফসিও ঘুমিয়ে গেছে । ইফসিকে কোলে নিয়ে জুঁই দাঁড়িয়ে আছে সি এন জি এর জন্যে । শাড়ি পরে বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা একটু কঠিন হয়ে যাচ্ছে । এমন সময় নাফিস জুঁইয়ের পাশে এসে দাঁড়ায় ।
– ইফসিকে আমায় দেও ?
নাফিস কথাটা এমন ভাবে বললো যেন ইফসি তার সন্তান । আর জুঁই তার নিজের বউ । এমন ভাবে অধিকার ফলাচ্ছিল সে । তখন জুঁইও বলে দেয় ,
– লাগবে না আমি যেতে পারবো ।
নাফিসের এইবার অনেকটা রাগ উঠে যায় । প্রায় ধমকের সুরেই বলে ওঠে ,
– এমন করো কেন সব সময় ? আমি কি রাস্তার কুত্তা নাকি ? বার বার কাছে আসতে চাই দূরে ঠেলে দেও কেন ? অপরাধ না হয় করেছিলাম তাই বলে এত কিছু করবা ? ইফসিকে আমায় দাও , আর চুপচাপ বাইকে উঠো । তারপর আমি ইফসিকে তোমার কাছে দিবো ।
– আমি নিজে চলে যেতে পারবো ।
– এখানে আর একটা কথাও না । চুপচাপ বাইকে উঠো ।
রাত প্রায় ১১ টার উপর বেজে গেছে । তাই জুঁইও আর কথা বাড়ায় নি । নাফিসের বাইকে উঠে যায় । আর নাফিস ইফসিকে তার কোলে দিয়ে বাইক স্টার্ট করে দেয় ।
এইসব কিছুর আলামত দূর থেকে মোহির চোখেই পড়ে যায় । এইবার মোহির সন্দেহটা আরও গাঢ় হয়ে যায় ।
প্রায় ১১ টা ৩০ ,
নাফিস বাইক থামায় জুঁইয়ের বাসার সামনে । বাইক থেকে নেমে নাফিস ইফসিকে কোলে নিয়ে নেয় । আর জুঁই তখন ইফসির জুতা হাতে নিয়ে উপরে উঠে যায় । নাফিসও চুপচাপ ইফসিকে কোলে নিয়ে উপরে চলে যায় । দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিলো খুব সুখী একটা পরিবার । আসলে ভেতরে কি আছে তা শুধু তারাই জানে ।
ঘরে এসে জুঁইয়ের ইশারায়া নাফিস ইফসিকে জুঁইয়ের রুমে শুইয়ে দেয় । ইফসিকে শুইয়ে দিয়ে তার কপালে একটা চুমা দিয়ে নাফিস রুম থেকে বেরিয়ে যায় । বেরিয়ে যাওয়ার আগে রুমটা ভালো মত দেখে নেয় । রুমের এক পাশে খাট , তার পাশে একটা ওয়ারড্রব আর একটা ড্রেসিং টেবিল রাখা । সামনের রুমে এক সেট বেতের সোফা আর একটা সিংগেল খাট রাখা । এ ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই ঘরে । জুঁইয়ের এই কষ্টের চলাফেরা নাফিসের ভেতরটাকে ভেঙে চুড়ে একাকার করে দেয় । যাওয়ার সময় নাফিস একবার জুঁইয়ের দিকে তাকায় । জুঁই তখন এক পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল । নাফিসের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল কিছু বলতে তাকে । পরবর্তীতে বলেই দেয় ,
– কাদম্বরীকে মাথা নিচুতে মানায় না ।
নাফিসের কথায় মাথা তুলে তাকায় সে নাফিসের দিকে । পরে নিজেও বলে ,
– কাদম্বরী তো কবেই নিঃশ্বেষ হয়ে গেছে । এখন আর খুঁজে লাভ নেই তাকে । খুঁজলেও পাবে না তাকে , অতি সহজেই হারিয়েছো যাকে ।
জুঁইয়ের কথায় নাফিস আর কিছুই বলে নি । আস্তে করে বাসা থেকে বেরিয়ে চলে আসে সে । আর জুঁই দরজায় খিল দিয়ে সেখানেই বসে পড়ে । না চাইতেও চিৎকার করে কাঁদতে চাচ্ছে সে । হাটু গেড়ে বসে কেঁদে দেয় জুঁই ।
– নাফিস আমি আর পারছি না । আর পারছি না , আর কত সহ্য করতে হবে আমাকে । আর কত ?
.
.
চলবে……………………….