কথা দিয়েছিলে ফিরবে পর্ব ২০

#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_২০
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

– আম্মুন আম্মুন আম্মুন আম্মুন

ইফসি তার মাকে ডাকায় অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়ে । রেহানা পারভিন তাকে শান্ত করতে পারছেনই না । সে বার বার বোঝাচ্ছেন যে তার আম্মুন ভেতরে কিন্তু ইফসি ডেকেই যাচ্ছে । দাদুনের কোল থেকে নেমে গিয়ে সোজা রুমের দিকে যাচ্ছে ইফসি । এইদিক দিয়ে রেহানা পারভিন বলা শুরু করে দেয় ,

– সেই কখন পাঠাইছি রুমে । জিজ্ঞেস করতে নাফিস কি খাবে । ওয় গিয়ে আটকিয়ে গেছে । বাচ্চাটার বোধ হয় ঘুম পাইছে ।

পরক্ষণেই তার মাথায় আসে রুমে তো নাফিস আর জুঁই এক সাথেই আছে । কি যেন ভেবে দৌড়ে গিয়ে নাতনিকে কোলে তুলে নেন তিনি । তারপর ইফসি আরও জোরে ডাকা শুরু করে ।

– দাদুন রে , ডাকো কেন ?
– আম্মুন দাদুন আম্মুন ।
– আম্মুন রুমে পাপাও রুমে , এখন কি আর সহজে বের হবে তারা । তাগোরেও সময় দিতে হবে রে দাদুন । আয় তুই দাদুনের কাছে থাক ।

ইফসি লাগাতার আম্মুন আম্মুন করতে থাকে । ইফসির ডাক জুঁইয়ের কানে যেতেই সে নাফিসকে ইশারা দেয় উঠার জন্যে ।

– ইফসি ডাকছে কেন এভাবে ? দেখি সরো দেখে আসি আমি ।
– আরে দাঁড়াও ,

এই বলে আলতো করে জুঁইয়ের ঠোঁট জোড়া নিজের আঙুল দিয়ে মুছে দেয় নাফিস ।

– যাও সরো ,
– বেঁচে গেলে তুমি ।
– তোমার কাছে মরার জন্যে আমার অনেক সময় বাকি আছে , আসছি এখন ।
– হু ,
– চেঞ্জ করো , ফ্রেশ হও ।

জুঁই বের হয়ে এসে ইফসিকে কোলে তুলে নেয় । তখন রেহানা বেগম জিজ্ঞেস করে ,

– নাফিস কি খাবে বলছে কিছু ?

শ্বাশুড়ির কথা শুনে তার মনে পড়ে যায় । তাকে তো পাঠানো হয়েছিল অন্য কাজে । কিন্তু সেখানে গিয়ে হয়ে গেছে অন্য কাজ । শ্বাশুড়ির কথায় মাথা নিচু করে থাকে জুঁই । জুঁইয়ের চুপ থাকা দেখে রেহানা পারভিন কিছু আন্দাজ করতে পারে তাই তিনিও বলে দেন ,

– অন্যকিছু খেলে আর কি খাওয়া লাগে ? তুমি ওরে সামলাও , দেখো মনে হয় ঘুমাবে তাই ডাকাডাকি করেছে । আমি রান্নাঘরে চাই ।

শ্বাশুড়ির কথায় লজ্জা পেয়ে যায় জুঁই । মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে তার । অন্যদিকে একটা ভালো লাগাও কাজ করছে নিজের মনের মধ্যে । রেহানা পারভিনের ভালো ব্যবহার গুলো সত্যিই জুঁইয়ের মনকে পুলকিত করে দিয়েছে ।

ইফসিকে কোলে নিয়ে রুমে যায় জুঁই । নাফিস তখন ফ্রেশ হয়ে নিজের কাজ করছিল । ইফসিকে কোলে নিয়ে জুঁইকে দেখে নাফিস এগিয়ে যায় তাদের দিকে ।

– কি হয়েছে আমার মায়ের , এত কান্নাকাটি কেন ?
– ওর পায়ে হয়তো ব্যাথা করতেছে নাফিস । যার জন্যে বিরক্ত করতেছে ।
– এন্টিসেপটিক দিলাম তো , মা আসো তো পাপার কাছে ।
– এক কাজ করো , তুমি ও-কে রাখো । আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি একটু ।
– আরে নাহ , যেতে হবে না । মা তো আছে সামলে নিবে । তুমি ও-কে ঘুম পাড়িয়ে দেও ।

সময়টা ভালোই পার হচ্ছিলো । ইফসি তার নতুন দাদার বাড়িতে বেশ ভালো আছে । জুঁই তার নতুন সংসারে ভালোই মানিয়ে নিয়েছে । এর মাঝে একদিন রেহানা বেগম আনিস বেপারি আর শান্তা শাম্মির বাসায় বেড়াতে যায় । সেখানে ইফসিকেও নিয়ে যেতে চায় রেহানা বেগম । কিন্তু ইফসি ঝামেলা করে তাই জুঁই দিতে চায় নি ।

– মা , নিতে হবে না থাক ।
– কেন নিতে হবে না কেন ?
– মা ও তো জ্বালায় , ঝামেলা করে ইদানীং ।
– ও জ্বালাবে না তো কি তুমি জ্বালাবা নাকি ?
– মা , আসলে আপনার শরীরও তো ভালো না , ওইদিকে গিয়ে যদি বিরক্ত করে ?
– আমার দাদুন ভালো , তাই নারে দাদুন ?

দাদুনের কথায় আবার মাথা নেড়ে সমর্থন করে ইফসি । তখন সবাই হেসে দেয় । নাফিস কোলে নিয়ে বুকের মধ্যে চেপে ধরে ইফসিকে ।

– এই বুড়ি , ফুপুর বাসায় যাবা ?
– হু হু ,
– জুঁই রেডি করে দেও , থাক ঘুরে আসুক ।
– জ্বালাবে কিন্তু ।
– শান্তা আছে তো , আর তাছাড়া শাম্মিও থাকবে , জ্বালাবে না ।
– হু ,

সবার কথা শুনে রেডি করিয়ে দেয় জুঁই ইফসিকে । রেডি হয়ে টুক টুক করে দাদুনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ছোট্ট ইফসি । রেহানা পারভিন ইফসিকে দেখে এক নজরে তকিয়ে থাকে । লাল রঙের ফ্রকে কি যে সুন্দর লাগছিল ইফসিকে । লাল রঙের রিবন দিয়ে দুটো ঝুঁটি বেধে দিয়েছ তার মা । একদম পরীর মত লাগছিল ইফসিকে । রেহানা বেগম তাড়াতাড়ি করে জড়িয়ে ধরে হাজারটা চুমা দেয় ইফসিকে । দাদুনের চুমু খেয়ে খিল খিল করে হাসে বাচ্চাটা । রেহানা বেগম ও-কে রাখবেন কোথায় ।

– হ্যাঁ রে দাদুন তোকে আমি রাখবো কইরে দাদুন ।

আনিস বেপারিও খুব খুশি । আসলেই বাচ্চারা ফেরেশতার রুপ হয় । আর একজন ফেরেশতার কাছে শয়তানও হার মানতে ব্যস্ত । আর এরা তো মানুষ মাত্র । জুঁই ইফসির কিছু জামা গুছিয়ে দেয় । একদিন থাকবে আর সে তো মিনিটের মধ্যে জামা পালটায় ৩-৫ টা । নোংরা হলেই পাল্টানোর জন্যে কান্নাকাটি করে ।

শান্তার কোলে চেপে আম্মুন আর পাপাকে বাই বাই বলে সে ।

– বাইইইইই বাইইইইইইই
– আম্মুন বাই বাই বলে না মা । আল্লাহ হাফেজ দিতে হয় , আসসালামু আলাইকুম বলতে হয় ।

তখন নাফিস বলে ওঠে ,

– আরে থাক , এইগুলো ওর মুখে দিয়ে আসবে এখন ?
– না আসলেও অভ্যাস করতে হবে তো ?

তারপর সবার সাথে ইফসিও চলে যায় । জুঁই দৌড়ে বারান্দায় চলে যায় । বারান্দা থেকে মেয়েকে দেখবে বলে দাঁড়িয়ে আছে সে । আর মেয়েও নিচে গিয়ে ঠিক বারান্দার দিকে তাকায় । মাকে দেখে ফুপুর কোল থেকে টা টা দেয় তার মাকে ।

ওদের বিদায় দিয়ে নাফিস বাসায় আসে , এর ফাঁকে জুঁই হাতের কাজ গুলো সেড়ে নেয় । বাসা পুরো ফাঁকা । হাফ ডে বলে তাদেরও ছুটি । কাল শুক্রবার অফ ডে ।

নাফিস এসে ড্রইং রুমে বসে আছে । ম্যাগাজিন পড়ছিল সে । কিন্তু চোখ তার জুঁইয়ের দিকে । জুঁই তখন রান্না ঘরে কাজ করছে । আজ যদি মন একটু বেহায়া হয়ে যায় ক্ষতি কিসে ? বিয়ের প্রায় ২০ দিন হতে চললো , অথচ কেউই কারো কাছে ধরা দিচ্ছে না । নাহ জুঁই নিজে আসছে নাহ নাফিস যাচ্ছে । পর মুহুর্তেই নাফিসের গতকাল আওন্ধ্যার কথা মনে পড়ে যায় । জুঁই কাজের ফাঁকে ওড়না খুলে পাশে রাখে । নাফিসের নজর বার বার জুঁইয়ের দিকে যাচ্ছে । কিন্তু লজ্জায় যেতেও পারছে না ।

অন্যদিকে জুঁইয়ের মনটাও খচ খচ করছে । বাসায় কেউই নেই তারা দুজন বাদে । শাম্মি অনেকবার বলেছিল তাকে যেতে , সবার সাথে গেলেই পারতো সে । কিন্তু নাফিসের জন্যেই তার যাওয়া হয় নি । নাফিস একা হয়ে যাবে পুরো বাসায় তাই থেকে যায় সে । কিন্তু এখন যেন কেমন লাগছে তার নিজের কাছে । রান্নাঘর থেকে আড় চোখে নাফিসকে খেয়াল করে জুঁই । তখনই দেখতে পায় নাফিস তাকে পর্যবেক্ষণ করছে । নাফিসের পর্যবেক্ষণ তাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে বার বার ।

এশার নামাজের আজানের পর জুঁই ফ্রেশ হয়ে নেয় । নাফিস তখন অফিসের কাজ করছিল রুমে বসে । জুঁই নামাজ পড়ে উঠে দাঁড়াতেই নাফিস জুঁইকে ডাকে ।

– জুঁই,,,,,,,?
– হু বলো ,
– এই ফাইলটা চেক দেও তো ।
– দেও ।

লাইফ পার্টনারের পাশাপাশি তারা কলিগও বটে । অফিসের টুকটাক কাজ বাসাতে নিয়ে আসে । দুজন মিলে সময় বের করে কাজ গুলোও মিটিয়ে নেয় ।

ফাইল দেখার সময়ও নাফিস বার বার জুঁইকে দেখছিল । জুঁইয়ের ঠোঁট গুলো দেখছিল । জুঁইয়ের শরীরের পুরো পা থেকে মাথার চুল অবদি পর্যবেক্ষণ করছে নাফিস ।

রাতের খাবার শেষে নাফিস বারান্দায় সিগারেট টানতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে । জুঁই রুমে এসে নাফিসকে বারান্দায় দেখে ঘড়িতে নজর দেয় । ঘড়িতে ১১ টা বেজে ২৫ বাজতেছে । এই সময়ে নাফিস বারান্দায় এটা ভেবে নিজের কাছেও সংকা লাগছে তার । ওড়নাটা গায়ের থেকে সরিয়ে রেখে বিছানায় বসে জুঁই । নাফিস কি চাইছে ? নাফিসের মনে কি চলছে তা একটু একটু বুঝতে পারছে জুঁই ।

জুঁইয়েরও মন চায় নিজেকে নাফিসের কাছে সপে দিতে । কিন্তু লজ্জায় ঘেষতে পারে না । গতকাল সন্ধ্যায় যা হয়েছিল তা ভেবে মুচকি হাসি মুখে ফুটে উঠে জুঁইয়ের । বার বার নাফিসের দিকে তাকাচ্ছে জুঁই । আগের থেকে আরও সুন্দর হয়ে গেছে নাফিস । আগের থেকে শরীরটাও বেশ ভার দিয়েছে তার । স্বামী হিসেবে একদম পারফেক্ট একজন মানুষ সে ।

জুঁই আর থাকতে পারে নি । উঠে গিয়ে বারান্দায় নাফিসের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে । জুঁইয়ের অস্তিত্বের টের পেয়ে নাফিস মুচকি হাসি দিয়ে বলে ,

– আজ কাদম্বরী ঘুমায় না কেন ?
– তুমি সিগারেট খাওয়া কমাতে পারো না ?
– সিগারেট হচ্ছে নেশা । ভালো লাগে খেতে ।
– নেশ কি করে কাটানো যায় ?
– এই নেশা কাটানোর নয় । এই নেশা কাটানোর জন্য অন্য নেশা লাগে ।
– কি নেশা সেটা ?
– বলা যাবে না ।
– কেন ?
– ওহে মোর কাদম্বরী তুমি কেন বুঝো না
নিকোটিনে পাই আমি সুখেরও সাধনা
নিকোটিনের জায়গা যখন ঠোঁটের মাঝে
নারী তুমি তখন আমার থেকে অনেক দূরে

নাফিসের কথায় জুঁই আবারও বলে ।

– নারী যদি থাকে পাশে ,
– নারীর সংগ বড় সংগ
ভালোবাসায় বাধা
নারী যদি থাকে সাথে
নিকোটিন হবে সর্বনাশা

জুঁই তখন সেইখানেই এক টানে নাফিসকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করায় । নাফিসকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের ঠোঁট দিয়ে নাফিসের ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরে জুঁই । জুঁইয়ের ঠোঁটের স্পর্শে হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে পা দিয়ে মুচরে অফ করে দিয়ে জুঁইয়ের কোমড় জড়িয়ে ধরে ।

আজ যদি দুটো মন মিলে যায় তাহলে হয়তো কিছু পুরোনো মান অভিমান ভেঙে যাবে । আজ যদি সব কিছু এক পাশে রেখে দুটো শরীর নিজেদের ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে তাহলে হয়তো কিছু কষ্ট সুখে পরিণত হবে । হয়তো আজ প্রকৃতিও তাই চাচ্ছে । হয়তো আজ আকাশের পূর্নিমার চাঁদটাও তাই চাচ্ছে । বারান্দা থেকে রুমের দরজায় এসে জুঁইকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে নেয় নাফিস । এ যেন এক অতৃপ্ত বাসনার কামনা পূরণের পূর্ব প্রস্তুতি চলছে দুজনের মাঝে ।

.
.

চলবে………………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here