কথা দিয়েছিলে ফিরবে পর্ব ৪

#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_৪
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

জুঁইয়ের পৃথিবীতে এখন ইফসি ছাড়া কেউ নেই । জুঁইয়ের পুরো দুনিয়া একদিকে ইফসি একদিকে । যদিও ইফসি অযাচিত ভাবেই এসেছিল । মূলত ইফসির জন্যই জুঁইয়ের বেঁচে থাকা । নয়তো জুঁই আগেই শেষ হয়ে যেতো । জুঁইয়ের এখনও মনে পড়ে ইফসি যখন প্রথম তার গর্ভে আসে । মান্থ মিস হয়ে যাওয়ার পর প্রেগন্যান্সি স্টিক দিয়ে যেদিন পজিটিভ রেজাল্ট পায় যে সে মা হতে যাচ্ছে সেদিন সে প্রায় ১ ঘন্টার মত স্তব্ধ হয়ে যায় । অযাচিত ভাবে অনাগত ভবিষ্যত তখন তার গর্ভে জায়গা করে নিয়েছে । সে চায় নি এই সন্তান । যেখানে তার নিজের ঠিক ঠিকানা ছিল না । সে তার স্বামীর কাছ থেকে শুধুই দৈহিক কষ্ট পেয়ে গেছে মনের শান্তি পায় নি কখনো ।

তারপর একে একে ৮ টা মাস পার করে জুঁই । ফারুক শুধু রাতে তার শারীরিক চাহিদা মেটাতেই ব্যস্ত ছিল কখনো খবর নেয় নি তার স্ত্রী কেমন আছে ।

জিনিস গুলো এখন খুব করে ভাবায় জুঁইকে ।

– মানুষটা চলে গিয়েও কেমন যেনো লেগে আছে আঠার মত । জীবনটাকে নিয়ে শেষ জুয়াটা না খেললেও পারতাম । জুয়ার মজলিশে আজ আমি হেরে যাওয়া জুয়ারি মাত্র ।

কিছুক্ষণ পর চোখের পানি মুছে নিজেকে তৈরি করে নেয় জুঁই । শাড়িতে কুচি দিতে দিতে হঠাৎ ভাবনায় মত্ত্ব হয়ে যায় জুঁই ।

– তার সাথে মনের মিলনটা ছিল হয়তো ঠিকই । কিন্তু আবদ্ধকরণ টা ছিল অনেক বেশি । হয়ত এটাকে প্রেম বলা চলে ভালোবাসা নয় । ভালোবাসা হলে আজ পরিস্থিতি অন্যরকম হতো ।

অঝোর ধারায় চোখের পানি পড়ছে তার চোখ দিয়ে । ভালোবাসার নামে জুয়া খেলেছিল সে আর পরবর্তীতে বিয়ের নামে আরও একবার নিজেকে জুয়াতে নিয়োজিত করে দিয়ে শেষ জুয়াটা আমিও খেলে দিলাম ।

রাস্তা দিয়ে উদাস মনে হেটে যাওয়া জুঁইয়ের খবরও নেই যে রিক্সাওয়ালা তাকে সাইড হতে বলছে তাকে ।

– আরে ওই আফা হরেন না ,
– দেখি নাই ভাই , যান আপনি ।
– রাস্তা দিয়া হাডেন কেমনে , নিজের লগে বাচ্চাডারেও মারবো মনে অয় ।

রিক্সাওয়ালার কথাও তার কান অবদি পৌঁছায় না । এতটাই উদাস সে যে তার সাথে তার দেড় বছর এর মেয়ে ইফসিও আছে তার খেয়াল নেই । জুঁই রাস্তার মাঝ বরাবর এসে হাতের ইশারা দিয়ে রাস্তা পার হয়ে ফ্লাইওভার দিয়ে ওপাশে চলে আসে । মাঝে মাঝে ইফসিকেও হাটায় সে । সবাই হয়তো ভাববে দেড় বছর এর মেয়েটাকে হাটাচ্ছে ,এ কেমন মা , আর সে ক্ষেত্রে জুঁইয়ের জবাব হয় , ” আমার মেয়ে আমার মতই সাধারণ মানুষ হিসেবে বড় হয়ে উঠবে , কারণ কে বলতে পারে যে বড় হয়ে সে তার মায়ের মত কষ্ট নিয়ে হাটবে না ”

কিছু দূর এসে ইফসি হাত পা ছুড়ছে , তার হয়ত পা ব্যাথা করছে । মায়ের দিকে দু’হাত পেতে ইশারায় বলছে ,

– আম্মুন কোলে কোলে ,

মেয়ের কথায় জুঁই কোলে তুলে নেয় ইফসিকে । মায়ের কথায় দুই ঝুটি দুলিয়ে মিষ্টি হাসি দেয় ইফসি । যে হাসিতে জুঁই তার শত কষ্ট নিমিষেই ভুলে যায় ।

– আম্মুনকে একটা পাপ্পা দিবা না মা ?
– উম্মাহ উম্মাহ , আম্মুন উম্মাহ উম্মাহ উম্মাহ

রাস্তাতেই অনেক গুলো চুমু দিয়ে দেয় তার মাকে । মা মেয়ের সম্পর্ক দেখে হয়তো আশপাশের সবকিছুও হিংসা করে । জুঁই ইফসির সাথে কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ।

হঠাৎ করেই একটা বাইক পেছন থেকে এসে জুঁই আর তার বাচ্চাকে ধাক্কা মারতে মারতে ব্রেক টেনে ধরে । বাইকে বসা পুরুষ যখন বাইক থেকে নেমে হেলমেট খুলে জুঁইয়ের সামনে দাঁড়ায় ওই মুহুর্তে জুঁইয়ের মাথা নষ্ট হয়ে যায় । পায়ের নিচ থেকে মাটি গুলো সরে যাচ্ছে এমন অবস্থা । ইফসিকে কোলে রাখা অবস্থাতেও জুঁইয়ের হাত নড়ে চড়ে ওঠে ।

এ কাকে দেখছে সে । সেই চোখ , সেই নাক , সেই চাহনি , সেই মাধুর্যতা , সেই শ্যাম বর্ণের জাদুকর আজও প্রায় একই রকম আছে । কেন যেন জুঁইয়ের ঠোঁট জোড়া কেঁপে ওঠে । কেন যেন কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় সে । ইফসিকে শক্ত করে ধরে রেখে চোখের কোণ থেকে বেয়ে পড়া পানি গুলো শাড়ির আঁচলে মুছে নেয় জুঁই । লম্বাটে শ্যাম বর্ণের পুরুষটি ধীর পায়ে অসার শরীর নিয়ে জুঁইয়ের দিকে এগিয়ে যায় ।

ইফসি তার মাকে কাঁদতে দেখে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে । মায়ের চোখের পানি দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে বাচ্চাটাও ।
পুরুষটি এগিয়ে এসে অবাক এবং শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে ,

– কেমন আছো জুঁই ??

সেই চেনা কন্ঠস্বর আজ প্রায় তিন বছর আবারও জুঁইয়ের কানে এসে লাগে । নিয়তির নিষ্ঠুর খেলায় বলি হতে হয় কেন জুঁইদের । চেনা শহরে কিছু পুরাতন ধুলো বালি পড়ে জমে থাকা কিছু স্মৃতি কেন এত দিন পর তার সামনেই এসে পড়ে । মেয়েকে আরও আঁকড়ে ধরে দুই পা কে নিজ আয়ত্ত্বে এনে অত্যন্ত শান্ত গলায় জবাব দেয় জুঁই ,

– মরার মত মরে নেই , আবার বাঁচার মত বেঁচেও নেই ।

তারপর হঠাৎ জুঁইয়ের মন অজান্তেই বলে ওঠে ,

– কথা তো দিয়েছিলে ফিরবে

তারপর বিষন্নতার মাঝে একটুকরো মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে রাস্তার বুকে

.

.

চলবে……………………

[। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here