#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_৫
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
অফিসের কেবিনে বসে ভাবছে অনেক কিছুই । পাশের সিটে ছোট্ট ইফসি বসে আছে চুপ করে । ইফসি বড্ড বেশি শান্ত । একদম যেন দ্বিতীয় জুঁই । ইফসি ক্ষুধা লাগলেও কাঁদবে না । আর সে জোরে ব্যাথা না পাওয়া ছাড়া কাঁদে না , আর এমনি পেলেও কাঁদবে না । আসলে আল্লাহ পাক হয়তো ইফসিকে শক্ত মাটি দিয়েই বানিয়েছে । ফাইল খুলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে জুঁই । যেইভাবে বসিয়ে রেখেছে ঠিক সেইভাবেই আছে ইফসি । ছোট ছোট দুইটা পুতুল দিয়ে খেলছে সে । মাকে একদম জ্বালাচ্ছে না বুড়িটা । হঠাৎ করে জুঁইয়ের মন চাইলো মেয়ের সাথে কথা বলতে ,
– আম্মুন তুমি করতেছো ?
মায়ের কথায় ঝুটি দুটো নাড়িয়ে মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকায় সে । একটু হাসি দেয় আর পুতুল দেখিয়ে বলে
– আমি তেলি (খেলি)
মেয়ের কথায় মুচকি হেসে দেয় জুঁই আর কাজে আবারও মন বসায় সে । ফাইল গুলো অনেক নিখুঁত ভাবেই পর্যবেক্ষণ করে জুঁই । অন্যদিকে ইফসি চেয়ার থেকে নেমে পুরো কেবিন হাটছে । ঠিক এইভাবেই জুঁইয়ের সকাল থেকে দুপুর আর দুপুর থেকে সন্ধ্যা হয়ে যায় । তারপর আবার ঘরের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হয় ।
রাতে মেয়েকে খাইয়ে শুইয়ে দেয় জুঁই । জানালার পাশে এসে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে সে । আল্লাহ পাকের এই সুন্দর পৃথিবীতে যদি দিন মুছে দেয়ার নিয়ম থাকতো তাহলে সে আজকের দিনটা অনায়াসে মুছে দিতে পারতো । কারণ আজকে এমন কাউকে দেখতে হলো তাকে আর এমন কারো কন্ঠস্বর শুনতে হলো তাকে যাকে সে তিন বছর আগেই মুছে দিতে বাধ্য হয়েছিল । অবহেলা পেতে পেতে শুকিয়ে যাওয়া গলাও তার চুপচাপ হয়ে যায় এক অন্ধকারের বদ্ধ ঘরে ।
চোখ থেকে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে জুঁইয়ের । যেই পুরুষটিকে মনে প্রাণে এত বেশিই ভালোবেসেছিল সে আজ সেই পুরুষটিই আবার তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে । তাও কিনা যখন তার সন্তান তার কোলে ছিল ।
হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায় সেইদিনের কথা যেদিন পার্কে প্রায় দেড় ঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিল জুঁই । আর সে এসেছিল পিছনে , চুপি চুপি এসে জুঁইয়ের চোখ চেপে ধরেছিল । আর জুঁইও তখন খপ করে সেই এক জোড়া হাত ধরে নেয় আর বলে ওঠে ,
– নাফিস , এই আসার সময় হলো তোমার ?
– আমি তো জানি অপেক্ষায় রত আছে আমার কাদম্বরী ,
– কথা নাই তোমার সাথে আর ?
– রেগে থাকলে বেশ লাগে আমার কাদম্বরীকে ,
– সব সময় মজা ভালো লাগে না কিন্তু ,
– রাগলে তোমায় লাগে যে ভালো
কাদম্বরী আমার আমি তোমাতেই
মিশে আছি পাও কি খুজে আমার
অস্তিত্ব
– আমাকে কাব্য আর কিছু কবিতা দিয়েই দমাতে পারো তুমি ।
– আমার তোমায় দমাতে হয় না তুমি আমাতে এমনি দমে আছো ।
– তাই তো এমন করো ,
– ভালোবাসি তোমায় আমি
এমন তো করি নি
চেয়েছি রাঙাতে এই মন
সাথে চেয়েছি তোমারই আরাধন
– ভালো ভালো খুব ভালো ।
ধ্যান ভেঙে যায় জুঁইয়ের । জানালার পাশে বসে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয় জুঁই । তারপর উঠে দাঁড়িয়ে জানালার থাই গ্লাসটা টেনে দিয়ে ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা নিয়ে বেতের সোফায় বসে যায় জুঁই । মাঝের পাতায় কিছু লিখে নিচে দুটো লাইন লিখে দেয় সে ,
হারিয়ে গিয়েও আবার এলে কাছে
কাছেই যদি এলে তবে হারিয়ে কেন গেলে
ডায়রিটা বন্ধ করে ব্যাগে রেখে লাইট অফ করে বিছানায় এসে শরীর এলিয়ে দেয় জুঁই । তারপর আস্তে করে চোখ বন্ধ করে নেয় সে । কারণ আগামীকাল আবারও তার যুদ্ধ করতে হবে ।
অন্ধকার ঘরে জ্বলন্ত সিগারেট হাতে খাটের সাথে হেলান দিয়ে আধো শোয়া অবস্থায় আছে একজন পুরুষ । তার চোখে বার বার ভেসে আসছে আজকে রাস্তায় দেখা এক নারীকে । যার চাহনিতে আগে থাকতো খুশির ঝলক আর এখন এক বিষন্নতার মেঘ জমা । পায় পাতলা শুকনো গঠনের নারীটি আজ অনেকটাই বদলে গেছে । নারীর কোলে ছোট বাচ্চা থেকে কেন যেন পুরুষের বুকের বাম পাশের জায়গাটায় চিন চিন করে ব্যাথা শুরু হয়েছিল ।
হয়তো আজকের এই পরিস্থিতি শুধুমাত্র তার জন্যেই । নারীর তো কোন অন্যায় ছিল না । নারী তো মন উজার করে শুধু ভালোবেসেছিল । আর সেই ভালোবাসায় ছিল না কোন ছলনা ছিল না কোন বাধ্যবাধকতা । খোট ছিল তার ভালোবাসার মাঝে । খোট ছিল তার ভরসার মাঝে । যার জন্যে নারীটি হারিয়ে গিয়েছিল তিনটি বছর আগে ।
একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছে পুরুষ । চোখের নোনাজল গুলো গড়িয়ে পড়ছে চোখ দিয়ে । হঠাৎ মুখ দিয়ে কিছু বেরিয়ে যায় তার ,
– শত বছরের সাথে থাকার ওয়াদা দিয়ে
হারিয়ে গিয়েছিলাম অতল গহ্বরে
আজ আবার তোমার সাথে দেখা
আমার কাদম্বরী
বুকের পাশে জমে থাকা চিন চিন
ব্যাথাটা আজ আবারও জ্বলে উঠেছে
আপনা আপনি
এই মুহুর্তে তার পাগল পাগল লাগছে । বার বার তাকেই মনে পড়ছে । কেন যেন মনে হচ্ছে আজ আর তার ঘুম হবে না ।
– গত তিনটি বছর এই যন্ত্রণাটা সহ্য করে বেশ ভালোই তো ছিলাম আমি কাদম্বরী
আজ আবার সামনে দাঁড়িয়ে লাভা জ্বালিয়ে দিয়েছ আমার মনের আঙিনাতে
ছোট বাচ্চা মেয়েটার মুখটাও বার বার চোখে ভাসছে তার । কেন যেন খুব মায়া হচ্ছিলো তার ।
– বাচ্চাটা হুবুহু জুঁইয়ের মত দেখতে হয়েছে । হয়তো তারই মেয়ে । কিন্তু আমার কাদম্বরীর পরনে সাদা শাড়ি কেন ছিল ?
প্রশ্নটা বার বার আহত করছে তাকে । ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে তার । পাগল করে দিচ্ছে । সিগারেট জ্বলেই যাচ্ছে একটার পর একটা । আজ হয়তো সিগারেটও নিস্তার পাচ্ছে না তার থেকে । এমন সময় একটা কথা তারও মনে পড়ে যায় । দিনটি ছিল ভালোবাসা দিবসের দিন । যাকে বলা হয় valentine day. সেদিন জুঁই লাল শাড়ি পরেছিল । খোঁপায় বেলীফুলের মালা লাগিয়েছিল । হাত ভর্তি চুড়ি দিয়েছিল । একদম লাল পরীর মত লাগছিল সেদিন তাকে , হাতে এক গুচ্ছ গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল ক্যাম্পাসে । তাকে দেখে এক গাল হেসে জুঁই সামনে দাঁড়িয়ে যায় । তারপর গোলাপ গুলো তার সামনে বাড়িয়ে দেয় আর বলে ,
– ভালোবাসি , এই পুরুষ শুনছো
ভালোবাসি আমি তোমায়
ভালোবাসি অন্তরের অন্ত স্থল থেকে
এই পুরুষ আমি তোমায় ভালোবাসি ,,
জুঁইয়ের কথায় এক গাল হেসে সেদিন সেও উত্তর দেয় ,
– ওগো মোর কাদম্বরী
লালে তোমায় লাগছে গো ভালো
আমি সেই লালের মাঝে হারিয়েছি
তুমি কি জানো ,
কাদম্বরী আমি তোমাকেই ভালোবাসি
সেদিন ক্যাম্পাসে সবার সামনে জড়িয়ে ধরেছিল জুঁই তাকে । আর সে পরম যত্নে আঁকড়ে ধরে নেয় জুঁইকে ।
হঠাৎ সিগারেটের জ্বলন্ত আগুন তার হাতের আঙুলকে ছুঁয়ে দেয়ায় ধ্যান ভাঙে তার । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করে নেয় সে ,
– আমি নাফিস শুধু ভালোবাসার নামে ছলনাই করে গেলাম । তুমি জুঁই আমায় এতটা ভালোবেসে আপন করে নিয়েছিলে আর আমি দায়িত্বের অযুহাতে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম তোমায় । আমার কাদম্বরী আমায় ছেড়ে গিয়েও আমার সাথেই মিশে আছে অবিরত । নাহ নাহ আমিই তো তাড়িয়ে দিয়েছিলাম তাকে আমার দুনিয়া থেকে ।
হয়তো আজ আর এই চোখের পানির মূল্য নেই । দুজনের পথ আজ দু দিকে বেকে গেছে । সময়টাও আজ অনেক দূরে অবস্থিত । শুধু রয়ে গেছে এক বুক হাহাকার আর এক চোখ নোনাজল ।
.
.
চলবে………………….