গল্প : কবি বর | পর্ব : ছয়
সন্ধ্যার পর ফার্ম হাউসের চারপাশে ঝিঁঝির ডাক শোনা যায়। দূরে আঁধারে উড়ে বেড়ানো একদল জোনাক দেখা যায়। কখনো কখনো এক পশলা শীতল হাওয়া এসে গা ছুঁয়ে যায়। কখনো আবার আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে যখন বিন্দুমাত্র সময়ের জন্য চারপাশ আলোকিত হয়ে যায়, তখন অজান্তেই বুকের ভেতরটা নড়েচড়ে উঠে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেইসব উপভোগ করছে হিমেল। আর আয়েশ করে সিগারেটের ধোঁয়া ফুকছে।
আকমল চাচা একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। হিমেলের হাতে সিগারেট দেখে তাঁর ভেতরটা পাপবোধে ফেটে যাচ্ছে। একসময় তিনি সিগারেটে অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁর ধারণা, তাঁকে দেখেই হিমেল সিগারেট খাওয়া শিখেছে। আর তাই তিনি যখনই হিমেলের হাতে সিগারেট দেখেন, তখনই ব্যথায় কাতর হয়ে যান। এর আগে কয়েকবার তিনি হিমেলকে বুঝাবেন বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি। তবে আজ যে করেই হোক, তিনি হিমেলকে বলবেন। আর তাই আকমল চাচা এক পা এক পা ফেলে হিমেলের সামনে উপস্থিত হলেন। হাত কচলাতে কচলাতে বললেন,
“আপনে বিড়ি খাইতাছেন চাচাজান? এইসব কিন্তুক ভালা না। আপনে এই অভ্যাস ছাইড়া দ্যান।”
হিমেল ঘার ঘুরিয়ে ফিরে তাকায়। কথা বলে না। চুপচাপ মুচকি হাসে। আকমল চাচা আবার বলেন,
“বিশ্বাস করেন চাচাজান, যেইদিন আপনের হাতে বিড়ি দেখছি হেইদিনই আমি তওবা করছি, আর জীবনে বিড়ি হাতে নিমু না। এর পর থেইকা আইজ পর্যন্ত বিড়িতে হাত দেইনাই। কিন্তুক আমি ছাড়লে কী অইব? আপনে তো ছাড়েন নাই।” বলে মাথা নিচু করেন তিনি।
“আপনাকে দেখে সিগারেট ধরিনি চাচা। আপনি শুধু শুধু নিজের দোষ দিচ্ছেন।” হিমেল আধখাওয়া সিগারেট হাত থেকে ফেলে পা দিয়ে পিষতে পিষতে বলল।
“যারে দেইখাই শিখেন, শিখছেন তো? এইসব বাজে জিনিস খাওয়া ধরছেন তো? ক্যান খান আপনে এইসব? বিড়ি খাইব আমার মতোন মাইনষে। যার কেউ নাই। কিছু নাই। না আছে আপন কোনো মানুষ। না আছে নিজের একটা বাড়ি। না আছে ঘর। না আছে কিছু। কিন্তুক আপনের তো সব আছে। বাপ আছে। বাপের কোটি কোটি ট্যাকা সব আপনের। গাড়ি আছে, বাড়ি আছে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবই আছে। তাইলে আপনের কীসের এত দুঃখ? আপনে এইসব খাইবেন ক্যান?”
“দুঃখ ভুলতেই মানুষ সিগারেট খায়?”
“হ।”
“আমার কিন্তু অনেক দুঃখ চাচা।”
“ও-কী কন! আপনের আবার দুঃখ কীসের? কী নাই আপনের কন তো?”
আকমল চাচার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে হাসল হিমেল। ধরা গলায় বলল,
“আমার মা নেই।”
মুহূর্তেই আকমল চাচার দৃষ্টি নিচু হয়ে গেল। তিনি ক্ষীণ আওয়াজে বললেন,
“মা? বহুদিন পরে মায়ের কথা মনে কইরা দিলেন। আপনেরে একটা ঘটনা কই চাচাজান?”
“বলেন।”
“ঘটনা কিন্তুক সইত্য। তখন আমার বয়েস পঁচিশ-ছাব্বিশ কিছু একটা হইব। আমি যেই মাইয়্যাডারে পছন্দ করতাম হের বিয়া যেদিন হইলো, সেইদিন রাইত আমি অনেক কাঁনলাম। যেই আমি কিনা কোনোদিন পান-সুপারি পর্যন্ত খাইনাই সেই আমিই সেইদিন বিড়ি খাইলাম। মায় আমারে কইল, কী রে বাপ? এমন করতাছোস ক্যান? কী হইছে তোর ক আমারে? আমি কিছু কইলাম না। মায়েরে ধাক্কা দিয়া ফালায়া দিলাম। মা চইলা গেল। আধা ঘন্টা পরে আবার আইল। তখনও আমি কানতাছি আর বিড়ি খাইতাছি। মায়ে এইবার আমার মাথায় হাত রাইখা কইল, তুই তো জানোস, তুই ছাড়া আমার আর কেউ নাই। তার পরেও এমন পাগলামি করতাছস ক্যান? কী হইছে খুইলা ক আমারে? ক না বাপ! তখন আমি কী করলাম জানেন?”
“কী করলেন?” হিমেল প্রশ্ন করল।
“সইরা যা এইখান থেইকা। বইলা ধাক্কা দিয়া ফালায়া ঘর থেইকা বাইরইয়া আইলাম। মায়ে পিছন থেইকা ডাকল। আমি হুনলাম না। এরপর দিন-রাইত পাগলের মতো ঘুরতাম। আর নেশা করতাম। প্রথম প্রথম সিগারেট। তারপর মদ, গাঞ্জা সব ধরছিলাম। ঘটনার এক মাস তেরো দিন পরে একদিন আমগো গেরামের একজন আমারে রেলস্টেশনে পইড়া থাকতে দেখল। হে-ই আমারে ডাইকা তুলল। তারপর কইল, কেমন পাষাণ রে তুই? তোর মায়ে এত কষ্ট কইরা মরল। মরনের সময় তোর নাম জপছে। বারবার কইছে, তোমরা সইরা যাও। আমার পোলা আইব। আইসা আমার মুখে পানি দিব। তারপরে আমি মরুম। এর আগে আমার মরণ নাই। কিন্তু তুই আইলি না। কবর দেওনের সময় তো আইতি পারতি! নিজের মায়ের মরা মুখ পর্যন্ত দেখলি না তুই! তোর মতো পাষাণ দুনিয়ায় আছে রে? তুই তো আস্তা একটা কুলাঙ্গার। রাইতেই আমি গেরামে গেলাম। ঘরে গিয়া ডাকলাম, মা, ওমা! আমি আইছি। তোর পোলা ফিরা আইছে গো মা! মাগো, দরজা খুইলা দে গো মা। অনেক খিদা লাগছে। বহুদিন তোর হাতে কিছু খাই না। আইজ তুই আমারে খাওয়াইয়া দিবি না মা? মা, মাগো! কিন্তুক মায়ে দরজা খুলল না। খুলব কেমনে, হেয় তো কবরে শুইয়া আছে। একবার কবরে গেলে কেউ কি আর ফিইরা আসে?”
আকমল চাচার চোখদু’টো টলটলে জলে ভরে গিয়েছিল। তিনি চোখ মুছে হিমেলের দিকে তাকালেন। ততক্ষণে হিমেলের চোখ উপচে জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। আকমল চাচা দ্রুত হিমেলের হাত ধরে ফেললেন।
“এইসব কথা কইয়্যা আপনেরে আমি কষ্ট দিছি। আপনে আমারে মাপ কইরা দ্যান চাচাজান। আমার ভুল হইয়্যা গ্যাছে। আর কোনোদিন এসব কথা কমু না।”
হিমেল চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল অনেক্ষণ। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফিরে তাকাল। নিস্তব্ধতায় আঁচড় কেটে নিচু আওয়াজে বলল,
“আপনি অপরাধী। ঘোর অপরাধী।”
“জানি চাচাজান। আমার মতো পাপী এই দুনিয়ায় একটাও নাই।”
তারপর দু’জনেই চুপ মেরে গেলেন। থমথমে আকাশটা গম্ভীর আওয়াজ তুলে গর্জন করতে লাগল। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকাতেই যখন এক মুহূর্তের জন্য চারপাশ আলোকিত হয়ে গেল, তখন দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছায়ামূর্তি দেখা গেল। আকমল চাচা অবাক হয়ে বললেন,
“কেডা আইতাছে? মাইয়্যা মানুষের মতো কেডা আইতাছে?”
হিমেল কৌতূহলী ভঙ্গিতে বলল,
“আদ্রিতা এখানে কেন আসছে?”
“আদ্রিতা? কেডা আদ্রিতা?”
“যে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, সে-ই।”
“হেয় এইখানে ক্যান আইব? আপনে তারে আইতে কইছিলেন?”
“না চাচা। আমি আসতে বলিনি।”
“তাইলে?”
চলবে