#কাছে_দূরে ♥️
#moumita_mehra
#পর্ব___২০♥️
হীর ভেজা চুলে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। গোলগোল চোখ পাকিয়ে নিজেকে দেখছে সে। তার মনে হচ্ছে তাকে দেখতে খুব অদ্ভুত লাগছে। তার মনে হওয়ার পেছনে কারনটা অবশ্য ছাদে ঘটে যাওয়া সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি। হঠাৎ দু’জনেরই যে কি হলো এখনও বুঝে উঠতে পারছেনা হীর। চোখ জোড়া সরু করে ফেললো হীর। মুখ বেঁকে নিজেকে এবার দেখতে লাগল। এভাবেও তাকে দেখতে বড় অদ্ভুত লাগছে। মনে মনে প্রশ্ন জাগছে, তার চোখ দুটো যদি এমন ছোট হতো বা রসগোল্লার মতো বড় হতো তাহলেও কি তাকে দেখতে অদ্ভুত লাগত? তার মুখটা যদি বাঁকা হতো? তাহলে তাকে দেখতে কেমন লাগতো?’
অদ্ভুত সব প্রশ্নদের ভীড় হচ্ছে মনে। পেটে আবারও ক্ষিদের টান পড়াতে মুচড়ে উঠল। চোখ মুখ স্বাভাবিক করে নিজেকে দেখলো আয়নায়। এবার সব ঠিক আছে। স্বাভাবিক আছে। খেতে যাওয়ার আগে মনে হলো ‘একটা মানুষ কয়দিন না খেয়ে বাঁচতে পারে?’ সে কি এই চেষ্টা টা করতে পারে? পরক্ষণেই বড়মার কথা মনে পড়ল। সে না খেয়ে প্রাকটিস করতে চাইলেও বড় মা তাকে এই কাজ কখনও করতে দিবেন না! আর কোনো বিশেষ ভাবনাতে নিজেকে জড়ালো না সে। নীচে চলে গেলো। ডাইনিং টেবিল ফাঁকা। এই সময় বড়মার এখানে থাকার কথা। হাতে থাকবে এক প্লেট খাবার আর মুখে থাকবে মেকি রাগের ছোপ। হীর তার মুখখানা দেখে মাথা নীচু করে এসে খেতে বসবে৷ চুপচাপ খাবে, মাঝে কোনো কথা হবে না। খাওয়া শেষ হতেই ঔষধের বক্স থেকে ঔষধ নিতে নিতে বড়মা গাল ফুলিয়ে বলবেন, ‘এই শরীরে বৃষ্টিতে কেন ভিজেছো?’ হীর জবাব দিতে পারবেনা। তার মনের মধ্যে অপরাধ বোধ কাজ করবে। চোখ পিটপিট করে বড়মার দিকে তাকিয়ে বাচ্চাসুলভ কন্ঠে বলবে, ‘আর ভিজবো না বড়মা! এই প্রমিজ করলাম।’ বড় মা বিশ্বাস করবে না হীরের প্রমিজে। তবুও হাসি মুখে মেনে নিবে।
হীর ভাবনার ঘোর কাটিয়ে টেবিলে এসে বসতেই প্লেট ভর্তি খাবার নিয়ে হাজির হলো রুবি। মুখে উত্তেজনার হাসি। রান্না ঘরে সে মহাব্যস্ত। তবুও হীরের খাবার নিজের হাতে নিয়ে আসতে খুব আনন্দে হয় তার। হীর বিরস মুখে প্রশ্ন করল,
—-‘ বড় মা কই?’
রুবি মুখে জবাব দিলো না। তার গাল ভর্তি পান। মাঝেমধ্যেই তাকে বড়দের মতো পান খেতে দেখা যায়। পান খেয়ে রুবি লাল দাঁতের হাসি দেয়। হীরের খুব ভালোই লাগে রুবির লাল দাঁতের হাসি। রুবি হাত উঁচিয়ে রান্নাঘরের দিকে ইশারা করল। হীর বুঝে নিলো বড় মা রান্না ঘরে। আজ রাতে বিয়ের শপিংয়ের জন্য বের হবে তারা। তাই রাতের খাবার এখনই রান্না করে রাখছেন নাজমা বেগম। হীর বসে রইল চুপচাপ। বড় মা না খাওয়ালে সে খাবে না। রুবি গ্লাসে পানি ঢেলে পানের দলা একপাশ থেকে অন্যপাশে নিয়ে বলল,
—-‘ খালাম্মায় অহনই আইবো আফা। আফনে একটু অপেক্ষা করেন।’
হীরের মুখে হাসি ফুটল। সে এবার মনের আনন্দ নিয়ে অপেক্ষা করতে পারবে। চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসল হীর। শপিংয়ের জন্য লম্বা একটা লিস্ট করা হয়েছে। সব গুলো আজই কমপ্লিট করতে হবে। সন্ধ্যার দিকে রওনা হবে সবাই। ওদিক থেকে নেহালদের পরিবারও আসবে। দুই পরিবার মিলে হবে শপিং। আপন মনে আবারও ভাবনাদের আনাগোনা হলো। কখন যে সামনে কেউ একজন এসে বসল তা টেরই পায়নি হীর। আচমকা মনে হলো সাবাব তার সামনে বসে আছে। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। চমকে উঠে নড়েচড়ে বসতে বসতে চারপাশে খেয়াল করল তারা দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই। সাবাব আঁড়চোখে দেখছে হীরকে। মনে মনে ভাবছে হীরকে কি করে সরি বলা যায়। হীরকে যতদূর জানে সে, ওরকম একটা ঘটনার পর হীর ভুলক্রমেও কথা বলবে না তার সাথে!
সাবাব হীরের এটেনশন পাওয়ার জন্য গলা খাঁকারি দিলো। হীর আঁড়চোখে তাকালেও সরাসরি দেখলো না সাবাবের দিকে। সাবাবের জন্য এটাও অনেক বড় কিছু। সাবাব ঢোক গিলে গলা ভেজালো। শান্ত কন্ঠে বলল,
—-‘ তুই কি আমার উপর রেগে আছিস?’
সাবাবের কন্ঠ পেতেই ঠোঁট কামড়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে নিলো হীর। সে মনে মনে প্রার্থনা করছিলো যেন সাবাব তার সাথে কথা না বলে! তার প্রার্থনা কবুল হয়নি। ভেবে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। মৃদুস্বরে বলল,
—-‘ ন,,না!’
—-‘ ছাদের ঘটনার জ..জন্য আম এক্সট্রিমলি সরি হীর!’
হীরের এবার চরম অস্বস্তি হচ্ছে! ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে কথা বলাটা মোটেও স্বস্তির নয়। সাবাবকে কি করে বোঝাবে?
—-‘ আ…আমার মনে নেই!’
—-‘ কি মনে নেই?’ (অবাক কন্ঠে)
—-‘ ক..কিছুই,, কিছুই মনে নেই!’
—-‘ মনে থাক বা না নাক। তবুও, আম সরি হীর! প্লিজ তুই ওগুলা মনে রেখে…’
—-‘ ইট’স ওকে ভাইয়া। তুমিও ভুলে যাওনা প..প্লিজ?’
“কি ভুলে যাবে? কি করেছিস দু’টিতে?” নাজমা বেগমের ব্যস্ত গলা! কেঁপে উঠলো দু’জনেই। সাবাব মায়ের দিকে করুন চাহনি দিয়ে হীরের দিকে তাকালো। হীর অস্বস্তিতে মাথা নুইয়ে নিলো! সাবাব হীরের মনের কথা বুঝে নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল,
—-‘ ও কিছু না মা। তুমি কোথায় ছিলে? খাবার কি আজ পাবো না? ক্ষিদেয় এবার আমি মরে যাচ্ছি।’
ছেলের বানীতে নাজমা বেগম ব্যস্ত হয়ে গেলেন। জবাব নেওয়া দেওয়া বাদ দিয়ে চটজলদি খাবার নিয়ে ছেলের সামনে হাজির হলেন। খাবার সামনে পেতে সাবাব আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে খেতে শুরু করল। নাজমা বেগম হীরের কাছে গিয়ে পাশের চেয়ার টেনে বসল। হাতে ভাত মাখিয়ে হীরের মুখে প্রথম লোকমা তুলে দিতেই পেছন থেকে হাজির হলো আদ্র। আদ্রকে দেখতে নাজমা বেগম রুবিকে ডেকে খাবার দিতে বলতেই রুবি খাবার নিয়ে এলো। আদ্রও বসে পড়ল সাবাবের পাশে।
__________________
—-‘ লিস্ট কোথায়?’
ড্রয়িং রুমে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন নাজমা বেগম। আজিম সাহেব সন্ধ্যার খবরের কাগজ নিয়ে বসেছেন। বউয়ের ব্যস্ত কন্ঠে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সিঁড়ি থেকে নামতে নামতে পাল্টা প্রশ্ন করল সাবাব,
—-‘ কিসের লিস্ট?’
নাজমা বেগম ব্যস্ত কন্ঠে জবাব দিলেন,
—-‘ শপিংয়ের লিস্ট। কার কাছে আছে জিজ্ঞেস করতো একটু? আর বাকিরা কোথায়? কখন বের হবে সবাই?’
সাবাব হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলল,
—-‘ লিস্ট বোধহয় হীরের কাছে আছে। নীচে আসার সময় শুনলাম। আর বাকিরা তো রেডি। এখনই চলে আসবে।’
‘আমরা এসে গেছি।’
এক এক করে সিঁড়ি ধরে নেমে এলো সবাই। সবার মাঝে হীর অনুপস্থিত। সানিয়া একবার পেছন মুড়ে হীরের সন্ধান চালিয়ে বলল,
—-‘ হীরটা আবার কোথায় আঁটকে গেলো? হীর?'(গলা উঁচিয়ে ডাকল)
মিলি বলল,
—-‘ ও তো সবার আগে তৈরি হয়েছে।’
এশা বলল,
—-‘ বাকি পড়ল নাকি সাজের?’
আজিম সাহেব পেছন থেকে খবরের কাগজ ভাজ করে উঠে এলেন এদিকে। যাওয়ার তাড়া করে বললেন,
—-‘ আমরা তো এক গাড়িতে যাবো না। সানি তুমি আমি আর তোমার মা চলো। ঐদিকে নেহালরা বোধহয় এসে পড়েছে শপিংমলে। আর সাবাব, তুমি হীর আর ওদের নিয়ে অন্য গাড়িতে এসো কেমন।’
বাবার আদেশে মাথা নাড়ল সাবাব। নাজমা বেগম আরেকবার উঁকি দিলেন হীরের রুমের দিকে। বের হতে না দেখে সাবাবের উদ্দেশ্যে বললেন,
—-‘ আমরা এগোই বাবা। তোরা সাবধানে আসবি কিন্তু।’
সাবাব স্মিত হেসে বলল,
—-‘ আচ্ছা সাবধানেই আসব। চিন্তা করো না।’
সানিয়ারা বেরিয়ে পড়ল। তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়েই তিন বন্ধু সোফায় গিয়ে বসল। হীর এখনও নামছেনা। সাবাবের কপালে চিন্তার ভাজ দেখা যাচ্ছে। নিজে থেকে যতক্ষণ গিয়ে না দেখবে ততক্ষণে শান্তি হবে না। সাবাবকে বারবার উঁকি ঝুঁকি দিতে দেখে আদ্র মিটমিটিয়ে হেসে বলল,
—-‘ ভাইয়া, একবার গিয়ে দেখে আসা উচিত ওর এতো লেট কেন হচ্ছে।’
সাবাব চোখ সরিয়ে নিলো হীরের রুম থেকে। আমতাআমতা করে বলল,
—-‘ হ্যাঁ, আমারও মনে হচ্ছে একবার দেখা উচিত এখনও আসছে না কেন?’
মিলি মিনমিনে কন্ঠে বলল,
—-‘ তুমি ডাকবে বলে হয়তো অপেক্ষা করেছে হীর।’
এশা আর আদ্র মুখ চেপে হেসে উঠলো। সাবাবও হাসল মনে মনে। হীরের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিয়ে বলল,
—-‘ আসছি আমি।’
সাবাবের যাওয়ার পানে তাকিয়ে তিন বন্ধু আরও এক দফা হাসল মুখ টিপে।
হীর কালো চুরিদারটা পাল্টে স্কার্ট পড়েছে। বিভিন্ন রঙের ফুলের কাজ স্কার্টে। স্কার্টের উপর সাদা লেডিস্ শার্ট। গলায় ঝুলছে সিলভার রঙের নেকলেস। কানে তাঁদেরই গোল এয়ারিং। পিঠ অব্দি ছড়িয়ে আছে সিল্কি চুলগুলো। মাঝখানে লম্বা সিঁথি। চুলগুলোর অর্ধেক সামনে আনল। চোখে কাজল এঁটেছিল। চুরিদারের সাথে মানাবে বলে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে মানাচ্ছে না। ঠোঁটের লিপ বাম মুছে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক লাগিয়েছে। সব মিলিয়ে পার্ফেক্ট। কিন্তু কাজলটা নিয়ে একটু দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে বটে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। যখনই কাজলটা মোছার জন্য হাত উঠালো তখনই পেছন থেকে পরিচিত কন্ঠ ভেসে আসল।
—-‘ কাজল টা মুছে ফেললে ভালো লাগবেনা।’
হীর চমকালো কিঞ্চিৎ। কিন্তু বহিঃপ্রকাশ ঘটলো না। সে আয়নার মধ্যে থেকেই তাকালো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে সাবাব। সাদা টি-শার্টের উপর কালো জ্যাকেট। ‘এই গরমে জ্যাকেট কে পড়ে?’ প্রশ্নটা নিজের মধ্যেই চেপে রাখল হীর। জ্যাকেটটা দেখে হীরের মনে হলো এটা শীতের নয়। গরমেও সাধারণ শার্ট,টি-শার্টের মতোই অনায়াসে পড়া যায়। মাথার চুলগুলো সাবাবের ফর্সা কপালে চুম্বন আঁকছে বারবার। চোখ জোড়া নির্লিপ্ত চাহনিতে চেয়ে আছে। হীর সোজা হয়ে দাঁড়ালো। পেছন মুড়ে তাকাতে তাকতে বলল,
—-‘ কাজল লাগালে লেপ্টে যায়।’
—-‘ দারুণ লাগে। ভীষণ মায়াবি।’
—-‘ এতো কিছুর হিসেব?’
—-‘ অজান্তেই রেখে ফেলি!’
হীর মনে মনে হাসল। সাবাবের সাথে অকারণেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু প্রশ্ন খুঁজে পেলো না। সাবাব হাত ঘড়িতে আবারও ব্যস্ত চোখ বুলালো। তাড়া দিয়ে বলল,
—-‘ সবাই নীচে অনেক্ষন ধরে অপেক্ষা করছে। এতো লেট কেন?’
হীর নিজেকে একবার দেখল। অতঃপর পার্স আর ফোন হাতে উঠিয়ে নিয়ে বলল,
—-‘ আমি তো সবার আগেই রেডি ছিলাম। বের হতে যাবো ঠিক তখনই হয়ে গেলো একটা ব্লান্ডার! বিছানার ঐ কোনো ছোট্ট একটা আলপিন বেরিয়ে ছিলো! যাওয়ার পথে ওখানটায় পা আঁটকে গেলো। পছন্দের চুরিদারটা ওখানেই ছিঁড়ে গেলো। তাই নতুন করে আবার চেঞ্জ করে রেডি হতে হলো।’
—-‘ হাঁটার পথে চোখ কই থাকে তোর?’
—-‘ চোখ সাথেই ছিলো। শপিংয়ের লম্বা লিস্টে ছিলো। সব গুলো মেলাচ্ছিলাম! বুঝতে পারিনি এমন কিছু ঘটবে।’
—-‘ পরের বার হাঁটার সময় দেখে হাঁটবি। নয়তো চোখ তুলে নিবো।’
সাবাবের ছোট্ট করে হুমকিতে হীরের মুখখানা চুপসে গেলো। বিরস মুখে বলল,
—-‘ একটু ভুলে এতবড় শাস্তি?’
—-‘ হ্যাঁ। ভুল তো ভুলই। চল এবার।’
—-‘ বকছো কেন? যাচ্ছি তো!’
—-‘ সাবধানে দেখে আয়। আর লিস্ট চেক করতে হবেনা। আশাকরি সব ঠিকই আছে। আর যদি ঠিক না থাকে তবে গাড়িতে গিয়ে চক করবি।’
এই বলে সাবাব চলে গেলো। হীর তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে মনে মনে হেসে বলল,
‘ হঠাৎ এতো কেয়ার! মেনে নেয়া যাচ্ছেনা তো!’
#চলবে_ ♥️