#কাঞ্জি
#পর্ব-৮
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
তলপেটে চিনচিনে ব্যথা নিয়ে রত্না বেগমের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে আবৃতি।মাথা নিচু করে এক হাতে পেট চেপে ধরে বসে আছে।প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে তার।এই মুহূর্তে তার প্রয়োজন এক গ্লাস গরম পানি এবং ব্যথার ঔষধ।রত্না বেগমের প্রশ্নের পালা শেষ হলে সে বেরিয়ে গেল রান্না ঘরের দিকে।মাস কামারির এই সময়টা প্রচন্ড পেট ব্যথায় ভোগে আবৃতি। গরম পানি খাওয়া এবং ছ্যাক নিলে কিছুটা ব্যথা কমে।চুলোয় পানি বসিয়ে এক লিটারের প্লাস্টিকের বোতলের খোঁজে লেগে গেল সে। প্রতি মাসেই কয়েকটা বোতল নষ্ট হয় এই গরম পানির কারণে। অদিতির জন্য হট ওয়াটার ব্যাগ আছে।যেটা বিদ্যুৎ চালিত। যখন তখন গরম করা যায় কিন্তু তার নেই।সে আবদার করেছিল কিন্তু রত্না বেগম রাজি হয়নি।মেয়েদের এমন টুকটাক ব্যথা সহ্য করতে হয় কিংবা স্বামীর বাড়ি গিয়ে এমন বিলাসিতা পাবে কি না এটার কথাও উঠেছিল।আবৃতির প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন সয়ে গেছে ব্যপারটা।গরম পানি বোতলে ঢালার সময় কিছুটা হাতে লাগলো, পেট ব্যথা কিংবা জ্বর সব কিছু মিলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্ট হচ্ছিলো তার। ওড়নায় বোতল জড়িয়ে নিজ রুমের ফ্লোরে গা এলিয়ে দিলো সে।প্রায় দুই ঘন্টা ঘুমানোর পর প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে জেগে উঠলো।গোসল সেরে বেরিয়ে এসে খাবারের তালাশ করছিল কিন্তু দুদিন ধরে বাড়িতে রান্না হয়নি।নিচে খেতে যাওয়ার শক্তি ছিল না।ফ্রিজ থেকে ভাত বের করে তার সাথে একটু গরম পানি মিশিয়ে নিলো।অল্প ভাত এবং বেশি পানি নিয়ে লবণ, কাঁচা মরিচ দিয়ে খাচ্ছিলো।
এই কাঞ্জি নামক খাবারটা তার কাছে ভীষণ আপন।যখন যখন তার ভাগে কোনো খাবার জুটে না তখন অল্প ভাতে পানি মিশিয়ে খেয়ে নেয় সে।পান্তা ভাতের পানি তথা কাঞ্জি তার নিকট ক্ষুধা নামক শত্রু নিধনের উৎকৃষ্ট অস্ত্র।
রুমে ফিরে এসে নিজের বিছানার নিচ থেকে একটা ছবি বের করে আবৃতি। তার বাবা মায়ের এক সাথে একটা ছবি।কোলে তাকেও দেখা যাচ্ছে।হাসির রেখা ফুটে উঠেছে মুখশ্রীতে।ইনিয়েবিনিয়ে বাবা মাকে অনেক কিছু বলে সে। টুপ টুপ করে ঝরে পড়া চোখের পানি নাক গড়িয়ে ঠোঁট গলিয়ে মুখে প্রবেশ করে নোনতা স্বাদ দেয়। তবুও আবৃতি কইতে থাকে তার গল্প।
এই ছবিটা প্রায় দীর্ঘ পনেরো বছর যাবত লুকিয়ে রেখেছে সে। রত্না বেগম অনেক কিছুই পুড়িয়ে ফেলেছে।তার মধ্যে ছবিটাও ছিল।তাইতো একটা পাশ পুড়ে গেছে খানিকটা।বাবার চেহারার অংশে কালো পোড়া দাগ।সেই পোড়া দাগে চুমু খায় আবৃতি। পরম যত্নে কিংবা ভালোবাসায় বুজে আসে দুই চোখ।
ছেলে পক্ষের থেকে প্রায় বিশ জন লোক এসেছে। নিকট আত্নীয় মিলিয়ে পঞ্চাশ জনের মতো হবে। তাদের খাবারের দেখাশোনা করছিল আজমীর, সিজাদ, শাহ্ এবং সিয়াম। পুরো বিকেল কয়েক বার আবৃতির খবর নিতে না পেরে বিরক্ত হয়ে আছে শাহ্। রিমঝিমকে কয়েক বার ডেকে জিজ্ঞেস করেছে সে কেবল উত্তর দিয়েছে আপু ঘুমাচ্ছে।হাত ঘড়িতে তাকিয়ে যখন দেখতে পেল বেলা পাঁচটা বাজতে চলেছে তার ভীষণ রাগ হলো।এখনো খায়নি মেয়েটা।সে খেয়াল কারোর নেই।নিজ থেকে আবৃতির খবর নিতে যাবে তো আরেক সমস্যা। নিজ মায়ের স্বভাব সম্পর্কে খুব ভালো করে জানে শাহ্। শাহিনা বেগম অহেতুক নানান ধরনের কথা বলবে।নিজের ছেলের আশেপাশে সচরাচর কোনো মেয়েকে তেমন পছন্দ করেন না।তাছাড়া রত্না বেগম তো আছেই।
আবৃতি যখন নিচে নামলো তার গায়ে সাদা এবং সোনালী রঙের শাড়ি।চুলগুলো কোমর ছাড়িয়ে ঝুলছে।ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল তাকে।বা হাতে ক্যানোলা লাগাবো।সুফিয়া খাতুন তাকে দেখে পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার সাথে।শাহিনা বেগম বিষয়টা খুব একটা ভালো ভাবে নিতে পারলেন না।নিজের মেয়ের বিয়ে এখনো ঠিক হয়নি। সেখানে আবৃতির আসাটা উচিৎ মনে হচ্ছে না।তবুও তাকে চুপ করে থাকতে হলো।কারণ এই বাড়িতে সুফিয়া খাতুনের কথার গুরুত্ব সব থেকে অধিক। তার কথা বা কাজের ভুল ধরার মতোন দুঃসাহস কেউ করে না।সুফিয়া খাতুন সিজাদকে ডেকে বলল,
“ভাই তোরা খেতে বোস।সবার খাওয়া তো শেষ। আবৃতিকে নিয়ে যা। দেখ যদি কিছু খায়।”
খাবার টেবিলে নয় ওরা খেতে বসলো ঘরেই।আজমীর বোনের পাশে বসে খাবার বেড়ে দিতে চাইলো।নাক মুখ কুঁচকে ফেলল আবৃতি। খাওয়া হলো না তার, অথচ পাশেই খেয়াল করলে সে দেখতে পেত তার সাথে সাথে উঠে গেছে শাহ্ নিজেও। কাজের লোককে বলে চিড়ে ভিজিয়ে আনিয়েছে। সাথে মিষ্টি দই। আবৃতি যে ঘরটায় ছিল সেই ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করলো শাহ্। কপালে হাত রেখে শুয়ে আছে মেয়েটা।
“উঠো, খেয়ে নিবে।”
“ইচ্ছে করছে না।”
“কোনো দিন করেছে?এতো কেন অবহেলা নিজের প্রতি।”
“আমি ঠিক আছি।আমার জন্য এত চিন্তার কিছুই নেই।”
“সত্যি নেই?আবৃতি বাড়িতে অনেক মানুষ তুমি কি চাইছো আমি কিছু করি?নিশ্চয়ই আমার রাগ সম্পর্কে তোমার ভালো ভাবেই আন্দাজ আছে।”
চোখ তুলে তাকায় সে। শাহ্ এর ইচ্ছে হয় জড়িয়ে নিতে মেয়েটাকে।তার কপালে ভালোবেসে কপাল ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলতে,
“মেহেবুবা, এত কিসের ভয় তোমার?তোমাকে আমি আমার মনে পাঁচটা বছর ধরে পুষে রেখেছি।কি প্রয়োজন ছিল আমার?বাবার ব্যবসা থাকতে এত কষ্ট করে বিসিএসটা দেওয়ার?আমি তোমার জন্য দিয়েছি।কেবল তোমাকে একটা ভালো ভবিষ্যৎ উপহার দিবো বলে।আমার মায়ের বিরুদ্ধে যেতে হবে আমার তোমাকে পেতে।আমি এত যুদ্ধ করছি আর তুমি নিজের খেয়ালটা রাখতে পারবে না?এ ভীষণ অন্যায় মাই হাইনেস।”
কিন্তু মুখে বলল,
“অসুস্থ তুমি।এটুক খেয়ে নাও।রাতে আইসক্রিম এনে দিব।”
“হুম।”
আবৃতি চুপচাপ খেয়ে নেয়।শাহ্ তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে।কেন এতো প্রতিবন্ধকতা তাদের মাঝে? তার মা, আবৃতির মা কিংবা অন্য সব বিষয় কেন এলো তাদের মাঝে?সম্পর্কটা ভোরের আলোর মতোও তো হতে পারতো।
আংটি বদলের পর ছবি তোলার হৈচৈ লেগে গেল।সেখানে রিমঝিমকে বার কয়েক ধমকে দিয়েছে শাহ্। মেয়েটা চঞ্চল, একটু বেশিই চঞ্চল।ছোটাছুটি করতে গিয়ে একবার নিজে পায়ে ব্যথা পেল, আরেকবার আবৃতির ক্যানোলা লাগা হাতে ব্যথা দিয়েছে। বিরক্ত হয়ে শাহ্ তাকে ধমকে দিয়েছে।কিন্তু মন খারাপের বদলে তার চোখে মুখে চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। রাতে আবৃতির সাথে ঘুমানোর সময় সে আবৃতিকে জিজ্ঞেস করলো,
“আপু শাহ্ ভাইয়ার সাথে আমার বয়সের তফাৎ কতো?”
“বারো বছর।”
“আই থিংক হি হ্যাজ আ ক্রাশ অন মি?”
আবৃতি ভ্রু-কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“হঠাৎ এমন মনে হলো কেন?”
“কাজিন রিলেটেড গল্প পড়ো না তুমি?সেখানে তো ভাইয়েরা এভাবেই ধমকে দেয়।ওহ তুমি তো ছিলে না তাই দেখো নি।আজ যখন তোমার হাতে ব্যথা লাগলো তখন ভাইয়া আমাকে ধমকেছে।কারণ আমারো লাগতে পারতো।তার এসব ব্যবহার তো তাই মনে হয়।”
“ওহ আচ্ছা।”
“মিথ্যে বলবো না, ভাইয়াকে আমারো ভালোই লাগে।আচ্ছা তুমি কখনো কারো উপর ক্রাশ খেয়েছো?”
আবৃতি জবাব দিলো না।চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল।রিমঝিমের এমন ধারণার জন্য আসন্ন বিপদের কথা ভেবে তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।
চলবে (এডিট ছাড়া।আপনারা রেসপন্স কম করলে আমিও গল্প কম করেই দিবো।শোধবোধ। তাই যারা গল্প পড়েন রেসপন্স করবেন।অন্তত এক লাইনের মন্তব্য।)
#ছবিয়ালঃ জারিন