কালো মেঘে রোদ্দুর পর্ব ১০

#কালো মেঘে রোদ্দুর (পর্ব:10)

♡আরশিয়া জান্নাত

মোহনা বেশ পরিপাটি হয়েই ইন্টারভিউ দিতে গেল। চারদিকে হাই কম্পিটিটর দেখে হতাশা গ্রাস করলেও মনে মনে নিজেকে হাজারটা অনুপ্রেরণামূলক কথাবার্তা বলে যাচ্ছে। কবি তো বলেছেনই “একবার না পারিলে দেখো শতবার”। জীবনে হারজিত আছেই। হয় সে জিতবে নাহয় শিখবে। কোনোটাতেই তো লস নেই। মনকে শক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে অবশেষে তার পালা এলো। সে আল্লাহর নাম নিয়ে ঢুকে পড়লো বোর্ড- কেবিনে।

কলেজ থেকে বের হয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল পিহু। ইলহাম সেই পথেই যাচ্ছিল ভদ্রতার খাতিরে পিহুকে দেখে বললো, হেই পিহু কেমন আছ?

আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?

আমি সবসময়ই বিন্দাস থাকি। তা বাসার সবাই ভালো তো?

জ্বি সবাই ভালো আছে। আপনার?

ভালো আছে। আসলে ঐদিনের ব্যাপারটা নিয়ে সবাই খুব আপসেট, বিশেষ করে বাবা। আমরা কেউ কল্পনাই করিনি এমন সিন ক্রিয়েট হবে। একটা মিসান্ডারস্ট্যান্ডিং থেকে এমন অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটে গেল। মোহনা আপু খুব কষ্ট পেয়েছে বোধহয়। তিনি ঠিক আছেন তো?

আমার আপু অল্পতে ভেঙে পড়ার মতো মেয়ে না। আসলে ও আর পাঁচটা মেয়ের মতো না। অন্যরা যেটাতে কেঁদে বুক ভাসায় আমার আপু সেটা আনপিনের ব্যাথার মতোই পাশ এড়িয়ে যায়। তবে হ্যাঁ আপনাদের বাসায় আসাটা কাকতালীয় হলেও আপুর জন্য এটা অনেক বড় একটা মিরাক্যাল ছিল। রাইয়্যান ভাইয়া অন্য কাউকে ভালোবাসলেও আপু কিন্তু তাকেই ভালোবেসেছে।

এটা জেনে আরো বেশি কষ্ট পেয়েছি জানো! ভাইয়া যদি 10% আগ্রহ দেখাতো বাবা ঠিকই মোহনা আপুকে ছেলের বৌ করে তুলতেন। আমাদের সবারই তাকে বেশ পছন্দ হয়েছে। কিন্তু,,,

পিহু তাকে থামিয়ে বললো, শুনুন 10% আগ্রহ আমার বোন ডিজার্ভ করেনা। আমি চাই আমার বোনের জীবনে এমন কেউ আসুক যে তাকে 100% ভালোবাসবে। এখানে কাউকে বাধ্য হয়ে এটেনশন দিতে হবেনা। আমি মনে করি যাকে ভালোবাসি তার অবহেলা পাওয়ার চেয়ে যে আমাকে ভালোবাসে তাকে পাওয়া উত্তম।

বোনকে অনেক ভালোবাসো তাই না?

আমার বোনটাই এমন। ভালো না বেসে থাকতে পারিনা।

শোনো পিহু তুমি অল্প বয়সে বেশ ম্যাচিওর! তবে কি জানো মানুষের মন খুব অদ্ভুত। একে ভালোবাসা দিয়ে পোষ মানানো যায়না। সে যার উপর আটকে যায় তার অবহেলাতেও আটকেই থাকে। তখন পুরো পৃথিবীর ভালোবাসা পায়ের সামনে এনে দিলেও তার মন খারাপ হবে এই ভেবে ঐ মানুষটাই তো ভালোবাসা দিলো না!!

আমি মন থেকে চাইবো আমার বোন সেই কাঙাল টা না হোক। মেয়ে হয়ে সে একজনের পেছনে অন্ধের মতো ঘুরেছে; তার এটেনশন পেতে কত কিই না করেছে। বিনিময়ে কি পেল? এখানে আসলে এক্সপেক্টেশন রাখাই ভুল ছিল। যাই হোক ভালো থাকবেন আল্লাহ হাফেজ

তুমিও ভালো থেকো। আর শোনো আমরা সত্যিই খুব স্যরি এই ইনসিডেন্টটার জন্য,,,

পিহু আর কথা বাড়ালোনা ঝটপট বাসে উঠে গেল।

ইলহাম মনখারাপ করে বললো, ভাইয়া কেন যে এখানে রাজী হলো না!


তুই আসলেই বেশি জিদ্দি। নিজের ইচ্ছেমতো জীবনযাপন করছিস। যখন যা চেয়েছিস তাই করেছিস কারো কথা তোয়াক্কাই করিস নি। তাই বলে ক্যারিয়ার নিয়েও এমন হেরফের করবি! হাই কোয়ালিফিকেশন নিয়ে কেউ এমন মশকারা করে? বলেছিলাম ফ্যামিলি বিজনেস জয়েন কর করলিনা। নিজের ইচ্ছাতে ডেলিভারি ম্যান হয়ে ঘুরলি। ভাবলাম কিছুদিনের জোঁক ঠিক কেটে যাবে। কিন্তু তুই তো নাছোড়বান্দা এটা ছাড়ার নামই নিচ্ছিস না! এমন করলে কিভাবে হয় ?? নিজেদের বিজনেস না কর দেশে কি চাকরির অভাব আছে? তোর মতো ছেলে এমন হেলাফেলা করলে মানায় না। এই দিন দেখার জন্য তোকে এতো পড়াশোনা করিয়েছিলাম??

রাফি পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললো, ওহ মাই সুইট আম্মাজান। এমন রেগে রেগে কথা বলোনাতো। দেখো বুকটা কেমন কাঁপছে! তুমি তো জানো আমি তোমার কঠিন কথাবার্তা শুনতে পারিনা। সফট হার্টের মানুষ কি না!

একদম নাটক করবি না। তোর এসব কথায় আমার টপিক চেইঞ্জ হবেনা। আমি চাই আমার ছেলে ভালো জব করুক। দেশবিদেশে নাম কামাক। এমন ভাউন্ডুলে জীবন কাটানোর মানে কি? এটার কোনো ভবিষ্যত আছে? আচ্ছা রাফু তুই কি বিয়েশাদী করবি না? মেয়ের বাবা জিজ্ঞাসা করলে কি বলবো ছেলের স্থায়ী কোনো জব নাই সে যখন যা পায় তাই করে? এমন বললে কেউ মেয়ে দিবে?

তোমাদের দেখে যে কেউ চোখ বন্ধ করে মেয়ে দিবে মা! তবে হ্যাঁ আমার নড়বড়ে প্রফেশন দেখে ভুলেও দিবেনা।

এই তো লাইনে এলি। তা কর না কিছু। তোর সাথের সবাই কত নামিদামি কোম্পানিতে ভালো পোস্টে আছে তুইও ট্রাই কর?

আম্মাজান তুমিতো জানো আমি ধরাবাধা জীবন যাপন করতে পারিনা। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ছকে বাধা লাইফ লিড করা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই আমি ফুড ডেলিভারি দেই ইচ্ছেমতো হাওয়া লাগিয়ে ঘুরি। রোজ কতরকম অভিজ্ঞতা অর্জন করি! সবাই টাকার পিছে ছুটলে চলে?

তোর সাথে কথায় আমি পারবোনা। শুধু শুনে রাখ এমন চলতে থাকলে আজীবন কুমার থেকে যাবি। ছেলেদের আসল গরিমা থাকে ইনকামে। এই ইনকামে বৌয়ের মেকাপ খরচো আসবেনা।

মা এই ইনকামে অনেকের সংসার চলে যায় আর বলছো মেকাপ খরচ! আমি এমন মেয়েকে বিয়ে করবো যে কৃত্রিমতার আড়ালে নিজেকে লুকোবে না। বরং সবসময় স্নিগ্ধ থাকবে ন্যাচারাল কুইন!

মিসেস ফাইজা পুলকিত মুখে বললেন, হ্যাঁ রে রাফু তোর পছন্দের কেউ আছে নাকি? ভালবাসিস কাউকে? থাকলে বল আমরা গিয়ে দেখি?

আছে মা একজন আছে। খুব সাধারণের মাঝে অসাধারণ একটা মেয়ে। আমি রোজ নতুন করে মেয়েটার প্রেমে পড়ি। জানো মা সে জানেনা পর্যন্ত আমি তাকে ভালোবাসি। চোখের দেখায় প্রেমে পড়ে মানুষ এমন গল্প অনেক আছে। কিন্তু কারো ব্যবহার এতোটা টানতে পারে আমার জানা ছিল না। এতো নম্র মেয়ে আমি খুব দেখেছি। দিন যত গেছে যতো বেশি জেনেছি ততো গভীরভাবে ডুবেছি। আমি জানিনা সে আমায় মেনে নিবে কি না। সত্যি বলতে আমি চাই সে আমার সাধারণ পরিচয়টাই জানুক। অন্য সবার মতো ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে মরিয়া না হোক।

ওহ এই তাহলে কারণ! এজন্যই বুঝি আটকে আছিস? শোন বাবা সবাই সুখ চায়। এটাতো খারাপ না। কেউই আজীবন কষ্ট করতে চায় না। একটা লাক্সারি লাইফ এক্সপেক্ট করাটা খারাপ না সোনা। কেউ যদি ভালো ফ্যামিলিতে মেয়ে দিতে চায় তাতে আমি দোষের কিছু দেখিনা।এটাই তো স্বাভাবিক নিয়ম তাই না? তুই কিন্তু মনঃকষ্ট পাস না। নিছেকে সবরকমের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত রাখিস।রেজাল্ট যাই আসুক।

আই লাভ ইউ মা। এইজন্যই তোমাকে আমি এত্ত ভালোবাসি।

হুহ সবই মাখন!

রাফি তার মাকে জড়িয়ে ধরে হাসতে লাগলো।



যতোটা টেনসড হয়ে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল ততোটা প্যারাও ছিল না। যে মানুষ অনেক ইন্টারভিউ দেয় তার কিছু থাকুক না থাকুক অভিজ্ঞতা থাকে অনেক। তাই তো এমন হার্ড ইন্টারভিউ খুব সহজেই আনসার করে এসেছে মোহনা। যদিও এখানে এই আশা রাখেনা তাকে অ্যাপয়েন্ট করা হবে। কারণ ইন্টারভিউ ভালো মানেই জব কনফার্ম এটা এই দেশে বলা যায় না। মামা চাচা ছাড়া কিছুই হয়না। তাই ফুরফুরে মুডেই ফল দোকানে গেল সে। মায়ের শখ হয়েছে আতাফল খাওয়ার। সেটাই খুঁজতে এসেছে। তার মায়ের আজগুবি সব শখ। যা এই শহরে সহজে পাওয়া যায় না তাই তার খেতে ইচ্ছে হয়। যে দোকানেই আতাফল খুঁজছে সেখানেই তাকে ড্রাগন ফল সাজেস্ট করছে। আরেহ ভাই দেশী ফলের সাথে কি আর বিদেশি ফল মিলবে? মা তো অন্তত মানবে না তাই না?
বহু দোকান ঘুরে অবশেষে আতাফল নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলো সে।
জীবনটা চলুক তার আপন গতিতে। এখন আর টেনশন নিয়ে লাভ নেই।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here