কালো মেঘে রোদ্দুর পর্ব ১১

#কালো মেঘে রোদ্দুর (পর্ব:11)

♡আরশিয়া জান্নাত

এই দাঁড়ান দাঁড়ান!

দৌঁড়াতে গিয়েও থেমে গেল রাফি। মোহনা কোমড়ে হাত দিয়ে রাগী লুক এনে বললো, এদিকে আসেন চটজলদি।
অগত্যা রাফি মরে গেছি টাইপ ভাব এনে পিছু ফিরে এলো।
এই যে মিস্টার সমস্যা কি? রোজ যখন কষ্ট করে পেছন পেছন আসেনই তাহলে পাশে এসে গল্প করলেই পারেন। আমারো সুবিধা হয় আর আপনারো!

মানে?! কে বললো আমি আপনার পেছনে আসি? আমিতো এদিকেই,,,

হয়েছে থাক আর মিথ্যা বলতে হবেনা। দেখেন এই শহরের রাস্তা এতোটাও ভালোনা। একটা ছেলে পাশে থাকলে অন্তত কেউ টিজ করতে পারবেনা আর গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে বোর লাগবেনা। কি বলেন?

আসলে আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন ব্যাপারটা এমন না কিন্তু।

মোহনা হাঁটতে হাঁটতে বললো, তা আপনি এখনো ফুড ডেলিভারি করেন?

হ্যাঁ। পাশাপাশি ছোটোখাটো একটা জব নিয়েছি।

বাসায় কে কে আছেন?

মা-বাবা আর ভাইবোন।

আপনি কয় নাম্বার?

ছোট।

ওহ আচ্ছা! সেজন্যই প্যারা কম। এখন সবার ফিনান্সিয়াল যে অশান্তি! টাকার বরকত নেই অথচ সবকিছুর দাম আকাশছোঁয়া। তা জীবনের লক্ষ্য কি?

পুরো পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো!

তা কতদূর ঘুরলেন? আই মিন এই পর্যন্ত কয়টা জায়গায় গেছেন?

পঁচিশটা।

ওয়াও! অনেক ঘুরেছেন দেখছি!

আপনার কোনটা পছন্দ?

সত্যি বলবো? আমার কাছে যদি অঢেল টাকা থাকতো তাহলে আমি কখনোই বাসা থেকে বের হতাম না। এক রাজ্য বই নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিতাম। শান্তিতে একটার পর একটা বই পড়বো আর ঘুমাবো।

আপনাকে দেখে মনে হয়না আপনি এমন ঘরকুণো ইচ্ছে পুষেন। সবসময় তো বাইরেই কাটান।

মোহনা হেসে বললো, এটা তো প্রয়োজনের খাতিরে! বাবা মারা যাওয়ার আগে আমি কখনোই কাজ ছাড়া বের হইনি। রাস্তাও ঠিকঠাক চিনতাম না। আমার গন্ডি ছিল স্কুল টু বাসা সর্বোচ্চ বাটালি হিল! এইটুকুই। এখন এই শহরের কত কি চিনি। সীমানা বিস্তৃত হয়েছে দিনের পর দিন। জানেন বাবা সবসময় বলতো উনার সঙ্গে বের হতে রাস্তাঘাট চিনতে ব্যাঙ্কের লেনদেন তার সঙ্গে গিয়ে বুঝতে। আমার তো ভাই নেই তাই বাবা আমাকে সব শেখাতে চাইতেন। কিন্তু আমি এমনই মেয়ে তখন শপিংটা পর্যন্ত নিজে করিনি। বাবা যদি দেখতো নিশ্চিত বলতো, বাহ এই না হলে আমার মেয়ে!

বলতে বলতে কখন যে চোখ ভিজে এলো টের পেলো না মোহনা। কতদিন পর এভাবে কাউকে বাবার গল্প বলছে সে! রাফি পুরোটা সময় নিরবশ্রোতা হয়ে রইলো। কথার লতায় এমন এক মর্মস্পর্শী জায়গায় চলে আসবে ভাবেনি সে।
মোহনা আড়াল করে চোখ মুছে লজ্জায় পড়ে গেল। নিজের এহেন কান্ডে নিজেই বিস্মিত।

মিস মোহনা উইকেন্ডে ফ্রি থাকবেন?

নাহ। সেদিন বাসায় অনেক কাজ থাকে। আর বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠি বলে সময় কুলায় না।

আচ্ছা।

কাল আমার আর্লি ছুটে হবে। চারটার এখানে থাকবেন।

রাফি মোহনার কথা শুনে হেসে দিলো। কেমন হুকুম করে বললো মেয়েটা!

মোহনা হাসতে হাসতে অফিসে ঢুকে গেল। এই দীর্ঘ পথটা অন্যসময় বিরক্তিকর লাগলেও আজ বেশ ভালোই লেগেছে মনে হচ্ছে পথটা খুব ছোট ছিল।
এমনটা কেন হলো? কোনো ছেলের সঙ্গে এভাবে আগে কথা হয়নি বলে নাকি অন্য কিছু?




ইদানীং না চাইতেও ইলহামের সাথে রোজ দেখা হয়ে যাচ্ছে পিহুর। কথা না হলেও ভদ্রতার হাসি বিনিময় করেই দুজনেই দায়সারা হয়। ব্যাপারটা যে কেউ ইচ্ছে করে করছে এমন না। কিছু একটা কানেকশন তো আছেই এমন অযাচিত সাক্ষাতের।

আচ্ছা পিহু বলতো কোন মানুষটা তোর জন্য বেশি পারফেক্ট হবে। একজন যে সবদিকে পারফেক্ট। ভালো ইনকাম ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডও বেশ পরিপাটি। কিন্তু সে তোকে ভালোবাসেনা। অপরজন যে কোনোদিকেই পারফেক্ট না। মানে ফিনান্সিয়ালী পজিশন তেমন একটা আহামরি না। আমাদের মতোই বলতে পারিস। কিন্তু তোকে অনেকদিন ধরেই পছন্দ করে হয়তো ভালোও বাসে। এক্ষেত্রে কোনটা চুজ করবি?

পিহু কিছুক্ষণ ভেবে বললো, যে ভালোবাসে তাকে চুজ করবো।

সিওর তুই?

অফকোর্স সিওর। দেখ আপু টাকাপয়সা কোনো ব্যাপারই না। যদি একটা সত্যিকার ভালোবাসার মানুষ পাশে থাকে। তাছাড়া আমি নিজেও জব করতে পারি। প্রয়োজনে দুজনে মিলে সংসার চালাবো। এখানে মানুষটা কেমন, তার ন্যাচার কেমন। সে কতখানি সৎ, আর ডেডিকেটেড কি না এসবই মুখ্য। এমন অনেক ধনী লোক আছে যারা অর্থের দিকে পারফেক্ট হলেও মনের দিক থেকে একদম জঘন্য।

হুম কথার লজিক আছে। আমিও এটাই ভাবছিলাম পরে মনে হলো আমি ইমোশনালী ভাবছি প্র্যাকটিক্যালি না। তাই তোকে জিজ্ঞাসা করলাম।

ঘটনা কি বলতো?

বলবো বলবো। সময় হোক।

আমার থেকে লুকানো হচ্ছে?

ধুরর বোকা না। তবে আমাকে একটু সময় দে। জানি তাকে, দেখি মানুষটা কেমন। তারপর তোকে বলবো।

অপেক্ষায় রইলাম। তবে আশা করি এবার আর ভুল মানুষকে চুজ করবিনা।

বেশি সত্যি বলিস না- গাঁয়ে বিঁধে।

সত্যি বলি বলেই তুই আমার কাছেই আসিস। কারণ অপ্রিয় হলেও মানুষ সত্যিটাকেই পছন্দ করে।

তোর পরীক্ষা কবে?

দেরী আছে কেন?

কতদিন কোথাও বেড়াতে যাইনা! ইচ্ছে করছে আমাদের পুকুরঘাটে বসে মুচির ভর্তা খেতে! পলি-মলিরা সবাই একসঙ্গে বসে গল্প করতে করতে যেভাবে খেতাম,,,,

আপু বাদ দে না। ঐ বাড়ি এখন আর আমাদের নেই। ওখানে কার কাছে যাবো?

জানিস পিহু আমি ভাবিনি যাদের আপন ভাইবোন ভাবতাম তারাও এভাবে পর হয়ে যাবে। তখন তো সবাই কত্ত আপন ছিল। পলির বিয়েতে প্রতিটা জিনিস মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে কিনেছিল। আমরা না যাওয়া অবধি হলুদ পর্যন্ত দেয়নি। মনে আছে আমার শেষ পরীক্ষা ছিল আমি পরীক্ষা দিয়ে এসে বাসে উঠেছিলাম। যেতে যেতে প্রায় রাত হয়েছিল। সবাই আমাদের জন্য অনুষ্ঠান শুরু করেনি অপেক্ষা করছিল।

আমাদের অপেক্ষা সাধে করেনি আপু। বাবার ত্রিশ হাজার টাকার জন্য করছিল। মনে নেই টাকা দিতেই বড় আব্বু বিয়ের বাজার করতে গেছিল!

মোহনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, তুই বেশিই বুঝিস।

আসলেই বেশি বুঝি। আর বুঝি বলেই কাউকেই নিঃস্বার্থ ভাবতে পারিনা। একমাত্র তোকে ছাড়া।

আমারেও ভাবিস না। আমিও কিন্তু স্বার্থের জন্যই তোকে রাখছি। এই যে এমন জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলে পরামর্শ দেস এজন্য চার্জ দিচ্ছি।

হাহাহা

চল তোরে আজকে ফুচকা খাওয়াবো।

আপু তুই ভুলে যাচ্ছোস আই হেইট ফুচকা!

হুরর আমার কত শখ ছিল একটা ছোট বোন হবে যারে নিয়ে আমি টকঝাল খাবো ফুচকা খাবো ঘুরবো। আর তুই কেমন!

তোর এই কথার জন্য আমি সবসময় এইসব ছাইপাঁশ খাই। চলো যাই খেয়ে আসি তোমার ফুচকা!

হেহে এই না হলো আমার লক্ষী বোইন।

হুহ।


জেইআই কোম্পানির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দেখে মোহনার উচ্ছাস ছিল দেখার মতো। অবশেষে তার জীবনে কাঙ্ক্ষিত কিছু একটা মিললো!
এই খুশির সংবাদটা মা বোনের পরে বিশেষ একজনকে খুব বলতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা রাইয়্যানকে বলার ইচ্ছেটা হলোনা কেন আর? তবে কি তার মন বদলেছে?

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here