কালো মেঘে রোদ্দুর পর্ব ১৩ ও শেষ

#কালো মেঘে রোদ্দুর (পর্ব:13)

♡আরশিয়া জান্নাত

আপনাকে একটা গল্প বলি। একটা মেয়ে ছিল যে তাঁর ভাগ্য নিয়ে চরম হতাশ। নিজের মা-বোনকে ঠিকঠাক চালাতে না পারার যন্ত্রণায় জর্জরিত থাকতো সবসময়। তার মনে হতো সৃষ্টিকর্তা তাঁর সাথে খুব অন্যায় করছে। তার আপন মানুষদের রূপ বদলানো কিংবা বন্ধুবান্ধবদের বিলাসবহুল জীবন সবমিলিয়ে তার মনে কষ্টের শেষ ছিল না। তারপর একদিন এলো এক রাজপুত্র। মেয়েটা তাকে তার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট ভাবতে শুরু করলো। এমন কিছু মিরাক্যাল ঘটলো যে সে ধরেই নিলো রাজপুত্রটা তার জন্য লাকি চার্ম। এই বুঝি তার জীবনের সব কালো আঁধার পেরিয়ে মিষ্টি রোদ্দুর হানা দিলো। কিন্তু সে যে মিথ্যা ভ্রমে ছিল তার প্রমাণ হলো প্রায় এক বছর পর। যাকে সে লাকি চার্ম ভেবে ভেবে মনোযোগের মূলবিন্দু বানিয়ে রেখেছিল, সে আসলে কখনোই সেটা ছিল না। এর পেছনে ছিল অন্য একজনের অবদান। অথচ মেয়েটা আলেয়ার পিছে এতোটাই মগ্ন হয়ে ছুটছিল পেছনে ফিরে দেখার সুযোগ হয়নি কেউ একজন ঢাল হয়েছিল।

মোহনা দম নিলো। রাফি বিব্রত চেহারার বসে রইলো। মোহনার কথার অর্থ বুঝেও বুঝতে পারছেনা যেন। মোহনা ফের বলতে লাগলো, জানেন আমি সবসময় আল্লাহকে দোষ দিয়েছি। আমার সাথে যাই হতো আমি তাকেই দোষ দিতাম। যখন পিহুর অপারেশনের টাকা অদ্ভুতভাবে যোগাড় হলো আমার মনে হলো আল্লাহর বুঝি একটু কৃপা হলো আমার প্রতি! আমি ভেবেছি এসব আমার মায়ের দোআ। আমার জীবনটা গুছিয়ে আসা, হঠাৎ করে পছন্দসই ফার্মে জব হওয়া লাইফ মোটামুটি সেটেল হওয়া সবকিছুই বুঝি আমার প্রাপ্য ছিল। অনেক কষ্ট করার ফল ভেবেই এতোদিন আনন্দিত ছিলাম। কিন্তু আমার ভুল ভেঙেছে মিস্টার জুনায়েদ ইসলাম রাফি!

আপনার সাথে যা ঘটেছে তার সবটাই কিন্তু আসলেই আপনার প্রাপ্য মিস মোহনা। মানুষের অবস্থান আজীবন এক থাকেনা। তাছাড়া আপনার অসম্ভব ভালো মেধা আর যোগ্যতায় আপনি আজ প্রতিষ্ঠিত। এখানে ভুল তো কিছু দেখছিনা।

জেআই কোম্পানির চেয়ারম্যান আশরাফ মাহমুদ আপনার বাবা এই সত্যিটা গোপন করেছিলেন কেন?

মিস মোহনা আমি একটু আগেই বলেছি আপনি তাই পেয়েছেন যা আপনার প্রাপ্য। আর আমার পরিবারের বিষয়ে আমি কখনোই ডিটেইলসে কিছু বলিনি। আমি চেয়েছিলাম আপনার সঙ্গে একজন সাধারণ মানুষ হয়েই মিশতে। আমি আসলেই যেমন তেমনটাই দেখাতে চেয়েছি। আমি চাইনি অন্য সবার মতো ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে আপনি আমায় পছন্দ করেন। সত্যি বলতে কি জানেন, আমি ফুড ডেলিভারি করে অনেকজনকে দেখেছি। যেসব মানুষ আমার আসল পরিচয় পেলে সসম্মানে গদগদ করতো তারাই কিন্তু ঠিকঠাক ভদ্রতাও দেখায়নি। একটু লেট হলেই দু চারটা কথা শোনাতেও কেউ ছাড়েনি। অথচ আপনি ছিলেন আমার অভিজ্ঞতার বাইরের একজন। আপনিই একমাত্র মানুষ যাকে আমি রাগ দেখিয়েছি। আর আপনি কাস্টমার হয়েও মিনিমাম রিয়েক্ট করেননি।এই বিষয়টা আমার জন্য মোটেও সাধারণ ঘটনা ছিল না।
আমি আপনার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য বারবার আপনার দ্বারে গেছি। হোয়াটস এপে নক করেছি, আপনার সোশ্যাল মিডিয়া খুঁজে বের করেছি। আপনার পেছনে ঘুরেছি। বিশ্বাস করুন যদি আমি দেখতাম রাইয়্যান সাহেব আপনার প্রতি আগ্রহী আমি কখনোই আপনার সামনে আসতাম না। আপনি কখনোই জানতে পারতেন না কেউ একজন ছিল! আমি খুব স্বার্থপর মিস মোহনা, রাইয়্যান সাহেবের ব্যাপারটা মিটে যাওয়াকে আমি বোনাস পয়েন্ট ভেবে লুফে নিয়েছি। আপনাকে বহুকষ্টে অন্য কারো জন্য মরিয়া হতে দেখে সহ্য করেছি। দ্বিতীয়বার আর সেটা দেখার সাহস হয়নি বলেই আগেপিছে না ভেবেই আপনার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। আপনি এটা ভাববেন না আপনার জবটা আমার রেফারেন্সে হয়েছে। আপনি নিজের এভিলিটিতেই এটা পেয়েছেন। এখানে আমার নামমাত্র ভূমিকা রয়েছে।

এখানে আমার প্রতি দয়া বা করুণা নেই তো?

হাহাহা। আপনাকে যখন মনে ধরেছে আমি আপনার নামটা ছাড়া কিছু জানতাম না। আপনার স্ট্রাগলটা জানার বহু আগেই এই মনটা আপনার হয়ে গিয়েছিল। তবে বিশ্বাস করুন জানার পর করুণা আসেনি,মনে সম্মানটা আরো বেড়েছে। আমার অনুভূতিকে অন্যভাবে জাস্টিফাই করবেন না প্লিজ!

শেষটা কি দাঁড়ালো তাহলে?

শেষ না সবে শুরু! আর এর সূচনাটা হলো আমি আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসি। আপনার সাথে জীবনের বাকি সবকয়টা বর্ষা কাটাতে চাই।

সবাই বসন্ত বলে আপনি বলছেন বর্ষা?

হ্যাঁ। কারণ আপনি আমার জীবনে স্নিগ্ধ বর্ষা হয়েই এসেছেন।

আজ বেশ কথা ফুটছে না? এতোদিন তো কিছুই বলেননি! কত মাস লেগেছে এইসব বলতে?

আপনার সামনে আসলেই সব জট বেঁধে যায়। গুছিয়ে কিছুই ভাবতে পারিনা। মুখস্থ করে আসা শব্দমালাও এদিকে ওদিক সরে যায়। আপনাকে মনের কথা বলতে নিলেই জ্বর এসে যায়। দেখুন আমার গা কেমন গরম হয়ে আসছে!

রাফির কথা শুনে মোহনা হাসতে লাগলো। রাফি বিড়বিড় করে বললো, আস্তে হাসুন প্লিজ আজ আমায় মেরে ফেলবেন নাকি!

মোহনা হাসি থামিয়ে বললো, হ্যাঁ আজ আপনার মার্ডারই হবে। ফার্স্ট টার্গেটেই ডিসকিউ!


পরিশিষ্ট: আজ পিহু আর ইলহামের বিয়ে। সকাল থেকেই সবাই চরম ব্যস্ত। ওদিকে মোহনার মেয়ে জুয়াইরিয়া একটু পরপর খালামণির সামনে এসে বলছে, খালামণি আমিও বৌ সাজবো বাবাইকে বলোনা আমাকেও বিয়ে দিতে। পিহু ওর নাক টেনে বলল, আগে বড় হয়ে নাও তারপর বিয়ে।
জুয়াইরিয়া তার উত্তরে বিশেষ সন্তুষ্ট হলো বলে মনে হলো না।

মোহনা ব্যস্তভঙ্গিতে রুমে ঢুকে আলমারি খুলতেই রাফি তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো, এতো ব্যস্ততা তোমার বরটার দিকে নজর দেওয়ার ফুরসত নেই। আমি যে সেই কখন থেকে তোমার অপেক্ষায় মরে যাচ্ছি খবর ই নেই!

ঘরভর্তি লোকজন এখনও তোমার আদিখ্যেতা লাগবে, দেখি ছাড়ো কখন কে এসে যায়।

হুহ আগেই বোঝা উচিত ছিল একটা রোবটকে বিয়ে করেছি! একটুও অনুভূতি নেই। রসকষহীন মেয়ে একটা!
মোহনা রাফির গলা জড়িয়ে বলল, তাই বুঝি খুব কষ্ট জনাবের তাই না? তা মেয়ে দেখবো নাকি তোমার জন্য? পিহু আর ইলহামের সাথে তোমার বিয়েটাও পড়িয়ে দেই?

অন্য মেয়ে লাগবে কেন বিবিসাহেবা। আপনি বললে আপনার সঙ্গেই আরেকবার বিয়ে করতে রাজী। বিয়ের পর কিন্তু আবার,,,,
কথাটা শেষ করবার আগেই জুয়াইরিয়া দুই হাত কোমড়ে রেখে বললো, বাবাই তোমাদের না একবার বিয়ে হয়েছে আবার করবে কেন? এখন খালামণির সাথে আমারও বিয়ে দাও। আমিও সুন্দর করে বৌ সাজবো।
মেয়ের এমন আবদার শুনে রাফি হাসতে হাসতে তাকে কোলে তুলে বলল, দিবো তো আমার মেয়েকে বিয়ে। আগে রাজকুমারকে তো আসতে দাও।
মোহনা নাক ফুলিয়ে বললো, হয়েছে পুরো বাপের মতো। এইটুকু মেয়ে বিয়ে বিয়ে করে মাথা খাচ্ছে। জানো তুমি ও এই নিয়ে কথাটা কয়বার বলেছে?

রাফি শব্দকরে হাসতে লাগলো। বাবার হাসি দেখে মেয়েও হাসছে। মোহনা মনে মনে বললো, মাশাআল্লাহ।
🌸🌸🌸
হ্যালো পিহু একটু জানালার ধারে আসো তো জলদি।

এখন? এতো মানুষ ঘিরে আছে আমি কিভাবে আসবো?

তুমি আসবা নাকি আমি ভেতরে আসবো?

উফফ দাঁড়াও আমি আসছি

পিহু জানালার ধারে দাঁড়াতেই ইলহাম মই দিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললো, বলেছিলাম চলো পালিয়ে বিয়ে করি, তাহলে আর এতো রীতিনীতি পালন করতে হতোনা আর আমার এডভেঞ্চারিং শখটাও পূরণ হতো।

এই কথা বলতে এতো কষ্ট করে এলে?

উহু। বলতে এসেছি ভালোবাসি পিহু

বলেই হলুদ মাখিয়ে দিলো পিহুর গালে। আমার বৌয়ের গালে আমি হলুদ মাখাবো না তা কি হয়? সেজন্য এসেছি। এখন শান্তি লাগছে।

তুমি আসলেই পাগল!

হুম তোমার পাগল!

¤সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here