#কালো_রাত্রির_খামে (১১)
#লেখা: ইফরাত মিলি
____________________
এক পশলা বৃষ্টি নামুক। না, সাধারণ বৃষ্টি নয়। বিশেষ এক বৃষ্টি নামুক। মেয়েটিকে ভিজিয়ে দিক, ভাসিয়ে নিক যত দুঃখ-দারিদ্র্যতা। মেয়েটি চোখ খুলে নিজেকে সুখী দেখুক। দেখুক সে এক বিশাল রাজ্যের রাজকন্যা। তাকে রাজকন্যা বানাতে বিশেষ সেই বৃষ্টিটা হোক।
আকাশের মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে রাত্রি। ধূসর মেঘে আকাশ ভরাট। সে অপলক তাকিয়ে আছে। কী যেন ভাবছে। তার মনে হচ্ছে এটা আকাশ নয়, এটা যেন তাদের কষ্ট শোভিত কোনো উদ্যান। সে কি সেই উদ্যানে তাকিয়ে ক্লেশ থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে?
অবশেষে বৃষ্টি নামলো কিছুক্ষণ পর। মেয়েটিকে ভেজালো। কিন্তু এটা সেই বিশেষ বৃষ্টি নয়, সাধারণ।
বৃষ্টি নামতেই এবং দূরে কোথাও ব’জ্রপাতের শব্দ হলেই চিলেকোঠায় ঘুমিয়ে থাকা নিঃস্ব ব্যক্তিটি জেগে উঠলো। অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। হঠাৎ স্মরণ হলো সে রোদে কাপড় শুকাতে দিয়েছিল সকালে। ইশ, কাপড়গুলো তো ভিজে গেল। দরজা খুললো সে। একটি শার্ট ও প্যান্ট দড়িতে ঝুলছে আর ভিজছে। মিশাত দৌড়ে ঘর থেকে বের হলো, ভাবলো আবার দৌড়ে ফিরে আসবে। সে এক টানে চট করে কাপড়গুলো দড়ি থেকে হাতে নিয়ে এলো। ফিরতে যাবে এমন সময় রেলিংয়ের দ্বার ঘেঁষে একজনকে দাঁড়ানো দেখতে পেল। প্রথমটায় ভয় পেল, মনে হলো কোনো মানুষ নয়, কোনো জিন তাকে প্রলুব্ধ করতে নিশ্চয়ই এমন বেশে দাঁড়িয়ে আছে। সে দৌড়ে চিলেকোঠায় ফিরলো। ফিরে মনে হলো সে বোকামি করেছে। কী দরকার ছিল কাপড়গুলো ওঠানোর? এগুলো তো এমনিতেই ভিজে গিয়েছিল। সে জানালা দিয়ে উঁকি দিলো। যাকে জিন ভেবেছিল সেই মেয়েটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো শখ করে ভিজছে। আবার মনে হলো শখ করে ভেজার ধরন হয়তো ভিন্ন হতো, অমন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে কেউ শখ করে কেন ভিজবে? তার কাছে ছাতা নেই। না হলে বাইরে বেরিয়ে একবার দেখতো। সে আর বৃষ্টিতে ভিজতে চায় না। বলা তো যায় না, যদি জ্বর বেঁধে যায় তখন? তার কাছে চিকিৎসা করানোর মতো টাকা নেই। সে পোশাক পালটে নিলো। কৌতূহলে আরও একবার উঁকি দিলো জানালা খুলে। মেয়েটি নেই। চলে গেছে? না কি জায়গাটা থেকে সরে গেছে? মিশাত দরজা খুললো। দরজা খুলে এমনভাবে ভয় পেল যে হৃৎস্পন্দনই বেড়ে গেল তার। শ্রাবণী মুখের সম্মুখ থেকে ছাতা উঠিয়ে বললো,
“বৃষ্টিতে ভিজবেন?”
“না না। তুমি কখন এলে?”
“এই মাত্র। আচ্ছা, আপনার নাম কী?”
“মিশাত ইসলাম।”
“আমার নাম শ্রাবণী।”
মিশাত হেসে বললো,
“শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমাতিথি?”
শ্রাবণী বুঝতে পারে না মিশাতের কথা। সে অবাক হয়ে জানতে চায়,
“সেটা আবার কী?”
“তোমার নামের মিনিং।”
“আমি ভাবতাম শ্রাবণী মানে বৃষ্টি সংক্রান্ত কিছু। কারণ শ্রাবণ মাসে তো বৃষ্টি হয়। আপনি কি খুব লেখাপড়া জানা লোক?”
“ইন্টার পাশ করেছি। এরপর ডিগ্রিতে ভর্তি হলেও আর লেখাপড়া হয়ে ওঠেনি। তিন বছর ধরে ঘুরছি-ফিরছি, বাঁশ খেয়েছি, আরও কত কাহিনি।”
“তারমানে আপনি এখন পড়লে ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষে থাকতেন?”
“হুম।”
“তার মানে আপনি আমার ভাইয়ের চেয়ে এক বছরের সিনিয়র।”
“তোমার ভাই আছে?”
“হুঁ, সে…” শ্রাবণী কথা বাড়াতে পারলো না। হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া শুরু হলো। আর তাতে প্রায় তার ছাতা উড়েই যাচ্ছিল। সে ছাতা রাখতে সক্ষম হলেও ছাতাটা উলটে গেল। এই ঝড়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দায়। মিশাত বললো,
“ভিতরে এসো।”
শ্রাবণীর উলটে যাওয়া ছাতাটার দিকে তাকিয়ে অশ্রুপাত হলো। ছাতা উলটে গেছে জানলে ঘরের লোক তাকে বকবে। শ্রাবণীকে কাঁদতে দেখে মিশাত বললো,
“তুমি কাঁদছো কেন?”
“ছাতা ভেঙে গেছে জানলে ঘরের লোক আমায় বকবে। কী করবো আমি? আপনি ছাতা ঠিক করতে পারেন?”
“আমি কীভাবে পারবো? মেকানিকরা পারবে।”
“মেকানিক কোথায় পাবো এখন? আচ্ছা আমি ছাতাটা আপনার কাছে রেখে যাই। আপনি এটা ঠিক করে আনবেন। ঠিক আছে?”
শ্রাবণী আর দাঁড়িয়ে না থেকে বেরিয়ে গেল। মিশাত কিছু বলতে গিয়েও পারলো না। এটা সারাতেও তো টাকা লাগবে, সে টাকা কোথায় পাবে? কালকে দিন মজুরের কাজ করে যা কামাই করেছিল এখন পরের জন্য সেই টাকা খরচ করতে হবে? এ তো মহা ঝামেলা!
___________________
বৃষ্টি হচ্ছে। থেমেছিল মাঝখানে, আবারও শুরু হয়েছে। এত ঘন ঘন বৃষ্টি বিরক্ত করে তুলছে যেন। ঘরকে মনে হচ্ছে সমুদ্র। হাঁটলেই পায়ের নিচে পানি থলথল। সারা ঘরে কেমন স্যাঁতসেঁতে একটা ভাব অনুভব হয়। শ্রাবণী ঘুমাচ্ছে। বৃষ্টিতে কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমাতে আরাম। রাত্রি শুয়ে থেকেও ঘুমাতে পারলো না। তার মস্তিষ্ক থেকে এখনও টিউশনি হারানোর চিন্তাটা যাচ্ছে না। বিষয়টা তাকে পীড়া দিচ্ছে। মালিহা ছাড়া আরও কয়েকজন স্টুডেন্ট তার ছিল। কিন্তু বেশ কয়েক মাস হয়েছে তারা স্কুলের শিক্ষকদের কাছে পড়তে শুরু করেছে। বর্তমানে রাত্রির কোনো স্টুডেন্ট নেই। কয়েকটা টিউশনি জোগাড় করতে পারলে ভালো হতো। বিজ্ঞপ্তি দেবে কি? আজকাল অভিভাবকরা স্কুল-কলেজের বড়ো বড়ো শিক্ষক ছাড়া বাচ্চাদের পড়তে দিতে চায় না। যে কারণে টিউশনি জোগাড় করাও কঠিন। রাত্রি বিছানা ছাড়লো।
এনামুল শিকদার আজ বাড়িতে। বসার ঘরে বসে অফিসের কোনো কাগজপত্র দেখছে। মানুষটাকে তার বয়স অনুযায়ী বেশি বৃদ্ধ দেখাচ্ছে। রাত্রি নিজের টিউশনি হারানোর খবরটা বাবাকে জানায়নি এবং জানাবেও না। নিজের রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে রাত্রি বাবাকে অপলক দৃষ্টিতে দেখছিল। কেন যেন ভালো লাগছিল, আবার দুঃখও লাগছিল মানুষটার জন্য।
রুম থেকে কলের শব্দ আসছে। রাত্রি রিসিভ করার জন্য রুমে এলো। কিন্তু এটা পরিচিত কোনো নাম্বার নয়। ল্যান্ডলাইন থেকে করা কল। রাত্রি অপরিচিত কারো নাম্বার থেকে সহজে কল না রিসিভ করলেও আজকে কী মনে হতেই রিসিভ করলো। রিসিভ করা মাত্রই ওপাশের মানুষটি বলে উঠলো,
“আমি জানি এটা আমি জানলেই আপনি কল কেটে দেবেন। কিন্তু প্লিজ, আপনি কল কাটবেন না, অনুরোধ করছি। একটু সময় কথা বলি আমরা। আপনি কেন পড়াতে আসেন না রাত্রি?”
রাত্রি উত্তর দিলো না। আদিলই আবার বললো,
“আপনার সাথে আমি ওরকম করেছিলাম বলে? কথা দিচ্ছি আর কখনও ওরকম করবো না। আপনার সাথে কথাও বলবো না। প্লিজ আপনি পড়াতে আসুন। আমি আপনাকে একবার দেখতে চাই। আমি আপনাকে না দেখতে পেয়ে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। আমার মস্তিষ্কের ভিতর তোলপাড় হয়ে যায়।”
রাত্রি কিছু বলছে না। সে চুপ করে থাকলে আদিল রেগে যেত। কিন্তু আজ সে রাগলো না। বললো,
“কিছু বলুন রাত্রি।”
“আপনি আমার কাছে আর কল দিবেন না। এসব পাগলামি বন্ধ করুন। আপনার মা আপনার জন্য ভালো মেয়ে দেখে রেখেছে…”
“আমি ওকে পছন্দ করি না। ও মেয়েও আমাকে পছন্দ করে না। কারণ ও ভাবে আমি একটা পাগল। আসলেই কি রাত্রি? আমি পাগল? আর এই একই কারণে আপনিও আমাকে অপছন্দ করেন?”
“ভালো থাকুন, আর সুস্থ হয়ে উঠুন।” বলে রাত্রি কল কেটে দিলো। আদিলের সঙ্গে তার কথা বলার কোনো মানে হয় না। আদিলের পাগলামিকে কিছুদিনের কল্পনা মনে করে ভুলে যাওয়া উচিত।
ঠিক রাত আটটায় রাত্রির মোবাইলে আরও একটা কল এলো এবং এটাও অপরিচিত নাম্বার থেকে। এই কলটাও আদিল দিয়েছে কি না ভাবলো সে। রিসিভ করার ইচ্ছা না থাকলেও শেষমেশ রিসিভ করলো। এবং এই কলের দ্বারা যে তার জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছিল রাত্রি তা একদমই আশা করেনি। একজন ভদ্র মহিলার কণ্ঠস্বর শোনা গেল,
“আসসালামু আলাইকুম। আপনি কি রাত্রি? আপনি ইংলিশ পড়ান?”
“ওয়াআলাইকুমুস সালাম। জি, আমি ইংলিশ পড়াই।”
“আমার একজন মেয়ে আছে। ও ক্লাস টেনে পড়ে। ওর জন্য একজন ইংরেজি টিচার খুঁজছি। আপনি বিকেল টাইমে ওকে পড়াতে পারবেন?”
রাত্রি বিশ্বাস করতে পারছে না কলটা তার কাছে আসলেই এসেছে কি না। সে আনন্দিত তো হলোই বটে, সেই সাথে অবাকও। সে সম্মতি জানালো।
ভদ্র মহিলা নিজের ঠিকানা দিলো। রাত্রি একটা খাতায় তুলে রাখলো ঠিকানাটা। খুব কাছে নয় বাড়িটা। মালিহাদের বাড়ির মতোই দূরত্ব। কিন্তু প্রশ্ন, মহিলা তার খোঁজ পেল কীভাবে? একটা টিউশনি হারানোর পর আরেকটা টিউশনি এত তাড়াতাড়ি পেয়ে যাওয়া অবশ্যই ভাগ্যের ব্যাপার। রাত্রির আনন্দে কাঁদতে মনে চাচ্ছে। এত শান্তি কেন লাগছে তার?
___________________
এমন একটি দিন নেই যে দিনটিতে রেহনুমা সুলতানা কাঁদেন না। এটি যেন তার নিত্য দিনের রুটিনের অংশ। তার কান্না বিশেষ বিশেষ দিনে বেড়ে যায়। এই বিশেষ দিনগুলো হলো যে দিন তার স্বামী তার গৃহে পা রাখেন। তার স্বামী জনাব শরিফুল খন্দকার খুব বেশি এখানে আসেন না। দেখা যায় বছরে দশ-পনেরো দিন তার পদধূলি পড়ে। তাও এ ঘরে তার অবস্থান বড়ো জোর কয়েক ঘণ্টা, এর বেশি নয়। তিনি আসলেই দুজনের মাঝে ঝগড়া হয়, অশান্তি হয়! কখনও কখনও রেহনুমা সুলতানাকে মা’রধরও করেন। ওই লোকটা আসার চেয়ে না আসাই যেন উত্তম। তবে শরিফুল খন্দকার এ ঘরে না থাকলেও, খুব বেশি না আসলেও, মাস শেষে স্ত্রীর একাউন্টে মোটা অঙ্কের টাকা জমা করেন। লোকটা খুব বেশি টাকা ইনকাম করে বলেই হয়তো মোটা অঙ্কের এমাউন্ট জমা করেন। কিন্তু টাকা দিয়েই কি সবকিছু সমাধান হয়? সুখ কেনা যায়? এ ঘরে যে সুখের বড্ড অভাব। ছেলে-মেয়ে দুটো কতটুকু বাবার স্নেহ পেয়েছে? ছেলেটা যা পেয়েছে, মেয়েটা তো তার কিছুই পায়নি। ওরা মেনে নিয়েছে ওদের বাবা খারাপ। ওরা এটা নিয়ে আফসোস করে না। তবে ভিতরে ভিতরে ওরাও যে ভীষণ কষ্ট পায় সেটা বোঝেন রেহনুমা।
ডোর বেল বাজলো। তিনি ধারণা করলেন ওই মেয়েটা এসেছে হয়তো। ওড়নায় চোখ মুছলেন তিনি। যথা সম্ভব স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে দরজা খুললেন। দরজা খোলা মাত্রই মেয়েটি সালাম দিলো। সালামের জবাব দেওয়ার পর মেয়েটা বললো,
“আমি রাত্রি। আজ আপনি আসতে বলেছিলেন।”
রেহনুমা সুলতানা হেসে বললেন,
“আমি ধারণা করেছিলাম আপনিই এসেছেন। ভিতরে আসুন।”
রেহনুমা রাত্রিকে বসিয়ে কিচেনে গেলেন। রাত্রি তার চোখ দুটো খেয়াল করতে ভুল করেনি। দেখে মনে হচ্ছিল ভদ্র মহিলা যেন কাঁদছিলেন। কান্না চোখ সে খুব ভালো করে চেনে। মহিলা খুব সুন্দরও। এমন সুন্দর মুখ সে অনেকদিন দেখেনি। এবার রাত্রি ঘরে একবার দৃষ্টি বুলালো। বাড়িটা এক তলা বিশিষ্ট হলেও এটা আয়তনে কম বড়ো নয়। বসার ঘরটা বৃহৎ আয়তনের। দৃষ্টিগোচর সব জিনিসপত্রে আভিজাত্যের ছোঁয়া। কিন্তু বাড়িটা বড়োই নিঝুম। মনে হচ্ছে না বাসায় রেহনুমা সুলতানা বাদে অন্য কেউ আছে।
রেহনুমা সুলতানা ফিরলেন কিছুক্ষণ পর, দুটো কফির মগ ও সাথে স্যান্ডউইচ নিয়ে।
খাবারদাবার দেখলে রাত্রির খুব অস্বস্তি হয়। সে অন্যের ঘরে তেমন কিছু খেতে চায় না। তবুও সবাই সৌজন্য রক্ষার্থে হালকা নাস্তা দিয়েই থাকে। এটা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। রেহনুমা এক কাপ কফি নিজের হাতে নিয়ে বললেন,
“আমি শুনেছি আপনি খুব ভালো পড়ান। আসলে আমার মেয়েটাকে যে পড়াতো তার পড়া না কি ওর ভালো লাগতো না। এজন্য একজন নতুন টিচার খোঁজা আর কি।”
“ও আচ্ছা।”
“আপনি কোন পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন?”
“অনার্স কমপ্লিট করেছি।” রাত্রি কিছুটা ভয় নিয়ে বললো। বড়োলোক ঘরের মানুষ তো, বাচ্চা পড়ানোর জন্য একেবারে মাস্টার্স পাশ টিচারও খুঁজতে পারেন।
রেহনুমা সুলতানা বললেন,
“ভালো। কবে থেকে পড়াতে আসতে পারবেন?”
“যদি আপনি বলেন তাহলে কাল থেকেও শুরু করা যায়।”
আগামীকাল থেকে পড়াতে আসারই কথা হলো তাদের মাঝে। মাইনে ঠিক হলো দুই হাজার টাকা। বিকেল চারটায়। ঠিক যে টাইমে মালিহাকে পড়াতে যেত। রাত্রির বিশ্বাস হচ্ছে না সে সত্যি সত্যিই টিউশনিটা পেয়েছে।
(চলবে)#কালো_রাত্রির_খামে (১২)
#লেখা: ইফরাত মিলি
____________________
পথে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। রিকশা দুর্ঘটনা। আর সেই রিকশা দুর্ঘটনার কবলে পড়ে রোশনিও আহত হয়েছে। পায়ে ব্যথা পেয়েছে সে। পা র’ক্তাক্ত হয়েছে। প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরছিল। অয়ন সামনে ছিল তার থেকে। দুর্ঘটনা দেখে অয়ন এগিয়ে এলো। আরও কয়েকজন লোক জড়ো হয়েছে। দুর্ঘটনাটা যে কীভাবে ঘটলো কিছু বোঝা গেল না। আচমকা রিকশাটা যেন কাত হয়ে পড়ে গেল। আর রিকশার একটা অংশ এসে পড়লো রোশনির পায়ে। রিকশা চালক ও যাত্রী রোশনির থেকে বেশি আহত হয়েছে। অয়ন এসে দেখলো রোশনি রাস্তায় বসে আছে। র’ক্ত বের হচ্ছে তার পা থেকে। যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে রেখেছে। অয়ন বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে চাইলো না। সে যখনই জায়গাটা থেকে সরে যাবে রোশনি তখনই বলে উঠলো,
“কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
রোশনির কথা কানে আসলেই অয়ন দাঁড়ালো। পিছন ফিরে রোশনির দিকে তাকাতেই রোশনি বললো,
“আপনি যাবেন না।”
ততক্ষণে উপস্থিত লোকগুলোর দৃষ্টি অয়নের উপর পড়েছে। একজন জানতে চাইলো,
“আপনি ওনাকে চেনেন?”
রোশনি বললো,
“চিনবো না কেন? আমরা পরিচিত।”
আহত তিনজনকে নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রোশনি অয়নকেও নিয়ে এসেছে সাথে। অয়ন মনে মনে আসতে অনিচ্ছুক হলেও লোকগুলোর সামনে এ কথা বলতে পারেনি। তাছাড়া মেয়েটা তো আসলেই তার পরিচিত, এমন অবস্থায় তার চলে যাওয়াও খারাপ দেখাতো। রোশনির পায়ে ছোটোখাটো একটি ব্যান্ডেজ। তার কেবল পা কে’টে গেছে। কিন্তু সে এমন একটা ভাব করছে যেন আঙুলের হাড়ও ভেঙে গেছে।
অয়নকে বললো,
“আপনি আমাকে একটু বাড়িতে পৌঁছে দেবেন? আমি একা একা যেতে পারবো না।”
রোশনির মনে হয়েছিল অয়ন বলবে,
‘আপনি আমার কে হন? আমি পর মানুষের জন্য কিছু করতে পারবো না।’
কিন্তু অয়ন আজ এমন কিছু বললো না। বললো,
“ঠিক আছে, আপনাকে সিএনজিতে উঠিয়ে দিচ্ছি।”
বলে অয়ন দরজার দিকে এগোনো দিলেই রোশনি বললো,
“আমি একা একা হাঁটতে পারছি না, আপনার কি উচিত না আমাকে একটু সাহায্য করা?”
অয়ন যেন শুনতেই পেল না এ কথা। বেরিয়ে গেল সে। একটা সিএনজি দাঁড় করালো। রোশনি তখনও এসে পৌঁছয়নি। ইচ্ছা করে একটু বেশিই দেরি করলো। প্রায় আট মিনিটের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হলো অয়নকে। অথচ রোশনির পাঁচ মিনিটেই বের হওয়ার কথা। অয়ন সিএনজিটা দেখিয়ে বললো,
“এটাতে যান।”
“এটাতে যান মানে? আপনি যাবেন না?”
“আমার পা ঠিকই আছে, আমি হেঁটেই যেতে পারবো।”
“আপনি কেমন মানুষ? একটা অসুস্থ মানুষকে আপনি সিএনজিতে উঠিয়ে দিয়েই দায় সারতে চান? যদি পথে সমস্যা হয়? দয়া করে আপনি আমাকে বাড়ি পর্যন্তই সঙ্গে নিয়ে যান। অসুস্থ মানুষের সেবা করুন, সওয়াব পাবেন।”
সিএনজি চালক বললো,
“আপা যখন কচ্ছে তখন আপনিও চলেন।”
সিএনজি চালক এমন বলছে কারণ দুজন গেলে সে ভাড়া বেশি পাবে। অয়ন বুঝলো ব্যাপারটা। সে চালকের পাশের সিটে উঠে বসলো।
সিএনজি থামলো রোশনির বাড়ির সামনে। দুজনই নামলো। কেউই ভাড়া দিচ্ছে না দেখে সিএনজি চালক ভাড়া চাইলো। অয়ন রোশনিকে বললো,
“ভাড়া দিন।”
রোশনি অবাক হলো। তাকে ভাড়া দিতে বলছে? কেমন ছেলে? ভাড়া তো ছেলেটার নিজেরই দিয়ে দেওয়া উচিত। এমনটাই তো ঘটে থাকে সাধারণত। তবে এ ছেলের বেলায় যে তা হবে না, এটাও তার বোঝা উচিত ছিল। রোশনি কিছু না বলে দিয়ে দিলো ভাড়াটা। অয়ন বোধহয় এখন চলে যাবে। রোশনি তার আগে বললো,
“একটা কথা বলবো?”
“কী কথা?”
রোশনির যদিও কথাটা বলতে লজ্জা লাগছে, তবুও সে লজ্জা ফেলে বললো,
“আপনার ওই ছোটো ছোটো চোখ দুটো আমার ভালো লাগে!”
অয়নের এ কথায় লজ্জা পাওয়া উচিত ছিল। কোনো মেয়ে যদি কোনো ছেলেকে বলে আপনার চোখ ভালো লাগে লজ্জা পাওয়াটা স্বাভাবিকই। কিন্তু মনে হলো অয়ন লজ্জা পায়নি। সে উলটো বললো,
“ছোটো চোখের ছেলেরা তো বেয়াদব হয়।”
“হ্যাঁ হয়, আমি আপনার বেয়াদবিও পছন্দ করি।”
একটু যেন অপ্রস্তুত হলো অয়ন। তবে সেটা রোশনিকে বুঝতে দিলো না। বললো,
“যাই পছন্দ করুন না কেন, আমাকে পছন্দ করতে যাবেন না। এটা আপনার জন্য পরামর্শ।”
রোশনি ভাবলো, সে কি অয়নকে পছন্দ করে? না এমন মনে হচ্ছে না। সে কেবল জানে সে অয়নের চোখ এবং বেয়াদবি পছন্দ করে। হ্যাঁ তার পছন্দের বিষয় দুটো অদ্ভুত, তবে সত্যি। চাইলে অয়নকেও পছন্দ করা যায়, কারণ সে সুন্দর। যে মানুষটি তার বেয়াদবি মেনে নিতে পারবে সে মানুষটির কাছে অয়ন নির্ঘাত পছন্দসই মানুষ। রোশনি কখনও এমন করে ভাবেনি। হঠাৎ মনে হলো- হ্যাঁ, সে তো গোটা অয়নকেই পছন্দ করে। আবার মনে হলো- না। রোশনি জানতে চাইলো,
“আপনাকে পছন্দ করা যাবে না কেন? আপনি কি খারাপ মানুষ?”
“খারাপ কি না জানি না, তবে অভাবের মতো বাজে আর কিছু নেই।”
বলে অয়ন আর দাঁড়ালো না।
রোশনি বিস্ময়ের আঁখি মেলে চেয়ে রয়। অয়ন গেট দিয়ে নিজের বাড়ির সীমানায় ঢুকেছে। কিন্তু রোশনি দাঁড়িয়ে রয়। কেন যেন তার মনে হয় সে অয়নকে পছন্দ না করলেও খুব শীঘ্রই বোধহয় অয়ন তার পছন্দের মানুষ হবে। জীবনের প্রথম পছন্দের মানুষ। রোশনি এ কথা ভেবে শিউরে ওঠে। আসলেই কি এমন হবে?
__________________
তাদের বাড়ির সম্মুখে একটি লোক। দেখে মনে হচ্ছে না বাড়ির ভিতরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কিন্তু তাদের বাড়ির সম্মুখে অপরিচিত কেউ কেন দাঁড়িয়ে থাকবে? ওদিকে সন্ধ্যা ঘনাতে শুরু করেছে। আজান হতে বেশি সময় বাকি নেই। শ্রাবণী এগিয়ে গেল। এতক্ষণ সুমি আপুদের বাসায় ছিল সে। লোকটাকে বললো,
“আপনি কে?”
লোকটা শ্রাবণীর দিকে ফিরে হেসে হাত নেড়ে বললো,
“হাই!”
শ্রাবণী প্রত্যুত্তর দিলো না। লোকটা জানতে চাইলো,
“এই বাড়ির নাম চামেলি ভিলা?”
“হ্যাঁ। আপনি কে?”
“রাত্রি নামের কেউ থাকে এখানে? সম্ভবত দ্বিতীয় তলায়। তার বাবার নাম এনামুল শিকদার, সৎ মায়ের নাম প্রিয়ারা, বড়ো বোনের নাম…”
লোকটা একে একে সবার নাম বললো। শ্রাবণীর চক্ষু কপালে। কে এই লোক? তাদের পরিবারের সবার নাম বলছে কীভাবে? একে জীবনে দেখেছে বলে তো মনে পড়ে না।
লোকটা বললো,
“কী? এমন কেউ নেই?”
“আছে। কিন্তু আপনি কে?”
লোকটা উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করলো,
“তুমি কে?”
“আমার নাম শ্রাবণী।”
“ছোটো বোন? কেমন আছো শ্রাবণী? তোমার বোনকে গিয়ে বলো কেউ একজন তার সঙ্গে দেখা করার জন্য গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে খুব তাড়াতাড়ি এসে দেখা করতে বলো।”
শ্রাবণীর লোকটাকে সুবিধার মনে হচ্ছে না। সে দ্রুত বাড়ির ভিতরে ঢুকলো। আপু কি এই লোককে চেনে? সে ঘরে এসে খবর দিলো,
“আপু, কেউ একজন এসেছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে।”
“কে?”
“চিনি না। বললো তোমার আপুকে খুব তাড়াতাড়ি এসে দেখা করতে বলো। আমাদের বাসার সবার নাম তার মুখস্থ। সাংঘাতিক মনে হলো লোকটাকে।”
“বলিস কী?”
“হ্যাঁ।”
রাত্রি চিন্তায় পড়লো। কে আছে যে এমনভাবে এসে তার খোঁজ করছে? অবশ্যই পরিচিত, কিন্তু কে?
“ছেলে না মেয়ে?” রাত্রি প্রশ্ন করলো।
“ছেলে।”
“ছেলে?”
রাত্রি এবার আরও অবাক হলো। তার কোনো ছেলে বন্ধু ছিল না শিক্ষা জীবনে। এমন করে কে আসতে পারে? মনে পড়লো তানবীনের কথা। হ্যাঁ, এটা হলে সে হতে পারে। বাড়ি পর্যন্ত এসে গেছে ছেলেটা? ভাগ্যিস শ্রাবণীর কাছে বলেছে। যদি বিল্ডিংয়ের অন্য কারো কাছে জিজ্ঞেস করতো? কী ভাবতো তারা? কী জন্য এসেছে? আর এত জরুরি তলবই বা করার মানে কী?
রাত্রি নিচে নামলো। কিন্তু আশ্চর্য! গেটের বাইরে কেউ নেই। রাত্রি এদিক-ওদিক দেখছে। কেউ কি মজা করলো তাদের সঙ্গে? আচমকা পিছন থেকে কেউ ডেকে উঠলো,
“রাত্রি!”
আচমকা পিছন থেকে ডাকায় রাত্রি ভয় পেয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে পিছনে তাকালো সে। একটি হাসি ভরা মুখ। তবে সে যা ভেবেছিল তা নয়, এই হাসি মুখটি অন্য কারোর। তবে সেইজনও পরিচিত জন।
যে ছেলেটা ঘর থেকে বের হয় না, সেই ছেলে এই সন্ধ্যা ক্ষণে তাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে এ কথা রাত্রির বিশ্বাস হতে চায় না। সে রুদ্ধ চোখে দেখছে আদিলকে। আদিল হেসে বললো,
“কী ভেবেছিলেন? আদিল আপনাকে ভুলে গেছে?”
“আ…আপনি কেন এসেছেন?” কথা বলতে গলা কাঁপে রাত্রির।
আদিল এক পা নিকটে এগোনো দিলে রাত্রি দূরে সরে গেল। আদিল আর এগোলো না। বললো,
“আমি জানি আপনিও আমাকে ভোলেননি।”
আদিল এবার এক পা নিকটে এগিয়ে রাত্রির হাতে কিছু গুঁজে দিলো। একটি শুকনো ফুল। রাত্রি বললো,
“এটা কী?”
“জবা! আপনার ফিরিয়ে দেওয়া জবা ফুল।”
রাত্রি হাত মুঠোবন্দি করে ফেললো। দুমড়ে মুচড়ে গেল শুকনো জবাটি।
আদিল বললো,
“আপনি আমার বিয়েতে যাবেন তো?”
রাত্রি না বোধক মাথা নাড়ে।
“না।”
“কেন যাবেন না? আমি আপনাকে দাওয়াত দেবো। আপনার অবশ্যই যেতে হবে।”
রাত্রি যাবে না সত্ত্বেও আদিলকে মানাতে বললো,
“আচ্ছা যাব।”
আদিল মৃদু হেসে বললো,
“না, আপনি যাবেন না। আপনার যাওয়া উচিত নয়। বলা তো যায় না, ওই মেয়েকে বিয়ে না করে যদি আপনাকে বিয়ে করে ফেলি?”
“আচ্ছা, যাব না তাহলে।”
“আপনার কী মনে হয়? আমি সত্যিই ওকে বিয়ে করবো তো?”
আদিলের কথায় ভীষণ রকম চমকায় রাত্রি। আদিল কি বিয়েটা করবে না বলে জিদ ধরবে? রাত্রি বললো,
“আপনার বিয়েটা করা উচিত।”
“আপনারও তো উচিত আমাকে ভালোবাসা। কই আপনি ভালোবাসেন?”
রাত্রির মাথা নুয়ে যায় সামান্য। কী বলবে বুঝতে পারে না।
আদিল হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি আকাশ ভালোবাসেন রাত্রি?”
রাত্রিও আকাশের দিকে তাকায়। আকাশে যখন মেঘ জমে কালো হয়, তখন সেই কালো রূপকে তার মনে হয় অভাবীদের দুঃখ-কষ্ট, আর এ কারণে সে আকাশ ভালোবাসে না। সে উত্তর দিলো,
“না।”
আদিল ভেবেছিল উত্তর ‘হ্যাঁ’ হবে। উত্তর না হওয়াতে সে আশ্চর্য হয়ে বললো,
“না কেন? ও…এজন্যই তো আপনি পাষাণ। কেউ আকাশ ভালো না বেসে পারে?”
“আমি পারি। আপনি আর কিছু বলবেন? এই সন্ধ্যায় আপনি বাইরে বের হয়েছেন কেন?”
“আপনি আমায় নিয়ে চিন্তিত? মানুষ কখন একটা মানুষকে নিয়ে চিন্তিত বোধ করে বলুন তো?”
“জানি না। আপনি বাড়ি যান।”
রাত্রি আর কিছু না বলে গেট পেরিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকলো। কিছুদূর গিয়ে আবার দাঁড়ালো সে। পিছন ফিরে তাকালো আদিল গিয়েছে কি না দেখার জন্য। সে পিছন ফিরে তাকাতেই আদিল বললো,
“পিছন ফিরে তাকাবেন না, বিপদে পড়ে যাবেন।”
বলে সে গেট থেকে সরে পড়লো।
রাত্রি নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ শূন্য গেটে। হঠাৎ যেন তার চিন্তা হলো, আদিল যেতে পারবে একা? আজান হচ্ছে। রাত্রি আর বাইরে দাঁড়িয়ে রইল না।
(চলবে)