কালো রাত্রির খামে পর্ব -১৭+১৮

#কালো_রাত্রির_খামে (১৭)
#লেখা: ইফরাত মিলি
___________________

শায়লা বেগম বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আজ ওই ছেলেটাকে তিনি ধরবেন। তিনি এখন চেনেন অয়নকে। অয়ন সেই বেয়াদব ছেলেটা, যে ছেলেটার কাছ থেকে এখানে আসার প্রথম দিন সাহায্য চেয়ে তারা পায়নি। সেই বেয়াদব ছেলেটাকে তার মেয়ে ভালোবাসে এ তার ভাবতেই যেন লজ্জা করছে। এ সময় ছেলেটা টিউশনি পড়িয়ে বাড়ি ফেরে। সেজন্য শায়লা বেগম একটু আগেভাগেই নেমে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু মনে হচ্ছে খুব বেশিই আগে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। রোশনি আজ প্রাইভেট পড়তে যায়নি, সে এখন ঘুমাচ্ছে।

টানা তেরো মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে অয়নের দেখা পাওয়া গেল। শায়লা একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত অয়নকে দেখে নিলেন। ছেলেটা দেখতে সুন্দর। কিন্তু সৌন্দর্য মানুষের সবকিছু নয়। কিন্তু তার মেয়েটা এই ছেলের সৌন্দর্যে ফেঁসে গেছে। এমনটা কেবল বোকা মেয়েরা করে। কারণ বিচক্ষণ মেয়েরা কেবল সৌন্দর্য যাচাই করবে না, সেই সঙ্গে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও যাচাই করবে। যেমন- ছেলেটার পারিবারিক অবস্থা, আচার-আচরণ, চারিত্রিক গুণাবলি ইত্যাদি। অয়ন তার সম্মুখ অতিক্রম করে যাওয়া দিলে শায়লা বেগম ডাকলেন,
“এই ছেলে, শোনো।”

ছেলেটা দাঁড়ালো না। হয়তো শুনতে পায়নি। শায়লা এবার একটু উঁচু স্বরে ডাকলেন,
“এই ছেলে, দাঁড়াও।”

অয়ন এবার দাঁড়ালো। শায়লা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি?”

“হ্যাঁ, এদিকে এসো।”

অয়ন এগিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, বলুন।”

“নিজেকে ভাবো কী তুমি?”

অয়ন ভীষণ চমকে গেল। মহিলা তার সঙ্গে এরকম করে কথা বলছে কেন? যতদূর মনে পড়ে এ মহিলাকে সে এর আগে হয়তো দেখেওনি। সে বললো,
“নিজেকে কী আর ভাববো? বাঘ অথবা ভাল্লুক তো নই। আমি মানুষ। তাই মানুষই ভাবী।”

“নিজেকে কি খুব চালাক মনে করো?”

“জি না, তবে মনে হচ্ছে আপনি এমন মনে করছেন।”

“আমার মেয়েটাকে কী বলে পটালে বলো তো?”

এ প্রশ্নে অয়ন যেন আকাশ থেকে পড়লো। মেয়ে পটানোর প্রসঙ্গ তার সঙ্গে? আজব ব্যাপার! তার মনে পড়ে না সে কোনোদিন এমন কিছু করেছে কি না। বললো,
“আপনার মেয়ে কে?”

“ওহ, এখন আমার মেয়েকে চিনতে পারছো না?”

অয়ন লক্ষ করলো তারা এখন রোশনির বাসার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটু ভেবে বললো,
“আপনি রোশনির মা?”

“এই তো চিনতে পেরেছো। বোকা সাজার চেষ্টা করো, তাই না? কী বলে পটিয়েছো আমার মেয়েকে?”

“কিছু বলে পটাইনি তো। আপনার মেয়ে বোকা। অযথাই আমাকে পছন্দ করেছে।”

“আমার সামনে ইনোসেন্ট সাজার চেষ্টা করো না একদম। ভালোই বুঝতে পারি আমি সবকিছু। আমাকে কি বোকা পেয়েছো তুমি? তোমাকে বলছি, নিজের সীমা ভুলে যেয়ো না।”

অয়ন হেসে বললো,
“আমি আমার সীমা সম্পর্কে ভীষণ সচেতন ম্যাম। তা নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আপনি আপনার মেয়েকে বোঝান। শুধু শুধু আমাকে পছন্দ করে লাভ নেই।”

“তোমার কাছ থেকে শুনতে হবে আমায় কী করতে হবে, না করতে হবে?”

“শুনবেন, কারণ যেহেতু আপনি কিছু না জেনে আমাকে কথা শোনাতে এসেছেন। আপনার মেয়েকে আমার থেকে খুব দূরে থাকতে বলবেন। আমি আপনার মেয়েকে পছন্দ করি না, আপনার মেয়ে পছন্দ করে, বুঝতে পেরেছেন? একটু জেনেশুনে কথা বলতে আসা বোধহয় ভালো।”

অয়ন আর দাঁড়িয়ে থাকলো না। বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।

শায়লা বেগমের মুখ অপমানে থমথম। ছেলেটার এত সাহস তাকে এরকম ভাবে কথা শোনালো? আর রোশনির সম্পর্কে কী শুনলো এটা? ছেলেটা ওকে পছন্দ না করা সত্ত্বেও ও পছন্দ করে? ছি! এ মেয়ে তার? এরকম বেয়াদব, গরিব ছেলেকে ওর মতো মেয়ে কোন দুঃখে পছন্দ করলো? তার মেয়েটা আসলেই গর্দভ!

___________________

পারভীনের সঙ্গে রাত্রির দেখা হলো গেটের সম্মুখে। রাত্রি পারভীনকে দেখে খুব অবাক হলো। পারভীন তাদের বাড়িতে কেন? কিছু কি ঘটেছে? আদিলের কিছু হলো না কি? রাত্রি বিস্ময় নিয়ে বললো,
“আপনি এখানে আন্টি?”

পারভীন বললেন,
“শুনলাম তোমার না কি বিয়ে ঠিক হয়েছে? তানবীন নামের কারো সঙ্গে?”

হ্যাঁ, রাত্রি আর তানবীনের বিয়ে নিয়ে দুই পরিবারের মাঝেই পাকাপাকি কথা হয়ে গিয়েছে। গতকালকেই সবটা পাকাপাকি হলো। রাত্রি বললো,
“জি।”

পারভীন রাত্রির মাথায় স্নেহের হাত রেখে বললেন,
“খুব সুখী হও তুমি, দোয়া রইল।”

রাত্রির কেন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। হয়তো পারভীন আদিলের মা বলেই এমন হচ্ছে। সে বললো,
“ধন্যবাদ আন্টি! কিন্তু আপনি কেন এসেছিলেন বললেন না তো?”

পারভীনের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি এসেছিলেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু তিনি বড্ড দেরি করে এসেছেন। প্রিয়ারা আর মিথিলার কাছ থেকে শুনেছেন রাত্রির বিয়ে ঠিক হয়েছে। এ কথা শোনার পর তিনি আর বিবাহের প্রস্তাব পেশই করতে পারলেন না। ভালো একজন ছেলের সঙ্গে বিয়ের কথা পাকাপাকির পর তার ছেলের জন্য প্রস্তাব রাখা বড়োই হাস্যকর। পারভীন তার আসার কারণটা গোপন করে বললেন,
“তোমাকে দেখার জন্য এসেছিলাম। তোমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই যাচ্ছিলাম, ভাবলাম একবার দেখে যাই।”

“ওহ।” রাত্রি থেমে আবার প্রশ্ন করলো,
“মালিহা ভালো আছে?”

“হ্যাঁ, আলহামদুলিল্লাহ।”

“আদিল ভাইয়া কেমন আছেন? উনি সুস্থ হয়েছেন?”

পারভীন দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে উত্তর দিলেন,
“হ্যাঁ, মোটামুটি।”

“ওনার বিয়ে কবে?”

পারভীন রাত্রিকে আদিলের বিয়ে ভাঙার কথাটা জানালেন না। বললেন,
“তারিখ এখনও ঠিক হয়নি। ওর বিয়ে হতে দেরি হবে। ওর আগে হয়তো তোমার বিয়েটা হয়ে যাবে।”

রাত্রি ভেবেছিল আদিলের খুব শীঘ্রই বিয়ে হবে। কিন্তু তার বিয়ে হতে দেরি হবে শুনে কেন যেন ভালো লাগলো না। আর পারভীনের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে তিনি যেন কিছু লুকোচ্ছেন। রাত্রি বললো,
“আদিল ভাইয়া কি সত্যিই ভালো আছে?”

“হ্যাঁ ভালো আছে। আচ্ছা আমি এখন যাচ্ছি তাহলে। যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। ভালো থাকো।”

পারভীন আর এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকলেন না। তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল রাত্রি। খুব তাড়াহুড়া করে চলে গেলেন যেন। কিন্তু কেন? পারভীন শুধুমাত্র তাকে দেখতে এসেছিল? ব্যাপারটা কেমন খটকা লাগছে। কিন্তু অন্য কিছুও তো বললেন না তিনি।

___________________

আদিল আর মালিহা অপেক্ষা করছিল কখন পারভীন ফিরবেন। কলিং বেল বাজলেই কেমন এক উত্তেজনা কাজ করতে শুরু করলো তাদের ভিতর। বিশেষ করে আদিলের মাঝে। মালিহা দরজা খোলার জন্য উঠতে গেলেই আদিল বললো, সে দরজা খুলবে। সে গিয়ে দরজা খুললো। তার ঠোঁটে হাসি। তবে দরজা খোলার পর তার ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেল। মায়ের মুখ সন্তোষজনক ঠেকছে না।
পারভীন ভিতরে প্রবেশ করলে আদিল দরজা লাগিয়ে বললো,
“কী হয়েছে মা?”

পারভীন কোনো উত্তর প্রদান করলেন না। হেঁটে গেলেন রুমের দিকে। আদিলও মায়ের পিছন পিছন এসে রুমে প্রবেশ করলো। পারভীন হিজাবের পিন খুলছেন। আদিল বললো,
“কী বলেছেন উনি? উনি কি আমাকে বিয়ে করতে চান না?”

পারভীন কিছু বললেন না। আদিল ধৈর্য হারা হয়ে বললো,
“তুমি কিছু বলছো না কেন?”

পারভীন ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমরা এটা নিয়ে আগামীকাল কথা বলবো আদিল।”

“আগামীকাল কেন? না, আজ কথা বলবো আমরা। এটা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টপিক। বলো, উনি কি আমায় বিয়ে করতে অনিচ্ছুক?”

আদিলকে কথাটা জানানোর পর আদিল কেমন আচরণ করবে সেটা নিয়ে চিন্তিত পারভীন। কিন্তু সত্যিটা তো ওকে জানাতে হবে। না হলে হয়তো ওর পাগলামি বন্ধ হবে না। তিনি বললেন,
“রাত্রির অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে!”

আদিল মায়ের কথা স্পষ্টভাবে শুনতে পেলেও যেন বিশ্বাস করতে চাইলো না। মনে হয় মা মিথ্যা বলছে। আবার ব্যাপারটা সত্যি হতেও পারে। রাত্রির তো আগেও অনেক বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে, কিন্তু একটাও বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি তাদের দরিদ্রতার জন্য। আদিল বললো,
“হ্যাঁ, হতে পারে। তাতে কী হয়েছে? ওনার এর আগেও বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, হয়নি তো।”

“এবারেরটা হবে। কারণ পাত্রপক্ষ কোনো কিছু দাবি করেনি। কোনো কিছুই নিবে না তারা। ওদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সবকিছু জেনেশুনেই তারা রাত্রিকে নিতে চাইছে। এবারের বিয়েটা সত্যিই হবে। বুঝতে পারছো তুমি?”

আদিলের এসব বিশ্বাস হচ্ছে না। মা নিশ্চয়ই বানিয়ে বানিয়ে বলছে। হয়তো মা রাত্রিকে পছন্দ করে না। মা হয়তো রাত্রিদের বাড়িতেই যায়নি। কিন্তু যদি সত্যিই মায়ের কথা সত্যি হয়? আদিলের হঠাৎ কেন যেন ভয় হলো। সে আচমকা বললো,
“আমি রাত্রির সঙ্গে দেখা করবো।”

পারভীন অবিশ্বাস্য চোখে তাকালেন,
“কী বলছো তুমি? তোমার আর রাত্রির আশেপাশেও যাওয়া উচিত না। ওকে ওর মতো ভালো থাকতে দাও। আমি অনুরোধ করছি তোমাকে, প্লিজ।”

“আমিও চাই উনি ভালো থাকুক। আর এটাও চাই তার ভালো থাকার শুরুটা আমার সাথে হোক। আমি তার সাথে দেখা করবোই। আমাকে দেখা করতেই হবে।”

আদিল রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। পারভীন বলে উঠলেন,
“পাগলামি করো না আদিল। ঘর থেকে এক পা বের হবে না তুমি।”

আদিল কথা শোনে না। পারভীনও ছেলের পিছন পিছন বেরিয়ে এলেন। সদর দরজা খুলে বের হতে গেলেই পারভীন ওর এক হাত টেনে ধরলেন। আদিল মায়ের দিকে তাকালো। পারভীন বললেন,
“বাড়াবাড়ি করো না বাবা।”

আদিল হাসলো,
“ভালোবাসা বিষয়টাই এরকম, একটু বাড়াবাড়ি করতেই হয়।”

পারভীন ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার ছেলেটা হঠাৎ খুব পালটে যাচ্ছে। ভালো হচ্ছে না কি আরও বেশি অসুস্থ হচ্ছে বুঝতে পারছেন না তিনি!
আদিল বললো,
“হাত ছেড়ে দাও মা। আমাকে যেতে হবে।”

আদিল এমন ভাবে বললো যেন ওর হাত ধরে রাখলে খুব বড়ো ক্ষতি হয়ে যাবে। পারভীন সম্মোহিতের মতো আদিলের কথা শুনলেন। হাত ছেড়ে দিলেন তিনি। আদিল চলে গেল, তিনি ডাকতে গিয়েও পারলেন না। টের পেলেন কষ্টে যেন তার বুকের ভিতরটা পাথর হয়ে যাচ্ছে।

নিজ বাড়ি থেকে রাত্রির বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে আসলো আদিল। তাকে সরাসরি রাত্রিদের ঘরের দরজায় যেতে হলো। দরজায় করাঘাতের একটু পরেই দরজা খুলে গেল। আদিল চাইছিল দরজা খুলে দেওয়া ব্যক্তিটা যেন রাত্রি হয়। তার প্রত্যাশা বাস্তব হলো।

দরজা খুলে ভীষণ রকম চমকে গেল রাত্রি। দরজা খুলে আদিলকে দেখবে এ যেন স্বপ্ন বৈ আর কিছুই নয়। আদিলের মুখ ঘেমে একাকার। কেমন উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছে তাকে। রাত্রি হতবিহ্বল হয়ে পড়ছিল আদিলকে দেখে, দ্রুত স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললো,
“আ…আপনি?”

“আপনার সঙ্গে আমার কথা বলা প্রয়োজন। আমি কি ভিতরে আসবো?”

আদিল ভিতরে ঢুকতে চাইলেই রাত্রি বাধা দিলো। আদিলকে সে কিছুতেই ভিতরে নিয়ে যেতে পারবে না। আদিল কী না কী বলবে বাসার লোকজনের সামনে তার ঠিক নেই। আর আদিলের কী এমন জরুরি কথা যে এই রাতে তার বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছে! রাত্রি বললো,
“দেখুন আজ কথা বলা সম্ভব নয়, অন্য কোনো দিন…”

“আজই।” রাত্রির কথার মাঝে কথা বললো আদিল। ভীষণ কড়া করে।

রাত্রি বুঝতে পারছে না কী করবে। ভিতরে নিয়ে তো বসানো যাবে না আদিলকে। আর বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বললেও মানুষজন দেখবে। এই রাতে কোনো ছেলের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারটা নিশ্চয়ই কেউ ভালো চোখে দেখবে না। আবার আদিলকে এভাবে তাড়িয়ে দেওয়ার মতো করে ফিরিয়ে দেওয়াও যায় না। রাত্রির মাথায় হঠাৎ ছাদের কথাটি এলো। হ্যাঁ, ছাদে যাওয়া যেতে পারে। রাতের বেলা কেউ ছাদে যাতায়াত করে না। দিনের বেলায় যারা যায় তাও শুধু কাপড় রোদে দিতে। চিলেকোঠার ছেলেটাও না কি নাইট গার্ডের চাকরি নিয়েছে। সুতরাং ছাদে গিয়ে কথা বলাই ভালো। রাত্রি দরজা টেনে আদিলকে নিয়ে ছাদে এলো। চিলেকোঠার সামনের বাতিটা জ্বলছে। এছাড়াও দূরের বিল্ডিংগুলো থেকে ভেসে আসছে কৃত্রিম আলো।
আদিল রাত্রিকে সেই কৃত্রিম আলোয় দেখছে। মনে হচ্ছে রাত্রি যেন অনেক সুন্দর হয়ে গেছে আগের চেয়ে। হয়তো সে রাত্রিকে এখন আর দেখতে পায় না বলে এমন মনে হচ্ছে। সে প্রথম যে প্রশ্নটা করলো সেটা হলো,
“আপনার না কি কারো সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে?”

রাত্রি বুঝতে পারলো আদিলের কথা বলতে আসার বিষয়বস্তু কী। সে আগেই এমন কিছুই ধারণা করেছিল। হয়তো পারভীনের থেকে কথাটা শোনার পরপরই ছুটে এসেছে। রাত্রি বুঝতে পারছে না পারভীন কেন আদিলকে কথাটা বলতে গেলেন। তিনি তো জানেন তার ছেলে সম্পর্কে। আর আদিলেরও তো অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে ঠিক করা, তাহলে কেন সে এখনও এখানে আসবে?
রাত্রি বললো,
“জি, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।”

আদিল যেন খুব বড়ো একটা ধাক্কা খেলো। সে চেয়েছিল মায়ের কথা মিথ্যা হোক। অবশ্য রাত্রিও যে তাকে মিথ্যা বলছে না তার কী নিশ্চয়তা! সে জানতে চাইলো,
“আসলেই?”

“আমি আপনাকে মিথ্যা কেন বলবো? সত্যিই বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

আদিল নীরব হয়ে গেল। নীরবতাটা বিদ্যমান রইল কীয়ৎক্ষণের জন্য। অতঃপর বললো,
“বিয়েটা কি হবেই?”

“হয়তো।”

আদিল আবারও কিছু সময় নীরব থাকলো, মাথা নিচু করে। হঠাৎ মাথা তুলে করুণ দৃষ্টি ও কণ্ঠে বললো,
“আমার কী দোষ ছিল রাত্রি?”

এমন প্রশ্নের সম্মুখে রাত্রি ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কোনো উত্তর দিলো না। আদিল বললো,
“আচ্ছা, আপনি আমাকে বিয়ে করতে পারেন না? আমি তো খারাপ নই। আমি খারাপ?”

“অবশ্যই আপনি খারাপ নন। তবে আমি ইতোমধ্যে তার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আর আপনিও অন্য…”

“কার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আপনি?” রাত্রির কথার মাঝে প্রায় চিৎকার করে উঠলো আদিল, “কে সে? সে কি রাজা? তাকে কথা দিলে কথা রাখতেই হবে?”

আদিল রেগে গেল। তবে দ্রুতই বুঝতে পারলো রেগে যাওয়া তার উচিত হয়নি। হ্যাঁ, এরকম আচরণ করা উচিত হয়নি তার। রাত্রি যেন কিছুটা ভয় পেয়ে গেছে। আদিল নরম গলায় বললো,
“আপনি আপনার প্রতিজ্ঞা ফিরিয়ে নিন রাত্রি। আমি আপনাকে ভালো রাখবো। বিশ্বাস করুন আমাকে।”

“আপনিও বোঝার চেষ্টা করুন। আসলে আমার ফ্যামিলি থেকে বিয়েটা ঠিক করেছে।” অসহায় গলায় বললো রাত্রি। তার দু চোখে বিনীত অনুরোধ।

আদিল হেসে ফেললো হঠাৎ। হালকা মাথা দুলিয়ে বললো,
“তাই তো, আপনি আমাকে কেন বিয়ে করবেন? আমি তো অসুস্থ, মানুষের ভাষ্যমতে পাগল আমি। আমাকে কেন বিয়ে করবেন? যার সঙ্গে আপনার বিয়ে হবে সে নিশ্চয়ই আমার মতো নয়। সে তো সুস্থ। হ্যাঁ, তাকেই বিয়ে করুন। আমি তো পাগল। পাগলামি করি।”

বলতে বলতে আদিলের চোখে অশ্রু এসে গেল। কেটে গেল ঠোঁটের হাসি।
রাত্রির খুব খারাপ লাগছে। তার জন্য কেউ কষ্ট পাবে এ তার কাম্য ছিল না। কিন্তু সে এটাও জানে সে যা করছে সেটা সঠিক। রাত্রি বললো,
“ইনশাআল্লাহ আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন।”

“কী লাভ? আমার সুস্থ জীবনেও তো আমি আপনাকে পাবো না! আপনি না আমার অসুস্থ জীবনে থাকলেন, না সুস্থ জীবনে থাকবেন। কিন্তু আমি আপনাকে আমার দুই জীবনেই কামনা করতাম। হয়তো ভুল করতাম!”

রাত্রি সায় মিলিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, ভুলই ছিল সব। আপনি ভুল বুঝতে গিয়ে অনেক দেরি করে ফেলেছেন।”

আদিল কিছু বললো না। দৃষ্টি নিচু করে রাখলো। আদিল আর কিছু বলবে না বুঝতে পেরে রাত্রি বললো,
“আপনি বাড়ি চলে যান। বেশি রাত পর্যন্ত বাইরে থাকা ঠিক হবে না।”

“সেটা আমার ইচ্ছা। আপনি ঘরে চলে যান। আমি নিজের ইচ্ছায় এসেছি, নিজের ইচ্ছায় যাব। আপনি বলার কে?”

রাত্রি বুঝতে পারলো আদিল ক্ষুব্ধ। তাই কথা না বাড়িয়ে আদিলের কথা মেনে বললো,
“আচ্ছা, আমি চলে যাচ্ছি।”

আদিলের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সে চায় না রাত্রি চলে যাক। কিন্তু সে এখন আটকাবেও না রাত্রিকে। তার দু চোখ লাল হয়ে গেছে। কণ্ঠনালিতে আটকে পড়তে চাইছে কথা। তবু সে কষ্ট করে কান্না চেপে বললো,
“যেতে যদি চান, তবে চলেই যান। কিন্তু কোনো একদিন প্লিজ ফিরে আসবেন। যেকোনো দিনে, যেকোনো সময়। আমি কোনো নির্দিষ্ট দিন দেবো না, ক্ষণ দেবো না। আপনার সাথে আমার সময়ের হিসাবনিকাশ নেই, কোনোকালে ছিল না। আপনি নিজ খুশি মতো আসবেন। আমি অপেক্ষা করবো আপনার আগমনের। তবে একটি অনুরোধ, আমার অপেক্ষাকে বিফল করবেন না। ভুল করে হলেও অন্তত একবার আসবেন।”

রাত্রি দাঁড়িয়ে গেছে আদিলের কথা শুনে। বুঝতে পারছে না তার এত কেন কষ্ট হচ্ছে। হয়তো আদিল তার জন্য কষ্ট পাচ্ছে বলে সেও কষ্ট পাচ্ছে। তবে তার কেন যেন মনে হচ্ছে আদিল আর অসুস্থ নেই। সুস্থ। পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু সুস্থ হয়ে গেলে তার এখন এরকম করে ছুটে আসার কথা নয়। তবুও কেন? রাত্রি বললো,
“আমি ভুল করে কিছু করি না, তাই বৃথা অপেক্ষা করবেন না। অপেক্ষা আপনাকে কিছুই দেবে না। আপনার মা যেটা চায় সেটা করা উচিত আপনার। মায়ের চাওয়া পূরণ করুন।”

রাত্রি দ্রুত নিচে নেমে গেল।
আদিল মনে মনে আওড়ালো,
‘আমি অপেক্ষা করবো। আর আপনি ভুল করে না হোক, সজ্ঞানেই না হয় ফিরে আসবেন আমার কাছে। সবকিছু এখনও শেষ হয়নি। আমি সেই দিনটার প্রতীক্ষায়।’

(চলবে)#কালো_রাত্রির_খামে (১৮)
#লেখা: ইফরাত মিলি
___________________

বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে রোশনি। কারো জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু যার জন্য অপেক্ষা করা সে মানুষটা আসছেই না। ওদিকে তার কলেজেরও দেরি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে তবুও দাঁড়িয়ে থাকবে। অয়নকে না দেখা পর্যন্ত কোথাও যাবে না। নিজেকে বাচ্চা বাচ্চা স্বভাবের মনে হচ্ছে রোশনির। না হলে সে কেন এমন পাগলামি করবে? অয়ন তাকে ইনডিরেক্টলি প্রত্যাখ্যান করার পরও? মা ইদানীং খুব বকাঝকা করছে। বাবাকেও জানিয়ে দিয়েছে বিষয়টা, ডায়ারিও দেখিয়েছে। রাত-দিন শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে বিয়ে দিয়ে দেবে। এমন হলে থাকা যায়? মায়ের ধারণা সে যেকোনো সময় অয়নের সঙ্গে পালিয়ে যেতে পারে। অথচ সে কি না এমন নয়। আর অয়ন তো নয়ই। এই প্রথম এমন কিছু ধরা পড়লো, তাতেই মা এত বেশি হাইপার হয়ে গেছে। পা ব্যথা হয়ে যাচ্ছে রোশনির। আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? অয়ন যদি না আসে? হঠাৎ করেই অয়নকে দেখতে পেল সে। প্রশান্ত হলো যেন মন। সেদিনের পর তার আর অয়নের সঙ্গে দেখা হয়নি। আজ হলো। অয়ন তাকে দেখেও এমন ভাণ করছে যেন দেখতেই পাচ্ছে না। তাকে অতিক্রম করে অয়ন সামনে এগোনো দিলেই সে বলে উঠলো,
“আমি জানি আপনি আমাকে দেখেও না দেখার ভাণ করছেন।”

অয়ন একবার ফিরে তাকালো না রোশনির দিকে। যেতে যেতে বললো,
“জানলে তো ভালোই। বুঝতেই পারছেন আপনাকে এড়িয়ে চলছি।”

রোশনি পিছু নিয়ে বললো,
“কেন এড়িয়ে চলছেন?”

“আপনিই বাধ্য করছেন। আপনি আমার সামনে না পড়লেই হলো। সামনে না পড়লে তো এড়িয়ে যেতে হবে না।”

“আমি ভুল করে আপনার সামনে পড়েছি এমন নয়, আমি আপনার জন্যই দাঁড়িয়ে ছিলাম।”

এ কথা শুনে দাঁড়ালো অয়ন। পিছন ফিরে রোশনির দিকে তাকালো। কত বোকা মেয়েটা! সে কীভাবে বোঝাবে মেয়েটাকে? অয়ন বললো,
“শুনুন আপনাকে ভালোভাবে বলছি, এসব পাগলামি। পাগলামি করবেন না। হ্যাঁ, এমন হতেই পারে, কাউকে আপনার ভালো লাগতেই পারে, সেটা দোষের নয়। কিন্তু সেই মানুষটা যদি না চায় তবে প্লিজ হ্যাংলামো করবেন না।”

রোশনির মন বেজায় খারাপ হয়ে গেল। অয়ন তাকে হ্যাংলা বললো? বলতে পারলো এটা? সে খুব অভিমান নিয়ে বললো,
“আমি হ্যাংলামি করি?”

“এক প্রকার সেরকমই। কিছু মনে করবেন না। আপনার মা ভিন্ন কথা ভাবছে। ভাবছে আমি আপনাকে প্রলুব্ধ করেছি। ব্যাপারটা কি আদৌ তেমন? আমি আপনাকে প্রলুব্ধ করেছি?”

রোশনি না বোধক মাথা নাড়লো। অয়ন বললো,
“আপনার মা আমাকে কথা শুনিয়েছে। মানুষের কথা শুনতে ভালো লাগে না আমার। আমার আত্মসম্মান বোধ আছে। আপনি এমন কিছু করবেন না যাতে আপনার মা ভুল বুঝে আবারও আমাকে কথা শোনাতে আসে। ভুল বুঝে আমাকে কথা শোনালে আমি তাকে অপমান করতে বাধ্য হবো। আপনি নিশ্চয়ই তা চাইবেন না।”

রোশনির কান্না পাচ্ছে। কত কঠিন ভাবে কথা শোনাচ্ছে অয়ন তাকে! সুযোগ পেলে বোধহয় মানুষ কথা শোনাতে খুব ভালোবাসে। অয়নও তেমন। বাজে!

অয়ন বুঝতে পারছে সে যা বলছে তা শুনতে রোশনির ভালো লাগছে না। অপমান বোধও হতে পারে। কিন্তু তাকে তো ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতেই হবে। অয়ন বললো,
“এরপর আর আমাদের দেখা না হওয়াই ভালো। আবেগকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। কারণ আবেগ আমাদের কিছুই দিতে পারে না। মানুষ যখন আবেগ মাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় তখন দেখে সে শূন্য। আবেগ মানুষের ক্ষণিকের ভুল।”

এসব শুনে রোশনি কিছুই বললো না।
অয়ন ভেবেছিল রোশনি তার কথায় সায় মিলিয়ে কিছু একটা বলবে, অথবা তীব্র অভিমানে কোনো কটু কথা শুনিয়ে চলে যাবে। কিন্তু সে কিছু বললো না।
অয়নের আর কিছু বলার নেই। অযথাই এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক মনে না হলে সে যখন দুয়েক পা নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে দিয়েছে, ঠিক তখনই রোশনি বললো,
“আপনি আমাকে সত্যিই পছন্দ করেন না?”

রোশনির প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য অয়নকে দাঁড়াতে হলো। বললো,
“পছন্দ-অপছন্দের বিষয় মুখ্য নয়। সঠিক-ভুল বিবেচনাই আসল। আমরা একে-অপরের জন্য ভুল। তাই আমাদের গতিপথ পরিবর্তন করা উচিত। ক্ষণিকের ভুলে জড়িয়ে পড়া ঠিক নয়। আশা করছি বুঝতে পে…”

রোশনি অয়নের কথার মাঝেই হেঁটে সামনে এগিয়ে গেল। তার পায়ের গতি মারাত্মক দ্রুত। একটু সময়ের জন্য বিরতি নিলো না।
অয়ন অবাক হয়ে কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইল স্থির হয়ে। তাতেই রোশনি তার থেকে অনেক দূরত্বে চলে গেল। শান্তি অনুভব করলো অয়ন, পাশাপাশি কেমন ভিন্ন একটা অনুভূতিও হলো। সে টের পেল তা। মন ভারাক্রান্তের মতো অনুভূতি। তবুও তার চাওয়া, এই দূরত্বের মেয়াদ সব সময় স্থায়ী হোক!

___________________

ঘরে অবসরে খাওয়ার মতো কিছু নেই। না কোনো বিস্কুট-টোস্টের টুকরো, না আছে চানাচুর। শ্রাবণীর বিশ্বাস তাদের ঘরেই শুধু এমন দুর্দশা। বিল্ডিংয়ের বাকি দুই ফ্লোরে হয়তো এমন দুর্দশা নেই। আর আছে মিশাতের ঘরে। তবে মিশাত তো নাইট গার্ডের চাকরি নিয়েছে। এরপর থেকে তার ঘরেও খাবার থাকবে, শুধু তাদের ঘর শূন্য থাকবে। বসার ঘরে বসে অস্ফুট স্বরে রাগে বকবক করছিল শ্রাবণী। রাত্রি বের হওয়ার পথে তা দেখে বললো,
“কী হয়েছে? কী বলছো তুমি?”

“কী বলবো? কিছু বলছি না। সব আমার কপালের দোষ।”

“তোমার কপালে কোনো দোষ লেখা নেই, তুমি আছে মনে করলে সেটা তোমার দোষ।”

“তুমি যাও তো প্লিজ, আমার এখন জ্ঞান নিতে ভালো লাগছে না।”

শ্রাবণী রুমের দিকে চলে গেল। রাত্রি সাবধান করে বললো,
“কোনো টু শব্দ করবে না। যেন শুনি না কারো সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছো। ঠিক আছে?”

রাত্রি সদর দরজা টেনে রেখে বেরিয়ে গেল বাইরে। আর মস্তিষ্ক জুড়ে আবারও শুরু হলো পুরোনো চিন্তার উপদ্রব। আদিলকে নিয়ে এত কেন ভাবছে সে? সে লক্ষ করলো ওই রাতের পর সে শুধু আদিলকে ভাবছে। ঘুমাতে পারছে না আদিলের চিন্তা করে, খেতে গেলেও অরুচি। এ কেমন কঠিন রোগ হলো তার? আদিলের জন্য সে কষ্ট অনুভব করে। কারণ আদিল তার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। হতে পারে আদিল এখন মানসিক ভাবে অসুস্থ, কিন্তু তাই বলে আদিলের কষ্ট তো ফ্যাকাশে নয়। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে এটা ভাবতেই যে, কেউ তার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। আদিলের সাথের পুরোনো সময়গুলোকে মনে পড়ছে। এর আগে এমন হয়নি। কিন্তু ওই রাতের পর কী যে হয়ে গেল। তিনদিন কেটে যেতেও তার উপর ফেলা প্রভাব কমেনি। তবে একটা বিষয় আজব! আদিলকে এখন আর একদমই অসুস্থ মনে হয় না। সে কি ভালো হয়ে যাচ্ছে?

“রাত্রি!”
গলির রাস্তা ধরে কিছুদূর হেঁটে আসার পর কেউ যেন ডাকলো মনে হলো। সম্ভবত পিছন থেকে। রাত্রি হাঁটতে হাঁটতে পিছনে তাকালো। তার থেকে দশ কদমের মতো দূরত্বে আদিলকে দেখা যাচ্ছে। তার দিকেই আসছে আদিল। রাত্রি দাঁড়ালো।
আদিল তার সামনে এসে প্রায় হাঁপাতে লাগলো। রাত্রি বললো,
“আপনি এখানে কী করছেন?”

“মর্নিং ওয়াক করছিলাম।”

রাত্রি ভ্রু কুঁচকালো,
“এই বিকেল বেলা আপনি মর্নিং ওয়াক করছিলেন?”

“ওহ স্যরি! এখন বিকেল? তাহলে আমি আফটারনুন ওয়াক করছি। আসলে কী হয়েছে জানেন? আপনি ওই চারটা বর্ণ চুরি করার পর থেকে আমার ইংরেজি শব্দগুলো তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এই যেমন এই মাত্রই আমি বিকেলকে সকাল বানিয়ে ফেললাম।”

“হুম বুঝতে পেরেছি।”

“হ্যাঁ, আপনি তো বুঝবেন। আপনি তো টিচার। টিচারদের মস্তিষ্ক দ্রুত কাজ করে, তারা দ্রুত সব বুঝে ফেলে।”

“আচ্ছা। আমাকে যেতে হবে, দেরি হয়ে যাবে নয়তো।”

“আমি আপনার সঙ্গে আসি?”

“না না, তার কী প্রয়োজন?”

“প্রয়োজন আছে। হতে পারে এটাই আমাদের শেষ দেখা। শেষ দেখায় অন্তত কারো সঙ্গে বাজে আচরণ করা উচিত নয়।”

“আমি বাজে আচরণ তো করছি না।”

“কোনো কিছুতে অসম্মতি করাও অনুচিত।”

রাত্রি চলতে শুরু করলো। আদিল তার সঙ্গে সঙ্গে এগোচ্ছে। রাত্রির হাত লক্ষ করে সে বললো,
“আপনাকে আংটি পরানো হয়নি?”

“জি না। ছেলের বাবা এখন বিদেশে আছেন ব্যবসায়িক কাজে। তিনি এলে তারপর সবটা হবে।”

“বিয়েটাও হবে?”

“হুম।”

আদিল হেসে উঠলো সশব্দে।

“হাসছেন কেন?” অবাক গলায় প্রশ্ন করলো রাত্রি।

“আপনি ভাবলেন কীভাবে আপনার বিয়ে এত সহজে হতে দেবো?”

রাত্রি খুব ভয় পেল আদিলের এ কথায়। বিস্ময়ে দেখতে লাগলো আদিলকে। আদিল বললো,
“আপনার চিন্তা নেই। আপনি টেরও পাবেন না কখন আপনার বিয়ে ভেঙে যাবে। আপনি শুধু দুটো ঘুমের ঔষধ খেয়ে নেবেন, যখন জেগে উঠবেন দেখবেন আপনি আমার ঘরে।”

রাত্রির পা থেমে যায়। হাত-পা অবশ হয়ে আসে। ভয়ে কাঁপতে থাকে হৃৎপিণ্ড। আদিল কি সত্যিই তার বিয়ে ভেঙে দেবে?

“দাঁড়ালেন কেন?” বিরক্ত হওয়া গলা আদিলের।

রাত্রি ভয়ার্ত দৃষ্টি জোড়া গোপন না করে বললো,
“আপনি এরকম কিছু করবেন না।”

“করবো। আমার যা যা ইচ্ছা হবে, আমি তাই তাই করবো। আপনার কথা তো শুনবো না। শোনাশুনি না হয় বিয়ের পরেই হবে।” আদিল হাসলো।

রাত্রি অসুস্থ বোধ করছে। সে কিছুতেই ঝামেলা কাটিয়ে শান্তি পূর্ণ একটা জীবন পাচ্ছে না। হ্যাঁ, আদিল চাইলেই তার বিয়েতে ঝামেলা করতে পারবে। কিন্তু সে চায় না কোনো ঝামেলা হোক। সবকিছু ধীরে ধীরে পরিপাটি হয়ে উঠছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আদিল আবার সব ভেঙেচুরে দেবে। আদিল তার বিয়েতে কোনো ঝামেলা করলে তানবীন কি তাকে ভুল বুঝবে? শেষমেশ কি আসলেই তাদের বিয়ে ভেঙে যাবে? এরপর কী হবে? এরপর কী হবে সেই চিন্তাটুকু আদিল রাত্রিকে করতে দিলো না, বলে উঠলো,
“কী ভাবছেন? এখন আপনার দেরি হচ্ছে না?”

রাত্রির সম্বিৎ ফিরলো। সে হাঁটতে শুরু করলো আবার। আদিলের সঙ্গে কোনো কথা বললো না। তবে আদিল একা একা বকবক করেই চললো। তবে রাত্রিকে কথা বলার জন্য জোর করলো না। রাত্রি মনে মনে পরিকল্পনা করলো, পারভীনের সাথে তাকে কথা বলতে হবে। বলতে হবে আদিলের যার সাথে বিয়ে ঠিক করা শীঘ্রই তার সাথে বিয়ে দিয়ে দিতে। কারণ সেরকম ভাবেই সবটা সমাধান হতে পারে। অবশ্য বিয়ের পরও আদিল এরকম করতে পারে। যদি আদিল সুস্থ হয়ে না ওঠে তবে তার দ্বারা সবই করা সম্ভব।

তুরিনদের বাড়ির সম্মুখে থামলো রাত্রি। আদিল বললো,
“এই বাসাতে পড়ান আপনি?”

“হ্যাঁ। আপনি এখন যান।”

“আমি যতটুকু শুনেছি তাতে এই বাসার ছেলের সঙ্গেই আপনার বিয়ে, তাই তো?”

রাত্রি কথা বললো না। সে জানাতে চাইছে না আদিলকে। গেট খোলার শব্দ হলো। তাদের দুজনের দৃষ্টিই চলে গেল গেটের দিকে। একজন সুদর্শন যুবক বেরিয়ে এলো বাইরে। রাত্রি ঘাবড়ে গেল, তার সঙ্গে আদিলকে দেখে কি না কী ভাববে তানবীন।
তবে তানবীনের মাঝে অবাক হওয়ার কোনো প্রতিফলন দেখা গেল না। এই বিষয়টা খুব অবাক করলো রাত্রিকে। রাত্রি তানবীনকে কিছু বলতে যাবে এর আগেই তানবীন আদিলের দিকে এক হাত বাড়িয়ে হাসি মুখে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম ব্রাদার।”

রাত্রি অবাক হলো। তানবীনের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে সে আদিলকে চেনে। কিন্তু
আদিলের মুখ বিস্ময়ে ঢাকা। হয়তো সে তানবীনের থেকে এমন আচরণ আশা করেনি। কিন্তু সেও করমর্দন করে হাসি মুখে বললো,
“ওয়াআলাইকুমুস সালাম।”

একে অন্যের হাত ছেড়ে দেওয়ার পর আদিল বললো,
“আপনার সঙ্গেই ম্যাডামের বিয়ে ঠিক হয়েছে, তাই তো?”

“হ্যাঁ।”

আদিল এবার তানবীনের নিকট এগিয়ে এলো কিছুটা। তানবীনকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী জ্ঞান করে প্রায় আ’ক্রমণাত্মক গলায় বললো,
“কিন্তু জানেন কি, দুর্ভাগ্যবশত আপনার সঙ্গে ওনার বিয়েটা হবে না।”

তানবীন মৃদু হেসে বললো,
“তাই? দেখা যাক, আমার ভাগ্য কতটা খারাপ হয়ে উঠতে পারে।”

তানবীনের কথা বলার ধরন মোটেই আ’ক্রমণাত্মক ছিল না। বরং খুব শান্ত, সুন্দর ছিল। আদিলও তার এমন আচরণ দেখে হেসে ফেললো। রাত্রির দিকে তাকিয়ে বললো,
“উনি খুব স্মার্ট। ভালো লেগেছে আমার।”

রাত্রি হতভম্ব হয়ে যাচ্ছে দুজনের ব্যবহারে। আদিল তানবীনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি যাচ্ছি। ভবিষ্যতে দেখা হবে।”

তানবীন হাস্য মুখে বললো,
“নিশ্চয়ই।”

তারা একে অপরের সঙ্গে আবারও করমর্দন করে বিদায় জানালো। তানবীন তাকিয়ে রইল আদিলের যাওয়ার পানে। ছেলেটার মাঝে সে তীব্র আত্মবিশ্বাস দেখতে পেয়েছে, সেই আত্মবিশ্বাস যেটা সে সব সময় নিজের মাঝে বজায় রাখে। দুজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া ভালো ব্যাপার নয়। তানবীন রাত্রির দিকে তাকালো। হকচকিয়ে গেল রাত্রি। ইতস্তত করে বললো,
“আসলে উনি হচ্ছেন…”

“আমি চিনি তাকে।”

“আপনি চেনেন?” খুব অবাক হলো রাত্রি।

“তোমার আশেপাশে থাকা প্রত্যেকটা মানুষকে আমি চিনি। আর যে তোমাকে পছন্দ করে…হতে পারে ভালোওবাসে, তাকেই কি না চিনবো না?”

রাত্রি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তানবীনের দিকে। তানবীন এসব জানে? কিন্তু কীভাবে?
তানবীন বললো,
“একজন মেয়েকে একাধিক ছেলে ভালোবাসতেই পারে। একজন ছেলেকেও একাধিক মেয়ে ভালোবাসতেই পারে। সেটা ব্যাপার নয়। গুরুত্বপূর্ণ এটা যে, সেই মেয়ে বা ছেলেটি কাকে ভালোবাসে।”

তানবীন রাত্রির মাথায় এক হাত রেখে চোখে চোখ স্থাপন করে বললো,
“ডু ইউ লাভ মি, রাত?”

রাত্রি উত্তর দিলো,
“আমি এখনও জানি না।”

“ডু ইউ লাভ হিম?”

“না, তবে আমি তার জন্য কষ্ট অনুভব করি।” ব্যথাতুর কণ্ঠ রাত্রির।

তানবীন হাত সরিয়ে নিয়ে হেসে বললো,
“ছাতাটা যত্ন করে রেখেছো তো?”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here