কালো রাত্রির খামে পর্ব -১৫+১৬

#কালো_রাত্রির_খামে (১৫)
#লেখা: ইফরাত মিলি
____________________

রোশনির কী যেন একটা হয়েছে! সারাদিন শুধু অয়নের কথা মনে পড়ছে তার। শুতে গেলে অয়ন, বসে থাকলে অয়ন, খেতে গেলে অয়ন, পড়তে বসলে অয়ন, সারাক্ষণ তার মস্তিষ্ক অয়নকে নিয়ে ভাবছে। অথচ সে চেয়েছিল সে আর অয়নকে ভাববে না। কারণ অয়ন তাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। অথচ সে কি না নির্লজ্জের মতো অয়নকেই ভেবে চলেছে সকাল-বিকাল-রাত্রি। শুধু তাই না, বই-খাতার নানা পৃষ্ঠায় সে অয়নের নাম লিখে রেখেছে। ডায়ারিতেও লিখেছে, সাথে বিভিন্ন প্রেম উক্তিও লিখিত সেখানে। এসব লিখতে গিয়েই অবশ্য একটা বিপত্তি ঘটালো সে। তার মা শায়লা বেগমের নজরে পড়ে গেল অয়ন নামটা। তিনি তো দেখা মাত্রই প্রশ্ন করলেন,
“এই, কার নাম লিখে রেখেছিস? অয়ন? কে এই ছেলে?”

রোশনি ভোঁতা মুখে তাকিয়ে রইল। ইশ, মা দেখে ফেললো এটা! কী বলবে সে এখন? শায়লা বেগম ধমকে উঠলেন,
“কী হলো? বলছিস না কেন কিছু?”

“আ… আসলে আম্মু…মানে… আসলে…”

মেয়েকে আমতা আমতা করতে দেখে শায়লা বেগম বুঝতে পারেন ঘটনা খুব একটা সুবিধার নয়। তিনি আচমকা রোশনির ডায়ারি তুলে নিলেন। ওটা টেবিলের উপরই ছিল।
রোশনি নিজেকে গালি দিচ্ছে মনে মনে, আজই কেন সে সব মেলে রেখেছে এরকম? মা দেখে ফেললো, ব্যাপারটা মোটেই ভালো হবে না এখন। তার মা সাংঘাতিক মানুষ। ভালোবাসেন খুব, তবে একটু এদিক-সেদিক করলে কড়া শাস্তিও প্রদান করেন।
বিভিন্ন কবিদের প্রেমের কবিতার বিভিন্ন লাইন রোশনি ডায়ারিতে লিখে রেখেছে। তার নিচে অবশ্যই অয়নের নামও লিখে রেখেছে। লজ্জায় মাথা কা’টা যাচ্ছে যেন তার, সাথে ভয়ও হচ্ছে।
শায়লা বেগম এক জায়গাতে এসে থামলেন, এখানে অয়ন নামের পাশে রোশনি নিজের নামটাও লিখে রেখেছে। দুটো নামের মধ্যে ছোটো একটা হার্ট এঁকে রেখেছে। এর ঠিক উপরেই লেখা,
‘তোমায় নিয়ে একদিন সূর্যাস্ত দেখতে যাব,
দেখতে যাব সমুদ্রের বিশালতা।
হাতে হাত রেখে দেখবো সূর্য আর সমুদ্রের ডুবে যাওয়া প্রেম।
তুমি জানো,
সমুদ্র আর সূর্যে প্রেম কতটা গভীর?
কতটা দূরত্ব তাদের মাঝে?
তবুও দেখো, ঠিক বেলা শেষে নিয়ম করে এক হয়ে মিশে দুজন।
তুমি কি বলবে এই মিশে যাওয়া কে?
ভালোবাসা?
না-কি লোক দেখানো?’

এই লেখাটুকু রুদ্র নামের একজনের লেখা। ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করেছে রোশনি।
শায়লা বেগম অবিশ্বাস্য চোখে তাকালেন মেয়ের দিকে। আতঙ্কিত গলায় বললেন,
“কার সাথে সূর্যাস্ত দেখতে যাবি তুই?”

রোশনি কী বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। সে মায়ের দিকে তাকাচ্ছে না। শায়লা বেগম আচমকা রোশনির মুখ নিজের দিকে ফেরালেন। ভয়ে হৃৎপিণ্ড কাঁপে রোশনির। শায়লা রাগে ফুঁসছেন। হুকুমের স্বরে বললেন,
“বল, অয়ন কে? তোর ক্লাসের কেউ?”

রোশনি না বোধক মাথা নাড়লো।

“তাহলে কে?”

রোশনি বলবে না বলবে না করেও বললো,
“পাশের বাড়ির।”

“পাশের বাড়ির কে?”

রোশনি আর কিছু বললো না।
শায়লা বেগম বললেন,
“বড়ো হয়ে গেছিস, তাই না? পাখনা গজিয়ে গেছে? বন্ধ কর এসব, নয়তো পাখনা কে’টে দেবো। বিয়ে দিয়ে শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেবো একেবারে। থালা-বাসন মাজবি ওখানে গিয়ে।”

শায়লা বেগম ডায়ারিটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
রোশনির মনে হলো মায়ের কথার জবাবে তার এটা বলা উচিত ছিল যে,
“বিয়ে দিলে অয়নের সাথে দিয়ো, তার ঘরে গিয়ে আমি সব করতে রাজি।”

হ্যাঁ এটা বলা বেয়াদবিও হতো। আর সে তো ঠিক বেয়াদবই হতে চায়। এখন গিয়ে কি সে কথাটা বলে আসবে? না থাক, মা বেশি রেগে গেলে আবার সমস্যা। তবে মা চুপও বসে থাকবে না। কিছু একটা অবশ্যই করবে। কিন্তু কী করবে রোশনি বুঝতে পারছে না।

_____________________

বাড়ির সামনে একটা বাইক দাঁড় করানো, বাইকের কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন মানুষ। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছে রাত্রি। কিন্তু কে বুঝতে পারছে না। মানুষটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে মুখ ঘোরানো। বাড়ির কাছাকাছি আসার পর হঠাৎ মানুষটা এদিকে মুখ ফেরালো। তানবীন! রাত্রির চোখ বড়ো বড়ো হলো। এ ছেলে তাদের বাড়ির সামনে কেন? রাত্রির রাগ লাগলো। তানবীন তার বদন চাপা সেই রাগ বুঝতে পেরেই যেন হাসলো।

“আপনি এখানে কেন?” কাছাকাছি এসে প্রশ্ন করলো রাত্রি।

“এটা তো সরকারি রাস্তা। মানুষের চলাচলের জন্য নির্মিত। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে মনে হয় না কোনো কারণ দরকার।”

“মানুষের সব কাজের পিছনেই কিছু না কিছু কারণ থাকে।”

“তাই? তাহলে তুমি যেহেতু আমাকে প্রশ্নটি করলে, তার মানে তোমারও এর পিছনে কারণ আছে। কী কারণ? তুমি কি এটা শুনতে চাইছিলে যে, আমি তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি?”

হ্যাঁ, এই ছেলে সম্পর্কে পূর্বে রাত্রি ঠিকই অনুমান করেছিল। এই ছেলে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলে মানুষকে সেই কথার প্যাঁচে ফেলে দারুণভাবে আ’ক্রমণ করতে পারে। রাত্রি বললো,
“যে কেউ পাগল হয়ে যাবে আপনার সঙ্গে কথা বললে।”

“যে কাউকে হতে হবে না, তুমি হবে তো?”

“জি না, আমি বোকা নই যে পাগল হবো। আমার বাড়ির কাছেপিঠে কখনও আসবেন না। আর আমার থেকেও দূরে থাকবেন। ধন্যবাদ!”

রাত্রি গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে তানবীনের কণ্ঠ শুনতে পেল,
“কিন্তু আমার মনে হয় না আমাদের মাঝে বেশিদিন দূরত্ব থাকবে।”

রাত্রি এ কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না। শুধু শুধু তর্ক করে তো লাভ নেই। একটা টিউশনি জোগাড় করার চেষ্টা করছে সে। জোগাড় হয়ে গেলে তুরিনকে আর পড়াতে যাবে না। কিছুদিন পর যখন রেহনুমা সুলতানা নিজের ছেলের আচরণ আন্দাজ করতে পারবেন, তখন নিজেই হয়তো তার মেয়েকে পড়াতে যেতে নিষেধ করবেন। তার চেয়ে নিজ থেকে আগেভাগেই টিউশনিটা ছেড়ে দেওয়া ভালো। কিন্তু যদি অন্য কোথাও টিউশনি না পায় তাহলে বড়ো সমস্যা হবে। তার এখন একটাই প্রার্থনা, অন্য কোথাও যেন একটা টিউশনি সে পেয়ে যায়।

ঘরে ঢুকে থমকে যেতে হলো রাত্রিকে। রেহনুমা সুলতানা আর তুরিন তাদের বাড়িতে? ছেলে নিচে দাঁড়ানো আর মা-মেয়ে তাদের ঘরে? কিছুটা অদ্ভুত লাগলো রাত্রির। তার হাতে বাজারের ব্যাগ। প্রিয়ারা এসে ব্যাগটা নিয়ে গেলেন। রাত্রি বিস্ময় গোপন না করেই বললো,
“আপনারা?”

আজ ছুটির দিন, তাই এনামুল শিকদারও বাসায় আছেন। মিথিলা, শ্রাবণীও আছে এখানে। নেই শুধু অয়ন।
মিথিলা বললো,
“বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন ওনারা।”

কথাটা শুনে যেন ছোটোখাটো হার্ট অ্যাটাক হলো রাত্রির। বিয়ের প্রস্তাব মানে? কার সাথে কার? রাত্রি টের পেল তার হৃৎস্পন্দনের গতি বাড়ছে। সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বললো,
“কার জন্য?”

রাত্রির প্রশ্নের উত্তরটা রেহনুমা দিলেন,
“আমার ছেলের সঙ্গে তোমার।”

রাত্রির মনে পড়ে গেল তানবীনের কথা। তানবীন বলেছিল, তার মনে হয় না তাদের মাঝে বেশিদিন দূরত্ব থাকবে। এটা কি এই জন্য বলেছে?
মিথিলা বললো,
“তুই ঘরে যা।”

রাত্রি আর দাঁড়িয়ে রইলও না। সে আসলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। সে কখনও ভাবতে পারেনি তানবীন তার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে, তাও আবার এত শীঘ্রই! তানবীনের পরিবারও সব মেনে নিলো? তানবীন ও তার পরিবার কি জানে তাদের পরিবারের অবস্থা সম্পর্কে? কত করুণ অবস্থায় তাদের বাস? যখন জানবে তখন নিশ্চয়ই বিয়ের এই কথোপকথন চূর্ণ হয়ে যাবে। এখন তো কেবল দরিদ্র ঘর দেখছে, যখন জানবে আর্থিক অবস্থাও একেবারে নিম্ন তখন কী করবে?
শ্রাবণীও রাত্রির পিছন পিছন এসেছে। পাত্রের ছবিও এনেছে সঙ্গে। রাত্রির সামনে এসে ছবিটা দেখতে দেখতে বললো,
“ভাইয়াটা কত সুন্দর। এত সুন্দর দুলাভাই পাবো এ তো ভাবতেই পারিনি। আমার তো ভীষণ পছন্দ হয়েছে। তোমার কেমন লাগে তাকে?”

রাত্রি একবার ছবিতে তাকিয়ে দেখলো। তানবীনের সৌন্দর্য নিয়ে বললে পছন্দ করার মতো ছেলে সে। রাত্রি অস্বীকার করবে না, তানবীনের সৌন্দর্য তার ভালো লাগে। এক দেখাতে পছন্দ করার মতো। কিন্তু সে তো তানবীন কেমন সেটা এখনও জানে না। যেরকম দেখেছিল তাতে তার মনে তানবীন স’ন্ত্রাসী এরকম একটা ধারণা জন্মেছিল প্রথমে। কিন্তু পরে সে নিশ্চিত হয়েছে তানবীন আসলে কোনো স’ন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত নয়। আর সে এটাও ভাবতো তানবীন তার সঙ্গে মজা করে। কিন্তু যেহেতু বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে তার মানে কি আসলে তানবীন তার সঙ্গে মজা করতো না? কিন্তু তানবীন তাকে কেন পছন্দ করেছে? এটা কি তার রূপ-সৌন্দর্যের জন্য?
রাত্রি বললো,
“এখনই এত খুশি হয়ো না। সবে কথা উঠেছে, যাক কিছুদিন। হয়তো এরপর আর তাদের খোঁজও থাকবে না।”

শ্রাবণীর মুখ কালো হয়ে গেল। ছবিতে দেখা ছেলেটার সঙ্গে তার আপুর বিয়ে হলে সে খুব খুশি হতো। দুজনকে খুব ভালো মানাতো। এছাড়া এত সুন্দর একজন মানুষ তার দুলাভাই এটা মানুষজনকে বলতেও তো ভালো লাগতো। পাত্রের মা-বোনকে দেখেও মনে হয়েছে তারা বেশ অর্থ-সম্পদশীল ব্যক্তি। যদি বিয়েটা না হয় তাহলে সে আসলেই খুব মর্মাহত হবে।
অনেকক্ষণ কেটে গেল। কীসব কথাবার্তা হলো বসার ঘরে রাত্রি কিছুই জানতে পারলো না। চলে যাওয়ার আগে হঠাৎ তুরিন তাদের রুমে এলো। রাত্রি দাঁড়ালো তুরিনকে দেখে। হেসে বললো,
“ভিতরে এসো।”

তুরিন ভিতরে ঢুকলো। বললো,
“এখনও কি আপনাকে আপু ডাকবো? না কি ভাবি?”

রাত্রি সামান্য লজ্জা পেল। তবে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো না। সে বললো,
“বিয়ে তো আর হয়নি, আপুই ডাকবে। যদি কখনও বিয়ে হয় তখন না হয় ভাবি ডাকবে।”

“যদি কখনও বলছেন কেন? বিয়েটা তো হবেই।”

“আচ্ছা, হলে দেখা যাবে।”

“আপনার কি আমার ভাইয়াকে পছন্দ হয়নি?”

হঠাৎ এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবে বুঝে উঠতে পারলো না রাত্রি। উত্তর দিতে একটু ভাবতে হলো তাকে। বললো,
“আসলে এটা এখনই বলা সম্ভব নয়। কারণ আমি তোমার ভাই সম্পর্কে তো তেমন কিছু জানি না।”

তুরিন হাসি হাসি মুখে বললো,
“কিন্তু ভাইয়া আপনার সম্পর্কে সব জানে।”

রাত্রি অবাক হয়ে তাকালো। তুরিন বললো,
“আপনি এই বিষয়টুকু নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, ভাইয়ার সঙ্গে আপনি সব সময় ভালো থাকবেন।”
একটু থেমে আবার বললো,
“যাচ্ছি তাহলে। খুব শীঘ্রই হয়তো আপনাকে ভাবি বলে ডাকবো।”

তুরিন চলে গেল। রাত্রি বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল ওর যাওয়ার দিকে। তানবীন সব জানে মানে কী? তাদের আর্থিক অবস্থা, টাকার অভাবে বার বার বিয়ে ভেঙে যাওয়া, সব জানে?

শ্রাবণী ভাবতে ভাবতে বললো,
“আমার মনে হয় বিয়েটা এবার হয়ে যাবে। কারণ আগের সম্বন্ধ গুলোর থেকে এটাকে ভিন্ন মনে হচ্ছে।”

রাত্রি শ্রাবণীর কথায় কান দিলো না, রেহনুমা সুলতানা কী বলে গেছেন সেটা থেকেই বোঝা যাবে আসলে কী হবে।

রাত্রি জানতে পারলো রেহনুমা সুলতানা প্রস্তাব রাখলেও তার বাবা এখনও কোনো মতবাদ ব্যক্ত করেননি। এত নিচু অবস্থায় থেকে অত বড়ো ঘরে মেয়ে বিয়ে দেওয়া ঠিক হবে কি না সেই চিন্তায় ভুগছেন। তবে তারা খুব আহ্লাদ করেই যেন রাত্রিকে ছেলের বউ করতে চাইছেন। এদিক থেকে মনে হচ্ছে বিয়ে দেওয়া যেতে পারে, কোনো সমস্যা হবে না। আবার মনে হচ্ছে এত ধনী ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়া ঠিক হবে না। কিন্তু মেয়ে যদি সত্যিই ওই ঘরে গিয়ে সুখী হয় তবে এরচেয়ে আনন্দের আর কিছুই হবে না। কয়েকটা দিন যাক। ছেলে পক্ষ ধীরে ধীরে সব জেনে যদি মেয়ে নিতে রাজি হয় তাদের কোনো আপত্তি প্রকাশ করা উচিত নয়।

রাতে খাওয়ার পর শুয়ে একটু চোখ বুজেছিল রাত্রি, যদিও ঘুমানোর জন্য নয়। আকস্মিক কল বাজলেই চোখ মেললো সে। মোবাইল টেবিলে। শ্রাবণী পড়ছিল, কল এলেই মোবাইল নিয়ে রাত্রির কাছে ছুটে এলো সে। বললো,
“দুলাভাইয়ের কল বোধহয়।”

“চুপ ফাজিল। অপরিচিত নাম্বার।”

“সেজন্যই তো মনে হচ্ছে।”

“বাজতে থাক, রিসিভ করার দরকার নেই।”

“আমি করি?”

“না।”

শ্রাবণী শুনলো না, রিসিভ করে ফেললো। রাত্রি শঙ্কা করেছিল হয়তো আদিল কল করেছে, কিন্তু না, শ্রাবণীর ধারণাই মিলে গেল। শ্রাবণী যখনই জানতে পারলো এটা তানবীন মোবাইলটা সঙ্গে সঙ্গে রাত্রির হাতে ধরিয়ে দিলো। হতভম্ব হয়ে গেল রাত্রি। সে কী বলবে তানবীনের সঙ্গে? তানবীন এর আগে কখনও কল দেয়নি, এই প্রথম। কারো সঙ্গে প্রথম ফোনে কথা বলতে অস্বস্তি হয়। আর তানবীন তো বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে, তার সঙ্গে কথা বলতে তো অনেক বেশি অস্বস্তি হবে। কী জন্য যে কল দিতে গেল ছেলেটা! আর কী জন্য যে শ্রাবণী রিসিভ করতে গেল।
রাত্রি একবার ভাবলো কল কেটে দেবে কি না, কিন্তু রিসিভ করে শ্রাবণী যেহেতু কথাও বলে ফেলেছে তাই আর কাটলো না। মোবাইলটা কানে লাগিয়ে বললো,
“হ্যা… হ্যালো!”

“গলা কেন কাঁপছে তোমার?”

“কাঁপছে না তো।”

“কিন্তু আমি তো স্পষ্ট টের পেলাম তোমার গলা কেঁপেছে।”

“কাঁপেনি। আপনি কেন কল দিয়েছেন? আর বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন কেন?”

ফোনের ও প্রান্তে তানবীন হাসলো।
“এটা কী বললে? প্রস্তাব কেন পাঠিয়েছি? প্রস্তাব কেন পাঠায় মানুষ? যে ঘরে বিয়ে উপযোগী মেয়ে আছে সেখানে প্রস্তাব তো যাবেই। না কি আমার প্রস্তাব পাঠানোয় বিশেষ নিষেধাজ্ঞা আছে?”

“সেটা নয়। আপনি আমার সম্পর্কে কতটুকু জানেন? খুব বেশিদিন হয়নি আপনি আমাকে দেখেছেন। আপনি কী জানেন আমার সম্পর্কে? আপনি জানেন আমাদের অবস্থা সম্পর্কে? আমার বাবা টাকার অভাবে আমার বিয়ে দিতে পারছে না, জানেন আপনি? আরও অনেক কিছু আছে যা আপনি জানেন না।”

“সব জানি। সব জানি বলেই তো তোমাকে আরও বেশি ভালোবাসি। সম্পদ মানেই সুখ নয়। যেখানে সম্পদ নেই সেখানেও সুখ থাকে। তুমি আমার সম্পদহীন সুখের রাজকন্যা। তাই আমি তোমাকে যে-কোনো মূল্যে অর্জন করবোই। কারণ তুমিই আমার প্রকৃত সুখ।”

তানবীনের কথায় যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় রাত্রির, বন্ধ হয় যেন হৃৎস্পন্দনও। কয়েক মুহূর্ত কিছু বলতে পারলো না সে। এরপর বললো,
“আপনি আ… আর কিছু বলবেন?”

তানবীন শান্ত হেসে বললো,
“আবারও তোমার গলা কাঁপছে রাত।”

“না, কাঁপছে না।” অথচ এটা বলতেও রাত্রির গলা সামান্য কাঁপলো। সে বললো,
“আর আমার নাম রাত্রি।”

“দুটোই এক অর্থ বহন করে। সুতরাং রাত ডাকলে সমস্যা নেই। তবে গলা কাঁপলে কিন্তু সমস্যা। গলা কাঁপা ভালো লক্ষণ নয়। দ্রুত কারো প্রেমে পড়ে যাবে এ লক্ষণ প্রকাশ করছে।”

“আর কিছু বলবেন? রাখছি না হলে।”

“এভাবে পালানোও কিন্তু ভালো লক্ষণ নয়। আচ্ছা রাখো, ঘুমাও। আর ঘুমের মাঝে আমাকে স্বপ্ন দেখো।”

“আপনাকে কেন স্বপ্নে দেখতে যাব?”

“কারণ শীঘ্রই তুমি আমার প্রেমে পড়বে তাই।”

রাত্রি আর কিছু না বলে কল কেটে দিলো। কেন যেন তানবীনের সঙ্গে সে কথা চালিয়ে যেতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল তানবীন তাকে কথায় হারিয়ে দেবে। ছেলেটা কি তাকে সত্যিই বিয়ে করতে চায়? যদি না চাইতো তাহলে নিশ্চয়ই মাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতো না। রাত্রি ভাবতেই পারছে না কাল তাকে ও বাড়িতে পড়াতে যেতে হবে। ভীষণ লজ্জা বোধ করবে সে। এরকমভাবে বিয়ের কথা ওঠার পর পড়াতে যাওয়া আসলেই সহজ ব্যাপার নয়। অথচ তাকে বলা হয়েছে সে যেন রোজ পড়াতে যায়।

শ্রাবণী জানতে চাইলো,
“কী কী বললো?”

রাত্রি চ’ড় মা’রার ভঙ্গি করে বললো,
“এক চ’ড় খাবে, রিসিভ করতে বলেছিল কে তোমায়?”

(চলবে)#কালো_রাত্রির_খামে (১৬)
#লেখা: ইফরাত মিলি
____________________

আকাশে অসংখ্য নক্ষত্রের ছড়াছড়ি আজ। শ্রাবণী তারা দেখছে। সে বসে আছে রুফটপে। মিশাতও বসে আছে তার পাশে। স্নিগ্ধ হাওয়া বইছে। শ্রাবণী আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
“জানেন, আমার আপুর না বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলে সুন্দর, ধনী। আমিও অমন সুন্দর আর ধনী একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চাই। যার অনেক টাকাপয়সা থাকবে। যাতে কখনও কেউ আমাকে গরিব বলে ঠাট্টা করতে না পারে।”

মিশাত বললো,
“দোয়া রইল, যেন এমন একটা বর তুমি পাও।”

শ্রাবণী হাসলো। বললো,
“আচ্ছা, আপনার কী চাওয়া?”

“আমার? আমি চাই আমার একটা স্থায়ী কাজ হোক। একবেলা খাবার খেয়ে পরের বেলা খেতে পারবো কি-না এমন চিন্তা না করা লাগুক। এমন অনিশ্চয়তার জীবন আর ভালো লাগে না। যদি আমি একটা স্থায়ী কাজ পাই, তবে তার প্রথম বেতন দিয়ে আমি তোমাকে একটা সুন্দর পোশাক কিনে দেবো।”

“আপনি কেন দেবেন?”

“ইচ্ছা আমার। যেহেতু আমি তোমার সম্পর্কে জানি, তুমি আমার সম্পর্কে জানো।”

শ্রাবণী কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভেবে হঠাৎ বললো,
“আচ্ছা, আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?”

শ্রাবণীর কথায় মিশাত যেন থ হয়ে গেল। লজ্জাও লাগলো তার। কিন্তু শ্রাবণী একেবারে নির্বিকার। মিশাত হাসার চেষ্টা করে ব্যাপারটা হালকা করার বৃথা চেষ্টা করে বললো,
“তুমি তো ধনী লোক বিয়ে করবে, আমি তো ধনী নই।”

“হয়তো এখন আপনি ধনী নন, কিন্তু হঠাৎ যদি ম্যাজিকের মতো ধনী হয়ে যান? আপনি আমার জন্য ধনী হবেন মিশাত ভাই?”

শ্রাবণীর কথায় ক্রমশই হতভম্ব হয়ে পড়ছে মিশাত। শ্রাবণী নির্বিকার হলেও মিশাত টের পাচ্ছে তার অন্তঃপুরে শ্রাবণীর কথাগুলো পরিবর্তন সাধিত করছে। তার হঠাৎ মনে হলো, হ্যাঁ তার ধনী হতে হবে। এই মেয়েটার জন্য হলেও হতে হবে।

শ্রাবণী বললো,
“আপনি যদি ধনী হয়ে যান, তাহলে আমি আপনাকে বিয়ে করবো। আপনি করবেন তো?”

মিশাত না বোধক মাথা নাড়লো।
শ্রাবণী বিস্ময়ে জানতে চাইলো,
“কেন?”

“কারণ তুমি অনেক ছোটো। মাত্র ক্লাস নাইনে পড়ো।”

“এখন না হয় ছোটো, আপনার ধনী হতে হতে আমি বড়ো হয়ে যাব। তিন বছর পর বিয়ে করবো আমি। এই তিন বছরে আপনাকে ধনী হতে হবে, যদি না হন আপনাকে আর বিয়ে করবো না।”

“তিন বছর পর বিয়ে করবে তুমি?”

শ্রাবণী লজ্জা পেয়ে হেসে বললো,
“হুম।”

মিশাতের এবার হাসি পাচ্ছে। সে বললো,
“তুমি বোকা না সহজ-সরল বুঝতে পারছি না।”

“বোঝার দরকার নেই।”

শ্রাবণী উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“রাতে খাওয়ার কিছু আছে আপনার ঘরে?”

“মুড়ি আছে। কেন? খাবে?”

“না। আপনি রাতে মুড়ি খেয়ে থাকবেন?”

“উহুঁ, হাওয়া খাবো।”

“হাওয়া খাবেন?” গভীর বিস্ময়ে বললো শ্রাবণী।

“হুঁ, খাওয়া খেলে সবচেয়ে বেশি পেট ভরে।”

“কীভাবে হাওয়া খাওয়া যায়?”

“প্রথমে মুখ হাঁ করবে, তারপর অনেকটা হাওয়া টেনে নেবে মুখের ভিতর, ঠোঁট মিশিয়ে ফেলে হাওয়া গিলে ফেলবে। এই হলো হাওয়া খাওয়া। সবচেয়ে সহজ খাদ্য।”

শ্রাবণীর হাসি পেল, একই সাথে কান্না। সে মন থেকে প্রার্থনা করলো মিশাত যেন তার বর্তমান অবস্থা থেকে ভালো অবস্থায় পৌঁছায় আগামীতে। মানুষটা খুব কষ্টে আছে। তাদের চেয়ে অনেক বেশি কষ্টে আছে। শ্রাবণী বললো,
“আমি যাই তাহলে।”

___________________

আদিলের বিয়ে যার সঙ্গে হওয়ার কথা তার নাম সুজানা। সম্পর্কে আদিলের মামাতো বোন সে। পরিবারের সবাই রাজি হলেও সুজানা একেবারেই রাজি নয় আদিলকে বিয়ে করতে। এ নিয়ে তাদের বাড়িতে কয়েকদিন ধরে ঝামেলা লেগেই রয়েছে। সুজানা আগে আদিলকে পছন্দ করলেও, আদিলের এক্সিডেন্টের পর সে আদিলকে একদমই পছন্দ করে না। অমন একটা মানসিক রোগীকে কি বিয়ে করা যায়? সে বাবাকে বলেছে, যদি আদিলকে বিয়ে করতে হয় তাহলে সে মরে যাবে, নতুবা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে। কিন্তু তার বাবার খুব ইচ্ছা আদিলের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার। কারণ তার বিশ্বাস আদিল দ্রুতই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু সুজানার ধারণা আদিলের সঙ্গে তার বিয়ে হলে সারাজীবন একটা পাগলের সঙ্গে জীবন কাটাতে হবে।
এ নিয়ে আজ বিকালে তাদের পারিবারিক ঝামেলা তীব্র হলে সুজানা রুমে এসে রাগ-জিদে নিজের হাত কে’টেছে ব্লে’ড দিয়ে। খবরটা পারভীনও শুনেছেন। তিনি সন্ধ্যার পর বের হচ্ছিলেন সুজানাদের বাসায় যাওয়ার জন্য। আদিল বললো, সেও যাবে। পারভীন ছেলেকে নিতে চাচ্ছিলেন না সাথে, কিন্তু আদিল যাবে বলে জিদ ধরলো।
পারভীন দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে ভাইয়ের বাসায় এলেন। পুরো বাড়ি থমথমে। সুজানার বাবা তাদেরকে বসতে বললে আদিল বললো,
“আমি কি একবার সুজানার ঘরে যেতে পারি?”

পারভীন কিংবা সুজানার বাবা কেউই চাচ্ছেন না আদিল সুজানার ঘরে যাক। আদিল স্বাভাবিক নয়, আর সুজানাও কেমন না কেমন আচরণ করে তার ঠিক নেই। পারভীন বললেন,
“তোমার যেতে হবে না, এখানে এসে বসো।”

“না, আমি যাই।”

বলে আদিল সুজানার রুমের দিকে এগোলো। পারভীন ডেকে উঠলেন,
“আদিল!”

ততক্ষণে আদিল সুজানার রুমে ঢুকেছে। দরজা খোলার শব্দ পেয়েই চোখ মেললো সুজানা। সে শুয়ে ছিল, আদিলকে দেখে উঠে বসলো সঙ্গে সঙ্গে। কেন যেন আদিলকে দেখতেও তার বিরক্ত লাগছে। আদিল হেসে বললো,
“কেমন আছো সুজানা?”

“ভালো।”

“আমায় বিয়ে করবে না বলে হাত কে’টেছো?”

সুজানা হাত আড়াল করার চেষ্টা করলো। তার হাতে এখন ব্যান্ডেজ। আদিলের কথার কোনো প্রত্যুত্তর দিলো না সে। আদিল তার দিকে এগিয়ে এলো। বেডের পাশে এসে দাঁড়াতেই সুজানা বললো,
“প্লিজ, আপনি আমার কাছে থাকবেন না, দূর থেকে কথা বলুন। দূরে যান।”

আদিল বললো,
“রিল্যাক্স, আমি এমন কোনো কঠিন রোগে আক্রান্ত নই যে তোমার কাছাকাছি দাঁড়ালে তুমিও আক্রান্ত হয়ে যাবে।”
আদিল দূরে গেল না। যেখানে এসে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। বললো,
“হাত কে’টে ভালো করেছো, কিন্তু একটা হাত কাটলে কেন? এটা তো ঠিক করোনি। ব্লে’ড কোথায়?”

আদিল হঠাৎ ড্রেসিং টেবিলের উপর ব্লেড খুঁজতে শুরু করলো। ভয় পেল সুজানা। ভয়ার্ত গলায় বললো,
“ব্লেড খুঁজছেন কেন আপনি?”

“কারণ তোমার অন্য হাতটি আমি কে’টে দেবো।”

সুজানার চোখ বড়ো হয়ে উঠলো ভয়ে। সে মাকে ডাকতে চাইলেই আদিল তার মুখ চে’পে ধরলো। বললো,
“চুপ। কোনো কথা বললে গলা কে’টে দেবো একেবারে।”

সুজানা অনেক ভয় পেয়ে গেছে। ভয়ে তার গলা দিয়ে এমনিতেই কথা বের হবে না। আদিল সুজানার মুখ ছেড়ে দিলো। বললো,
“আমিও তোমাকে বিয়ে করবো না। কারণ আমি একজনকে ভালোবাসি। তার নাম রাত্রি। আমি তাকে বিয়ে করবো। তুমি এই যে বিয়ে করবে না, করবে না বলছো তাতে আসলে আমারই লাভ। এই কাজটা চালিয়ে যাও, ঠিক আছে? বিয়েটা বন্ধ করো। আর যদি বিয়ে বন্ধ না করতে পারো, আমার যদি সত্যিই তোমাকে বিয়ে করতে হয়, তবে মনে রাখো, বাসর ঘরে আমি সত্যিই তোমার গলা কে’টে দেবো ব্লে’ড দিয়ে। মনে থাকবে?”

সুজানা মাথা নাড়লো। মেয়েটার মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। আদিল সুজানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“ইউ আর সো গুড গার্ল, মাই সিস্টার!”

বলে সে সরে এলো সুজানার কাছ থেকে। বললো,
“আমার বিয়েতে যেয়ো কিন্তু, আমার বউকে সাজাবে তুমি। পারবে না?”

সুজানা কথা বললো না। সে এখন অপমান বোধ করছে।
আদিল হেসে বললো,
“অবশ্যই পারবে।”

আদিল বেরিয়ে গেল। রাগে সারা শরীর যেন জ্বলে যাচ্ছে সুজানার। না, সে মরে যাবে তবুও এইরকম একটা ছেলেকে বিয়ে করবে না। আদিল’রা বাড়ি থেকে বের হতেই সুজানা সবটা জানালো বাবাকে, যা যা বলেছে আদিল। সব শুনে সেলিম আলীর মেজাজ চরম খারাপ হলো। মেয়ের কাণ্ড-কারখানায় তিনি আগেই বোনকে জানিয়েছেন হয়তো বিয়েটা দেওয়া সম্ভব নয়। এসব শোনার পর তার আসলেই মনে হচ্ছে বিয়েটা দেওয়া যাবে না। ছেলে অন্য কাউকে ভালোবাসে, বাসর ঘরে মেয়ের গলা কে’টে দেবে, এগুলো কেমন কথা? সত্যিই তো আদিল তার মেয়ের গলাও কে’টে দিতে পারে! তিনি বোনকে কল করে এবার সরাসরি জানিয়ে দিলেন এই বিয়েটা সত্যিই আর দেওয়া সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে আদিল সুজানাকে কী কী বলে গেছে তাও সব বললেন।
তখন পারভীন সবে বাসায় এসেছেন। সব শুনে তারও মেজাজ প্রচণ্ড রকম খারাপ হয়ে গেছে। আদিলের দিকে তাকালেন রাগী চোখে। আদিল মায়ের রাগী চোখ দেখে বললো,
“কী হয়েছে মা? আমি কি কিছু করেছি?”

“করোনি কিছু? তুমি কী কী বলেছো সুজানাকে?”

“এমন কিছু বলিনি যাতে তোমার রেগে যাওয়া উচিত।”

“তুমি রাত্রিকে ভালোবাসো, ওকে বিয়ে করবে, এসব বলোনি?”

“বলেছি এবং তা সত্যিও।”

“সুজানাকে এই বিয়ে ভাঙতে বলেছো, যদি না ভাঙে তাহলে বাসর ঘরে ওর গলা কে’টে দেবে, এ কথা বলেছো?”

“হ্যাঁ।”

“ওর হাত কা’টার জন্য ব্লেড খুঁজেছিলে এ কথা সত্য?”

“তো খুঁজবো না? ও একটা হাত কা’টবে কেন?” একটু থেমে বললো, “আমি কি ওকে বিয়ে করার জন্য মরে যাচ্ছি যে ওর হাত কা’টতে হবে?”

পারভীন কেঁদে ফেললেন। অসহায় গলায় বললেন,
“তোমাকে নিয়ে আমি আর পারছি না। তুমি এমন কেন করছো? কষ্ট হয় তো আমার। আমি তোমার ভালোর জন্যই সব করছি।”

মায়ের চোখে অশ্রু দেখে আদিলের চোখও অশ্রুপূর্ণ হয়। সে বললো,
“কিন্তু আসলে তো আমি ভালো থাকতাম না মা। তোমার ছেলে যেরকম সুখী থাকবে ভাবছো তুমি, আসলে সেরকম ভাবে সুখী থাকবে না।”

পারভীন চোখ মুছলেন। বললেন,
“কী চাও তুমি? রাত্রির বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো? ওর সাথে ভালো থাকবে?”

উত্তরটা মালিহা দিলো,
“পাঠিয়ে দাও। ম্যাডামকে ছাড়া কারো কাছে পড়তে ভালো লাগে না। ম্যাডামকে মিস করছি। সে আমাদের বাড়িতে থাকবে। আমাকে পড়াবে। দেখবে ভাইয়াও ভালো হয়ে যাবে।”

পারভীন বললেন,
“ঠিক আছে, আমি প্রস্তাব পাঠিয়ে দেখবো।”

আদিল আচমকা মায়ের কপালে চুমু খেয়ে নিজের রুমের দিকে গেল। তার এ কাজটুকুতে বোঝা গেল সে কতখানি আনন্দিত। পারভীন আদিলের দিকে তাকিয়ে থেকে আবারও চোখের জল ফেলেন। তিনিও তো চান তার ছেলেটা ভালো থাকুক, আনন্দে থাকুক। কিন্তু তার মনে শঙ্কা, রাত্রি হয়তো আদিলকে বিয়ে করতে সম্মত হবে না!

______________________

তুরিনের পড়ার টেবিল জানালার কাছে। ওখান থেকে উঠান দেখা যায়, আর উঠান থেকে জানালাও দেখা যায়। সেই যে বেঞ্চ আছে সেখানটাও স্পষ্ট দেখা যায়। রাত্রি এর আগে খেয়াল করেনি। হয়তো বাইরেই তাকায়নি, কিংবা তাকিয়েছে লক্ষ করেনি। আজ হঠাৎ তার চোখ পড়লো। প্রথমে ফুলের টবে, তারপরই বেঞ্চে, বেঞ্চে বসে থাকা মানুষটার উপর। চোখে চোখ পড়তেই হাসলো তানবীন। হৃদয় ধক করে উঠলো ওই হাসিতে। রাত্রি চোখ সরালো চকিতে। তানবীন কি তার দিকেই তাকিয়ে ছিল? এখনও কি তাকিয়ে আছে? রাত্রি আড়চোখে আবার তাকালো। হ্যাঁ, তাকিয়ে আছে তো। তুরিন ডাকলো,
“ভাবি!”

রাত্রি ভয় পেল আচমকা ডাকে। তুরিনের দিকে তাকালো। তুরিন খাতা এগিয়ে দিয়ে বললো,
“লেখা শেষ।”

রাত্রি খাতা দেখতে দেখতে বললো,
“ভাবি ডাকবে না, তোমার ভাবি এখনও হইনি আমি। আপু ডেকো।”

তুরিন বললো,
“কিন্তু আমার মনে হয় ভাবি ডাকাই গুড, বেটার, বেস্ট!”

“না প্লিজ, ডেকো না। আমি অস্বস্তি বোধ করি।”

তুরিন আর কিছু বললো না, কিন্তু তার ভাবি ডাকতেই ভালো লাগছিল।

আজ পুরো ঘণ্টাটা কেমন অস্বস্তিতেই কাটলো রাত্রির। কারণ তানবীন বাইরে থেকে তাকে দেখছিল। কেউ এরকম ভাবে দেখলে অবশ্যই অস্বস্তি হওয়াই স্বাভাবিক। রাত্রি বুঝতে পারছে না তানবীনের সঙ্গে তার আসলেই বিয়ে হবে কি না। সে এরকম কিছু ভাবতেই পারছে না। যদি হয়? তানবীন তার স্বামী হবে, তুরিন তার ননদ হবে, রেহনুমা তার শাশুড়ি মা হবে, এই বাড়িটা তার শ্বশুর বাড়ি হবে…না, এসব ভাবতে গেলেও তার মাথা গুলিয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে এটা কখনও ঘটা সম্ভব নয়। কিন্তু সবটা এমন যেন বিয়েটা আসলেই হয়ে যাবে। হলে তো তাকে এরপর থেকে এ বাড়িতে থাকতে হবে। রাত্রি তুরিনের রুমটাতে চোখ বুলালো। এত সুন্দর রুম। তানবীনের রুমও নিশ্চয়ই এত সুন্দর। সে বুঝতে পারছে না, এরকম বাড়ির মানুষরা কেন তার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো? তানবীনদের তুলনায় তাদের কিছুই নেই।
রাত্রি তুরিনকে আগামীকালের পড়া দেখিয়ে বের হলো রুম থেকে। রেহনুমা বাড়িতে নেই, মার্কেটে গিয়েছেন কেনাকাটা করতে। বাড়ির কাজে সাহায্যকারী মহিলাটা ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। খুব বেশি বয়স্ক তিনি নন। হতে পারে রেহনুমা সুলতানার চেয়ে দুই-তিন বছরের বড়ো। রাত্রি তাকে দেখে সালাম দিলো। মহিলা রাত্রির গাল ছুঁয়ে আদর করে বললেন,
“ও মা, তুমি তানবীনের বউ? কী মিষ্টি তুমি!”

রাত্রি সামান্য হাসার চেষ্টা করে বললো,
“আমি ওনার বউ নই, বিয়ে এখনও হয়নি।”

“হবে তো, না কি? মাশাআল্লাহ অনেক মানাবে তোমাদের। দুজন সারাজীবন সুখী থাকো।”

রাত্রির মহিলার অগ্রিম কথা ভালো লাগছে না, অস্বস্তি হচ্ছে। বিয়ে হলোই না অথচ সারাজীবন সুখী থাকার কথা বলছেন। রাত্রি তাড়াতাড়ি মহিলার পাশ কাটিয়ে বাইরে চলে এলো। ভেজানো সদর দরজা খুলে নামতেই তানবীনের মুখোমুখি। রাত্রি তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলো। কিন্তু অন্যদিকে পা বাড়াতেই তানবীন তার সামনে এসে দাঁড়ালো। আবার অপরদিকে পা বাড়ালো রাত্রি। তানবীন ইচ্ছা করে আবারও তার সামনে এসে দাঁড়ালো। রাত্রি বললো,
“করছেন কী আপনি?”

“কী করছি?”

“পথ আটকাচ্ছেন।”

“আমি তো আটকাচ্ছি না, তুমিই সামনে এসে যাচ্ছ।”

“না, আপনি ইচ্ছা করে করছেন।”

“কী করে জানো ইচ্ছা করে করছি? এখনই এত তাড়াতাড়ি বুঝতে শিখে গেছো আমাকে?”

“ব্যাপারটা তেমন নয়।”

“তাহলে কেমন?”

“জানি না।”

তানবীন হেসে ফেললো। রাত্রি বললো,
“হাসছেন কেন?”

“হাসা যাবে না?”

“সেটা বলিনি।”

“তাহলে?”

“কিছু না। তবে হ্যাঁ, ওরকম ভাবে তাকাবেন না।”

“কী রকম ভাবে?”

“ওই যে, জানালা দিয়ে তাকাচ্ছিলেন।”

তানবীন বললো,
“তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ?”

“হ্যাঁ, অপরাধ।”

“তাহলে শাস্তি দাও। তোমাকে ফেলে রেখে যাও আমার কাছে।”

“অদ্ভুত কথাবার্তা!”

রাত্রি পাশ কাটিয়ে চলে গেল তানবীনকে। তানবীন আকাশের দিকে তাকালো। মেঘ জমতে শুরু করেছে। সে জানে রাত্রি হেঁটে বাড়ি ফিরবে। পিছন থেকে ডেকে বললো,
“একটা ছাতা নিয়ে যাও।”

“দরকার নেই।”

তানবীন দৌড়ে ঘরে ঢুকলো। ফিরে এলো তার ছাতাটা নিয়ে। রাত্রি গেট পেরিয়ে ততক্ষণে বাইরে চলে গেছে। তানবীন দৌড়ে বের হয়ে ধরে ফেললো রাত্রিকে। ছাতাটা রাত্রির হাতে দিয়ে বললো,
“বিয়ের রাতে ফেরত দিয়ো।”
বলেই সে বাড়ির দিকে ঘুরলো।

রাত্রি পিছন থেকে বললো,
“যদি বিয়েটা না হয়?”

তানবীন ফিরে তাকালো। বললো,
“হবে। আর সেদিনও বৃষ্টি থাকবে। এক ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখবো আমরা। তোমার হাতের ওই ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে।”

রাত্রি তাকিয়ে রইল আর তানবীনও। দুজনের চোখে চোখে কিছু যেন বিনিময় হলো। যা তাদের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছে আলোড়ন সৃষ্টি করলো। তবে সে আলোড়ন কেউ কাউকে বুঝতে দিলো না।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here