#কালো_রাত্রির_খামে (১৯)
#লেখা: ইফরাত মিলি
___________________
অল্পের জন্য প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়তে হলো রাত্রিকে। সে প্রায় বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছিল, এর মাঝেই বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া, শুরু হলো বজ্রপাতও। সে ভিজে একাকার হলো। আল্লাহর নাম করতে করতে বাড়িতেও পৌঁছে গেল। তবে সে যে বোকার মতো একটা কাজ করে ফেলেছে তা বুঝতে বাকি নেই। সে তো কোনো দোকান বা অন্য কোনো বিল্ডিংয়ের নিচে আশ্রয় নিতে পারতো। তবে এ কথা তার মাথাতে একবারের জন্যও আসেনি। গেট দিয়ে ঢোকার সময় তার জামাটা গেটের ভাঙা এক অংশে বেজে ছিঁড়ে গেছে। তার মূল মন খারাপের কারণই এটা। তার যে কী পরিমাণ মন খারাপ হচ্ছে সে বুঝাতে পারবে না। এমনভাবে জামাটা ছিঁড়ে গেছে যে এটা সেলাই করে বাইরে পরে বের হওয়া যাবে না। সেলাইয়ের দাগটা দেখা যাবে। আজ হয়তো তার এমন মন খারাপ করতে হতো না, যদি সে হুট করেই আরও একটা ভালো জামা কিনতে পারতো। কিন্তু এই রকম একটা পোশাক সে চাইলেই কিনে ফেলতে পারবে না। কারণ পোশাক কেনার জন্য টাকা ব্যয় করলে অন্য ক্ষেত্রে টাকার ঘাটতি হবে। ঘরে এসে ঢুকতেই প্রিয়ারা বললেন,
“তোমার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিল। যে ঝড় হচ্ছে বাইরে। খুব ভিজে গেছো তুমি। যাও তাড়াতাড়ি পোশাক পালটে নাও।”
রাত্রি রুমে এলো। ঠান্ডা লাগছে তার। তাপমাত্রাও কমে গিয়েছে, আর তার শরীর ভেজা বলে ঠান্ডাটা আরও বেশি লাগছে। সে ব্যাগের মধ্য থেকে সব জিনিসপত্র বের করতে লাগলো। ব্যাগ ভিজলেও ব্যাগের ভিতরে পানি ঢুকতে পারেনি। মোবাইল বের করে রাখার সঙ্গে সঙ্গেই কল বেজে উঠলো। তানবীন কল দিয়েছে। রিসিভ করা মাত্রই তানবীনের চিন্তিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল,
“তুমি বাসায় পৌঁছেছো?”
“জি।”
“খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। রিকশা নিয়ে ফিরেছো?”
“না, রিকশা, সিএনজি কিছুই পায়নি। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি।”
“আচ্ছা। অনেকবার কল দিয়েছিলাম তোমাকে, কিন্তু তুমি রিসিভ করোনি।”
“আসলে তখন আমি রাস্তায় ছিলাম। কল রিসিভ করার অবস্থায় ছিলাম না। ভিজে গিয়েছি পুরো।”
“বোকা। তোমার বাসা থেকে বের হওয়ার কী দরকার ছিল? আমি ফিরতাম, তারপর না হয় তোমাকে তোমার বাড়িতে পৌঁছে দিতাম।”
“অসুবিধা হয়নি। একটু ভিজে গেছি এই আরকি।”
“আমি এখন কোথায় জানো?”
“না।”
“তোমার বাসার সামনে।”
“কী?” রাত্রির পিলে চমকে উঠলো। সে তাড়াতাড়ি জানালা খুললো সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে। সে অবাক হয়ে গেল রাস্তায় একটা বাইক দাঁড় করানো দেখে। বৃষ্টির জন্য ভালো দেখা যাচ্ছে না। জানালা খুলে রাখা দায়। রাত্রি জানালাটা বন্ধ করে বললো,
“আপনি পাগল? এই ঝড়ের ভিতর আপনি এখানে এসেছেন কেন?”
“কল রিসিভ করছিলে না। চিন্তা হচ্ছিল। আর বৃষ্টিতে কোথাও আটকা পড়েছো কি না সেটা দেখতেই আসতে হলো।”
“এখনই যান।”
“কোথায় ঘরে নিয়ে বসাবে, তা নয়, উলটো তাড়িয়ে দিচ্ছ।”
“আমার অত ভালো ঘর নেই। সবার বসার জন্য উপযুক্ত নয়।”
“তুমি যদি থাকতে পারো ও ঘরে তবে আমিও পারি।”
“আপনি চলে যান। বজ্রপাত হচ্ছে, আপনার ভয় করছে না?”
“তোমার ভয় হচ্ছে না? যদি একটা বাজ আমার মাথার উপর পড়ে তখন?”
“এসব কথা বলবেন না। একটা নিরাপদ স্থানে যান তাড়াতাড়ি।”
“হুম।”
রাত্রি মোবাইলটা বিছানায় রেখে আলনার দিকে এগোলো। পায়ের নিচে পানি ছলছল করছে। বিদ্যুৎ নেই। চার্জার লাইট জ্বালিয়েছে। আলনার কাছে এসেই সে ভয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলো। একটা ছোটো আকৃতির সাপ। আচমকা পায়ের খুব নিকটে দেখতে পেয়ে বেশি ভয় পেয়ে গেছে। সে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে এলো। বৃষ্টির কারণে কেউ তার চিৎকার শুনতে পায়নি। প্রিয়ারা বসার ঘরে বসে ব্লাউজ সেলাই করছিলেন সুই-সুতা দিয়ে। ব্লাউজের একটা জায়গায় সেলাই ছিঁড়ে গেছে। রাত্রিকে এরকম ভাবে বের হতে দেখে বললেন,
“কী হয়েছে?”
“রুমে একটা সাপ!”
“বলছো কী?” প্রিয়ারা উঠে দাঁড়ালেন। রাত্রি হঠাৎ খেয়াল করলো শ্রাবণীকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। সে জানতে চাইলো,
“শ্রাবণী কোথায়?”
“বাইরে গিয়েছিল। ফেরেনি।”
“মেয়েটা এত কেন বাইরে ঘোরাঘুরি করে?”
“সাপটাকে কী করবে এখন?”
“বোকার মতো কথা বলবেন না।” মিথিলা বলে উঠলো। সে রুমের দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে এগিয়ে এসে বললো,
“সাপটাকে দুধ কলা দিয়ে পুষবে না কি? মে’রে ফেলতে হবে।”
রান্নাঘর থেকে একটা লাঠি নিয়ে এলো মিথিলা। শ্রাবণী লাঠিটা এনে রেখেছিল টিকটিকি মারার জন্য। কিন্তু রাত্রির মনে হলো এই লাঠি সাপ মা’রতে উপযুক্ত নয়। কিন্তু মিথিলা ঠিকই সাপটাকে মে’রে ছাড়লো এই লাঠি দিয়ে।
___________________
চিলেকোঠার ঘরে বজ্রপাতের শব্দ আরও বেশি ভয়ানক শোনাচ্ছে। মাঝে মাঝে যখন ঝড় শুরু হয় মিশাতের মনে হয় চিলেকোঠাটা ভেঙেচুরে যাবে। ইট-সিমেন্টে গড়ে ওঠা জীর্ণশীর্ণ দেওয়াল ভেঙে পড়বে তার গায়ের উপর। ওভাবেই সে মারা যাবে, কেউ জানবেও না এই ধ্বংসাবশেষের নিচে মিশাত নামের একটি ছেলে রয়েছে!
হাওয়া কি না তার প্রিয় খাদ্য। আরও কত কী ভাবনা যে আসে মাথায়। তবে আজ তার এমন ভাবনা হচ্ছে না। একলা থাকলে হয়তো হতো, কিন্তু এখন যে সে একা নয়। শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথি এখন তার ঘরে। বসে বসে ক্যাডবেরি খাচ্ছে। ক্যাডবেরিটা গতরাতে সে যেখানে নাইড গার্ডের কাজ করে সেখানকার এক ভাই দিয়েছিল। খাওয়া হয়নি। আজ শ্রাবণী যখন এলো তখন মনে হলো ওকে খেতে দেয়। শ্রাবণীকে আর কখনও কিছু খেতে দেয়নি এর আগে। এছাড়া শ্রাবণীর ছাতা মেকানিকের কাছ থেকে ঠিক করে এনে দেওয়ায় যত টাকা খরচ হয়েছিল সেটা শ্রাবণী দিয়ে দিয়েছিল। সেও ‘লাগবে না’ এমন কথা না বলেই টাকাটা নিয়ে নিয়েছিল। এখন সেটার জন্য লজ্জা লাগে। কী হতো যদি সেদিন সে টাকাটা না নিতো? অবশ্য পুরোনো কথা মনে করে এখন সে কেন আফসোস করছে? আফসোস কোনো ভালো জিনিস নয়।
“নিন।”
শ্রাবণীর কথা শুনে শ্রাবণীর দিকে ফিরে তাকালো মিশাত। শ্রাবণী তার দিকে ক্যাডবেরির খোসা বাড়িয়ে দিয়েছে। মিশাত খোসাটা নিলো। দেখতে পেল তার ভিতর অর্ধেকটা ক্যাডবেরি এখনও রয়ে গেছে। সে বললো,
“খাবে না?”
“আপনাকে খেতে দিয়েছি।”
মিশাতের কেন যেন লজ্জা করলো। এই ক্লাস নাইনে পড়া মেয়েটার কথায়ও আজকাল সে অযথাও লজ্জা পাচ্ছে। কী একটা বাজে ব্যাপার যে হচ্ছে তার সঙ্গে। সে মিথ্যা বললো,
“আমি চকলেট খাই না, তুমিই খাও।”
বলে খোসাটা বাড়িয়ে দিলো শ্রাবণীর দিকে। শ্রাবণী বললো,
“আমি আপনাকে দিয়েছি, আপনি না খেলে পরে ফেলে দেবেন।”
শ্রাবণী চেয়ার ছেড়ে উঠে এলো জানালার কাছে। মিশাত জানালায় পলিথিন দিয়ে রেখেছে। শ্রাবণী জানতে চাইলো,
“এটা কেন দিয়ে রেখেছেন?”
“যাতে ভিতরে বৃষ্টি না আসে, কিন্তু বাইরের আলো আসে। বিদ্যুৎ থাকে না তো। জানালার কপাট লাগিয়ে দিলেই তো ঘর অন্ধকার হয়ে যাবে।”
“দারুণ বুদ্ধি। আপনি জানেন, বৃষ্টি হলেই না আমাদের রুমটা সাগর হয়ে যায়।”
“সাগর?” বিস্ময়ে প্রশ্ন করলো মিশাত, “কীভাবে?”
“সেটা আপনার জানতে হবে না। তবে ওই সাগর সৃষ্টি হওয়ার জন্য আমাদের বাড়ি ভাড়া কিছুটা কম নেওয়া হয়।”
“সাগরের মাঝে থাকতে ভালো লাগে?”
শ্রাবণী দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললো,
“প্রকৃত সাগর হয়তো খুব সুন্দর। কিন্তু আমাদের রুমে যে সাগর সৃষ্টি হয় ওটা অসুন্দর। আমাদের কষ্ট দেয়।”
মিশাত বুঝতে পারছে না সাগর বলতে কী বোঝাচ্ছে শ্রাবণী। সে বুঝতেও চায় না। হয়তো কোনো কষ্টের বিষয়। কষ্টের কথা জেনে সেও কষ্ট পেতে চায় না।
“পানি খাবে?” বললো মিশাত।
“পানি?” অন্যমনস্ক গলায় বললো শ্রাবণী, “আমাদের তো পানির কোনো অভাব নেই মিশাত ভাই। এই যে বৃষ্টি হচ্ছে, হাঁ করে বৃষ্টির পানি খেয়ে তৃষ্ণা মেটানো যাবে। কিন্তু আমাদের যে সুখের অভাব আছে। ওই সুখের অভাব কীসে মিটবে? আপনি দুঃখী, আমরা দুঃখী, বিল্ডিংয়ের বাকি দুই ভাড়াটিয়া পরিবারও দুঃখী। এই শহরে আদৌ কোনো সুখী মানুষ কি আছে মিশাত ভাই?”
শ্রাবণীর কথায় ক্রমশই মন খারাপ হতে থাকলো মিশাতের। সে উত্তর দেবে, ‘না।’
কিন্তু তার আগেই শ্রাবণী বললো,
“হ্যাঁ, সুখী মানুষ আছে তো। যাদের অনেক টাকা, অনেক ভালো জামা আছে, তিন বেলা ভালো তরকারি দিয়ে ভাত খায়, যাদের অনেক বন্ধু আছে, তারা তো সুখীই, তাই না বলুন?”
শ্রাবণীর চোখ চিকচিক করে উঠলো অশ্রুতে। তার এসবের কিছুই নেই। তার সামনে যে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে, সেই মানুষটারও এসব কিছুই নেই। মিশাতেরও চোখ ভিজে আসে। শ্রাবণী অশ্রুসজল নেত্রতে হেসে বললো,
“আপনি আমার বন্ধু হবেন মিশাত ভাই?”
মিশাত ইতোমধ্যে শ্রাবণীকে নিজের বন্ধু ভাবতো। সে বললো,
“এখনও বন্ধু হইনি?”
শ্রাবণী আবার হেসে বললো,
“আপনি আমার একমাত্র বন্ধু। কিন্তু দেখুন, এমন একজনকে আমি বন্ধু বানালাম যে কি না আমার চেয়েও দুঃখী।”
শ্রাবণী একটুক্ষণ থেমে থেকে বললো,
“আমরা কি আমাদের কষ্টগুলোকে মাড়িয়ে কখনও সুখী হয়ে উঠতে পারবো মিশাত ভাই?”
প্রশ্নটা তীব্র হাহাকার সৃষ্টি করলো মিশাতের বুকে। সেও খুব ভাবনায় পড়লো, কখনও কি তাদের সুখী হয়ে ওঠা হবে এই দুঃখের শহরে?
____________________
শরিফুল খন্দকার দেশে ফিরেছেন। ফিরেই চলে এলেন বাড়িতে। তার অবর্তমানে তার ছেলের বিয়ে ঠিক করে এত স্পর্ধা হয়ে গেছে রেহনুমার? তার ছেলেকে তিনি পছন্দ করে বিয়ে করাবেন, রেহনুমা বিয়ে ঠিক করার কে? তাও কি না ঠিক করেছে একটা ভিখারি পরিবারের মেয়েকে। বেশি স্পর্ধা বেড়ে গেলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দেবেন।
এই কথাগুলো রেহনুমাকে বলতেই রেহনুমা জবাবে বললেন,
“ওহ এখন খুব বাবার অধিকার ফলাতে এসেছো? এতকাল কোথায় ছিলে? ছেলেটাকে আমি মানুষ করেছি। ভালো-মন্দ খবর কখনও নিয়েছো তুমি? তুমি শুধু টাকা দিয়ে খালাস। আমাদের ভুলে ঘর ছেড়ে দূরে থাকো সব সময়। ছেলেমেয়ে দুটো অসুস্থ থাকলেও তোমার দেখা পাওয়া যায় না। তোমার তো ভাগ্য ভালো তোমার মতো একজন অযোগ্য বাবার জন্য অপেক্ষা করে আমি তানবীনের বিয়ে দিতে দেরি করেছি।”
শরিফুল খন্দকারের মস্তিষ্ক প্রচণ্ড গরম হলো।
“কী বললি তুই? অযোগ্য?”
তিনি রাগের মাথায় ধাক্কা মা’রলেন রেহনুমাকে। পিছনে টি-টেবিল ছিল। রেহনুমা টেবিলের উপর পড়ে ভীষণ ব্যথা পেলেন। শরিফুল খন্দকার তার গলা চেপে ধরে বললেন,
“খুব কথা হয়েছে তোর, তাই না? গলা বেশি বড়ো হয়ে গেছে? একদম মে’রে ফেলবো।”
রেহানুমা শরিফুল খন্দকারের হাত ছাড়ালেন খুব কষ্টে। তার চোখ জুড়ে অশ্রুর বন্যা। তীব্র ঘৃণা নিয়ে বললেন,
“বলবো না? তুমি তো একটা খারাপ মানুষ! তোমার মতো একটা মানুষের স্ত্রী আমি এ আমার জন্য চরম লজ্জা। ঘৃণা লাগে ভাবতে। ব্যবসায়িক কাজের নাম করে নিজের বান্ধবীকে নিয়ে বিদেশ থেকে ঘুরে এসেছো, এসব জানি না আমি? সবকিছুই জানি আমি। সব সময় সব খবরই আসে আমার কাছে। তোমার ছেলের কানেও আসে এসব খবর! তুমি লোকটা তো অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছো! অনেক আগে। যখন ছেলেটা ছোটো ছিল তখন থেকেই তুমি নষ্ট হয়ে গেছো। দিনের পর দিন থাকো কোথায় তুমি? তোমার কারি কারি টাকা আছে বলে আমাদের মানুষ মনে করো না? যা খুশি করে বেড়াবে তুমি? ছেলেমেয়েদের কথাও একবার মাথায় আসে না তোমার? ওরা তো এখন বড়ো হয়েছে। লজ্জা হয় না তোমার? এসব পরকীয়া ছেড়ে ভালো হতে ইচ্ছা করে না?”
শরিফুল খন্দকার অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে রেহনুমার চুল আঁ’কড়ে ধরলেন। আক্রোশে টি-টেবিলের সঙ্গে বার কয়েক আ’ঘাত করলেন রেহনুমার মাথা। মাথা ফেটে র’ক্ত গড়ালো। ঝামেলা চরমে চলে গেল এবার। অতীত-বর্তমানের নানা বিষয় উঠে আসলো। যা আরও রাগিয়ে তুললো শরিফুল খন্দকারকে। রাগে যেন উন্মাদ হয়ে গেলেন তিনি। একটা ফুলদানি দিয়ে রেহনুমাকে আ’ঘাত করলেন। একবার না, একাধিক বার।
তানবীন আর তুরিন মামার বাসা থেকে বাড়ি ফিরেছে। দরজা ভেজানো পেল। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকা মাত্রই যা দেখলো তা দেখার জন্য তারা কেউই প্রস্তুত ছিল না। বাবা তাদের মাকে ফুলদানি দিয়ে আ’ঘাত করছে। র’ক্তের স্রোত নামছে মায়ের মাথা থেকে। কেমন বিধ্বস্ত হয়ে গেছে মা। তানবীন ছুটে এসে বাবাকে থামানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাকে থামানো যাচ্ছে না। তুরিন এ ঘটনা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছে। সে একটুও নড়তে পারছে না নিজের জায়গা থেকে।
তানবীনের হঠাৎ কী যে হলো! সেও আর সহ্য করতে না পেরে দিশেহারা হয়ে একটা ফুলদানি তুলে শরিফুল খন্দকারের মাথায় আ’ঘাত করলো। খুব জোরে। শরিফুল খন্দকারের শক্তি শিথিল হয়ে আসলেই তানবীন তাকে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো যেন। শরিফুল খন্দকার দেওয়ালের সঙ্গে বাজেভাবে বাড়ি খেলেন। তবে তার দিকে কেউ ভ্রুক্ষেপ করার সুযোগ পেল না। তানবীন ব্যস্ত হয়ে পড়লো মাকে নিয়ে। রেহনুমা কথা বলছেন না। মাথা র’ক্তাক্ত। রক্ত পড়েই চলেছে। সারা মুখ মেখে গেছে র’ক্তে। ভয় করছে তানবীনের। কাঁদছে সে। সে সহজে কান্না করার ছেলে নয়। এ ব্যাপারটা সহজ নয়ও।
“মা, কথা বলো।” কান্নায় গলা ভেঙে আসে তানবীনের।
কিন্তু রেহনুমা কোনো সাড়া দেন না। তানবীন মায়ের এক হাত আঁকড়ে ধরে। কিন্তু তার মা চোখ খুললো না, সাড়া দিলো না। এরকম করলে তো হবে না, তাকে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য কল করতে হবে। সে এক বন্ধুর কাছে কল দিয়ে বললো একটা অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য।
তুরিন এসে মায়ের কাছে বসেছে। এটা যেন বাস্তব নয়। ঘুমিয়ে দেখা দুঃস্বপ্ন যেন। তুরিন আকস্মিক কষ্টে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। সেই কান্নার শব্দ তার মায়ের কানে পৌঁছয় না। তুরিন কাঁপা কান্না কণ্ঠে বললো,
“এ-এটা…কী হলো ভাইয়া?”
তানবীন কিছু বুঝতে পারছে না, বলতে পারছে না। এমন কিছু কখনও হবে এ দুঃস্বপ্নেও কখনও ভাবেনি তারা। তানবীনের হঠাৎ চোখ পড়লো শরিফুল খন্দকারের দিকে। আরেক দফা ঝটকা খেলো যেন সে। শরিফুল খন্দকারের নিথর দেহ পড়ে আছে ফ্লোরে। র’ক্তে তলিয়ে যাচ্ছে ফ্লোর। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে তানবীনের। শরিফুল খন্দকারও নিশ্চল! দেওয়ালের যে জায়গাটায় তার মাথা বাড়ি খেয়েছিল সেখানে র’ক্ত লেগে আছে। তানবীন মায়ের দিকে তাকালো। তার সমগ্র বিশ্ব ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। বাবার দিকে এগিয়ে গেল সে। মায়ের মতোন বাবাও শব্দহীন, নিথর! যেন দুজনই মৃত!
__________________
হাসপাতালের করিডোরে চিন্তিত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। তানবীন পাথরের মতো স্তব্ধ। সে এখন কাঁদছে না। তার চোখের জল শুকিয়ে গেছে। যেন মরানদী। তবে তুরিন কেঁদেই চলেছে। চাচার পরিবারও এসে গেছে। মামা এসেছে, আর রয়েছে তানবীনের কয়েকজন বন্ধু বান্ধব।
এখনও কোনো খবর পাওয়া যায়নি। একটু পরে একজন ডাক্তার এলেন সংবাদ জানানোর জন্য। প্রথমে জানালেন শরিফুল খন্দকার মৃত। হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই তিনি মারা গেছেন! এ খবরে শোকে কেঁপে উঠলো করিডোর। কেউ কেউ কেঁদে চোখ ভেজালো। বিশেষ করে চাচা। তানবীন জানে তার বাবার মৃত্যুতে চাচা অতটাও ব্যথিত নন, যতটা সে দেখাচ্ছে। নিজের বাবাকে ঘৃণা করে তানবীন। তবুও বাবার মৃত্যুর সংবাদে হৃদয় ভাঙলো তার। তার চোখের মরানদীতে আবারও জল দেখা গেল। সে আটকে রাখতে পারলো না অশ্রুনীর। গাল বেয়ে নেমে গেল জলধারা। আর নেমেই গেল। দ্বিতীয় সংবাদটা এখনও শোনা বাকি। দ্বিতীয় সংবাদটা হলো- রেহনুমা সুলতানাও মারা গেছেন! হাসপাতালে আনার পরও তিনি জীবিত ছিলেন, কিন্তু এই মাত্র উনি মৃতবরণ করলেন! জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা। এমন ভয়ংকর কিছু সহ্য করার ক্ষমতা তানবীনের হলো না। আচমকা একটা মনুষ্য দেহ ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ার শব্দ হলো। সকলে চোখের সামনে তানবীনকে লুটিয়ে পড়তে দেখে ঘাবড়ে গেছে। তুরিন আতঙ্কিত গলায় ডেকে উঠলো,
“ভাইয়া!”
(চলবে)#কালো_রাত্রির_খামে (২০)
#লেখা: ইফরাত মিলি
___________________
রেহনুমা সুলতানা ও শরিফুল খন্দকারের মৃত্যুর সংবাদ জানানো হচ্ছিল সব পরিচিতদের। কিছু মানুষকে রাতেই জানানো হয়েছে আর কিছু মানুষদের সকালে। রাত্রির কাছে কল এলো সকালে। তানবীনের মোবাইল থেকে। এত সকালে তানবীনের কল? রাত্রি রিসিভ করে ফেললো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। অপর প্রান্ত থেকে একজন সালাম দিলো। কেবল সালাম শুনেই রাত্রি বুঝতে পারলো এটা তানবীন নয়। রাত্রি সালামের প্রত্যুত্তর দেওয়া মাত্রই অপরিচিত মানুষটা নিজের পরিচয় দিলো। তানবীনের বন্ধু সে। পরিচয় দেওয়ার পাশাপাশি মৃত্যুর সংবাদও জানালো সে।
রাত্রি এমন একটা সংবাদ শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। গতকাল বিকেলেও সে রেহনুমা সুলতানাকে দেখেছে। ভালো, সুস্থ মানুষ। অথচ আজ তার মৃত্যুর সংবাদ এলো! কীভাবে কী হলো? তাও দুজন মারা গেছেন! রাত্রি যেন ভাবতে পারছে না কিছু। এ সংবাদ তার কাছে ভয়ংকর সংবাদ! জানতে চাইলো,
“কীভাবে মারা গেলেন?”
“সে অনেক কথা আপু। এভাবে বলার মতো নয়।”
তানবীনের বন্ধু ব্যস্ত ভঙ্গিতে কল কেটে দিলো। রাত্রির হাত-পা অবশ অবশ লাগছে। সে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না যা শুনেছে তা আসলেই সত্যি। কেন যেন ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! বেশিদিন হয়নি সে রেহনুমাকে চেনে। কিন্তু যতদিন ধরে চেনে ততদিনেই রেহনুমা তার মনে স্থান করে নিতে যথেষ্ট ছিল। রাত্রি মাথা নুইয়ে ফেললো। মানুষের মৃত্যু কখন, কীভাবে যে হয়ে যায়! তানবীন আর তুরিনের কথা ভেবে কষ্টটা আরও তুখড় হয়ে উঠলো তার। ওরা এখন কেমন আছে?
রাত্রি দ্রুত রুম থেকে বের হলো ঘরের বাকিদের খবরটা জানাতে। সে টের পাচ্ছে বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা কীভাবে কাঁপছে!
____________________
বাড়িটা আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশী মানুষদের পদচারণায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে। একাধিক লোকের কথাবার্তার আওয়াজে কোলাহলময় হয়ে উঠেছে বাড়ির আঙিনা। কারো কারো চোখের জল এখনও পড়ছে। নয়টায় জানাজা হবে। শরিফুল খন্দকার খুব বেশি পরিচিত না থাকলেও মোটামুটি ভালোই পরিচিত ছিলেন শহর জুড়ে। তার কর্মক্ষেত্রেরও কিছু মানুষ এসেছে।
তানবীন কোলাহল থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিজের রুমে বসে আছে, খাট ঘেঁষে ফ্লোরে। বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তাকে। নিজের ভিতর নিজে কী যে ভয়ংকর এক যুদ্ধ করছে সে সেটা কাউকে বোঝাতে পারছে না। কাউকে এই যুদ্ধের ময়দানে সঙ্গী করতে পারছে না। এক দিকে মাকে হারানোর তীব্র যন্ত্রণায় পৃথিবীটা ভেঙেচুরে আসছে, অন্যদিকে বাবাকে খু’ন করার অপরাধবোধ তাকে অবশিষ্টটুকুও চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে। হোক অনিচ্ছাকৃত খু’ন, কিন্তু সত্যি তো এটাই সে খু’ন করেছে! তাও কি না নিজেরই বাবাকে! মায়ের মুখটা খুব মনে পড়ছে। সবচেয়ে আপন মানুষটাকে সে হারালো! মানুষটাকে সব সময় দুঃখী দেখে গেছে। কোনো একদিন খুব করে মায়ের হাত ধরে আশ্বস্ত করে বলতে ইচ্ছা করছিল,
‘মা, আজ থেকে তুমি সুখী। কোনো দুঃখকে আর স্পর্শ করতে দেবো না তোমাকে। এক বিন্দু পরিমাণ দুঃখও তোমাকে ছুঁতে পারবে না।’
কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনি। আর কখনও বলা হয়ে উঠবেও না! তীব্র যাতনায় চোখ বোজে তানবীন। বন্ধ আঁখি বেয়ে ক্লেশের নীর ঝর্ণা বয়ে যায়।
রুমের অর্ধ ভেজানো দরজা খুলে ফেললো একজন। তিনি তানবীনের মামা। জানালেন, একজন সাংবাদিক এসেছে। জোড়া মৃত্যুর ঘটনায় উৎসাহী হয়ে নিউজ তৈরির জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে এসেছে। রাতে না কি হাসপাতালে পুলিশও এসেছিল। তানবীন সে সময় অজ্ঞান ছিল।
সাংবাদিক এসেছে শুনে ভয়ে হৃৎপিণ্ড লাফাতে লাগলো তানবীনের। এই সাংবাদিক কি তার সম্পর্কে পত্রিকায় লিখবে? কেমন হেডলাইন হবে? ছেলের হাতে বাবা খু’ন? তানবীন কুঁকড়ে যায় ভয়ে! অথচ ভয় বিষয়টা কখনও তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ছিল না। গতরাতের ঘটনা পুরো তাকে ভেঙে চুরমার করে নতুন এক তানবীনকে সৃষ্টি করেছে। তানবীন বললো,
“আমি কারো সঙ্গে দেখা করবো না মামা।”
“আমি চলে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু ওনারা জোর করছেন। একবার দেখা করো বাবা।”
সাংবাদিক লোকটাকে একটা রুমে বসতে দেওয়া হয়েছে। কারণ বাইরে অনেক কোলাহল! তানবীন রুমে ঢুকে তুরিনকেও দেখতে পেল। বোনকে দেখে তার আরও কষ্ট হয়। তাদেরকে সব সময় যে মানুষটা পরম যত্নে, ভালোবাসায় আগলে রাখতো, সে মানুষটা তো আর নেই! এখন কে দেখে রাখবে তুরিনকে? কে যত্ন নেবে মায়ের মতো করে? কী হবে তার বোনটার? তানবীন রুমে ঢোকা মাত্রই সাংবাদিকের সঙ্গের লোকটা ক্যামেরা উঁচু করলো ছবি তোলার জন্য। মামা সঙ্গে সঙ্গে বললেন,
“না, কোনো প্রকার ছবি তুলতে পারবেন না। আর কিছু রেকর্ডও করতে পারবেন না।”
সাংবাদিক সাহেব বললেন,
“ঠিক আছে।”
তানবীন তুরিনের পাশে বসলেই সাংবাদিক বলতে শুরু করলেন,
“আমি ইতোমধ্যে যা জানতে পেরেছি তা হলো আপনারা দুই ভাইবোন গত সন্ধ্যায় মামার বাসায় গিয়েছিলেন। এবং যখন ফিরলেন তখন দেখলেন শরিফুল খন্দকার, মানে আপনাদের বাবা আপনাদের মাকে মা’রছিল। আসলে কীভাবে কী হয়েছিল ঘটনাটা বলতে পারেন?”
তানবীন সাংবাদিকের দিকে তাকালো। গতরাতের ঘটনা ব্যাখ্যা করার মন মানসিকতা বা শক্তি কোনোটাই নেই তার। তবু সে যখন কিছু বলার জন্য কেবল নিজের ওষ্ঠদ্বয় ফাঁক করলো তুরিন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো,
“যখন আমরা ফিরলাম তখন বাবা একটা তামার ফুলদানি দিয়ে মাকে আ’ঘাত করছিল! এরপর মা যন্ত্রণায় দিশেহারা হয়ে আত্মরক্ষার জন্য বাবাকেও ফুলদানি দিয়ে আ’ঘাত করে এবং ধাক্কা দেয়। বাবা দেওয়ালের সঙ্গে গিয়ে বাড়ি খায় এবং মারা যায়। আর মা তার কিছুক্ষণ পর হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যায়।”
তানবীন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তুরিনের দিকে। তুরিন মিথ্যা বললো? সাংবাদিক সাহেব খুব মনোযোগ সহকারে তুরিনের কথা শুনলেন এবং দ্রুত গতিতে কিছু লিখে নিলেন। যদিও এ ঘটনা তিনি আগেই শুনেছেন। এরপর তুরিনের উদ্দেশ্যে আবারও প্রশ্ন করলেন,
“আপনারা কোনো প্রকার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেননি?”
“আমরা বাধা দেওয়ার আগেই সবটা ঘটে গিয়েছিল! চোখের পলকে!”
সাংবাদিক তানবীনের দিকে তাকালেন,
“আপনার বোন যা বলছে সত্যি?”
তুরিন এবার দাঁড়িয়ে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে উঠলো,
“আপনার কি মনে হয় আমি মিথ্যা বলছি? আমার কথা বিশ্বাস হলো না আপনার? এটাই ঘটেছে। আপনি প্লিজ চলে যান। আমরা এখন সেই অবস্থায় নেই যে আপনার সামনে বসে থাকবো, আপনি যা প্রশ্ন করবেন তার উত্তরও দিতেই থাকবো। আমাদের কষ্ট আপনারা বুঝবেন না। প্লিজ, চলে যান।”
সাংবাদিক সাহেব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেন। তানবীনের মামা জামাল হোসেনের দিকে তাকালে তিনি বললেন,
“এগুলোই ঘটেছে। আপনারা এখন চলে যান। ছেলেমেয়ে দুটো মা-বাবাকে হারিয়েছে, বুঝতেই পারছেন ওদের মনের অবস্থা।”
সাংবাদিক সাহেব চলে গেলেন। ।
তানবীন বোনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
“মিথ্যা বললি?”
তুরিন অশ্রুসিক্ত চোখে বললো,
“মাকে হারিয়েছি, এরপর বেঁচে থাকা সবচেয়ে আপন মানুষটাকেও কি হারাবো?”
এ কথা বলেই তুরিন বেরিয়ে গেল। সেখানে এসে বসলো যেখানে তার মায়ের লা’শ রাখা। কাপড়ে ঢেকে রাখা তার মৃত মায়ের শরীর। তুরিন মুখের উপর থেকে কাপড় সরালো। কাপড়ের নিচ থেকে মায়ের একটা হাত আঁকড়ে ধরে খুব অভিমান করে বললো,
“এভাবে ছেড়ে যেতে পারলে আমাদের? আমরা কীভাবে থাকবো? কীভাবে বাঁচবো? আমাদের তো আরও অনেক অনেক অনেক সময় একসঙ্গে কাটানোর কথা ছিল মা!”
তুরিনের মামি এসে রেহনুমা সুলতানার মুখ থেকে সরানো কাপড়টা টেনে দিলো। তুরিন বেশিক্ষণ এখানে বসে থাকলে ভেঙে পড়বে। সে তুরিনকে উঠিয়ে অন্যদিকে নিয়ে গেল। মামিকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো তুরিন।
তানবীন দরজায় দাঁড়িয়ে মায়ের লাশের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করে জীবনটা কোনো এক অন্ধকার গহ্বরে পড়ে গেল যেন। এতই গহীন গহ্বর যে সেখান থেকে একটুখানি আলোও দেখা যাচ্ছে না। মায়ের পাশের রুমেই বাবা শুয়ে আছে। সে মে’রে ফেলেছে ওই লোকটাকে! সে একজন খু’নি! এ কথা ভাবতেই পা টলে ওঠে তানবীনের।
রাত্রি ও তার পরিবার সবে এসে পৌঁছেছে তানবীনের বাড়িতে। অনেক লোকজনে বাড়ির প্রতিটা কোণ পূর্ণ। যাদের দেখতে পাচ্ছে তারা সবাই-ই অপরিচিত। তানবীন অথবা তুরিনকে দেখতে পাচ্ছে না। কাজে সাহায্যকারী সেই মহিলাকেও দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ একটা রুমের দরজায় চোখ পড়লো রাত্রির। মুখ দেখতে না পেলেও ওটা যে তানবীন বুঝতে অসুবিধা হলো না। রাত্রি সেদিকে এগিয়ে গেল। দরজায় এসে দাঁড়ালো তানবীনের পাশে। তানবীন তাকে লক্ষ করেনি। তানবীনের চোখ দুটি লাল। অজস্র জলের ধারা নেমে যাচ্ছে। তুরিন কাঁদছে ওপাশে বসে। ভীষণ কষ্টের দৃশ্য। সে আবার তানবীনের দিকে তাকালো। এ মুহূর্তে তানবীনেরও চোখ পড়লো রাত্রির উপর। কেউ কিছু বলতে পারলো না। সান্ত্বনা দেওয়ারও ভাষা হারিয়ে ফেলেছে রাত্রি।
__________________
খুব বাজেভাবে কেটে গেল তিনটে দিন, অনেকের মন খারাপের সাক্ষ্য নিয়ে। চতুর্থ দিনটাও কি ভালো কাটছে? উহুঁ, একদম নয়। তুরিন আর তানবীনের জন্য ভীষণ কষ্ট অনুভব হয়। তারা একদম ভালো নেই। নেই তারা আগের মতোও। বিশেষ করে তানবীন। হঠাৎ খুব পালটে গেছে। রাত্রি সব সময় যে তানবীনকে দেখে এসেছে সেই তানবীন আর নেই। সে যেন এখন অপরিচিত একজন! কারো সাথে কথা বলতেই ভুলে গেছে সে। নিজের রুম থেকে বাইরে বের হয় না। কেউ দেখা করতে চাইলে দেখা করে না। জগতের সবকিছুর থেকে যেন নিজেকে গুটিয়ে নিতে চায়। এরকম কেন হয়ে গেল সে?
রাত্রি এখন তানবীনদের বাড়ি যাচ্ছে। জানে না তানবীন তার সঙ্গে কথা বলবে কি না। হয়তো বলবে না। ব্যাগের ভিতর মোবাইল বেজে উঠলে রাত্রি দাঁড়িয়ে মোবাইল বের করলো। মালিহার কল। আজ হঠাৎ মালিহা কল করলো কেন? রাত্রির মনে হলো নিশ্চয়ই ভালো কোনো খবর নয়। সে রিসিভ করলো। মালিহা অন্য কোনো কথা না বলে প্রথমেই বললো,
“আমাদের বাসায় আসতে পারবেন ম্যাডাম?”
মালিহার কণ্ঠ কেমন যেন শোনালো। ভয় ভয়।
রাত্রি বললো,
“কেন? কী হয়েছে মালিহা?”
মালিহা এবার কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
“ভাইয়া সিঁড়ি থেকে পড়ে খুব আঘাত পেয়েছে। খুব মানে খুব। আপনাকে একবার দেখতে চাইছে। প্লিজ, আসুন না আমাদের বাসায়। আপনাকে রিকোয়েস্ট করছি ম্যাডাম।”
রাত্রি শিউরে উঠলো। এ কেমন অঘটন ঘটে চলেছে আজকাল?
“তোমার ভাইকে হাসপাতালে নাওনি?”
“হ্যাঁ, এই কিছুক্ষণ হলো বাসায় ফিরেছি। আপনি একবার আসবেন ম্যাডাম?”
একজন অসুস্থ মানুষ দেখতে চাইছে তাকে, সে না করবে কীভাবে? রাত্রি বললো,
“আচ্ছা, আমি যাব।”
“এখনই আসুন না। আপনি বেশি দেরি করলে ভাইয়া আরও অসুস্থ হয়ে যাবে।”
“আচ্ছা, এখনই আসছি।”
রাত্রিকে আবার উলটো পথ ঘুরতে হলো। খুব চিন্তা হচ্ছে তার! আদিল কি খুব বেশি আঘাত পেয়েছে? কবে পড়লো সিঁড়ি থেকে? হাসপাতাল থেকে রিলিজও করে দিয়েছে? কেন আশেপাশে শুধু এমন দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে? খুব দুঃখ লাগছে রাত্রির।
মালিহা দরজা খুললো। রাত্রিকে দেখে হাসি ফুটলো তার অধরে। খুশি মনে বললো,
“আপনি এসেছেন ম্যাডাম? খুব খুশি হলাম। ভিতরে আসুন।”
রাত্রি ভিতরে ঢুকলো। তবে আদিলকে দেখে খুব অবাক হলো সে। ভেবেছিল আদিল বিছানায় শুয়ে থাকবে। তার হাত-পা অথবা মাথায় ব্যান্ডেজ থাকবে। কিন্তু কই? সে তো একদম সুস্থ মানুষের মতো বসে আছে। আদিল উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে। হাস্য মুখে প্রশ্ন করলো,
“কেমন আছেন রাত্রি?”
রাত্রি মালিহার দিকে তাকালো।
“তুমি যে বললে তোমার ভাই খুব আহত হয়েছে?”
মালিহা মাথা নুইয়ে ফেললো। তবে তার ঠোঁটে হাসি। রাত্রিকে আনতে পেরে যেন জিতে গেছে।
আদিল এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
“আহতই তো। খুব আহত। মানুষ কি শুধু শারীরিক ভাবেই আহত হয়? র’ক্ত-মাংসের খোলসের নিচে যে মনটা আছে সেটা কি আহত হয় না?” আদিল সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“আমার মনটা খুব আহত রাত্রি। কত যে যন্ত্রণা হয় সেখানে! এই যন্ত্রণার এক ভাগও যদি আপনি অনুভব করতে পারতেন, তাহলে আপনি আমায় অবশ্যই ভালোবাসতে বাধ্য হতেন।”
আদিলের কথাগুলো এমন আবেগ জড়িত ছিল যে, সহজেই রাত্রির মন খারাপ করে দিলো। কিন্তু সে দুর্বলতা অনুভব করলো না। বললো,
“আমি এখানে আপনার আহত মনের গল্প শুনতে আসিনি।”
এরপর মালিহার দিকে তাকিয়ে বললো,
“মিথ্যা বলে আনলে আমাকে? তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি মালিহা।”
মালিহা রাত্রির কথার কোনো প্রত্যুত্তর না দিয়ে বললো,
“ভাইয়া এখন আর অসুস্থ নয় ম্যাডাম। আপনি জীবনে আসার পরই সে ধীরে ধীরে ভালো হয়ে গেছে। জানেন আজকে রান্না করেছে ভাইয়া। কেউ মানসিক সমস্যাগ্রস্ত হলে কি রান্না করতে পারে?”
আদিলকে যদিও সুস্থই মনে হচ্ছে তবুও রাত্রি এ কথা মানতে চায় না। সুস্থ হয়ে গেলে আদিল এখনও কেন এরকম করবে? সে তো এমন ভাবেনি কখনও। না, সে এটা মানতে চায় না। আদিলকে প্রশ্ন করলো,
“আসলেই আপনি সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেছেন?”
“তা তো জানি না। তবে আমার হৃদয় আপনার জন্য সারাজীবন অসুস্থ থাকবে।”
“মিথ্যা বলে কেন ডেকে আনলেন আমাকে?”
“মিথ্যা বলে ডেকেছি? আমি? কই আমি তো ডাকিনি।”
“আপনি সরাসরি ডাকেননি। মালিহাকে দিয়ে ফোন করিয়েছেন।”
“না তো। মালিহাই তো বললো আপনি না কি আজ আসবেন আমাদের বাসায়।”
রাত্রি অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো মালিহার দিকে। সে তাকানো মাত্রই মালিহা মাথা নুইয়ে ফেললো। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আদিল রাত্রিকে ডাকার ব্যাপারে কিছু জানে না। মালিহা নিজ থেকেই ফোন করেছিল এবং পরে আদিলকে বলেছিল রাত্রি আসবে। আসলে সে চেয়েছিল তার ভাইয়ের রান্না খাইয়ে তার ভাই যে সুস্থ হয়ে গেছে সেই খবরটা জানাবে রাত্রিকে।
আদিল বললো,
“আমি খিচুড়ি রান্না করেছি, খাবেন?”
“আমার এখন কোনো কিছু খাওয়ার সময় নেই, আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে।”
“না, আপনাকে খেতে হবে। আপনি বললেই তো হবে না সবটা, কিছু কিছু বিষয় আমি বললেও হবে।”
আদিলের কথাটা বলতে দেরি, কিন্তু মালিহার দৌড়ে কিচেন থেকে খাবার আনার জন্য যেতে দেরি হলো না। মালিহা চলে গেল।
রাত্রি আদিলকে দেখছে। সত্যিই কি আদিল ভালো হয়ে গেছে? ভালো হয়ে গেলেও কেন এরকম করছে? না, ব্যাপারটা এরকম এগোতে দেওয়া যায় না। রাত্রি বললো,
“আমি জানি না আপনি সুস্থ মস্তিষ্কে এসব বলছেন, করছেন কি না। কিন্তু একটা কথা আপনাকে জানিয়ে রাখি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আমি তাকেই বিয়ে করবো। তাই আপনি দয়া করে আমাকে মনে রাখবেন না। এটা আমার অনুরোধ!”
আদিল বললো,
“কিন্তু আমি যে আপনার অনুরোধ রাখতে পারবো না। আর আমি আপনার সিদ্ধান্ত মানি না।”
“সে আপনি না-ই বা মানতে পারেন। কিন্তু আমি তাকেই বিয়ে করবো। কারণ তার সাথেই আমার বিয়ে হওয়ার কথা। আর আমি চাইবো আপনি কোনো ঝামেলা করবেন না।”
আদিলের কথাগুলো শুনতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তার চেহারায় অসহ্য একটা যন্ত্রণা ফুটে উঠছে। রাত্রির কষ্ট হচ্ছে তা দেখতে।
মালিহা দাঁড়িয়ে আছে কিচেনের দরজায়। রাত্রি এবং আদিলের চেহারা দেখে সে সামনে এগোতে পারছে না। আদিল মাথা নুইয়ে রেখে ছিল, মাথা তুলে তাকিয়ে বললো,
“আমি যে ভাবতাম, আপনি আমারই।”
“আর ভাববেন না। আমি খুব দুঃখিত। আমি কখনও চাইনি আপনি আমার জন্য কষ্ট পান। আমি ভাবতাম আপনি সুস্থ হয়ে গেলে এসব আর আপনার মনে থাকবে না। হয়তো আমি ভুল ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। কারণ তার পাশে আমার থাকাটা খুব জরুরি। মাফ করবেন আমাকে।”
আদিলের মনে হচ্ছে রাত্রি তার থেকে খুব দূরে চলে যাচ্ছে, খুব দূরে। এত দূরে যে সে আর কখনও রাত্রিকে দেখতেও পারবে না। এর আগে কখনও এমন মনে হয়নি। তবে আজ মনে হচ্ছে। আদিলের বাম চোখ বেয়ে এক বিন্দু নোনা জল ঝরলো। সে বললো,
“আমিও যে আমার জীবনে আপনার খুব প্রয়োজন অনুভব করি রাত্রি!”
রাত্রি হাত জোর করে কান্না চোখে বললো,
“দয়া করে আমাকে ভুলে যান। সে এখন খুব কঠিন ও কষ্টের একটা সময় পার করছে। আমি তাকে আর নতুন কোনো কষ্টে দেখতে চাই না। প্লিজ, আপনিও আমাকে আর মনে করে কষ্ট পাবেন না!”
রাত্রির চোখ থেকে জল গড়ালো।
আদিল আর সহ্য করতে পারছে না। ভীষণ কষ্টে তার ভিতরটা চুরমার হচ্ছে। সে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,
“আপনি চলে যান রাত্রি। আপনার সাথে আমি আর কথা বলতে পারছি না। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে!”
রাত্রির খুব কষ্ট হচ্ছে আদিলের কথা শুনে। তার জন্য আদিল এভাবে কষ্ট পাবে এটা সে আসলেই ভাবেনি। সে ভেবেছিল এক রকম, হয়ে গেল অন্য রকম! রাত্রি চোখের জল মুছে বেরিয়ে গেল ফ্ল্যাট থেকে।
আদিলের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু নেমে গেল। সোফা থেকে রিমোটটা উঠিয়ে ছুঁড়ে মারলো ফ্লোরে, ভীষণ দুঃখ ও কিছুটা রাগেও।
মালিহা এখনও নিজের জায়গা থেকে নড়তে পারেনি। তার মনে হলো আজ রাত্রিকে ডাকাটাই ভুল ছিল।
(চলবে)