#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৩০
.
তখন সময়টা সন্ধ্যা। অর্ঘমা নিজের রুমে বসে বসে বিড়ালছানার সাথে সময় কাটাচ্ছিল। বাসায় সে আর মিনা বেগম ছাড়া কেউ নেই। কলিংবেলের শব্দে উঠে দাঁড়াল অর্ঘমা। কিন্তু সে যেতে যেতেই মিনা বেগম দরজা খুলে দিয়েছেন। তিনি ড্রয়িংরুমেই ছিলেন। অর্ঘমা গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল দরজার ওপাশে অভ্র আর নিধি দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে গেল সে। এবার কিছুটা এগিয়ে গিয়েই দাঁড়াল ব্যাপারটা বোঝার জন্য। দরজা খুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনে তাকালেন মিনা বেগম। পরক্ষণেই হুংকার ছেড়ে বললেন,
-“এই মেয়েটার সাথে তুই কোত্থেকে ফিরছিস অভ্র?”
নিধি কাচুমাচু ভঙ্গিতে অভ্রর পেছনে চলে গেল। মিনা বেগমকে সে বড্ড ভয় পায়। ভদ্র মহিলা যে তাকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না সেই সম্পর্কে সে অবগত। অভ্র পেছন থেকে নিধিকে সামনে এনে তার হাত ধরে বলল,
-“এই মেয়েটা এখন থেকে তোমার পুত্রবধূ।”
-“কীহ্?”
ভীষণ রকমের ভড়কে গেলেন মিনা বেগম। তার চোখ দু’টো যেন কপালে উঠে গেল। কিছু বলার মতো ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। সেই সঙ্গে চমকে গেছে অর্ঘমাও। তার ভাই বিয়ে করে ফেলেছে? তাও আবার তারই বান্ধবী নিধিকে? তার মুখেও কোনো শব্দ নেই বলার মতো। সে শুধু আড়চোখে মিনা বেগমের দিকে তাকাচ্ছে।
আজ অভ্রর অফিস বন্ধ ছিল। সকালে নিধি ভার্সিটি যাওয়ার পর অভ্র ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে বাবা-মাকে নিধির ব্যাপারে জানালে তৎক্ষণাৎ বেঁকে বসেন মিনা বেগম। অভ্রর বাবার তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। তিনি শুধু বলেছেন,
-“দেখো বাবা, সারাজীবন সংসার তুমি করবে। ওই মেয়ের সাথে জীবন তুমি কাটাবে। তাই তুমি যা ভালো বুঝো সেটাই করো। জীবন তোমার, সিদ্ধান্তও তোমার। তুমি তো আর সেই ছোট্টটি নেই যে তোমাকে এই বয়সে ভালোমন্দ বোঝাব আমি। নিজের ভালোমন্দ অবশ্যই তুমি নিজে বুঝতে শিখেছ। তোমার যদি মনে হয় নিধি তোমার উপযুক্ত তাহলে আমার কোনো সমস্যা নেই ওকে পুত্রবধূ হিসেবে মানতে।”
বাবার সহজসরল স্বীকারোক্তি শুনে অভ্র খুশি হলেও পরক্ষণেই মায়ের চেঁচামেচির কারণে তার সেই খুশিতে ভাঁটা পড়ল। তিনি কোনোভাবেই তার একমাত্র ছেলের বিয়ে এমন মেয়ের সাথে হতে দিবেন না যার কিনা নিজের বলতে কিছুই নেই। এমন কি পরিবারও না। মায়ের সাথে বহুক্ষণ কথা কাটাকাটি হওয়ার পর অভ্র রেগে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। আর এখন ফিরল নিধিকে সাথে নিয়ে।
-“তোর মাথা ঠিক আছে অভ্র? কী বলছিস এটা তুই?”
-“ঠিকই বলেছি মা। নিধি এখন থেকে তোমার পুত্রবধূ। আমি আর ও বিয়ে করে নিয়েছি।”
-“অভ্র!”
-“আমি সকালেই বলেছিলাম, বিয়ে করলে আমি নিধিকেই করব।”
-“আমার কথার কী কোনো দাম নেই তোর কাছে? এতবার বারণ করা স্বত্বেও তুই এই মেয়েকে বিয়ে করতে পারলি?”
-“প্রথমত, নিধিকে আমি ভালোবাসি। দ্বিতীয়ত, ও প্রেগন্যান্ট। আর বেবিটা আমার।”
ঝড়ের গতিতে একটা থাপ্পড় পড়ল অভ্রর গালে। থাপ্পড়টি মেরেছেন মিনা বেগম। রাগে তার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। যে ছেলেকে নিয়ে তিনি এত গর্ব করতেন, সেই ছেলে কিনা শেষমেশ এমন একটা কাণ্ড ঘটাল? ছিঃ ছিঃ! আর কোনো শব্দ অপচয় না করে তিনি হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। অভ্র নিধির হাত ধরে ভেতরে ঢুকল। অর্ঘমা এগিয়ে এসে কিছু না বলে নিধিকে নিয়ে রুমের ভেতরে গেল। রুমে যেতে যেতে চোরের মতো আশেপাশে তাকিয়ে গলার স্বর নিচু করে প্রশ্ন করল,
-“তুই সত্যি সত্যি প্রেগন্যান্ট?”
অপ্রস্তুত হলো নিধি। লজ্জাও পেল কিছুটা। অস্বস্তিতে কাচুমাচু অবস্থা তার। অর্ঘমা কী বলবে ভেবে পেল না। শুধু মৃদু হেসে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বান্ধবীকে অভিনন্দন জানাল।
___
নীরদ নিজের আর অর্ঘমার বিদেশে যাওয়ার সকল কাগজপত্র তৈরি করছে। কাগজপত্র পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেলেই সে অর্ঘমাকে বিয়ে করে নিবে। কোনো অনুষ্ঠান করবে না। একদম ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা সেরে ফেলবে। যদি তার পরিবার না মানে তাহলে শুধু বন্ধু-বান্ধব, অভ্র আর নিধিকে নিয়ে বিয়েটা সেরে ফেলবে। নীরদ শতভাগ নিশ্চিত তার পরিবার থেকে এই বিয়ে কোনোভাবেই মানবে না। তবুও বিয়েটা করলে তার ওপর রাগ করবে সবাই। বড়জোর কথা বলবে না কয়েকদিন। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো অর্ঘমার সাথে সহজ হতে পারবে না তারা, ব্যস! এইটুকুই।
এর মাঝে বেশ কয়েকবার থানায়ও গিয়েছিল নীরদ। কিন্তু ফলাফল সেই শূন্যই। অফিসার মোটা অংকের টাকা খেয়ে বসে আছে শাকিলের কাছ থেকে। তাই তার বিরুদ্ধে কোনো স্টেপ সে নিচ্ছে না। উল্টো এই কেসটা মিথ্যে প্রমাণ করার সকল চেষ্টা করছে। নীরদ বুঝে গেছে পুলিশ তাদের সহায়তা করবে না। এখন যে পক্ষের টাকা আছে আইন সেই পক্ষকেই সমর্থন করে। আর তাদের টাকা থাকলেও শাকিলের মতো অতো টাকা নেই যে আইনকে কিনে নিবে। পুলিশের অযৌক্তিক কথাবার্তায় একরাশ রাগ নিয়ে থানা থেকে ফিরে এসেছে নীরদ। অর্ঘমাকে এসবের কিছুই জানায় নি। মেয়েটা এমনিতেই প্রতিনিয়ত কষ্ট পাচ্ছে দূর্ঘটনাটার কথা ভেবে। এসব বলে সেই কষ্টের দাবানলে আর ঘি ঢালতে চায় না সে।
___
দু’হাত ভরতি মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বাসায় এসেছে নীরদ। অভ্রর দিকে তাকিয়ে সেই কখন থেকে মিটমিট করে হাসছে সে। অভ্র বেচারা একটু পর পর শুঁকনো কাশি দিয়ে ফোনের দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছে। এভাবে যদি লজ্জার হাত থেকে বাঁচা যায় নীরদের কাছ থেকে। কিন্তু নীরদ তো নীরদই। অভ্রর পাশে বসে গলা ঝেড়ে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
-“কী ভাই? কী হলো এটা?”
-“কোনটা?”
-“বাচ্চাটা কোত্থেকে এলো?”
অভ্র বেশ বুঝতে পারছে নীরদ তাকে খোঁচাতে এসেছে।
-“আকাশ থেকে টপকেছে।”
-“তুমি ঢিল না মারলে তো টপকানোর কথা ছিল না, তাই না?”
-“তোর এই খোঁচাখুঁচির অভ্যাস যাবে না?”
-“কেন যাবে? আমি তো শুধু সত্যিটা বলি।”
-“অনেক সত্যি বলে ফেলেছিস ভাই। এবার চুপ থাক।”
-“ঠিক আছে, থাকলাম চুপ। তবে আমি এখনো একটা জিনিসই ভেবে পেলাম না। তোমার বোনের সাথে আমার এতদিনের সম্পর্ক। আজ পর্যন্ত তো ওকে একটা কিসও করলাম না। আর তুমি আমার পরে নিধির সাথে সম্পর্কে জড়িয়েও ডিরেক্ট বাবা হয়ে গেলে?”
অভ্র খুকখুক করে কেশে উঠল। সে চেয়েও পারছে না নীরদকে কিছু বলতে। আড়চোখে নীরদের দিকে তাকিয়ে একপ্রকার বিরক্ত হয়ে বলল,
-“বোন হয় আমার। এসব কী বলিস তুই আমার সামনে? এর থেকে অর্ঘমাকে নিয়ে বাইরে থেকে ঘুরে আয়। তবুও তোর এই খোঁচাখুঁচি বন্ধ কর।”
-“হবু বাবাদের এত রাগ করতে হয় না। বাবুর উপর এফেক্ট পড়বে।”
-“চাচ্ছিসটা কী তুই?”
-“তোমার মতো সাহসী হতে চাইছি।”
-“ভাই, হাতজোড় করে মাফ চাইছি তোর কাছে। তুই আর এই ব্যাপারে কোনো কথা বলিস না।”
-“ভেবে দেখব। তবে তার আগে তোমার বোনকে একটু দেখে আসি।”
অভ্র হাতজোড় করে নীরদকে যেতে বলল। নীরদও হাসতে হাসতে উঠে এগিয়ে গেল অর্ঘমার রুমের দিকে।
___
অর্ঘমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল ব্যালকনির জানালার সামনে। সে গভীর ভাবে কিছু একটা ভাবতে ব্যস্ত। নীরদ রুমের দরজা চাপিয়ে দিয়ে গিয়ে পেছন থেকে অর্ঘমাকে জড়িয়ে ধরে টুপ করে গালে একটা চুমু খেয়ে নিল। চমকে উঠল অর্ঘমা। নীরদ দিন দিন বেপরোয়া স্বভাবের হয়ে উঠছে তার জন্য। ব্যাপারটা বেশ উপভোগ্য হলেও সে উপভোগ করতে পারছে না আজ। বরং তার খারাপ লাগছে, কষ্ট হচ্ছে। যার ফলে মেজাজটাও বিগড়ে আছে তার। ছেলেটা এত অবুঝ কেন? কেউ কীভাবে জেনে শুনে নিজের জীবনটাকে এমন একজনের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছে যে মেয়ে কী না একজন ধর্ষিতা?
নীরদ তাকে এসব ভাবতে বারণ করেছিল। সে-ও ভাবা বাদ দিয়েছিল। কিন্তু লোকজন তাকে ভুলতে দিলে তো! আজ নীরদের মা ফোন দিয়েছিল তাকে। ফোনে নীরদের মায়ের সাথে নুসরাতও ছিল। তারা অনেক কিছুই বলেছে। যদিও ভদ্রভাবে বলেছে কিন্তু অর্ঘমা তো আসল খোঁচাটা ঠিকই বুঝেছে। নুসরাত একদম সাফ সাফ ভাবে বলে দিয়েছে সে নিজের ননদকে নীরদের বউ করে নিয়ে আসতে চায়। মেয়েটা নাকি অনেক ভালো। নীরদকে পছন্দও করে। এর বিপরীতে অর্ঘমার বলার কিছুই ছিল না। সে শুধু এতটুকুই বলেছিল যে নীরদ তাকে ভালোবাসে। তখন নীরদের মা বলেছেন, ‘ভালোবাসা আজ আছে। এখন তোমাদের বিয়ে হলে আশেপাশের লোকজনের কথা রোজ রোজ শুনতে হবে নীরদকে। কয়েক মাস পর বা কয়েক বছর পর তখন আর এই ভালোবাসাটা থাকবে না। থাকবে শুধু তিক্ততা আর বিরক্তি। তখন ভালোবাসাটা গায়েব হয়ে যাবে। তাই তোমাদের ভালোর জন্যই বলছি তুমি নীরদের থেকে দূরে থাকো। ও এখন আবেগের বশে এতবড় সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছে। পরে ওকেই ভুগতে হবে। আর আমি চাই না আমার ছেলের ভবিষ্যত নষ্ট হোক। আমার কথাটা বুঝতে পেরেছ তুমি?’ অর্ঘমা তখন নীরব ছিল। মুখে আর কোনো শব্দ ছিল না বলার মতো। সত্যি কথাগুলো সবসময় তেঁতো হয়। তার কাছেও তেঁতো লেগেছে। কল কাটার পর থেকে বারবার নীরদের মায়ের বলা কথাগুলো তার কানে রেডিওর মতো বেজে চলেছে। নীরদের কাজকর্ম তার রাগের আগুনে ঘি ঢালার কাজ করছে।
একসময় আর সহ্য করতে না পেরে নীরদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে মাথার চুল দু’হাতে খামচে ধরে ফ্লোরে বসে পড়ল অর্ঘমা। নীরদ বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে অর্ঘমার দিকে। চোখের জলে নিমিষেই ভিজে উঠেছে গালজোড়া। চোখ বন্ধ করে অর্ঘমাকে অনবরত কিছু বিরবির করতে দেখে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল নীরদ। অর্ঘমার মাথায় হাত রাখতেই ছিটকে সরে গেল সে। চোখেমুখে একরাশ ভয় নিয়ে বারবার দূরে যেতে বলতে লাগল নীরদকে। হঠাৎ এসবের মানে নীরদ বুঝল না। তার চোখে শুধু বিস্ময় খেলা করছে। অর্ঘমার ব্যবহারে পাগলামো প্রকাশ পাচ্ছে। ধক করে উঠল তার হৃদয়। মেয়েটাকে আবার কেউ উল্টো পাল্টা কিছু বলেনি তো? এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই অর্ঘমা জোরে কেঁদে উঠল। বিষয়টাতে চমকে উঠল নীরদ। কী থেকে কী হলো বা কী হচ্ছে কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না। অভ্র আর নিধি একপ্রকার দৌড়ে এলো। অর্ঘমাকে কাঁদতে দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলে নীরদ চুপ রইল কিছু সময়। অর্ঘমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে এগিয়ে গেল তার দিকে। অর্ঘমা পেছাতে চাইলেও পারল না। পিঠ দেয়ালের সাথে ঠেকে গিয়েছে তার। নীরদ হাঁটু গেড়ে বসে তার গালে হাত রাখতেই গাল ঘুরিয়ে নিল অর্ঘমা। এবার দু’হাতে অর্ঘমার গাল ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। চোখ বন্ধ করে নীরদের হাত সরানোর জন্য জোরাজোরি করতে লাগল। অভ্র আর নিধি একে অপরের দিকে তাকিয়ে আবারো ওদের দিকে তাকাল। তারা নীরব দর্শকের মতো দেখছে সবকিছু।
নীরদ কোনো প্রশ্ন না করে অর্ঘমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। অর্ঘমার ধৈর্যের বাঁধ পুরোপুরি ভেঙে গিয়েছে। রাগের মাথায় হাত দ্বারা উল্টো পাল্টা আঘাত করতে লাগল সে নীরদকে। নিজের মুখ অর্ঘমার কাঁধে গুঁজে চুপচাপ তাকে জড়িয়ে ধরে বসে আঘাত সহ্য করতে লাগল। অর্ঘমা কান্নার পাশাপাশি নিজের সকল অভিযোগ খোলাসা করে দিল নীরদের কাছে। কিছু বলল না নীরদ। চোখ বন্ধ করে সেভাবেই বসে রইল। হুট করে অর্ঘমাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। টেবিলের উপর থেকে গ্লাস নিয়ে পানি খেয়ে চোখ বন্ধ করে মাথার চুলগুলো মুঠোয় নিয়ে টানতে লাগল। চোখ মেলে অর্ঘমাকে একবার দেখে নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। অভ্রও বের হয়ে গেল নীরদের পেছন পেছন।
অর্ঘমা শান্ত হয়েছে অনেক সময় নিয়ে। শান্ত হওয়ার পর থেকে বিছানায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। পাশেই নিধি বসে অর্ঘমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। একটা সময় পর অর্ঘমা ঘুমিয়ে গেল। কান্নার ফলে ঘুমের রেশটা বেশ গাঢ়ই হলো তার।
চলবে…#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#অন্তিম_পর্ব
.
অর্ঘমার যখন ঘুম ভাঙল তখন পুরো বাসায় নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। পড়ার টেবিলের চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে নীরদ। তার চোখমুখে কঠিনতা প্রকাশ পাচ্ছে। অর্ঘমা শুয়ে থাকা অবস্থায়ই অপলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। নীরদের চোখ বন্ধ। কপালে আঙুল দিয়ে মাসাজ করছে। ওকে এতটা রাগতে আগে কখনো দেখেনি। অর্ঘমা উঠে বসল। গলা শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। পাশের টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে পানি খেয়ে গ্লাসটা আবার যথাস্থানে নামিয়ে রাখল। পেছন ঘুরে দেখল নীরদ তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে শান্ত অথচ কঠোর গলায় বলল,
-“ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।”
-“কেন?”
-“তুমি কী এভাবেই থাকতে চাচ্ছ?”
অর্ঘমা আয়নার দিকে তাকাল। অতিরিক্ত কান্নার ফলে চেহারার বিশ্রী অবস্থা। দেখতে জঘন্য লাগছে তাকে। চুলের অবস্থা তো না বলাই ভালো। সে একপলক নীরদের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসে চুল ঠিক করে নিল। তাকে এবার কিছুটা মানুষের মতো লাগছে। এতক্ষণ তো পাগলের বেশ ছিল তার। নীরদ উঠে এসে অর্ঘমার ওড়নাটা মাথায় জড়িয়ে দিয়ে তার হাত ধরে হনহনিয়ে বের হলো রুম থেকে। অর্ঘমা হতভম্ব! আশ্চর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল সে।
-“আরেহ্! কোথায় নিচ্ছেন আমাকে? হাত ছাড়ুন নীরদ। ছাড়ুন বলছি! ব্যথা পাচ্ছি আমি।”
তৎক্ষণাৎ হাতের বাঁধন কিছুটা ঢিলে হলো অর্ঘমার। কিন্তু নীরদ তার হাত ছাড়তে নারাজ। সোজা ড্রয়িংরুমে এসে জোর করে তাকে সোফায় বসাল। অর্ঘমা খেয়াল করল সোফায় আরও লোকজন আছে। এর মধ্যে তার বাবা আর অভ্র দু’জন। বাকিদের সে চেনে না। দেখতে অনেকটা হুজুরের মতো। অর্ঘমা ইতস্ততবোধ করতে লাগল। নীরদের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“এখানে কেন এনেছেন আমাকে? আপনাকে যা বলার তা তো আমি বলেই দিয়েছি। আর কী চান?”
-“যা চাই দেবে?”
-“প্লিজ নীরদ! আমি আর এসব নিতে পারছি না। সহ্য হচ্ছে না আমার। এর থেকে মরে যাওয়াটাও বোধকরি সহজ ছিল আমার জন্য। আমি ক্লান্ত নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে। নিজেকে আমি সামলে নিয়েছি। এবার আপনি প্লিজ আপনার পরিবারের কথা শুনুন। তারা আপনার ভালোমন্দটা বুঝে বলেই তো বলছে আমাকে ছাড়তে। তাছাড়া তাদের তো কোনো দোষ নেই। তারা ঠিকই বলছে।”
-“যথেষ্ট বলেছ! আমি তোমার থেকে শুনতে চাইনি কীসে আমার ভালোমন্দ। আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছি আমি যা চাই দেবে কিনা?”
-“কী চান আপনি?”
-“তোমাকে।”
-“অসম্ভব!”
-“সম্ভব। তার জন্যই তোমাকে এখানে এনেছি। আজ, এখন, এই মুহূর্তে আমাদের বিয়ে হবে। আর তুমি চুপচাপ মত দিয়ে দিবে। আমার মেজাজ কোন পর্যায়ে আছে তার ধারণাও নেই তোমার।”
অর্ঘমা বিস্মিত হয়ে নিজের বাবা আর ভাইয়ের দিকে তাকাল। তাদের মুখভঙ্গি নীরদের কথাকেই সত্যি বলছে। রাগে এবার শরীর কাঁপতে লাগল অর্ঘমার। সবাই তাকে পেয়েছে কী? তাকে কেন সবাই মিলে এভাবে টর্চার করছে? এর থেকে বোধহয় সেদিন মরে গেলেই ভালো হতো। শাকিল মেরে কেন ফেলল না তাকে? বাঁচিয়ে রেখেছিল কেন তাকে? তিলে তিলে মারবে বলে? অর্ঘমার চোখ ফেটে অশ্রুবিন্দু মুক্তো দানার মতো গড়িয়ে পড়ল। চোখমুখ কঠিন করে তাকাল সে নীরদের দিকে। যার স্পষ্ট অর্থ সে জীবনেও মত দিবে না। তার মুখাবয়ব বুঝতে পেরে নীরদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“আমাকে খারাপ হতে বাধ্য করো না।”
-“আপনি আমাকে খারাপ হতে বাধ্য করবেন না নীরদ। আপনার প্রতি আমার যে ভালোবাসা, সম্মান, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস আছে সেটা নষ্ট করবেন না।”
-“নষ্ট হলে হোক। সহ্য করে নেব। কিন্তু তোমাকে ছাড়া থাকতে হবে সেটা সহ্য করতে পারব না।”
-“আমি বিয়ে করব না।”
-“করতে হবে তোমাকে।”
-“আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন নীরদ।”
-“বাড়াবাড়ির এখনো কিছুই দেখো নি তুমি। ফাজলামোর একটা লিমিট থাকে। তোমরা সবাই আমার সাথে লিমিট ক্রস করে ফাজলামো করছ। আমি তো আর সহ্য করব না এসব। আফটার অল আমিও একটা মানুষ। আর কত? এবার হয় তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে নয়তো আমি এমন কিছু করব যার জন্য তোমরা, স্পেশালি তুমি আজীবন পস্তাবে।”
-“বোঝার চেষ্টা কেন করছেন না আপনি?”
-“কারণ আমি চাই না বুঝতে। আমি শুধু জানি আমি তোমাকে চাই। আমার পরিবার আর তুমি জাস্ট বাইরের লোকের কথা ভাবছ। একটাবার কী আমার কথা ভেবে দেখেছ? আমি কী চাই সেটা ভেবেছ? আমি কীসে ভালো থাকব তা ভেবেছ একটাবারও? আমি তোমাকে চাই অর্ঘ। শুরু থেকে চেয়ে এসেছি আর এখনো চাচ্ছি। আমি তোমাকে ভালোবাসি। অনেক বেশি ভালোবাসি। একটু ভরসা করে আমার হাতটা ধরে দেখো। সারাজীবন তোমায় বুকের মাঝে আগলে রাখবো। কখনো সামান্য অভিযোগটুকুও করার সুযোগ দেবো না। প্লিজ অর্ঘ! ফিরিয়ে দিও না আমাকে। আমি বাঁচতে পারব না। পাগল হয়ে যাব আমি তোমাকে ছাড়া।”
একটু আগের কঠিন মুখশ্রীর ছেলেটা এখন কাঁদছে। কাঁদছে অর্ঘমা নিজেও। নীরদ অর্ঘমার পায়ের কাছে বসে পড়ল। অভ্র এসে বোনের মাথায় হাত রাখল। তার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাল অর্ঘমা। অভ্র বোনকে বুঝাতে লাগল। সে নীরদের পক্ষ হয়ে কথা বলছে। নিজের বোনের জন্য নাহয় সে-ও একটু স্বার্থপর হলো। অভ্রর বাবাও তাল মেলাতে লাগলেন অভ্রর সাথে। নিধি চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে সবার কার্যকলাপ দেখছে। এসবের মাঝে তার না ঢোকাটাই শ্রেয় বলে মনে করল সে। সোফায় বসে থাকা বাকিরা এসব তামাশা দেখছে।
অর্ঘমার মনও বলছে বিয়েতে রাজি হয়ে যেতে। কিন্তু নীরদের পরিবার আর সমাজ! অর্ঘমার মনে দ্বিধা কাজ করছে। সে মাথা চেপে বসে আছে সোফায়। অভ্র আর তার বাবা সমানে তাকে বুঝিয়ে চলেছে। এদিকে আবার নীরদ তার পায়ের কাছে বসে কোলে মাথা রেখে কেঁদে যাচ্ছে। কী করবে সে? নীরদের দিকে তাকিয়ে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অর্ঘমা বলল,
-“আমাকে বিয়ে করলে আপনার পরিবারের থেকে আপনি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। আর আমি কী করে জেনে-বুঝে আপনার পরিবার থেকে আপনাকে আলাদা করি বলুন তো? এভাবে তো আপনিও ভালো থাকবেন না আর আমিও ভালো থাকব না। এই কথাটা কেন বুঝতে চাইছেন না আপনি?”
-“আমি সব বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি কেন বুঝতে পারছ না? আমার পরিবার আজ হয়তে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। কিন্তু আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলছি তারাই একদিন নিজে থেকে আবার আমার সাথে যোগাযোগ করবে। আমি আমার পরিবারকে ভালো মতোই চিনি অর্ঘ। আর রইল বাকি বাইরের লোকের কথা! তাদের পরোয়া আমি করি না। অন্যের ভালো দেখলে তাদের জ্বলবে এটাই স্বাভাবিক।”
-“কিন্তু নীরদ..”
-“আর কোনো কিন্তু নয় অর্ঘ। প্লিজ রাজি হয়ে যাও বিয়েতে। প্লিজ!”
অর্ঘমা অসহায় দৃষ্টিতে অভ্রর দিকে তাকাল। সে-ও বলছে রাজি হয়ে যেতে। এক মুহূর্তের জন্য অর্ঘমার মনে হলো পুরো দুনিয়া জাহান্নামে যাক। শুধু সে আর নীরদ একে অপরের সাথে ভালো থাকলেই হলো। অর্ঘমা রাজি হলো। নীরদের চোখ খুশিতে চিকচিক করে উঠল। মুহূর্ত ব্যয় না করে তৎক্ষণাৎ কাজীকে বলল বিয়ে পড়াতে। নাহলে আবার যদি অর্ঘমা বেঁকে বসে তখন! তাড়াহুড়োয় খুব অল্প সময়ের মাঝে অর্ঘমা আর নীরদের বিয়েটা হয়ে গেল।
___
নীরদের জরুরি ফোনকল পেয়ে অর্ঘমাদের বাসায় এসেছে নীরদের বাবা-মা ও নুসরাত। তারা বর্তমানে সোফায় বসে আছেন। তাদের সামনের সোফায় বসে আছেন অর্ঘমার বাবা, অভ্র আর নীরদ। নীরদের চোখেমুখে গাম্ভীর্যের ছোঁয়া। সোফার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ঘমাকে দেখে নুসরাত বিরক্ত স্বরে বলল,
-“এখানে কেন ডেকেছিস? এই বাসায় বসে কথা বলার তো আর কিছু নেই আমাদের জানা মতে।”
-“তোদের বলার নেই কিন্তু আমার আছে। এতদিন তোরা অনেক তামাশা করেছিস। আমি হাজার বুঝিয়েও তোদের মানাতে পারিনি। আমার ধৈর্যের একটা সীমা আছে। সীমাটা তোরা লঙ্ঘন করে ফেলেছিস।”
-“কীসব বলছিস নীরদ? মাথা ঠিক আছে তোর?”
-“হ্যাঁ, ঠিকই আছে। তোমাদের যা বলার জন্য ডেকেছি শুধু সেটা শোনো। আমি বিয়ে করে ফেলেছি। ঘন্টাখানেক আগে কাজী আমার আর অর্ঘমার বিয়ে পড়িয়েছে। এখন তোমরা মানো বা না মানো সেটা তোমাদের ব্যাপার। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখো যে অর্ঘমা এখন থেকে আমার স্ত্রী।”
স্তব্ধ ভঙ্গিতে বসে আছে নীরদের বাবা-মা আর বড়ো বোন। তাদের মাথায় যেন গোটা আকাশটাই ভেঙে পড়েছে। নীরদ তাদের না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে? তাও আবার অর্ঘমাকে? মাথা যেন কিছু মুহূর্তের জন্য কাজ করা বন্ধ করে দিল নীরদের মা-বাবা আর নুসরাতের। নীরবতা ভেঙে চেঁচিয়ে উঠলেন নীরদের মা।
-“পাগল হয়েছিস তুই? কী বলছিস এটা?”
-“যা সত্যি তাই।”
-“নীরদ!”
-“চেঁচাবে না বাবা। আমি কোনো ভুল করি নি। যাকে ভালোবাসি তাকে বিয়ে করেছি শুধু।”
-“কিন্তু ও একটা ধর্ষিতা নীরদ।”
-“মুখ সামলে কথা বলবি আপু।”
-“মিথ্যে তো বলি নি আমি।”
-“ওর সাথে যা হয়েছে তা নিতান্তই একটা দূর্ঘটনা। তার জন্য তো ওর পুরো জীবনটা থেমে থাকতে পারে না। আর আমাদের বিয়ে তো ঠিক করাই ছিল। আমি শুধু সেটাকে পুরোপুরি স্বীকৃতি দিয়েছি।”
-“আমার ননদের সাথে তোর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে নীরদ। সামনের মাসের শুরুতে বিয়ে। কার্ড ছাপানোর কাজ অলমোস্ট হয়ে গিয়েছে। আর তুই এই সময় এসে এটা কী করলি? এখন আমি ওদের কাছে মুখ দেখাব কীভাবে?”
-“সেটা তুই জানিস। আমার সাথে এসব ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ বিয়েতে আমার মত ছিল না। তোমরা আমাকে জানিয়ে করো নি কিছু। তোমরা যেহেতু আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করো নি, তাই আমিও অর্ঘমাকে বিয়ে করার আগে তোমাদের জানানোর প্রয়োজন মনে করি নি।”
-“এই মেয়ের সাথে যদি তুই সম্পর্ক রাখিস তো আমাদের সাথে কোনো সম্পর্ক তোর থাকবে না। আর কখনো যোগাযোগ করবি না।”
-“ঠিক আছে।”
নীরদকে এখনো এতটা শান্ত দেখে আশ্চর্য হলো সকলে। নীরদের বাবা ভীষণ রেগে বললেন,
-“ঠিক আছে মানে? তোমার কাছে আমাদের কোনো মূল্য নেই? এই মেয়েটাই এখন সব হয়ে গেল তোমার?”
-“এই কথা তো আমিও বলতে পারি। তোমাদের কাছে আমার কোনো মূল্য নেই। থাকলে আমার খুশিটা বুঝতে তোমরা। কিন্তু তোমরা তা বুঝতে পারছ না। বরং আমি যার সাথে খুশি থাকব তাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছ।”
ভীষণ কথা কাটাকাটি হলো নীরদ আর তার পরিবারের মাঝে। একটা সময় অর্ঘমাকে বাজে কথা বলতেও ছাড়ল না নীরদের পরিবার। অভ্র সাথে সাথে তাদের সাবধান করল যাতে দ্বিতীয়বার তারা এমন কিছু না বলে। নীরদকে কোনো ভাবে রাজি করাতে না পেরে অবশেষে বাধ্য হয়ে অর্ঘমার পরিবারকে যা নয় তাই শুনিয়ে চলে গেল নীরদের বাবা-মা আর বোন।
___
অর্ঘমা ঘরের ভেতরে চলে গিয়েছিল অনেক আগেই। তার এসব চেঁচামেচি ভালো লাগছিল না। তাছাড়া সে তো জানতই যে এমন কিছু হবে। এতক্ষণ যাবৎ ঘরে বসে সে সব কথা শুনছিল। কেঁদেকেটে তার চেহারার হাল বেহাল হয়ে গেছে। নীরদ ঘরে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দিয়ে অর্ঘমার পাশে গিয়ে বসল। চোখ তুলে তাকাল অর্ঘমা। বলল,
-“কাজটা আপনি ঠিক করলেন না নীরদ। এখন বাকিটা জীবন আমাকে এই বোঝা ঘাড়ে নিয়ে বয়ে বেড়াতে হবে যে আমি আপনাকে আপনার পরিবারের কাছ থেকে দূরে সরিয়েছি।”
-“তুমি কিচ্ছু করো নি অর্ঘ। এসব আমাদের ভাগ্যে লেখা ছিল।”
ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল অর্ঘমা। নীরদ তাকে বুকে টেনে নিল। চুম্বন করল তার মাথায়। হাত বুলিয়ে দিল তার চুলে।
-“আমার সাথেই কেন এমন হলো নীরদ? আমি তো কখনো কারও খারাপ চাইনি বা ক্ষতি করি নি। তবে কেন?”
নীরদ কোনো উত্তর দিতে পারল না। শুধু সান্ত্বনা দিয়ে গেল অর্ঘমাকে। একটা সময় সেভাবেই ঘুমিয়ে গেল অর্ঘমা।
___
পরিশিষ্টঃ
অফিস শেষে বেরিয়ে এসে হাত ঘড়িতে সময় দেখল নীরদ। লন্ডনের রাস্তাঘাট আসলেই সুন্দর। হাড় হিম করা ঠান্ডা পড়েছে। খুব সম্ভবত তুষারপাত হবে আজ রাতে। হাত দু’টো একটা আরেকটার সঙ্গে ঘষে নিয়ে পাশে তাকিয়ে যেতে গিয়েও থেমে গেল। তার এক কলিগ মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। এই বাঙালি ছেলেটা নতুন। সদ্য জয়েন করেছে অফিসে। কথাবার্তা বেশ গুছিয়ে বলে। দেখতে শুনতেও ভদ্র। কাজের প্রতি ভীষণ মনোযোগী হওয়ায় নীরদের বেশ পছন্দের। যদিও সে নীরদের জুনিয়র। নীরদের জানা মতে আজ ছেলেটার ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। তবে জলদি জলদি বাসায় না গিয়ে এখানে এভাবে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে কেন? নীরদ এগিয়ে গেল তার দিকে।
-“কী ব্যাপার তাহমিদ? এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আজ না তোমার বিবাহবার্ষিকী?”
-“আর বলবেন না স্যার। বিবাহবার্ষিকীতে মনে হচ্ছে উপহার হিসেবে বিবাহবিচ্ছেদ পাব।”
-“ছিঃ! এসব কী কথা?”
-“ঠিকই বলছি স্যার। আমার স্ত্রীর সাথে আমার আর বনিবনা হচ্ছে না। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। ভেবেছিলাম আমার সমস্যাগুলো বুঝবে। কিন্তু শুরু শুরুতে সব ঠিক থাকলেও এখন আর কিছুই ঠিক নেই। ওর কাছে আমার পরিশ্রম, আমার ইমোশনের কোনো দাম নেই। পান থেকে চুল খসলেই বারবার ডিভোর্স ডিভোর্স করে চিল্লাবে। আর বলবে আমাকে বিয়ে করাটা ওর জীবনের মস্ত বড়ো ভুল। এখন আপনিই বলুন স্যার, কতদিন সহ্য করা যায় এসব? রোজ অফিস করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফেরার পর এসব শুনতে ভালো লাগে?”
-“তোমার সমস্যাটা আমি বুঝতে পারছি। তোমার স্ত্রী যখন চেঁচামেচি করে তুমিও নিশ্চয়ই চুপ থাকো না? তুমিও চেঁচামেচি করো।”
-“জি স্যার। মেজাজ খারাপ হয়ে যায় তখন। নিজেকে সামলাতে পারি না।”
-“শোনো তাহমিদ! মেয়েরা একটু এমনই হয়। তোমাদের যেহেতু লাভ ম্যারেজ অতএব তোমাদের মধ্যে তো বোঝাপড়াটা আরও ভালো থাকা উচিত। তোমার স্ত্রী তোমার সাথে চেঁচামেচি করে কারণ তুমি অফিস শেষ করে বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ো। ওকে তো একটুও সময় দাও না। তোমার স্ত্রী সব ছেড়ে এই ভীনদেশে এসেছে শুধু মাত্র তোমার জন্য। তোমার সাথে থাকবে বলে। সে বাসায় একা থাকে সারাদিন। তার কথা বলার কোনো সঙ্গী নেই। তাই দিনশেষে তুমি যখন বাসায় ফেরো ও শুধু তোমার থেকে একটু সময় চায়। এখন তুমি যদি সেটাও না দিতে পারো তো চেঁচামেচি করাটা স্বাভাবিক। আর তোমার স্ত্রী যখন চেঁচামেচি করবে তখন তুমি চুপ থাকবে। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করবে। তাহলেই বিষয়টা আর বড়ো হবে না। তা না করে যদি তুমিও চেঁচাও তাহলে তো কথায় কথা বাড়বেই।”
তাহমিদ চুপ করে শুনল নীরদের কথাগুলো। ভেবেও দেখল বিষয়টা। আসলেই নীরদের কথা ঠিক। সে মৃদু হেসে বলল,
-“এই সামান্য ব্যাপারটা এতদিন কেন আমার মাথায় এলো না?”
-“সারাক্ষণ শুধু কাজের ব্যাপার ভাবলে চলবে? নিজেদের ব্যাপারেও ভাবতে হবে।”
-“ধন্যবাদ স্যার। আচ্ছা স্যার, একটা প্রশ্ন করি?”
-“হ্যাঁ, করো।”
-“আপনি কখনো কারও প্রেমে পড়েন নি?”
-“পড়েছিলাম তো। এখন কথা না বাড়িয়ে বাসায় যাও জলদি। আজ একটা বিশেষ দিন তোমাদের। সবকিছু ঠিকঠাক করে নাও।”
-“জি স্যার। ধন্যবাদ।”
নীরদ মুচকি হেসে নিজের বাসার দিকে হাঁটা শুরু করল।
___
কলিংবেল চাপতেই কিছুক্ষণের মাঝে দরজা খুলে গেল। অর্ঘমার হাসিমাখা মুখটা দেখেই নীরদের সারাদিনের সকল ক্লান্তি যেন এক নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল। মৃদু হেসে অর্ঘমার কপালে চুম্বন করে ঘরে প্রবেশ করল।
ঘুমানোর সময় নীরদ তার কাজ শেষ করে ফোন আর ল্যাপটপটা পাশের টেবিলে নামিয়ে রাখল। অর্ঘমা তখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে মোড়ায় বসে চুল বাঁধতে ব্যস্ত। তার সাড়ে ছয় মাসের উঁচু পেটটার দিকে তাকিয়ে হাসল নীরদ। প্রেগন্যান্সির এই সময়টাতে অর্ঘমা বেশ গুলুমুলু হয়ে গেছে। তাকে দেখতে আগের চেয়ে আরও বেশি আকর্ষণীয় লাগে। দেখতে দেখতে কীভাবে যে বিয়ের তিনটা বছর কেটে গেল টেরও পেল না সে। দুই বছর আট মাস হতে চলল তারা এই দেশে এসে সেটেল্ড হয়েছে। তার পরিবার বলেছিল কয়েক বছর পর নাকি অর্ঘমার প্রতি তার এই অনুভূতি আর থাকবে না। কিন্তু অর্ঘমার প্রতি তার ভালোবাসা এখনো আগের মতোই আছে। বরং বেড়েছে আগের থেকে। এখনো একবার তার দিকে তাকালে নীরদের চোখ ফেরাতে মন চায় না। নীরদ চেষ্টা করেছিল তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার। কিন্তু তারা এখনো অভিমান করে আছে নীরদের উপর। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে এই ভেবেই নীরদ নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। কখনো অর্ঘমাকে তার মন খারাপপর কথা বুঝতে দেয় না। পাছে মেয়েটা আবার নিজেকে দোষারোপ করা শুরু করে। নীরদ উঠে গিয়ে অর্ঘমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মনে মনে বলল,
❝হ্যাঁ, আমি প্রেমে পড়েছিলাম!
সাদা কলেজ ড্রেসের সাথে দুই বেণী করা
এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম।
কথায় কথায় মিষ্টি হাসি দেওয়া মেয়েটার
প্রেমে পড়েছিলাম।
আমি প্রেমে পড়েছিলাম তার কাজল কালো
ডাগর আঁখির।
তার দুষ্টুমির প্রেমে পড়েছিলাম, তার
চঞ্চলতার প্রেমে পড়েছিলাম।
প্রেমে পড়েছিলাম তার পাগলামির, তার
বোকামির।
আমি প্রেমে পড়েছিলাম তার অশ্রুজলে
ভেজা মুখশ্রীর।
প্রেমে পড়েছিলাম তার পায়েলের রিনঝিন
শব্দের।
বেঁধে গিয়েছিলাম তার মায়ায়,
মাতোয়ারা হয়েছিলাম তার নেশায়।
আমি প্রেমে পড়েছিলাম এক ষোড়শী
কিশোরীর।❞
অর্ঘমা হেসে জিজ্ঞেস করল,
-“কী হয়েছে?”
-“কিছু না। অনেক রাত হয়েছে। চলো ঘুমাবে। এই অবস্থায় এত ধকল নেওয়া ঠিক না। এমনিতেও একটু পরেই আবার তোমার ঘুম ভেঙে যাবে।”
-“আমাকে নিয়ে এত চিন্তা কেন করেন আপনি?”
-“একটা মাত্র বউ আমার। তাকে নিয়েই তো চিন্তা করব। তার ওপর এখন আবার জুনিয়র অর্ঘমা আসতে চলেছে।”
-“ইশ! কে বলল এটা জুনিয়র অর্ঘমা? জুনিয়র নীরদও তো হতে পারে।”
-“কিন্তু আমার তো জুনিয়র অর্ঘমা চাই।”
-“একটা হলেই হলো। আমার কোনো আপত্তি নেই।”
-“আমারও না। এসো এবার।”
অর্ঘমাকে ঠিক মতো শুইয়ে দিয়ে নীরদ সাবধানে তাকে বুকে টেনে নিল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে টুকটাক গল্প করতে লাগল। কিছু সময় পর অর্ঘমার থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল নীরদ। মেয়েটা ঘুমিয়ে গিয়েছে। আবারও অর্ঘমার কপালে চুম্বন করে তাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজল। মুখে তার প্রশান্তির হাসি। যেন দুনিয়ায় সে সবথেকে সুখী ব্যক্তি।
(সমাপ্ত)