কৃষ্ণবেণী পর্ব -০২

#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_২
#নন্দিনী_নীলা

ভরাট গলায় তিনি বলে উঠলেন, ” উর্মি আস্ক হার টু স্টপ ক্রায়িং।”
আমি আবসা অন্ধকারে সেদিক পানে তাকিয়ে রইলাম। তার দেখা যেমন পেলাম না তেমনি তার বলা একটা শব্দ ও আমার মাথায় মস্তিষ্কে ধরা খেলো না।ফ্যাল ফ্যাল করে বোঝার চেষ্টা করছি। তিনি কি বললেন? জটিল সেই বাক্য গুলো আমি বুঝতে পারলাম না। এদিকে উর্মি আপু আমাকে আর কিছু বলল না। আমি সেসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরলাম। ঘুম ভাঙ্গল কারো চিৎকার স্বরে আমি ধরফরিয়ে উঠলাম।
আমার সামনে একটা অতি সুন্দরী মেয়ে দাড়িয়ে আমাকেই ডেকে যাচ্ছে ভাবি ভাবি বলে। আমি তার দিকে বোকা চোখে তাকিয়ে আছি।
“ভাবি ওঠো আমরা চলে এসেছি বের হও গাড়ি থেকে।”
আস্তে আস্তে আমার বিয়ে হওয়া থেকে শুরু করে গাড়ির সমস্ত ঘটনায় আমার মনে পরল। তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম।
উর্মি আপু আমাকে নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকতে লাগল। আমি চোখ বড়ো বড়ো করে দেখছি সব।
এটা কোন বাড়ি না রাজমহল আমার জানা নেই। রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি। এখন রাত কিন্তু তবু এত আলো, এতো আলোকিত চারপাশ যে এখানে রাত মনে হচ্ছে না। সাদা দালানটা চিকচিক করছে আলোয়। সবচেয়ে যেটা আমার নজর কারলো তা হলো বাসার সামনেই বড় করে লেখা লেখা,” নিঝুম ভিলা”
রাজপ্রাসাদের মত একটা বড় দরজা। এই দরজা খুললে আমার মনে হয় আমাদের তিন পরিবার এই দরজা দিয়ে একবারে ঢুকতে পারবে। এত বড় দরজা দেখে আমি বড়সড় একটা ঢোক গিললাম। দরজার উপরের পাট্টা খুঁজে পেলাম না আমি মাথা উঁচু করে তাকালাম। আমি ভাবলাম এই দরজার জন্য তাল গাছের মতো লম্বা আর হাতির মত মোটা মানুষ দরকার। সেই এই দরজার জন্য উপযুক্ত।সেখানে আমি খাটা মানুষ নিজেকে একটা পুতুলের সমান লাগছে।
উর্মি আপু আমাকে টেনে ভেতরে নিয়ে আসলো। এই বাসা থেকে আমাদের বাসায় গিয়েছিল ৫ জন মানুষ আমার স্বামী, উর্মি আপু, আমার দেবর আর আমার স্বামীর দুইজন ফ্রেন্ড। আমি জানিনা এদের গুরুজন কেউ কেন যায়নি।

ভেতরে গিয়ে আমি আরো চমকালাম। এত সাদা লাইট আমার যেন চোখে লাগলো। মাথার উপরই একটা বড় ঝাড়বাতি যেটা লাল নীল বাতি জ্বলছে। আমি ঠিক সেটার সরাসরি দাড়াইছি। আমার চোখ ঘোলা হয়ে আসল। আমি তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়ালাম।
দামি দামি শোপিস, ফুলদানি, সাজ করা পেন্ডিং দিয়ে জায়গাটা এত সুন্দর ভাবে সাজানো যে এখানে নিজেকে খুবই বেমানান লাগল। এমন রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি ঘর দেখে এবার আমার ভয় লাগতে শুরু করল। এমন একটা বাড়ির ছেলে কিনা আমাকে বিয়ে করল? এদের উদ্দেশ্য কি? আমাকে মেরে টেরে ফেলতে চায় না তো।
আমি ঢোক গিলে পাশে তাকাতেই দেখতে পেলাম বড়ো করে দুইটা ছবি টানানো মনে হয় একজন মানুষই দাঁড়িয়ে আছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত তার ছবিটা টানানো। আমি বড়ো বড়ো চোখ করে পেন্ডিং টার দিকে তাকিয়ে আছি।
” ভাবি এটা তোমার শ্বশুর বাড়ি পছন্দ হয়েছে?”
উর্মির কথা শুনে আমি ওর দিকে তাকাতে যাব তখনই একজন মহিলার কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠি।
“এই মেয়েকে জায়ান, বিয়ে করে নিয়ে এসেছে?”
উর্মি বললেন,” হ্যা মম।”
মহিলাটির দিকে তাকালাম। ফর্সা ধবধবে শরীরে সিল্ক রানী গোলাপি শাড়ি পরে আছে। শরীরের অধিকাংশ জায়গা দেখা যাচ্ছে। হাতা কাটা ব্লাউজ, ঠোঁটের লাল লিপস্টিক, কান পর্যন্ত চুল, ছেড়ে দেওয়া। চোখে একটা চশমা। তিনি আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে চেঁচিয়ে কাউকে ঠেকে উঠলেন,” লিয়া কাম ফাস্ট।”
হাটু পর্যন্ত টাইট টপস পরিহিত একটা চাকমা মেয়ে দৌড়ে আসল। আমি হা করে তাকিয়ে আছি।
“ইয়েস ম্যাম!”
“দিস ইজ জায়ান ওয়াইফ টেক হার টু এ রুম।”
কথাটা বলেই তিনি আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,” ইওর নেম?”

আমি ঢোক গিলে তাকিয়ে আছি। এরা সবাই ইংলিশেতে কেন কথা বলছে আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে উনি কপাল কুঁচকালো। উর্মি বললেন,” মম ভাবির নাম তৃষ্ণা।”
উনি আমার দিকে অদ্ভুত করে চেয়ে চলে গেল ফোন কানে ধরে।
লিয়া মেয়েটি আমাকে নিয়ে এলো একটা রুমে আমি চারপাশ তাকাতে তাকাতে এলাম।
সে আমার সাথে ইংরেজি তে কথা বলতেই আমি বললাম,” আমি আপনের কথা বুঝি না। আপনে আমার নাগাল ক‌‌ইরা কথা কন।”
লিয়া বললেন,” আচ্ছা। ম্যাম আপনি এখন ফ্রেশ হোন। বিছানায় আপনার পোশাক রাখা আছে। এই রুম আপনার। এখন থেকে এখানেই আপনি থাকবেন।”
বলেই চলে গেল মেয়েটি। আমি বিশাল বড়ো রুমটায় দাঁড়িয়ে আছি। রুমের মাঝখানে একটা বড়ো বিছানা, একটা ড্রেসিং টেবিল। কি করব বুঝতে না পেরে আমি সেখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি।
একটু পরে দরজা খুললে রুমে প্রবেশ করল উর্মি। আমাকে খাটের এককোণে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এদিক ওদিক তাকাতে বললেন, কি হয়েছে?
“কিছু হয় নাই আমি গোসল করবার চাইছিলাম।”
উর্মি আমাকে টেনে বাথরুমে নিয়ে গেল আর কিভাবে কি করতে হবে সব বুঝিয়ে তারপর পোশাক দিয়ে সে চলে গেল। আমি বাথরুমের ভিতরে আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে আছি।

গোসল করে বের হতে দেখতে পেলাম লিয়া আমার জন্য খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আসতেই হাসি মুখে খাবারটা দিয়ে বলল খেয়ে নিতে।
আমি বললাম,”একাই খাবো বাসার আর সবাই কোথায়?”
“সবাই বাইরে খাচ্ছে। তোমাকে এখানেই দিতে বলেছে!”
“আর উনি কোথায়?”
লিয়া তৃষ্ণার কথা বুঝতে না পেরে বললেন,” উনি কে?”
তৃষ্ণা লজ্জায় আর কিছু বলতে পারল না। লিয়া ও আর কিছু বলতে না দেখে চলে গেল। তৃষ্ণা খেয়ে বিছানায় বসে র‌ইল। ও ভাবছে এটা কি আমার স্বামীর রুম? আজ আমাদের বিয়ে হয়েছে সেই হিসেবে আজকে তো আমাদের বাসর রাত তাহলে এই রুমটা দেখে কেন মনে হচ্ছে না বাসর রাত। এদের বাড়িতে আসার পর বিয়ের কোন সাজসজ্জা কিছুই দেখতে পেলাম না। সবাই খুব স্বাভাবিক যেন বিয়েটা শুধু আমাদের বাড়িতেই হয়েছে এই বাড়ি ছেলে যে বিয়ে করেছে দেখে মনে হচ্ছে না।

সব অপরিচিত মানুষদের সাথে আছি ভাবতে আরো কান্না পেয়ে গেল। বাড়ির সবার কথা মনে পড়ছে। তাছাড়া রুমে ও একা আছে। একটু পরে হয়তো স্বামী নামক ব্যক্তিতে চলে আসবে। তারপর কি হবে ভাবতেই ওর কান্না পেয়ে গেল কাঁদতে কাঁদতে নরম বিছানায় বসে পরল। নরম বিছানায় বসতে আরাম পেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। নিস্তব্ধ এই রুমটাতে ঘুমিয়ে ভোর হলো নিস্তব্ধভাবে। কোন মানুষের আনাগুনা নাই।
সবকিছু অন্ধকার। সব সময় বকুলের সাথে ও ঘুমায় একা খুব ভয় পাই ও। ধরতে গেলে ভীতু টাইপের একটা মেয়ে বলা যায়। তৃষ্ণা ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। মানুষের সন্ধানে। এত বড় দালান, এতো রুম ও কোন দিকে চলে গেছে ও নিজেই বুঝতে পারছে না। এখন কোন রুমে নিজে ছিল সেটাই খুজে পাচ্ছি না। সব রুম গুলোর দরজা একরকম লাগছে ও ভয়ে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

ও একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল। তখনই দরজাটা হাট করে খুলে যায়। অপর পাশের ব্যক্তি দরজা খুলতেই কেউ একজন ধাপ করে তার বুকের উপর পরতেই সে চমকে উঠে।
তার পেশিবহুল হাত দ্বারা সামনের মানুষ টাকে পরা থেকে বাঁচিয়ে নেয়।
তৃষ্ণা সোজা হয়ে দাঁড়াল। সামনে তাকিয়ে একটা অপরিচিত উদাম শরীরের পুরুষ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠে চোখ নিচে নামিয়ে নেয়।
জায়ান অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তৃষ্ণার দিকে। এখানে তৃষ্ণা কে আশা করেনি। ও ফট করেই তৃষ্ণার হাত ধরে রুমে টেনে নিয়ে দরজা আটকে দেয়।
” এই মেয়ে তুমি আমার রুমের দরজায় কি করছ? আমার রুম চিনলে কি করে?” বিস্মিত গলায় বলল।
লজ্জায় তৃষ্ণা তাকাতে পারছে না। ওর সামনে একটা ছেলে শুধু ট্রাউজার পরে দাঁড়িয়ে আছে ভাবতেই লজ্জায় ওর কান গরম হয়ে আসছে।
সাথে ভয় ও পাচ্ছে ও একজনের ব‌উ হয়ে এসেছে সেই ব্যক্তিকে তো দেখতেই পেল না উল্টা অন্য পরপুরুষের সামনে এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
ও পেছনে ঘুরে দরজা খুলতে গেল। জায়ান শক্ত করে ওর হাত ধরে বললেন,” এ্যান্সার মি।”
ভয়ে তৃষ্ণা কাঁপছে এই লোকটা ওর হাত ধরছে কেন?
ও ভয়ার্ত গলায় বললেন,” আপনের কথা আমি বুঝতাছি না। আমারে ক্ষমা ক‌ইরা দেন আমি ভুল কইরা আপনের রুমের সামনে চ‌ইলা আইছি। আপনে আমার হাত ধরছেন ক্যান। আমার স্বামী জানলে কিন্তু রাগ করব। ছাড়েন আমার হাত।” কপাট রাগ দেখিয়ে বলল।
জায়ান তৃষ্ণার কথা শুনে চমকে হাত ছেড়ে দিল। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তৃষ্ণার দিকে।
” এই মেয়ে তাকাও আমার দিকে।”
তৃষ্ণা তাকাল না।
জায়ান এবার ধমকে উঠল তৃষ্ণা ভয়ে মাথা তুলে তাকালো জায়ানের মুখের দিকে।
জায়ান নিজের মুখটা এগিয়ে এনে বললেন,,”এবার বল কে রাগ করবে?”
তৃষ্ণা কাঁপা কাঁপা ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,” আমার স্বামী।”
“হোয়াট আর ইউ ম্যাড? আমি হাত ধরলে তোমার স্বামী রাগ করবে?”
তৃষা মাথা কাত করে স্বীকার করল।
জায়ান শক্ত গলায় বললেন,,”তোমার স্বামীকে দেখেছো? তার নাম কি?”
“আমি কিছু জানি না!”
“একটা থাপ্পর মারবো! নাম বল! স্বামীকে এতো ভয় পাও আর তার নাম জানো না!”
“জা-য়া-ন”
“আমাকে ভালো করে দেখো তো তোমার স্বামীর সাথে মিল পাও কিনা।”
বলার অপেক্ষা করেনি তৃষ্ণা তাকিয়েই ছিল। লোকটার মাথায় নজর পড়লে সবার আগে। কালো মাথার চুল গুলো যেন হলুদ করেছে। আমি তো শুনেছিলাম উনার মাথার চুল সাদা কালা। ওনার মাথার চুল তো তেমন না একটু অন্যরকম হলুদ করা এটাতো কালার করা ওমন আমাদের গ্রামে বৃষ্টি আপু করেছিল।
“আপনে কে?”
“জায়ান আহনাফ।” চমকালো তৃষ্ণা। চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে, জায়ানের দিকে।
“ভেরি ব্যাড নিজের হাসবেন্ড কে চিনতে পারলে না? এমন বোকা সোকা বউ পাব বলেই তো এমন পিচ্চি মেয়েকে ধরে বিয়ে করে নিয়ে আসলাম। শোন মেয়ে তোমার বোকামো আর সরলতা দেখে আমি ইমপ্রেস হয়েছি‌। এজন্য তোমাকে একটা গিফট দেব। আসো আমার সাথে।”
বলে জায়ান টেনে আমাকে ভেতরে নিয়ে আসল নিজের আলমারি খুলে কিছু একটা বের করে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। তার হাতের গিফট টা দেখে ভয়ে আমি কেঁপে উঠলাম এমন গিফট কেউ দেয়? এটা কি গিফট নাকি আমাকে ভয় দেখানোর জিনিস।
জায়ান জিনিসটা আমার দিকে এগিয়ে আনছে আমি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় ঠাস করে পড়ে গেলাম।

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here