#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_11
#Writer_NOVA
বৃষ্টিতে সারা উঠোন কাদায় মাখামাখি। বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশ এখনো ভার। কালো মেঘেরা দলে দলে ছোটাছুটি করছে। যেকোনো সময় ঝুপঝাপ বৃষ্টি নেমে যেতে পারে। পা টিপে টিপে হাঁস-মুরগির খোয়ারের সামনে গেলো ফুল। হাস-মুরগি ছেড়ে খাবার দিয়ে দিলো। গোটা একটা দিন খোয়ারে বন্দী থাকার পর ছাড়া পেয়ে হাঁসগুলো প্যাক প্যাক করতে করতে পুকুর ঘাটের দিকে রওনা দিলো। মুরগিগুলো খাবার খেয়ে এদিক সেদিক দৌড়ে চলে গেলো। ফুল শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। জীবনটা বিষাক্ত মনে হচ্ছে তার। বেঁচে থাকার ইচ্ছেগুলো কেমন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। ইদানীং তার মনে হয় সকল সমস্যার মূল যেনো সে। সমাজের যাঁতাকলে পিষ্ট না হলে তারও একটা সুন্দর সংসার থাকতো। পরের বাড়ি থেকে কথা শুনতে হতো না।
‘চেয়ারম্যান সাব বাড়িত আছেননি?’
পুরুষালি গলা পেয়ে ভাবনা থেকে ফিরলো ফুল। মাথায় ঘোমটা টেনে সদর দরজার দিকে পা বাড়াতেই ঝুমুর এসে আটকে দিলো।
‘ফুল, তুমি খাড়াও। আমি যাইতাছি।’
ফুল মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। ঝুমুর ওড়নার গিট খুলতে খুলতে হাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কেডায়?’
‘চিঠি আইছে।’
‘দেন।’
‘স্বাক্ষর করবার পারবেন?’
ঝুমুর করুন চোখে ফুলের দিকে তাকালো। সে তো ভাঙা ভাঙা শব্দে একটু-আধটু পড়তে পারে। লিখতে তো পারে না। যা পারে সেটা বোঝার সাধ্যি কারো হয় না। ফুল চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করে নিচু গলায় বললো,
‘তুমি চিন্তা করো না। আমি দেখছি।’
সদর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে যতটা সম্ভব আড়াল করে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
‘কোথায় সাইন করতে হবে বলুন।’
কলম, কাগজ দিয়ে ডাকপিয়ন বললো,
‘ছোড টিক চিহ্ন দিয়া দিছি। হোনে(সেখানে) কইরা দিয়েন।’
ফুল কাগজ, কলম নিয়ে আলগা হয়ে বসে হাঁটুতে রেখে সাইন করলো। কাগজ, কলম ফেরত দিতেই ডাকপিয়ন চিঠি এগিয়ে দিলো। ফুল চোখ দিয়ে ইশারা করতেই ঝুমুর উচ্ছসিত মনে চিঠিটা ধরলো।
‘কার চিঠি ঝুমুর আপা?’
ঝুমুর ভাঙা ভাঙা শব্দে উচ্চারণ করলো,
‘ফুল রেহনুমা। ও আল্লাহ! এডা দেহি তোমার চিঠি।’
ফুলের কপাল কুঁচকে গেলো। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফের জিজ্ঞেস করলো,
‘কে পাঠিয়েছে? প্রেরকের নাম দেখো।’
‘মনোয়ার সর্দার।’
‘কই দেখি!’
চিঠি হাতে নিয়ে মুহুর্তেই ফুলের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেলো। সাথে দুশ্চিন্তাও ভর করলো। বাড়িতে সব ঠিক আছে তো?
পুষিকে কোলে তুলে আদর করছে শুভ। মনিবের আদরের স্পর্শ টের পেয়ে পুষি ভদ্র বাচ্চা হয়ে রয়েছে।
দক্ষিণের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে অদূরের ধানক্ষেত দেখায় মগ্ন সে। এখনো শীতল বাতাস বইছে। শুভর গায়ে সেন্ডো গেঞ্জি, লুঙ্গি থাকায় একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। প্রকৃতি আজ স্তব্ধ হয়ে আছে। তাই আজ বাড়ি থেকে বের হবে না বলে মনস্থির করেছে শুভ। সে বাসায় আছে আর ফুলকে জ্বালাবে না তা কি হয়? এর জন্য গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডাকলো,
‘কইতরির মা, এদিক আহিস।’
মালিকের হঠাৎ চিৎকারে ভয় পেলো পুষি। চমকে শুভর দিকে এক পলক তাকিয়ে পুনরায় আরাম করে শুয়ে পরলো।ফুলকে ডেকে কান খাড়া করে রাখলো। বারান্দা দিয়ে ফুলের পায়ের শব্দ পাওয়া যায় কিনা। এক মিনিট, দুই মিনি, তিন মিনিট অতিক্রম করলো। তবুও ফুলের আসার নাম নেই। শুভ বিরক্ত হলো। তাই পূর্বের থেকে জোরে চেচিয়ে বললো,
‘কইতরির মা, কই তুই?’
‘আসতেছি!’
নিচ থেকে ফুলের উচ্চ গলার স্বর পাওয়া গেলো। একটু পর ধুপধাপ পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ফুলের আসার শব্দ পেতেই কলিজা ঠান্ডা হলো শুভর। মুখের বিরক্তি নিমিষেই হারিয়ে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।
‘ডাকছিলে?’
হাঁপাতে হাঁপাতে বললো ফুল। হাঁটুতে ভর দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো৷ শুভ তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সামনে নজর দিলো।
‘এতক্ষণ লাগে আইতে? কহন ডাকছি তোরে?’
‘এক ডাকে দৌড়িয়ে এলাম। এরপরও বলছো আমার দেরী হয়েছে।’
‘দুইটা ডাক দিছি আমি।’
‘উদ্ধার করে ফেলছো। এবার বলো কি লাগবে।’
চিবিয়ে চিবিয়ে বললো ফুল। শুভ কোলে থাকা পুষিকে নিচে নামিয়ে দিলো। আরামের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় পুষি বিরক্তি দৃষ্টিতে শুভর দিকে তাকালো। শুভ হুশ হুশ করতেই ম্যাও ম্যাও করে বিরক্তি প্রকাশ করে নবাবী ভঙ্গিতে কামরা ছাড়লো পুষি।
‘কিছু বলছো না কেনো?’
‘এতো চিল্লাস কেন?’
‘চিল্লালে তো তুমি।’
‘তোর নানীর বিয়া লাগছে যে তাই।’
ফুল ছেৎ করে রেগে গেলো। আঙুল উচিয়ে দাঁত কটমট করে বললো,
‘খবরদার আমার নানীকে টানবে না।’
শুভ দুই হাত নাড়িয়ে চোখ পিটপিট করে ভয় পাওয়ার ভান করে বললো,
‘ওরি বাবা, ভয় পেলাম।’
ফুল চোখ সরু করে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেলো। রান্না ছেড়ে এসেছে। ফিরে গেলে সোহেলী বেগম নানা কথা শুনাবে। বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। তাড়া দিয়ে বললো,
‘কি দরকার? বলো।’
‘চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক।’
ফুল মুখ ভোঁতা করে ফেললো। এই ছেলের হয়েছে কি? দক্ষিণের জানালার দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে শুভ। ফুল ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। শুভ মনে মনে খুশি হলো। কেনো জানি নীরবতার সঙ্গী হিসেবে ফুলকে চাইছিলো সে। এখন পেয়ে ভালোই লাগছে। ফুল গুটি গুটি পায়ে পিছিয়ে গেলো। দরজার সামনে গিয়ে দিলো একটা দৌড়। তার দাঁড়িয়ে থাকার সময় নেই। দৌড়ের শব্দ পেয়ে শুভ পিছনে ফিরিয়ে দেখে ফুল নেই।
বিকেলে টিপ টিপ করে বৃষ্টি নেমেছে। টমটম থেকে নেমে বড় রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলো সে। নদীর ঘাটের রাস্তা কাদার ছড়াছড়ি। এক হাতে মাথায় ছাতা ধরে রেখেছে। কাঁধের দিকে ছাতার ডাট রেখে ঘাড় দিয়ে আটকে রেখে দুই হাত দিয়ে প্যান্ট উল্টিয়ে উঁচু করলো। যাতে কাদা না লাগে। চামড়ার জুতা জোড়া হাতে নিলো। কাজ হতেই ছাতা ধরে পা টিপেটিপে ঢালু বেয়ে নামতে লাগলো। ঐ তো মাঝিকে নৌকা নিয়ে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
মনু মাঝি বিড়ির প্যাকেট থেকে বিড়ি বের করে দিয়াশলাই দিয়ে ধরালো। বৃষ্টির দিনে মানুষ বের হয় কম। তাই খেয়া পারাপার বেশি হয় না। এই দিনে বাড়ি থেকে বের হওয়া মানে অলস সময় পার করা। কাজ না থাকলেও বাড়ি থাকতে চায় না মনু মাঝি। পোয়াতি বউটা সারাদিন খ্যাচ খ্যাচ করে। মাঝে মাঝে এই কারণে বউকে উত্তম-মধ্যমও দেয়। তবুও থামে না। এর জন্য বাড়ি থাকার থেকে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নৌকায় বসে থাকা ভালো।
‘ওপাড়ে যাবে?’
গমগমে কন্ঠস্বর শুনে চোখ তুলে তাকালো মনু মাঝি। সাদা শার্ট, কালো প্যান্টে এক সুদর্শন যুবক হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে সরু ফ্রেমের চশমাটিতে বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির পানি জমে আছে। বাম হাতে সেটা পরিষ্কার করলো ছেলেটি। মনু মাঝি হাতের বিড়ি নদীতে ছুড়ে ফেলে হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কই যাইবেন?’
‘চেয়ারম্যান বাড়ি।’
‘উডেন।’
যুবকটি ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালো। ঠিকমতো ছাতা না ধরায় সাদা শার্টে ছিটেফোঁটা বৃষ্টির পানি পরেছে। গিয়ে ধুয়ে না দিলে তিল পরে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেদিকে গ্রাহ্য করলো না সে। নৌকার মাচা ভিজে গেছে। মনু মাঝি একটা উঁচু পিঁড়ি এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘এডায় বহেন।’
‘ধন্যবাদ।’
পিঁড়িতে বসলো। নৌকাটা কিনারার হিজল গাছের সাথে সরু দড়ি দিয়ে বাধা ছিলো। মাঝি দড়ি ছুটিয়ে বৈঠা নিলো। নৌকার আগায় জায়গা নিয়ে বসে নদীর পানিতে বৈঠা ফেললো। ছলাৎ ছলাৎ পানির শব্দ করে নৌকাটা এগিয়ে যেতে লাগলো গন্তব্যের উদ্দেশে।
‘আপনেরে তো আগে কহনও দেহি নাই।’
মনু মাঝির প্রশ্নে স্মিত হাসলো সে। ধীর গলায় বললো,
‘শহরে থাকি আমি।’
‘এর লিগ্গা আমার আপনেরে নতুন নতুন মনে হইতাছে।’
‘আপনি নতুন মাঝিতে যোগ দিয়েছেন?’
‘নতুন না, দুই বছর হইয়া গেছে। বড় ভাই মাঝিতে আছিলো। টাইফয়েড জ্বরে হেয় মইরা যাওনের পর হের কাম আমি ধরছি।’
যুবক এদিক সেদিক তাকিয়ে উত্তর দিলো।
‘এর জন্য আমাকে চিনেননি।’
‘আপনের এই গেরামের পোলা?’
‘হ্যাঁ, বছর দুই-আড়াই ধরে গ্রামে আসা হয় না।’
‘আইচ্ছা, এর লিগা চিনি নাই। আমিও আগে শহরে কাম করতাম। ভাই মইরা যাওনের পর গেরামে আইয়া বিয়াশাদী করছি। এরপর থিকা হেনেই থাকি।’
সে উত্তর দিলো না। গভীর মনোযোগ দিয়ে চারিপাশের পরিবেশ দেখতে ব্যস্ত। গ্রামের চেহারা কত পাল্টিয়েছে। রাস্তা-ঘাট আগের থেকে একটু ভালো। মনটা অনেকটা ফুরফুরে লাগছে। কতদিন পর প্রিয় মানুষগুলো দেখা মিলবে। এ যেনো ঈদের চাঁদ দেখার মতোই আনন্দদায়ক।
#চলবে
গল্পটা কি আপনাদের ভালো লাগছে না? তাহলে দু-এক লাইন মন্তব্য কেন করছেন না? এত ব্যস্ততার মধ্যে আমি যদি আপনাদের জন্য গল্প লিখতে পারি, আপনারা সামান্য দুই মিনিট ব্যয় করে দুই লাইন মন্তব্য কেন করেন না?