#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_10
#Writer_NOVA
রসুইঘরের টিনের চালে ঝমঝম শব্দ করে বৃষ্টি পরছে। বাতাসের ঝাপটায় থেমে থেমে গা কেঁপে উঠছে ফুলের। দূর থেকে দূরান্তে তাকালে সাদা কুয়াশার মতো আবরণ ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। কবিগুরুর “আষাঢ়” কবিতার মতো পরিস্থিতি। যেনো প্রাকৃতিও কবির সাথে মিলিয়ে সাবধান করছে, “ওগো, আজ তোরা যাস না ঘরের বাহিরে”। সামনে থাকা লাউশাকের মাচা বাতাসের তোরজোড়ে হেলেদুলে উঠছে। শুভদের বাসার দক্ষিণের বিশাল কড়ই গাছের মগডালটা চির চির শব্দ করে উঠলো। ধুপ করে নারিকেলের পরার শব্দ চমকে উঠলো ফুল। বিজলি চমকাচ্ছে। সকাল থেকে বৃষ্টি। সারাদিন আবহাওয়া এমনি ছিলো। বৃষ্টির দিন ফুলের পছন্দ নয়। চারিদিকে সেঁতসেঁতে পরিবেশ, ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ, উঠান ভর্তি কাদার মাখামাখি। আসলেই বিরক্তিকর!
দরজায় মৃদু কষাঘাতে নড়েচড়ে বসলো ফুল। পরনের ওড়না ঠিক করে মাথায় আধ ঘোমটা টেনে দিলো। দরজার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো। শুভ এক হাতে নিজের ভর দিয়ে নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফুলের দিকে। চেহারার গম্ভীরতায় ফুলের কাছে ভিন্ন কোন শুভর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে বলে মনে হলো। মাথার চুলগুলো জবজবে ভেজা। পরনের শার্টের অবস্থা বেহাল। ফুল মনে মনে বেশ রাগলো। এই ছেলে আবারো জ্বর, সর্দিকাশিকে নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছে। এমনিতেই তাকে কাবু করে ফেলে। আর আজ তো বৃষ্টিতে ভিজেছে।
‘কিরে ভিতরে আইতে কবি না?’
‘তুমি আবার এতো ভদ্র কবে হলে? আমার কামরায় আসার জন্য অনুমতি চাইছো। বিষয়টা অদ্ভুত নয় কি?’
‘আমি ভালা হইতে চাই কিন্তু সমাজ আমারে হইতে দেয় না। আবারো নিজের চোখে প্রমাণ পাইলাম।’
শুভর কথায় ফুল আড়ালে হাসলো। শুভর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তখনো ফুলের দিকে।
‘ধূর, তোর উনুমতির গুষ্টি কিলাই। কহন থিকা দাঁড়ায় রইছি।’
শুভ হনহন করে ভেতরে ঢুকে খাটে বসতে নিলে ফুল চেচিয়ে উঠলো,
‘আরে আরে করো কি? আমার বিছানা ভিজাবে নাকি? দাঁড়াও বলছি।’
শুভ দাঁড়ালো না। ত্যাড়ামি করে বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে আরাম করে বসলো। ফুল কোমড়ে হাত রেখে ঠোঁট ফুলিয়ে তাকালো। শুভ মনে মনে হাসলো। তাকে দাঁড় করয়ে রাখার শিক্ষা এটা। ফুল কিছু বললো না। আলনার থেকে গামছা এনে শুভর দিকে বাড়িয়ে দিলো।
‘তুমি ভালো হওয়ার মতো মানুষ না। একটু আগে আবার সিনেমার মতো করে ডায়লগ দেয়। “আমি ভালা হইতে চাই কিন্তু সমাজ আমারে হইতে দেয় না”। ইশ, আসছেন ভালো মানুষের ছালা। দিলো আমার বিছানাটা ভিজিয়ে। এমনি ভেজা আবহাওয়া আমার ভালো লাগে না।তার মধ্যে বিছানা ভিজিয়ে দিলো।’
‘যেমনে কইতাছোত মনে হইতাছে আমি হিসু করে ভিজায় দিছি।’
শুভ কৌতুকের সুরে বলে নিজে নিজে হেসে উঠলো। ফুল নাক, মুখ কুঁচকে বললো,
‘ছি! তোমার মুখে কিছু আটকায় না।’
শুভ ফুলের কথায় কান দিলো না। গামছা দিয়ে শরীর, মাথা মুছে নিলো। এরপর পকেট থেকে সাবধানে দুই মুঠ কাচের চুড়ি বের করলো। এক মুঠ লাল, আরেক মুঠ নীল। চুড়ি আটকানোর জন্য যেই কাগজটা ব্যবহার করা হয়েছে তা ভিজে ছিঁড়ে গেছে। যা জানান দিচ্ছে সে একটু আগে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এটা কিনে এনেছে।
‘নে এগুলা তোর।’
বিস্ময়ে ফুলের মুখটা হা হয়ে গেলো। চুড়ি আনতে ছেলেটা এই ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে বাজারে গিয়েছিলো? তাই শরীর এমন ভেজা! বিস্ময় চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেললো,
‘তুমি চুড়ি আনতে গিয়েছিলে?’
শুভ প্রতিত্তোরে মুচকি হাসলো। এতেই বোঝা যায় সত্যি তাই। শুভ তাড়া দিয়ে বললো,
‘নে ধর, লাল চুড়িগুলো এহন পইরা আমারে দেহা তো।’
সহজ-সরল আবদার। কিন্তু ফুলের মন ইঙ্গিত দিচ্ছে অন্য কিছুর। এটা সত্যি হলে যে বড় একটা অঘটন ঘটে যাবে। তাই চুড়ি না ধরে স্থির দৃষ্টিতে শুভর দিকে তাকিয়ে রইলো।
মাগরিবের আজানের আগ মুহুর্তে ঝুমুর কোথা থেকে এসে ফুলকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘ফুল তোমারে চাচা ডাকে।’
হাতের চুড়িগুলো লুকিয়ে স্বাভাবিক হয়ে ফুল বললো,
‘তুমি যাও আমি আসছি।’
ঝুমুর গেলো না। এদিক সেদিক তাকিয়ে খাটের নিচ উঁকি দিয়ে মাঝারি সাইজের একটা নারিকেল বের করলো। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো,
‘দেহো ফুল, আমি এইডা পাইছি। বৃষ্টিতে ধুপ কইরা পরছিলো। বৃষ্টি কমতেই লইয়া আইছি।’
নারিকেল পরার শব্দ ফুল পেয়েছিলো। ইচ্ছা ছিলো সে কুড়িয়ে আনবে। কিন্তু শুভর চক্করে পরে সব ভুলে গেছে। হাতের চুড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে ফুল ইতস্ততায় পরে গেলো৷ শুভ সামনে থেকে তাকে বাধ্য করেছিলো চুড়ি পরতে। শুভ নিজে পরানোর ভয় দেখাতেই ছিটকে দূরে সরে নিজে নিজে পরে নিয়েছিলো। তা নিয়ে শুভর কি হাসি!
‘তুমি চুড়ি পাইলা কই? কালকে না চাচী ভাইঙ্গা ফালাইলো।’
ফুল চকিতে তাকালো। এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে বলে ফুল চুড়িগুলো আড়াল করেছিলো। তার মন বলেছিলো পরে দেখিয়ে ঝুমুর আপাকে সবটা বলবে। এখন উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না।
‘কি হইলো কও না?’
‘সে অনেক কাহিনি! পরে বলবো। আগে চাচার ঐখান থেকে আসি।’
কিন্তু ঝুমুর মানলো না। জোকের মতো করে ফুলকে ঠেসে ধরলো৷ ফুল হাতের চুড়ি খুলতে খুলতে ঝুমুরকে সবটা বলতে আরম্ভ করলো।
‘আমারও মনে হইছে শুভ ভাই দিছে। তবুও তোমারে জিগাইলাম। তুমি যহন কানতাছিলা আমার অনেক খারাপ লাগছিলো। তাই শুভ ভাই ফিরনের পর সব খুইল্লা কইছি।’
‘ওহ, কলকাঠি তুমি নাড়িয়েছো তাহলে?’
ফুল সরু চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো। ঝুমুর খিলখিল করে হেসে উঠলো। সেই হাসির শব্দ কানে আসতেই ফুল তব্দা মেরে রইলো। মনে মনে চিন্তা করলো একটা মানুষের মনে এতো কষ্ট থাকার পরও কিভাবে পারে এভাবে হাসতে?
🌸
‘তোমার চা।’
‘কই থাকোস আজকাল? সারাদিন ধইরা তোর কোন খবর নাই। পুরা দিন ধইরা আমি বাড়ি। তোর দেহা নাই। ঝুমুররে দিয়া কহন খবর পাঠাইছি। তুই এহন আলি।’
ফুল কপাল কুঁচকালো। আনোয়ার সর্দার কাপ নিয়ে চায়ে চুমুক দিলেন। চাচা, ভাতিজীকে একসাথে দেখে সোহেলী বেগম কিংবা সুফিয়া বিবি কারোর ভালো লাগলো না। সোহেলী বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
‘হো সারাদিন দেহো নাই। পরাণ পুড়তাছিলো না। এহন মন ভইরা দেইখা পোড়া মনডারে জুড়াও।’
‘এই মাইয়ার লিগা তোর যে কেন এতো পিরিতি তাই বুঝি না। ওর মায় কি করছিলো ভুইল্লা গেছোত?’
সুফিয়া বিবির পিঞ্চ মারা কথাবার্তায় ফুলের রাগ হলেও নিজেকে সংবরণ করে নিলো। তার এখন ঝামেলা করতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া যেখানে তার চাচা মজুদ আছে সেখানে কথা বলা বেয়াদবি। চায়ের কাপ নামিয়ে শান্ত গলায় উত্তর দিলেন আনোয়ার সর্দার।
‘না মা ভুলি নাই। হুদা (শুধু) অন্যের মাইয়ারে দোষ দেও কেন? দোষ তো তোমার পোলাও করছে। ওর মায় একলা পালায় নাই। তোমার পোলা লগে আছিলো। কই একবারও নিজের পোলার কথা কইতে দেহি না তোমারে। হুদাই ওর মায়েরে সব বিষয়ে টানো কেন? দোষী দুজনেই। কথা হুনাইলে দুইজনরে হুনাইবা। না হুনাইলে কাউরে না।’
সোহেলী বেগম মুখ তেঁতো করে বললেন,
‘ছোট ভাইয়ের বউয়ের লিগা দরদ বাইয়া পরতাছে।’
সুফিয়া বিবি হুংকার দিয়ে উঠলেন,
‘এই ছেমরির লিগা আমগো কথা হুনাস? এই ছেমরির মায় আমার পোলাডারে তাবিজ কইরা নিছে।’
আনোয়ার সর্দার ধীরেসুস্থে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
‘ওর মা দোষ করছে। ওর মা রে কথা হুনাইবা। একটার বদলে একশোটা হুনাইবা। কিন্তু ওরে হুনাও কেন? বেচারির কি দোষ? ও কি তোমার পোলা আর ওর মায়রে কইছিলো ভাইগা যাইতে? নাকি ও নিজে দাঁড়ায় থাইকা বিয়া দিছে? যার কারণে ওর প্রতি এতো ক্ষোভ তোমগো। নূরজাহানের মতো ফুলও তোমার নাতনি। এই বংশের মাইয়া। একই বংশের দুই মাইয়ার প্রতি এতো ভেদাভেদ কেন করো?’
‘ভেদাভেদের কথাডা আপনের মুখে মানায় না।’
শুভর কন্ঠস্বর পেয়ে সবাই দরজার দিকে তাকালো। শুভ শক্ত মুখে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। ভেতরে ঢুকে পূর্বের কথায় জোর দিয়ে বললো,
‘যেই কামডা নিজে করেন ঐ কামডা না করতে অন্যেরে কইবেন না। অবশ্য যার মায় ভেদাভেদ করে তার পোলায় করবো না কেন?’
‘শুভ!’
ধমকে উঠলেন আনোয়ার সর্দার। শুভ পাত্তা দিলো না। ফুলের দিকে তাকিয়ে দেখলো চোখ দিয়ে পানি পরছে। নাকের ডোগা লাল হয়ে গেছে। বুকের ভেতরটা ছেৎ করে উঠলো। মেয়েটা এমন কেন? পারে না সবাইকে কড়া কথা শুনিয়ে দিতে। তা না করে বেশিরভাগ সময় কেদেকেটে অস্থির হয়ে যায়। ফুলের এক হাত ধরে কামরা থেকে বের হয়ে গেলো শুভ। অন্য সময় হলে ফুল হাত সরিয়ে নিতো। কিন্তু আজ কিছু বললো না। চুপচাপ শুভর পিছু পিছু প্রস্থান করলো।
ছেলেকে এভাবে সবার সামনে ফুলের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে দেখে সোহলী বেগম তেতে উঠে বললেন,
‘এই মাইয়া যত নষ্টের গোড়া। আমার পোলাডারেও বিষায় হালাইছে। বাপের লগে তর্ক করে।’
সুফিয়া বিবি খাটের পাশ দিয়ে পানের চিপটি ফেলে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
‘তোর ছোড পোলা ভদ্র আছিলো কবে? জন্মের পর থিকা বাপের লগে বেয়াদবি করে।’
সেহেলি বেগম আঙ্গারের মতো জ্বলে উঠলো।
‘আপনের ছোড পোলা বোধহয় ভালা আছিলো? হেই তো কামের বেডির মাইয়া লইয়া ভাগছে। ভালো পোলারা কি এমন কাম করে?’
সুফিয়া বিবি কম যান না। আঙুল তুলে শাসিয়ে বললেন,
‘খবরদার আমার মনোয়াররে নিয়া কিছু কবি না।’
‘আপনেও আমার শুভরে নিয়া কিছু কইবেন না।’
বউ, শাশুড়ীর ধুমধড়ক্কা কথা কাটাকাটি লেগে গেলো। মিনিটের মধ্যে তা ঝগড়ায় রূপান্তরিত হলো। আনোয়ার সর্দার টিকতে না পেরে ধমকে উঠলো।
‘থামবা তোমরা? বাড়িডারে মাছের বাজার বানায় ফালাইছে। মন চায় না থাকতে। সারাদিন অশান্তি করো তোমরা। বাড়িত থাকনের চেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুইরা মাইনসের সেবা করোন ভালো।’
উঠে চলে গেলেন আনোয়ার সর্দার। সেদিকে বউ, শাশুড়ী এক পলক তাকিয়ে আবার ক্যাচাল শুরু করে দিলেন। আজ এই ঝগড়া থামার নয়।
#চলবে
সবাই রেসপন্স করবেন প্লিজ☹️।