কোন_এক_শ্রাবণে❤ পর্ব ৩১+৩২

#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩১

গাম্ভীর্যতার ছিঁটেফোটাও নেই নিজাম রহমানের সারামুখে।বরং ঠোঁটের কোঁণে ঝুলছে মুচকি হাসি।তোহা তখনো ভয়ে মাথা নিচু করে রেখেছে।নিজাম রহমান নাতনির নতমুখের দিকে চেয়ে স্বশব্দে হেসে পাশে বসলেন।তোহার ডানপায়ে আলতা পরানো ইতিমধ্যেই শেষ করেছে তিহান।পা টা নামিয়ে রেখে নিজাম রহমান হাস্সোজ্জ্বল মুখের দিকে চাইলো সে।তারপর একেবারেই স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
—“বাচ্চা মানুষতো ‘নানা’,পড়তে জানেনা।তাই আরকি।”বলে অবিলম্বে তোহার বামপাটা নিজ হাঁটুর উপর তুলে নিলো।

নিজাম রহমান আবারো হাসলেন।খানিকটা দুষ্টুমি করে ফিচলে গলায় বললেন,
—“মনোয়ারা কেও আমি এভাবে আলতা পরিয়ে দিতাম।”

কথাটা শোনামাত্রই হেসে ফেললো তিহান।চমৎকার সুন্দর নজরকাড়া হাসি।সুপুরুষ চেহারার মাঝেও কোথায় যেনো একটু লজ্জাভাব লুকিয়ে আছে।অপরদিকে তোহার তখন ঘোরতর লজ্জায় আর ঘটনার আকস্মিকতায় অজ্ঞান হবার অবস্থা।মনোয়ারা তাদের নানুর নাম।তথাপি নানার কথার মানে,ইঙ্গিত,ইশারা বুঝতে কোনোরকম কষ্ট হয়নি তার।

—“তোমার না নানুর সাথে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিলো?তবে?”নিছক কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করলো তিহান।

—“বিয়ের পর প্রেম করা যায়না বুঝি?তোমাদের নানু খুব লাজুক ছিলো বুঝলে।বিয়ের দু”তিনমাস অবধি প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলেনি আমার সাথে।আমি তখন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক।বুকে একসমুদ্র প্রণয়ের ঢেউ। রাতের বেলা বাড়ি ফেরার সময় আলতা,শাড়ি,চুড়ি নিয়ে আসতাম।পাগলামি করতাম।তোমাদের নানু মুখ বুজে সহ্য করতো।আরক্তিম লাল আভায় ছেঁয়ে যেতো তার গাল।তারপর ধীরে ধীরে তার লজ্জা কাটলো।বউ হলেও কয়েকমাস পর্যন্ত ব্যাক্তিগত প্রেমিকাই ছিলো সে আমার।”

—“আরে বাহ্ নানা।তুমি দেখি…”বলেই দুই ভ্রু দুবার উঁচিয়ে দুষ্টুমি করলো তিহান।নিজাম রহমান হেসে আস্তে করে তিহানের কাঁধে চাপড় মারলো।এদের দুজনকে একসাথে দেখে ভালোলাগায় ভরে উঠছে মন।
মনে চাচ্ছে এখনই বিয়ের কাজ সেরে ফেলতে।তবে তিহানের সাথে আগেই কথা হয়েছে তার।তাই এ বিষয়ে এখন আর কিছু বললেন না।তাছাড়া তার নাতনি টাও বেশ লাজুক।মৃদু হেসে তিনি তোহার মাথায় হাত রেখে স্নেহের সহিত বললেন,
—“তুমি অনেক ভাগ্যবতী মা।এমন যত্ন সবার ভাগ্যে থাকে না,বুঝলে?”

উওরে মৃদুভাবে মাথা নাড়ালো তোহা।নানা-নাতির লাগামহীন কথাবার্তায় রীতিমত লজ্জায় মাথা কাঁটা যাবার মতো অবস্থা তার।এমন একটা লজ্জাকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে জানলে কস্মিককালেও এখানে বসে আলতা পরতোনা সে।
এরই মাঝে তিহান যেন তাকে আরো একটু লজ্জার হাবুডুবু খাওয়াতে নিজের হাত বাড়িয়ে বললো,
—“হাতটা..”

মুখটা একটু তুলে চোখ রাঙিয়ে তিহানের দিকে তাকালো তোহা।সেই চাহনী যেনো আগুন ঝলসানো কন্ঠে বারবার বলছে,”আপনার কি একটুও লজ্জা নেই?”
তিহান নির্লজ্জের মতোই হাসলো।নিজেই তোহার হাতটা টেনে আঙ্গুলের উপর অংশগুলায় আলতা ভরাতে শুরু করতেই লজ্জায় ঠোঁট চেপে ধরলো তোহা।মনে হচ্ছে এখন ছুটে চলে যেতে পারলে ভালো হতো।তবে এমনটা করলে খুবই বিশ্রি বেয়াদবি হবে।
তোহার অসস্তি বুঝতে পেরেই উঠে দাড়ালেন নিজাম রহমান।যাওয়ার আগে তিহানের এককাঁধে হাত রেখে ঝুঁকে বললেন,
—“প্রণয়ের পথটুকুতো অনেক চলেছো,এবার একটা স্হায়ী গন্তব্য পৌঁছানো উচিত কিন্তু।অন্তত আংটি টা পরিয়ে রাখলে..”

—“আচ্ছা,আমি ভেবে দেখবো নানা”।মাঝপথেই ধীরকন্ঠে উওর দিলো তিহান।

নিজাম সাহেব চলে যেতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো তোহা।ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো,
—“আপনার কি মাথা গিয়েছে পুরো?নানার সামনে এমন করে কেও?না জানি উনি কি ভাবলো!আল্লাহ্”

—“তোমার কি মাথা গেছে?উনার কথা শুনে বুঝোনি কিছু?অদ্ভুত!”

—“এটাও তো আপনার কাজ।নির্লজ্জের মতো নানাকে বলেছেন..ছিহ্!”

—“আমি কিছু বলিনি।উনি এমনেই বুঝেছে।তারপর নিজেই জিজ্ঞেস করেছে।…তোমার মতো ওতো লজ্জা নিয়ে থাকলে আমার আর তোমাকে পাওয়া লাগবেনা।”নির্বিকার ভঙ্গিতে কথাটা বললো তিহান।তার এতটুকু কথাতেই কন্ঠনালি আটকে গেলো তোহার।পরমূহুর্তেই নিজেকে সামলে নিলো সে।তারপর আগেই মতোই অগ্নিকন্ঠে বললো,
—“আপনার কি দরকার ছিলো আমাকে সবার সামনে ওভাবে খাইয়ে দেয়ার?আবার আম্মু জিজ্ঞেস করলে উওর কি দিলেন?”আমিই খাইয়ে দিই খালামনি।ওর হাত মাখবে শুধু শুধু।”তিহানের মতো করে কথাটা বলে থামলো তোহা।পরমূহুর্তেই দ্বিগুন মেজাজ দেখিয়ে বললো,”আপনার কি আম্মুকে এতোটাই বোকা মনে হয়?”

তোহার কথাটায় প্রতিক্রিয়া দেখালোনা তিহান।ততক্ষনে তোহার চার হাতপায়েই তার আলতা পরানো শেষ।
আলতার বোতলটা বন্ধ করে বসার জায়গাটার উপর রাখলো তিহান।তোহার হাত পা লাল রঙে রাঙানো।
পরণে হলুদ কামিজ।মাথায় ঘোমটা।মনে হচ্ছে হলুদের আসরের কোন বউ পালিয়ে এসে হবু বরের সাথে প্রেমে মেতেছে।

তিহান একদৃষ্টিতে কিছুক্ষন কাঙালের ন্যায় চেয়ে থাকলো।অত:পর তোহার হাতদুটো মুঠোয় নিয়ে মাথা অল্প ঝুঁকিয়ে হাতের উল্টোপিঠ নিজের কপালে ছুঁইয়ে দিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,

—“”দীর্ঘ প্রেমকাহন পূর্ণতা পাক।এই মূমূর্ষ প্রেমিকের অপেক্ষার অবসান হোক।তুমি শুধু আমার হও।”

______________
বারান্দার গোলাকার জায়গাটা ছেলে মেয়েদের খোশগল্পে মেতে উঠেছে।তোহা বসেছে রেলিংয়ের পাশের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে।
তার পাশে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে আছে তূর্য।অপরপাশে স্বর্ণালী।তিহান বসেছে সাইফ আর নুহাশের মাঝে।অনেকটা বৃত্তাকারেই আছে তারা।তোহা উদাসমুখে সাদা সচ্ছ আকাশের দিকে চেয়ে আছে।সাদা আকাশের প্রতিচ্ছবি পরেছে তার ঘনকালো হরিণী চোখদুটিতে।মনে হচ্ছে কোন গভীর কালো জলদিঘিতে সাদা শুভ্রপরী ডানা মেলে স্নান করছে।ঠোঁটের কোনটা একটু প্রসারিত হলো তিহানের।নুহাশের দৃষ্টি তখন আগাগোড়াই তোহার দিকে।ভ্রু কুঁচকে মজার ছলে সে বললো,
—“আলতা টালতা পরেতো একেবারে বৌ সেজে বসে আছিস তোহা?ব্যাপার কি?তূর্য ভাইয়া তোমার বোনের মতলব তো ভালো ঠেকতেছেনা আমার!”
নুহাশের কথায় হাসলো তূর্য।
—“কিরে?আলতা পরেছিস কেনো?”বলেই তোহার মাথায় হাল্কা চাঁটি মারলো তূর্য।এতক্ষণে ধ্যান ভাঙলো তোহার।কথাগুলো কানে ঢুকেনি তারউপর তূর্য আর নুহাশকে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে আরো হতবিহ্বল হয়ে পরলো সে।নড়েচড়ে বসে বিচলিত কন্ঠে বলল,
—“কিছু বললে তোমরা?”

এবার যেনো আকাশের “চাঁদ” হাতে পেয়ে গেলো নুহাশ। কয়েকগুন উৎসাহ নিয়ে জোর গলায় সে বললো,
—“এবারতো একশো পার্সেন্ট শিওর ভাইয়া।তোমার বোন নির্ঘাত প্রেম করে।বেখেয়ালি হওয়াই এর প্রথম লক্ষণ।”

এবারো নুহাশের কথা হেসে উড়িয়ে দিলো তূর্য।তোহার মন তখন আবারো অন্যমনষ্ক হয়ে পরেছে।অকারণেই মন খারাপ লাগছে।মন ভালো থাকার হাজারটা কারণ থাকা সত্তেও এই “অকারণটা” সব দখল করে বসে আছে।

এরইমধ্য সবার জন্য চা দিয়ে গিয়েছে মনোয়ারা।বড় ট্রে তে চায়ের সাথে টোস্ট বিস্কিট।বিস্কিটের উপর চিনি দেয়া।খেতে বেশ স্বুস্বাদু।
গরম চায়ের কাপ হাতের তুলে নিলো তোহা।কাঁচের কাপের হাতলে না ধরে সরাসরি কাপের গাঁয়ে ধরার কারণে হাল্কা একটু ছেঁকাও খেলো আঙ্গুলে।তার সেদিকে মন নেই।সে ব্যস্ত শরতের আকাশের সাদা মেঘের ভেলা গুলো চোখের দৃষ্টিতে দেখেই একান্ত আপন করে নিতে।
ধ্যানহীন মস্তিষ্কে গরম কাপে চুমুক দিতে যেতেই কেউ হাতের কব্জি ধরে ফেললো তার।চকিতে তাকালো তোহা।
তিহান সাথেসাথেই তার হাত ছেড়ে গলার স্বর নামিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
—“গরম এখনো”।

দৃষ্টি নামিয়ে নিলো তোহা।ভাবলো,আচ্ছা তার মন খারাপের সাথে কি কোথাও তিহানও জড়িয়ে আছে?পরমূহুর্তেই ভাবনাটা হেসে উড়িয়ে দিকে মনে মনে বললো,ধুর!এই লোকটাকে তার মন ভালো করার এক অবিচ্ছেদ্য কারণ।
______________
সন্ধ্যাবেলার আবছা অন্ধকার পুকুরপাড়।ভুতুরে নির্জন পরিবেশ হওয়া সত্ত্বেও এখানটায় অনেক শান্তি আছে।পুরো বাড়ির একেবারেই কোঁণার দিকে বড় পুকুরটা।বারান্দার কোঁণার সাইড ঘেঁষে না দাড়ালে পুরোপুরি দেখা যায়না।স্হির স্বচ্ছ পানিতে এক দুইটা সবুজ পাতা ভাসছে।সবাই বাড়ির ভিতরে।ভরা আড্ডার আসর থেকে সে-ই নেমে এসেছে চুপিসারে।কারণ,মন ভালোনা।সব কেমন পানসে লাগছে।
পাড়ের দিকে এককদম এগোলো তোহা।পুকুরে মাছ থাকলে বেশ হতো।তবে এটায় মাছ টাছ নেই।শুধুমাত্র বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য খনন করেছে নানা।
যদিও অন্ধকার তবুও স্বচ্ছ পানিতে গভীর ভাবে তাকালে নিজেকে দেখা যায় নাকি তা দেখার জন্য কয়েক পা এগিয়ে যেতেই অসাবধানতায় হুট করে পিঁছলে গেলো তোহা।অত:পর পানিতে বিকট শব্দ তুলে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ…”
#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩২

চা টা শেষ করে মাত্র কাপটা মেঝেতে রেখেছে তিহান।এরই মাঝে পুকুরের পাশ থেকে পানির শব্দে কান খাড়া হয়ে এলো তার।ঘাড় ফিরিয়ে একবার তাকালো।শুধু সেই নয় সেখানে উপস্থিত সবাই-ই তাকালো।কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়েও থাকলো।তিহানের কপালে গভীর ভাঁজ।পানিতে ঝাপটানোর অনবরত আওয়াজ আসছে।
কিছুক্ষণের ব্যবধানেই তার শূন্য মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠলো।ঘাড় ঘুরিয়ে একপলকে সবার দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়িয়ে সে।শঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,”তিহু কোথায়?”

চারিদিকে পানি।পুকুরটা বেশ গভীর তার উপর গুমোট অন্ধকার।দুহাত মেলে ঝাপটাচ্ছে তোহা।এখনো ডুবে যায়নি।সে সাঁতার জানে।তার যখন পনেরো-ষোল বছর ছিলো তখনই নিজ দায়িত্বে তাকে সাঁতার শিখিয়েছিলো তিহান।শহরের তেমন পুকুর -টুকুর নেই।কোন জায়গায় এক সুইমিংপুল ছিলো সেখানে নিয়ে গিয়ে টানা বিশদিনে সাঁতার জিনিসটা রপ্ত করতে পেরেছিলো সে।তবে এখানটায় পানির গভীরতা তার উপর আকস্মিক ভয়টা সারা গায়ে,মন মস্তিষ্কে নিপুণভাবে জেঁকে বসেছে।হাত-পা কাঁপছে।সাঁতরানোর ঠাঁই পাচ্ছেনা কোনোভাবেই।তবুও হাল ছাড়েনি।সাঁতরিয়ে পাড়ে না পৌছাতে পারুক অনন্ত ডুবে যেন না যায় সেই চেষ্টাই করছে।

এলোমেলো পায়ে নিচে ছুঁটছে তিহান।তার পা কাঁপছে।মাথায় কাজ করছেনা কোনোকিছু।সবকিছু কেমন জমাট বেঁধে যাচ্ছে।তোহাকে না দেখা পর্যন্ত শান্তি হচ্ছেনা এতটুকুও।তার পিছে পিছে বাকিরাও আসছে।তিহানকে রীতিমত দৌড়ে বেরিয়ে যেতে দেখে হলরুমে বসে থাকা আতিয়া স্বর্ণালির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে বললো,
—“কি হয়েছে?এভাবে কই যাচ্ছিস সবকটা?”

স্বর্নালি কিছু বলতে পারলোনা।বিষয়টা এখনো পুরোপুরি ঠাওর করতে পারেনি সে।তাকে ফ্যালফ্যাল করে বোকার মতো চেয়ে থাকতে দেখে সাইফ আগ বাড়িয়ে উওর দিলো,
—“তোহা বোধহয় পুকুরে পরে গিয়েছে খালামনি।আমরা শিওর না।”

“কিহ্”বলে আৎকে উঠলো আতিয়া।টেনশনটা তার বরাবরই বেশি।মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো।তূর্য নেই আশেপাশে।সে আগেই ছুটেছে তিহানের পিছুপিছু।তার অসচ্ছ দৃষ্টি দেখেই সাইফ এগিয়ে গেলো।আলতো করে ধরে বসিয়ে দিলো সোফায়।
_____________

তোহার অবস্থা নিভু নিভু।বেশ বুঝতে পারছে কয়েকটা পা এদিকেই দৌড়ে আসছে তবে ডাকার নূন্যতম শক্তিটাও পাচ্ছেনা।নিস্তেজ হয়ে আসছে শরীর।শেষ কয়েকবার হাত দিয়ে এগোনোর চেষ্টা করলো সে।
হাল ছেড়ে দেয়ার আগমূহুর্তে পানিতে আরো একজনের ঝাপিয়ে পরা আর মুখের উপর ফ্ল্যাশলাইট পরায় কিছুটা চেতনা ফিরে পেলো।সামনের কালো অবয়বের মানুষটির মুখ না দেখেই সে ক্ষীণ কন্ঠে ডাকলো,
—“তিহান,ধরুন আমাকে”।

কথাটা পুরোপুরি শেষ না হতেই দুহাতে তোহাকে জাপটে ধরে বুকের সাথে একেবারে মিশিয়ে ফেললো তিহান।
সাথেসাথেই সম্পূর্ণ গায়ের ভার তার উপর ছেড়ে দিলো তোহা।এতক্ষনের ভয়টা নিমিষেই কেটে গেছে।তবে শক্তি পাচ্ছেনা।তিহান কে যে একটু জড়িয়ে ধরবে সেই উপায়টাও নেই।
তোহার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে জোরে জোরে শ্বাস নিলো তিহান।বুকের হাঁসফাঁসটা কমানোর চেষ্টা করলো।তবে সফল হলোনা।আর একটু হলে সে নিজেই জ্ঞান হারাতো ভয়ে।তূর্য ততক্ষনে ফেনের ফ্ল্যাশলাইট সমেত পুকুরের সিঁড়ি ধরে অর্ধেক নেমে গেছে।তিহানকে উদ্দেশ্য করে সে গলা বাড়িয়ে ডাকছে,
—“তিহান ভাই,আমি আসবো?”

—“না,তুই দাড়া ওখানেই।আমি পারবো।আসতেছি।”বলে তোহাকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিলো তিহান।তোহার চোখ বন্ধ।তবে জ্ঞান হারায়নি।

—“দয়া করে জ্ঞান হারাবানা।আমার কিন্তু ভয় করছে খুব।”তিহানের কাঁপা কন্ঠের বাচ্চাসূলভ আবদারে মলিনভাবে হাসলো তোহা।
তাকে নিয়ে পাড়ে উঠে মাটির উপরই বসে পরেছে তিহান।তোহার মাথা তার বুকে।তূর্য আস্তে আস্তে হাত বুলাচ্ছে বোনের মাথায়।চুপচুপে ভেজা জামায় শরীরের অবয়ব স্পষ্ট।গায়ের ওড়না এখনো পুকুরেই ভাসছে।তাড়াহুড়োয় সেটা আর আনা হয়নি।

—“কথা বলছেনা কেনো?অজ্ঞান হয়ে গেছে?”তোহার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো তূর্য।

তোহার ভেজা চুলগুলো কানের পিছের দিকে গুঁজে দিয়ে তিহান মৃদু গলায় উওর দিলো,
—“নাহ,জ্ঞান আছে।খুব ভয় পেয়েছে হয়তো।”বলেই চোখজোড়া বোজল তিহান।
এই সন্ধ্যাবেলা এমন একটা ভয়ংকর কাজ ঘটে যাবে বুঝতেই পারেনি সে।মেয়েটা কখন উঠে গেছে খেয়ালই করেনি।করলে হয়তো এমন হতোনা।
এরইমাঝে ছুটে এলো বাড়ির সবাই।এদিকের লাইট জ্বলে উঠতেই তোহাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দুহাতে লুকিয়ে আগলে ধরলো তিহান।আতিয়া কান্না করছে ফুঁপিয়ে।
তিহান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে তাকে সান্তনা দিয়ে বললো,
—“তিহু ঠি ক আছে খালামনি।কেঁদোনা।ও আরো ভয় পেয়ে যাবে।”

আরমান সাহেব এগিয়ে আসলেন।আতিয়া ধরে উঠিয়ে মেয়ের মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে তিহানকে বললেন,
—“ওকে একটু ঘরে নিয়ে যেতে পারবে তিহান?দুজনেই তো ভিজে গেছো।”

তিহান মাথা ঝুকালো।ভদ্রতার সহিত নম্র কন্ঠে বললো,
—“জি খালু,নিয়ে যাচ্ছি।আপনি খালামনিকে ভিতরে নিয়ে যান।আমরা আসছি।”

আরমান সাহেব মৃদু হেসে আতিয়া নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন।তার স্ত্রী অল্পতেই অস্থির হয়ে উঠে।প্রেশার বেরে যায়।
তারা ভেতরে চলে যেতেই আফিয়ার দিকে চোখের ইশারায় কিছু একটা বললো তিহান।ছেলের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে আশেপাশে তাকালো আফিয়া।স্বর্ণাকে দিয়ে হলরুমের সোফা থেকে তার গায়ের শালটা আনিয়ে তোহার গায়ে জড়িয়ে দিলো।
তিহান মুচকি হেসে তোহাকে কোলে নিতে গেলেই তোহা আধো আধো স্বরে বললো,
—“আমি পারবো।”

দাঁতে দাঁতে চেপে অগ্নিচোখে তাকালো তিহান।শুধুমাত্র দূর্বল হয়ে পরেছে বলে তোহাকে কিছু বলেনি এতক্ষণ।নতুবা একা একা এখানে আসার অপরাধে তার আগেই একে দু-চারটা চড় লাগানো উচিত ছিলো।
তথাপি তোহার কথাটা দাম না দিয়ে তাকে কোলে তুলে নিলে তোহা আবারো কিছু বলতে গেলেই সে রাগে কটমট করে বললো,
—“একদম চুপ”।

মুখটা চুপসে গেলো তোহার।ঠোঁটজোড়াও আপনাআপনিই বন্ধ হয়ে গেলো।
তিহান তাকে কোলে করে নিয়েই রুমে ঢুকলো।তখন শুধু আফিয়া আর স্বর্ণালি আছে রুমে।স্বর্ণালি তোহার জামাকাপড় বের করছে আর আফিয়া গ্লাসে পানি ঢালছে।তিহানের নিজের জামাকাপড়ও ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে।ফোনটা ছিলো পকেটে সেটাও হয়তো গেছে নষ্ট হয়ে।
কিছু করার নেই,সেই মূহুর্তে তো আর ফোনের কথা মনে ছিলোনা তার।তপ্ত একটা নি:শ্বাস ছাড়লো তিহান।
তোহাকে শুইয়ে দিতে দিতে হাল্কা ঠোঁট নাড়িয়ে বললো,
—“এভাবে নাম ধরে ডাকলে..রোজ রোজ পুকুরে পরে গেলেও কিছু বলবোনা,প্রমিস!”।
_____________
রাতের খাবার খাচ্ছে তোহা।খাচ্ছে বলতে তাকে খাইয়ে দেয়া হচ্ছে।আতিয়ার হাতে খাচ্ছে সে।একবারো তাকে বের হতে দেয়া হয়নি রুম থেকে।পায়ের কাছটায় বসে আছে তিহান।অন্যকেউ নেই রুমে।আতিয়ার কড়া বকার উপর আছে সে।তবে সে নিজেও জানে সে বকা খাওয়ার মতো কাজই করেছে আজ।দু-একটা থাপ্পড় যে এখনো গালে পরেনি এইতো ঢের বেশি।তবে আতিয়া ছাড়া আর কেউ কিছু বলতে এলেই তাকে ভদ্রতার সহিত থামিয়ে দিচ্ছে তিহান।ফলস্বরূপ তিহান আর আতিয়া ছাড়া আর কারো বকার শিকার এখন অবধি হতে হয়নি।
যদিও তিহানের সাথে লজ্জায় চোখ মেলাতে পারছেনা তোহা।বয়সে তার থেকে এত বড় মানুষটাকে নাম ধরে কিভাবে ডেকে ফেললো?ইশ!”আপনি” করেই তো বলে সবসময়।আজকে কিভাবে যেনো শুধু নামটাই বেরিয়ে গেছে।

—“সামান্য মন খারাপ ছিলো বলে তুই এই ভর সন্ধ্যাবেলা পুকুর পাড়ে যাবি তোহা?”

তোহা উওর দিলোনা।চুপচাপ ভাত চিবাতে লাগলো।মাকে এ ব্যাপারে নিজের পক্ষ নিয়ে আর কিছু না বলাই শ্রেয়।কখন যেন দ্বিগুন রেগে যায়।

—“আর তোমার মেয়েকে হুদাই এতো কষ্ট করে টাকা খরচ করে সাঁতার শিখিয়েছিলাম আমি খালামনি?কি লাভ হলো বলোতো?”ফুঁসে উঠে বললো তিহান।আতিয়াও সাঁয় দিলো তার কথায়।

তোহা অপরাধীর মতো মাথা নুইয়ে আস্তে করে বললো,
—“আমি সত্যিই পারছিলাম না তিহান ভাই।পানি ছিলো অনেক।”।তিহান ঠোঁট চেপে তাকাল।একটা কারণে অবশ্য নিজের উপরই রাগ লাগছে।তবে আতিয়া সামনে আছে দেখে সে বিষয়ে কিছু বলছেনা।

খানিকবাদে আতিয়া ভাতটা খাইয়ে দিয়ে প্লেট রাখার জন্য বেরিয়ে যেতেই তিহান উঠে তোহাকে পানি খাইয়ে দিলো।নিজের হাতে ভেজা ঠোঁটের চারপাশ মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,

—“তোমার মন খারাপ থাকবে কেনো?এই আমিটা আছি কি করতে?তোমার মনই যদি ভালো না রাখতে পারি তবে কিভাবে নিজেকে প্রেমিক দাবি করি বলোতো?এতো ঘোর অন্যায়”।

~চলবে~

[কোনোক্রমেই কার্টেসী ছাড়া কপি করবেন না]
[লেখা হয়েছে আরো আগেই।কারেন্ট ছিলোনা তাই দিতে দেরি হলো।]
~চলবে~

[কোনোক্রমেই কার্টেসী ছাড়া কপি করবেন না।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here