কোন_এক_শ্রাবণে❤ পর্ব ৩৩+৩৪

#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩৩

ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে।রাতের ঠান্ডা প্রকৃতি ছড়িয়ে দিচ্ছে ঘুমের আবির্ভাব।রাস্তার ওপারের সারিবেঁধে দাড়িয়ে থাকা নারিকেল গাছগুলো এঁকেবেঁকে শরীর দুলিয়ে যাচ্ছে।মাঝেমধ্য থেমে যাচ্ছে তারপর হঠাৎ হঠাৎ আবারো দুলতে শুরু করছে।আকাশে মিটমিট করে জ্বলছে অগণিত তারকারাজি।পূর্ণিমা চাঁদের আলোর ঝলকানিতে পুরো উঠোন-বারান্দা আলোকিত।
বারান্দার রেলিংয়ে দুহাত রেখে চোখ বুজে স্নিগ্ধ সময়টা উপভোগ করছে তোহা।তবে কেনো যেনো এই নির্মল প্রকৃতিও কোনোক্রমেই তার মন ছুঁতে পারছেনা।তার এই মনটা খুব একরোখা স্বভাবের।সেই যে একটা মানুষের কাছে পরে আছে তো পরেই আছে।তাকে ছাড়া কিছুই আর ভালোলাগেনা।

ঘড়ির কাঁটা প্রায় বারোর ঘরে ছুঁইছুঁই।গ্রাম্য এলাকায় এই সময়টা গভীর থেকেও গভীর রাত।আশেপাশে একটা কাকপক্ষীও চেঁচাচ্ছেনা।সেই সন্ধ্যা থেকে ঘরে কোনঠাসা হয়ে বসে থাকতে থাকতে আর সহ্য হচ্ছিলো না তোহার।বের হয়ে একটু প্রাণভরে শ্বাস নেয়ার জন্য আঁকুপাঁকু করছিলো ছোট্ট মনটা।তাই স্বর্ণালি ঘুমিয়ে পরতেই ধীরপায়ে কোনরকম শব্দ ছাড়া বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাড়িয়েছে সে।
চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বুঝতে পারছে কেউ একজন তার পাশে এসে দাড়িয়েছে।না দেখা পর্যন্ত সে ভেবেই ফেলেছিলো পাশে তিহান আছে।কিন্তু..কেনো যেনো তিহানের গায়ের চিরচেনা গন্ধটা সে পাচ্ছেনা।
পাশের মানুষটার হাল্কা কাশির শব্দে চমকে চোখ মেললো তোহা।চকিতে পাশে তাকাতেই দ্বিগুণ চমকে উঠলো সে।পাশে তার বাবা দাড়িয়ে আছেন।এই সময়ে একেবারেই অনাকাঙ্খিত মানুষটাকে দেখে প্রবল অসস্তি
জাঁপটে ধরলো তোহাকে।মাথায় ওড়নাটা আরো একটু সামনে টেনে নিয়ে সে মৃদু কন্ঠে বললো,
—“আব্বু,তুমি এখানে?”

আরমান সাহেব হাসলেন।মেয়ের কাঁপা কাঁপা কন্ঠ শুনেই তার ভেতরের ভয়টা টের পেয়ে গিয়েছেন তিনি।এতো স্নেহের সহিত কথা বলার পরও তোহা কেনো তাকে এত ভয় পায় কিছুতেই বুঝে আসেনা।তোহার দৃষ্টি নিচে মেঝের দিকে।কেমন একটা অপরাধীর মতো দাড়িয়ে আছে সে।যেন রাত বিরেতে এখানে দাড়িয়ে থাকা একটা অন্যায় আর আরমান সাহেব তাকে হাতনাতে ধরে ফেলেছেন।

আরমান সাহেব ঘুরে রেলিংয়ে হাত রাখলেন।পরিবেশটা একটু সহজ করার জন্য নরম কন্ঠে বললেন,

—“চোখ বন্ধ করে কি ভাবছিলে?”

তোহা যেন আরো একটু লজ্জায় পরে গেলো।কি উওর দিবে?সে তিহানের কথা ভাবছিলো?এটাকি আর বলা যায় নাকি।তথাপি একটু মুচরে গেলো সে।আরো একটু গুটিয়ে দাড়িয়ে আঁটসাঁট স্বরে উওর দিলো,
—“কিছু ভাবছিলামনা আব্বু।”

আরমান সাহেব হতাশ শ্বাস ছাড়লেন।তার প্রতি মেয়ের এই ভয় হয়তো জীবনেও কাটাতে পারবেন না তিনি।বস্তুত তিনি এখানে এসেছেন তোহার সাথে কিছু জরুরি কথা বলতে।কথাগুলো জানা তার খুব দরকার।নয়তো কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না।
কিছুক্ষন নিরবতায় কাটলো।আরমান সাহেব গলা ঝেড়ে নিরবতা ভাঙলেন।বললেন,

—“দেখো মা,আমি তোমার বাবা।যথেষ্ট আদর স্নেহ দিয়ে তোমাদের তিন ভাই-বোনকে বড় করেছি।তুমি সবচেয়ে ছোট।আর সবচেয়ে আদরের।আমার কাছে ভয়ের কিছু নেই।বুঝতে পেরেছো?”

তোহা উপরনিচে মাথা নাড়ালেও ভয়টা এতক্ষণে দ্বিগুন হয়েছে তার।একটু পরে হয়তো তিনগুন চারগুণ অবধি ছাড়িয়ে যাবে।
আরমান সাহেব একটু সময় নিয়ে বললেন,
—“তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা ছিলো।”

—“বলো আব্বু।”বিনীত গলায় উওর দিলো তোহা।তবে এবারো বোধহয় না চাইতেও তার কন্ঠটা একটু কেঁপে গেছে।

—“তোমার অভিভাবক হলেও জোরপূর্বক তোমার উপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার অধিকার আমার নেই।আমি কখনোই চাইনা আমার কোনো সিদ্ধান্ত তোমার উপর বোঝা হোক।আবার এটাও কথা যে তোমার কোনো ভুল সিদ্ধান্ত আমি সমর্থন করবোনা।তাইনা?”

তোহাকে এবার একটু বিচলিত দেখালো।বাবার কথার মানে গুলো তার মাথায় ঢুকছেনা কোনোভাবেই।এই রাতের বেলা বাবা এসব কেনো বলছে তার অর্থোদ্ধার করা মোটেই সম্ভব হচ্ছেনা।ক্ষণে ক্ষণে পরিবেশটা আরো ভারি লাগছে।

—“তুমি এসব কেনো বলছো আব্বু?কোনো কারণ আছে?”

আরমান সাহেব আর দেরি করলেন না।কোনোরকম অসস্তি ছাড়াই তোহাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন,
—“তুমি কি তিহানকে পছন্দ করো?”

প্রশ্নটা শুনতেই যেনো কয়েকসেকেন্ড থম মেরে থাকলো তোহা।অত:পর বজ্রহতের ন্যায় একপলক তাকিয়ে মাথা নামিয়ে ফেললো।গলা শুকিয়ে কাঠ।বাবার মুখ থেকে সরাসরি এমন একটা কথা শোনার পর তার কেমন প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত?তার কি লজ্জা পেয়ে চলে যাওয়া উচিত?নাকি বাবাকে উওর দেয়া উচিত?
বুঝতে পারছেনা।গলার কথাগুলো কেমন জটলা পাঁকিয়ে যাচ্ছে।

—“লজ্জার কিছু নেই মা,নিশ্চিন্তে বলো।”

তোহা বলতে পারলোনা।নিরব হয়ে গুমড়ে রইলো।কেনো সে বলতে পারছেনা কিছু?কেন মনে হচ্ছে সে মুখ খুললেই অনর্থ হয়ে যাবে।উল্টাপাল্টা বকে ফেলবে।

মেয়ের নিরবতা দেখে কিছুক্ষন চুপ রইলেন আরমান সাহেব।অত:পর মাথা ঝুকিয়ে নিজের হাতে তালু পর্যবেক্ষণ করতে করতে বললেন,
—“তবে কি আমি উওরটা “হ্যাঁ” ধরে নিবো?”

এবার আর চুপচাপ থাকতে পারলোনা তোহা।এখনও চুপ থাকলে”তিহান”নামক প্রেমিকটার সাথে বড্ড বেশি অন্যায় হয়ে যাবে যে!এই অন্যায় সে করতে পারবেনা।কখনোই না।
উপরন্তু মুখে কিছু বলতে না পেরে মৃদুভাবে মাথা নাড়ালো তোহা।লজ্জার রক্তিম আভা তার মুখের আনাচে কানাচে।
আরমান সাহেব ঠোঁট এলিয়ে হাসলেন।যেনো বুকের কোনো একটা পাথর নেমে গেলো নিমিষেই।তোহাকে ঘুমাতে যেতে বলতেই একছুটে জায়গা প্রস্থান করলো তোহা।আরমান সাহেব আরো কিছুক্ষন নির্নিমেষ চেয়ে রইলেন কালো আকাশের পানে।
_________________
পরেরদিনটা বেশ স্বাভাবিকভাবেই কাটছিলো তোহার।দুপুরের দিকে তারা কাজিনরা ঘুরতে বেরিয়েছিলো।তিহানের ফোন গেছে নষ্ট হয়ে।অনেক ঘুরে টুরে গ্রাম পেরিয়ে বড় মার্কেট থেকে একটা ফোন কিনে এনেছে।সেই
সাথে তোহার জন্য ছিলো একঝাঁক বকা।মূলত তারজন্যই তিহানের ফোনটা নষ্ট হয়েছে।তোহা কিছু বলেনি অবশ্য।বিকেল পর্যন্ত সব ঠি কঠাকই ছিলো তবে একটা বড় ঘটনা ঘটে গেলো বিকেলের পরপরই।

ঘুরে-টুরে বাসায় ফিরে সে যখন হাত মুখ ধুয়ে একটু ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।তখনই আতিয়া সহাস্য মুখে তার রুমে প্রবেশ করে বললেন,
—“তোহা,তোকে ডাকছে।নিচে আয়।”

—“কে ডাকছে আম্মু?যেয়ে বলো আমি ঘুমাচ্ছি।”বিরক্তি সমেত উওর দিলো তোহা।উওর দিয়েই শুতে উদ্যত হতেই আতিয়া জোর গলায় বললো,

—“তোর বাবা ডাকছে।আয় জলদি।”

বাবার কথা শুনে একটু থমকালো তোহা।বাবার বলা কালরাতের কথাগুলো ভাসছে কানের কাছে।বাবা কেন তাকে নিচে ডাকছে?নিচে হয়তো সবাই আছে।সবার সামনে তাকে জরুরি তলব করার কারণটা কি?আচানক একটা ভয় ঢুকে গেলো তোহার মনে।তবুও যথেষ্ট স্বাভাবিক কন্ঠে সে উওর দিলো,
—“আচ্ছা আসছি।যাও তুমি।”
____________
হলরুমের সোফায় বসে আছে বাসার প্রতিটি সদস্য।কেমন একটা খুশি খুশি আমেজ সর্বত্র।তোহার পরণে হাল্কা গোলাপী রংয়ের থ্রিপিস।মাথায় সাদা ওড়না।একেবারেই সাধারণ ছিমছাম ঘরোয়া পোশাক।
সে গিয়ে আরমান সাহেবের কাছে যেয়ে দাড়াতেই তাকে হাতের ইশারায় বসতে বললেন তিনি।
এদিক ওদিক তাকিয়ে চুপচাপ স্বর্ণালির পাশে বসে পরলো তোহা।সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো এখানে আসলে হচ্ছেটা কি।সবার মুখেই মিটিমিটি হাসি।সবাই যেভাবে চুপ করে সিঁড়ির দিকে চেয়ে আছে মনে হচ্ছে কারো জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে।তোহাও চুপচাপ বসে রইলো।তবে বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হলো না।মিনিট তিনেক বাদেই কালো ট্রাউজার আর কালো টি-শার্ট পরিহিত তিহানকে নামতে দেখা গেলো সিঁড়ি বেয়ে।তার মুখে চাপা গোছানো হাসি।

জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো তোহা।তিহান এগিয়ে কোনো কথা না বলেই তার পাশে বসতেই হুড়মুড়িয়ে একটু চেপে গেলো তোহা।লোকটা শুরুটা করেছে কি সবার সামনে?পুরুষ মানুষ বলে কি লজ্জার মাথা খেয়ে বসেছে?আশ্চর্য!
তবে তাকে যারপরনাই অবাক করে দিয়ে আরমান সাহেব উঠে তার পাশে এলেন।উঠলেন তিহানের বাবা আমজাদও।
তিহান হেসে ফেলেছে ততক্ষনে।তোহা আড়চোখে তাকালো।লোকটার মুখে গাঢ় হাসিটা একটু বেশিই মানিয়ে যায়।তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় খালি।নিজেকে সামলে চোখ নামালো তোহা।
আমজাদ সাহেব হেসে তিহানের হাতে একটা আংটি ধরিয়ে দিলেন।বললেন,”পরিয়ে দাও।”

মূহুর্তেই হতবুদ্ধি হয়ে পরলো তোহা।হতভম্ব ফ্যাকাশে চেহারায় শূন্য চোখে চেয়ে থাকলো।আচমকা এমন একটা ঘটনাটা বুঝে উঠে,মেনে নিতে বেশ বেগ পেতে হলো তাকে।যখন বুঝে উঠলো তখনই আশেপাশে তাকিয়ে ব্যস্ত চোখে তিহানের দিকে তাকালো সে।লোকটার মুখের ঝলমলে হাসিটাই বলে দিচ্ছে যা হচ্ছে সবই সত্য।বাস্তবিকই ঘটছে।কোন সপ্ন নয়।
মনে মনেই কিছুক্ষণ নিজের সাথে আমতা আমতা করলো তোহা।তার জীবনের এই অতি আকাঙ্খিত মূহুর্তটা যে এভাবে অনাকাঙ্খিত একটা সময়ে হুট করেই সত্যি হয়ে যাবে তা কখনো ভাবেইনি।

তিহান সেদিন আলতা পরানোর জন্য যেভাবে বলেছিলো ঠি ক সেভাবেই আজও নিজের হাত মেলে দিয়ে বললো,
—“হাতটা..”

এতক্ষণে তোহার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।মাথা ঝুঁকিয়ে ফেললো সে।কাঁপা হাতে আলতো করে তিহানের হাতের উপর হাতটা রাখতেই অনামিকা আঙ্গুলটা মূহুর্তেই জলজল করে উঠলো একটা স্বর্ণের সাদা পাথর বসানো আংটিতে।হাতের সাথে জলজল করে উঠলো তোহার চোখও।
তিহানের আংটি পরানো শেষ হতেই আরমান সাহেব তোহার দিকে একটা আংটি এগিয়ে দিলেন।তবে তোহাকে হাত মেলতে হলোনা।তিহান নিজেই হাত এগিয়ে দিলো।তিহানের হাত স্পর্শ করলোনা তোহা।দু আঙ্গুলে আংটিটা ধরে আস্তে করে তিহানের আঙ্গুলে পরিয়ে দিলো।আরো চওড়া হলো তিহানের ঠোঁটের হাসিটা।
তিহানের হাত সরানোর আগেই একফোঁটা নোনাজল টুপ করে গড়িয়ে পরলো সেই হাতের উপর।তিহান বললোনা কিছু।সে জানে মেয়েটা খুশিতে কাঁদছে।তার বারণ করার কোনো কারণ আজ আর অবশিষ্ট নেই।
#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩৪

আংটি পরানো শেষ হতেই মিষ্টিমুখ করলো সবাই।এদের কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে সবাই ই জানতো এংগেজমেন্টের বিষয়টা।শুধু তোহা ছাড়া।
তোহার অবস্থা তখন শোচনীয়।প্রচন্ড লজ্জায় চোখ তুলতে পারছেনা সে।কেমন একটা দমবন্ধকর পরিস্থিতি।এই সব যে এই পাশে বসা লোকটার কারসাজি তা বুঝতে একরত্তি অসুবিধা হলোনা।গতকাল রাতে বাবার কথাগুলো শুনে সে কিছুটা আন্দাজ অবশ্য করেছিলো।কিন্তু এত তাড়াতাড়ি “আকদ” হয়ে যাবে কস্মিককালেও ভাবনায় আসেনি।
নিজাম রহমানের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা হাসির ঝলকানিতে।লোকটার খুশি যেনো উপচে পরছে।

আফিয়ার পর তিহানের বাবা আমজাদ সাহেব তোহার মুখে একটু খানি মিষ্টি তুলে দিলেন।অপরহাত মাথায় বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
—“বিয়েটা হবে তোমার মাধ্যমিকের পরে।তিহান কিছুতেই তোমার পরীক্ষার আগে বিয়ের ঝামেলা চাচ্ছেনা।বুঝলে?”

তোহা তাকালোনা।হাল্কা মাথা নাড়ালো শুধু।এখনো কেউ তাকে এখান থেকে যেতে বলছেনা কেনো?ও আল্লাহ!

খানিক বাদেই তিহানের ইশারায় তোহাকে রুমে দিয়ে গেলো আফিয়া।সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার তাদের মধ্যেকার বিষয়টা নিয়ে কেও তাকে চেতাচ্ছেনা পর্যন্ত।নুহাশ,সাইফ,তূর্য এমনকি স্বর্ণালিও স্বাভাবিক।যেনো তাদের কড়া আদেশ দেয়া হয়েছে যাতে তোহাকে কোনরকম বিরক্ত না করা হয়,লজ্জা অসস্তিতে না ফেলা হয়।
_____________

বিছানার বামকাত হয়ে ফিরে শুয়ে আছে তোহা।চোখে ঘুমের ছিঁটেফোটাও নেই।ঘরের নীলরঙা ডিমলাইটের মৃদু আলোয় হাতের অনামিকা আঙ্গুলে জলজল করছে আংটিটা।হাতটা চোখের সামনে মেলে ধরে আংটিটার দিকে নিষ্পলক চেয়ে থেকে সেই বিশেষ মূহুর্তটা স্বতিচারণ করার চেষ্টা করছে সে।চোখের কোঁণে এখনও চিকচিক করছে আবেগী জ্বল।
এই আংটিটা আসলেই তিহান পরিয়ে দিয়েছে তাকে?হঠাৎ করেই কিভাবে তাদের সুপ্ত অপ্রকাশিত প্রণয়টা সবার কাছে প্রকাশ পেয়ে গেলো?শুধু প্রকাশ না একেবারে পূর্ণতা পাওয়ার প্রথম ধাপটাও পেরিয়ে ফেললো নিমিষেই।
জীবন কি এতই সহজ?সবকিছু কি এতটাই বাঁধাহীন?কারো জন্য হ্যাঁ।আবার কারো জন্য হয়তো “না”।
তবে এই লোকটা বোধহয় তার জীবনে কখনো বাঁধা-নিষেধ,চড়াই উতরাই সৃষ্টি হতে দিবে না।নিজের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেলেও প্রশস্ত বুকটার নিচে তাকে আগলে রাখবে সবসময়।
ফোনের ভাইব্রেশনের কাঁপুনিতে ভাবনার সুতো ছিঁড়লো তোহার।ভ্রু কুঁচকে বালিশের পাশ হাতরালো সে।ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রীনে “তিহান ভাই” নামটা চোখে পরতেই ভেতরটা একটু কেঁপে উঠলো বোধহয়।কিছুক্ষন রিং হতেই কেটে গেলো ফোনটা।ভাইব্রেশনের কাঁপুনিটা থেমে যেতেই সম্ভিৎ ফিরে পেলো তোহা।জিভে কামড় দিয়ে তৎক্ষনাত ধরফরিয়ে উঠে বসলো।সেকেন্ড পেরিয়ে যেতেই আবারো স্বউদ্যমে ফোনটা ভাইব্রেশনের হতে শুরু করলো।ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রিসিভ করলো তোহা।এখন নিশ্চিত একটা রামধমক খাবে।ফোন রিসিভ করে “সরি” বলার আগেই ওপাশ থেকে তিহান গুরুগম্ভীর শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,
—“বাইরে আসো।”

কয়েক মূহুর্ত নিশ্চুপ হয়ে রইলো তোহা।অত:পর গলা খাদে নামিয়ে মৃদুস্বরে বললো,
—“জি?”

ওপাশ থেকে তপ্ত নি:শ্বাসের আওয়াজ শোনা গেলো শুধু।তোহা পাল্টা কিছু বলার সাহস পেলোনা আর।ঘুমন্ত স্বর্ণালিকে একবার পরখ করে নিয়ে বিছানা নামতে নামতে মিনমিন করে বললো,
—“আসছি”।

সে “আসছি” বলতেই ফোনটা কেটে গেলো অপরপাশ থেকে।ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে ফোনটা বিছানায় রেখে এলোমেলো চুলগুলো হাতখোঁপা করে নিলো তোহা।মাথায় ওড়না চাপিয়ে নিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে এলো দরজা খুলে।

বারান্দায় তখন ঠান্ডা শীতল মনমাতানো বাতাস।বাতাসের প্রথম দমকা টা উষ্ম শরীর ছুঁয়ে যেতেই গায়ের লোমগুলো শিরশির করে দাড়িয়ে পরলো।এদিক ওদিক তাকিয়ে রেলিং ধরে আকাশের দিকে চেয়ে থাকা তিহানকে দেখতে পেলো তোহা।সুতির সাদা ওড়নাটা আষ্টেপিষ্টে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে তিহানের পাশে যেয়ে দাঁড়ালো।তার উপস্থিতি টের পেতেই ঘুরে দাড়ালো তিহান।ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে তোহার সারামুখে দৃষ্টি ঘুরালো বেশ অনেকক্ষন।তোহার নত দৃষ্টিতে একঝাঁক প্রশ্ন উপচে পরছে।এই রাতের বেলা ডেকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো লোকটা?শেষমেষ প্রশ্ন করার জন্য মুখ খুললো তোহা।বললো,

—“আপনি এতরাতে..”

—“তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো সেজন্য ডেকেছি।”তোহার প্রশ্ন শেষ হবার আগেই উওর দিলো তিহান।
তোহা একপলক তাকালো।মূহুর্তেই ঠোঁট চেপে ক্ষীণ হাসলো।তিহানের চোখ আটকে রইলো সেই হাসিতে।
“খট”করে একটা শব্দ হতেই চমকে উঠলো তোহা।তবে কি কেউ আসছে এদিকটায়?তাদের একসাথে দেখে ফেললে কি হবে?”
তোহার অস্থির দৃষ্টি দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো তিহান।
—“কেউ আসছেনা।বাতাসের ধাক্কায় হয়তো শব্দ হয়েছে কিছুতে।এত ভয় পাও কেনো?”

তোহার মধ্য কোন পরিবর্তন দেখা গেলোনা।সে ভীত দৃষ্টি বারান্দার ওপাশে চেয়ে রইলো।হাঁফ ছাড়লো তিহান।
তোহার হাত টেনে ধরে সামনে এগোতে নিলেই তোহা সন্দিহান কন্ঠে বলে উঠলো,
—“আবার কোথায় যাচ্ছেন?”

—“তুমি যে হারে ভয় পাচ্ছো।আমি একটু মন ভরে দেখার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে।”

—“আপনি মজা নিচ্ছেন?”

তিহান সরু চোখে তাকালো।তোহার কথাটা তোয়াক্কা না করে চুপচাপ ছাদের সিঁড়ি ধরে উপরে উঠতে লাগলো।
______________
ছাদভর্তি চাঁদের আলো।পাশের একটা ছোট্ট টব থেকে বেলি ফুলের তীব্র ঘ্রান নাকে এসে ঠেকছে।মাথা ঝিমঝিম করছো তোহার।তিহান দাড়িয়ে আছে মুখোমুখি।আংটি পরানো হাতের চার আঙ্গুলের অগ্রভাগ আলতো করে ধরে ঠোঁটের কোঁণে ক্ষীণ হাসি নিয়ে একদৃষ্টিতে দেখে চলেছে বিরতিহীন ভাবে।যেন সেখানেই তার গোটা জীবনের সব সুখ এসে ভর করেছে।
একপর্যায়ে ধৈর্যহারা হয়ে পরলো তোহা।বললো,

—“এতো কি দেখছেন?”

তিহান মুখ তুলে তাকালো।আবার মাথা নামিয়ে আংটিটায় বৃদ্ধাআঙ্গুল বুলিয়ে বললো,
—“সুন্দর লাগছে।তাইনা?”

তিহানের খেই হারানো কথাবার্তায় হেসে ফেললো তোহা।একটু পর হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে মুখের চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিয়ে হাসি থামিয়ে চিন্তিত কন্ঠে বললো,
—“আপনি কি এখন থেকে সবসময় “তুমি” করে ডাকবেন?”

তোহার বাহু ধরে কাছে টেনে নিলো তিহান।হাতের উল্টোপিঠ গালে ছুইয়ে দিয়ে ভ্রু উচিয়ে বললো,
—“ডাকা তো উচিত।আমার অধিকার আছে।”

তোহা উওর দিলোনা।তার মুখে চিন্তার প্রখর ছাপ স্পষ্ট।এই লোকের মাঝেমধ্য একান্তে ডাকা”তুমি” ডাকেই লজ্জায় শেষ হয়ে যায় সে আর সবসময় সবার সামনে ডাকলেতো আর চোখ মেলানোর অবকাশ থাকবেনা।

—“নাহ্ ডাকবোনা।বিয়ের পর ডাকবো।নয়তো আমার “তুমি” ডাকটায় অভ্যস্ত হয়ে যাবে তুমি।তখন “তুমি”ডাকার পরমূহুর্তেই তোমার লজ্জারাঙা আরক্তিম চেহারাটা আর দেখতে পাবোনা।তা কি হয় বলো?”

কেটে গেলো আরো কয়েকটি মাহেন্দ্রক্ষণ।তিহানের ধূসর রংয়ের সম্মোহিত দৃষ্টি তখন তোহার গভীর কালো চোখে।লোকটার মধ্য কোন সংকোচ নেই।

—“নিচে নামবেন না?অনেক রাত হয়ে গেছে।”আস্তে করে বললো তোহা।

তিহান সে প্রসঙ্গে কোন উওর দিলোনা।আচমকা তোহার বাম চোখের পাতায় আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিতেই চোখ বন্ধ করে ফেললো তোহা।চোখ বন্ধ অবস্থাতেই তাড়াহুড়ো করে বললো,”কি করছেন?”

আরো কিছুক্ষণ তোহার ঘন পাপড়িতে আঙ্গুল দিয়ে খেললো তিহান।প্রশ্ন করলো,
—“তুমি চোখে কাজল দাওনা কেনো?”

প্রশ্নটায় অপ্রস্তুত হয়ে পরলো তোহা।বাস্তবিকই সে আজপর্যন্ত কখনো চোখে কাজল দেয়নি।কেনো জানি কাজল লাগাতে ভয় লাগে।একবার অবশ্য চেষ্টা করেছিলো।কিন্তু পারেনি বরং হাত কেঁপে চোখে বাজেভাবে খোঁচা লেগে গিয়েছিলো।তারপর আর কখনো সাহস করেনি।আইলাইনার দিয়েই সবসময় কাজ চালিয়ে দিয়েছে।

—“আমি কাজল দিতে পারিনা।ছোটমুখে উওর দিলো তোহা।

তিহান হাসলো।তোহার একগালে হাত রেখে মোহনীয় স্নিগ্ধ ভারি পুরুশালী কন্ঠে বললো,
—“জানো,তোমাকে কাজল চোখে দেখার কত শখ আমার।তোমার কাজল দেয়া চোখের মায়ার মাত্রাটা ভেবেইতো আমার ভয় হচ্ছে।আচ্ছা,সেই চোখে একবার তাকালে আমি দৃষ্টি ফেরাতে পারবোতো”লাজুকলতা”?

তোহা লজ্জা পেলো।লোকটা নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে।এই রাত বিরেতে তার প্রেমিক মন আবারো জেগে উঠেছে।এই ভয়ংকর প্রেমিককে সে কি করে সামলাবে?তার যে অত স্বাধ্যি নেই।

তার ভাবনার মাঝেই তিহান একবুক আবদারমাখা ছেলেমানুষি স্বরে বললো,
—“আমি একদিন তোমাকে কাজল পরিয়ে দিব।ঠিকাছে?”

তোহা একমূহুর্ত দেরি না করে উওর দিলো,
—“আচ্ছা,দিয়েন।”

বাতাসের বেগ বেড়ে গেছে।গাছের পাতা নড়ার সাঁ সাঁ শব্দ হচ্ছে।একটা দমকা হাওয়ায় তোহার মাথার ঘোমটা পরে গেছে।খুলে গেছে খোঁপার চুল।তীব্র বাতাসে অগোছালো চুল সামলাতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে তোহাকে।কিছুতেই সবগুলো চুল হাতের মুঠোয় আনতো পারছেনা।
বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টা করে চুলগুলো খোঁপা করার পর গায়ের ওড়না ঠি ক করতেই তিহান এগিয়ে এলো।নিজেই ওড়নার আচঁল টেনে নিয়ে তোহার মাথায় পরিয়ে দিতে দিতে বললো,

—“তোমাকে ঘোমটায় মানায় খুব।”

~চলবে~

[বাসার ওয়াই-ফাই কানেকশন নিয়ে কি যে একটা ঝামেলায় আছি।সময় উল্টাপাল্টা হওয়ার জন্য দু:খিত।একটু পরে নেট চলবে কিনা জানিনা।তাই আগেভাগেই দিয়ে দিলাম]
~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here