গুমোট অনুভুতি পর্ব ৫

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৫

হৃদয় সিঁথির লাল সিঁদুরে অসমাপ্ত প্রেমকাব্য, চোখের দু ফোঁটা অশ্রু মিশ্রিত কাজল করে
রেখে দিলাম আমি হীনা তোমার ডায়েরির শেষ পাতায়…
(সংগ্রহীত)

লাইনগুলো মনে মনে আওড়াচ্ছে রুশি, ঠোঁটের কোনে একরাশ তাচ্ছিল্যের হাসি।কিচ্ছুক্ষণ পুর্বেই সায়ানের অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছে,কথা ঠিক হয়েছে সায়ান তাদের বাড়ি গিয়ে রুশির হাত চাইবে ওর বাবার কাছে তারপর ঘরোয়া ভাবে বিয়ে সম্পন্ন হবে। রুশি তাতে সম্মতি দিয়েছে। আসার সময় সায়ান নিজের ড্রাইভারকে দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার কথা বললেও রুশি না করে দিয়ে সোজা চলে এসেছে। মাত্র তিনবছরের সম্পর্কে এতো মায়া বাড়িয়ে কি লাভ! এই মায়া জিনিসটা বড্ড খারাপ। কারো মায়ায় একবার জড়িয়ে গেলে আর সেখান থেকে বেরুনো যায়না। তাইতো এতোগুলো দিন চলে যাওয়ার পরেও তাকে ভুলতে পারেনি। কিন্তু এটাও সত্যি যে তার ডায়রির পাতায় আর ওর বিচরণ নেই। না সেই মানুষটিকে ও ভালো বাসে নি আর না প্রেমে পড়েছে, শুধুমাত্র তার মায়া জড়িয়েছে, ভয়ংকরভাবে!

ও জানেনা জীবন কোন দিকে মোড় নিচ্ছে, কি হতে চলেছে কিছুই জানেনা। শুধু এতোটুকু আশা করতে পারে যে ওর সন্তান ওর মতো পরিস্থিতিতে পড়বে না। আর যাই বেঁচে থাকতে তার উপর একটুও আচড়ও আসতে দিবে না। সায়ান যেহেতু বলেছে ওর কেরিয়ার গড়ে দিবে তাই আর ওকে এটলিস্ট কারো পুশওভার হয়ে থাকতে হবে না!

রিক্সা এসে ওদের কলোনিতে থামতেই ও ভাড়া মিটিয়ে হাটা শুরু করলো বাসার দিকে।ঘড়িতে রাত প্রায় আটটা বাজে, আজকে ঘরে ঢুকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে সাথে পুরোনো সেই কথাগুলো! নিজেকে প্রস্তুত করেই ঘরে প্রবেশ করলো রুশি। আশায় ছিলো কিছু একটা ছুড়ে মারবে গায়ের উপর কিন্তু তেমন কিছুই হলো বরং পরিস্থিতি বড্ড শীতল। ওর বাবাই সোফায় চিন্তিত ভংগিতে বসে আছে, আর পালক মা বসে পান চিবুচ্ছে। পালক ভাই-বোন দুজনই উপস্থিত হয়তো ওকে কিছু একটা বলবে বলেই বসে আছে!

পালক মা পানের ফিকনি ফেলে ওর দিকে তাকালেন তারপর তামাটে দাঁতে হেসে বলে উঠলেন

“সেকি মা তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? এদিকে এসে বসো”

তার এরুপ তেল মিশ্রিত কথার সাথে কখনোই পরিচিত নয় রুশি তাই কিছুটা হচকিয়ে বলে উঠলো

“কোন কিছু কি দরকার?মানে কিছু করা লাগলে বলতে পারেন”

“নাহ তেমন কিছু নয় আসলে তোর জন্য একটা প্রস্তাব এসেছে তাই ভাবলাম তোর বিয়ের বয়স হয়েছে বসিয়ে রেখে তো লাভ নেই। সবাইকেই বিয়ে করতে হবে তাইনা?যতো তাড়াতাড়ি করবি তত সামলে নিতে পারবি”

রুশি এবার আসল কাহিনী বুঝতে পারলো,

“কিন্তু আম্মু নিহা আপু তো আমার থেকে বড় তাহলে তো তার আগে বিয়ে হওয়া উচিৎ। আমার মনে এই বিয়েটা নিহা আপু করলেই ভালো হবে”

“সেকি বলিস নিহা করবে মানে?”

উনি চেঁচিয়েয় কথাটা বলে উঠলেন তারপর কিছুটা সামলে বললেন

“নিহাতো এখনো পড়াশুনা করছে ও এখন বিয়ে করে কি করবে?”

“আমিও তো পড়াশুনা করছি আম্মু!তাছাড়া আমার আগে বিয়ে হয়ে গেলে নিহা আপির সমস্যা হবে। তুমি বরং নিহা আপিকে বিয়েটা করতে বলো।আমি এখন বিয়ে করতে চাইনা”

কথাটা শুনেই নাহার বেগম যেনো তেলে বেগুনে জলে উঠলো

“আমার মেয়ে কোন দুঃখে ওই পঁয়ত্রিশ বছরের বুড়োকে বিয়ে করবে?ওকে জেনে শুনে আমি সেখানে দিবো নাকি?”

রুশির বাবাই তখন কিছুটা শক্ত কন্ঠে বললেন

“তাহলে রুশিকে কেনো দিবে,রুশি কি তোমার মেয়ে নয়?”

“শোন ও তোমার মেয়ে হতে পারে কিন্তু আমার নয়। এই আপদ আর কতকাল ঘাড়ে রাখবো?আর ভাসিয়ে তো দিচ্ছিনা বরং সসম্মানে বিয়ে দিচ্ছি। আর তুমি শুনো এই যে এতোকাল আমার খেয়েছো পরেছো তাই আমাদের এই ঋণ পরিশোধের কথা ভেবেও তুমি বিয়েটা করে নাও বুঝেছো!আর আমার শেষ কথা বিয়েটা হচ্ছে”

শেষের কথাটা স্বামীকে শুনিয়ে কিছুটা জোরেই বললেন,এই পালক মেয়ের প্রতি তার স্বামীর আদিক্ষেতা কোন কালেই সহ্য হয়না তার। সেই তেরো বছর পুর্বে একটা আশ্রম থেকে মেয়েটিকে নিয়ে চলে এসেছিলো তার স্বামী। কেন এনেছে জিজ্ঞেস করতেই বলে

“আশ্রমে সমস্যা হয়েছে, বিশাল আগুনে ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে তাই সব বাচ্চাদের বিভিন্ন ফেমিলিতে দিয়ে দিচ্ছে। এই মেয়েটিকে দেখে খুব মায়া হয়েছে ওর তাই নিয়ে এসেছে। ওরা যেভাবে থাকে মেয়েটিও নাহয় সেভাবে থাকবে”

কিন্তু এই সহজ কথাই হজম হলোনা তার,নিজের ছেলে মেয়েকে চালাতেই হিমশিম খায় তারউপর নতুন আরেকজন জুটেছে তবে সেটা মুখে প্রকাশ করেনি। নিজের কাজে সাহায্য করার একজনের দরকার ছিলো তাই আর আপত্তি করেনি। কিন্তু সমস্যা তখন থেকে শুরু হয়েছে যখন থেকে আশেপাশের মানুষ এইটুকুন মেয়ের রুপের আর গুনের প্রশংসা শুরু করলো। আর এখনতো ভালো ভালো ঘর থেকে প্রস্তাব আসে এই মেয়ের যা দেখে নাহারের পিত্তি জলে উঠে। নিজের মেয়ের বিয়ে নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত তিনি তাইতো আগেই একে বিদায় করতে চায়। ছেলের বয়স একটু বেশি হলে কি হবে?ছেলে সরকারি চাকরি করে ওখানে গেলে এই মেয়েতো সুখেই থাকবে। আর যাইহোক গাংগে ভাসিয়ে দিচ্ছেনা তো!

নাহার বেগমের চোখের ভাষা হয়তো রুশি কিছুটা বুঝতে পেরেছে তাই কিছু না বলে রুমে চলে গেলো। এখানে দাঁড়িয়ে আরো কিছু কথা শুনার ইচ্ছে নেই। আর তাছাড়া নিহাল মানে ওর পালক ভাইয়ের চাহনি সহ্য হচ্ছে না ওর। এই লোকটিকে ও একমুহুর্তও সহ্য করতে পারে না, সম্পর্কে নিজের বোন হয় এমন মেয়ের এরুপ আচরণ?পালক হোক আর যাই হোক বোনতো বোনই হয় তাইনা!

_______________________

সায়ান সবে মাত্র অফিস থেকে ফিরেছে, টাইটা খুলে সোফায় চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিলো। হঠাৎ কেয়ারটেকার এসে বললো

“স্যার চন্দ্রিকা মেডাম এসেছে!আপনার জন্য ওয়েট করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে”

সায়ান হুট করে চোখ খুলে ফেললো, মনের ভেতর অজানা ভয় খেলে গেলো, তাহলে কি ও কিছু জেনে গেছে?কিন্তু সেটাতো সম্ভব নয়। সায়ান দ্রুত পায়ে রুমের দিকে এগুলো আর বিছানায় একজন নারীকে শুয়ে থাকতে দেখলো, বয়স আনুমানিক বিশ বছরের কাছাকাছি। চেহারায় অসম্ভব মায়া আর টানা টানা সেই চোখ দুটো যে কাউকে প্রেমে পড়তে বাধ্য করবে। এই মেয়েটাকে সায়ান ভালোবাসে যে কিনা একসময় ওর জীবন বাচিয়েছে, আজ ও না থাকলে হয়তো ও বেচে থাকতো আর সায়ান জামিল খান হতো না।তাইতো তার কাছে ও ওয়াদাবদ্ধ! সারাজীবন ভালোবাসার ওয়াদাবদ্ধ যে স্থান অন্যকাউকে দিবে না বলে প্রমিস করেছিলো কোন এক কালে। তাইতো রুশানি নামের মেয়েটিকে মেনে নেয়া সম্ভব নয়, নয়তো আর যাইহোক মেয়েটিকে ছেড়ে দিতো না কখনোই।

সায়ান দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বারান্দায় গিয়ে বসলো, ওর সাথে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। একসাথে দুটো মেয়ের জীবন নিয়ে খেলছে ও। একজনকে ও ভালোবাসে আর অন্যজন ওর বাচ্চার মা হতে চলেছে। আর দুইজনকেই ঠকাচ্ছে ও কিন্তু কাউকেই ফেলতে পারছেনা। সায়ান মাথার চুল টেনে ধরলো শক্ত করে,অপরাধবোধ ওকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।বারবার ভয় হচ্ছে যদি চন্দ্রি কখনো জানতে পারে আমি ওর অজান্তে এতোবড় অপরাধ করে ফেলেছি ওকি আমার ক্ষমা করবে?হয়তো করবে না কারণ কোন নারীই তার সবচেয়ে মুল্যবান মানুষকে কারো সাথে শেয়ার করতে পারে না সেখানে চন্দ্রি কি করে করবে??আর ওই মেয়েটা! ওরও তো কোন দোষ নেই, ওর জন্য শুধুমাত্র ওর জন্য ওই মেয়েটার জীবন আজ এই মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে!

ফোনের আওয়াজে ধ্যান ভাঙল সায়ানের, রিসিভ করে কানে দিতেই ওপাশ থেকে সাহিল বলে উঠলো

“বস! ওই মেয়েটাকে কাল দেখতে আসবে।আজ বিকালে মেয়েটির পালক এটা নিয়েই প্রতিবেশির সাথে আলোচনা করেছেন।আর সম্ভবত কালই কাবিন হয়ে যেতে পারে। কি করবেন এখন?”

“তুমি সবকিছু রেডি করো, আমরা কাল ছেলেপক্ষ যাওয়ার আগে সেখানে যাবো আর যে করেই হোক ওকে বিয়ে করে একবারে নিয়ে আসবো।আর যাইহোক হাত গুটিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না”

সায়ান ফোন রেখে দিলো,ওই মেয়েটিকে যা প্রমিস করেছে তার সবকটা পুরণ করবে ও। তখনি মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসে

“কার বিয়ের কথা বলছো সায়ান?”

পেছনে চন্দ্রিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সায়ান দাঁড়িয়ে গেলো, তবে কি সব শুনে ফেলেছে?এখন কি করবে ও!

#চলবে

(ছোট করে দেওয়ার জন্য স্যরি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here