গুমোট অনুভুতি পর্ব ৫১+৫২

গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৫১

হসপিটালের ছোট্ট কেবিনে ছোট্ট একটা পরিবারের বসবাস, বাবা-মা আর সাথে থাকে ছোট্ট রাজকন্যা! হসপিটালের কেবিনে প্রয়োজনীয় সকল কিছু রয়েছে, মোটকথা একটা পরিবার থাকতে যা যা প্রয়োজন। ছোট্ট মেয়েটি বর্তমানে কান্না করছে আর তার বাবা কিছুতেই তাকে চুপ করাতে পারছে না। অন্যদিন কান্না না থাকলে মায়ের কাছে নিলেই থেমে যায় কিন্তু আজ কিছুতেই যেনো কিছু হচ্ছে না! অনেকক্ষণ চেষ্টার পর বাবাটি বুঝতে পারলো বাচ্চার ডায়পার্ড চেঞ্জ করতে হবে, আর এইজন্যই বাচ্চাটি কান্না করছে! বাবা অসহায় চোখে বাচ্চার দিকে তাকালো! এই ডায়পার্ড চেঞ্জ করা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাগজগুলোর একটি, ডায়পার্ড যদিও খুলে ফেলা যায় তবে নতুন করে পরাতে কি মেয়ের সাথে একদফা যুদ্ধ হয়ে যায় বাবার। আজোও তার ব্যাতিক্রম কিছু নয়,বাবা এই পরিস্থিতিতে পড়লেই তার স্ত্রীর দিকে তাকায় আর ভাবে নিশ্চই সে তাকে এই অবস্থায় দেখে বেশ মজা পাচ্ছে!তাইতো আজ আড়াই মাস ধরে এই কাহিনী দেখেও তার দয়া হচ্ছে না আর উঠছেও না সে।

সায়ান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে নিজের মেয়েকে শান্ত করতে লাগলো,মেয়েটির নাম এখনো ঠিক করা হয়নি কিন্তু সায়ান আদর করে পাখি বলে ডাকে,ওর পরীর পাখি!সায়ান উপর দিয়ে বেশ শক্ত, নিজের মেয়েকে একাই বড় করছে। কোম্পানিও সামলাচ্ছে যদিও সাহিলের সহযোগীতায় এটা সম্ভব হচ্ছে, সাহিলের মতো বিশ্বস্ত লোক এযুগে পাওয়া যায় না! আর সবচেয়ে বড় কথা নিজেকে সামলাচ্ছে ও, নিজের সাথে প্রতিনিয়ত কিভাবে লড়ছে তা নিজেই জানে! প্রতিমুহুর্তে মনে করে নিজেকে এটা মনে করিয়ে দেয় যে ‘সায়ান ইউ আর অলরাইট!’
কিন্তু আসলেই কি ও ঠিক আছে?প্রতিনিয়ত ওর হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা কি করে দেখাবে সবাইকে?পাখি ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ওকে আলতো করে দোলনায় শুইয়ে দিলো তারপর রুশির সামনে এসে বসলো।

আজ প্রায় আড়াইমাস ধরে রুশির এভাবে শুয়ে আছে, কোন সাড়াশব্দ নেই!চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে থাকার পরও সায়ানের ওকে ভালো লাগছে। ডাক্তার বলেছে যদিও রুশি ভেজিটেবল অবস্থায় আছে কিন্তু ও সবকিছু শুনতে পায় কারণ ওর বাঁচার তীব্র ইচ্ছে আছে! আর রুশি খুব দ্রুত রিকোভার করছে তারমানে রুশির জ্ঞান খুব দ্রুত ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে আর রুশির মৃত্যুর কোন আশংকা নেই। তবে স্মৃতি ফিরবে কিনা তার কোন গেরান্টি দিতে পারছে না, না ফেরার সম্ভাবনা বেশি!সায়ানের কাছে রুশির শ্বাস চলছে এতোটুকু খবরই অনেক,রুশি যদি ওকে ভুলে যায় তবে ও খুব কষ্ট পাবে ঠিক আছে কিন্তু ও রুশিকে আবার ভালোবাসতে বাধ্য করবে, এই দুনিয়ায় রুশি শুধুমাত্র তার। সেটা রুশি চাইলেও, না চাইলেও!

সায়ান রুশির হাতের পিঠে আলতো করে চুমু খেলো তারপর বললো

“আমি তোমার জন্য ওয়েট করছি মিসেস খান!আর কতো চুপ করে থাকবে?এবার তো উঠো! আমি পুরো দুনিয়ার কাছে শক্তিশালী হলেও আমি ভেতরে ভেতরে কত দুর্বল হয়ে পড়ছি তা শুধু আমি জানি। এই আমিকে সামলানোর জন্য তুমি নামক নারীর বড্ড প্রয়োজন!তুমি প্লিজ তাড়াতাড়ি উঠো, আমি আর আমাদের মেয়ে তোমার কন্ঠ শোনার জন্য অধীর আগ্রহে আছি। আমাদের বেবির জন্য হলেও প্লিজ কাম ব্যাক!”

সায়ান ওই অবস্থায় হাত রেখে ঘুমিয়ে পড়লো, প্রতিদিন এভাবেই ঘুমিয়ে পড়ে ও। আর সকালে ঘাড়ের ব্যাথায় কাবু হয়ে যায় কিন্তু তবুও পরম এক শান্তি পায়। রুশি আজ আড়াই মাস ধরে হাসপাতালে আছে বলে এই স্থানই এখন ওর বাড়ি হয়ে গেছে!রুশির কাছে অন্যরা এসে থাকতে চাইলেও সায়ান সম্পুর্ণ না করে দিয়েছে, কড়া কন্ঠে বলেছে ওর বউয়ের জন্য ও একাই যথেষ্ট। মাঝেমাঝে পাখির স্বাস্থ্যের জন্য বাইরের পার্ক থেকে ঘুরে আসে, প্রতি উইক্যান্ডে সায়ানের পরিবার ওদের সাথে এসে দেখা করে যায় তারপর চলে যায়।

মেয়েকে খুব সুন্দর করে ড্রেস পরিয়ে খাইয়ে বেরিয়ে পড়লো সায়ান,মেয়েটি বড্ড শান্তশিষ্ট ওর। প্রয়োজন ছাড়া কান্না করেনা, আবার রাতও জাগেনা। হয়তো বুঝে বাবার কষ্ট তাই তাকে জালাতন করে না!পার্কে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরির পর যখন ফিরছিলো তখন ওর ফোনে ফোন আসে, তুলে দেখে সামু কল করেছে!ও তুলে বললো

“কিরে সামু কি অবস্থা…”

সামু ওর কথা শুনেছে কিনা তা বুঝলো না কিন্তু সে তাড়াহুড়া করে বললো

“ভাই তুই কই?দ্রুত কেবিনে আয়, ভাবির জ্ঞান ফিরেছে!”

সায়ান হুট করে বসে পড়লো মেয়েকে নিয়ে, আজ আড়াইমাস পর রুশির জ্ঞান ফিরেছে। খুশিতে ওর চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো। ও দ্রুত দৌঁড়ে আসতে চাইলেও মেয়ের কারণে সাবধানে পা ফেলে আসলো, কেবিনের সামনে আসতে সবার হতাশ চাহনি দেখতে পেলো, ও জিজ্ঞেস করলো

“কি হয়েছে?সবাই এভাবে উদাস হয়ে আছো কেনো?”

“ভাই!ভাবি আমাদের কাউকে চিনতে পারছে না, শুধু তার পালক বাবাকে ছাড়া। উনি এখন ভেতরে তার সাথে কথা বলছে!ও হ্যা ইনানকেও চিনতে পারছে!”

সায়ান ঠিক যেই ভয়টা পেয়েছিলো ঠিক সেটাই হলো, রুশির স্মৃতি হারিয়ে গেছে। ওর মনে হচ্ছে কেউ ওর বুকে ছুরি চালাচ্ছে এতোটা যন্ত্রণা হচ্ছে। ও দ্রুত কেবিনে ঢুকতেই ইনান আর রুশির বাবাকে দেখতে পেলো!রুশির বাবা রুশিকে তার আসল বাবা মা সম্পর্কে বলছে!তারা ওকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেলেন তারপর আস্তে বেরিয়ে পড়লেন!সায়ান কাছে যেতেই রুশি ভ্রু কুচকে তাকালো আর প্রশ্ন করলো

“কে আপনি?আমি কি কোথাও আপনাকে দেখেছি?আমার মনে পড়ছে না কেনো আপনি কে!”

“রুশি ভালো করে তাকিয়ে দেখো! আমি সায়ান তোমার হাজবেন্ড! আর এইযে দেখো এটা আমাদের মেয়ে, আমি ওর নাম রাখিনি তবে পাখি বলে ডাকি। তুমি ওর নাম রেখে দিও হ্যা?তোমার মনে পড়ছে কিছু?আমাদের কিভাবে দেখা হয়েছিলো বা কি!তুমি কি আমাকে পুরোটাই ভুলে গেছো রুশি!”

“আ্ আমি কিছু মনে করতে পারছিনা কেনো?আ্ আমি আপনাকে চিনি কিন্তু কিভাবে চিনি?আমার কিছুই মনে নেই কেনো?আমার বুকে খুব ব্যাথা করছে! আমার মনে হচ্ছে আমি কিছু হারিয়ে ফেলছি কিন্তু আমি হারাতে চাইনা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে! কিচ্ছু মনে পড়ছে না, কিচ্ছুনা! আমি মনে করতে চাই সব!”

রুশি কান্না জড়িত কন্ঠে বলতে লাগলো, তারপর মাথা চেপে ধরে বসে রইলো। সায়ান সেই কতোক্ষণ ধরে ডাকছে কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই। একসময় রুশি জ্ঞান হারালো!

কেবিনে ডাক্তার রুশির চেকয়াপ করছে আর সায়ান বাইরে মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, রুশি ওকে ভুলে গেছে এটা এতো চেয়েও মানতে পারছে না,কিছুতেই না। এতোদিনের সকল ধৈর্য রুশির ওই অবাক চাহনিতে যেনো গলে গেছে, রুশির ওর দিকে এমনভাবে চেয়ে আছে যেনো কোন বাইরের মানুষ ও! ভালোবাসার মানুষের এই চাহনি সহ্য করা বড্ড কষ্টের!ও পারেনি সে কষ্ট সহ্য করতে!ডাক্তার বেরিয়ে এসে হতাশার স্বরে বললো

“পেইশেন্টের মাত্র জ্ঞান ফিরেছে, এই মুহুর্তে তাকে পুরোনো স্মৃতি মনে করানোর চেষ্টা করা একদম ঠিক হয়নি!যদিও পেইশেন্টের আপাদত তেমন ক্ষতি হয়নি তবে নেক্সটাইম এমন হলে তাকে হয়তো বাঁচান যাবে না। আমি রিকোয়েস্ট করছি আপনাদের, এই ভুল আর করবেন না, নাহয় পেইশেন্টকে আর বাঁচানো যাবে না”

ডাক্তার চলে যাওয়ার পর সায়ান বাইরে থেকে রুশির দিকে তাকিয়ে আছে,নিজেকে কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে! ও বড় একটা বোকামি করে ফেলেছে যাতে রুশির অনেক ক্ষতি হতে পারতো!সায়ানের ভাবনার মাঝেই ওর প্রিয় আন্টি ওর কলার চেপে ধরে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো

“আমি জানি সায়ান তুই রুশিকে অনেক ভালোবাসিস!সবার থেকেই বেশি হয়তো কিন্তু তাই বলে মা হিসেবে নিজের মেয়ের ক্ষতি মেনে নিবো না। তোর জন্য অনেক বড় কিছু হয়ে যেতো সায়ান, তুই রুশিকে ঠিকভাবে প্রোটেক্ট করতে পারবিনা। তাই আমি চাই তুই তার থেকে দূরে থাক!”

তারপর সে মিসেস খানের দিকে তাকিয়ে বললেন

“আমি জানি আপা আমি নিষ্ঠুরের মতো কাজ করছি! কিন্তু মা হিসেবে আমার কিছু করার নেই।আমি চাই রুশিকে নিয়ে দেশের বাইরে চলে যেতে চাইছি, রুশির অবস্থার উন্নতি হলে নিজে তাকে আবার ফিরিয়ে আনবো। কারণ আমরা জানি ও সায়ানের আমানত, খান বাড়ির বউ। দরকার হয় আবার বিয়ে দিবো আর প্রোটেক্টও করবো যাতে অন্যকোন কিছুতে না জড়ায় কিন্তু এখন ওকে এখানে রাখা সেফ মনে হচ্ছে না। সায়ানের নিজের উপর কন্ট্রোল নেই তাই ও চাইতেও কিছু করে ফেলতে পারে!আমার এটা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।”

“নাহ! তুমি কি বলছো তা বুঝতে পারছো আন্টি! এর থেকে ভালো আমায় মেরে ফেলো আমি কিছু বলবো না। তবুও রুশিকে নিওনা, আমি এমন কিচ্ছু করবো না আর সত্যি বলছি!”

সেদিন সায়ানের সকল পাগলামোও রুশিকে নিজের কাছে রাখতে পারে নি, রুশির বাবা-মা জোর করে তাকে নিয়ে চলে গেছে আর কোথায় নিয়ে গেছে তা কেউ জানেনা। যদিও সায়ানের ধারণা তারা লন্ডনে আছে! সায়ান সাথে সাথেই হয়তো যেতে পারতো সেখানে কিন্তু মেয়ের কথা ভেবে যায়নি,মেয়ে কয়েকবছরের হোক তবেই ও যাবে রুশিকে খুঁজতে আর বাবা মেয়ে মিলে তাদের মাকে মানিয়ে দেশে নিয়ে আসবে!মেয়ের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে সায়ান বললো

“তুমি তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে যাও পাখি!তারপর আমরা তোমার মাকে তোমার নানা-নানির থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসবো তারপর নিজেদের কাছে রেখে দিবো!কোথাও যেতে দিবো না”

মেয়েটি বুঝলো কিনা কে জানে?কিন্তু বাবার কথা শুনে খিলখিল করে হেসে দিলো যেনো সব বুঝতে পেরেছে। সায়ান মেয়েকে কোলে নিয়ে হাটতে লাগলো আর ভাবতে লাগলো কবে ওর পাখিটা পড়ে হবে আর কবে ওর ছোট্ট পরীর কাছে যেতে পারবে!

এইটুকু পরে কুঞ্জন থামলো, কান্না করতে করতে ওর হিচকি উঠে গেছে! ও এই মানুষগুলোকে না চিনলেও তাদের কষ্টে যেনো নিজেই কষ্ট পাচ্ছে!এতো কষ্ট এই অনুভুতির ভেড়াজালে?ও পরের পেজ উল্টাতেই দেখে আর কিছু নেই, শেষপর্যন্ত দেখেও কিছু খুঁজে পেলো না। ও থম মেরে বসে রইলো, এরপর কি হয়েছিলো? সায়ান কি রুশিকে খুঁজে পেয়েছিলো? আর ওদের মেয়েটা? সে কেমন আছে এখন?কতো বয়স তার?কি করে জানবে ও এরপর কি হয়েছে?

রুম থেকে বেরিয়ে ও নিজের ঘরে গিয়ে মন বসাতে পারলো। কিভাবে জানবে এরপরে কি হয়েছিলো?ও বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে পড়লো।লন্ডন! বলেছিলো লন্ডন থাকতে পারে!এরমানে লন্ডনে ও জবাব পেতে পারে সব কিছুর!আর বাবাতো লন্ডনেই গিয়েছিলো তাহলে তো আরো সহজ হয়ে যাবে! ও ভেবেই বাঁকা হাসি দিলো।বিড়বিড় করে বললো

“লান্ডান! আম কামিং দেয়ার!”
গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৫২

সন্ধ্যা হতেই কুঞ্জন ধীর পায়ে মায়ের রুমের গেলো তারপর তার সামনে গিয়ে বসলো, এই মুহুর্তে ওকে দেখলে যে কেউ বলবে ওর থেকে ইনোসেন্ট বাচ্চা আর কেউ নেই। ওর মা ওর দিকে তাকিয়ে বিচলিত কন্ঠে বললো

“কি হয়েছে বাবা?তোমার চোখ মুখের এই অবস্থা কেনো? তুমি কান্না করেছো? মন খারাপ তোমার?”

কুঞ্জন মাথা নাড়িয়ে না বললো তারপর ছলছল নয়নে মায়ের দিকে তাকালো। মুহুর্তেই কোথা থেকে সব খারাপ লাগা জড়ো হলো নিজেই বুঝতে পারলো না, ও মায়ের দিকে তাকিয়ে খুব কষ্টে বললো

“পাপাকে খুব মিস করছি মাম্মা!”

“তোমার পাপা তো আজ সকালে গেলো বাড়ি থেকে, আমিও হসপিটালের মর্নিং শিফটে ছিলাম তাই তার সাথে দেখা হয়নি। তুমি তাকে বলোনি কেনো তাহলে তো সে যেতো না”

“তখন তো বুঝতে পারিনি কিন্তু এখন খুব খারাপ লাগছে!পাপাকে খুব মনে পড়ছে,আমি তার কাছে যাবো মাম্মা!”

“কিন্তু তোমার বাবা তো মাত্র সেখানে গিয়েছে, এখন আসতে তো সময় লাগবে।আমি তাকে বলবো দ্রুত যাতে কাজ শেষ করে চলে আসে, আমাদের কুঞ্জন তাকে খুব মিস করছে!”

“মাম্মা আমি তাকে এখন দেখতে চাই!”

“ঠিক আছে,সেখানে পৌছলে তুমি ভিডিও কল দিয়ে দেখে নিও”

“আম্মু আমি তাকে সরাসরি দেখতে চাই, ফোনে দেখে হবে না। চলো আমরা পাপার সাথে দেখা করতে লন্ডন যাই,পাপাকে সারপ্রাইজ দেই। তুমি পাপার সাথে যে ওই আঙ্কেলটা আছে না, যে এখন লন্ডন থাকে! তাকে বলো সব ঠিক করে দিতে। তারপর আমরা লন্ডন গিয়ে পাপার সাথে দেখা করলে পাপা অনেক খুশি হবে!”

“না কুঞ্জন! তোমার পাপা দুদিন পর চলে আসবে তাই শুধু শুধু গিয়ে কি লাভ?আমরা অন্যকোন সময় তোমার পাপার সাথে গিয়ে ঘুরে আসবো”

কুঞ্জন মুখ ফুলিয়ে মায়ের কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়লো, তারপর সোজা নিজের রুমে গিয়ে দরজা লক করে দিলো। তারপর মুচকি হেসে চোখের পানি মুছে নিলো আর নিজের জামাকাপড় প্যাক করা শুরু করলো। ও জানে ওর মা বেশিক্ষন না রাজি হয়ে থাকতে পারবে না, ঠিক কতোক্ষণ পর এসে বলবে কুঞ্জন সব গুছিয়ে নাও। আমরা তোমার বাবার কাছে যাচ্ছি, তুমি মন খারাপ করোনা।এইজন্যই মাকে এতো ভালোবাসে ও।বাবাকেও অনেক ভালোবাসে তবে মাকে একটু বেশিই ভালোবাসে!

ও যা ভেবেছিলো তাই হয়েছে,রাতে রুম থেকে বের না হওয়ায় সকালেই ওর মা রাজি হয়ে গেছে আর বলেছে সন্ধ্যায় ওদের ফ্লাইট!আগেই পাসপোর্ট করা থাকায় সবকিছু মেনেজ করতে দেরি হয়নি, কুঞ্জন তো মহাখুশি। নিজেকে কেমন যেনো গোয়েন্দা মনে হচ্ছে,ডায়রির শেষের অংশের রহস্য উদ্ধারে কুঞ্জন দ্যি গ্রেট লন্ডনের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিয়েছে। কথাগুলোর ভাবতেই প্রচণ্ড এক্সাইটমেন্ট ফিল করছে কুঞ্জন! লন্ডনের পথের সারা রাস্তা ঘুমিয়েই এসেছে, লন্ডনে গিয়ে তাকে রহস্য সমাধানে মশগুল থাকতে হবে তাই রেস্টের প্রয়োজন।

দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে তারা একটি বিশাল বাংলোর সামনে এসে পৌছলো, কুঞ্জন একবার ভেবেছিলো মাকে জিজ্ঞেস করবে এটা কার বাড়ি কিন্তু পরে ভাবলো নাহ! নিজেই রহস্য উদ্ধার করবে। মাথার ক্যাপটা ঠিক ঠাক করে কলিংবেল চেপে বেশ ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক তখনি কেউ একজন দরজা খুলে দিলো, মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে আসতেই ও সেদিকে ফিরে তাকালো। একটা গৌর বর্ণের মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, লম্বায় প্রায় ওর সাইজেরই বা ওর থেকে ছোট কিন্তু বয়সে বড়োই মনে হলো! বিদেশের মাটিতে থাকলেও চেহারায় একটা বাঙালিয়ানা ফুটে উঠেছে। বিদেশের মাটিতে বাঙালিরা বাঙালি কাউকে পেলে কতো খুশি হয় তা কেবল তারাই জানে! কুঞ্জন কিছু বলার পুর্বেই সেই মেয়েটি নেটিভ স্পিকারের মতো বলে উঠলো

“হু আর ইউ?হোয়াচ ইউ ওয়ান্ট?”

কুঞ্জনের মুখটা চুপসে গেলো, মেয়েটার ইংলিশ শুনে নিজে যাও একটু আধটু ইংলিশ জানতো তাও ভুলে গেলো। ও কি বলবে বুঝতে পারছে না! কিন্তু ওই মেয়েটাই হঠাৎ হেসে বললো

“সামু আন্টি!কতোদিন পর তোমাকে দেখলাম!কেমন আছো তুমি?”

বলেই কুঞ্জনের মাকে তাড়াতাড়ি জড়িয়ে ধরলো দৌঁড়ে এসে, মেয়েটির মুখে এতো মার্জিত বাংলা শুনে কুঞ্জন ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো! বাংলা যদি জানতোই তবে ওর সামনে এতো ইংলিশে ফরফর করার কি দরকার ছিলো। কুঞ্জন যেনো মহা বিরক্ত হলো, ওই মেয়েটি এবার ওর দিকে ফিরে কৌতুহল নিয়ে বললো

“ওকি তাহলে ছোটু?আমাদের ছোটু কতো বড় হয়ে গেছে! বাহ দেখতে তো লম্বা চৌড়াও হয়েছে বেশ!”

বলে হুট করে এসে জড়িয়ে ধরলো আর আর গালে কিস করে বসলো আর ওর মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে চলে গেলো। যদিও এটাই লন্ডনের কালচার তবুও ও তো এসবে অভ্যস্ত নয়, ও বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। প্রত্যেকটা স্পন্দন যেনো বলছে
“এক পারদেসি মেরা দিল লে গায়ি!”

ও নিজেকে সামলে ভিতরে হাটা ধরলো ভিতরে, এখন ওর এসব ভাবার সময় নেই। যদিও ও আরোও এই ছোটু নাম শুনেছে কিন্তু আম্মুকে জিজ্ঞেস করলে বলতো তার বান্ধুবী বা বান্ধুবীর মেয়ে।তাই তাদের প্রতি তেমন আগ্রহ ও দেখায়নি আর না ভিডিও কলে কথা বলেছে কখনো! তাহলে কি নিজের মায়ের বান্ধুবীর বাসায় আছে ওরা?

ভেতরে ঢুকতেই সোফায় নিজের বাবাকে দেখতে পেলো সাথে তার সমবয়সী আরেকজনকে! তার সাথে একটু আগের মেয়েটির অনেক মিল চেহারার তবে পুরোপুরি নয়। অনেকটাই মিল আবার অনেকটাই অমিল!ওদের দেখেই ওর বাবা দাঁড়িয়ে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে আর বলে উঠলো

“সামু!তোমরা?এখানে কখন এলে আর কিভাবে এলে? আমাকে বললে না কেনো তোমরা আসছো? আমিই তো সাথে করে নিয়ে আসতে পারতাম”

“আর বলোনা, তোমরা বাবা-ছেলে কোনদিন শান্তি দিয়েছো আমায়?ইনান তোমার ছেলে রাতের বেলায় হুট করে এসে বলে পাপাকে মিস করছি তার কাছে যাবো। আর জানোই তো তোমার মতো জেদি তাই না মেনে পারা যায়?তাই আসতে হলো এইখানে!”

“তো আমাকে বলোনি কেনো?”

“তোমার ছেলে তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে তাই বলিনি”

“সেটাই আমার ছেলে আমাকে মিস করবে তাইনা?দেখো তোমার সাথে থেকেও বাবাকে ছাড়া থাকতে পারেনা। আমার ছেলে বলে কথা!”

সামু মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেলো আর ইনান মুচকি হেসে ছেলের দিকে তাকালো।কুঞ্জন ভেবেছিলো ওর বাবা রেগে যাবে কিন্তু এমনটা হয়নি। বাবার চোখে মুখে খুশির ঝলক দেখে ওর মুচকি হাসলো, বাবা এতোটা খুশি হবে ও ভাবে নি। ও সোফায় বসে সামনের ব্যাক্তিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো, ভাবতে লাগলো যদি ও ঠিক জায়গায় আসে তবে ডায়েরি অনুযায়ী এই ব্যাক্তিটি কে হতে পারে?দেখতে লম্বা, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি তবে দেখতে অনেক ইয়াং!গৌর বর্ণ, মুখে চাপ দাড়ি যদিও তার দু একটাতে পাক ধরেছে কিন্তু এখনো হিরোদের মতোই লাগছে। খুব সুদর্শন দেখতে, এখনো নিশ্চই মেয়েরা তার পেছনে ঘুরে?হাতে খবরের কাগজ, চেহারায় আলাদা এক গাম্ভীর্য! তবুও কি মোহনীয় লাগছে!সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট যেনো বেশ মানিয়েছে তাকে! অবশ্য এমন সুপুরুষকে সকল কিছুতেই মানাবে এমন ধারণাই কুঞ্জনের। এমন সময় সদর দরজা দিয়ে দুজন নর-নারী ঢুকলো। ও সেই নারীর দিকে গভীর ভাবে তাকালো, খুব পরিচিত হলো মুখখানি! ও চোখবন্ধ করে ভাবতে লাগলো কে এই নারী?কে হতে পারে?ওর মা যদি সেই ডায়েরীর সামু হয় তবে সামনের জন কে?রুশি না চন্দ্রিকা?যদি রুশি হয় তবে পাশের জন কি সায়ান?তাহলে সায়ান রুশিকে কোথায় খুঁজে পেয়েছিলো আর ওদের মেয়ে কোথায়?

#চলবে

(আশাকরি কুঞ্জন কে বুঝতে পেরেছেন 🙂)
#চলবে

(আপনাদের প্রিয় চরিত্র কি এই গল্পের? আমার ইনান!কারণ তার ত্যাগের কারণে অনেক কিছু সম্ভব হয়েছে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here