#গোধুলীর_শেষ_প্রহরে
#পর্বঃ২৩
#রাউফুন (ছদ্মনাম)
একদিন কেটে গেছে। ভোরের আলো ফুটতেই সারাফের জ্ঞান ফিরে এসেছে। জ্ঞান আসার পরেই ও যখন বুঝতে পারলো কথা বেরোচ্ছে না ওর কণ্ঠনালী থেকে তখনই হট্টগোল বাঁধলো। উত্তেজিত হয়ে সজোরে হাতের ক্যানালো টা এক টানে খুলে ফেললো সে। হসপিটালের সব কিছু ভাঙচুর শুরু করলো। নার্স ঘাবড়ে গিয়ে দৌড়ে বাইরে এলেন। ডক্টর কে ডাকলো সে। বাইরে সবাই বসে ছিলো। সারা রাত ঘুমের রেশ ছিলো না কারোর চোখেই। সবেই হইতো চোখ লেগে এসেছিলো সাহিরা, শাম্মী, সুপ্রিয়র। কুহু, আর প্রিতি মুহুর ক্যাবিনে ছিলো। মুহু আবার উত্তেজিত হয়ে বারবার বিলাপ করছিলো সারাফের জন্য। তখন বাধ্য হয়ে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পারিয়ে দেওয়া হয়েছে ওঁকে। মুহুর পাশে থাকতে থাকতেই কুহু আর প্রিতির ও একটু আগে চোখ লেগে এসেছে। তৌহিদ কাল আরও কিছুক্ষন থেকে চলে গেছিলো। কারণ তানহা বাড়িতে একা আছে। ভাঙচুরের আওয়াজে ওঁদের ঘুম ভেঙে যায়।।উপরন্তু আবার নার্সকে ছুটতে দেখলেন শাম্মী। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
‘কি হয়েছে নার্স? আপনি এমন ঘাবড়ে গেছেন কেন?’
নার্স আতংকিত হয়ে বলে, ‘ এই ক্যাবিনের পেশেন্ট উত্তেজিত হয়ে ভেতরের সবকিছু ভাঙচুর করতে শুরু করেছে। প্লিজ আসুন আপনারা।’
সুপ্রিয় কে কল করতেই সুপ্রিয় ছুটে এসেছিলো। বড় ভাই বেঁচে আছে জেনে তার যেনো আকাশ সম আনন্দ। কিন্তু বাকি সব টা যখন শুনেছে তখন মা কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিয়েছিলো সে। তার মায়ের বিশ্বাস সত্যি হয়েছে তবে। মা দের কথার আর বিশ্বাসের অদ্ভুত একটা শক্তি থাকে। তার মায়ের বিশ্বাস অটুট ছিলো। ❝বিশ্বাসে মিলাই বস্তু তর্কে বহু দূর!❞ কথাটার প্রমান আজ সে পেয়েছে। সে যদি ভেঙে পরে তাহলে মাকে সামলানো মুশকিল হবে। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে তার মাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছে। আগে কেন তাকে জানাইনি এসব নিয়ে সে অভিযোগ ও করেছে মাকে। কিন্তু শাম্মী এতো কিছুর মধ্যে সুপ্রিয় কে খবর দিতেই ভুলে গেছিলেন। এরপর মনে পরতেই তিনি সুপ্রিয় কে ফোন করে হসপিটাল আসতে বলেন। এরপর যা কিছু হয়েছে সব টা খুলে বলে। সুপ্রিয় নার্স কে বলে,
‘আমি যাচ্ছি। আমি যদি ভাইয়া কে বলি আমি তার ছোট ভাই সে শান্ত হবে। নিশ্চয়ই শান্ত হবে।’
সুপ্রিয় আর শাম্মী ক্যাবিনের ভেতরে গেলো। সাহিরা নিশ্চল, নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু যেতে পারলেন না। ভেতর টা আত্ম হাহাকারে ভরে উঠছে তার। খুব করে মন টা চাইছে যেতে। সারাফকে দু হাতে জড়িয়ে ধরতে। বলতে, ‘ইচ্ছে করছে একটিবার আমাকে মা বলে ডাকো বাবা। আমাকে ক্ষমা করে দিও আঠাশ টা বছর তোমার থেকে কেড়ে নেওয়ার জন্য।’ কিন্তু হাই অনেক বলতে চাওয়া কথাও আজ গলায় কা’টা’র মতো বিঁধে আছে। খচখচ করছে হৃদয় টা। প্রতিনিয়ত র’ক্ত ঝড়ছে সেখান থেকে। প্রিতি এসে সাহিরার পাশে দাঁড়িয়ে উনার কাধে হাত রাখলেন। সাহিরা প্রিতির দিকে অশ্রু সজল চোখে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলেন।
শাম্মী আর সুপ্রিয় গিয়ে দেখলো সারাফ উম্মাদের মতো সব কিছু ছুড়ে ফেলছে। এরপর ব্যাডে বসে মাথা চেপে ধরে আ, আ, করছে। কারণ তার মুখ থেকে আ,আ, শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ আসছে না। ওর মাথার চুল গুলো অপারেশন করার ফলে সব গুলো কেটে ফেলা হয়েছে। তার এক ঝাক সিল্কি চুল যেগুলো মৃদু মন্দ বাতাসেও ঢেউ খেলতো সে চুল নেই। কতই না প্রিয় ছিলো সে চুল তার। ন্যা’ড়া মাথার মাঝ বরাবর সেলাইয়ের চিহ্ন। প্রায় ছয় থেকে সাত টা সেলাই পরেছে মাথায়। যিনি সারাফের অপারেশন করিয়েছেন সে ডক্টর এখন ইমার্জেন্সি অটি তে আছেন সেজন্য আসতে পারেন নি। কিন্তু শাম্মী তো ডক্টর তিনিও তো একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে সারাফ কে ঘুম পারিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু একজন মা কি কখনোই তার সন্তানের এমন বিরুপ অবস্থা সহ্য করতে পারেন। ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। কাঁন্নার শব্দ কানে আসতেই সারাফের হাত থেমে গিয়েছে। সে দেখলো তার জন্মদাত্রী মা জননী দাঁড়িয়ে আছেন। সাথে আরও একটা ছেলে। কালকের ঘটনা আর শাম্মীকে দেখেই সে আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে গেলো। নিজের সন্তান কে অন্যের ভরসায় কেন রেখে গেছিলেন তিনি। হসপিটালে তো আরও অনেক ডক্টর ছিলেন উনার কর্মরত। তাহলে কেন তিনি নিজের সন্তান কে আগলে রাখতে গাফিলতি করেছিলেন।।হাতে নেড়ে আ আ করে কিছু বলার চেষ্টা করলো কিন্তু ব্যর্থ হলো। সে খুব করে চাইলো চিৎকার করে উঠতে। কিন্তু না পারলো না সে। যন্ত্রণায় মাথা চেপে ধরতে সুপ্রিয় এগিয়ে এলো। সারাফ কে দুহাতে আগলে ধরে বলে,
‘আমার ভাইয়া! দেখো আমাকে, আমি, আমি তোমার ছোট ভাই সুপ্রিয়। আমাদের বাবা মারা গেছে। কিন্তু আমি খুব করে চাইতাম আমার বড় ভাই থাকুক যে আমাকে বাবার মতো বটগাছ হয়ে ছাঁয়া দেবে। আজ দেখো সত্যিই আমার বড় ভাই আছে। আমাকে ছাঁয়া দেওয়ার জন্য আমার বড় ভাইকে পেয়ে গেছি আমি। আজ খুব কষ্টের মধ্যেও আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষদের একজন।’
সুপ্রিয় সারাফকে ঝাপটে ধরে কান্না করছে। শাম্মী মুখে হাত চেপে কান্না আটকে কিছু টা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। দুই ভাইকে এক সাথে দেখে যেমন আনন্দিত তিনি তার থেকেও বেশি ব্যথিত তিনি। কিন্তু তার ছেলে মাহেত কে কেন অন্য রকম লাগছে এতো। ওর চোখে স্পষ্ট অভিমানের ছোঁয়া লেগে আছে। কেন এই অভিমান?
এদিকে মাথা যন্ত্রণায় ছটফট করছে সারাফ। সে বুঝলো এই ছেলেটা তবে তার ছোট ভাই। তাই তার মায়ের সঙ্গে এসেছে। কিন্তু এতো কেন কষ্ট হচ্ছে তার মানতে ইনি তার মা! কি কারণে? শুধুই দায়িত্বহীনতার কারনে এই অভিমান জন্ম নিচ্ছে মনে?
আচ্ছা সে কেন কথা বলতে পারছে না? তার মাথার চুল গুলো কেন ফেলে দেওয়া হয়েছে? কেন এই আহাজারি? তাকে জানতে হবে? শেষ বার তো সে মুহুকে দেখেছিলো। কোথায় সে? ওর কথা না বলতে পারার জন্য কি তাকে ছেড়ে চলে যাবে মুহু? অবহেলা করবে কি মুহু তার ফুলবাবু কে? আগের মতোই কি মুহু তাকে ভালোবাসবে? নাকি সত্যিই থেকে থেকে যাবে? যদি চলে যায় মুহু? তখন কি করবে সে? মুহুর্তের মধ্যে এতো এতো প্রশ্ন মনে জাগতেই মাথার যন্ত্রণা বেড়ে গেলো। মুহুর তাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই মাথার চাপ টা আরও বেড়ে গেছে। ভয় হচ্ছে খুব তার মুহুকে হারানোর ভয়। হৃদয়হরিনী কে হারানর ভয়। সে এবার কাশতে শুরু করলো। কোনো রকমে সুপ্রিয় কে হাতে ঠেলে সরিয়ে দিলো আস্তে করে।
আর তখনই তার চোখ গেলো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে। মুহু দাঁড়িয়ে আছে। এটা তার হৃদয়ীনি। তার হার হাইনেজ! কেমন বিদ্ধস্ত লাগছে ওঁকে। মাথা যন্ত্রণা ভুলে সে অপলক নয়নে তাকিয়ে রইলো। তার প্রনয়িনীর মুখখানা ওমন বিষন্নতায় ছেঁয়ে গেছে কেন? তার জন্য কি? ক্লান্ত প্রনয়ীনির চোখ, মুখ ফুলে গেছে। কেঁদেছে খুব দেখেই বোঝা যাচ্ছে! মুহু টলমলে পায়ে হেঁটে এলো। শাম্মী আর সুপ্রিয় না চাইতেও বেরিয়ে এলো। কারণ তাদের মনে হলো মুহু সামলাতে পারবে সারাফকে। ওঁকে দেখতেই সারাফ শান্ত হয়ে গেছে। মুহু কাছে আসতেই সারাফ,
‘হাত নেড়ে আ আ করে বুঝালো চলে যাও এখান থেকে। তোমার আমার সাথে থাকা ঠিক হবে না। তোমার সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ সামনে পরে আছে। আমি আর আগের মতো নেই যে। মানুষ আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। আমি কারোর হাসির খোড়াক হতে চাই না। যাবো না কারোর সামনেই। নিজেকে বন্দি করে নেবো চার দেয়ালের মাঝে!’
সারাফের আরও অস্থিরতা বাড়লো। সে ভেবে নিলো মুহু হইতো তাকে বলবে, আমি তোমার সাথে থাকতে পারবো না। লোকে কি বলবে তোমাকে নিয়ে রাস্তা ঘাটে বেরোলে। তোমার মতো বোবা ছেলের সঙ্গে থাকা যায় নাকি?’ এসব ভেবে এতোটাই অস্থিরতা বাড়লো যে হৃদস্পন্দন বিট করছে হাইলি। পালস রেট অনেক টাই বেড়ে গেছে তার। ওঁকে ছটফট করতে দেখে মুহু আরও ঘনিষ্ঠ হলো সারাফের। এখনো অব্দি একটাও শব্দ সে মুখ থেকে বের করে নি। শুধু পলকহীন তাকিয়ে আছে সারাফের নিষ্পাপ শুকনো মায়া ভরা মুখ, নিষ্প্রাণ চোখের দিকে। মুহুর চুপ থাকাটাই সারাফের অস্থিরতা কমেনি এতোটুকুও। ছটফট করছে ভীষণ ভাবে। মুহু সারাফের অতিব নিকটে এসে তার শুষ্ক ওষ্ঠাধরে চেপে ধরলো ওর সরু পাতলা ঠোঁট দিয়ে। সারাফ মূর্তির ন্যায় বসে রইলো। ওর ছটফট করা, সমস্ত অস্থিরতা, সমস্ত বিলাপ, সবটুকু বিষাদ শুষে নিচ্ছে তার ভালোবাসা। শিরদাঁড়া উঁচিয়ে উঠলো মুহুর্তের মধ্যে। রক্তের প্রবাহ সর্বাঙ্গে মুভ করতে লাগলো। অন্তস্থল হয়ে উঠলো সামালহীন। সারাফের চক্ষুদ্বয়ে ছড়িয়ে থাকা নোনাজল গড়িয়ে পরলো গাল বেয়ে। তিতকুটে অনুভূতির রেশ কেটে গেলো। সারাফ পুরো পুরি শান্ত হওয়ার পর মুহু ওঁকে ছেড়ে দিলো। ঠোঁট কামড়ে কিছু সময় ঘন নিঃশ্বাস নিলো দুজনেই। হাঁপাতে হাঁপাতে নিজেদের কপালে কপাল ঠেকালো। মুহুর চোখের অশ্রুকনারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না। টপটপ করে পরছে। সে শান্ত স্বরে বলে,
‘সুখ কাকে বলে জানো ফুলবাবু? সুখ হলো সঠিক মানুষের সান্নিধ্য লাভ করা। সঠিক মানুষ কে বাঁছাই করে তার সাথে সারাজীবন কাটানো। সেটা যেমন পরিস্থিত হোক না কেন! সুখ হলো সঠিক মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়া যে তোমাকে সঠিক ভাবে ভালোবাসে। সুখ এবং দুঃখ একে অপরের সাথে যত্ন এবং শেয়ার করে নেওয়া। ছোট ছোট আনন্দে অনেক বেশি খুশি হওয়া। নিশ্চয়ই সুখী ভালোবাসা সবসময় কল্পনায় থাকে না। তুমি কি ভেবেছো মুহু তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে। মুহু এই অবস্থায় তার ফুলবাবু কে ছেড়ে চলে যাবে? আমার ভালোবাসার সেই সঠিক মানুষ টি হলে তুমি ফুলবাবু। যাকে কোনো পরিস্থিতিতেই এই মুহু ছাড়বে না। মুহুর ভালোবাসা এতোটাও ঠুনকো না। মুহু একবার কারোর সাথে থাকার জন্য প্রতিজ্ঞাবধ্য হলে সে শেষ নিঃশ্বাস অব্দি থাকে। ভেবো না এতো তারাতাড়ি আমার থেকে তুমি মুক্তি পাবে। তোমার মুক্তি মিলবে না এই মুহুর থেকে। মাথায় এবং মনে ভালো করে কথা গুলো রেজিস্ট্রার করে নাও!’
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সারাফ মুহুর
দিকে। কান্নায় বিজড়িত হয়ে চোখের কোণে অশ্রু কনারা ভীড় জমালো। মুহু সেই অশ্রু গড়িয়ে পরবার আগেই সন্তর্পণে দুই হাতের বেষ্টনীতে মুছে দিলো। তারপর আলতো করে দু কাধে হাত রেখে শুইয়ে দিলো সারাফকে।
বাধ্য ছেলের মতো শুয়ে পরলো সে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে প্রিয়তমাকে দেখে যাচ্ছে। আচ্ছা মুহু তাকে দয়া দেখাচ্ছে না তো? তার এই ধারণা টা এই যে একটু আগের ঘটনা ভুলিয়ে দিয়েছে। মুহুর্তেই মন থেকে বিলীন করে দিলো তেতো ভাবনা গুলো। সারাফ তাকিয়ে আছে এখনো মুহুর মুখপানে। মুহু সেই দৃষ্টির মানে বুঝে আবার বলে,
‘আমরা আজই বিয়ে করবো ফুলবাবু। তৈরি থাকো। তোমাকে কোথাও ছাড়ছি না আমি। সারাক্ষণ চিপকে থাকবো আমি তোমার সাথে। তাই তো পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করছি। বাবা এসেছিলেন তাকে কাজী ডাকতে পাঠিয়েছি। তারপর আশা রাখছি তোমার আর ভয় থাকবে না। আমি তোমাকে মিথ্যা কোনো আশ্বাস দিয়ে আশ্বস্ত করতে চাচ্ছি না বা দয়া দেখাচ্ছি না। আমি তোমাকে ভালোবাসি! যে ভালোবাসার মাপ ঝোক করার পদ্ধতি নেই। সে ভালোবাসা যেটা সমুদ্রের স্রোতের চেয়েও অবিকল, অবিরত, অবিশ্রান্ত থাকবে আজীবন!’
#চলবে