#গোধূলি_বেলায়
#পর্ব_12
– শোন কাল সকাল সকাল রেডী থাকবি। তোকে নিয়ে হসপিটালে যাব।
– কেন? প্রেগনেন্সি টেস্ট তো আমি করিয়েছি তুমি কি আবার শিউর হতে চাও?
– না সেজন্য নয়। অন্য কারনে যাব।
– কেন? কি সেই কারন? সেটাই তো জিজ্ঞাসা করছি।
– দেখ একটা ভুল হয়ে গেছে আমি শিকার করছি কিন্তু তাই বলে তো আরও একটা ভুল করতে পারি না আমরা।
– মানে কি বলতে চাইছ তুমি বলো তো? কোন দ্বীতিয় ভুলের কথা তুমি বলছ।
– আমি বাচ্চাটা এবোর্শান করানোর কথা বলছি।
আনন্দি এমন কিছু শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। হ্যা ও জানত সমাপ্ত প্রথমে সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারবে না। আনন্দিও পারে নি, প্রথম জানার পর একটা অজানা ভয় ঘিরে ধরেছিল ওকে। কিন্তু তাই বলে বাচ্চা নষ্ট করার কথা ওর মাথায় কখনও আসে নি। আর ও কল্পনাতেও ভাবে নি সমাপ্ত এমন কিছু বলবে। আনন্দি কাপা কাপা গলায় বলল,
– মানে কি বলছ এসব তুমি? বাচ্চা নষ্ট করবে মানে?
– বাচ্চা নষ্ট করব মানে বাচ্চা নষ্ট করব। এতে না বোঝার তো কিছু নেই। দেখ আমরা একটা ভুল করে ফেলেছি কিন্তু এখন বাচ্চাটাও তো আমরা একসেপ্ট করতে পারব না। আমরা যদি বাচ্চাটা রাখার কথা ভাবি তাহলে এটা আরও একটা ভুল হবে।
– না কিছুতেই না। আমি আমার বাচ্চা কিছুতেই নষ্ট করব না। তোমার লজ্জা করে না নিজের সন্তানকে এভাবে মেরে ফেলতে চাইছ।
– না করছে না। কারন আমি বাস্তবটা চিন্তা করে কথা বলছি তোর মতো আবেগ দিয়ে না। দেখ এখনও আমরা কেবল স্টুডেন্ট। দুজনেই পড়াশোনা করছি। ফাস্ট ইয়ারটা সবে পার করেছি এখনও গ্রাজুয়েশন শেষ করতে প্রায় তিন চার বছর লাগবে। এসময় একটা বাচ্চা রাখার কথা চিন্তা করাটাও বোকমী।
– হ্যা এটা ঠিক আমদের এখনও একটা বাচ্চা রাখার মতো এবিলিটি হয় নি। হয়তো প্লান করে হলে আমরা কখনও এই সময় বাচ্চা নিতাম না। কিন্তু আমাদের ভুলেই ও এসেছে। ওর তো কোন দোষ নেই। আর একটা প্রাণকে এতো সহজে হত্যা করা যায় না, আর আমিও পারব না।
– পারবি। তুই একবার ভবিষ্যতটা ভেবে দেখ। একবার ওর জন্ম হলে আমাদের ভবিষ্যতে কি কি ফেস করতে হবে ভেবে দেখ তাহলে তোর আর কোন প্রবলেম হবে না। আর কোন পিছুটান আসবে না।
আনন্দি হাসল কিছুটা সময়। সমাপ্ত ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। ও বুঝল না ও কি এমন বলল যে মেয়েটা এমন করে হাসছে। আনন্দি কিছুটা সময় হাসার পর সমাপ্তর দিকে তাকিয়ে বলল,
– বেশ ভাল বলেছ তুমি। কিন্তু তোমার একজন মায়ের মমতা সম্পর্কে কোন আইডিয়া নেই। একজন মা দশ মাস দশদিন একটা বাচ্চাকে পেটের মধ্যে রেখে বড় করে আর তার যাত্রাটা শুরু হয় সে মা হতে চলেছে এটা জানার মাধ্যমে। একজন মা যদি নিজের কথা ভাবত না তাহলে তোমাদের মতো বাবাদের জন্ম এই পৃথিবী হতো না। তারা নিজের কথা না ভেবে নিজেদের সুখ বিসর্জন দেয় বলেই তোমরা পৃথিবীর আলো দেখতে পাও। তুমি কি করে ভাবলে সেই মা জাতি হয়ে আমি শুধু মাত্র নিজের কথা ভেবে আমার সন্তানকে মেরে ফেলব?
– দেখ এটা মাত্র একটা ভ্রুন। এখনও ভ্রুনের বিকাশই ঠিক মতো হয় নি। তুই তখন থেকে কি বাচ্চা বাচ্চা করিস। একটা পরিপূর্ণ বাচ্চা হতে এখনও মেলা দেরী আছে। এটাকে নষ্ট করলে কিছু হবে না আমি বলছি তো।
– এই ভ্রুনটাকে যদি তুমি একটু সময় দাও তাহলে এটা একটা ভ্রুন থেকে একটা বাচ্চাতে পরিনত হতে পারবে। এই যে এই ঘরের মেজেতে তার গুটি গুটি পায়ে হেটে বেড়াবে, তোমাকে বাবা বাবা বলে ডাকবে। তার ছোট্ট ছোট্ট পায়ে পুরো বাড়ি ছোটাছুটি করবে, আধো আধো কথা বলবে, একটা মিষ্টি কিউটের ডিব্বা হবে ও দেখ। আফটার অল তোমার বেবি তোমার মতো তো হবে।
একটু হাসল আনন্দি হয়তো চোখের সামনে ও বাচ্চাটাকে দেখতে পাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছে বাচ্চাটা গুটি গুটি পায়ে দৌড়ে এসে মা মা বলে ওর কোলে ঝাপিয়ে পড়ছে।
আবার বলতে শুরু করল, ভেবে দেখ বড় ভাইয়া আর ভাবীর মতো আমাদেরও একটা ঋতুসোনা থাকবে। আমাদেরও একটা পিচ্চি পুতুল হবে সে একান্ত আমাদের হবে ওর উপর শুধু আমাদের অধিকার থাকবে আর কারও না। একান্ত আমাদের পিচ্চু সোনা হবে ও। একবার সে সব কথা ভাব তো।
– আমার সেসব ভাবার দরকার নেই। এখন আমার বাচ্চা পালার বয়স না। এখন পড়াশোনা করে নিজের কেরিয়ার তৈরী করার সময়।
– এই কথাটা আগে মনে হয় নি। যদি বাচ্চার দ্বায়িত না নিতে পার তবে পুরুষত্ব দেখাও কেন তোমরা। বউয়ের কাছে যাও কেন যখন জানো যে তোমার একটা বাচ্চা পালার কোন মুরোদ নেই। তোমাদের মতো পুরুষদের না পুরুষত্ব না থাকাই ভাল তাহলে রাস্তায় হাজার হাজার শিশুকে এভাবে পড়ে থাকতে হতো না। তোমরা অন্ধকার ঘরে নিজোর পুরুষত্ব প্রমান করবে আর তারপর সেই নিষ্পাপ শিশু গুলোর কোন ভবিষ্যত দিবে না। এটাই কি তোমাদের পুরুষজাতির নীতি?
– আনন্দি মুখ সামলে কথা বল।
– কেন এখন খুব লাগছে আমি এই কথা গুলো বলাতে? একবার ভেবে দেখ তো আমি যা বলেছি তা কি ভুল বলেছি না কি অন্যায়?
– ন্যায় অন্যায় বিচার করার কোন ইচ্ছা এখন আমার নেই। দেখ আমার একটা ভুলের জন্য আমাকে ওই সব পুরুষদের সাথে তুলনা করবে না। তুমি জানো আমার নিজের উপর কতোটা কনট্রোল আছে। কিন্তু সেদিন অসাবধানতা বসত একটা ভুল হয়ে গেছে তাই বলে আমাকে এতোটা নিচে নামাতে তুমি পার না।
– আমি তো সেটার জন্য কিছু বলি নি তোমাকে ইভেন বলতাম ও না যদি না তুমি নিজের কথা ভেবে এই ছোট্ট প্রাণটাকে মেরে ফেলতে না বলতে যেটা কিনা তোমারও অংশ।
সমাপ্ত আর কিছু বলে না। কি বলবে বুঝতে পারে না। এই মুহু্র্তে ওর শখের করাতের মতো অবস্থা হয়েছে। প্রচন্ড সিধান্তহীনতাই ভুগছে ও।
ঘর থেকে বেড়িয়ে সমাপ্ত সরাসরি ছাদে গিয়ে দাড়ায়। স্নিগ্ধ বাতাসে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে থাকে ওর এখন ঠিক কি করা উচিত।
একবার মনে হয় অসুক না বাচ্চা, হোক না ওর একটা ছোট্ট সংসার ক্ষতি কি তাতে।
কিন্তু আবার অন্য একটা মন বলে উঠছে না সমাপ্ত এই ভুলটা কিছুতেই করিস না। একটা বাচ্চার দ্বায়িত তো আর কম না আর তোর নিজের কি বা আছে এখনও বাবার টাকায় চলিস। নিজের তো একটা টাকা রোজগার করার মুরোদ নেই বাচ্চাটা আসলে তাকে পালবি কিভাবে?
যে নিজে এখনও বাবার আশ্রয়ে থাকে তার নিজের বাচ্চার সপ্ন দেখা কোন মতেই উচিত নয়।
ভেবে যেন মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে সমাপ্তর কিন্তু কোন সিধান্ত নিতে পারছে না। এটা এমন একটা বিষয় যে কাউকে বলতেও পারছে না আর না পারছে কারও কাছে একটু সাহায্য চাইতে।
সমাপ্ত বেড়িয়ে যাওয়ার পর থেকে চুপচাপ বসে আছে আনন্দি। ও জানে সমাপ্ত কিছুতেই বাচ্চাটা রাখতে চাইবে না। ও সমাপ্তকে খুব ভাল করে চেনে। একবার যা বলে তাই করে।
কাল কি সত্যি ওকে নিয়ে গিয়ে বাচ্চা নষ্ট করিয়ে আনবে সমাপ্ত। এখন আনন্দি কি করবে যে করেই হোক বাচ্চাকে বাচাতে হবে। আনন্দি কিছুতেই পারে না নিজের সন্তানকে মেরে ফেলতে।
তাহলে কি ও বাসা থেকে পালিয়ে যাবে? এটা কি ঠিক ডিসিশান হবে? কিন্তু বাসা থেকে পালিয়ে যাবেই বা কোথায় ওর তো কোন আত্মীয় সজনও নেই যার বাসায় গিয়ে কিছুদিন থাকা যাবে আর না কোন সেরকম বন্ধু যে আনন্দির কথায় ওকে থাকতে দেবে। তাহলে এখন কি করবে আনন্দি?
রাতে খাবার টেবিলে আনন্দি আর সমাপ্তকে অনুপস্থিত দেখে আরফা ওদেরকে ঘরে ডাকতে যায়। আরফা ভেবেছিল দুজকেই একসাথে পাবে কিন্তু ঘরে শুধু আনন্দিকেই পেল। অগত্যা আরফা আনন্দিকে নিয়ে নেমে এলো।
খাবার টেবিলে সবাই বসেছে। আনন্দির খাওয়ার কোন ইচ্ছা না থাকতেও আসতে হয়েছে, সমাপ্তর ওকই অবস্থা। আনন্দি সমানে প্লেটের মধ্যে অঙ্গুল দিয়ে আকিবুকি করে চলেছে কিন্তু তখন থেকে এক নলাও মুখে পুড়ে নি।
মনেয়ারা বেগম বিষয়টা লক্ষ করেন তিনি আনন্দির পাশের চেয়ারেটাই বসা ছিলেন। তিনি নিজের প্লেট থেকে এক নলা ভাত নিয়ে আনন্দিকে জোর করে খাইয়ে দেন। আনন্দি জোর করে মুখ নেড়ে খেতে চেষ্টা করলে ওর বমি চলে আসে। ও দৌড়ে বেসিনের সামনে গিয়ে বমি করে ভাসিয়ে দেয়।
এমনিতে প্রেগনেন্সির সময় সব কিছু গন্ধ লাগে যাই খাওয়া হয় তাতেই বমি আসে সেখানে আনন্দি প্রায় এক সপ্তাহ থেকে না খাওয়া। এক সপ্তাহ আগে যখন ওর প্রেগনেন্সির বিষয়টা জানল তারপর থেকে ঠিক মতো খেতে পারে নি ও। তার উপর অতিরিক্ত মানসিক চাপ। সব যেন একসাথে এসে এটাক করে আনন্দিকে।
বমি করা শেষ হতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আনন্দি। এমনিতে আনন্দির বমি করার বিষয়টাতে সবাই বেশ চিন্তিত ছিল তারউপর এভাব অজ্ঞান হয়ে যাওয়াতে সবাই বেশ ভয় পেয়ে যায়।
মনোয়ারা বেগম আর আরফা গিয়ে আনন্দিকে তোলার চেষ্টা করে। বুঝতে পারে আনন্দি জ্ঞান হারিয়েছে এখন ওকে ঘরে নিতে হবে। তাই সমাপ্তকে বলে আনন্দিকে কোলে নিয়ে ঘরে যেতে।
সমাপ্ত এগিয়ে আসে। একটানে কোলে তুলে নেয় আনন্দিকে তারপর এগিয়ে যায় ঘরের দিকে।
আর সাহিল যায় পাড়ার মোড়ে যে ডাক্তার বসে তাকে আজকের মতো ডেকে আনতে। এতো রাতে তাকে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ তাও একবার দেখে আসতে ক্ষতি কি। আনন্দির যা অবস্থা বোঝা যাচ্ছে তাতে তিনি একবার দেখে গেলে মন্দ হয় না।
ডাক্তার বাবু কেবল দোকান বন্ধ করছিলেন তাতেই সাহিল গিয়ে উপস্থিত হয়। ডাক্তারটা বেশ ভাল মানুষ একবার বলাতেই তিনি এতো রাতে যেতে রাজি হয়ে যান।
আনন্দিকে এনে বিছানায় শোয়ানো হয়েছে। সমাপ্ত দাড়িয়ে আছে একটু দুরে। হঠাৎ করে আনন্দির কি হল সেটা সমাপ্তও বুঝতে পারছে না। মনোয়ারা বেগম আনন্দির পাশে বসে ওর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে ঘোসে চলেছেন। আরফাও পাশে বসে আছে আর একটু দুরে দাড়িয়ে আছে আনিসুর সাহেব।
সাহিল ডাক্তার বাবুকে নিয়ে বেশ হুরমুর করে ঢোকে ঘরে। ডাক্তার বেশ কিছুটা সময় চেকাপ করে বললেন,, তেমন কিছু তো মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে উনি প্রেগনেন্ট তাই হয়তো এমন হয়েছে। আপনারা কাল একটু টেস্ট করিয়ে নিয়েন হসপিটালে গিয়ে। আজ আপাতত আমি একটা ইনজেকশান দিচ্ছি যাতে তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরে আসে।
আনন্দি প্রেগনেন্ট এটা শুনে যেন সবার অবাক হওয়ার সীমা থাকল না। আনন্দি প্রেগনেন্ট হলো কখন আগে তো বলে নি। সবাই সমাপ্তর দিকে তাকাল। সবার দৃষ্টি ওর দিকে দেখে সমাপ্ত যেন ভয়ে সেটিয়ে গেল কি করবে কি বলবি কিছু বুঝতে পারছে না। সত্যিটা কি বলে দিবে , এমনিতেই কাল টেস্ট করতে গেলেই সবাই জানতে পারবে।
সমাপ্তকে দেখে সবাই বুঝল কোন ঘাপলা তো নিশ্চয় আছে কিন্তু কেউ কিছু বলল না। আপাতত চুপ করে থাকল আনন্দির জ্ঞান ফিরলেই সবটা জানা যাবে। আগে আনন্দি জ্ঞানটা ফেরা জরুরি। ডাক্তার একটা ইনজেকশান করে বেড়িয়ে গেলেন।
চলবে,,,
জাকিয়া সুলতানা
বি দ্রঃ জানি না কি হযরবল লিখেছি। ঘুমে দুই চোখ বন্ধ হয়ে আসছে তার মধ্যে লিখলাম। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে দেবেন। ধন্যবাদ