গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে পর্ব -৪৮+৪৯+৫০ ও শেষ

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৮

“এই ভালোবাসা আর ঘৃ’ণার যুদ্ধে তুমি কাকে জয়ী হতে দেখতে চাইছ, এ্যাংরি কুইন?”

নির্জন নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করে বেশ আগ্রহের সঙ্গে তাকিয়ে রইল রাগিনীর শুকনো এবং দুর্বল মুখের দিকে উত্তরের আশায়। মেয়েটা এখনো চোখ দুটো অর্ধেক বুঁজে রয়েছে। পুরোটা খুলতেই পারেনি। সারা মুখে লেগে আছে ক্লান্তি। পোশাক-আশাক দেখে মনে হচ্ছে ঘুম থেকে উঠেই সরাসরি ছুটেছে হসপিটালে। শর্ট গেঞ্জির মতো টপসের উপর গলায় রাখা স্কার্ফ কোনোরকমে জড়ানো। রাগিনী দেরি করল না উত্তর দিতে। নির্লিপ্ত গলায় বলল,
“আই ওয়ান্ট টু সি লাভ উইন।”

“ভালোবাসো আমাকে?”

রাগিনী অস্পষ্ট চোখে রেগেমেগে তাকাল। অকপটে উত্তর দেয়,
“আই হেট ইউ।”

নির্জন হেঁসে ওঠে। তার হাসিতে চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে ফেলে রাগিনী। ক্ষীণ গলায় জিজ্ঞেস করল,
“হাসছেন যে?”

“হাসব না? আমি যে তোমার বলা আই হেট ইউ বাক্যের মাঝে ভালোবাসা শব্দটা শুনতে পেলাম। এভাবে কেউ আই হেট ইউ বলে? যেকোনো মানুষ হেট এর পরিবর্তে লাভ শুনে ভুল করবে তো।”

রাগিনী ঠোঁট বাঁকা করে ভেংচি কে’টে অন্যপাশ ফিরে বসল। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“ক্রি’মিনাল কোথাকার!”

নির্জন ঠিক করে শুনতে পেল না রাগিনীর কথা। জিজ্ঞেস করল,
“কিছু বললে?”

“হ্যাঁ বললাম। আপনি এখনি আমার হ্যালুসিনেশন থেকে বিদায় হবেন। সেটাই বললাম। বিদায় হন এখান থেকে। একা থাকতে দিন। বিরক্ত করবেন না।”

“বিদায় না হলে কী করবে?”

রাগিনী চটে গেল। অস্থির হয়ে প্রতিত্তোরে বলল,
“মে’রে দেব আপনাকে।”

“আমি তো অনেক আগেই ম’রে গিয়েছি। বিলীয় হয়েছি তোমার মাঝে।”

রাগিনী এবার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। কর্ণকুহরে সুমধুর সুরের ন্যায় বাজতে থাকে সেই বাক্য। হৃদয়ে খেলে গেল দোল। মূহুর্তেই মনে হলো লোকটা এখনো বিদায় হচ্ছে না কেন? আগের মতো উধাও হয়ে যাচ্ছে না কেন? তবে কি সত্যিই সত্যিই…?
তৎক্ষনাৎ নিজের ডান হাতের পিঠে এক নম্র স্পর্শ অনুভূত হলো তার। নিজের ধূসর গোলাপি বর্ণে মিশ্রিত ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা নির্জন ভালোবাসার স্পর্শ আঁকল রাগিনীর হাতে পিঠে। রাগিনীর শরীর জুড়ে শুরু হলো কম্পন। উঁহু… এটা মিথ্যে নয়। সত্যি! বাস্তব! রাগিনী চোখ বুঁজে ফেলে। আঁখি জুড়ে নামতে থাকে অশ্রু যা সংবরণ করতে থাকে। মানুষটা সত্যিই তবে এসেছে। কেন এসেছে? কী চাই তার? তবে রাগিনীর নির্বোধ মনের বাসনা জাগল বাজে লোকটার কাঁধে মাথা রেখে নিজের সব মনের কথাগুলো উগড়ে দিতে। তা আর হলো কই? চোখ খুলে আর দেখল না লোকটাকে। কই গেলেন উনি? রাগিনী আশেপাশে তাকাল। নির্জন ইতিমধ্যে ফোনে কার সাথে যেন কথা বলতে বলতে হাঁটা লাগিয়েছে করিডোর ধরে। দ্রুত হাঁটছে সে। যেন কত তাড়া! রাগিনী উঠতে চাইল। চিৎকার করে লোকটাকে থামিয়ে দিতে ইচ্ছে করল। তবে ক্লান্ত পা দুটো সায় দিল না। কণ্ঠে শক্তি এলো না। সে মাথা লাগিয়ে ফেলল দেয়ালে। নিস্তেজ হতে থাকল চোখ দুটো।

নিজের ডেরায় ফিরতে বেশ রাত হয়েছে রূপাঞ্জনার। আজকাল এক জায়গায় বন্দি থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে যাবার পরিক্রম হয় তার। বাহিরে গিয়েও তো শান্তি নেই। চোরের মতো লুকিয়ে থাকতে হয় সার্বক্ষণিক। আজ রাস্তায় কয়েকটা পথশিশুকে চোখে পড়েছিল তার। তাদের কারোর হাত নেই। আবার কারোর দুটো চোখ নেই। আরো বিভিন্ন সমস্যায় জ’র্জরিত। রূপার বুঝতে দেরি হয়নি এসব তার আদেশেই করা হয়েছিল একসময়। ঠিক তার আদেশে নয় ডার্ক ম্যাক্সের আদেশে। রূপা তো শুধুমাত্র সেই আদেশ পালন করার গুটি মাত্র। আগে কবির বাচ্চাগুলোর ছবি দেখিয়েছিল তাকে। তাই কিছুটা চিনতে পেরেছে। আজ বাচ্চাগুলোকে দেখে ভেতরটা হাসফাস করছিল তার। সে সত্যিই এতটা নির্দয়া হয়ে উঠেছে? যেখানে শিশুদেরও রেহাই নেই? তবে কিছু করার নেই।

পুরোনো, পরিত্যক্ত যেই কারখানাটা ভূতুড়ে নামে পরিচিত সেখানেই নিজেদের আস্তানা গেঁড়েছে রূপাঞ্জনা এবং তার দলবল। এখানে গতকালই এসেছে। ঘনঘন জায়গা পাল্টাতে হয় নিজেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে। তার জীবনটা তো এমনই। কোথাও সুখ নেই, কোথাও অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্ব থেকেও অস্তিত্বহীনের মতোই বেড়াতে হয়। গরমের মধ্যে হুডি পড়ে থাকাটা অসহ্য! হুডির টুপি মাথা থেকে নামিয়ে দরজা খুলেই চোখে পড়ল কবিরকে। নিজের রি’ভলবারে খুব যত্ন করে বু’লেট ঢোকাচ্ছে সে। পাশেই দুই-তিনজন নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে আছে। এদের আর কাজ কী? অবশ্য রূপাও তো ব্যতিক্রম ছিল না। সারাদিন একই কাজ ছিল। মাতাল হয়ে পড়ে থাকা। কয়েকদিন ধরে ম’দ বা দামি ব্র্যান্ড কাবু করতে পারে না তাকে। রূপাঞ্জনা ধীর পায়ে কবিরের পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে আদেশের সুরে বলল,
“কবির! আমার ঘরে ঠান্ডা পানি আন তো। বাসি হয়ে গিয়েছে ঘরের পানি।”

নিজের ঘরের লোহার দরজার কাছে দাঁড়াল রূপা। নাকে ঠেকল এক বাজে গন্ধ। অনেকদিন পরিত্যক্ত আর অপরিষ্কার হয়ে পড়ে থাকার ফলাফল এটা। রূপার এসব সয়ে গিয়েছে। তবে এখনো কবিরের হেলদোল বা প্রতিত্তোর না পেয়ে বিরক্ত হলো সে। বলল,
“কী হলো? কানে কালা হয়েছিস নাকি?”

কবির তবুও নির্লিপ্ত। রূপাঞ্জনা অবাক। কবির তো তার কথার হেরফের করে না কখনো। কিছু বললে সাথে সাথে হন্তদন্ত হয়ে করে দেয়। রূপাঞ্জনা পিছু ফিরে তাকাল।
“এই শালা কু*! কথা কানে যাচ্ছে না? দেব নাকি কানের নিচে?”

“গা’লিগা’লাজ করছিস কেন ওকে? ভদ্র মেয়ে হয়েছিস না? ভদ্র মেয়েরা বুঝি গা’লি দেয়?”

নিজের শোনা সবচেয়ে ভয়া’নক কণ্ঠস্বর আঁতকে তুলল রূপাকে। কানে কি ভুল শুনল? নাহ! রূপার ঘরের দরজা খুলে দরজায় ঠেস দিয়ে বেশ আয়েশের সঙ্গে সিগারেট ফুঁকছে স্বয়ং ডার্ক ম্যাক্স। ডার্কের শান্তভাব চোখের পেছনে হিং’স্রতা প্রগাঢ় দেখতে পায় সে। রূপা বিস্ময়ে স্থির মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়েছে। যেন কোনো দুঃস্বপ্ন! ডার্ক ম্যাক্স এখানে কী করে? এই পুরো দলের কারোর জানার কথা নয় রূপাকেও কেউ পরিচালনা করে। সুতরাং, ডার্ক ম্যাক্স বলে কোনো অস্তিত্ব বিরাজমান তাও তো কেউ জানার কথা নয়! তবে? রূপা বিস্ময়, অদম্য উচ্ছাস এবং উত্তেজনার সঙ্গে প্রশ্ন করে,
“আ…আপনি আমাদের ডেরায়?”

ডার্ক সিগারেট শেষবারের মতো ঠোঁটে ধরে টেনে তা হাতে নিয়ে তা নিশানা করে রূপার পায়ের কাছাকাছি ফেলতেই চমকে উঠে সরে যায় রূপা। মৃদু হেসে রূপার পাশ কাটিয়ে যেতে যেতেই কবির উঠে দাঁড়ায়। ডার্ক ম্যাক্সের উদ্দেশ্যে বিনীত সুরে বলে,
“সব রেডি, বস!”

“গুড জব! এখন তোদের লেডি বসের থেকে তোকে বেশি বিশ্বাস করা যায়। তোদের লেডি বস তো মুখ ঘুরিয়ে নিলো।”

রূপা তাদের কথোপকথনে আগামাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। তবে বোঝার চেষ্টা করতে থাকল। কিঞ্চিৎ বোধগম্য হলেও পুরোটা হলো না। ভাবনা জগতে মত্ত থাকা রূপাকে চমকে দিয়ে ডার্ক বলল,
“আমার গ্যাং, আমার লোকজনকে একদিন না একদিন তো আমার দর্শন পেতেই হতো রূপা। সেটা আগে হক না পরে। তোর তাগিদে না হয় সেটা আগেই হলো। তোর প্রতি তো বিশ্বাস নেই আর। তাই আমি সবার সামনে এসেছি। সবাই জানে এখন তাদের মাস্টার আমি। স্বয়ং ডার্ক ম্যাক্সের সরাসরি আদেশে এবার কাজ হবে।”

রূপা হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল। এজন্যই কবির তাকে পাত্তা দেয়নি। এতদিন যার আদেশে মেনে এসেছে সে এখন সকলের কাছে তুচ্ছ! রূপা উদগ্রীব হয়ে কিছু বলতে চাইল,
“আমি…”

“তোরে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তুই আমার দাবা কোর্টের হেরে যাওয়া একটা গুটি যে কোনো কাজে লাগে না।”

রূপা মাথা নুইয়ে ফেলল। তবে রাগ হচ্ছে ভীষণ। রাগের কারণ সে জানে না। ডার্ক তার জায়গা থেকে ঠিক। তার বিশ্বাস না করার কারণটাও ঠিক। এতদিন পর হুট করেই কারোর কথার খেলাপ করাটা রূপার সাজে না সেটা রূপা নিজেও জানে। কিন্তু! মনের মাঝে যে তৈরি হওয়া অদম্য ‘স্বাধীনতা’ নামক শব্দটি বেশ উথালপাতাল করছে। এই ভয়’ঙ্কর হিং’স্র জা’নোয়ারের সঙ্গে কাজ করা যেন নিজের গলায় নিজে শি’কল বেঁধে রাখার মতোই। সে স্বাধীনতা একদিন অনুভব করেছিল। অভিরূপের সাথে। ওই নৌকাতে! খোলা আকাশের নিচে, অবাধ্য বাতাসের মাঝে। সেদিন যেন ছিল প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেবার মতো দিন। ঠিক সেদিন থেকে মন টিকতে চায় না এই জীবনে। শুধু পালাই পালাই করে। এজীবন যেন কিছু মূহুর্তের জন্য অসহনীয় মনে হয়! তবে মুক্তি পাওয়ার কি কোনো পথ সে আদেও খোলা রেখেছে?

“ভাবিস না। তোকে ফে’লেও দেব না। তোকে আমার দরকার। যতই ইউজলেস হয়ে যাস না কেন! তোকে খুব দরকার।”

রূপা মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। সে জানত ডার্ক এমন কথাই বলবে। রূপার এত সহজে নিস্তার নেই এটা সম্পর্কে সে অবগত। নিস্তার পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো মৃ’ত্যু। তবে সকলের প্রস্তুতি দেখে কিছুটা অবাক হয়েই প্রশ্ন করল,
“কীসের প্রস্তুতি নিচ্ছেন আপনারা? কোনো প্ল্যানিং আছে আপনাদের?”

কেউ তার কথার কোনো জবাব দিলো না। রূপার ভেতর ভেতর রাগ হলেও প্রকাশ করল না। ডার্ক ম্যাক্স নিচে পড়ে থাকা বড় গা’ন তুলে রূপাঞ্জনার দিকে তাক করে এক চোখ বন্ধ করে বলল,
“তা তো অবশ্যই। তোর প্ল্যানিং এর আশায় বসে থাকলে কি আমাদের দিন চলবে নাকি? ঢাকায় কী কারণে এসেছিলাম সেটা তুই ভুললেও আমি ভুলিনি ইভেন আমার পুরো টিমকেও ভুলতে দিই নি। চট্টগ্রামের সকলের সামনে অজানা হয়েই চ্যালেঞ্জ ছুঁ’ড়ে দিয়ে এসেছিলাম ঢাকাকে পরিণত করব মৃ’ত্যুপুরী।”

রূপাঞ্জনা তপ্ত শ্বাস ফেলল। মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে লাগল প্রথমেই অভিরূপ নামক ব্যক্তিটির কথা। তবে কি টার্গেট অভিরূপ চৌধুরী? কিলবিল করে উঠল মনে থাকা প্রশ্নগুলো। তাই আবারও জানতে বলল,
“টার্গেট কী? অন্তত এতটুকু তো জানতে পারি? সেই অধিকার নিশ্চয় হারাই নি?”

ডার্ক বেশ সহজ গলায় বলল,
“শুনলাম রাগিনীর বাপটা হার্ট অ্যা’টাক করে হসপিটালে পড়ে আছে। সেই কারণে তোর পেয়ারের অভিরূপও নিজের সেফটি জোন থেকে বেরিয়ে হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি করছে। কথা সত্য?”

রূপাঞ্জনা আঁতকে তাকাল। ডার্ক বেশ উপভোগ করল রূপার আঁতকে ওঠা। সে হাসি বাড়াল। রূপার হৃৎস্পন্দনের গতি বাড়তে বাড়তে যেন বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। কবে হলো এই ঘটনা? তবে কি টার্গেট অভিরূপ? না চাইতেও সে মুখ ফসকে বলে দিলো,
“উনিই আপনার টার্গেট?”

“হ্যাঁ। না হওয়ার কী আছে? আমি যাকে টার্গেট করি সেটা তো কখনো মিস যায়নি। তাছাড়া ও তোকে বাঁচিয়েছে। সেকারণে তুই ওকে বাঁচাচ্ছিস। যাকে ইংরেজিতে বলে, গিভ অ্যান্ড টেক। এতে আমাদের বেনিফিট কী? আমরা কেন টার্গেট থেকে সরে আসব।”

রূপাঞ্জনার মুখ চুপসে গেল। বিমূঢ় হয়ে পড়ল মূহুর্তেই। হাত মুঠো করল। বুকের মাঝে অস্থিরতা তড়তড় করে বেয়ে যেন মাথা থেকে পা অবধি ছড়িয়ে পড়ল। তার কী করা উচিত?

সিটে একভাবে মাথা লাগিয়ে ঘুমাচ্ছে রাগিনী। কোনো হুঁশ নেই তার। লোকজনের সরগম ঘটেছে হসপিটালে। কর্ণকুহর অবধি পৌঁছাচ্ছে না শোরগোল। তার হাতে যখন ঝাঁকুনি অনুভূত হলো নড়েচড়ে উঠল ঘুমের মাঝেই। একহাত দিয়ে ঢাকল নিজের মুখ। ঘুম হালকা হতেই কানে ভেসে এলো চিকন মিষ্টি পুরুষালী কণ্ঠ।
“খোলা চোখখানা করো বন্ধ
বাতাসের ঠান্ডা গন্ধ,
বয়ে বেড়ায় ঘরেরও বাহিরে।
আসো ছোট্ট একটা গান করি
যাতে ঘুম পাড়ানি মাসী এসে পাশে
বসে হাতখানা দিবে কপাল ভরে…!”

কণ্ঠে মেশানো সুরটা বেশ মুগ্ধকর। আপনাআপনি চোখ খুলে গেল রাগিনীর। সোজা হয়ে বসে চোখে আশপাশটাতে পড়তেই চোখমুখ দুহাত দিয়ে মুছে নেয় রাগিনী। পাশ ফিরে তাকাতেই নজরে আসে অভিরূপের হাস্যমুখর চেহারা। রাগিনী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে আকস্মিক হাসি দিতেই অভিরূপ বলে,
“ঘুম ভেঙেছে তাহলে?”

“এমন করে গান গাইলে সকলেরই ঘুম ভেঙে যাবে।”

“খুব খারাপ গাইছিলাম?”

রাগিনী মাথা নাড়ায়। অতঃপর জোর গলায় উত্তর দেয়,
“উঁহু না। সুন্দর গাইছিলেন জন্যই তো ঘুম ভাঙলো। কয়টা বাজে?”

অভিরূপ আন্দাজ করে বলে,
“এই প্রায় সাড়ে আটটা!”

তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায় রাগিনী। পায়ের জুতোটা সামলে নিয়ে পড়তে পড়তে বলে,
“এত দেরি হয়ে গিয়েছে! বাবাকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে তো।”

“রিল্যাক্স, রিল্যাক্স! উনি খাওয়া শেষ করে মেডিসিনও নিয়ে নিয়েছেন। এখন নিজের দিকে তাকাও।”

শান্ত হলো রাগিনী। অভিরূপের কথা বোধগম্য হলো না। বোকা বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তৎক্ষনাৎ অভিরূপ বলল,
“আমি জানতাম মেয়েরা ঘনঘন ড্রেস চেঞ্জ করতে ভালোবাসে। তুমি তো দেখছি পুরোটাই আলাদা। ছেলে হতে গিয়ে মেয়ে হয়ে গিয়েছ নাকি?”

থতমত খেয়ে উদ্ভট নজরে তাকায় রাগিনী। কী বলছে লোকটা? এটা কেমন কথা? তার এমন চাহনিতে অভিরূপের বোঝার বাকি থাকে না সে অযাচিত কিছু বলে বসেছে। আবার তাকে রাগের চোটে পে’টাতে না শুরু করে। নিজের মুখ সামলে বলে ওঠে,
“আই মিন তুমি যেমন সাহসী, তেমনই ফাস্ট গার্ল। তাই বলছিলাম।”

রাগিনী প্রতিত্তোরে কিছু বলল না। ঘুমটা যেন কমপ্লিট হয়নি। হাই তুলল একবার। তখনি অভিরূপ বলল,
“আমি আর নোমান তো এসে গিয়েছি। তুমি বরং গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো বাড়ি থেকে। আমি আর নোমান আঙ্কেলের কাছেই আছি।”

বেশ দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলো রাগিনীর মনে। একে তো এই অতিথি মানুষটি আসার পর থেকে একের পর এক ঝামেলাই পড়ছে। তার ওপর এই বাবার খেয়াল রাখার ঝামেলাটা চাপিয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে? রাগিনীর মৌনতায় অভিরূপ ভ্রু কুঁচকায়। আর ক্ষীণ সুরে বলে,
“আঙ্কেলের খেয়াল রাখতে পারব না এমন ভাবছ না তো?”

“না, না। আমি তো আপনাকে এসব ঝামেলায় জড়াতে চাইছিলাম না।”

“কীসের ঝামেলা? এক্সকিউজ মি, ম্যাডাম! হি ইজ মাই আঙ্কেল। আই নো হি ইজ ইউর ফাদার। বাট হি ইজ মাই আঙ্কেল অলসো!”

রাগিনী বুঝে গেল অভিরূপের কথার সাথে পারার ক্ষমতা তার নেই। তাই শুধু শুধু কথা বাড়তি করে লাভ নেই। তারও বাড়ি গেলে ভালোই হয়। নিজেকে ফ্রেশ করা দরকার! সে রাশেদ সাহেবের সঙ্গে কথা বলেই চলল নিজের বাড়ি। রয়ে গেল নোমান আর অভিরূপ।

সিটি হসপিটালের বাহিরে হুড়মুড়িয়ে অটো থেকে নামল রূপাঞ্জনা। পরনে বাধ্য হয়ে লং গোলাপী কামিজ আর বড়ো কালো ওড়না। নেমেই ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত পা চালাতেই পায়ের নিচে ওড়না পড়তেই মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়তে পড়তে নিজেকে সামাল দিলো সে। বিরক্তির ‘চ’ শব্দের ন্যায় উচ্চারণ করে কোনোরকমে গলায় পেঁচিয়ে নিলো ওড়না। বিলম্ব না করে ঢুকল হসপিটালে। রাশেদ সাহেবকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। কেবিন নম্বর জেনে তাড়াহুড়ো করে ছুটল সেখানে রূপা। আত’ঙ্কের শেষ নেই। কিছুক্ষণ আগেই ডার্কের তৈরি করা মাস্টার প্ল্যান এক্সকিউট করতে নেমে পড়েছে তার টিম। আর রূপার ধারণা মতে তাদের লক্ষ্য অভিরূপ! নিজেকে আটকাতে চেয়েও তা না পেরে মনের কথা অনুযায়ী ছুটে এসেছে হসপিটালে। সে পারছে না নিজেকে শান্ত রাখতে। সে জানে এর পরিণামটা ঠিক সুবিধার নয়। তবুও অবাধ্য, দুর্বার মনটা কী চায় সে নিজেই বোঝে না। বুঝলেও সফল হতে পারে না!

হুড়মুড়িয়ে কেবিনের দরজা খুলতেই কেবিনে থাকা সকলেই চমকে তাকাল রূপাঞ্জনার দিকে। পরক্ষণেই নিজেকে ধাতস্থ করল রূপাঞ্জনা। মুখটা স্বাভাবিক করার চেষ্টায় থাকল। কেউ তাকে আবার ধরে ফেলবে না তো? ইনিয়েবিনিয়ে তার চোখ যখন চকলেট কালার শার্টে আবৃত এক পুরুষকে অ’ক্ষত অবস্থায় দেখল তখন মন এবং চক্ষু দুটোই শান্তিতে ছেয়ে গেল। মুখ পুরে বেরিয়ে এলো স্বস্তির শ্বাস। মাথায় প্রশ্ন এলো, এত ব্যাকুলতা, আকুলতার কীসের তরে? ইহা শুধুই কী সামান্য বাঁচানোর বদৌলতে বাঁচানো? নাকি পাথরের ন্যায় মনটার উপরের আবরণ খানি ভেঙে পরিলক্ষিত হচ্ছে নারী মনটা?

“আঙ্কেল! শুনতে পাচ্ছেন? বলছিলাম যে আপনার মেয়েকে আপনি সবদিক থেকেই পারফেক্ট করে তৈরি করেছেন দেখছি!”

পিটপিট করে তাকালেন রাশেদ সাহেব। অতঃপর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন অবিকল রাগিনীর ন্যায় দেখতে মেয়েটাকে। যাকে দেখে যে কারোর ভুল হতে পারে। অভিরূপ ফের বলল,
“আগে জানতাম অলওয়েজ লেডিস ফার্স্ট সেটা শুধু ডায়লগেই বলে। আপনার মেয়ে ফার্স্ট হয়ে নারী জাতির এই ডায়লগের মর্মার্থ কিন্তু ধরে রাখতে পারল!”

রূপা থতমত খেয়ে চেয়ে থাকে। কীসব বলছে লোকটা? মাথায় নিশ্চয় কোনো স্ক্রু ঢিলে আছে। সে সবটা জেনেই হসপিটালে পা রাখার সাহস দেখিয়েছে। সে রাগিনীর মুভমেন্টের প্রতিটা খবর জানে। তাই তো সুযোগ খুঁজছিল। আর সেই সুযোগ সে পেয়েও গিয়েছে। হাতছাড়া করেনি। দরজা হালকা ভিড়িয়ে দিয়ে ভেতরে এলো রূপা। এই প্রথম সে রাগিনীর বাবার মুখোমুখি হয়েছে। আচ্ছা নিজের মেয়েকেও কি উনি চিনতে ভুল করবেন? নাকি ধরে ফেলবেন? ধরে ফেললে তো সমস্যা! কথায় বলে, র’ক্তের সম্পর্ক চিনতে ভুল হয় না। তাই রাশেদ সাহেব ধরে ফেললেও খুব একটা অবাক হবে না রূপা। তাই সে রাশেদ সাহেবের কাছাকাছি না গিয়ে দূরেই দাঁড়িয়ে রইল।

রাশেদ সাহেব মেয়েকে দেখে কিছুটা নম্র সুরে বললেন,
“তোমায় যা বলেছিলাম গতকাল! এবার শুধু আমি একা একা তোমার জন্য চিন্তা করব না। আমি চিন্তা করার জন্য আরেকটা সঙ্গী আনছি।”

নোমান উনার কথার মাঝপথে ব্যঙ্গ করে বলল,
“অভিরূপ কিন্তু চিন্তা করার মানুষ একদমই নয় আঙ্কেল। তবে আমি চাইলে আমি ওকে জোর করে চিন্তা করাতে পারি।”

অভিরূপ নোমানের কথায় ফোঁড়ন কেটে বলে,
“শাট আপ! কে বলেছে আমি চিন্তা করতে পারি না? আমি আরেকটু হলে আঙ্কেলের চিন্তায় হার্ট ফেল করে বসতাম। তোর মতো নাকি?”

“সেই! আমার মতো হলে তো চিন্তা ছিল না। আমার মতো নয় বলেই সমস্যা।”

অভিরূপ তড়িঘড়ি করে আরো কিছু বলতে চাইল। তবে তার আগেই রাশেদ সাহেব মেয়ের নীরবতা দেখে জিজ্ঞেস করে উঠলেন,
“কী হয়েছে রাগিনী? কোনো সমস্যা মা?”

রূপার ভেতরটা কেমন যেন করছে এবার। নিজের কানে ‘মা’ শব্দটি ভেসে আসার পর বাড়ল উতলা মনের অস্থিরতা। এই প্রথম কারোর থেকে এভাবে ‘মা’ ডাকটি শুনেছে সে। এই প্রথম কেউ আদর করে ডেকেছে তাকে। উত্তর না দিয়ে কী করে থাকবে? সে তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো,
“না, বাবা।”

কথার শেষে বাবা শব্দটি বলে নিজেই থমকালো রূপা। রাজ্যের অস্থিরতা ঘিরে ধরল তাকে। দরদর করে ঘামতে আরম্ভ করল এসি রুমেও। কখনো কারোর মুখ থেকে আদুরে গলায় ডাক না শোনার পর আজ যখন প্রথমবার কেউ তাকে মা বলে নিজের মেয়ের মতো ডাকল তখন নিশ্চল হয়ে পড়ল শরীরের প্রতিটা অঙ্গ। কোথাও একটা হৃদয়ের সমস্ত ভালো লাগা গিয়ে জমা হলো। এ যেন অত্যন্ত স্নিগ্ধ অনুভূতি। রাগিনী মেয়েটা সত্যিই অনেক ভাগ্যবতী! যাকে সকলে এত ভালোবাসে। যার বাবা তাকে এত ভালোবাসে। নিশ্চয় তার জীবনটা সুন্দর! রূপার মতো ছন্নছাড়া নয়।
“একটু পানি এগিয়ে দাও। তৃষ্ণা পেয়েছে।”

রাশেদ সাহেবের এমন কথায় রূপা এতটাই উতলা হলো যেন এটা তার নিজেরই বাবা। সে দ্রুত টেবিল থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে পানি ঢেলে দিতে গেল রাশেদ সাহেবকে। তবে অতিরিক্ত অস্থিরতা এবং তাড়াহুড়োতে সফল হলো না সে। ফলস্বরূপ কাঁপা হাত থেকে পড়ে গেল কাঁচের গ্লাস নিচে। বিকট শব্দ হলো। কাঁচ ভেঙে চারিদিকে ছিটিয়ে পড়ল। পানি গড়িয়ে পড়ল আশেপাশে। সকলের দৃষ্টি তখন ফ্লোরে। রূপাঞ্জনা তখন যেন দিশেহারা। কী করতে গিয়ে কী করে ফেলছে? নিজেরই কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে হলো তার। রাশেদ সাহেবও নিচে গ্লাস পড়ে যাওয়ার সেদিকে তাকালেন। হতবাক হলেন অন্যকিছুতে চোখ পড়তেই। স্থির নয়নে কিছু মূহুর্ত চেয়ে থাকতেই দম বন্ধ লাগল উনার। হাসফাস করতে থাকল। বিছানায় টলে পড়লেন। আকস্মিক ঘটনায় উপস্থিত সকলে চরম বিস্মিত। হঠাৎ কী হলো রাশেদ সাহেবের? নোমান দেরি না করেই ছুটল কেবিনের বাহিরে ডক্টরকে ডাকতে। রূপা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। হঠাৎ এমন হবার কারণ উপলব্ধি করতে পারল না। হঠাৎ করেই সে নিজের পায়ের দিকে তাকাল। তার পায়ে হালকা উঁচু হিল। তবে ডান পায়ে ছয়টা আঙ্গুল স্পষ্ট দৃশ্যমান। রূপা না চাইতেও নিজের মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরল। তাহলে এটাই উনার এমন অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কারণ? উনি ধরতে পেরেছেন রূপা রাগিনী নয়? কেন আগ বাড়িয়ে পানি দিতে গেল সে?

ডক্টর ইরশাদ ছুটে কেবিনে প্রবেশ করলেন। দেরি না করেই বুকে চাপ দিতে আরম্ভ করলেন। নার্সকে বললেন ইনজেকশন রেডি করতে। অভিরূপ সবকিছুর মাঝে কী করবে ভেবে পেল না। স্তব্ধ হয়ে থাকা রূপাঞ্জনার হাতটা ধরে বাহিরে নিয়ে এলো। রূপাঞ্জনার ফোনের মেসেজ টোনটা বেজে উঠতেই চকিতে তাকিয়ে পার্স থেকে ফোন বের করল সে। অভিরূপের অশান্ত মুখে পানে চাইল একবার। একটু সরে এসে মেসেজ ওপেন করতেই একটা মেসেজ ভেসে উঠল ফোনের স্ক্রিনে।
‘মিশন কমপ্লিট! সিলি গার্ল! অভিরূপকে বাঁচাতে দৌড় দিয়েছিস। কিন্তু আমার টার্গেট তো অভিরূপ চৌধুরী নয়।’

হাফ ছাড়ল রূপা। তবে টার্গেট কী ছিল? মাথায় এলো না। সেসব নিয়ে মাথাও ঘামাল না। ফোনটা জোরে চাপ দিয়ে ধরে বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলল,
“সব ধ্বংস হক তোর হাতে ডার্ক ম্যাক্স! শুধু ওই পাগল মানুষটা অক্ষত থাক।”
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৯

হসপিটালের ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে রূপাঞ্জনা। তার থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে রেলিং চেপে দাঁড়িয়ে রয়েছে অভিরূপ। দুজনেই চুপচাপ। মুখে নেই কথা। অভিরূপের হাতে কীসের যেন চা! ওয়ান টাইম গ্লাসে মাঝে মাঝে লাগাচ্ছে নিজের সুন্দর ওষ্ঠদ্বয়ের চুমুক। আজ সূর্যের তেজটা কম। রোদ কম ছড়াচ্ছে। মেঘের উড়ে বেড়ানোর সংখ্যা বেশি। বাতাসের বেগটাও বেশি। এত বড়ো ভবনের ছাঁদে হাওয়ার পরিমাণ যেন স্বাভাবিকের চেয়ে আরো অনেকটাই বেশি। মাঝে মাঝে সূর্যের কিরণে চোখমুখ কুঁচকে আসছে রূপাঞ্জনার। বায়ুর মাত্রা বাড়তেই ক্লিপ থেকে খুলে খুলে আসছে রূপার ছোটো চুলগুলো। তড়িঘড়ি করে সেসব ক্লিপে আটকাতে চাইল রূপা। অভিরূপের কণ্ঠসুরে এবার ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় সে।
“আঙ্কেল এখন ভালো আছে টেনশন নিও না। উনি এত দ্রুত তার আদরের মেয়েকে রেখে কোথাও যাবেন না।”

রূপাঞ্জনা চুলগুলো ক্লিপে আঁটকে ছোট্ট করে জবাব দিল, ‘হুমম।’
সে নিজেও চিন্তিত ছিল। মূহুর্তে মূহুর্তে ভেবে যাচ্ছিল এই মানুষটার আবার কিছু হবে না তো? যদিও কিছু একটা হয়েই যেত তাহলে একটা মেয়ে তার বাবাকে হারাত। বিষয়টা রূপার ভালো লাগত না। রূপার কাছে সবচেয়ে দুর্বল দুটো শব্দ হচ্ছে মা আর বাবা। এই দুটো মানুষের প্রসঙ্গ যখন আসে তখন সে ভেতরে ভেতরে তড়পে ওঠে। কারণটা হয়ত ছোটোবেলা থেকে নিজের এই আপন মানুষগুলোকে কাছে না পাওয়া। অভিরূপ আবারও বলল,
“একটা কথা এখনো বুঝিনি আঙ্কেল ভালোই তো কথাবার্তা বলছিলেন তাহলে হঠাৎ এমন হাইপার হলেন কেন?”

থতমত খেয়ে রূপার পা গেল নিজের পায়ের দিকেই। তার পায়ের ছয়টা আঙ্গুল! পরক্ষণেই দৃষ্টি সরিয়ে ভবনের নিচে মেইন রাস্তার দিকে তাকাল সে। আনমনে দেখতে লাগল ব্যস্ত যানবাহনের ছোটাছুটি। অভিরূপও চুপ হলো এবার। মনে মনে একটা কথা বলার জন্য উসখুস করছে। শত সংকোচ কাটাতে সাহায্য করে তার গান, তার গলার সুর। ফট করে বলল,
“গান শুনবে?”

চকিতে তাকাল রূপা। কী বলবে বুুঝতে না পেরে শুধু মাথা ঝাঁকাল। রূপাকে এমন মনমরা দেখে অভিরূপ একটু ব্যতিব্যস্ত হলো। মেয়েটাকে একটু চঞ্চল করতেই তো তার যত কারসাজি! অভিরূপ এবার উপায়ে উপায়ন্তর না পেয়ে খপ করেই রূপার ডান হাতটা ধরে নিয়ে হেঁচকা টানে। তার এমন আচরণে লোচন দুটো বড়ো বড়ো হলো রূপার। কী করতে চাইছে এই ছেলে? আঁতকে উঠল রূপা। অভিরূপ অন্যহাতটা নিজের বুকের বাম পাশে রেখে গানের সুর তুলে বলল,
“তোমায় হৃদমাঝারে রাখব, ছেড়ে দেব না।
ওরে ছেড়ে দিলে সোনার গৌড় আর পাবে না
ক্ষ্যাপা ছেড়ে দিলে সোনার গৌড় আর পাবে না, না, না,না,
ছেড়ে দেব না।”

রূপাঞ্জনা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার হাতটা উঁচু করে ধরে তাকে গোল করে ঘোরাতে শুরু করল অভিরূপ। মেয়েটার বিস্মিয়ে ভরা ফ্যাকাশে চেহারা দেখতে বেশ মজা পেল সে। এই দৃশ্য সারাজীবন দেখতে পেলে মন্দ হয় না! মুগ্ধ হয়ে সে গেয়ে উঠল,
“তোমায় হৃদমাঝারে রাখব, ছেড়ে দেব না।
তোমায় হৃদমাঝারে রাখব, ছেড়ে দেব না!”

থামল অভিরূপ। ছাড়ল রূপার হাত। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল রূপা। এবার তার দিকে ঝুঁকে অভিরূপ বলল,
“কোনো তো রিয়েকশন দাও!”

“মানে?”

“হাসো, রাগো, বিরক্ত হও। কিন্তু মনমরা হয়ে থেকো না। তোমায় বিশেষত রাগানোর জন্যই এভাবে উইদাউট পারমিশন হাত ধরে রাউন্ড করে ঘুরিয়েছি। রেগে রেগে তাকাও। আমি ম্যানেজ করে নেব তোমার চোখের আগুন। কিন্তু চোখের পানি আমার সহ্য হবে না।”

রূপাঞ্জনা অভিরূপের এমন অদ্ভুত কর্মের কারণটা জেনে আরো বেশি হতবাক হলো। নিজেকে ধাতস্থ করে তৎক্ষনাৎ জবাব দিল,
“আমি মনমরা হয়ে নেই। একদম ঠিকঠাক আছি।”

“তুমি কি বহুরূপী?”

আচমকা অভিরূপের অযাচিত সত্য কথায় হকচকিয়ে উঠল রূপাঞ্জনা। তবে কি মানুষটা চিনে ফেলল তাকে? মুখে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্কের রেশ। দেখতে পেল সন্দিহান হয়ে চেয়ে আছে অভিরূপ। আমতা আমতা করে রূপা জিজ্ঞেস করল,
“মা…মানে? কেন?”

“কেন আবার! কখনো তোমায় সাহসী দেখি! কখনো বা ভয়ংকরী! আবার কখনো নমনীয় তুলোর মতো। কখনো একেবারেই ভীতুর ডিম। তুমি যেন একটা মানুষ নও, একের ভেতর সব একটা গাইড।”

রূপাঞ্জনা এবার স্বস্তি পায়। প্রতিত্তোরে বলে,
“এই আপনার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে কীসে মানায়?”

“প্রথম যেই রূপে তোমায় দর্শন করেছিলাম। সাহসিনী! ভয়ংকরী চাহনি! সেই চোখে আস্ত একটা দাবা’নল দেখে ফেলেছিলাম। সেটাই আমার খুব প্রিয়।”

অভিরূপ নিঃসঙ্কোচে বলে দিল। রূপাও সঙ্গে সঙ্গে বলল,
“তবে ধরে নেবেন সেটাই আমার আসল রূপ, আমার আসল ব্যক্তিত্ব।”

“তোমার সেই ব্যক্তিত্বকেই আমি ভালোবাসি।”

রূপাঞ্জনার মনে খেলে গেল উত্তাল হাওয়া। দম বন্ধ হওয়া এক অনুভূতি আঁকড়ে ধরল তাকে। এ যেন ডার্কের অত্যা’চারের থেকেও বেশি পীড়া দেয়। নিজের ওড়না মুঠো করে ধরে বলল,
“কী?”

অভিরূপ নিজেই চমকালো এবার। সে পাগল হয়ে গিয়েছে। কোনো প্রস্তুতি বা কোনো ইঙ্গিত না দিয়েই সরাসরি ভালোবাসি? উঁহু, প্রসঙ্গ পাল্টানো দরকার! সে ঢক গিলে বলল,
“আঙ্কেল আমার ব্যাপারে তোমায় কিছু বলেছে?”

বোধগম্য হলো না রূপার। বোকা বোকা দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। বলল,
“কীসের ব্যাপারে?”

অভিরূপ সাহস করে বলে দিল,
“সহজ ভাষায় উনি এবার চিন্তামুক্ত হতে চান। মানে তোমার দায়িত্ব আমার কাঁধে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাইছেন। সোজা কথা, আমাকে উনি আমাদের বিয়ের কথা বলেছেন। তোমার আপত্তি না থাকলে বিষয়টা এগোবে।”

বাকরুদ্ধ হলো রূপাঞ্জনা। তার মানে রাগিনী আর অভিরূপের বিয়ে! রূপার ভালো লাগার কথা। সে মনটাকে ভালো লাগানোর চেষ্টা করল। তবে হয়ে উঠল না। নিজের হাতটা বাড়িয়ে অভিরূপের হাত ধরে বোকামি করে বলল,
“ওহ বিয়ে! কংগ্রাচুলেশনস!”

অভিরূপ হাত মেলাতে মেলাতে অন্যহাত দিয়ে মাথা চুলকে বলল,
“এই প্রথম দেখলাম কোনো বিয়ে তার নিজের বিয়েতেই তার উডবিকে কংগ্রাচুলেশনস জানাচ্ছে।”

সঙ্গে সঙ্গে হাত ছাড়িয়ে নিলো রূপা। এক মূহুর্তের জন্য যেন ভুলতে বসেছিল সে এখন অন্য এক ব্যক্তিত্বের অভিনয়ে রয়েছে। এখানে থাকলে বার বার এমন ভুল হবে। দ্রুত কোনোভাবে চলে যাওয়া দরকার! রাগিনীও যেকোনো মূহুর্তে চলে আসতে পারে! ঠিক নেই। হন্তদন্ত হয়ে একটা পরিকল্পনা বের করে বলল,
“আপনি যেই চা পান করছিলেন আমার জন্য একটু হবে? গলা শুকিয়ে যাচ্ছে আরকি!”

“হুয়াই নট। ক্যান্টিনে যাচ্ছি আর আসছি। কোথাও যেও না।”

অভিরূপ চলল রূপাঞ্জনার পাশ কাটিয়ে চা নিতে। হাঁটার মাঝে থেমে ঘাড় বাঁকিয়ে বলল,
“বললে না তো কোনো আপত্তি আছে কিনা এই সম্পর্কে! তুমি বললে বিয়েটা নিয়ে আর একটা কথাও উঠবে না।”

রূপাঞ্জনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রাগিনী এই প্রশ্নে কী জবাব দিত? নিজের বাবার এই প্রস্তাবে না করত না নিশ্চয়ই! তবে ওই পুলিশের লোক কোহিনূরের সঙ্গে তার যে সম্পর্কের গভীরতা? তার কী হবে? ফের ভাবল, এত জেনে তার কী? থমথমে গলায় বলল,
“হয়ত নেই।”

“চা আনতে আনতে সিউর হয়ে নাও আপত্তি আছে কিনা! আই ওয়ান্ট গ্যারান্ট অ্যান্ড ওয়ারেন্টি।”

অভিরূপ আর উত্তরের জন্য দাঁড়াল না। চলে গেল। সে যাওয়ার কিছুটা পরেই হনহনিয়ে নিচে নেমে চলে গেল রূপা।

‘ব্রেকিং নিউজ! শহরে লেগে তো রয়েছেই একের পর এক আত’ঙ্ক। নিরাপদে নেই কেউই। এইসব কিছুর মাঝে আবারও নতুন এক বিপদের সূচনা। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা, বর্ণনীল ব্যাংকে ভয়া’নক ডা’কাতি হয়েছে। ডা’কাতের দল ছি’নিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। সেই সঙ্গে প্রাণ গি’য়েছে দুজনের। আ’হত তিনজন। তাছাড়া সেখানে উপস্থিত থাকা সব মানুষের শ্বাসকষ্ট উঠে গিয়েছে। পুলিশ ইনভেস্টিগেট করে এতটুকু জানতে পেরেছে যে কোনো কেমিক্যালের ব্যবহার হয়েছিল সেখানে। ফলে হয় কেউ কেউ জ্ঞান হারায় আর নয়তবা শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। টেরো’রিস্ট অ্যা’টাকের পর এই ডা’কাতি যেন আমাদের পাঁচ বছর আগের সেই ভয়া’নক আত’ঙ্কবাদীর কথা মনে করিয়ে দেয় যারা পুরো শহরটাকে নিঃ’স্ব করার মি’শনে উঠেপড়ে লেগেছিল। কে আছে এসবের পেছনে? পুলিশ টিম, গোয়েন্দা বিভাগ কারোরই সাধ্য হয়ে উঠছে না আত’ঙ্কবাদীদের ধরার। তার উপর এই হা’মলা কি তারা সামলাতে পারবে?’

ফোনের স্ক্রিনে এই সংবাদ শুনতে বি’ষের ন্যায় লাগল নির্জনের কাছে। নিজের ক্রো’ধ আর নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে উঠল না তার। ফোনটাকে বেশ রূঢ়ভাবে ছিটকে ফে’লে দিলো ফ্লোরে। ফোনের বিভিন্ন পার্টস খুলে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। সেটাতেও ক্ষ্যান্ত হলো না নির্জন। উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলে থাকা সমস্তকিছু একহাতেই ঝটকা দিয়ে ফে’লে দিতেই মেহরাজ এলো। বিকট শব্দে সে নিজেও চমকে উঠে নিজের মুখ ঢাকল। বলা তো যায় না তার মুখচোখেও কোনদিক থেকে আ’ক্রমণ হয়! উঁকি দিয়ে দেখল নির্জন টেবিলে দুটো হাত রেখে নিচু হয়ে চোখ বন্ধ করে রয়েছে। রাগে মৃদু কাঁপছে। মেহরাজ ঢক গিলে মিনমিন করে বলল,
“স…স্যার…”

নির্জন মাথা উঠিয়ে চোখ মেলে তাকাতেই আঁতকে উঠল মেহরাজ। এই মূহুর্তে এখান থেকে কেটে পড়ায় শ্রেয় মনে হলো তার কাছে। যেন সে ভুল সময় এসে পড়েছে। তড়িঘড়ি করে পেছন ফিরে বলল,
“সরি স্যার। আমি অন্যসময় আসছি।”

নির্জনের বিরক্তি আকাশ ছোঁয়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“যেতে বলেছি তোমায়? কী বলবে বলো!”

নির্জনের কথায় আর বাহিরে বের হওয়ার সাহসটা পায় না মেহরাজ। ফিরে এসে টেবিলে একটা ফাইল রেখে বলে,
“এখানে একটা ডক্টরের ডিটেইলস আছে স্যার।”

“কোন ডক্টর? কীসের ডক্টর?”

“ওইযে, আপনাকে বলেছিলাম না? আমরা খোঁজ পেয়েছি সেই ডক্টরের যে নকল রাগিনীর সার্জারি করে আসল রাগিনী ম্যাডামের মতো হয়েছেন।”

এবার টনক নড়ে নির্জনের। ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“হু। তার খোঁজ পেয়েছো?”

“ইয়েস স্যার। কিন্তু আপনার কথা অনুযায়ী আমরা ইন্ডিয়ার পুলিশ টিমের সাহায্য নিই। কারণ এটা জানা যে বাংলাদেশ এখনো প্লাস্টিক সার্জারি বিষয়ে এতটাও উন্নত নয় যে একজনের চেহারা হুবহু বসিয়ে দিতে পারবে। আর কাজটা ইন্ডিয়াতেই হয়েছে। ইন্ডিয়ার পুলিশ টিম ধারণা করেছে বাংলাদেশ থেকে চো’রা ভাবে তারা ইন্ডিয়ায় গিয়েছিল। কারণ এই নিয়ে অনেক কথা উঠেছিল তখন। কিন্তু প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এইটা হচ্ছে ডক্টরের ডিটেইলস।”

নির্জন ফাইলটা ধরে ঘাঁটল। ফের ডা’কাতির কথা স্মরণে আসতেই ফাইল হাতে ধরেই প্রশ্ন করল,
“সাংবাদিকদের কথা অনুযায়ী এই ডা’কাতি, আত’ঙ্ক বর্তমানে রিপিট চলছে। মানে এর আগেও এমন কিছু ঘটেছিল। আচ্ছা, এসপি স্যার বলছিলেন না? পাঁচ বছর আগেও একটা ডেঞ্জারাস স’ন্ত্রাসের দল পুরো শহরকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল! সেই টিম সম্পর্কে কিছু জানো তুমি?”

“না স্যার। তবে এটা জানি যে ওই টিমের ধ্বং’স তো অনেক আগেই হয়ে গিয়েছিল। ওই মাস্টারমাইন্ড তো ম’রে গিয়েছিল। তাই না?”

“কী নাম ছিল সেই মাস্টারমাইন্ডের?”

মেহরাজ মাথা চুলকায়। এত কিছু তো তার মনে নেই। নির্জনের কৌতূহল বাড়তে থাকে। মেহরাজের মুখভঙ্গিতে বুঝতে পারে সে এতকিছু জানে না। তাই বলল,
“আগেকার ইনফরমেশন, ফাইলস্ যেই রুমে জমা থাকে সেখান থেকে পাঁচ বছর আগে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা সম্পর্কে যত ইনফরমেশন কালেক্ট হয়েছে সেটার ফাইল নিয়ে এসো। ফাস্ট!”

মেহরাজ মাথা ঝাঁকিয়েই ছুটল। নির্জন ঠোঁট কামড়ে লক্ষ্য করল ডক্টরের ইনফরমেশনগুলো। এখানে থাকলে আহামরি কিছু করে উঠতে পারবে না সে। কারণ ঘটনা ঘটেছে ইন্ডিয়ায়। হয়ত সেখানে পাড়ি জমাতে হবে কিছুদিনের জন্য।

মেহরাজ ফিরে এলো নির্জনের কাছে মিনিট বিশেক পর। হাতে ধুলোমাখা, ময়লা নীল রঙের ফাইল। বিনয়ের সঙ্গে এগিয়ে দিলো নির্জনের কাছে। সেটা হাতে নিয়েই প্রথমে ফুঁ দিয়ে উপর থেকে ময়লা ঝেড়ে নিতেই দৃশ্যমান হলো ফাইলের ওপর কালো মোটা কালি দিয়ে লেখা ‘ডার্ক ম্যাক্স মিশন’ শব্দটি। চোখজোড়া সরু হয়ে এলো নির্জনের। ফাইলটা খুলল আগ্রহের সাথে। দেখা গেল একজন অর্ধবয়স্ক লোকের ছবি। মৃ’ত অবস্থায়। চুলে হালকা পাক ধরেছিল সবে। চোখেমুখে ভদ্রসভ্য একটা ভাব থাকলেও এই মানুষটির মুখোশের পেছনে ছিল এত ভয়াবহতা? তা মেনে নিতে একটু কষ্ট হলো নির্জনের। নিজে একের পর এক ডিটেইলস পড়তে থাকল। সেখানে লেখা ছিল, ‘ছবিতে যেই ব্যক্তিটি তার নাম ডার্ক ম্যাক্স। সেটা ছিল তার ছদ্মনাম। আসল পরিচয় এখনো সকলের কাছে অজানা। যুবক থাকতেই তার টান ছিল বিভিন্ন কেমিক্যালের প্রতি। কেমিক্যাল নিয়ে বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালোবাসত। তার গুপ্ত ল্যাবও ছিল। সেখানেই তার মৃ’ত দেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। নিজের বুদ্ধি আর কেমিক্যাল দিয়ে নতুন নতুন আবিষ্কার দিয়ে আধিপত্য করতে চেয়েছিল শহর জুড়ে। প্রথমে ছোটোখাটো চু’রি। আস্তে আস্তে একটু করে নিজের গ্যাং তৈরি তারপর থেকে শহরে আত’ঙ্ক ছড়িয়ে ফেলে একের পর এক হা’মলা এবং ডাকা’তির মাধ্যমে। তাকে আটক করা হলেও বেশিদিনের জন্য রাখা যায়নি। ফাঁ’সি হবার আগেই পলা’তক হয় সে। তার খোঁজ করা হয়। সে ছিল পুরো শহরের আত’ঙ্ক। তবে সকলকে অবাক হয়ে দিয়ে সে নিজেই নিজের গুপ্ত ল্যাবে আত্ম’হ’ত্যা করে। এতেই তার ইতি ঘটে।’

বড় একটা শ্বাস ফেলে নির্জন। আসলেই এবার মনে হচ্ছে পাঁচ বছর আগের এই ডার্ক ম্যাক্সের কেসটার সঙ্গে কোনো না কোনো যোগসূত্র রয়েছে এই রিসেন্ট টেরো’রিস্ট এবং ডা’কাত দলের। তবে কি ডার্ক ম’রেনি? না ম’রলে ফাইলে কার ছবি? মাথাটা ধরে যায় নির্জনের। আপাতত ডা’কাতির বিষয়টা রায়ান দেখছে। সেটা নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চায় না। যেকোনো একটাতে ফোকাস রাখতে হবে। নির্জন ধপ করে বসে পড়ে নিজের চেয়ারে। শান্ত গলায় বলে,
“ইন্ডিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করছি মেহরাজ। গেট রেডি!”

নিজের চশমাটা ঠিকঠাক করে কেবিন নম্বর দেখে চলেছে উর্মিলা। কাঙ্ক্ষিত কেবিন খুঁজেই পাচ্ছে না। জাস্ট রিসেপশনিস্ট বলেছিল সেকেন্ড ফ্লোরের কথা। কোনদিকে সেটা বললে কী এমন ক্ষতি হয়? বেখেয়ালি হয়ে হাঁটতে গিয়ে হুট করেই কোনো লম্বাচওড়া ব্যক্তির সঙ্গে হোঁচট খেয়ে গেল সে। মেজাজটা গেল বিগড়ে। পড়তে নিয়েছিল তার সাধের চশমা সেই সঙ্গে হাতে টিফিনবক্সটাও। একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকাতেই সামনে থাকা মানবটিকে দেখে চোখমুখটাও কুঁচকে এলো এবার। নোমানও উর্মিলার দেখা পাওয়ায় অন্যদিকে ঘুরে গেল! এই মেয়ে নির্ঘাত আবার ঝগড়া বাঁধাবে! আস্তে করে বলে ফেলে,
“চোখ তুলে দেখো না কে এসেছে,
নতুন করে আবার ঝগড়ার সানাই বেজেছে!”

আস্তে করে বললেও শুনতে ভুল হলো না উর্মিলার। গজগজ করে নোমানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল,
“এই, এই আপনি কী বললেন?”

“যেটা তুমি শুনলে। চোখটা খারাপ হলে কী হবে? কানের শ্রবণশক্তি দেখি একদম একশো তে একশো। হয়ত মানুষ ঠিকই বলে মানুষের একটা ইন্দ্রিয় অচল হলে আরেকটা বেশিই সবল থাকে।”

রাগে কটমট করে উর্মিলা বলল,
“খবরদার! আমার চোখ অচল নয়। জাস্ট একটু সমস্যা! আমাকে ইনসাল্ট করবেন না। আপনার তো সব সবল থাকতেও চোখ পকেটে করে তুলে হাঁটেন। নাহলে এতবার ধাক্কা লাগে?”

“তা এই দুপুরে হঠাৎ করে ঝগড়ার ঝুড়ি নিয়ে কোত্থেকে উদয় হলে?”

“বাড়ি থেকে। আঙ্কেলকে দেখতে এসেছি। আপনার সঙ্গে কথা বলে টাইম ওয়েস্ট করার সময় আমার মোটেও নেই। রাগিনী কোথায়? তাকে ডাকুন।”

“সি ইজ বিজি।”

দায়সারা ভাবে উত্তর দিলো নোমান। একটু থেমে আবারও বলল,
“সে তো তোমার মতো যখন-তখন ঝগড়া করার জন্য রেডি থাকে না। ওর অনেক কাজ থাকে। ও হয়ত এখন অভিরূপের সাথে ছাঁদে আছে।’

গাল ফুলিয়ে ফেলল উর্মিলা। মনে মনে বাসনা জাগল যদি সামনের এই অসহ্যকর, খুঁচিয়ে কথা বলা লোকটাকে উদুম কে’লানি দেওয়া যেত! নোমান অন্যপাশ ফিরে কোনোমতে নিজের হাসি আটকালো। এই উর্মিলা মেয়েটাকে রাগাতে বেশ লাগে তার। শ্যামলা উজ্জ্বল চেহারায় যখন রাগ ফুটে ওঠে, ছিপছিপে আর চাপা গাল তখন ফুলে যায় আপনাআপনি। নাক ফুলিয়ে ঝগড়া করার ভঙ্গি দেখলে নোমানের মন চায় সেখানেই সে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবে!

নিজেকে সামলে উর্মিলা ছাঁদে যাবার পথ ধরে বলল,
” ছাঁদে কী করছে দুপুর সময় ও? দেখে আসি।”

নোমান তৎক্ষনাৎ তার হাত আঁটকে ধরল। ধমকে বলল,
“এই মেয়ে, বুদ্ধিসুদ্ধি নেই? তারা ছাঁদে কথা বলছে।”

“কী কথা?”

“সব খুলে বলতে হবে?”

চোখ ছোটো করে তাকাল উর্মিলা। না বললে কী করে বুঝবে? তার এমন চাহনিতে নোমান ফিসফিস করে বলল,
“রোমান্টিক কথাবার্তা বলছে। বুঝেছো এবার? বিয়ের আগে যেসব কথাবার্তা একটা ছেলে আর মেয়ের মাঝে হয় সেসব বলছে।”

উর্মিলা এবার বিস্ফো’রিত চোখে তাকায়। বিস্ময়ে টলমল করতে থাকে। আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে। কী প্রতিক্রিয়া করবে বুঝে উঠতে পারে না। হাত থেকে টিফিনবক্সটা পড়ে যেতে নিয়েও নেয় না। ধরে ফেলে নোমান। নিজের উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে জোরেশোরে চিৎকার দিয়ে বলে,
“কিহ্?”

এমন উচ্চরবে ভ্যাবাচেকা খেয়ে মাথায় বুদ্ধি না পেয়ে উর্মিলার মুখ হালকা করে চেপে ধরে বলে,
“চুপ, চুপ! হসপিটাল এটা! মানুষ তোমাকেও পাগল ভাববে সঙ্গে আমাকেও।”

বলেই আশেপাশে তাকায় সে। দেখল চারপাশে থাকা লোকজন উদ্ভট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে সকলকে ইশারায় সরি বলল নোমান। সকলে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল উর্মিলার দিকে। উর্মিলা মিনমিন করে বলল,
“সরি! এক্সাইটমেন্ট সামালতে পারিনি।”

নোমান কিছু বলার আগেই হাতে করে চা নিয়ে ঘটল অভিরূপের আগমন। অভিরূপ আশেপাশে তাকিয়ে রাগিনীকে খুঁজল। তাকে পেল না। উর্মিলার দিকে চোখ পড়তেই অভিরূপ স্বভাবসুলভ হেঁসে বলল,
“হ্যালো, উর্মিলা!”

উর্মিলার যেন হার্ট অ্যা’টাক হবার উপক্রম। তার পছন্দের স্টার তাকে নিজ থেকে হ্যালো বলছে। কম ব্যাপার নাকি? আবার নাকি এই মানুষটা তার বান্ধবীর হাজবেন্ড হতে চলেছে। এটা তো বড়োসড়ো ব্যাপার! অভিরূপ জিজ্ঞেস করল,
“রাগিনী এদিকে এসেছে?”

নোমান ভ্রু কুঁচকায়।
“রাগিনী তো তোর সাথে ছিল!”

“তা তো ছিল। কিন্তু ওর জন্য চা আনতে ক্যান্টিনে গেলাম। ওখানে তো সব ছেলেমেয়েদের মাঝে ফেঁসে গিয়েছিলাম। সকলে সেল্ফি অটোগ্রাফ দিতে দিতে আধম’রা হয়ে ফিরে এলাম। এসে দেখি সে নেই। কোথায় গেল বুঝতে পারছি না।”

নোমান ছো মে’রে অভিরূপের হাত থেকে চা নিয়ে সেখানে চুমুক বসিয়ে বলল,
“জীবনে জুতা নিচে পড়িস কিনা সন্দেহ আছে। আর তুই কিনা অন্যজনের জন্য চা আনতে যাচ্ছিস! ইন্টারেস্টিং!”

আরো বেশ কিছু কথা চলে তাদের মাঝে। অভিরূপ ফোন করলেও রাগিনী ফোনটা ধরে না। সে বেশ চিন্তিত হয় মনে মনে তার জন্য।

আধঘণ্টা পর তড়িঘড়ি করে হসপিটালে আসে রাগিনী। ব্যাগ খুলতে খুলতে ফোনে দেখে অভিরূপের নয়বার কল। কিছুটা চমকে ওঠে সে। পায়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দ্রুত পৌঁছে সকলের কাছে। সকলে রাশেদ সাহেবের কেবিনেই দাঁড়িয়ে আছে। চিন্তিত অভিরূপের চোখের সামনে রাগিনী দৃশ্যমান হতেই চকিতে তাকাল সে। রাগিনীর পরনে অন্য পোশাক, খোলা চুল হাতে অন্য ব্যাগ। এ যেন অন্য রূপের রাগিনী! ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলে,
“তুমি বাড়ি গিয়েছিলে আবার?”

অভিরূপের প্রশ্নের মানে খুঁজে পায় না রাগিনী। কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
“মানে? আমি তো সবেই বাড়ি থেকে এলাম। আপনি আমায় অনেকবার কল করেছেন! কোনো সমস্যা? বাবা ঠিক আছে তো?”

অভিরূপ ভ্যাবাচেকা খায়। ক্ষীণ সুরে বলে,
“তখনই তো একটু প্রবলেম হয়েছিল! কিন্তু একটু পরই তো ডক্টর বললেন উনি ঠিক আছেন।”

বাবার সমস্যার কথা শুনেই মনটা ছ্যাঁত করে উঠল রাগিনীর। আর কারো কথা কানে না তুলেই দ্রুত রাশেদ সাহেবের কেবিনে প্রবেশ করল। অভিরূপ হাঁ হয়ে চেয়েই রইল। তারপর নোমানকে বলল,
“বুঝলাম না! ও একটু আগে তো অন্য ড্রেসে ছিল। আবার এখন অন্যভাবে! আবার বলছে ও কেবল এলো। ওর কথা তো কিছুই বুঝলাম না।”

নোমান একটু ভেবে বলল,
“তুই ওকে তোদের বিয়ের কথা বলেছিস?”

অভিরূপ মাথা নাড়ায়। তৎক্ষনাৎ তার ঘাড়ে চাপড় মে’রে নোমান বলে,
“সেকারণেই লজ্জা পেয়েছে। তোর মতো তো সবাই নির্লজ্জ নয় ইউ নো! লজ্জা নারীর ভূষণ! আর হয়ত কোনো প্রবলেম হয়েছে আই মিন গার্লস প্রবলেম। তাই হয়ত বাড়িতে গিয়েছিল আবার। ঘাঁটাস না ওকে।”

অভিরূপের সবটা অবিশ্বাস্য মনে হয় না। নোমানের কথায় যুক্তি আছে বটে। তাই সেসব নিয়ে আর কথা বাড়ায় না সে।

কেটে গিয়েছে প্রায় এক সপ্তাহ। বিলীন হয়েছে আগের স্নিগ্ধ সময়গুলো। সুস্থ হয়ে উঠেছেন রাশেদ সাহেব। এখন বাড়িতেই রয়েছেন তিনি। মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করতে শ্বাস ফেলতে সময় পান না যেন। রাগিনীর আপত্তি নেই জন্য আরো বেশি খুশি তিনি। রাগিনী নিজের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করছে তার বাবাকে চিন্তামুক্ত রাখার। এভাবেই কাটছে দিন। আজকে অভিরূপের মা-বাবা আর নোমানের বাবাও দেশে আসছেন। নোমানের মা নেই। ওদেরকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে গিয়েছে নোমান আর অভিরূপ। আজ সন্ধ্যায় আংটি পড়ানো হবে রাগিনীকে। যাকে বলে এঙ্গেজমেন্ট। রাগিনীর এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা বা তোড়জোড় নেই। সে এসেছে লাইব্রেরিতে। বিগত কদিন ধরে সময় কাটছে না তার। অন্যদিকে রাশেদ সাহেব মানা করে দিয়েছে বর্তমানে ইন্টারনেট, ভার্চুয়াল লাইফ থেকে দূরে থাকতে। কারণ রাগিনীর মেডিটেশন চলছে। ডিপ্রেশন কাটানো প্রয়োজন তার। আর ইন্টারনেটের বিভিন্ন জিনিস চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় অনেকসময়। তাই রাশেদ সাহেবের এই কথা!

চারিদিকে যেন বইয়ের পাহাড়। এত এত বইয়ের মাঝে কোন বইটা তার পড়া উচিত সেটা ভেবেই দিশেহারা হয়ে উঠছে রাগিনী। গোল গোল চোখে দেখছে বইয়ের সব নাম। বেশ ভেবে একটা বই হাতে নিলো রাগিনী। এটা প্রেমের উপন্যাস। ঢক গিলে সাথে সাথে বইয়ের তাকে রেখে দিলো সে। এটা পড়লে পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে ফের কোহিনূর নামক ব্যক্তিটির গুনগান গাইবে। কী দরকার যেই মানুষটা তার নয় সেই মানুষটাকে মনে করার? প্রয়োজন নেই তো! তবে বিগত কয়েকদিন ধরে কোথায় হারিয়েছে মানুষটি? রাগিনীর মনে প্রশ্ন এলো। লোকটার দেখা পায়নি সে বেশ কয়েকদিন হলো। অদ্ভুত বিষয় হলো রাগিনীর বিষয়টাকে খুশি হওয়ার কথা! তবে তার মনটা উল্টো কাজ করছে। বিষণ্ণ, বিমূঢ়, ব্যাকুল হয়ে উঠছে বারংবার।

আকাশপাতাল ভাবনা চিন্তার মাঝে অসাবধানতাবশত আচমকা মৃদু ধা’ক্কা লাগে কারোর সঙ্গে। হকচকিয়ে সরি বলতে নিলেই বই হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ফাহমিদকে চোখে পড়ে তার। অনেকদিন পর ফাহমিদকে দেখে অসাময়িক হেসে রাগিনী বলে,
“ফাহমিদ, অনেকদিন পর দেখা হলো! কেমন আছো?”

“এইতো চলছে! তা ম্যাডাম হঠাৎ লাইব্রেরিতে! ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই পড়াশোনা স্টার্ট হয়ে দিয়েছো?”

“তেমন কিছু না। এমনি পড়ার জন্য বই খুঁজছিলাম। তুমি কী বই পড়ছো?”

ফাহমিদ স্মিত হেসে তার হাতের বইটা দেখায়। সেটা দেখেই রাগিনী বলে ফেলে,
“তোমার এখনো কেমিস্ট্রির প্রতি আগ্রহ গেল না। সেই কলেজ থেকে দেখছি তুমি কেমিস্ট্রি খুব পছন্দ করো। এখনো একই রয়ে গেলে। কী পাও এটা পড়ে?”

“তুমি যেমন সাইকোলজি নিয়ে পড়ে শান্তি পাও, আমিও তেমনই কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ে মজা পাই।”

রাগিনী আর ফাহমিদ দুজনেই নিজের পছন্দ মতো বই নিতে নিতে বেশ কথাবার্তা বলল। এর মাঝে রাগিনী খেয়াল করল তার দিকে বেশ কয়েকজন উদ্ভট চোখে তাকাচ্ছে। বার বার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে। বিষয়টা কেমন যেন লাগল রাগিনীর। তবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ফাহমিদকে বিদায় জানিয়ে বাহিরে এসে উর্মিলাকে কল লাগালো সে। বেশ দ্রুতই ফোন রিসিভ হলো। রাগিনী সঙ্গে সঙ্গে বলল,
“কোথায় তুই? আমি অপেক্ষা করছি তো!”

“তোর পেছনে তাকা। দেখতে পাবি।”

কানে ফোন নিয়েই পেছন ফিরল রাগিনী। চোখে পড়ল চশমা পড়া ছিমছাম সুন্দর গড়নের মেয়েটাকে। রাগিনী কল কেটে এগিয়ে আসতেই উর্মিলা তড়িঘড়ি করে বলল,
“চল, চল! অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। আমার এখনো অনেক শপিং বাকি।”

উর্মিলার তাড়াহুড়ো দেখে রাগিনী হাসে। মেয়েটা এত এক্সাইটেড যে মনে হচ্ছে তারই বিয়ে। অন্যদিকে রাগিনীর কোনো হেলদোল নেই। রাগিনী কথা বাড়ায় না। গিয়ে বসে গাড়িতে। গাড়ি চলতে শুরু করে। রাস্তায় বেশ ট্রাফিক! প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে হাতে ফোন নিয়ে ফেসবুক ঘাঁটতে লাগল উর্মিলা। রাগিনীর বেশ ঘুম পাচ্ছে। আজকাল রাতে ঘুম পায় না তার। এপাশ-ওপাশ করে শেষমেশ জীবনের সবচাইতে বিরক্তিকর মানুষটির স্কেচ দেখে কেটে যায়। মিনিট পাঁচেক পর হুট করেই নিজের কাঁধে হালকা ব্যথা অনুভব করে রাগিনী। শুনতে পায় উর্মিলার উচ্চ কণ্ঠসুর।
“এই এই রাগিনী! দেখ দেখ। কী দেখাচ্ছে ফেসবুকে!”

রাগিনীর চোখ মেলতে মন চাইল না। চোখ বুঁজেই হালকা অপ্রসন্ন হয়ে বলল,
“কী দেখাচ্ছে?”

“তোর আর অভিরূপ জিজুর ছবি! ভাইরাল হয়ে গিয়েছে।”

চোখ খুলতে সময় লাগল না এবার রাগিনীর। বিদ্যুতের গতিতে উঠে বসে ছোঁ মে’রে ফোনটা নিয়ে দৃষ্টি আটকালো ফোনে থাকা ছবির দিকে। উপরে স্পষ্ট ক্যাপশন লেখা, ‘তবে কি বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশি নারীর প্রেমের আটকালো অভিরূপ চৌধুরী? প্রেমে পড়ে রিকশায় ভ্রমণে দুজন।’

ভ্রু কুঞ্চিত হলো রাগিনীর। মাথায় একটাই প্রশ্ন এলো এই ছবিটা কখনকার তোলা? সে কবে অভিরূপের সাথে রিকশায় উঠেছিল? মনে পড়ছে না তো! উর্মিলা প্রফুল্ল হয়ে বলল,
“বিয়ে না হতেই সেলেব্রিটি হয়ে গেলি! বিয়ে হলে কী হবে ভেবেছিস?”

রাগিনী পাল্টা প্রশ্ন করে বলল,
“কিন্তু এটা কবেকার ছবি?”

“ভুলে গেলি? আমরা ওইদিন ঘুরতে বেরিয়েছিলাম রিকশায়!”

“কবে?”

“এত দ্রুত কীভাবে ভুলতে পারিস? আমরা ঘুরতে বেরিয়েছিলাম!”

রাগিনীর মনে পড়ে না তারা কবে একসাথে বেরিয়েছিল? যেদিন বের হওয়ার কথা ছিল সেদিন তো উর্মিলা ছিল না। আর সেই বাজে ঘ’টনাও ঘটে গিয়েছিল তার সঙ্গে। তবে তারা ঘুরতে গেল কখন? মাথায় চাপ পড়ে রাগিনীর। তবুও স্মরণে আসে না। ভালো করে ছবির দিকে খেয়াল করে দেখে ছবিতে যেমন ড্রেস তার পরনে তেমন ড্রেসও তার নেই। এমন ভাবনায় সারা রাস্তা কাটে তার। আর পাশে উর্মিলার বকবক!

বেখেয়ালি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রাগিনী। মন থেকে চিন্তা সরছে না সেই ছবিটা দেখার পর থেকে। তবে একটা জিনিস বেশ বুঝতে পেরেছে তখন লাইব্রেরীতে এভাবে লোকজন ঘুরে ঘুরে তাকে পর্যবেক্ষণ করার কারণ। ছবিটা নিয়ে বেশ চিন্তিত সে। ছবি দেখে মনে হলো যেন একদম জীবন্ত! কোনো ইডিটের প্রভাব নেই। তবে?
“এই ঘড়িটা ভালো লাগছে?”

ভাবনার অন্ত ঘটে রাগিনীর। উর্মিলার হাতে ঘড়ি দেখে ভালোমতো খেয়াল না করেই বলে,
“হু ভালোই তো।”

“তাহলে কিনে নিই?”
রাগিনী মাথা দুলায়। ঘড়ি কিনে দুজন বেরিয়ে আসে।

লিফট থেকে নেমে নয়নতাঁরা এত এত ড্রেসের শোরুম দেখে দিশেহারা হয়। দৌড়ে যেতে গিয়েও যায় না। নির্জনের হাত ধরে হাঁটতে থাকে। নির্জনের আরেকহাতে ব্যাগে ভর্তি। নয়নতাঁরা আজ তাকে জোর করে শপিং করাতে নিয়ে এসেছে। আজই ইন্ডিয়া থেকে দেশে ফিরেছে নির্জন। প্রথমেই ভেবেছিল রাগিনীর খোঁজ নেওয়ার কথা! তবে নয়নের জোরাজুরিতে আসলে হলো শপিংমলে। হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে নির্জন বিরক্ত হয়ে বলে,
“আমার ব্যাংক ব্যালেন্স কি আজকেই শেষ করার প্ল্যানিং করে এসেছো নয়ন?”

“আরে না না! আমি তোমার ব্যাংক ব্যালেন্স শেষ করলে রাগিনী ভাবির কী হবে? আমি এতটাও খারাপ ননদিনী হব না যে ভাবির কথা ভাববে না।”

নির্জন দম ফেলে বলে,
“তাহলে অনেক তো শপিং করেছো! এখন তো যাওয়া যায়!”

“আর একটা বিগ ব্রাদার প্লিজ! রিমেম্বার, তোমার জন্য আমাকে লন্ডনেই সব জামাকাপড় ফেলে আসতে হয়েছে। আর এটা তোমার পানিশমেন্ট।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নির্জন। মেয়েদের এই একটা সমস্যা! শপিংমলে এলে তাদের কেনাকাটা শেষ হতে চায় না।

উর্মিলা আর রাগিনী ঢুকেছে ড্রেসের সাইডটাতে। শোরুমে ঢুকে একের পর এক ড্রেস দেখে যেতে ব্যস্ত উর্মিলা। রাগিনী আনমনে বাহিরের দিকে চেয়ে। মনে পড়ছে তার বিগত কিছু স্নিগ্ধ মূহুর্ত। কোহিনূরকে তার সঙ্গে এখানে এনেছিল সে। কতই পাগলামি না করেছিল! সেইসব স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে একটু একটু করে। আকস্মিকভাবে সেই স্মৃতি যেন সত্যিতে পরিণত হয়। তার সামনে সত্যিই কোহিনূরকে আবিষ্কার করে বসে রাগিনী। মাথাটা ভনভন করে ঘুরে ওঠে। সে কি ভুল দেখছে? নাহ, সব ঠিক দেখছে। সব স্পষ্ট। ওইতো মানুষটা শোরুমের বাহিরেই দাঁড়িয়ে! পাশে একটা চেনা নারীও চোখে পড়ে তার। কোহিনূর তার সঙ্গেই কথা বলতে মশগুল। রাগিনীর আশেপাশে অন্ধকার হয়ে আসে। এতদিন কোথায় ছিল মানুষটা? জানতে মনটা আকুলতায় ছেয়ে যায়। আর ওই মেয়েটাকে চিনেও চিনতে পারে না। নিজের মনের বিরুদ্ধে যাবার সাধ্য তার নেই। কোহিনূর তার চোখের আড়াল হতেই দ্রুত সে উর্মিলাকে বলল,
“আমি একটু আসছি।”

বিলম্ব না করে শোরুমের বাহিরে চলে এলো সে। দেখা পেলো কোহিনূরের। সে অনেকটা দূরে মেয়েটির সাথে হাঁটছে। রাগিনী যেতে গিয়েও থমকালো! কেন সে বার বার ছুটতে চাইছে মানুষটার নিকট? আচমকা মনে পড়ল কোহিনূরের পাশে থাকা মেয়েটির কথা! এটাই তো সেই মেয়ে যাকে সে আর কোহিনূর একদিন হসপিটালে দেখেছিল। কোহিনূরকে দেখে সে বিগ ব্রাদার বলে ডেকে উঠেছিল। কিন্তু কোহিনূর তাকে না চেনার ভান করেছিল বেশ ভালো করেই। আর আজকে ওই মেয়েটির সাথে কোহিনূর? সব গুলিয়ে এলো রাগিনীর। মাথায় একটাই কথা এলো, ‘মানুষটাকে একদমই বিশ্বাস করা যায় না। পৃথিবীর সবচেয়ে অবিশ্বাসযোগ্য মানুষটাকে সে ভালোবেসে ফেলেছে।’
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৫০ [অন্তিম পর্বের প্রথমাংশ]

রাগিনী বড়ো শপিংমলের এত এত মানুষের মাঝে যেন সম্পূর্ণ একা। এত কোলাহলে একটা যান্ত্রিক রোবট লাগছে নিজেকে। যে যেভাবে পারছে পরিচালনা করে চলে যাচ্ছে। মিথ্যে অভিনয় সাজিয়ে তাকে উপহার দিয়ে চলেছে। আর সে আপনমনে সেসব গ্রহণ করে যাচ্ছে। তবুও কোনো অদ্ভুত জোরের কারণে মনে আকাঙ্ক্ষা জাগল মানুষটার সঙ্গে মেয়েটির ঠিক কেমন সম্পর্ক সেটা জানতে এবং হাতেনাতে তাকে ধরে সাবধান করে দিয়ে আসতে। অনেক হয়েছে আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এবার থেকে যদি মানুষটি তার কাছে আসে তবে খুব খা’রাপ হয়ে যাবে! সেটাই রাগিনী আর বুঝিয়ে দেবে কোহিনূরকে। এসব ভেবে নিজের উপর জোর খাটিয়ে এগোতে থাকে রাগিনী। কিন্তু সে মানুষটিকে হারিয়ে ফেলেছে। এত লোকজনের মাঝে খুঁজে পেল না চেনা ব্যক্তিত্বকে। কোথায় গেল সে? হাঁটতে হাঁটতে সামনে থাকা রেলিং ধরে দাঁড়াল রাগিনী। নিচটা দেখতে থাকল বেশ মনোযোগ দিয়ে। হঠাৎই চোখে পড়ল কোহিনূরকে। ওইতো নিচে নেমে পার্কিং এর দিকে হেঁটে যাচ্ছে মেয়েটার সাথে। রাগিনী ঝটপট করে লিফটের কাছে গেল। তবে এতটা ভীরের মধ্যে লিফটে যেতে টাইম লাগবে বলে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামল সে। পার্কিং এর দিকে যেতেই রাগিনী খেয়াল করল কোহিনূর আইসক্রিমের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। তার পাশে থাকা মেয়েটি কোহিনূরের হাত জড়িয়ে ধরে আইসক্রিম কেনার পাগলামি জুড়ে বসেছে। রাগিনী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। মেয়েটা নিশ্চয় কোহিনূরের বেশ কাছের কেউ। কৌতূহল বাড়ল মনে। সরগমের মাঝে মানুষজনের মধ্যে সূক্ষ্ম দৃষ্টি দ্বারা তাদের প্রতিটা পদক্ষেপকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে।

“মাই ডিয়ার ব্রাদার! তুমি ভাবির পছন্দের খেয়াল রাখতে রাখতে আমার পছন্দ ভুলতে বসেছ! আমি স্ট্রবেরি ফ্লেবার পছন্দ করি।”

ভ্রু কুঁচকে ক্ষীণ গলায় নির্জনের উদ্দেশ্যে কথাটা বলল নয়নতাঁরা। ফোনে ব্যস্ত থাকা নির্জন খুব একটা পাত্তা না দিয়ে দোকানদারের উদ্দেশ্যে বলল,
“তাকে একটা স্ট্রবেরি ফ্লেবারের আইসক্রিম দেন।”

মেহরাজের সঙ্গে কিছু ডিটেইলস নিয়ে কথা বলছিল নির্জন হোয়াটসঅ্যাপে। চোখমুখ হালকা কুঁচকানো। মেহরাজ একটা ছবি পাঠিয়েছে তাকে। ছবিতে একটা ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বয়সের একটা লোক। ডান ভ্রু এর মাঝে কাটা। শ্যামলা দেখতে। নকল রাগিনীকে রাগিনীর মতো বানাতে এই লোকটাই সমস্ত ডিটেইলস আর টাকাপয়সা দিয়েছিল। নির্জনের কাছে চেনা চেনা লাগল এই মুুখটা। তবে মনে এলো না। যেই ডক্টরের কাছে নকল রাগিনীকে নেওয়া হয়েছিল তার ভাষ্যমতে তখন নকল রাগিনীর অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। চোখমুখ প্রায় ঝ’লসে গিয়েছিল তার। নির্জন এটা এখনো বুঝতে পারেনি রাগিনীর চেহারা অবিকল তৈরির জন্যই কি তার চেহারা ঝ’লসে দেওয়া হয়েছিল নাকি এটা এক্সি’ডেন্ট ছিল? তবে ছবিতে থাকা এই লোকটা তখন হসপিটালের পেপারে নওশাদ খান লিখে সাইন করেছিল বলে জানা যায়। নির্জন এটা নিশ্চিত যে ওটা তার আসল নাম ছিলই না। এসব কিছুর মাঝে নির্জনের অন্যহাতে টান পড়ায় কিছুটা হকচকিয়ে নিচু হয়ে তাকায় সে। একটা ছোট্ট মেয়ে। কৃষ্ণবর্ণ তার গায়ের রং। বয়সটা দশ বছরের বেশি হবার কথা নয়। হাতে ফুলের গাজরা। নির্জন ঝুঁকে নিচু হতেই মেয়েটি জিজ্ঞেস করল,
“ফুলের মালা লইবেন? মাত্র ত্রিশ টাকা।”

“নাম কী তোমার?”

“দিয়া।”

“বেশ সুন্দর নাম। তা দিয়া! আমি ফুলের গাজরা নিয়ে কাকে পড়াব বলো তো? আমার তো কেউ নেই পড়ানোর মতো।”

দিয়া মাথা চুলকালো। মূহুর্তেই দিয়ার পেট থেকে উদ্ভট আওয়াজ আসতেই নির্জন বুঝল মেয়েটি না খাওয়া। তৎক্ষনাৎ সে প্রশ্ন করল,
“আইসক্রিম খাবে?”

দিয়া মাথা নাড়াল আর মিনমিন করে বলল,
“আমার ফুলের মালা কিনে টাকা দেন তাইলেই হইব। আবার এইডা বসরে জমা দিতে হইব। তারপর তার মধ্যে থেকে যা পামু ওইডা নিয়া আমি আর আমার কানা ভাই মিলে ভাগ করে খামু।”

নির্জন ভ্রু কুঁচকে ফেলে। বস মানে সে বোঝেনি। সে নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,
“বস মানে? আর তোমার ভাই আছে?”

“এত শুইনা কী করবেন? মালা না কিনলে কন চইলা যাই।”

এবার মেয়েটির কণ্ঠস্বরে জড়তা খুঁজে পেল নির্জন। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। শহরে ছোটো ছেলেমেয়েদের ভিক্ষা করতে বসিয়ে দেওয়া বা তাদের রোজগার করতে লাগিয়ে দেওয়ার অনেক চক্র কাজ করে। এর আগেও নির্জন এমন কয়েকটা কেস সলভ করেছে। এটাও হয়ত তেমনই কিছু। নির্জন শ্বাস নিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“ভয় পাচ্ছো কেন? আমাকে বলতে পারো। ভয় পেও না।”

“আপনের লগে বেশি কথা কইলে বস আমারেও ভাইয়ের মতো কানা কইরা দিয়া চোখ বেইচা দিবে। আমি গেলুম।”

ছোটো মানুষ! পেটে কথা থাকে না। শেষ কথাতে নির্জন বুঝতে পারল সে যা ভেবেছিল তাই। মেয়েটি চলে গেলেও নির্জন তাকে চক্ষু আড়াল করল না। কিছুদূর না যেতেই বেশ লোকজনের মাঝে মলের বাহিরে দাঁড়াতেই সেই ছোট্ট মুখে ঠাস করে চ’ড় দিয়ে বসল একটা লোক। নির্জন বেশ ভালোভাবেই দেখে নিলো সেটা। বেশ ভালো করে খেয়াল করতেই তার চক্ষু চড়কগাছ হলো। এটা তো সেই লোকটা! যার ছবি মেহরাজ হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছে! একে যদি ধরতে পারা যায় তবে অনেক ইনফরমেশন বেরিয়ে আসবে। নির্জন যেন হাতের শপিংব্যাগগুলো নয়নের হাতে দেওয়ারও সময় পেল না। সেগুলো সেখানেই ফেলে দিয়ে ভীর ঠেলে যেতেই নয়নের বিরক্তি ভরা কণ্ঠ শুনল,
“মহা বিপদ তো! তোমার সঙ্গে শপিং এ এসেও শান্তি নেই। আমি গাড়ির কাছে ওয়েট করব। লোকটাকে উ’দুম কে’লানি দেওয়া শেষ চলে এসো। বেশি লেট করাবে না বলে দিলাম।”

নয়নের জোর দিয়ে বলা কথায় নির্জনের এক মূহুর্তের জন্য মনে হলো আসলেই সে একটা পা’গলকে বড়ো করছে। একের পর এক লোকজনের পাশ কাটাতে কাটাতে যখন সেই নওশাদ খানের মুখটা বেশি স্পষ্ট হলো তৎক্ষনাৎ চিনে উঠতে পারল নির্জন। এটা তো সেই ক্রি’মিনাল যার সঙ্গে ওই নকল রাগিনী মিলে মেন্টাল হসপিটালে তাকে মা’রতে এসেছিল! সেদিন অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিল সে এবং হসপিটালের সকল পেশেন্ট। সেদিনের ব্যর্থতার ক্ষো’ভ মাথায় চেপে বসল এবার তার। আজ তার পরিচয় জনসম্মুখে এলেও নির্জন ওই নওশাদকে ধরার প্রতিজ্ঞা নিলো। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া একের পর এক পড়তে থাকা ছোট্ট মেয়েটির গায়ে মা’র যেন নির্জনের শরীরেও লাগল। তার প্রলম্বিত নিঃশেষ নিঃশ্বাস আর অগ্নি প্রবাহের ন্যায় দৃষ্টির সম্মুখীন হলেও যেন কেঁপে উঠবে শত্রুপক্ষ।

দিয়ার ঠোঁট ফে’টে র’ক্ত বেরিয়েছে পাশ দিয়ে। ফুঁপিয়ে কাঁদতে গিয়েও থমকে থমকে যাচ্ছে মেয়েটা। লোচন ভর্তি আতঙ্কের ছড়াছড়ি সেই সঙ্গে টলটল করছে পানি। কবির জলন্ত সিগারেটটা বেশ ক্ষিপ্র হয়ে মুখে ধরে রেখেছে। এতক্ষণে একটা রোজগারও করতে পারেনি মেয়েটা। এদের বাঁচিয়ে কী লাভ? অবশ্য ডার্ক ম্যাক্স আদেশ দিয়ে দিয়েছে এই মেয়েটার কিডনি নিয়ে একটা কেমি’ক্যাল জাতীয় কিছু দিয়ে খতম করে দিতে। কাজটা আজকের মধ্যেই সারতে হবে। এসব ভাবনার মাঝে ব্যাঘাত ঘটিয়ে দিয়া আধো গলায় বলল,
“মাফ কইরা দেন। আমারে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় দেন। আমি যা পামু সব দিয়া দিমু। একটু খাইতে দিয়েন আমারে আর ভাইডারে। তাইলেই হইব।”

কবিরের বাসনা জাগল রেগে এবার দিয়ার ছোট্ট গলাটাই চে’পে ধরতে। হাতটা মুঠো করে ফেলল সে। ধ’মক দিতে উদ্যত হলো। সেই মূহুর্তে তার ঘাড়ে হাত রাখল কেউ। প্রশস্ত হাতের জোর এবং শক্ত করে চেপে ধরায় যেন কাঁধের হাড্ডি ভে’ঙে যেতে খুব একটা সময় লাগবে না। কিছু বলার আগেই শুনতে পেল এক পুরুষালী কণ্ঠ।
“কতকাল আর কাপুরুষের মতো বাচ্চাদের ইনকাম খাবি? এরচেয়ে জেলে গেলে কোনোরকম পরিশ্রম ছাড়া দুইবেলা রুটি আর একবেলা ভাত জুটে যাবে।”

এমন কথায় চরম রেগে গেল কবির। কার এত বড়ো সাহস? তাকে জেলের হু’মকি দেয়? কবির দ্রুত ক্ষিপ্ত হয়ে তার কাঁধ থেকে আগন্তুকের হাতটা সরিয়ে নিতেই মূহুর্তের মাঝেই কিছু বুঝের ওঠার আগেই ছিটকে পড়ে সে মাটিতে। কানের নিচের জায়গাটা টনটন করে ব্যথা করে ওঠে। হাতটা না চাইতেও চলে যায় সেই গালের জায়গাটিতে। আঙ্গুলে এসে ঠেকে তরল আর হালকা গরম এক পদার্থ। কাঁপা হাতে কবির গাল থেকে হাত সরিয়ে চোখের সামনে ধরতেই কনিষ্ঠা আঙ্গুলের মাথায় তাজা র’ক্ত দেখতে পেতেই চোখ তুলে তাকায় হাত চালানো সেই ব্যক্তির দিকে। নির্জনকে চিনতে খুব একটা ভুল হয় না কবিরের। কাঁপুনি বাড়ে তার। আজ সে কোনো দলবল নিয়ে আসেনি। সে ধরা পড়তে চায় না পুলিশের কাছে। কবির পিছিয়ে এলো। নির্জন এগিয়ে এসে তার পায়ের উপর পা তুলে দিতেই ব্যথায় কুঁকড়ে গেল সে। নিজের সমস্ত ক্রো’ধ অর্পন করতে ব্যস্ত নির্জন। আশেপাশে জমা হয়েছে ভীর। ভীরের মাঝে তাকে তার প্রিয় দুটো চোখও পর্যবেক্ষণ করছে সেটা নির্জনের অজানা। নির্জন হিসহিসিয়ে কবিরকে টেনে তোলে। কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“জানো’য়ার একটা! লজ্জা লাগে না তাই না? বাচ্চাদের সাথে জঘ’ন্য কাজ করতে? লজ্জার বলিদান দিয়ে দিস নাকি তোরা?”

“ভালো হচ্ছে না অফিসার। পরিণাম ভালো হবে না। ছেড়ে দে আমায়! নয়ত আমার কাছে থাকা রি’ভলবার দিয়ে যে কারোর প্রা’ণ চলে যাবে।”

কবিরের বলা ঠুনকো হু’মকি বিন্দু মাত্র ভয় ধরাতে পারল না নির্জনের মনে। থমথমে সুরে জবাব দিল,
“রি’ভলবার চালাতে হাত লাগে। আর সেই হাত তুই কাজে পারবি না।”

নির্জন মুচড়ে ধরে কবিরের হাত। আর্তনাদে কেঁপে ওঠে আশপাশ। সকলে দূর থেকে হতবাক হয়ে চেয়ে দেখছে। কেউ কেউ কাছে এগিয়ে আসছে জানার জন্য। তবে তার আগেই কোনোমতে নির্জনকে ধা’ক্কা দিয়ে পালায় কবির। সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে শুরু করে নির্জন। মেইন রাস্তার জ্যামের মাঝে গাড়ির ফাঁক দিয়ে দুজনই দৌড়াচ্ছে। নির্জন ছোটার গতি বাড়াল। কবির প্রাণপণে চেষ্টা করছে কোনোরকমে বাঁচার। শেষ রক্ষা বুঝি হলো না। তার মাথাটুকু নির্জনের হাতের কবলে আসতেই সঙ্গে সঙ্গে সে ফে’লে দিতেই কবিরের মাথা গিয়ে লাগে বাসে। চারিপাশ অন্ধকার দেখতে পায় কবির। এরইমধ্যে বুকে অনুভব করে তীব্র ব্য’থা। বুকে হাত দিয়ে চিত হয়ে পড়ে যায় সে। নির্জন স্থির হয়ে দাঁড়ায়। বাসের থাকা সকলে, যানবাহনে থাকা যাত্রীরা বিস্ময়ে দেখে চলেছে দৃশ্য। নির্জন কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের ঘাড়ের একপাশ ধরে ঘাড় কাত করে দেখতে থাকল আ’হত কবিরকে। সময় নষ্ট করা যাবে না। কবিরকে দ্রুত ঘাড় ধরে তুলে অন্যহাতে দুটো হাত মু’চড়ে ধরল সে। এখন এর থেকেই হয়ত পাওয়া যাবে পরের কোনো অজানা তথ্য!

কবিরকে গাড়িতে তুলে হুড়মুড়িয়ে গাড়ির দরজাটা লক করল নির্জন। নয়নতাঁরা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আশ্চর্য! এই আঁটকুড়ে লোকটাকে গাড়িতে তুললে কেন? ওর সঙ্গে গাড়ি শেয়ার করে কী করে যাব?”

“তোমায় এত কষ্ট করে এই ক্রি’মিনালের সঙ্গে গাড়ি শেয়ার করতে হবে না। তুমি রিকশা বা অটোতে করে বাড়ি এসো।”

বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় নয়নতাঁরা নির্জনের কথায়। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে জেদ ধরে বলল,
“মানছি না, মানব না। তুমি গাড়িতে এই ক্রিমি’নালটাকে এসি গাড়িতে নিয়ে যাচ্ছো আর আমি কিনা গরমে অটোতে যাব? নেভার এভার!”

নির্জন গাড়িটা স্টার্ট দিল। সামনে থাকা সানগ্লাস চোখে দিয়ে ফিচেল হেঁসে বলল,
“তাহলে অনশন শুরু করতে পারো নো প্রবলেম।”

ব্যস…আর কোনো উত্তরের অপেক্ষা করল না নির্জন। গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। পায়ের ধাপটা বিরক্তি নিয়ে জোরে ফেলে মুখটা জড়িয়ে ফেলল নয়ন। এখন কিনা অটোতে বাড়ি ফিরতে হবে?

পুলিশ স্টেশনের সামনে রাগিনীর গাড়িটা থামল। এখানেই তো থেমেছে কোহিনূরের গাড়ি। সে সচক্ষে দেখেছে। গাড়িটা তো বাহিরেই রয়েছে এখনো অবধি। রাগিনী তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নামল। নিজেকে এবার কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে তার। কোহিনূরের সঙ্গে এই জায়গাটির সম্পর্ক কোনোমতে বুঝে উঠতে পারল না। অতিরিক্ত ভাবনায় বুকটা ধড়ফড় করছে। মনে মনে একটা কথা জেগে উঠল বারংবার! মানুষটিকে তবে শুধু শুধু ভুল বুঝে এলো নাকি সে? রাগিনী ভেতরে ঢোকার আগেই বাঁধা হয়ে দাঁড়াল দুটো কনস্টেবল। একজন শুধালো,
“কমপ্লেন বা জিডি করাতে এসেছেন নাকি?”

রাগিনী বুঝে উত্তর দিল,
“না। কোনো কমপ্লেন নেই।”

“তবে কেন এসেছেন? কোনো কমপ্লেন থাকলে ওই বিল্ডিং-এ যান। এইদিকে যাওয়া যাবে না। বড়ো স্যার ছোটোখাটো বিষয়ে দেখেন না। ব্যস্ত আছেন।”

রাগিনী শুধু হেলেদুলে ভেতরে দেখার চেষ্টা করল। তবে কোনোমতেই পেরে উঠলো না সে। আগ্রহ নিয়ে তাদের দুজনকে বলল,
“আচ্ছা, এখানে একজন লোক ঢুকলো। একজন আ’হত লোককে নিয়ে। ব্লু কোট পড়া ছিল। উনি কে?”

কনস্টেবল দুজন এবার বড়োই বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকাল। মেয়েটির এত কৌতূহল তাদের ভালো মনে ঠেকল না। শক্ত গলায় বলল,
“আপনার কি কোনো কাজ আছে এখানে? থাকলে বলেন। আমাদের বিষয়ে আপনাকে কেন কৈফিয়ত দেব? আপনি যান তো! আপনাকে তো সুবিধাজনক লাগছে না।”

রাগিনী কোনোমতেই বোঝাতে পারল না তাদেরকে। বরং যেন তারাই উল্টো চোখে তাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে। রাগিনীর অতিরিক্ত উত্তেজনার চোটে কান্নাও পেয়ে যাচ্ছে। সে হতাশ হয়ে পেছন ফিরে কয়েক ধাপ হেঁটে বাহিরে এলো। দৃঢ় নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ির দিকে ধাবিত হলেও সবশেষে শোনা গেল এক কাঙ্ক্ষিত ব্যস্ততায় ভরা কণ্ঠ। রাগিনী ফিরে তাকাল তৎক্ষনাৎ। ফ্যাকাশে চোখেমুখে তখন অদম্য আগ্রহ। ফোনে কথা বলতে বলতে একমনে হেঁটে বাহিরে আসছে কোহিনূর। হাঁটাচলা, পোশাকে-আশাকে একটা চটপটে, দক্ষ, সাহেব রকমের হাবভাব। রাগিনী সবচেয়ে বেশি অবাক হলো তখন যখন দেখল দুটো কনস্টেবল তাকে স্যালুট করল। কোথাও একটা উত্তেজনা তড়তড় করে বাড়ল। নিঃশ্বাসের মাত্রা ঘন হয়ে এলো। কর্ণগোচর হলো মানুষটির উতলা কণ্ঠ।
“শোনো, ওখানে আমার মনে হয় অনেক বাচ্চা আছে যাদেরকে দিয়ে ভিক্ষা করানো হয়। যাদের শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ বি’ক্রি করা হয়। আর কবির স্বীকার করেছে ইতিমধ্যে এক থেকে দেড় বছরের বাচ্চাদের কোলে নিয়ে কিছু মহিলা যে ভিক্ষা করে বেড়ায় তারাও একটা চক্র। সবটাই টেরো’রিস্টের মাস্টারমাইন্ডের খেল! ওদের রেসকিউ করার ব্যবস্থা করো। এজ স্যুন এজ পসিবল, আন্ডারস্ট্যান্ড মেহরাজ?”

অপরপাশে কী বলা হলো তা শুনতে পেল না রাগিনী। শুনতে চাইলও না। এলোমেলো পায়ে এসে কোহিনূরের সামনে পড়ল সে। ফোন কাটতেই সামনে এসে পড়া হৃদয় জুড়ে থাকা নিজের প্রিয়তমার এমন মুখটা দেখে থমকালো কোহিনূর। ফোনটা কোনোরকমে পকেটে রেখে নিজেকে শান্ত রেখে জিজ্ঞেস করল,
“রাগিনী! তুমি এখানে হঠাৎ?”

রাগিনীর কানে যেন পৌঁছালোই না কথাটা। তার মাথাটা ঘুরছে এবার। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে গমগমে আওয়াজে বলল,
“কে আপনি?”

কোহিনূর নিজেও থতমত খেয়ে গেল! কী বলছে মেয়েটা? এই সময় এসে কীসব প্রশ্ন করছে? সে কি মজা করছে? কোহিনূর কিছু না বুঝে অসাময়িক হেঁসে বলল,
“তোমার অপ্রিয়তম ব্যক্তি!”

“সেটা জানতে চাইনি। আপনার পরিচয় কী? আপনি কী করেন?”

“সেকী! শাহ্ রাশেদ স্যার কিছু বলেনি তোমায়? তোমায় যেদিন আমি তোমার বাড়ির পেছনের চিলেকোঠা থেকে রেসকিউ করি সেদিন তো উনাকে সব বলেছিলাম। আমি কে! কেন আমি তোমার বাবার হসপিটালে পেশেন্টের বেশে ছিলাম! কেনই বা আমাকে শত শত মিথ্যে বলতে হয়েছে। সব বলেছি। তোমায় উনি কিছু জানান নি?”

রাগিনী মনে করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। তার বাবা তাকে শুধু বলেছিল, এই মানুষটিকে ভুলে যেতে। দ্রুত রাগিনী মাথা নাড়ায়। বিড়বিড়িয়ে বলে,
“কেউ কিছু বলেনি আমায়। আপনার রুমে আমি রি’ভলবার পেয়েছিলাম। আপনার শতশত মিথ্যের মাঝে আপনাকে শুধু আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে অপ্রিয় চরিত্র মনে হয়েছে। কিন্তু কেন করেছিলেন ছলনা? আপনি টেরো’রিস্ট নন?

কোহিনূর হতাশ ভঙ্গিতে তাকায়। সত্যিই মেয়েটা জানে না সে আসলে কে? কেন বলেছিল এত মিথ্যা? সে নির্লিপ্তে স্বীকার করে বসল,
” আমি কেন টেরো’রিস্ট হতে যাব? যাদেরকে ধরতে আমি মিশনে নেমেছি তাদের জন্যই আমার এত ছলনা।”

কোহিনূর থামল। ঢক গিলে বলল,
” রাগিনী, আমি নির্জন আহমেদ কোহিনূর। দ্যা লিডার ওফ সিক্রেট টিম পুলিশ ডিপার্টমেন্ট।”
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৫০ [অন্তিম পর্বের শেষাংশ]

কিছুক্ষণ পূর্বে বলা কোহিনূরের কথাটা রাগিনীর কর্ণগোচর হলেও নিজের শ্রবণশক্তিকে আর বিশ্বাস করে উঠতে পারল না সে। যেন আবারও ভুল শুনছে, আবারও হ্যালুসিনেট করছে। আস্তে করে হাত উঠিয়ে নিজের ডান কানে হাত রাখল সে। মাথা উচিয়ে উচ্ছ্বাস এবং স্তম্ভিত দৃষ্টি নিয়ে তাকাল সামনে থাকা গম্ভীর রূপ ধারণ করা মানুষটির উপর। নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে বলল,
“তাহলে ওই রিভ’লবার…”

“ওটা আমার। উপরমহল থেকে পারমিশন নিয়ে ইউজ করা রিভ’লবার। ওটা তোমার চোখে পড়ত না যদি হসপিটালে অ্যা’টাক না হতো।”

রাগিনীর নয়ন বৃহৎ আকার ধারণ করে। অস্ফুটস্বরে বলে,
“অ্যা’টাক?”

“তুমি কি সত্যিই কিছু জানো না? শাহ্ রাশেদ স্যার তোমায় কিছুই বলেন নি আমার সম্মন্ধে? আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার সবটা জেনে আমার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে চাইছিলে।”

রাগিনী মাথা নুইয়ে ফেলল। কোহিনূরও মুখটা অন্যদিক ফিরিয়ে রেখেছে। দুজনের মাঝে নীরবতা। রাগিনীর রাগ হলো নিজের প্রতি। সবই অতিরিক্ত চিন্তাভাবনার ফলাফল! সামনে থাকা মানুষটাকে ভুল বুঝতে বুঝতে নিজেই বোকামীর সমস্ত সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। নিজেই নিজের প্রতি বিরক্ত হলো। তার চুপ থাকা দেখে কোহিনূর নিজে থেকে বলল,
“লেট ইট গো! কোথা থেকে এলে এখানে?”

“শ…শপিং মলে আপনাকে ওই মেয়েটার সঙ্গে দেখেছিলাম সেখান থেকে…”

রাগিনী মিনমিন করে পুরো কথাটা বলতে পারে না। থেমে যায় পুরোটা বলার মাঝেই। কোহিনূর পকেটে হাত গুঁজে গাম্ভীর্য ধারণ করে বলে,
“ফলো করেছো?”

রাগিনী মৌনতা অবলম্বন করল। তার নীরব থাকা কোহিনূরের কাছে এক একটা প্রশ্নের উত্তর ঠিকই মিলিয়ে দিচ্ছে। কোহিনূর হাতটা তুলে সময় দেখে। দুপুর হয়ে এসেছে। আকাশের মাঝে তেজ ছড়ানো সূর্যের রশ্মি প্রগাঢ় হয়ে চলেছে। কোহিনূর নিজ থেকে বলে,
“যাকে শপিংমলে দেখেছিলে ও আমার বোন হয়। নিজের ছোটো বোন। তুমি তাকে আগেও দেখেছো। তবে সেদিন আমি ওকে চিনতে অস্বীকার করেছিলাম তোমার সামনে। তার জন্য সরি। বাই দ্যা ওয়ে, গাড়ি নিয়ে এসেছো না? বাড়ি যাও তবে। আমারও কিছু কাজ আছে।”

কোহিনূরের দায়সারা এবং গম্ভীর হয়ে বলা কথাগুলো শুনে রাগিনীর মনে হলো লোকটি রাগ করেছে কিংবা অভিমান! নয়তবা সে এভাবে কথা বলে না। যখন লোকটির ভেতর থেকে এক দীর্ঘশ্বাস এলো রাগিনী বুঝল মানুষটি কোনো কারণে কি কষ্ট পেয়েছে ভীষণ? কোহিনূর তার পাশ কাটিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে যেতেই তার হাতটুকু আলতো করে ধরে রাগিনী। সংকোচ কাটিয়ে বলে ফেলে,
“সবটা না বলে কোথায় চলে যাচ্ছেন? আমি সবটা জানতে চাই, অফিসার সাহেব।”

দুজন দুদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। রাগিনীর হাতে কোহিনূরের হাতটা আলতো করে বাঁধা। কোহিনূর চাইলেই তা ছাড়াতে পারে। তবে এই তুলোর ন্যায় স্পর্শ ছাড়াতে মন চাইল না। সে সেভাবেই দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,
“আর কী জানতে চাও?”

“সব জানতে চাই!”

কোহিনূরের অফিসের কেবিনে বসে রয়েছে রাগিনী। চেয়ারে বসে আশেপাশে ভালো করে দেখে নিলো সে। বেশ ছিমছাম করে সাজানো। ডানদিকে বড়ো ঘড়িটা বেশ পুরোনো। টেবিলে একগাদা ফাইলপত্র পড়ে রয়েছে। সবই কেসের ফাইল। বামদিকে তাকাতেই লাল রঙের নোটিশ বোর্ড চোখে পড়ল তার। সেখানে বেশ কয়েকজনের ছবি টাঙানো। আশ্চর্যের বিষয় হলো রাগিনীর ছবিটাও রয়েছে সবকিছুর মাঝে। রাগিনীর জানামতে নোটিশবোর্ডে সব আ’সামী আর সন্দেহভাজন ক্রি’মিনালের ছবি রাখা হয়। তবে তার ছবি সেখানে কী করছে? হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়াল রাগিনী। দ্রুত পায়ে গিয়ে দাঁড়াল বোর্ডের সামনে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। দরজা খুলে কারোর পায়ের শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে কোহিনূরকে ব্যস্ত পায়ে প্রবেশ করতে দেখল সে। একবার রাগিনীর দিকে চেয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে পড়ল লোকটা। রাগিনীও ফিরে এসে তার বিপরীতে বসল। আগ্রহ দমাতে না পেরে প্রশ্ন করে ফেলল,
“ওখানে আ…আমার ছবি…”

“তুমি নামক য’ন্ত্রণা থেকেই তো ঘটনার শুরু রাগিনী। তাই তোমার ছবি নোটিশ বোর্ডে থাকবে না তা কি হয়?”

“মানে?”

কোহিনূরের গলা শুঁকিয়ে গিয়েছে। সে টেবিলে থাকা পানি খেয়ে এবার একনাগাড়ে বলা শুরু করল,
“তুমি হয়ত জানো ঢাকায় বর্তমানে টে’রোরিস্ট টিমের বিশাল হা’মলার মুখে। তারা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছে জায়গাটাকে নিঃস্ব করে দিতে। আর এই কেসের দায়িত্ব আমার হাতেই এসে পড়ে। আমি কাজে লেগে পড়ি। জানা যায় চট্টগ্রামে তারা ধ্বংসলীলা চালিয়ে এখন ঢাকার উপর নজর পড়েছে। আমি সব ইনফরমেশন কালেক্ট করি। একজন আই উইটনেসের বর্ণনা অনুযায়ী রাগিনী তাজরীনের দিকে আঙ্গুল ওঠে। অর্থাৎ তোমার দিকে। তোমার নামে সবটা জেনে নিলাম। তুমিও চট্টগ্রামেই ছিলে। আমার সন্দেহের তীর তোমার উপরে গিয়ে পড়ল। কিন্তু একটা কথা মাথায় আসছিল না একটা মেয়ে যার কোনো অভাব নেই। যার বাবা একজন নামি-দামি সাইকোলজিস্ট তার মেয়ে কেন এই পথে হাঁটবে? তবুও আমি তোমাকে সন্দেহের বাহিরে রাখতে পারিনি। তাই আমি পেশেন্ট হয়ে আসি তোমার জীবনে। যতটা পেরেছি ততটা তোমার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেছি। আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তোমার সম্পর্কে জানা। মনে আছে? তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরের দিন ভোরে আমি তোমার বাড়িতে যাই? তোমার ঘরে যাওয়ার বায়না ধরেছিলাম। সেটা এমনি এমনি ছিল না। তোমার ঘর সার্চ করেছিলাম সেদিন। তারপর আমাকে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিলে সেখানে তোমার উপর ওই অ্যা’টাক…”

রাগিনী কোহিনূরের কথার মাঝপথে থামিয়ে থমথমে গলায় বলল,
“আপনি করিয়েছিলেন?”

কোহিনূর নির্লিপ্তে মাথা ঝাঁকাল। রাগিনী মনটা বিষিয়ে উঠল মূহুর্তেই। ইচ্ছে করল সামনের মানুষটাকে ইচ্ছেমতো কথা শুনিয়ে দিতে। আর কেঁদে উঠে জিজ্ঞেস করতে, ‘এমনটা করতে পারলেন আপনি?’ তবে রাগিনী নিজেকে সামলায়। ঢক গিলে বলে,
“তারপর বলুন!”

“আমি যা আশা করেছিলাম তুমি তার উল্টো বের হলে। আস্ত একটা ভীতুর ডিম। যার কিনা এসবে ভয় কাজ করে। জ্বর আসে। আমার বিষয়টা অদ্ভুত লেগেছিল। আমি শুধু পাগল হয়ে গিয়েছিলাম এটা ভাবতে ভাবতে যে তুমি কী করে এসব করতে পারো?”

রাগিনী চুপ করে রইল। মাথা নিচু করল। চোখের টলটলে পানি সে দেখাতে রাজি নয়। মনে বার বার একটা প্রশ্ন ধা’ক্কা দিতে থাকল। সব অনুভূতি মিথ্যে ছিল? মানুষটির চোখে বসন্তময় প্রেমের জোয়ার ভুল ছিল? মানবটির সুন্দরতম স্পর্শের পেছনেও স্বার্থ ছিল? ছিল বুঝি কোনো বড়ো উদ্দেশ্য? তাদের মাঝে ছিল না কোনো প্রণয়ী মাখা মূহুর্ত? কর্ণকুহরে ভেসে এলো কোহিনূরের শান্ত কণ্ঠ,
“তবে সেই নম্রতার স্পর্শ আমায় চিনিয়ে দিয়েছিল যে সে নম্রতার রানি। তার কোমলতা আমায় গ্রাস করেছিল। এই দক্ষ অফিসারের সন্দেহের চাহনিকে ভুল প্রমাণ করে নিজের সুন্দর চাহনিকে জিতিয়ে দিলো।”

রাগিনীর প্রতিক্রিয়া নেই। সে মাথা নুইয়ে একভাবে বসে। চোখ দুটো বন্ধ। মাঝে মাঝে মৃদু কেঁপে উঠছে। তা কোহিনূর লক্ষ্য করলেও সে থামল না।
“আমার সারা শরীরে অসংখ্য যেই দাগ দেখেছিলে সেটা আমার এই ভয়া’নক জবের কারণেই। যেই কয়টা বছর এখানে কাজ করেছি আর কেস সলভ করতে হয়েছে আর শত্রুপক্ষের সামনে পড়তে হয়েছে এবং তাদের করা আ’ঘাত শরীরে বহন করতে হয়েছে। কখনো বু’লেট শরীরে গেঁথে গিয়েছে আবার কারো ছু’রির আ’ঘাতে র’ক্তাক্ত হতে হয়েছে। আমার গালে আর কপালেও বেশ কিছু এক রয়েছে। গালের দাগ ঢাকা থাকে দাড়িতে আর কপালেরটা চুলের কারণে দেখতে পাওয়া যায় না। আরো একটা কারণ আছে। আমার বাবা পুলিশ অফিসার ছিলেন। সেই সুবাদে শ’ত্রুপক্ষের ক্ষো’ভের স্বীকার হতে হয়েছিল। পুরো পরিবারকে আ’গুনে পু’ড়িয়ে মা’রার চেষ্টা! তারপর আমি আর আমার বোন নয়নতাঁরা বেঁচে গেলাম! কিন্তু আ’গুনে পুড়ে যাওয়ার দাগটা এখনো আছে।”

অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকাল রাগিনী। চমকে উঠল কোহিনূর। কী হলো মেয়েটার? কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাগিনী ভেজা গলায় জিজ্ঞেস করল,
“এখনো কি সন্দেহ করেন আমি এই কাজে যুক্ত?”

এবার বুঝে উঠতে পারল রাগিনীর এমন অশ্রু ভরা পানির কারণ। সে নিজের চেয়ার থেকে উঠে রাগিনীর নিকট এসে দাঁড়াল। রাগিনীর হাতটা আস্তে করে ছুঁয়ে বলল,
“আপনি তো তার থেকেও বড়ো অপ’রাধী বের হলেন ফিউচার সাইকোলজিস্ট ম্যাডাম! এই সিক্রেট অফিসারের কঠিন মনটাকে নিজের আওতায় করে ফেললেন নিজের ছলনায়।”

অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল রাগিনী। আজ এতবার চমকাচ্ছে কেন সে? ইচ্ছে করল নিজেকে চিমটি কাটতে। সে স্বপ্ন দেখছে নাকি সব সত্যি? উৎসুক পানে সে চেয়ে রইল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুপুরুষটির দিকে। কোহিনূর তার দৃষ্টিতে থাকা অজস্র প্রশ্ন বুঝে তাকে টেনে চেয়ার থেকে উঠিয়ে দাঁড় করালো। মুখের সামনে থাকা চুলগুলো ঠিকঠাক করে কিছু চুল কানের পিঠে কিছুটা উপরে ঠেলে দিয়ে স্নিগ্ধতায় মোড়ানো মুখটা বের করে বলল,
“আমি জানি তুমি রাগ করেছো। ভীষণ রেগে আছো। বাট ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড মাই সাইড প্লিজ ম্যাডাম! আচ্ছা, ইমাজিন করো এই কোহিনূরের মতো আরো একজন কোহিনূর আছে। মানে শরীরটা আলাদা কিন্তু চেহারা হুবহু এক। তবে তুমি কি কনফিউজড হবে না?”

কপাল কুঁচকে গেল রাগিনীর। কোহিনূরের কথা বোধগম্য হলো না তার। বলল,
“মানে?”

“তোমার মতো দেখতে আরো একজন এক্সিস্ট করে সেটা কি তুমি জানো?”

চোখ দুটো এবার কপালে উঠে গেল রাগিনীর। নিজের উত্তেজনা দমাতে না পেরে জোরে বলে উঠল,
“কী? মানেটা কী?”

কোহিনূর রাগিনীর মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“রিল্যাক্স। সব বলছি তো!”

কোহিনূর একে একে সবটা খোলাসা করল রাগিনীর সামনে। রাগিনী হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মুখে এলো না কোনোরকম কথা। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। তার অগোচরে এতকিছু ঘটেছে? তারই চেহারা নিয়ে কেউ একজন ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে। সহ্য হলো না রাগিনীর। চরম রাগ হলো সেই মেয়েটির প্রতি। কেন তারই চেহারা বাছতে হলো তাকে? অন্যকেউ ছিল না? হিসাব মিলল একে একে। অভিরূপের বলা প্রতিটা কথা এবার মিলে যেতে শুরু করল। সেদিন হসপিটালের কথা থেকে শুরু করে আজকের যেই ছবি ভাইরাল হয়েছিল সেটা অবধি মিলে গেল রাগিনীর কাছে। সবটা ভেবে মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিল রাগিনীর। মাথা চেপে ধরল একহাতে। সব বলা শেষে কোহিনূর ঠাণ্ডা মাথায় রাগিনীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“এখন বলো! আমার সন্দেহ করা কি অযৌক্তিক ছিল?”

রাগিনী থম মে’রে দাঁড়িয়ে রইল আনমনা হয়ে। মাথাভর্তি চিন্তা। বাবা তাকে এতকিছু জানালেন না কেন? হয়তো রাগিনী ডিপ্রেশনে আগে থেকেই ভুগছিল সেকারণে সবই আড়াল করে নিজে একাই সব চিন্তা মাথায় করে নিয়ে হার্ট অ্যা’টাক করে বসেছিলেন! মানুষটা এত চাপা কেন? মিনমিন করে রাগিনী উত্তর দিলো,
“ছিল না অযৌক্তিক। আপনি আপনার জায়গায় ঠিক রয়েছেন এবং আছেন। তার মানে এসবকিছু করার পেছনে আপনার একটা উদ্দেশ্য ছিল! আমার কাছাকাছি আসা! আমার কাছে কাছে থাকা সবটা আপনি অহেতুক বা নিজ ইচ্ছাতে করেন নি তাই না?”

কোহিনূরকে বেশ ভাবালো রাগিনীর এই প্রশ্ন। এটা তো সঠিক যে প্রথম প্রথম সে মোটেও নিজ ইচ্ছেতে রাগিনীর কাছে থাকেনি। সবকিছু করেছিল বাধ্য হয়ে তবে এখন তো সেই বাধ্যবাধকতা নেই। সেটা মিশে গিয়েছে মাটির সঙ্গে কবেই। উদ্ভব ঘটেছে নাম না জানা সম্পর্কের। তবুও সে রাগিনীর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য নির্লিপ্তে বলল,
“না করিনি। বাধ্য হয়েই করেছিলাম।”

রাগিনী দাঁত কিড়মিড় করে তাকালেও কণ্ঠস্বর শান্ত রাখল নিজের। শরীরটা রা’গে, দুঃখে জ্বলে যাচ্ছে এবার। ফট করে জিজ্ঞেস করল,
“আর সেদিন রাতে ওই চুমু? সেটা ঠিক কি কারণে খেয়েছিলেন শুনি? স্পর্শ করেছিলেন কেন আমাকে?”

রাগিনী ফট করে এমন চটে যাওয়া দেখে থতমত খেয়ে যায় কোহিনূর। নিজেকে ধাতস্থ করে মুচকি হেসে দেয় সে রাগিনীর আড়ালে। অতঃপর জবাবে বলে,
“তোমায় চুমু খেতে মিষ্টি, ঝাল নাকি টক সেটা ট্রাই করছিলাম।”

রাগিনীর মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল এবার। একে তো কোহিনূর নিজের পরিচয় সঠিক সময় জানায় নি। প্রচণ্ড দেরি করে ফেলেছে। এতোটাই দেরি করেছে যে এখন সবটা হাতের বাহিরে। অভিরূপের সঙ্গে বিয়েতে রাজি হয়েছে একপ্রকার জেদ করে এবং কোহিনূরের উপর অভিমান করেই। এখন কী হবে? কোহিনূরকে মৃদু ধা’ক্কা দিয়ে নিজেই সরে এলো রাগিনী। চিল্লিয়ে বলল,
“চরিত্রহীন পুরুষ! অসভ্য লোক। দূরে থাকুন।”

এতদিন পর নিজের ধানিলঙ্কাকে দেখতে পেয়ে মনটা যেন নেচে উঠল কোহিনূরের। এ যেন জলন্ত আ’গুন জ্বলে উঠেছে দাবানল হয়ে। গালে দেখা গেল রক্তিম আভায় জর্জরিত। নাক ফুলিয়ে সাপের ন্যায় ফোঁস ফোঁস করছে সে। কোহিনূরের মনে পড়ল মেহরাজের বলা একসময়ের কথা। একদা সে বলেছিল, ‘প্রতিটি নারীর মাঝে একটা গুপ্ত নাগিন লুকায়িত থাকে। সময় পেলেই তা জেগে ওঠে।’
আজ যেন সেই গুপ্ত নাগিনকেই দেখতে পাচ্ছে কোহিনূর। রাগিনী হিসহিসিয়ে বলে,
“আমিই বোকা! আমি মনে মনে ভেবে নিয়েছিলাম আপনি আমাকে ভালোবাসেন। ভেবেছিলাম আমার সঙ্গে হাতে হাত রেখে বাকি জীবন কাটানোর আবদার করবেন কোনো এক সময়! কিন্তু আমি ভুল। সবটা ভুল। সবকিছু ভুল।”

রাগিনী তড়িঘড়ি করে ব্যাগটা ভালোমতো কাঁধে নিয়ে নিলো। কোনোরকম কথা বলল না আর। এখানে আর এক মূহুর্ত থাকবে না। যাওয়ার পথ ধরলেই দ্রুততার সঙ্গে তার হাতটা এবার চেপে ধরে কোহিনূর। নিজের সঙ্গে তাকে মিশিয়ে নিতেই শুরু হলো রাগিনীর ছটফটানি। নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টায় ব্যর্থ হলে কোহিনূর তার দাড়িভর্তি গাল রাগিনীর নরম গালে লাগিয়ে বলল,
“এইযে বোকা মেয়ে! একটু শান্ত হও। একটা গল্প শোনাই! এক অফিসারের প্রেমে লুটিয়ে পড়ার গল্প একটু শুনে যাও।”

“শুনব না আমি। ছাড়ুন। নয়ত চিৎকার করব আমি।”

“করো! যত খুশি করো। আমার লোকজন এসে দেখুক আমি কীভাবে তোমায় সামলাচ্ছি।”

রাগিনী দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল এবার। কোহিনূর বলল,
“গোধূলি এক বেলায় এক পুরুষের দৃঢ় নজর পড়েছিল এক কোমল নারীর দিকে। পুরুষটি ভেবেছিল সে এই কোমল নারীকে ধ্বংস করবে। তবে হলো ঠিক বিপরীত কান্ড। ঘটল অঘটন। সেই কোমলতায় ধ্বংস হতে চলল সেই পুরুষ। এক ধারালো ছুরির মতো নারীটি প্রবেশ করল তার হৃদয়ে। পুরুষটি বলে উঠল…”

রাগিনী কৌতূহলী হয়ে শুধালো,
“কী বলে উঠল?”

“গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে। আমার হৃদয়ে জোরপূর্বক প্রবেশ করেছিলে। খুব কি দরকার ছিল এই অঘটন ঘটানোর?”

রাগিনী শিথিল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কোহিনূর তার দুহাতের উপর হাত রেখে বলল,
“ভালোবাসি তো, মিস. সাইকোলজিস্ট ম্যাডাম!”

রাগিনী খুশির জোয়ারে ভাসবে নাকি রেগে মানুষটিকে দূরে সরিয়ে রাখবে বুঝল না। দিশেহারা হয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে পড়ল। ঠোঁট কামড়ে নিজের সম্পূর্ণ প্রতিক্রিয়া ঢাকার চেষ্টা করল। অস্পষ্ট সুরে বলল,
“মিথ্যে!”

“ডাহা সত্যি! ভালোবাসলে কি ভালোবাসি বলতেই হবে? সাইকোলজিস্ট ম্যাডাম কি আমার চোখ পড়তে অক্ষম হয়েছে? ভালোবাসি বললেই বুঝি ভালোবাসা হয়?”

রাগিনী এবার রাশভারী গলায় বলল,
“তবে আমার বাবাকে জানান নি কেন? বলেন নি কেন আমাদের কথা?”

“স্যার বলতে দিলেন কোথায়? বলার সুযোগ দেওয়ার আগেই সুন্দর করে প্রত্যাখান করে দিলেন আমায়।”

রাগিনী ঘুরে দাঁড়াল এবার। কোহিনূরের চোখে চোখ রেখে বলল,
“কেন?”

কোহিনূর মলিন হাসে। গাম্ভীর্যের সাথে বলে,
“পুলিশ ডিপার্টমেন্টের জব! নিরাপত্তা নেই। প্রতিটা মা-বাবা চায় তার সন্তান নিরাপদে জীবনযাপন করুক। যদি তোমার কিছু হয়ে যায় আর আমি তোমায় নিরাপত্তা প্রদান না করতে পারি তবে সবটা শেষ হয়ে যাবে যে। আর তোমার আর আমার বিয়ের পর যদি কখনো আমার কিছু হয়ে যায় তবে তুমি যে ভেঙে পড়বে! তাই উনি আমাকে প্রত্যাখান করলেন।”

“আপনি আর কিছু বলেন নি বাবাকে?”

কোহিনূর মৃদু সুরে বলল,
“কী বলব?”

রাগিনীর আরেক দফা রাগ হলো। লোকটা সব তো রাগার মতোই ভুলভাল কাজ করেছে। সবটা কি সহ্য করা যায়? সে আবারও দূরে ছিটকে গিয়ে তার ব্যাগ হাতে নিয়ে সেটা দিয়ে কোহিনূরের বুকে অনবরত মা’রতে মা’রতে বলল,
“ঠিকই তো! তা বলবেন কেন! আমার কাছ থেকে ছাড়া পেতে চাইছেন তাই না?”

রাগিনীর হাতটা ধরল কোহিনূর। মেয়েটা মে’রেই চলেছে। হাফ ছেড়ে বলল,
“এখান থেকে ছাড়া পেতে হলে মৃ’ত্যু ছাড়া আর কোনো পথ তো দেখতে পাচ্ছি না রাগের রানি!”

রাগিনীর রাগ কমল না। চোখ ভর্তি অশ্রু নামলো। আজ তার এঙ্গেজমেন্ট। কী করবে ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়ল। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বলল,
“মিথ্যুক! আমি চলে গেলেই তো আপনার ভালো। আপনি বরং এখানে বসে বসে আপনার কেস সলভ করুন এবং আমার আর অভিরূপের এঙ্গেজমেন্টের লাইভ টেলিকাস্ট দেখুন।”

রাগিনীর শেষ কথার আগামাথা বুঝে উঠতে পারল না কোহিনূর। হা করে চেয়ে রইল। রাগিনী হনহনিয়ে বেরিয়ে যেতেই সেই মূহুর্তে মেহরাজ এসে প্রবেশ করল। তাকে দেখেই চক্ষু চড়কগাছ হলো রাগিনীর। মেহরাজ চোখমুখ খিঁচে নিজের মুখটা ঢাকতে গিয়েও লাভ হলো না।
“এই আপনি! এখানে কী করছেন?”

আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল রাগিনী। মেহরাজ বুঝল আর লাভ নেই। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“হ্যালো, রাগিনী ম্যাডাম। আমি স্যারের এসিস্ট্যান্ট অফিসার!”

“আপনারা সবগুলো ঠক! আপনাদের সকলের বিরুদ্ধে আমি কেস করব। মিথ্যেবাদী একেকটা।”

রাগিনী দ্রুত পায়ে চলে গেল। কোহিনূর থমকে দাঁড়িয়ে রইল কিছুটা সময়। একটা সময় বিড়বিড় করে বলল,
“অভিরূপ আর রাগিনী এঙ্গেজমেন্টের লাইভ টেলিকাস্ট মানে?”

মেহরাজের কানে এলো সেটা। দ্রুতই সে এগিয়ে এসে বলল,
“স্যার, স্যার! এখন নিউজ চ্যানেলে হেডলাইন বেরিয়েছে। সিঙ্গার অভিরূপ চৌধুরীর সাথে রাগিনী তাজরীনের এঙ্গেজমেন্ট। আজ ঠিক সন্ধ্যে সাতটায়।”

কোহিনূরের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো পরমুহূর্তেই। দরদর করে ঘামতে শুরু করল। গভীর ভাবনায় মত্ত হলো। ফের স্বাভাবিক হয়ে বলল,
“হবে না এঙ্গেজমেন্ট!”

“আপনি কী করে জানলেন স্যার? যেখানে মিডিয়া একশো পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিচ্ছে?”

কোহিনূর স্মিত হাসল। প্যান্টের পকেটে নিজের হাতটা গুঁজে বলল,
“আমি জানি বলেই বলছি। রাগিনীর উপর এই বিশ্বাসটা আমার আছে। আর সে আমার বিশ্বাস ভাঙবে না কখনোই।”

অনেক আয়োজনের মাঝে নিজের ঘরে বসে ডায়েরী ঘাঁটাঘাঁটি করতে ব্যস্ত রাশেদ সাহেব। তন্নতন্ন করে খুঁজে চলেছেন ডায়েরীর প্রতিটা পাতা। কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছেন না কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি। ফলে কপালে পড়েছে প্রগাঢ় ভাঁজ। একহাতে ফোন। ফোনে ডায়াল স্ক্রিন অন করা। ডায়েরীতে খুঁজে না পেয়ে ডায়েরী বন্ধ করলেন তিনি। বিরক্তি নিয়ে ছুটলেন আলমারির দিকে। আলমারি ঘেঁটে টেনে বের করলেন একটা ফাইল। লাল রঙের এই ফাইলটা উনার অতি অপ্রিয় হলেও কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণে তিনি এটা বছরের পর বছর যত্নে রেখে দিয়েছিলেন। ফাইল খুলে বের করলেন একটা নম্বর। দ্রুত ফোনে নম্বর তুলতেই ঘরে চা নিয়ে প্রবেশ করল সৈয়দ। রাশেদ সাহেব ভ্রুক্ষেপ না করে নিজ কাজে ব্যস্ত হলেন। নম্বরটা বন্ধ। রাশেদ সাহেব রাগ হলেন ভীষণ। ধপ করে বসলেন বিছানায়। অস্থির হয়ে পড়লেন। বুকে হাত রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গে সৈয়দ এগিয়ে এসে চিন্তিত গলায় বলল,
“স্যার, ঠিক আছেন?”

“ঠিক আছি আমি। কিন্তু কতক্ষণ ঠিক থাকব জানি না।”

“এমন কথা বলতেছেন কেন?”

রাশেদ সাহেব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন,
“সেটা তোমার জানা কথা সৈয়দ। কেন আমার এত অস্থিরতা! ওইদিন ওই হসপিটালে ওই মেয়েটিকে দেখে আমি কিছুতেই শান্ত হতে পারছি না।”

সৈয়দ উনাকে আশ্বস্ত করে বলল,
“এই বিষয়টা নিয়া তো আপনে নিশ্চিত না। বিষয়টা কাকতালীয় হতে পারে। এসব নিয়ে মাথা ঘামায়ে শরীর খারাপ না করে আমাদের রাগিনী মায়ের বিয়েতে আনন্দ করেন।”

“কিন্তু ওই ছয়টা আঙ্গুল আমাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না সৈয়দ!”

“কইলাম তো! কাকতালীয় হতে পারে। মনটা ভালা রাখেন। মেয়েটাকে ভালো জায়গায় বিয়ে দিতাছেন। এইডাই তো খুশি। আপনের জামাই তার মা-বাবা নিয়া আসলো বলে। তাড়াতাড়ি আসেন নিচে।”
সৈয়দ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তবে চিন্তা কমে না রাশেদ সাহেবের। বরং বাড়তে থাকে।

সন্ধ্যের আগমূহুর্ত। আকাশে অন্ধকার নেমে আসছে। দেখা যাচ্ছে চাঁদের সৌন্দর্য। কোহিনূর আজ দ্রুতই বাড়ি ফিরেছে। বেশ তাড়াহুড়ো লেগে আছে বাড়ি ফেরার পর থেকে। সে আবার কোথাও বের হবে। রাগিনীর ফোনের লোকেশন বর্তমানে তার বাড়িতে নয় অন্য কোথাও দেখাচ্ছে। এতে কোহিনূর নিশ্চিত রাগিনী এঙ্গেজমেন্টের ভয়েই বাড়ি যাচ্ছে না। সে আসার পরপরই ওয়াশরুমে ঢুকে গিয়েছে ফ্রেশ হতে।

দরজাটা হালকা ফাঁক করে ঘরের ভেতরটা ভালো করে দেখে নেয় নয়নতাঁরা। ঘরটা একদম ফাঁকা। বেডে চোখ পড়তেই দেখল সেখানে অগোছালো হয়ে পড়ে আছে কোহিনূরের পরনে সব পোশাক। ওয়াশরুম থেকে আসছে পানি পড়ার শব্দ। পা টিপে টিপে কোহিনূরের ঘরে প্রবেশ করল নয়ন। চারিপাশে খুঁজতে থাকল কোহিনূরের ফোনটা। খুঁজে পেল না! তারপর বেডের কাছে গিয়ে তার ভাইয়ের একেকটা জামা সরাতেই বেরিয়ে এলো কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি। এইতো তার ভাইয়ের ফোন। দ্রুত ফোন নিয়ে ফোনের স্ক্রিন অন করল নয়ন। দৃশ্যমান হলো রাগিনীর মিষ্টি হাসির একটা ছবি। তৎক্ষনাৎ দাঁত কেলিয়ে হাসল নয়নতাঁরা! তার ভাইটা কবে থেকে এত রোমান্টিক হলো? ভালোবেসে প্রেমে পড়লে বুঝি সব হয়!

নিজের ভাবনার অন্ত ঘটিয়ে দ্রুত নিজের ফোনটাও প্যান্টের পকেট থেকে বের করল নয়ন। ওয়াশরুমের দিকে একবার তাকিয়ে তাড়াতাড়ি করে কোহিনূরের ফোনের ফোন নম্বর অপশনে গেল সে। নয়ন জানে তার ভাই কখনোই ফোনে পিন বা পাসওয়ার্ড কিছুই দেয় না। এতেই অবশ্য তার সুবিধা হয়েছে। দ্রুত স্ক্রল করে করে ইন্সপেক্টর রায়ান নামে সেভ করা নম্বরে এসে থামল সে। মুখে ফুটে উঠল বিশ্ব জয়ের হাসি। নিজের ফোনে তুলে নিলো নম্বরটা। তারপর কোহিনূরের ফোনটা নিজের জায়গায় রেখে দিয়ে বেরিয়ে এলো নয়নতাঁরা।

নিজের ঘরটাতে এসে দরজা লক করে বেডের উপর উঠে খুশিতে লাফিয়ে লাফিয়ে কিছুক্ষণ পর শান্ত হয়ে বসল নয়ন। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন রায়ানের নম্বরটা ডায়াল করেই কল করে বসল সে। বুকটা দুরুদুরু করছে তার। সে জানে না মানুষটা কল রিসিভ করলে কী বলে কথা শুরু করবে! তবে তাকে কথা বলতে হবে। একবার কল দিলে কল রিসিভ না করলেও পরবর্তীতে কল রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে রায়ানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর!
“হ্যালো! ইন্সপেক্টর রায়ান সিকান্দার বলছি!”

নয়নতাঁরার কণ্ঠস্বর এমনিতেই আঁটকে গেল তখন। কিছু বলার চেষ্টায় থেকেও পারল না। রায়ান জবাব না পেয়ে এবার জোর দিয়ে বলল,
“হ্যালো! কে বলছেন?”

নয়নতাঁরা এবার ঘনঘন শ্বাস ফেলে কণ্ঠস্বর চিকন করে বলল,
“আমি একটা মেয়ে বলছিলাম।”

“মেয়ে বলছেন সেটা বুঝতে পেরেছি। তবে নামটা কী? আর কল করেছেন কেন? এনি প্রবলেম?”

নয়নতাঁরা এবারও আটকালো। কী বলবে খুঁজে পেল না। সেই লজ্জাজনক ঘটনার পর আরো লজ্জা লাগছে তার কথা বলতে। এবার রায়ানের কথায় তাজ্জব বনে গেল নয়নতাঁরা।
“মিস. নয়নতাঁরা! কিছু বলবে?”

নয়নতাঁরার বুকে যেন অনবরত ঢোল পে’টাতে শুরু করল। এভাবে কেউ সম্মোধন করে নাকি কাউকে? যে কেউ স্ট্রো’ক করে ফেলতে পারে। নয়নতাঁরা মিনমিন করে বলল,
“আপনি জানলেন কী করে এটা আমি?”

“যেদিন আমার কাছে ফোন ফেলে গিয়েছিলে সেদিন আমি বুঝিনি এটা কার ফোন। তাছাড়া আমার ছবি দেখে কিছুটা হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ফলস্বরূপ আমাকে চেক করতে হয়েছিল তোমার নম্বর। তাই আমি জানি এটা তোমার নম্বর। আর কিছু?”

নয়নতাঁরা মাথা চুলকায়। লোকটার ভারি বুদ্ধি। সেই বুদ্ধির সামনে নয়ন ছোট্ট একটা পিঁপড়ে মাত্র। সে মুখ ফস্কে বলে ফেলে,
“থ্যাংকস।”

রায়ান কিছুটা কনফিউজড হয়ে বলে,
“থ্যাংকস কেন হঠাৎ?”

“আমার ফোনটা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।”

“এতগুলো দিন পর আমাকে থ্যাংকস বলার জন্য মনে পড়ল?”

নয়নতাঁরা বিরবির করে বলে উঠল,
“মনে তো সবসময় পড়ে। আপনার মতো নিরামিষ মানুষের বোঝার ক্ষমতা নেই। বুঝতে হলে নয়নতাঁরার ক্লাস করতে হবে অনেক অনেক।”

রায়ান ফোনের ওপাশ থেকে খুব একটা শুনতে পেল না। তাই জিজ্ঞেসা করল,
“কিছু বললে?”

নয়নতাঁরা হকচকিয়ে বলল,
“না না। কিছু না। বলছিলাম আপনার নম্বর পাইনি তাই থ্যাংকস জানানো হয়নি।”

“এনিথিং এলস্? আসলে আমি অফিসে এখনো। একটু বিজি।”

নয়নতাঁরা এবার আবদার করে বসল,
“লাস্টবার যখন আমার বাড়িতে এলেন তখন তো আপনাকে বাড়ির ভেতরে বসতেও দিতে পারিনি। চলে গেলেন। তাই বলছিলাম সেই ভুল শুধরে নিতে আপনাকে আমার বাড়িতে ইনভাইট করলাম।”

রায়ান কিছুটা থেমে থেমে বলে,
“কিন্তু এসবের তো দরকার নেই। আমাকে বাড়িতে বসতে দিতে হবে এটা কে বলেছে?”

“আমি বলেছি। ফ্রি আছেন কবে?”

“তা জেনে তুমি কী করবে?”

নয়নতাঁরা এবার কিছুটা রাগের রেশ ধরে বলল,
“পাল্টা প্রশ্ন না করে সঠিক জবাবটা দিন না!”

“শনিবার বাদে ফ্রি নেই আমি।”

“তবে শনিবারে সন্ধ্যা ছয়টায় আমি আপনার জন্য শেরাটন রেস্টুরেন্টে ওয়েট করব।”

রায়ান আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে গেলেও নয়নতাঁরার কথার চাপে বলাটা আর হয়ে উঠল না।
“মনে থাকে যেন ঠিক সন্ধ্যে ছয়টায়।”

ব্যস…কল কেটে গেল। রায়ানের বিনয়ের সাথে প্রস্তাবটা প্রত্যাখান করা আর হলো না। সে ফোনের দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল। মেয়েটা মাথাতে নিশ্চিত কোনো সমস্যা রয়েছে। ভাবনার জোয়ারে না ভেসে ফোনটা টেবিলে রাখল সে। না চাইতেও আনমনে আওড়ালো,
“যেমন ভাই তার তেমন বোন! আর আমি বারবারই তাদের মাঝে ফেঁ’সে যাই! উফফ…!”

সন্ধ্যে তখন ঠিক সাড়ে ছয়টা। খুব একটা লোকজনের সমাগম না করলেও রাশেদ সাহেব বাড়ি সাজানো নিয়ে কোনোরকম ত্রুটি রাখেন নি। চারিপাশটা সাদা রঙের আলোয় ঝকঝক করছে। চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে। সিঁড়ির রেলিংয়ে মোড়ানো সাদা ফেইরি লাইট। রাগিনীর সাদা রঙটা বেশ পছন্দ! তাই রাশেদ সাহেব আজকের সাজসজ্জা সবটা সাদা রঙ দিয়েই করেছেন। সাদা ফেইরি লাইটের মাঝে সাদা রঙের ফুলগুলোও দৃশ্যমান। নাদিম সাহেব অর্থাৎ অভিরূপের বাবা তার পুরোনো বন্ধুকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়েছেন। সেই সঙ্গে বন্ধুর সঙ্গে গড়ে উঠতে চলেছে নতুন সম্পর্ক! এতে আরো আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়েছেন তিনি। খুশির আমেজের যেন শেষ নেই। অপরদিকে রাশেদ সাহেব চিন্তার মাঝেও নিজের খুশি বজায় রাখতে ব্যস্ত। চিন্তাটুকু জুড়ে রয়েছেন উনার মেয়ে রাগিনী। মেয়েটা এখনো অবধি বাড়ি ফিরেনি। অথচ কিছুক্ষণ কর অনুষ্ঠান শুরু হবে। বুকটা ধড়ফড় করছে উনার। মেয়েটার কিছু হলো না তো আবার? বেশ কয়েকবার কল করেছেন ইতিমধ্যে তবে রাগিনী ফোন তোলেনি। বিষয়টা আরো বিষাদের হয়ে দাঁড়িয়েছে উনার কাছে। অভিরূপ নিজের ঘরে নোমানের সঙ্গে তৈরি হতে শুরু করেছে। বেশিক্ষণ লাগবে না তার। ছেলেমানুষের তৈরি হতে খুব একটা সময় লাগে না। কিন্তু রাগিনী কোথায়? কিছুক্ষণের মাঝে যখন প্রশ্ন উঠবে কী জবাব দেবেন?

হলরুমের বড়ো সোফায় বসে বেশ আড্ডা চলছিল বয়স্কদের মাঝে। ছিলেন নোমানের বাবাও। কথায় কথায় ছোট্ট রিও রাজা বেশে নিচে নেমে বেশ আয়েশ করে হেলেদুলে এসে লাফ দিয়ে উঠে রাশেদ সাহেবের পাশে গা এলিয়ে দিলো। সকলে কিছুটা চমকে তাকাল তার দিকে। রিও কেও আজ জামা পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মাথায় সুন্দর টুপি। এটা নোমানের কাজ। নোমানও বিড়াল বেশ পছন্দ করে। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো রিও রাগিনীর পর নোমানের সঙ্গে সখ্যতা গড়েছে। রিও এর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে এখানে তারই আধিপত্য। বিড়াল ছানাকে দেখে অভিরূপের মা মিসেস. সুরভী জিজ্ঞেস করলেন,
“এটা কার? বাড়ির ছোট্ট মেম্বার নাকি?”

“রাগিনীর এটা। রাস্তা থেকে রেসকিউ করে নিয়ে এসেছে। প্রচন্ড দেমাগ তার।”

বলেই রাশেদ সাহেব হাসার চেষ্টা করেন। রাগিনীর প্রসঙ্গ ওঠায় সঙ্গে সঙ্গে সুরভী বলে বসেন,
“ভালো কথা! রাগিনী কোথায়? যার জন্য এত আয়োজন তার দেখা পেলাম না আসার পর থেকে।”

রাশেদ সাহেব থতমত খেলেন। একটা বাহানায় সেখান থেকে উঠে এলেন। কল করলেন মেয়েকে বারংবার।

অভিরূপ বেশ যত্নসহকারে নিজের চুল ঠিকঠাক করছে। নিজের কোটের কলারে বার বার হাত দিয়ে দেখছে ঠিক আছে কিনা। মনে মনে যে উল্লাস তা চেপে রাখা যাচ্ছে না। এই প্রথম সে কাউকে ভালোবেসে আর কোনোরকম জটিলতা ছাড়াই নিজের স্বপ্নে দেখা প্রেমিকাকে পাওয়া একপ্রকার চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। নোমান ওয়াশরুমে। নিজের ব্র্যান্ডের পারফিউমটা নিয়ে কোটের উপর ছড়াতেই তার ফোনে টুং করে মেসেজ বেজে উঠল। প্রথমে পাত্তা না দিলেও পরবর্তীতে আবারও শব্দ হওয়ায় কপাল কুঁচকে ফোনটা হাতে নিলো সে। রাগিনীর নামটা স্ক্রিনে ভেসে ওঠায় অপেক্ষা না করে ফোনের লক খুলতেই একটা ভয়েস মেসেজের দেখা পেল। আর নিচে ছোট্ট করে লেখা, ‘কথাগুলো আপনি একা শুনবেন প্লিজ’। অভিরূপ অবাক না হয়ে পারল না। আশেপাশে কেউ নেই দেখেই ভয়েজ মেসেজ অন করতেই রাগিনীর সুমিষ্ট কণ্ঠে কেমন থমথমে ভাবটা পাওয়া গেল।
‘প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে আপনার কাছ থেকে এবং আপনার মা-বাবার কাছ থেকে। এই বিয়েটায় আমি জেদের বশে রাজি হয়েছিলাম। কখনোই মন থেকে মানি নি। আর আজ সবটা জানার পর বিয়েটা করা আমার কাছে নিজের গলায় ফাঁ’স দেওয়ার মতো। আর জেদের কারণটা ছিল আমার ব্যক্তিগত একজন মানুষ। আমার জীবনে অন্য এক পুরুষ রয়েছে। তার জায়গা অন্য কোনো পুুরুষ নিতে পারবে না। আর এক্ষেত্রে আমি স্বার্থপর। যদি মানুষটিকে নাও পাই তবুও অন্য কারোর হাত ধরা সম্ভব হবে না। আর সবচেয়ে বড়ো কথা আপনিও কখনো রাগিনী তাজরীনকে ভালোবাসতে পারেন নি। সাইকোলজি বলে, একটা মানুষ যখন চেহারা দেখে মুগ্ধ হয় তখন সে তার প্রেমে পড়ে। আর যখন কারোর ব্যক্তিত্ব দেখে মুগ্ধ হয় তবে সে তাকে ভালোবাসে। আর আপনি কারোর ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছেন। ব্যক্তিত্ব রাগিনীর ছিল না কখনো। আমার মতো দেখতে আরো একটা মেয়ে এক্সিস্ট করে। যার সঙ্গে আপনার সকল একান্ত মূহুর্ত কেটেছে। শুনতে উদ্ভট এবং বানানো কথা হলেও এটা চরম সত্য ছিল। হসপিটালের ছাঁদে আপনার সঙ্গে একান্ত মূহুর্ত কাটিয়েছে ওই মেয়ে, তার সাহসী দৃষ্টিতে মত্ত হয়েছেন আপনি, তার সঙ্গে রিকশা এবং নৌকা ভ্রমণ করেছেন আপনি। আপনার জীবনে আমার কোনো চিহ্ন মাত্র নেই। আর এটা বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনি ভুল মানুষের প্রতি নিজের ভালোবাসা উজাড় করেছেন। মেয়েটির চেহারা নকল! সে একজন টেরো’রিস্ট টিমের মেম্বার। আর বেশি কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনি একজন মুগ্ধকর মানুষ। একজন আনন্দের জাদুকর। তবে ভালোবাসা সকলের জন্য নয়, অভিরূপ। আমি এখন বাড়ি ফিরতে পারব না। বাবার সামনে দাঁড়াতে পারব না। পরিস্থিতি বুঝে আমি ঠিক বাড়ি ফিরব। আই এম সরি!”

নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অভিরূপ। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করল। রাগের সবুজ রগ ফুটে উঠল তার। চোয়াল শক্ত হলো। নোমান সবে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে ঘটল আকস্মিক ঘটনা। তার সামনে অভিরূপের দামি ফোনটা গিয়ে পড়ল ড্রেসিং টেবিলের কাঁচে। বিকট শব্দে চারিদিক কেঁপে উঠল। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রইল আয়নার কাঁচ এবং ফোনের বিভিন্ন অংশ।

ঘড়ির কাঁটা সাতটায় গিয়ে ঠেকেছে। নোমান অভিরূপের ঘরের দরজা ধা’ক্কা দিয়ে যাচ্ছে। অভিরূপের সাড়াশব্দ না পেয়ে সকলে আতঙ্কে জর্জরিত। মিসেস. সুরভী কেঁদেই দিয়েছেন। অনবরত কেঁদে চলেছেন। ছেলেটা সন্ধ্যায় হুট করেই বলল বিয়েটা সে করতে চায় না। এমনটা বলার কারণ না বলেই সে হনহনিয়ে এসে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। নোমান অবশ্য জানে কারণটা। সে অভিরূপের ফোনটা উঠিয়ে ঠিকঠাক করে তার অপ্রত্যাশিত ক্রো’ধের কারণ জানতে ফোন অন করেছিল আর রাগিনীর সমস্ত কথা শুনেছে। সে নিজেও বিষয়টাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে সে জানে অভিরূপ উল্টাপাল্টা কিছু করার ছেলে মোটেও নেই। শেষমেশ নোমান বিক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
“অভি! দরজা খোল। আন্টি ভেঙ্গে পড়েছেন। অসুস্থ হয়ে পড়বেন এবার।”

তবুও দরজা খোলে না। নোমান দরজায় লা’থি দেয়। আর চিল্লিয়ে বলে,
“দরজা খুলবি না ভাঙব?”

রাশেদ সাহেব দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। কোনদিকে যাবেন কী করবেন বুঝতে পারছেন না। এরই মাঝে দরজা খুলল অভিরূপ। তার বিষণ্ণ চেহারা এবং ফ্যাকাশে মুখের বর্ণ সকলের প্রতিক্রিয়া পাল্টালো। নিজের ফোলা চোখের চাহনি নোমানের দিকে নিক্ষেপ করে সে বলল,
“আমি শুধু নোমানের সঙ্গে কথা বলতে চাই। অন্যকেউ আমার ঘরে আসবে না। বাবা কিংবা মাও না।”

নোমান সবার দিকে তাকিয়ে আশ্বাস দিলো। তারপর ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করল। পুনরায় শব্দ করে দরজা আঁটকে দিল অভিরূপ। মিসেস. সুরভীর অশান্ত মন মানছে না। তবুও কিছু করার নেই।

ঘরটা অন্ধকার করে রেখেছে অভিরূপ। তার গায়ে আর কোট নেই। সেটা টেনে ফেলে দিয়েছে বেশ অযত্নের সঙ্গে ফ্লোরে। আয়নার কাঁচগুলো একভাবে পড়ে আছে। অভিরূপের পরনে সাদা শার্টের অবস্থাও নাজেহাল। ঘেমে একাকার অভিরূপ। এসি থাকা সত্ত্বেও এসি অন করেনি অভিরূপ। শার্টের উপরের তিনটা বোতাম খুলে বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়ল সে। নোমান তার পাশে বসে এসির রিমোট হাতিয়ে বলল,
“গরম লাগছে না তোর?”

“না।”

অভিরূপের ভার কণ্ঠ। নোমান ধম’কের সুরে বলল,
“ঘেমে তোর শার্ট ভিজে গিয়েছে আর বলছিস গরম নেই?”

বলেই এসির পাওয়ার অন করতে গেল নোমান। সঙ্গে সঙ্গে তার হাত চেপে উঠে বসল অভি। নোমান হকচকিয়ে গেল। তাকে আরেক দফা চমকে দিয়ে অভিরূপ তাকে জড়িয়ে ধরল। নোমান হতভম্ব। কর্ণকুহরে এলো অভিরূপের বলা কণ্ঠস্বর।
“আমি কি ভুল মানুষকে ভালোবাসলাম? কেন ভালোবাসলাম? যদি সে সত্যি টেরো’রিস্ট হয় তাহলে সেও সকলের সঙ্গে আমায় শে’ষ করতে চেয়েছিল?”

নোমান নীরব। মুখে কোনো কথা আসছে না। অভিরূপ ফের বলল,
“যে আমার মৃ’ত্যু কামনা করে তার সঙ্গে সারাজীবন চলার স্বপ্নে আমি দিনরাত মত্ত থাকি! ভালোবাসা কি এমনই হয়?”

ভালোবাসা নামক চার শব্দটির ব্যাখ্যা একেক জনের কাছে একেকরকম। প্রতিটি মানুষ ভালোবাসার কাঙাল হয়ে থাকে। এর জন্য কেউ ধুঁকে ধুঁকে ম’রে এক মুঠো ছাইয়ে পরিণত হচ্ছে আবার কেউ নতুন করে সজীব পাতার ন্যায় জীবিত হচ্ছে। কে হবে ভবিষ্যতে এই সুন্দর সজীব পাতা? আর কে হবে এক মুঠো ছাই?

[১ম খণ্ডের সমাপ্তি]

[)🤍

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here