গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে পর্ব -৩৮+৩৯+৪০+৪১+৪২

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৮

ভয়ে শিথিল হয়ে রয়েছে রাগিনী। ফ্লোরে গুটিশুটি হয়ে নিজের ওড়না চেপে ধরে ভীতু নজরে বার বার তাকাচ্ছে সেই প্রা’ণঘাতী অ’স্ত্রের দিকে। সারা অঙ্গ জুড়ে ছেয়ে গিয়েছে এক উত্তেজনা। ক্ষণে ক্ষণে সৃষ্টি হচ্ছে কম্পন। মনে হচ্ছে যেন তার সামনে একটা বাঘ নয়ত সিংহ দাঁড়িয়ে যেটা যেকোনো মূহুর্তে আ’ক্রমণ করে বসতে পারে। না চাইতেও অবাধ্য মস্তিষ্ক জানান দিল উর্মিলার কথা সেদিনের কথাগুলো। সেই কথাগুলোর রেশ বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ল রাগিনীর মনের অভ্যন্তরে। বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভূত করল সে। সারা শরীর যেন অসাড় হয়ে এসেছে। না চাইতেও নিজের হাতের কম্পন থামানোর চেষ্টা করে দূর থেকে হাত বাড়াল সেই রি’ভলবারের দিকে। যদি জিনিসটা মিথ্যা হয়? শুকনো গলায় ঢক গিলে জিনিসটাকে ছোঁ মে’রে দ্রুত নিজের কাছে নিয়ে এসে নেড়েচেড়ে দেখল। কেমন একটা অদ্ভুত গন্ধ আসছে সেটা থেকে। তাহলে সেটা কি গান পাউডার? তাহলে এটা সত্যিই রি’ভলবার? সর্বাঙ্গ জুড়ে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল রাগিনীর তৎক্ষনাৎ সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বেডের নিচে ঢুকিয়ে দিয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়াল।

দরজার কাছে ছুটে গিয়ে দরজা ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আবারও বেডের নিচটায় চোখ গেল তার। কানে যেন হাওয়ার তালে ভেসে আসছে, ‘আচ্ছা! সে যদি সুস্থ হয় আর এমন ভান করে থাকে তাহলে নিশ্চয় তার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য আছে? এখন তো কয়েকদিন ধরে টে’রোরিস্ট হাম’লার বিষয়টা চলছেই। এমন নয় তো? যে ওই কোহিনূর কোনোভাবে টে’রোরিস্ট টিমের সাথে যুক্ত?’

এই কথা স্মরণে আসার পর দাঁড়ানোরও শক্তি পাচ্ছে না রাগিনী। দরজা ধরে রেখেছে। ভেতরে ভেতরে যেন ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে নিজের তৈরি কিছু আপন অনুভূতি। আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে সে আবার ভুল ভাবছে না তো? কিন্তু ধারণা তখনই পাল্টে যাচ্ছে। এখানে সবটা পরিষ্কার। আরো পরিষ্কার করতে কোহিনূরের সাথে দেখা হবার পর একটার পর একটা ঘটা অদ্ভুত ঘটনার হিসাব মিলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রাগিনী। প্রথমে কোহিনূরের হুট করেই আগমন। তার পাগলামির মাধ্যমে রাগিনীকে ধরে রাখা, আস্তে আস্তে তার আসল সত্ত্বা প্রকাশ পাওয়া, হসপিটালে বাচ্চা ছেলেটাকে দেখতে যাওয়ার সময় অন্য একটা মেয়ে তাকে আরেক নামে সম্মোধন করা, একদিন ঘুরতে বের হওয়ায় রাগিনীর উপর একদল লোক গু’লি চালানো, কোহিনূরের এক্সি’ডেন্টে ক্ষতি হয়েছে বলা সত্ত্বেও তার যানবাহনে ভয় না পাওয়া, দক্ষতার সাথে গাড়ি ড্রাইভ করতে জানা! এবার সবটাই যেন আপনা-আপনি বোধগম্য হয় রাগিনীর। ভাবনায় নিমগ্ন রাগিনীর দুচোখ ভর্তি পানির উদ্ভব যে কখন ঘটেছে সেটা টের পায়নি রাগিনী নিজেই। অস্ফুটস্বরে কোনোমতে ভাঙ্গা গলায় বলল,
“এটাই তাহলে উদ্দেশ্য। আপনাকে যা ভেবেছিলাম আপনি তাহলে সেটা নয়। আপনাকে যা কখনোই ভাবিনি আপনি সেটাই।”

রাগিনী বুঝে উঠতে পারল না কোহিনূরের জন্য সে অপেক্ষা করবে কিনা! তাকে কিছু বলা উচিত কিনা! বললে যদি আবার তাকেই কিছু করে বসে? মানুষটা তো নিষ্ঠুর। তার প্রতি কি দয়া দেখাবে? না হয়ত। তারা তো স্বার্থপর হয়। যার প্রতি কোমল অনুভূতি ছিল একরাশ। সেই কোমল অনুভূতিগুলো ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়ে পাল্টে গেল এক ঘৃণ্য অনুভূতিতে। এখানে আর এক মূহুর্তও দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না রাগিনীর। ঠোঁট কামড়ে চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসা পানিকে বাঁধা দিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
“ওরাই কি তাহলে ফিরে এসেছে?”

রাগিনীর ভেতরটা জ্বলছে। মনে হচ্ছে আগুনের তাপে জ্বলে ছারখার হয়ে যাবে সব। ঝলসে যাবে মনের দুয়ার। এই ঘরটায় আর থাকা সম্ভব নয়। দরজা ঠেলে বাহিরে চলে আসে সে এলোমেলো পায়ে।

ফোনে কথা বলে কোহিনূর ঘরে প্রবেশ করল কিছুটা বিক্ষিপ্ত হয়েই। এর থেকে যেন ফোনটা না ধরাই ভালো ছিল। শুধু শুধু আবারও তাদের ব্যর্থতার গল্প শুনতে হলো। নকল রাগিনীর ট্রেস আর পাওয়া যায়নি। জানা নেই কোন প্রান্তে গিয়ে লুকিয়েছে। এসব কথা শুনে মেহরাজকে ধম’ক দিয়ে ফোন কেটে দিয়েছে কোহিনূর। তারপর জোর পায়ে হাঁটা ধরেছিল নিজের অশান্ত, বিক্ষিপ্ত বিক্ষুব্ধ মনটাকে শান্ত করার প্রতিষেধক নেওয়ার জন্য। সেই প্রতিষেধক একটাই রাগিনী! যাকে দেখলে এই আগুন ধরানো মনটা নিমিষে বরফগলা এক রাজ্যে পাল্টে যেতে বাধ্য। তবে মনের বাসনা আর পূর্ণতা পেল না। রাগিনীর দেখা পেল না দুটো নেত্রপল্লব। ঘরটা খালি। আশেপাশে তাকাল কোহিনূর। আসলেই সে নেই। বিছানায় পড়ে রয়েছে একভাবেই খাবারগুলো। সেসব রেখে রাগিনী কোথায় চলে গেল? ঘরে এসে জানালার কাছে গেল কোহিনূর। উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল রাগিনীকে গার্ডেনে দেখা যাচ্ছে কিনা। সেটাতেও ব্যর্থ হলো সে। আগে তো মেয়েটা খাবার রেখে এভাবে কোথাও চলে যায় না। তার কাশি আসতেই স্মরণ হলো রাগিনী তো অসুস্থ ছিল। অসুস্থতা কি বাড়লো তবে? কী করে খোঁজ নেবে?
“আমার মনটাকে অতৃপ্ত করেই বিদায় নিলে রাগের রানী? অতৃপ্ত মনটাকে বোঝাই কী করে বলো?”

ঘরে আসার পর দরজা বন্ধ করে রেখেছে রাগিনী। খোলেনি এখনো অবধি। দুপুরের খাবার খায়নি। সৈয়দ তাকে ডাকতে এসেছিল একবার। রাগিনী বলেছে খিদে নেই। আসলেও নেই খিদে। গলা দিয়ে খাবার নামবে না। নিজের বেডে গুটিশুটি হয়ে বালিশ চেপে ধরে বসে আছে। জানালার পাশে থাকা পর্দা হঠাৎ উড়ে উঠতেই ধড়ফড়িয়ে উঠল সে। মনে হলো যেন কেউ তাকে ধরতে আসছে। চিল্লিয়ে বলল,
“আমি কিছু করিনি।”

পর্দা চোখে পড়তেই শান্ত হলো দেহ। স্থির হলো দৃষ্টি। কোহিনূরের কথা স্মরণে আসতেই গুটিয়ে নিল নিজেকে। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“যার কাছে নিজেকে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ ভেবেছিলাম সে-ই হয়ে উঠল আমার নীরব ঘাতক!”

কথার মাঝে থামল রাগিনী। চোখের সামনে যেন স্বপ্নের ন্যায় ভেসে উঠল অতীতের সবথেকে অবহেলিত, অযত্নে রাখা এক পাতা। যেই পাতার ঘটনা ভুলেও যে স্মরণ করতে চায় না। তবে আজকের ঘটনা যেন সেই ঘটনার সাথেই সংযুক্ত।
“ও…ওরা চলে এসেছে এখান অবধি। আমার পি…পিছু কেন ছাড়েনি এ…এখনো। আমি তাদের থেকে মুক্তি চাই।”

বালিশে মুখ চেপে ধরে ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে রাগিনী। ভয় শুধু হাতছানি দিচ্ছে তাকে। তীব্র কোনো কিছুর আশঙ্কায় সারা গায়ের লোম শিউরে উঠেছে। কানে বাজছে সেদিনের বলা সেসব কথা। কত সুন্দর মূহুর্ত ছিল সেদিন। কতটা আপন ভেবে বলেছিল কোহিনূরের উদ্দেশ্যে সেসব কথা। কতটা স্বাচ্ছন্দ্যে ছিল লোকটার সাথে। নিজের বলা কথাগুলোই তার কানে বারংবার ধা’ক্কা খায় এবার।
‘পৃথিবীতে দুটো পুরুষের কাছে নিজেকে সবথেকে নিরাপদ মনে করি আমি। প্রথমজন আমার বাবা। দ্বিতীয়জন কোহিনূর সাহেব।’

কর্ণকুহরে ভেসে আসা সেই কথা আর শুনতে চায় না রাগিনী। কানটা চেপে ধরে দুহাতে। দাঁত চেপে বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। চোখ খুলে পিছু ফিরতেই দেয়ালের সঙ্গে টানানো কোহিনূরের স্কেচটা যেন জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে। কোহিনূরের হাসোজ্জ্বল সেই মুখশ্রী ছিল রাগিনীর অদ্ভূত শান্তির কারণ সেই হাসিটা দেখে ভয় করতে শুরু করল তার। সেভাবেই শক্ত গলায় বলে ওঠে,
“আপনাকে বলেছিলাম, আমার বিশ্বাস ভাঙ্গবেন না প্লিজ। আপনি সেটাই করে খুব আনন্দ পেলেন।”

রাগিনীর এরূপ কথায় যেন হাসিটা আরো গাঢ় হলো স্কেচে থাকা কোহিনূরের। অথচ স্কেচে থাকা কোহিনূরের প্রাণ নেই। হাসিটাও আগের মতোই স্থির। তবুও রাগিনীর এমনটা মনে হচ্ছে। পুরো শরীর রি রি করছে। বালিশটা ফেলে দিয়ে রাগিনী দ্রুত ধাবিত হলো কোহিনূরের ঝুলিয়ে রাখা সেই স্কেচের দিকে। হাতের নখ দিয়ে আঁচড় দিতে ইচ্ছে করল তার। তবে পারল না। মানুষটির চোখের দিকে তাকিয়েই পড়ল গভীর ভাবনায়। না চাইতেও ছুঁয়ে দিতে বাধ্য হলো আদুরে স্পর্শে সেই আঁকা চোখ। এই চোখটা সে কত অনুভূতি মিশিয়ে এঁকেছিল। তবে তার জানা নেই কতটা গভীরতা দিতে সক্ষম হয়েছিল। আসল নেত্র তো আরো গভীরতম ছিল। তবে সেটাও কি মিথ্যে ছিল? ছলনা ছিল? দুর্বল কন্ঠে রাগিনী বলল,
“আপনাকে অবিশ্বাস করতে আমার ইচ্ছে করছে না। মনের মাঝে ঘৃণ্য বর্বরোচিত মানুষদের তালিকার মাঝে আপনি নামক মানুষটাকে ফেলতে ইচ্ছে করছে না। আপনি আমার কাছে সবসময়ের জন্য এক মোহনীয় মানুষ। তবে আমায় ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন আজ। আমার সন্দেহকে জিতিয়ে দিয়েছেন। আপনি বড়ই নিষ্ঠুর!”

রাগিনীর বলা কথাগুলো যেন নিজেরই সহ্য হচ্ছিল না তার। কথা শেষ করার সাথে সাথে সরে এলো। তার উচিত মানুষটাকে ঘৃণা করা। সে ঘৃণা করে কথাও তো বলতে পারছে না। দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ফিরে গিয়ে ধপ করে সে বসে পড়ল নিজের বিছানায়। নিজের চোখের কোণে লেগে থাকা একটুখানি অশ্রু মুছে নিল হাতের পিঠ দিয়ে। কী করা উচিত কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার। কাকে জানাবে সে কথাটা? কেউ কি তাকে বিশ্বাস করবে? এসব আগপাছ ভাবতে ভাবতে আবারও চোখ ভর্তি পানি জমা হলো। তার পায়ে লাগল কারো আলতো ছোঁয়া। মাথা নিচু করে সেই স্পর্শ করার মালিককে দেখে মন শান্ত হলো কিছুটা। রিও মিউ শব্দ করে নিজে থেকে রাগিনীর কোলের উপরে উঠে বসে মাথা উঁচিয়ে রাগিনীর মুখশ্রীর দিকে অসহায় পানে তাকায়। যেন সেও বুঝেছে কিছু একটা। বুঝে নিয়েছে তাকে অতি যত্নে রেখেছে যেই নারী তার আজকে মন খারাপের দিন। রাগিনী পরম যত্নে তাকে দুহাত দিয়ে উঁচিয়ে ধরল। রিও সঙ্গে সঙ্গেই তার সামনের দুটো পা দিয়ে রাগিনীর গলা জড়িয়ে ধরে মিউ মিউ শব্দ করে উঠল। রাগিনীর বুঝতে সময় লাগল না রিও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মন খারাপ করেছে। ভেজা কন্ঠে বলল,
“আজকে খুব অসহায় লাগছে নিজেকে। এতো এতো মিথ্যে অনুভূতির মাঝে একমাত্র তোমার অনুভূতিই সত্যি মনে হচ্ছে। মানুষ হিংস্র, মিথ্যের পাহাড় গড়তে পারে। তোমাদের সরল অনুভূতির সামনে তারা বোধহয় তুচ্ছ।”

অনেক ভেবে উর্মিলার কথা মাথায় এলো রাগিনীর। যাকে এই মূহুর্তে সব ভরসা করে বলা সম্ভব। এই কথাগুলো কাউকে না কাউকে তো বলাই যায়। অন্তত এখন কী করা উচিত সেটা সম্পর্কে যদি সাজেশন পাওয়া যায় ক্ষতির কিছু নেই। আর যাই হক সে চায় না তার বাবার হসপিটালের এতো বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যাক। ভাবতে ভাবতে নিজের ফোনটা হাতে নিল রাগিনী। মলিন মুখে ফোন স্ক্রল করে নম্বর খুঁজে বের করে উর্মিলাকে কল লাগালো। কিছুক্ষণ রিং হতেই ওপরপানে থেকে উর্মিলার চিকন গলার সুর শোনা গেল।
“হ্যালো মামা।”

“আমি তোর মামা নই। আমি রাগিনী।”

উর্মিলা তড়িঘড়ি উত্তরে বলে,
“সরি সরি। জানিস তো আমি এখনো চশমা কিনি নি। তাই ঠিকঠাক দেখতে পাইনি তোর নাম। মার্কেটে গিয়েছিলাম আমার ওই কিউট ব্লু কালার ফ্রেমের চশমা খুঁজেই পাইনি। একজনের কাছে নাকি ছিল সেটাও নাকি কোন যেন ছেলে নিয়ে চলে গিয়েছে। ছেলেগুলো আস্ত একেকটা আপদ। একটা ছেলে আমার চশমা ভাঙ্গল আরেকটা ছেলে আমি কেনার আগে চশমাটা কিনে নিয়ে চলে গেল। শোন রাগিনী, একটা এডভাইজ দিচ্ছি, জীবনে আর যাই হক কোনো ছেলের পাল্লায় পড়বি না। তারা দেখবি তোর জীবনে বিপদ আর বিপদই ডেকে আনবে।”

না চাইতেও যেন রাগিনীর মুখ থেকে ফস্কে বেরিয়ে গেল,
“ঠিকই বলেছিস। অলরেডি হয়ত ডেকে এনেছে।”

“কী ডেকে এনেছে? আর তোর গলা এমন লাগছে কেন? কেমন যেন থমথমে। মন খারাপ নাকি তোর?”

“তুই যা বলেছিস সব মিলে গেছে রে উর্মিলা!”

উর্মিলা একটু নীরব রইল। ভাবার চেষ্টা করল তার কোন কথাটা মিলেছে। বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,
“আই নো উর্মিলার কথা দেরিতে হলেও সঠিক হয়। বাট কোন কথাটার কথা বলছিস বল তো?”

রাগিনী জোর গলায় কোহিনূরের নামটা। কিন্তু গলায় সমস্ত কথা দলা পাকিয়ে আসছে। ঢক গিলে অস্পষ্ট সুরে বলে ওঠে,
“কো…কোহিনূর! তুই ঠিকই বলেছিলি। উনার উদ্দেশ্য ভালো নয়।”

“কেন, কেন? কী করেছে তোর সাথে? তুই ঠিক আছিস তো?”

“আমার সাথে কিছুই করেন নি। কিন্তু আজকে উনার বেডের নিচে আমি রি’ভলবার পেয়েছি।”

বলেই ঠোঁট কামড়ে ধরল রাগিনী। দম বন্ধ লাগছে এবার। ওপরপাশ থেকে উর্মিলা আঁতকে উঠে বলল,
“কী বলছিস? ঘটনা সত্য? আমি তোকে বলেছিলাম ওর উপর নজর রাখতে। ওর উদ্দেশ্য ভালো নয়। এখন বোঝ। জাতে মাতাল, তালে একেবারে শয়’তান। ও যদি ভালো হয় ওর কাছে এতো বড় মা’রাত্মক অ’স্ত্র কী করে আসবে? নিজের আর ওই হসপিটালের ভালো চাইলে এখনি পুলিশের কাছে যা। সব জানিয়ে দে।”

রাগিনীর মাথায় পুলিশের কথা মাথায় আসেনি সেটা নয়। এসেছে কয়েকবার। তবে সাহস হয়নি। আবার সেই মানুষটার বিরুদ্ধে যেতে মস্তিষ্ক থেকে পা অবধি বারণ করছে। শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারছে না যে। উর্মিলা রাগিনীর প্রতিত্তোর না পেয়ে আবারও শক্ত কন্ঠে বলল,
“শুনতে পাচ্ছিস কী বলছি? রক্ষা পেতে হলে দেরি করিস না। যত দেরি করবি তত রিস্ক বাড়বে। আর…”

রাগিনীর যেন আর শুনতে ইচ্ছে করল না উর্মিলার বলা কথাগুলো। আস্তে আস্তে ফোনটা কানের পাশ থেকে নামিয়ে নিয়ে কেটে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। কিছুক্ষণ আগেও সে কোহিনূর নামক ঘোরে মত্ত ছিল। সেই ঘোর কাটিয়ে ওঠা কি এতোই সোজা?

দরজায় কেউ নক করল আবার। পলক ফেলে দরজার দিকে চাইলো রাগিনী। আবার নিশ্চয় সৈয়দ কাকা এসেছে। মানুষটা ভীষণ চিন্তা করে তাকে নিয়ে। সে ঠিকমতো খেলো কিনা, কী খেলো সব দেখাশোনা করে। রাগিনী রিওকে নামিয়ে দিয়ে ধীর পায়ে দরজার দিকে পা বাড়াল। দরজার লক খুলতে খুলতে গলা খাদে নামিয়ে বলল,
“বললাম তো চাচা। আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। আমার দরকার পড়লে খেয়ে নেব।”

“আমার চাচা হওয়ার বয়স এখনো হয়নি। অথচ তুমি আমাকে বার বার চাচা বানিয়ে দাও। দ্যাটস নট ফেয়ার।”

চকিতে তাকায় রাগিনী অভিরূপকে দেখে। ছেলেটা ঠোঁট উল্টিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাগিনী নিচু সুরে বলল,
“আপনি? কোনো দরকার?”

“দরকারটা আমার না। তোমার দরকার।”

কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে কপাল কুচকালো রাগিনী। অভিরূপের দিকে চেয়ে রইল শূন্য দৃষ্টিতে। অভিরূপ একগাল হেঁসে বলল,
“বলছিলাম খাবার না খেয়ে কি অনশন শুরু করেছো?”

এবার রাগিনী বুঝল আসল বিষয়টা। মিইয়ে যাওয়া গলায় উত্তরে বলল,
“অনশন শুরু করব কেন? সবার রুচি তো সবসময় এক থাকে না। আপনারা লাঞ্চ করে নিন। আমার খিদে পেলে আমিও করে নেব।”

“তুমি হয়ত অনশন শুরু করো নি। তোমার পেট নিশ্চয় অনশন শুরু করে দিয়েছে খোঁজ নিয়ে দেখো। নিশ্চয় এতক্ষণে বলতে শুরু করে দিয়েছে, ‘chahiye naan ya roti, chahiye raan ya boti, mangalo ram kasam, kasht ho jayee…’

শত বিরহের মাঝেও অভিরূপের সুর করে বলা গানটি কানে পৌঁছাতেই মলিন হাসলো রাগিনী। রাগিনীর হাসি দেখে অভিরূপও বিজয়ের হাসি দিল। যেন তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। অতঃপর আবারও হাসি বজায় রেখেই অভিরূপ বলল,
“তাহলে এভাবে পেট যেন আর অনশন না করে তার সমাধান করতে খাওয়া দরকার কী বলো?”

“আপনি কী করে বুঝলেন যে আমার পেট অনশন করছে?”

“গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। ডিল করবে? যদি পেট অনশন করে তাহলে তুমি আমায় ঘুরতে নিয়ে যাবে। আর যদি অনশন না করে তাহলে আমি তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাব! ডিল?”

রাগিনী আবারও নীরবতা অবলম্বন করল। গোল গোল চোখে চেয়ে রইল। তার ভাবমূর্তি কিছুই বুঝে উঠতে পারল না অভিরূপ। আবারও যদি মেয়েটার অগ্নিমূর্তি বেরিয়ে আসে আর এমন ইচ্ছের বিরুদ্ধে খেতে বলায় যদি ঠাস ঠাস করে কয়েকটা লাগিয়ে দেয় তবে? ভেবেই গা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল তার। পলাতক হওয়া বেটার মনে হচ্ছে। তাই সে পেছন ফিরে দীর্ঘশ্বাস দিয়ে হাঁটা ধরে বলে,
“ভাবলাম তোমায় নিয়ে গেলে আঙ্কেল খুশি হবেন। আঙ্কেল খুব আশায় আছেন তুমি গিয়ে উনার সঙ্গে বসে খাবে। আশাটা বোধহয় পূর্ণ হলো না।”

রাগিনীর টনক নড়ে এবার। ফট করে জিজ্ঞেস করে,
“বাবা এসেছে?”

“হ্যাঁ শুনলাম ছুটি নিয়ে এসেছে। স্পেশালি আমাদের সাথে লাঞ্চ করার জন্য।”

রাগিনী এবার কিছু না বলেই তড়িঘড়ি পায়ে অভিরূপের পাশ কাটিয়ে ঝড়ের বেগে চলে গেল। অভিরূপ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঠাঁই। তারপর নিজে নিজে বলল,
“যাহ্ বাবা। আঙ্কেলের কথা শুনে মেয়েটা সাইক্লোনের গতিতে নামবে জানলে এতো বকবক না করে আঙ্কেলের কথায় আগে বলতাম।”

খাবার টেবিলে খেতে বসেছে সকলে। সৈয়দ আর সাহানা দুজন খাবার পরিবেশন করছেন খুশিমনে। রাগিনী মুখ নিচু করে খেয়ে যাচ্ছে। মুখে বিষণ্নতা। সারা মুখমন্ডল জুড়ে এক ফ্যাকাশে ধূসর বর্ণের আনাগোনা। সেটা চোখ এড়ালো না রাশেদ সাহেবের। তবে উনি প্রথমেই কিছু বললেন না। আগে অভিরূপ আর নোমানকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তা বাবা! তোমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? আনকমফোর্টেবল ফিল করছো না তো?”

“না আঙ্কেল একদমই না। নিজের বাড়ির চেয়ে কম কিছু মনে হচ্ছে না। আগে জানলে তো প্রথমেই এখানে এসে উঠতাম। আপনি না চাইলেও জোর করে এখানে থাকতাম।”

অভিরূপের কথায় খেতে খেতে নিঃশব্দে হাসেন রাশেদ সাহেব। অভিরূপ আঁড়চোখে রাগিনীর দিকে তাকায়। তৎক্ষনাৎ নোমান নিজের হাতের কনুই দিয়ে গুঁতো দেয় অভিরূপকে। অভিরূপ ক্ষিপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নোমানের পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে বলে,
“শরীরে ধার বেশি হয়েছে নাকি তোর? ষাঁড়ের মতো গুঁতোচ্ছিস কেন?”

“চোখটা খুলে পড়ে যাওয়ার আগে বাঁচিয়ে নিলাম। থ্যাংকস দে। পায়ের উপর থেকে পা সরা। নয়ত আমারও পা আছে।”

অভিরূপ ঢক গিলে পা সরিয়ে খেতে ব্যস্ত হলো। রাশেদ সাহেব এবার রাগিনীকে বললেন,
“রাগিনী, তোমার শরীর কি খারাপ এখনো?”

উটকো ভাবনায় বিভোর রাগিনী চমকে নড়েচড়ে তাকাল। মেয়েটাকে আনমনা দেখে কিছুটা চিন্তিত হলেন রাশেদ সাহেব। রাগিনী কোনোরকমে উত্তর দিল,
“না বাবা। আমি ঠিক আছি।”

রাগিনী তার বাবাকে জানাতে চাইছে কথাগুলো। পারছে না। সম্ভব নয়। মানুষটার বুকে ব্যথা উঠেছিল গতকাল রাতে। ডক্টর বলেছে বেশি টেনশন উনাকে না দিতে। তাই এই কথা বলে টেনশন বাড়ানোর কথা ভাবতে পারে না রাগিনী। রাশেদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
“তাহলে খেতে আসছিলে না যে? সৈয়দ বলল আমাকে। কী হয়েছে?”

“বাবা একটু দুর্বল লাগছে। বেশি কিছু না।”

রাশেদ সাহেব এবার বড় শ্বাস ফেলে গাম্ভীর্যের সাথে বললেন,
“একটা কথা বলার ছিল তোমায়। তোমাকে বাড়ি থেকে বেশি বের হতে হবে না। চেষ্টা করো বাড়িতে থাকার। বাহিরে এখন অনেক কান্ড ঘটছে।”

রাগিনী মাথা উঁচিয়ে তাকাল বাবার দিকে। রাশেদ সাহেবও রাগিনীর মনের কথা বোঝার চেষ্টা করছেন। উনি মেয়ের নিরাপত্তা নিয়েই আগে ভাবছেন। যেহেতু এতো বড় ক্রা’ইমের একটা তীর রাগিনী নিজে তাই নিজের মেয়েকে নিয়ে বিপদ বাড়াতে চান না উনি। এরপর আবারও তিনি বলেন,
“আর কোহিনূরকে নিয়ে চিন্তা করলে বলে দিই, প্রতিদিন তার কাছে খাবার পৌঁছে যাবে। চিন্তা করো না। ব্যাস… আমি এটাই চাই তুমি একা একা বাড়ি থেকে বের হবে না।”

রাগিনী মাথা নাড়াতেই অভিরূপ হতাশ হয়ে বলল,
“তাহলে অনশনের হারজিতের পর ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যানিং ক্যান্সেল!”

“কীসের প্ল্যানিং?”

উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন রাশেদ সাহেব। অভিরূপ বলল,
“রাগিনী আর আমার মধ্যে একটা ডিল হয়েছিল। যে হারবে সে ঘুরতে নিয়ে যাবে। সেটার কথাই বলছিলাম।”

রাশেদ সাহেব চুপ করে রইলেন এবার। খেতে খেতে মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়েটার মনমরা চাহনি ভালো লাগছে না। ঘুরতে গেলে ঠিক হতে পারে। আর অভিরূপ তো আছে। তাই সাহস নিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টে বললেন,
“সবাই মিলে গেলে কোনো সমস্যা নেই। তুমি, নোমান আর রাগিনী যেতেই পারো। আর রাগিনীর ইচ্ছে হলে কোনো ফ্রেন্ড ডেকে নিতে পারো।”

অভিরূপের হাসি গাঢ় হলো। রাগিনীর দিকে চেয়ে উৎসাহ নিয়ে বলল,
“তাহলে হারল কে রাগিনী?”

রাগিনীর যেতে ইচ্ছে করল না বাহিরে। তবুও কথাগুলো ফেলতে পারল না। জোরপূর্বক হেঁসে বলল,
“আমি হার স্বীকার করছি। আমি আপনাদের ঘুরতে নিয়ে যাব। আপনারা তো শহর চিনেন না। তাই দায়িত্বটা আমি নিলাম।”

ফোনের রিংটোনটা এবার পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তকর শব্দে পরিণত হলো ঘুমন্ত রূপাঞ্জনার কাছে। চেহারা জড়িয়ে গেল বিরক্তিতে। জোর করে আঁখি দুটো খোলার চেষ্টা করল। একহাত বাড়িয়ে চারিপাশে ফোনটা খুঁজতে চাইল। কোহিনূরের কবল থেকে পালিয়ে কোনোরকমে ক্লান্ত ভঙ্গিতে গা ঢাকা দিয়েছিল সে। ফোনটা হাতে পেয়ে চোখ বুঁজেই রিসিভ করে কানে ধরে বলল,
“হ্যালো।”

“অনেক তো ঘুমিয়ে নিলি। এবার জাগার সময় হয়েছে। আসল কাজের সময় হয়েছে।”

শান্ত সুরের মাঝে হিংস্রতা অনুভব করে চোখটা থেকে ঘুম উড়ে গেল এবার রূপার। ভালোমতো জাগতেই মনে হলো আজকের মিশনে আনসাকসেসফুল হয়েছে সে। কোহিনূরকে মা’রতে পারেনি। তার এই অসফলতার কারণে নিশ্চয় রেগে আছে ডার্ক ম্যাক্স। অস্ফুটস্বরে সে বলল,
“আই এম সরি ডার্ক ম্যাক্স!”

“তোর সরি শুনতে শুনতে কান পঁচানোর ইচ্ছে আমার নেই। আমার ক্রোধের স্বীকার হতে না চাইলে দ্রুত তৈরি কর নিজেকে। পরের মিশন আজকেই শুরু হবে। আর ভুলিস না! প্রথম মিশন কমপ্লিট করতে পারিসনি। তাই এই মিশনটাও কমপ্লিট না হলে ফল খুব একটা ভালো হবে না।”

রূপাঞ্জনা উঠে বসে এবার। শুঁকনো গলায় জানতে চায়,
“পরের মিশন অবশ্যই কমপ্লিট হবে ডার্ক ম্যাক্স। কী পরের মিশন?”

“অভিরূপকে শে’ষ করে পুরো দেশে আ’তংক সৃষ্টি করা। আজ বিকেলে রাগিনীর সঙ্গে বের হবে অভিরূপ। কিন্তু আসল রাগিনী নয় রাগিনী রূপি রূপাঞ্জনার সাথে যেন ফেমাস সিঙ্গার অভিরূপের শেষ যাত্রা হয়।”

ভেতরটা নড়ে ওঠে রূপার। সময়টা বুঝি এসেই গেল এবার। এখন তার রক্ষককেই উপড়ে ফেলতে হবে বুঝি। রূপা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“আপনি কী করে জানলেন ডার্ক ম্যাক্স? যে আজ ওরা বের হবে?”

ডার্ক হেঁসে জবাব দেয়,
“ডার্ককে বোকা মনে করিস তুই? ডার্ক সব জানে। নিজেকে তৈরি কর রাগিনী রূপে। ‘দ্যা ফেমাস সিঙ্গার অভিরূপ চৌধুরী বাংলাদেশে ঘুরতে এসে অকালেই টেরো’রিস্টের হা’মলার শিকার হয়ে মৃ’ত্যু হয়ে গেল’। হেডলাইনটা অনেক সুন্দর হবে তাই না?”

রূপাঞ্জনা কিছু বলে না। সে দরদর করে ঘামছে। ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে যায়। রূপার নিশ্বাস ওঠানামা করে। নিজের অস্থিরতা যেন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সর্বাঙ্গ। আগে তো এতোটা উতলা হয়নি মন। তবে কি প্রথমবার তার হাত কাঁপবে কাউকে মা’রতে?
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৯

দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। রোদের তেজ কিছুটা কমে এসেছে। তবে রাগিনীর ভারাক্রান্ত হৃদয় সেই ঘটনার রেশ কাটিয়ে উঠতে পারছে না। ক্ষণে ক্ষণে মনে জেগে উঠছে সংশয়। মস্তিষ্কে ছেয়ে গিয়েছে চিন্তায়। ভালো লাগার এক সুন্দর নিজ হাতে সাজানো পৃথিবী এলোমেলো হয়ে পড়েছে। কারণটা বোধহয় কোহিনূর। কারণ সেই পৃথিবীর রাজা তো তাকেই বানানো হয়েছিল। ভালোবাসা মাখানো এক মুকুট তাকেই পড়ানো হয়েছিল। মর্যাদা যে রাখতে পারল না। তবে তাকে দোষ দেওয়া ঠিক কিনা বুঝতে পারছে না রাগিনী। সে নিজের কাজ করেছে। দোষ কি তবে রাগিনীর? যে একপাক্ষিকভাবে নিজের পৃথিবী সাজিয়েছিল? অপরদিকের মানুষটা হয়ত নিজের অন্ধকার রাজ্য সাজাতে নিমগ্ন ছিল? এতোকিছুর মাঝেও নিজ মনে জড়তা চাপিয়ে রেখে অন্যমনস্ক হয়ে রেডি হচ্ছিল রাগিনী। বেগুনি রঙের একটা জামায় নিজেকে ফুটিয়ে তুলেছে সে। তবে বিবর্ণ সেই চেহারা প্রাণবন্ত লাগছে না আজ। চুলে কোনোরকম বেণি করে সামনের বাম দিকটা ছেড়ে দিল রাগিনী। দৃঢ় শ্বাস ফেলে নিজেকে শক্ত এবং স্বাভাবিক করার ব্যর্থ চেষ্টা করল। আয়নায় দেখল নিজেকে। টেবিলে থাকা সাদা রঙের ঘড়ি হাতে জড়িয়ে নিল। কেমন জানি ঘুম ঘুম পাচ্ছে দুপুরের খাবার খাওয়ার পর থেকেই। চোখের পাতা লেগে আসছে। ইচ্ছে করছে যাওয়া ক্যান্সেল করে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে যেতে। কিন্তু সেটা এখন আর করা সম্ভব নয়। সকলে তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যে নিশ্চয়। এই সময় যাওয়া বারণ করা এক ধরনের অভদ্রতার মাঝেই পড়বে।

চোখটা টেনে টেনে খুলে রেখে ঘর থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে কাঁধে ব্যাগ আর সেটার মাঝে ফোনটা তুলে চেইন লাগিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে বাহিরে চলে আসে। বেণি পেছনে চলে যাওয়ায় তা ঠিক করতে করতে করিডোর ধরে হাঁটতেই সামনে পড়ল সাহানা। ঘুম ভরা চোখে তাকে দেখে ঠোঁট টেনে হাসল রাগিনী। জিজ্ঞেস করল,
“কোনো দরকার?”

“না তেমন কোনো দরকার আছিল না। বাহিরে যাইতেছো ঘুরতে? যাও যাও। তোমার মন মনে হয় ভালা না। ঘুইরা আসো। ভালা লাগবে।”

বলেই রাগিনীর আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলেন সাহানা। তারপর কিছু একটা ভেবে আবারও বললেন,
“তোমাগো এখনি বয়স ভালো কইরা সাজবা, স্টাইল কইরা মাথা বাঁধবা। তোমাগো বয়সে থাকতে কত সাজতাম আমি! আর তুমি দেখি সারাদিন একভাবে বাইরে বের হইয়া যাও।”

“আমার সাজতে ভালো লাগে না।”

মলিন হেসে জবাব দেয় রাগিনী। সাহানা যেন সন্তুষ্ট হন না। রাগিনীর চুলে দিকে তাকিয়ে বলেন,
“চুলগুলা সারাদিন বেণি কইরা থাকো। খোঁপা করো। আরো সুন্দর মানাইব জামার লগে।”

“সময় নেই এখন। বের হতে হবে। সবাই হয়ত ওয়েট করছে আমার জন্য।”

সাহানা কোনোরূপ কথা শুনলেন না আর। রাগিনীর পেছনে এসে তার চুলটা খুলে নিয়ে রাগিনী না চাওয়া সত্ত্বেও খোঁপা করে দিলেন হাত দিয়ে। অতঃপর রাগিনীর মুখশ্রীর দিকে চেয়ে মুগ্ধ হয়ে বললেন,
“এইতো সুন্দর দেখা যায় এখন। শুধু কমতি একটু ফুলের। বাড়ির পেছনে তো কাঠগোলাপের এতো বড় গাছ লাগাইয়া রাখছো। এখন ফুলটার শেষ সময় চলে। যাও দেখি ফুলগুলো খোঁপায় গুঁজে নাও। পরি দেখা যাইব তোমারে তখন।”

রাগিনী ঢক গিলে। চোখদুটো ডলে নেয়। সে পরি হতে চায় না এই মূহুর্তে। কারোর একান্ত পরি হতে চেয়েছিল সে নিজের আনমনেই। ইচ্ছেগুলো কোথাও মিলিয়ে গিয়েছে। যেমনটা দূর থেকে দেখা যায় আকাশটা মিলিয়ে যেতে ঠিক তেমনই মিলিয়ে গিয়েছে। রাগিনী ক্ষীণ সুরে বলল,
“সময় নেই। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

“তোমরা খালি তাড়াহুড়ো করো ক্যান? ওই গায়ক সাহেবরে কইয়া দিছি তুমি যাইতেছো একটু পর। সে আর তার বন্ধু বাইরে গাড়ির কাছেই আছে বাগানে। তুমি পেছনের দরজা দিয়ে গিয়ে কাঠগোলাপ নিয়া যাইতে কত সময় লাগবে? চলো দেখি তোমারে সাজাইয়া দিই।”

সাহানা যেন রাগিনীর কথা মানতে নারাজ। উনি নিজের কথাকে বাস্তবায়ন করেই ছাড়বেন। রাগিনীকে নিজের মনমতো সাজিয়েই দম নেবেন। তাই রাগিনীর হাত ধরে হাঁটা লাগালেন। সিঁড়ি দিয়ে নেমে চিলেকোঠা পেরিয়ে সেই পেছনের গেটের দিকে উপস্থিত হয়েই সাহানা বললেন,
“যাও। দেখো নিচে অনেক ফুল পইড়া আছে। আমি রাতের রান্না বসাইছি একটু দেখে আসি। আর কিছু মনে কইরো না। আমার মাইয়া নাই তো তাই ইচ্ছা করে তোমারে সাজাইয়া দিতে।”

রাগিনী সাহানার এমন সরল কথা আর চাহনিতে ভালো লাগল। সে পরিবর্তে একটা সুন্দর হাসি উপহার দিতেই সাহানা উল্টোদিক হাঁটা লাগালেন। রাগিনী উপায়ন্তর না পেয়ে আরেকটু এগিয়ে দিয়ে পেছনের দরজার শক্ত ছিটকানি খুলল। দরজাটা খানিকটা ধা’ক্কা দিতেই খুলে গেল দরজা। বাহিরে বের হলো। কিছুটা সামনেই বড় কাঠগোলাপের গাছ। নিচে ফুলগুলো পড়ে আছে অবিন্যস্তভাবে। ঘুমের চোটে এবার ঘোলা দেখছে রাগিনী সবটা। হঠাৎ তার অনুভূত হয় তার পা থেমে গিয়েছে। এগোতে পারছে না। পা চালাতে পারছে না। ছটফটিয়ে উঠল গলায় চাপ লাগায়। বুঝতে সময় লাগল কেউ তার গলা বাহু দিয়ে চেপে ধরেছে। কে এমন করছে? ঘাড় পেছনে ঘুরিয়েও লাভ হলো না। একটা শক্তিশালী পুরুষকে ঘোলাটে দেখে চিনতে পারল না সে। ফট করেই মাথায় খেলে গেল কোহিনূরের নাম। না চাইতেও যেন ভয়ের মাত্রা বাড়ল। সে সবটা জেনে যাওয়ায় তাকে বুঝি এভাবে শা’স্তি দেওয়া হচ্ছে? তাকে কি আর বাঁচিয়ে রাখবে না? রাগিনী চিৎকার করতে চাইল। নখ দিয়ে আঁচড় কাটলো ইচ্ছেমতো। লাভের লাভ হলো না। এবার নিশ্বাসটাও নিতে পারল না সে। নাকের সামনে রুমাল জাতীয় কিছু আনা হয়েছে। অদ্ভুত ঘ্রাণে ঝাঁঝ লাগলো প্রথমে। পরক্ষণেই বাকি শক্তিও গায়েব হলো শরীর থেকে। পুরোটা নিস্তেজ হয়ে গেল রাগিনী।

রাগিনীকে ছেড়ে দিতেই সেন্সলেস রাগিনী মুখ থুবড়ে পড়ে গেল ঘাসযুক্ত মাটিতে। কবির নিচের হাতটা নেড়েচেড়ে দেখে নিল। আঁচড় দিয়ে অনেকটাই হাতের অবস্থা বেহাল করেছে মেয়েটা। নখ বসে গিয়েছিল একদম। কবির রাগিনীর দিকে ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“পারবে না তবুও ছাড়বে না। ঘুমের ঔষধ দিলে কী হবে! এই সাহানার ঘুমের ঔষধ দেখি কোনো কাজের না। তেজ কমে না মাইয়াটার। কী অবস্থা করল হাতের। ভাগ্যিস ক্লোরোফর্মের ব্যবস্থা করা গিয়েছিল।”

সামনে থাকা রূপাঞ্জনা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিচে পড়ে থাকা দুটো ফুল হাতে তুলে নিয়ে বলল,
“মেয়ে মানুষ বলে কথা! তাদের তেজ আলাদাই।”

“যেমন আপনের।”

ফুলটা খোঁপায় গুঁজে কবিরের দিকে সরু চাহনিতে তাকাল রূপা। তার আবার তেজ? নেই বললে ভুল হবে। আছে তো অবশ্যই। নাহলে এতো এতো সরব ফেলে দিতে পারতো না নিশ্চয়। কবির রূপাঞ্জনাকে দেখে অবিশ্বাস্য হয়ে বলে,
“বস আপনাকে তো পুরাই এই রাগিনীর মতো লাগে এখন।”

“তাই নাকি? সেটাই যদি হয় তাহলে সেদিন কোহিনূর আমাকে চিনতে পারল কী করে? নিশ্চয় কোনো নিখুঁত পার্থক্য রয়েছে এখনো।”

“পুলিশের লোক, বস! বুঝতে হবে। চোখ দিয়েই সব বুঝতে পারে।”

“পুলিশের লোক হলেও বা কী? এতো পুলিশের চোখে ধুলো দিয়েছি। এটা শুধু তার কাছে কেসের অংশ নয়। হতে পারে মেয়েটা তার কাছে অন্য অনুভূতি!”

রূপাঞ্জনা আর কবিরের উত্তরের অপেক্ষা করল না। রাগিনীর হাতের ব্যাগ থেকে ফোন থেকে শুরু করে যা যা নিয়েছিল সব নিজের ব্যাগে নিয়ে হাঁটা দিল সামনের দিকে। হাতে সময় কম। যত দ্রুত কাজ শেষ করা যায় ততই ভালো। তবে আশংকা একটাই! সে যে মনস্থির করতে পারছে না নিজেকে। লক্ষ্যভ্রষ্ট না হতে হয়!

অস্থির মনে, এলোমেলো পায়ে বাগান দিয়ে ঢুকল উর্মিলা। রাগিনীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে সে। মেয়েটার কণ্ঠ তখন ফোনে শুনে ঠিকঠাক লাগেনি উর্মিলার কাছে। মনে হলো এই মূহুর্তে তার একটু রাগিনীর পাশে থাকা উচিত। অন্তত সাহস দেওয়া উচিত। বিরবির করে সে আনমনে বলল,
“ভয় পাওয়াই কথা। এতোদিন একটা আত’ঙ্কবা’দীর সেবাযত্ন করার পর যখন তার আসল পরিচয় জানতে পারা যায় তাহলে ভয় পাবেই। আমি ওর জায়গায় থাকলে তো আরেক দফা জ্ঞান হারিয়ে চিত হয়ে থাকতাম। কে জানে এখন…”

শেষ কথাটা অসম্পূর্ণ রইল উর্মিলার। শক্ত কিছুর সাথে ধা’ক্কা খেয়ে নিজেকে সামলে নিল সে। চোখে চশমা নেই। সবই ঘোলাটে দেখে। সামনে তাকিয়ে কেমন যেন পিলার পিলার লাগছে তার। ভ্রু কুঁচকে তাকাল উর্মিলা। এবার পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে এলো কর্ণকুহরে। ওমা! পিলার কথাও বলে!
“মাঝে মাঝে তো দেখে চলার অভ্যেস করতেই পারেন মিস. চাশমিশ।”

কণ্ঠস্বর কেমন চেনা চেনা ঠেকল উর্মিলার কাছে। স্মরণে এলো কিছুক্ষণ পর। চোখ পাকিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার পর বুঝল এটা সেই কুচুটে লোক। আগ বাড়িয়ে ঝগড়া করে শুধু শুধু। তৎক্ষনাৎ কপালে ভাঁজ পড়ে উর্মিলার। তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে সে।
“আপনি আবার? আমার দিনটাই খারাপ যাবে আজকে। আপনার জন্য আসতেই চাইছিলাম না আজ রাগিনীর বাড়ি। নেহাত ওর পাশে থাকতে হবে তাই এলাম। এসেই যে এমন কুচুটে মুখ দেখতে হবে জানলে আসতাম না।”

“ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, আজকের দিনটা অলরেডি চলে গিয়েছে। এখন বিকেল। তাই দিন নষ্ট হওয়ার কোনো চান্স নেই। রাত নষ্ট হলে হতে পারে। আর আমিও এমন ঝগড়ুটে মেয়ের দেখা আবার পাব জানলে আরো পরে বের হতাম।”

সর্বাঙ্গ জ্বলে ওঠে উর্মিলার। ইচ্ছে করে নিজেই নিজের চুল টেনে ছিঁড়তে। কেউ এতো শান্তভাবে কাউকে জ্বালাতে কী করে পারে। রেগেমেগে বলল,
“শুনুন, আপনার সাথে ঝগড়া করে মুড নষ্ট করার ইচ্ছে আমার নেই। রাগিনী কি বাড়ির ভিতরে আছে?”

“মেবি! রেডি হচ্ছে। আমাদের শহর দেখাতে নিয়ে বের হবে তাই।”

উর্মিলা আর কথা বাড়াল না। রাগে গজগজ করতে করতে নোমানের পাশ কাটিয়ে যেতেই নোমান হুট করেই তাকে পিছু ডেকে বলল,
“হ্যালো, মিস. চাশমিশ! একা একা বাড়ির মধ্যে ঢুকতে পারবেন তো? নাকি আমি এগিয়ে দিয়ে আসব? বলা যায় না আবার কখন কোন দেয়ালের সাথে মাথা ঠুকে যায়।”

উর্মিলা ঝাঁঝালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করল এবার। নোমান ঠোঁট টিপে হাসল। কেন সে জানে না তবে রাগাতে ভালো লাগছে তাকে। ইচ্ছে করছে আরো জ্বালাতে। আরো রাগাতে! রাগিনীকে দেখে নোমান বলল,
“ওইযে তোমার বান্ধবী!”

পেছন দিক থেকে রূপাকে আসতে দেখেই সকলেই রাগিনী ভেবে ভুল করল এবার। করারই কথা। এতো নিখুঁত মিল থাকলে কাছের লোকজন ছাড়া যে কেউ ভুল করবে। তবে রূপাঞ্জনার ভয় করছে। কারণ রাগিনীর স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। যদি ভুল কিছু বলে বা করে একবার ধরা পড়ে তবে আর পালানোর চান্স নেই। উর্মিলা রূপাকে দেখেই তার দিকে দ্রুত এগিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। জাপ্টে ধরে ফিসফিস করে বলে,
“ঠিক আছিস তো তুই?”

রূপাঞ্জনা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল জবাব দিল না কিছুর। বিরক্ত লাগল বেশ। এভাবে কেউ হা’মলে পড়ে নাকি? এটা একদম তার পছন্দ নয়। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে ধ’মকে সরিয়ে দিয়ে। তবে তা তো করা যাবে না। কিছুটা সময় নিয়ে কণ্ঠ চিকন করে বলল,
“আমি ঠিক আছি।”

“আমি তো ভেবেছিলাম তুই একদম ভয়ে ঘর থেকেই বের হচ্ছিস না। কিন্তু এখানে এসে দেখি কাহিনী অন্য। তুই সবার সাথে ঘুরতে বেরিয়ে যাচ্ছিস। আমিই বাড়িতে টেনশন করে ম’রছিলাম।”

রূপাঞ্জনা বুঝতে পারল এটাই সেই রাগিনীর ফ্রেন্ড হবে। নামটাও শুনেছিল মনে হয়। উর্মিলা! অতিরিক্ত বকবক করে। রূপাঞ্জনা শান্ত থাকার চেষ্টা করে বলল,
“আমার আর কী হবে! তুইও চল না আমাদের সাথে।”

“মোটেও না। তোরা যা। আমি কুচুটে লোকের সাথে যেতে পারব না।”

বলেই আঁড়চোখে নোমানের দিকে তাকাল উর্মিলা। নোমান কিছুটা চটে গেলেও শান্ত রাখল নিজেকে।
“আমার পক্ষেও এই আধকানা মেয়ের সাথে যাওয়া পসিবল না। দেখা যাচ্ছে কোথায় গিয়ে মাথা ঠুকে যাবে! নয়তবা পড়ে যাবে। আমাদের ঘোরাঘুরিই স্পয়েল হয়ে যাবে। তখন ম্যাডামকে হসপিটালে দৌড়াতে হবে। রাগিনী, এতো রিস্ক নেওয়ার কোনো দরকার নেই।”

তেতে উঠল উর্মিলা এবার। এতো বড় সাহস? তাকে এতো সহজে আধকানা উপাধি দিয়ে দিল? এবার উর্মিলার মন চাইছে লোকটারই চুল ছিঁড়তে। ক্ষুদ্ধ হয়েই সে বলল,
“রাগিনী, আমি তোদের সাথেই যাব। আর অনেক অনেক ঘুরব। একজনকে দেখিয়ে দেব আমি আধকানা কিনা!”

নোমান মিটমিটিয়ে হাসতেই গ্যারাজের কাছ থেকে হেঁটে এলো অভিরূপ। এ্যাশ কালার একটা শার্ট পড়েছে সে। হাতা গুটিয়ে রেখেছে কনুইয়ের কাছে। বোতামের ফাঁকে ঢুকানো সানগ্লাস আর হাতে কালো বেল্টের একটা ঘড়ি পড়েছে। পুরোটা ফর্মাল ড্রেসআপ তার। বিকেলের মিষ্টি আলো তার মুখে পড়লে আশ্চর্য রকম সুন্দর লাগে। রূপাঞ্জনা তাকে দেখেই থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মানুষটাকে সে আগে মনোযোগ দিয়ে দেখেনি। আজ দেখতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কোথাও খুঁত বের করার চেষ্টা করছে যেখানে তাকালে মনে হবে তাকে এলোমেলো লাগছে, অসুন্দর লাগছে। এমন করতে করতে রূপাঞ্জনার চোখটা আটকায় অভিরূপের মাথায় ঝাঁকড়া আর অযত্নে রাখা চুলগুলোর দিকে। কপালে অযত্নে পড়ে আছে অগোছালো হয়ে। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই অগোছালো জিনিসটাই ভালো লাগছে রূপার কাছে। সে পুলকিত হয়ে চেয়েই রইল। সবার মাঝে যে কথোপকথন হচ্ছে তাতে কান গেল না তার। হুট করে চোখের সামনে হাত নাড়ানো দেখে হকচকিয়ে তাকাল সে। অভিরূপের সুমিষ্ট কণ্ঠে বলা কথাগুলো এবার কানে পৌঁছালো তার।
“হ্যালো, ম্যাডাম! আপনি কি আবারও আমাকে মামা, চাচা কোনটা ডাকা যায় সেটা ভাবছেন?”

রূপা কপাল কুঁচকে জবাব দিল,
“মামা, চাচা ডাকব কেন? আপনি আমার কোন জন্মের মামা, চাচা?”

রাগিনী রূপী রূপাঞ্জনার কথায় অন্যরকম ঝাঁঝ পেয়ে উৎসুক হলো অভিরূপ। এইতো মেয়েটা! মনে হচ্ছে অসুস্থতা কাটিয়ে নিজের ফর্মে ফিরে এসেছে। এখন তাহলে বুঝি কথায় কথায় চোখ রাঙিয়ে তাকাবে? ঝাঁঝালো গলায় কথা বলবে? অভিরূপের তো প্রিয় এটাই! সে তো এটার জন্যই চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করেছিল। মেয়েটা হয়তবা জানে না।
“সেটা তো আমিও তোমাকে বলি! কিন্তু আমাকে সুযোগ পেলেই অদ্ভুত সম্পর্কে জুড়ে দাও।”

“এসব বাদ দে তো। তুই কী যেন বলছিলি! আজ গাড়িতে যাবি না। তো কীসে যাবি?”

অভিরূপের নেত্র দুটো চকচক করে উঠল নোমানের কথায়। প্রগাঢ় হেসে বলল,
“হ্যাঁ। আমি তো কখনো রিকশায় উঠিনি। তুই জানিস সেটা। তাই আমি ঠিক করেছি আজ আমরা রিকশাই ঘুরব। আর স্ট্রিটফুড ট্রাই করব।”

“আর ইউ সিউর অভি? তুই রিকশায় যাবি? দেখ, ভেবেচিন্তে কথা বল। রিকশাই কিন্তু এসি নেই। পরে চিল্লাচিল্লি করতে পারবি না।”

“আপনি চুপ করুন। আপনারা ওই গাড়ির কাঁচের মধ্যে থেকে প্রকৃতি দেখে কী বোঝেন বলুন তো? উনি এবার সত্যি প্রকৃতির রিয়েল ফিল নিতে চাইছেন আর আপনি কিনা ভয় দেখাচ্ছেন?”

ধমকে বলল উর্মিলা। নোমানে জবাবে স্পষ্ট ভাবে বলল,
“মিস. চাশমিশ! একটা চুল পরিমাণও তো এই ভদ্রলোককে চেনেন না। আমি তো ছোট থেকে দেখে আসছি তাই বুঝি। মাঝরাস্তায় রিকশা থেকে নেমে গরমে হাঁপিয়ে গাড়ি গাড়ি করবে। আর স্ট্রিটফুড দেখলেই তো ও নাক শিটকায়।”

“তুই কী মনে করিস আমাকে? আমি রিকশায় যেতে পারব না? স্ট্রিটফুড ট্রাই করতে পারব না? সবসময় আমার বদনাম না করলেই তোর চলে না। তাই না?”

গাল ফুলিয়ে বলে অভিরূপ। বাচ্চাদের যেমন তাদের বায়না পূরণ না হলে জেদ ধরে মুখ বেলুনের ন্যায় ফুলিয়ে রাখে ঠিক তেমনই করেছে অভিরূপ তার মুখভঙ্গি। এরই মাঝে হাসি পেল রূপার। তবুও তা চাপিয়ে গাম্ভীর্যের সাথে বলল,
“আচ্ছা সে দেখা যাবে কার কথা ঠিক হয়। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তো আর রিকশা আপনাআপনি নিয়ে যাবে না। ঠিক করতে রিকশা। কোথায় যাবেন আপনারা?”

“তুমি যেখানে নিয়ে যেতে চাও!”

রূপাঞ্জনা ভ্রু কুঁচকালো। আর কথা বাড়াল না। কথা বাড়িয়ে সময় তো নেই। তারা সবাই মিলে বাহিরে বের হলো। বের হওয়ার আগে বাড়িতে আবার কিছু একটা নেওয়ার জন্য গিয়েছিল নোমান। ফিরে আসা মাত্র মেইন রোডে একে একে দুটো রিকশা ঠিক করল রূপাঞ্জনা। অভিরূপ প্রথমটায় তড়িঘড়ি করে উঠে বসল বেশ আগ্রহের সাথে। তারপর উল্লাসের সাথে বলল,
“দেরি করছো কেন? উঠে পড়ো। নোমান, তুই উর্মিলার সাথে আয়। আর রাগিনী আমার সাথে আসুক।”

কথাগুলো খুব সহজে বলে দিলেও রূপার অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ায় থমকে গেল অভিরূপ। নোমানও সরু চোখে তাকিয়ে আছে। যেন দৃষ্টি দিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করছে, ‘বাহ! বেশ ভালোই তো রাগিনীকে নিজের পাশে বসিয়ে যেতে চাচ্ছিস। অতি বাড় বেড়ো না বাছা, ঝড়ে পড়ে যাবে। আমি কিছুতেই এই বাচাল মেয়েটার সাথে যাচ্ছি না।’

নোমান ইশারা করে রাগিনীর বাড়ি দেখিয়ে দিল। অর্থাৎ সে বাড়ি ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়বে। অভিরূপও বেশ নিষ্পাপ মতো একটা ভঙ্গি করে অনুরোধ করল না যেতে। আবারও রূপার দিকে দৃষ্টি যেতেই শুকনো ঢক গিলে নিয়ে বলল,
“ইয়ে মানে, নোমান আর আমি কেউই তো শহর চিনি না। তাই হারিয়ে গেলে কী হবে? তাই ভাবছিলাম দুজনের কাছে দুটো গাইড থাক। তাতে ভালো হবে। তাই না?”

রূপাঞ্জনা উত্তরে আর কিছু বলল না। কিছুটা সংকোচ নিয়েই উঠে বসল অভিরূপের পাশের সিটে। তার তো অভিরূপের কাছে কাছেই থাকতে হবে। মূল লক্ষ্য তো একটাই। তার হাতের ব্যাগে রয়েছে মোক্ষম জিনিসপত্র। প্রথমটা বো*ম। টাইমিং ফিট করা আছে ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের। এই সময়ের মধ্যে কাজ না হলে টাইম শেষ হলে আপনা-আপনি ব্লা’স্ট করবে সেটা। তাই এতো তাড়াহুড়ো রূপার। ভয় একটাই যেই হাতে এতো মানুষের র’ক্ত লেগে আছে। সেই হাতটা যেন আজ না কাঁপে। তাহলে সে আজ নিজের কাছে হেরে যাবে।

অভিরূপের পাশে বসতেই চেঁচিয়ে উঠল উর্মিলা।
“রাগিনী! তুই এমনটা করতে পারলি? আমি এই কুচুটের সাথে যাব তাও এক রিকশায়? আমাকে একা রেখে যেতে পারছিস তুই?”

“তোর সমস্যা হলে অন্য রিকশা নে। আলাদা চলে আয়। আর নাহলে দুজনই মুখে পারমানেন্ট তালা মে’রে নে। মৌনব্রত কর। কথা বলতে হবে না।”

রাগিনীর শান্ত কণ্ঠে উত্তর শুনে উর্মিলা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
“বুঝি বুঝি! দ্যা চকলেট বয় অভিরূপকে পেয়ে এখন আমাকে ভুলে যাচ্ছিস তুই। আমি সব বুঝি।”

রূপাঞ্জনা বিরক্ত হয়ে তাকাল। অভিরূপ হেসে একটু চুলগুলো হাত দিয়ে নাড়ালো। আর রিকশাওয়ালার উদ্দেশ্যে বলল,
“মামা, চলেন আপনি।”

রিকশাওয়ালা যেই কিনা প্যাডেল করা শুরু করল মাথা থেকে হাত সরে গেল অভিরূপের। কেমন যেন কাঁপছে রিকশা। আবার দুলছেও। ভয় ধরে গেল অভিরূপের। আচমকা রিকশার হুক চেপে ধরে জোরে জোরে বলল,
“এই মামা, আপনার রিকশায় সমস্যা আছে নাকি? এমন করে কেন?”

“একদম ফিট রিকশা। কোনো সমস্যা তো নাই। আপনে ভালা কইরা বসেন।”

রিকশাওয়ালার উত্তরে মুখ ফ্যাকাশে হলো অভিরূপের। ক্যাচক্যাচ শব্দও করছে। তবুও চেষ্টা করল রূপাঞ্জনার সামনে সাহস ধরে রাখার। রূপা অন্যদিকে চেয়ে থেকে আপনমনে কিছু ভাবছে। আনমনেই সে বলল,
“রিকশা এভাবেই চলে। টালমাটাল হয়ে, হেলেদুলে।”

ফট করেই রাস্তার গর্তে যখন রিকশা খানিকটা হোঁচট খেল আরো বেশি নড়চড় দিয়ে উঠতেই অভিরূপ আর আগপাছ না ভেবে রূপার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“ও মাই গড! আমি পড়ে যাব! এ কোন বিপদে পড়লাম! ওহ গড, প্লিজ সেভ মি।”

রূপাঞ্জনার হাতে আচমকা এই স্পর্শে চকিতে তাকালো অভিরূপের পানে। চোখ বড় বড় করে তাকাল নিচে যেখানে তার আর অভির হাত মিলিত। অদ্ভুত এক নবীন অনুভূতি, অস্বস্তি সব মিলিয়ে মিশ্র অনুভূতি জায়গা করল মনে। কপাল ঘেমে উঠল। ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই অভিরূপ ভয়ে ভয়ে ছেড়ে দিল রূপার হাত। আর মিনমিন করে বলল,
“সরি।”

“রাস্তা ভালো নয় তেমন। অনেক গর্ত আছে। এমনটা হবেই রিকশায়।”

বলে থামল রূপাঞ্জনা। অভিরূপের ভয় মাখা ফ্যাকাশে চুপসে যাওয়া চেহারার দিকে তাকালো একবার। তারপর বিস্ময়ের সুরে বলল,
“ভেবেই আশ্চর্য হচ্ছি যেই মানুষ সেদিন আমায় ওসব বখাটে ছেলেদের হাত থেকে বাঁচাতে কত নাটক করল সাহসের সাথে সেই মানুষটাই রিকশায় এতো ভয় পায়?”

“কখনো উঠি নি তো। আর সাহসও পাচ্ছি না।”

বলতে বলতেই আবারও একটা গর্তে পড়ল রিকশা। চমকে উঠে না চাইতেও রূপাঞ্জনার হাতটা আবারও নিবদ্ধ করল নিজের হাতে। এবার ঠোঁট কামড়ে সেই স্পর্শ সহ্য করল রূপাঞ্জনা। এই স্পর্শ যেন চামড়া ভেদ করে পুরো শরীরে নাড়া দিচ্ছে। অভিরূপ ভয়ে ভয়ে বলল,
“আমি তোমার হাতটা ধরে থাকি প্লিজ? প্রমিস, অন্যকিছু করব না।”

“অন্যকিছু বলতে?”

“ইয়ে মানে নাথিং! ধরে থাকি হাতটা?”

রূপাঞ্জনা আর কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ায়। অভিরূপের উষ্ণ আরো প্রগাঢ় হয়। নিজেকে সংবরণ করার চেষ্টায় মত্ত থাকে রূপাঞ্জনা।

উর্মিলা আর নোমান রিকশার দুই ধারে দুজন বসে আছে। দুজন দুদিকে মুখ করে রয়েছে। ভুলেও একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে না। তাকালেই যেন তৃতীয় বিশ্বযু’দ্ধ নিশ্চিত। হুট করে রাস্তার গর্তে রিকশা হেলেদুলে উঠলে পরিস্থিতির চাপে দুজন কাছাকাছি এসে দ্রুত বিদ্যুতের বেগে আবারও আগের জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। খানিকক্ষণ পর কিছু একটা ভেবে নিজের পকেট থেকে আস্তে করে চশমার বক্স বের করে নোমান। বক্স খুলে চশমা নিয়ে পুনরায় চশমার বক্স পকেটে ঢুকিয়ে চশমা নিজে পড়ে উর্মিলার উদ্দেশ্যে বলল,
“দেখো তো আমায় কেমন লাগছে?”

উর্মিলা রাশভারি হয়ে তাকালো নোমানের পানে। তার চোখে পছন্দের ফ্রেমের চশমা দেখে বিরক্তি কোথায় যেন উবে গেল। হা হয়ে দেরি না করেই টেনে খুলে নিল চশমা। নিজের দুহাতে ধরে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
“আমার চশমা! আমার পছন্দের ফ্রেম।”

নোমানের মাথায় খেলে গেল দুষ্টু বুদ্ধি। সে ছো মেরে নিয়ে নিল চশমা। আর শক্ত গলায় বলল,
“আশ্চর্য তো! আমার চশমাকে তুমি নিজের চশমা কী করে বলছো? এটা আমি আমার টাকা দিয়ে কিনেছি। তুমি তো দেখছি মহা ডা’কাত।”

“কিন্তু এটা তো মেয়েদের ফ্রেমের চশমা।”

“তো কী হয়েছে? আমি আমার গার্লফ্রেন্ডের জন্য কিনেছি।”

নাক ফুলিয়ে চোখ রাঙালো উর্মিলা। একটুর জন্য খুশি হয়েছিল তা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। মুখ পেঁচার মতো করে আবারও অন্যদিকে ফিরিয়ে নিতেই ফট করে নোমান তার হাতে চশমা ধরিয়ে বলল,
“নাও তোমার চশমা। তোমার জন্যই কিনেছিলাম। সেদিনের জন্য সরি। অনেক ঘুরে তোমাকে সরি বলার জন্য এই ফ্রেম পেয়েছি। আর পড়ে দেখো পাওয়ার এক কিনা!”

উর্মিলার মুখে দেখা গেল হাসির ঝিলিক। যেন একঝাঁক খুশির দল হা’না দিয়েছে তার মুখেই। বিকেলের কমলা রোদ তার হাসিময় রূপটাকে বাড়িয়ে দিতে আরো সাহায্য করছে। উর্মিলা চশমা পড়ল। তারপর উৎসুক হয়ে বলল,
“সব ঠিকঠাক।”

নোমান নিঃশব্দে হেসে সামনে তাকায়। হঠাৎ করেই উর্মিলা প্রশ্ন করে,
“এটা কোন দোকান থেকে কিনেছিলেন?”

“অনেক ঘুরতে হয়েছে এটার জন্য। ঠিক মনে নেই নামটা। বাট বসুন্ধরা থেকে কিনেছিলাম।”

“ওখানে কি একপিসই এই ফ্রেম ছিল?”

নোমান মাথা নাড়িয়ে জবাব দিতেই আবারও উর্মিলা তেতে উঠে বলল,
“তার মানে আপনিই সে-ই লোক যে লাস্ট পিস কিনে নিয়েছিলেন আর আমাকে ঘুরে আসতে হয়েছিল?”

নোমানের চোখজোড়া সরু হয়ে আসে। বুঝে উঠতে পারে না কিছুই। উর্মিলা আরো রেগে বলে,
“আপনার জন্য আমাকে ঘুরে আসতে হয়েছে। বলেছে, লাস্ট পিস একটা লোক কিনে চলে গিয়েছে। আপনি না কিনলে ওটা আমি পেতাম।”

কিছুটা সময় নিয়ে নোমান বুঝল বিষয়টা। হতভম্ব হলো নিজেই। কোনোরকমে জবাব দিল,
“বাট, এনে তো তোমাকেই দিলাম। তাহলে ক্ষতি কীসে হলো?”

“সেদিন আমাকে পুরো মার্কেট ঘুরিয়ে বলছেন ক্ষতি হয়নি? বদ লোক!”

বিষম খেলো নোমান। যার জন্য এতো খুঁজে চশমা কিনলো এখন সেই কিনা কথা শোনাচ্ছে? এটা কী মানা যায়? একেই বোধহয় বলে, ‘যার জন্য করি চুরি সে-ই বলে চোর!’
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪০

শোয়া থেকে উঠে বসল নির্জন। পুরো বেডে দুটো ব্ল্যাঙ্কেট দিয়ে ভরা। দুটো পা ঢাকা ব্ল্যাঙ্কেট দিয়ে। ঠান্ডা লাগছে কিছুটা। কপাল থেকে ভেজা রুমালটা সরিয়ে পাশে থাকা বাটিতে রেখে দিল। দৃঢ় শ্বাস ফেলতেই ভেতর থেকে গরম এক বাতাস তার হাতে এসে পড়ল। শান্তি পাচ্ছে না কিছুতেই। হাত দুটো ক্ষণে ক্ষণে কাঁপছে। ভেসে উঠেছে হাতের ভেতরে থাকা সবুজ রগ। সেটাই মনোযোগ দিয়ে দেখছে নির্জন। নয়নতাঁরার প্রবেশে মাথা উঠিয়ে তাকাল সে। নয়নতাঁরা হাতে একটা বাটি নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নির্জনকে বসা অবস্থায় দেখে তাড়াতাড়ি করে এগিয়ে এসে বলল,
“বিগ ব্রাদার, আবার কেন উঠে বসেছো তুমি? কিছুক্ষণের জন্য শান্তভাবে শুয়ে থাকা যায় না?”

“এমন হাবভাব করছো যেন আমার জ্বর নয় ক্যান্সার বা জন্ডিস হয়েছে। আই এম ফাইন। এভাবে শুয়ে থাকতে দম বন্ধ লাগছে আমার।”

“সারাদিন ক্যাঙ্গারুর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছো একদম। দেখি, টেম্পারেচার কত?”

নির্জন কিছু বলার আগেই তার মুখে থার্মোমিটার পুরে দিল নয়ন। চোখ গরম করে নির্জনকে শান্ত হয়ে বসে থাকতে বলল সে। নির্জন চোখমুখ কুঁচকে বসে থাকল দুই মিনিট মুখে থার্মোমিটার নিয়ে। সময় হলে সেটা বের করে ভালো করে টেম্পারেচার দেখতেই চোখ দুটো ছানাবড়া হলো নয়নতাঁরার। নির্জনের সামনে থার্মোমিটার ধরে বলল,
“দেখেছো, দেখেছো? পুরো ১০২। আর ভদ্রলোক কিনা যাবেন অফিসে। আহা! আমি জানি তুমি ব্রিলিয়ান্ট মানুষ। অনেক শক্ত মানুষ। তাই বলে সুপারম্যান মনে করে নিজেকে ভুল ভেবে বসো না।”

“আমার কাজ আছে নয়ন। ভালো লাগছে না। কেমন যেন অস্থির লাগছে।”

নয়নতাঁরা দমে না। ধমকে বলল,
“তোমার কাজকে আমি তোমার রি’ভলবা’র দিয়ে গু’লি মা’রি। তুমি বেড থেকেও উঠবে না।”

কড়া চাহনি নিক্ষেপ করল নির্জন। এই নয়ন মেয়েটা যেন মূহুর্তেই বড় হয়ে গিয়েছে। প্রতিবারই যতবার নির্জনের কিছু হয় তখনি যেন ম্যাজিকের মতো সে ফট করে বড় হয়ে যায়। ভাইয়ের যত্ন করে দায়িত্ব নেয়। কথায় কথায় ভাইকে ধমক দেয়। আজও ব্যতিক্রম হয়নি তার। সকালের পর থেকে দুপুরে প্রচন্ড মাথাব্যথা নিয়ে বাড়ি আসে নির্জন। তারপর থেকে গা গরম হতে থাকে। নয়ন খেয়াল করে সবই। তারপর জ্বর পরিক্ষা করেই বর্তমানে নির্জনকে জোর করেই বেডে শুইয়ে রেখেছে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি পূর্ণ গাল ছাড়া পুরো মুখে জ্বরের ভাবটা দেখা দিয়েছে রক্তিম বর্ণ হয়ে। চোখ দুটো কিছুটা ফুলে গিয়েছে। কথা বলতেও যেন মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মাথা বাড়ালো না নির্জন। দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে বসতেই চোখটা বুজল সে। নয়নতাঁরা বাটি আবারও হাতে নিয়ে চামচ দিয়ে নাড়াতে নাড়াতে শান্ত গলায় বলল,
“বিগ ব্রাদার! এটা একটু খেয়ে নাও।”

চোখ মেলে ভ্রু কুঁচকে তাকাল নির্জন বাটির দিকে। চিকেন স্টু দেখেই নাক শিটকে এলো তার। গম্ভীর গলায় বলল,
“বিদেশে থেকে থেকে দেশি রান্নাবান্না ভুলে গিয়েছো? আমার এসব খাওয়ার রুচি হয় না। আর তোমার রান্না মুখে দেওয়া যাবে নাকি?”

নয়নতাঁরার চোখ ছোট হয়ে আসে। ঠেস মে’রে বলে,
“আমার রান্না তো মুখে দেওয়া যাবেই না। রাগিনী ভাবির হাতের খাবার তোমার মুখে লেগে গিয়েছে কিনা!”

“যখন তখন রাগিনীর কথা না তুললে চলে না তোমার তাই না?”

“বাবাহ্! এখনি যেভাবে কিছু বলতেই ক্ষেপে যাচ্ছো। বিয়ের পর কী হবে? আমি পাত্তা পাব তো?”

কথায় কথায় নির্জনের মুখে খাবার ধরে নয়নতাঁরা। খাবার মুখে নিয়ে গিলতে গিলতে বলে,
“কোথায় থেকে কোথায় চলে যাচ্ছো?”

“ঠিক জায়গাতেই আছি আমি। আমি বুঝি না নাকি? কীসের এতো অস্থিরতা? মন আকুপাকু করছে না?”

নির্জন চোখ গরম করে তাকায়। শক্ত গলায় বলার চেষ্টা করে,
“আই এম ইউর বিগ ব্রাদার! আর ভাইয়ের সাথে কেউ এসব কথা বলে নাকি?”

নয়ন ঠোঁট কামড়ে হেঁসে উত্তর দিল,
“সবাই বলে। শুধু তোমার মতো নিরামিষ ভাই থাকলেই বলে না। আচ্ছা শোনো, রাগিনী ভাবি সব সত্যিটা জানিয়েছো?”

নীরবতা অবলম্বন করে নির্জন। মুখটা আগের চেয়ে বেশি ভার হয়ে আসে। তার মুখভঙ্গি দেখেই নয়নতাঁরার বুঝতে দেরি হয় না এখনো তার ভাই যেই অবস্থাতে ছিল সেই অবস্থাতেই আছে। নাক ফুলিয়ে নয়ন বলল,
“তুমি তো দেখছি বাহিরের মানুষের কাছেই যত সাহস দেখাও। ভাবির কাছে একদম ভীতুর ডিম!”

“চেষ্টা তো কম করিনি। কিন্তু সে সামনে আসলেই তো সব উলোটপালোট হয়ে যায়। মুখের দিকে তাকালেই মনে হয় ও জানলেই সব শেষ। এ জীবনে আর আমার মুখোমুখি হবে না।”

“তুমি জোর করে তার মুখোমুখি হবে। সে যতবার চলে যাবে তুমি ঠিক ততবারই তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। তার মনেও যদি তোমার জন্য গুপ্ত আর সেই সব থেকে সুন্দর অনুভূতি গেঁথে থাকে তবে একসময় না একসময় ঠিক তোমার কাছে ধরা দেবে।”

নির্জন স্থির চোখে নয়নের দিকে তাকাল। তারপর হাত উঠিয়ে নয়নের নাকটা টেনে ধরে বলল,
“এসব কথাবার্তা কে শিখিয়েছে তোমায়?”

হাতটা সরিয়ে দিয়ে নাক ঘষতে ঘষতে নয়নতাঁরা বলল,
“প্রেমে পড়লে সবাই আপনা-আপনি শিখে যায়। আমি কিন্তু সিরিয়াস বিগ ব্রাদার। মিথ্যে দিয়ে কখনো কোনো সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি হতে পারে না। ইউ সিউরলি নো দ্যাট?”

“আই নো দ্যাট। কিন্তু সত্যি স্বীকার করার সৎসাহস আমার নেই। এই প্রথম নিজেকে চরম মিথ্যেবাদী মনে হচ্ছে আমার নয়ন। এই মিথ্যে আমার রাতের ঘুম কেঁড়ে নিয়েছে। ব্যাস…এতো টুকু বুঝে গিয়েছি ও আমার সামনে আসলে আমি জীবনেও জবান খুলতে পারব না।”

নয়নতাঁরা বুঝল তার ভাইয়ের মনের কথা। কারণ ছেলেটার কণ্ঠসুরে অন্যরকন অনুনয়। এমনভাবে কথা বলতে কখনো শোনে নি সে। নির্জন আবারও অনবরত বলল,
“এবার নিজেকে সেই অপরাধীদের মতোই মনে হচ্ছে যাদের বন্দী করতে আমি দিনরাত খাটি।”

নয়ন চুপচাপ নির্জনের মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে ভাবলেশহীন হয়ে পড়ল। এভাবেই খাবার শেষ করে নির্জন। পিনপতন নীরবতা ছেড়ে খাবারের বাটি রেখে ফট করেই চোখেমুখে উজ্জ্বলতা নিয়ে নয়ন বলে ওঠে,
“ফাইন! তুমি তার সামনাসামনি কিছুই বলতে পারবে না। কিন্তু তার সামনাসামনি না থেকে তো বলতেই পারো। তাই না?”

নির্জন ভ্রু কুঁচকায়। কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ে। মুখ চোখা করতেই নয়নতাঁরা হাতিয়ে তার ভাইয়ের ফোনটা হাতে নিয়ে ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে বলে,
“এখন রাগিনী ভাবির নম্বর ডায়াল করো আর তাকে সব সত্যি বলে দাও।”

“আর ইউ ম্যাড নয়ন? ওর কণ্ঠ শুনলেই আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠবে। তাছাড়া জানি না কেন আজ হুট করেই আমায় কিছু না বলে চলে গিয়েছে। কারণটা এখনো জানি না।”

নয়নতাঁরা ভারি বিরক্ত হয় এবার। দাঁত কটমট করে রেগে রেগে জবাব দেয়,
“দিস ইজ টু মাচ বিগ ব্রাদার। দিন দিন ভিগি বিল্লি হয়ে যাচ্ছো। সবকিছুতে তোমার সমস্যা। কিন্তু নয়ন আজকে তোমাকে দিয়ে সত্যিটা বলাবেই। আচ্ছা নো প্রবলেম। আমি তোমায় সাজেস্ট করব যা যা বলতে হবে। এক নিশ্বাসে বলে দেবে।”

নির্জন বুঝলো এখন আর এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তাছাড়া সে তো কম চেষ্টা করেনি। দেখা যাক আজ ইনিয়েবিনিয়ে সবটা বলতে পারে কিনা। বুকে সাহস নিয়ে দুরুদুরু মনে ফোনটা হাতে নেয় নির্জন। নয়নতাঁরা দ্রুত হাতে কলম আর খাতা নিয়ে বসে। নির্জন নম্বর ডায়াল করে কল করে।

মাওয়া ঘাটে এসেছে রূপাঞ্জনা আর অভিরূপ। নদীর স্রোত সবকিছু যেন ভেসে নিয়ে যেতে সক্ষম অদূরে। ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা হাওয়া এসে গায়ে লাগছে রূপার। ওড়না সামলাতে না পারার দরুন বার বার সরে যাচ্ছে অন্য জায়গায়। বেশ বিরক্ত হয় রূপা। ওড়না জিনিসটাকে এতো উড়তে হবে কেন? স্থির থাকা যায় না? অন্যদিকে ফুচকা খেয়ে অলরেডি পানির বোতলের উপর পানির বোতল কিনে ঢকঢক করে পানি গিলছে অভিরূপ। ঝাল ফুরাচ্ছে না মুখ থেকে। জিহ্বা বের করে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে মাঝে মাঝে। এমতাবস্থায় রূপাঞ্জনা আঁড়চোখে তাকিয়ে বলল,
“সবার পেটে সব সয় না। ভেবে ঝাল নেওয়া উচিত ছিল।”

“আ…আমি তো ভেবেছিলাম তু…তুমি যখন ঝাল খেতে পারছো আমিও পারব। তাই তো এক্সট্রা করে…”

“আপনি স্ট্রিটফুড খেয়ে অভ্যস্ত নন। নোমান ভাই ঠিকই বলেছিলেন। একে তো সারা রাস্তা হাতটা ধরে এসে আমার হাতটাই ব্যথা করে দিয়েছেন তার উপর ঝালে মনে হচ্ছে এখনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবেন।”

এবার যেন অভিরূপের ইগোতে আঘাত লাগে। রাগিনী বুঝি তাকে এতোই দুর্বল ভাবে? সামান্য ঝালে জ্ঞান হারাবে এটা ভাবছে? নিজেকে ধাতস্থ করে অভিরূপ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
“আমি এতোটাও উইক নয়।”

রূপাঞ্জনা কিছু বলল না। হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকাল একবার। হাতে বেশি সময় নেই। অনেকক্ষণ কেটে গিয়েছে আর রয়েছে মাত্র চল্লিশ মিনিটের মতো। এর মধ্যে যেকোনো ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো। নয়ত সব শেষ হবে। সবকিছুর সাথে সে নিজেও। অভিরূপের এই চাঞ্চল্যকর মুখটা পু’ড়ে কীভাবে বিভৎস হবে সেটা কল্পনা করতেই গা শিউরে ওঠে রূপার। কেমন যেন লাগছে তার। তার মনটা যেন খুব করে চাইছে আজ যেন সে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। কিন্তু এতে তো তার কোনো লাভ নেই। তবে? মাঝে মাঝে কিছু মনোবাসনা বোধহয় লাভ-ক্ষতি হিসেব করে না। অভিরূপের বায়না ধরা কণ্ঠে ধ্যানটা ভঙ্গ হয় রূপাঞ্জনার।
“এই সবাই কী নৌকায় উঠছে! আমরাও উঠি?”

রূপাঞ্জনা দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
“হ্যালো, মিস্টার! ওটা নৌকা। কোনো এক্সপেন্সিভ জাহাজ বা ট্রলার না।”

“আমিও তো ওটাকে নৌকাই বললাম। জাহাজ না ট্রলার কখন বললাম?”

বিস্ময়ের সুরে জানতে চায় অভিরূপ। রূপাঞ্জনা ঘাড় কাঁত করে বলল,
“রিকশায় উঠেই আর একটু হলে স্ট্রো’ক করে দিতেন। আর নৌকা? শেষমেশ আপনাকে নিয়ে হসপিটালে দৌড়াতে হবে আমায়।”

“হ্যালো মিস. সাহসীনি! আমাকে মি. ভীতু ভেবো না। আমার যথেষ্ট সাহস আছে। আর এখন আমি নৌকায় উঠব। তার সঙ্গে তুমিও।”

বেশ ভাব নিয়ে কথাগুলো একনাগাড়ে বলার পর সিঁড়ি দিয়ে নেমে মাঝির সাথে কথা বলতে উদ্যত হলো অভিরূপ। রূপাঞ্জনা শুধু দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকে চেয়ে দেখল অপলক। লোকটার জানাও নেই সে মৃ’ত্যুকে নিজে আহ্বান করছে। রূপাঞ্জনা যে তার মৃ’ত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এটা জানলে ঠিক অভিরূপের কী প্রতিক্রিয়া হবে? ভাবতে ভাবতেই রূপাঞ্জনার মনে হয় ব্যাগের ভেতরে থাকা ফোনটা অনবরত ভাইব্রেশন হচ্ছে। সে দ্রুত এবার ফোন বের করতেই আনসেভ একটা নম্বর দেখতে পায়। গলা খাঁকারি দিয়ে সিঁড়ির উপরে উঠে একটু সাইডে আসে রূপা। ফোনটা না চাইতেও রিসিভ করে কানে ধরে।

ফোনটা রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে কেঁপে উঠে নির্জন। ঢক গিলে অনবরত ঘন শ্বাস ফেলতে থাকে। নয়নতাঁরা পাশ থেকে তাকে আলতো ধা’ক্কা দিয়ে ইশারায় বলে কথা বলতে। তৎক্ষণাৎ নির্জন কোনোমতে বলে ওঠে,
“হ্যালো, রাগিনী! আমি নির্জন। আই মিন কোহিনূর।”

ওপাশ থেকে বিস্ময়ের কন্ঠে ভেসে আসে এবার।
“আপনি?”

“হ্যাঁ আমি।”

বলেই আঁড়চোখে নয়নের খাতার লেখার দিকে তাকায় সে। তারপর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠসুরে বলতে থাকে,
“আমি জানি তুমি অবাক হয়েছো। হয়ত ভাবছো আমার কাছে ফোন এলো কী করে! আমি সব তোমাকে একে একে বলছি। বাট প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবে না।”

“বলুন?”

“একচুয়ালি আপনি কোনো মেন্টাল পেশেন্ট নয় রাগিনী। আমি একটা উদ্দেশ্য নিয়ে সেখানে এই রূপে থাকতে শুরু করি।”

ওপাশটা পুরোটা স্তব্ধ। নির্জন খুব করে অপেক্ষা করে রাগিনীর উত্তরের। কিন্তু রাগিনী চুপ হয়ে গিয়েছে। নয়নতাঁরার দিকে তাকিয়ে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বলল,
“ও তো কোনো এন্সারই করছে না। এখন কী করব?”

নয়নতাঁরা পাতা উল্টে দ্রুত লিখে দেখালো নির্জনকে। যেন নির্জন নিজের কথা বলা চালিয়ে যায়। আর ফিসফিসিয়েই জবাব দিল,
“তুমি একটা সিক্রেট অফিসার। এতোটুকুতে ভয় পেলে চলে?”

নির্জন পুনরায় ফোন ভালো করে কানে ধরল। এবার একনাগাড়ে বলতে শুরু করে,
“কেসটা এতোটা জটিল ছিল যার মধ্যে তুমিও জড়িয়ে ছিলে। রাগিনী তাজরীন নামটা জড়িয়ে ছিল। তাই তোমায় পরখ করতেই আমার সেভাবে থাকা। কিন্তু আস্তে আস্তে আমার ধারণা সবটা পাল্টে দিলে তুমি। বুঝিয়ে দিলে তুমি কারোর ক্ষতি করার আগে নিজেই ম’রে যাবে। তাও তাকে আ’ঘাত করবে। এটাই ছিল রাগিনী তাজরীন। আমি উল্টোটা ভেবে সবসময় তোমায় সন্দেহের নজরে দেখেছি। আমার কাজটাই এমন ছিল যে আমি কাউকে সন্দেহের বাহিরে রাখতে পারতাম না। হ্যাঁ, আমি পুলিশের লোক। একজন সিক্রেট অফিসার। নির্জন আহমেদ কোহিনূর। তুমি শুধু আমার কোহিনূর নামটা জানতে। বাকিটা আজ জানলে। এখন বাকিটা তোমার হাতে। যা পানিশমেন্ট দেবে মেনে নেব আমি। ব্যাস…রিকুয়েষ্ট একটাই। এই নামহীন সুন্দর অনুভূতিগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘৃণার অনুভূতি তৈরি করো না এই কোহিনূরের জন্য।”

কিছুক্ষণ নীরব থাকে ওপাশ। শোনা যায় না রাগিনীর সেই রিনরিনে কণ্ঠ। তার নীরবতা যত বাড়ছে ততই যেন হৃদয় থেকে র’ক্তক্ষরণ হচ্ছে নির্জনের। গলা শুঁকিয়ে আসছে। নিশ্চিত টেনশনের চটে জ্বরটাও ধিকধিক করে বেড়েছে? ফট করেই কল কেটে যায়। ধড়ফড়িয়ে নির্জন আবারও কল করে সেই নম্বরে। ফোন সুইচ অফ বলতেই উন্মাদনা বেড়ে গেল নির্জনের। নয়নের উদ্দেশ্যে বলল,
“আমি বলেছিলাম! ও সহ্য করবে না। এতো বিশ্বাস যখন এক পলকে টং করে ভেঙ্গে যায় তখন হৃদয়ে আগুন ধরে। এখন কী হবে?”

“উফফ…প্রেমের চক্করে সবাই ভীতুর ডিম দেখি। ট্রাই করো ফোন করতে।”

নির্জন কথা না বাড়িয়ে বারংবার ফোনে কল দিতে থাকে। তবে ফলাফল শূন্য। তিন-চার বার এমন করার পরপরই তার ফোনেই উল্টে কল আসে। কোনোকিছু না দেখেই দ্রুত রাগিনীর কল ভেবে রিসিভ করতেই ধারণা পাল্টায় তার। পুরুষালি কণ্ঠ তাকে স্থির বানিয়ে দেয়।
“স্যার, একটা ইনফরমেশন পেয়েছি।”

“কী ইনফরমেশন মেহরাজ?”

“জটিল ইনফরমেশন। আপনার কথা অনুযায়ী ইন্সপেক্টর রায়ানের মাধ্যমে রাশেদ সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে আমাদের টিমের একজনকে কাজের লোকের ছদ্মবেশ ধরে আজ সকালে রাগিনীর বাড়িতে পাঠানো হলো। সে কিছুক্ষণ আগে আমাদের সাথে কনটাক্ট করেছে। আর বলেছে বাড়িতে সাহানা নামক মহিলাটি যথেষ্ট সন্দেহজনক। তার কাছে দুটো মোবাইল ফোন রয়েছে। আর মাঝে মাঝেই কার সাথে যেন কথা বলতে দেখেছে।”

নির্জন নড়েচড়ে বসে। ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু একটা ভেবে বলে,
“তাহলে ঘরের শত্রু বিভীষণ!”

“স্যার, আরো একটা কথা বলার আছে।”

কিছুটা সংকোচ নিয়ে বলল মেহরাজ। নির্জন ছোট্ট করে জিজ্ঞেস করল,
“কী?”

“আজকে রাগিনী ম্যাডাম বেরিয়েছিল অভিরূপদের সাথে। আর রেডি হওয়ার পর ওই মহিলা মানে সাহানা কেন যেন পেছন দিকে দরজা দিয়ে রাগিনীকে বিদায় দিয়েছে। আর আমাদের লোক সেটা ফলো করতেই সাহানা চমকায়। আর বিভিন্ন বাহানা দিয়ে আমাদের লোককে সে চোখে চোখে রাখছে। মনে হয় সেও কিছু আন্দাজ করেছে।”

দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো নির্জনের। শক্ত গলায় বলল,
“আচ্ছা, বাড়ির পেছনদিকে তো কোনো লোকজন থাকে না তাই না?”

“না স্যার। ওদিকে তো তেমন কেউ যায়ই না।”

নির্জন আবারও কথা বলা থামায়। ভাবনায় গভীরে চলে যায়। কিছু একটা মাথা আসতেই চোখ বড় বড় হয় তার। মেহরাজের উদ্দেশ্যে জোরে বলে ওঠে,
“ওয়েট অ্যা মিনিট! ওই মেয়ে আর রাগিনী দুজনই এক দেখতে। এর মানে এর মধ্যে কোনোকিছু ঘটে গিয়েছে।”

বলেই থামলো সে। অতঃপর দম দিয়ে তড়তড় করে বলে উঠল,
“রাগিনী ইজ ইন ডেঞ্জার। আর অভিরূপ চৌধুরীও। মেহরাজ, আমার কথা মন দিয়ে শোনো! ওই সাহানা নামক মহিলাকে এখনি আটক করার ব্যবস্থা করো। লেট করা যাবে না। আর অভিরূপ বা তার বন্ধু নোমান! যেকোনো একজনের ফোন ট্র্যাক করো জলদি। আর ট্র্যাক করার পর যেই লোকেশন দেখাবে সেখানে দ্রুত ফোর্স পাঠাও। আমি আসছি।”

ফোন কাটে নির্জন। দ্রুত তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায়। মাথাব্যথা যেন আরো বেড়ে যায়। মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। ব্ল্যাঙ্কেট থেকে বের হতেই শরীরে ঠান্ডা লাগে বেশ। তবে দাঁড়ালে চলবে না। নয়নতাঁরা এমন অবস্থা দেখেই বেশ চিন্তিত হয়ে বলল,
“কী হয়েছে? এনি প্রবলেম?”

নির্জন কিছু বলে না। দেয়ালে হাত মুঠো করে আ’ঘাত করে জোর গলায় বলে,
“বুলশিট! আমি যদি ভুল না হয় একটু আগে ওটা রাগিনী নয়। ওই টেরো’রিস্ট গার্ল ছিল।”

বিস্ময়ের চরম সীমানায় নয়নতাঁরা। হতভম্ব হয়ে বলল,
“মানে?”

“এতো কিছু বলার সময় নেই এখন। আমি কাজে যাচ্ছি।”

নয়নতাঁরা নির্জনের হাত ধরে অসহায় পানে চেয়ে বলে,
“বাট বিগ ব্রাদার! তোমার জ্বর…”

দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে হাতটা সরিয়ে নেয় নির্জন। ধীর গলায় বলে,
“আমার সংলগ্নে থাকা নারীর বিপদ আমার অসুস্থতার কাছে তুচ্ছ। তার কিছু হলে নিজের মৃ’ত্যুই শ্রেয় মনে করব।”

নয়নতাঁরা আর বাঁধা দিল না। যাক না! এই প্রথম তার ভাই জীবনে কাউকে এতোটা ভালোবেসেছে। কোনো নারী তার মনটা চুরি করতে সক্ষম হয়েছে। সর্বস্ব দিয়ে আগলে রাখার প্রতিশ্রুতি করেছে নিজেকে। সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে তো হবেই।

ফোনটা সুইচ অফ করে সিঁড়ির নিচে নেমে এলো রূপাঞ্জনা। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“সো স্যাড নির্জন আহমেদ কোহিনূর! রং নম্বরে কল না করলেও রং পারসনের কাছে কল এসেছে।”

“কী বিড়বিড় করছো?”

অভিরূপের কণ্ঠস্বরে কিছুটা হকচকিয়ে তাকায় রূপা। মাথা নাড়িয়ে জানায় কিছু না। নদীর হিম করা বাতাসে চোখ বন্ধ হয়ে আসে তার। তৎক্ষনাৎ অভিরূপ তার হাতে থাকা ঝালমুড়ি এগিয়ে দিয়ে বলে,
“চলো! খেতে খেতে নৌকা ভ্রমণ করব আজ।”

ঝালমুড়ির দিকে তাকিয়ে চোখ সরু করল রূপাঞ্জনা। লোকটা আবারও স্ট্রিটফুড কিনেছে? সহ্য হবে তো? অবশ্য সে কেন এতো ভাবছে। যা ইচ্ছে তাই হক। তবুও কথা দমাতে না পেরে সে বলল,
“এটাও কিন্তু ঝালের জিনিস।”

অভিরূপ ঝালমুড়ি মুখে দিয়ে বলে,
“আই ডোন্ট কেয়ার। সঙ্গে মিষ্টি মূহুর্ত, মিষ্টি বাতাস আর একটা মিষ্টি মানুষ থাকলে ঝাল নিজে নিজেই পালিয়ে যাবে।”

হতবিহ্বল হলো রূপাঞ্জনা এবার। কান দুটো কেমন যেন গরম হচ্ছে। পুরো দেহ জুড়ে উত্তেজনা ছোটাছুটি করছে। অভিরূপ কি তাকে মিষ্টি মানুষ বলে সম্মোধন করল? সে মিষ্টি? অতঃপর তার মনে হলো সে মিষ্টি নয়। রাগিনী মিষ্টি। আর অভিরূপ তো তাকে রাগিনী ভেবেই কথা বলছে নিশ্চয়। না চাইতেও ভারাক্রান্ত হলো মন। মনের মতিগতি কিছুই বুঝে উঠতে পারল না রূপাঞ্জনা। তখনি অভিরূপ ইশারা করল নৌকার দিকে। ছোট্ট নৌকায় পা বাড়িয়ে উঠে পড়ল রূপাঞ্জনা। পেছন ডাক শুনতে পেল,
“আমাকে ধরো!”

পিছু তাকিয়ে রূপা দেখল ভয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে একটা পা নৌকায় বাড়িয়েছে অভিরূপ। লোকটা পারবেও না ছাড়বেও না। না পেরে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিল রূপাঞ্জনা। টেনে তুলে নিল তাকে। নৌকা চলল নিজ গতিতে। রূপাঞ্জনার দেখে দেখে অভিরূপও বসে পড়ল নৌকায়। প্রথমে কেমন যেন লাগছিল তার বসতে। তবে সংকোচ বোধ কাটল তার। গালে হাত দিয়ে চেয়ে রইল একমনে সেই নেত্রপল্লবের দিকে যা সবসময় গভীর নেশায় অভিরূপকে টানে। কী আছে ওই দৃষ্টিতে?

হঠাৎ করেই রূপা পা নৌকার নিচে পানিতে দুলিয়ে বসতেই দৃষ্টি ভড়কালো অভিরূপের। আর বলল,
“আরে! পড়ে যাবে তো।”

রূপা স্পষ্ট গলায় জবাব দিল,
“কখনো দেখেছেন পানি দুলিয়ে বসলে পড়ে যায়। এভাবে মজা লাগে।”

“সত্যি?”

রূপাঞ্জনা আর জবাব দেয় না। আবারও ঘড়ির দিকে তাকায়। বুকটা এই প্রথম দুরুদুরু করছে তার। পা দুলিয়ে দুলিয়ে শীতল পানিতে শান্ত করতে চাইছে মন। তখনি দেখল অভিরূপও তার পাশ ঘেঁষে সাহস করে পা নিচে দুলিয়ে দিয়ে ঠান্ডা পানির স্পর্শ পেতেই হেঁসে দিল। যেন কোনো বাচ্চা তার পছন্দের খেলনা পেয়ে মুখ ভর্তি হাসছে। অভিরূপ উচ্ছ্বাসের সাথে বলল,
“দারুণ তো! কিন্তু নৌকা একটু টলমল করছে। মনে হচ্ছে পড়ে যাব।”

“সাঁতার জানেন না?”

“জানি তবুও।”

রূপাঞ্জনা বিড়বিড় করে বলে,
“ভীতুর ডিম!”

অতঃপর নীরবতা। অভিরূপের ইচ্ছে করে আরো কথা বলতে। সারাদিন যদি কথা বলতে পারে, পাশাপাশি বসে থাকতে পারে তবুও তার কোনো অভিযোগ থাকবে না। ঢক গিলে অভিরূপ বলে,
“তোমার অনেক সাহস তাই না?”

ঘাড় ঘুরিয়ে গোল গোল চোখে তাকায় রূপাঞ্জনা। হঠাৎ এই প্রশ্ন করছে কেন লোকটা? রূপাঞ্জনা জিজ্ঞেস করে,
“কেন?”

“কেন মানে? সেদিন ওতো টে’রোরিস্টের সামনে একটা বাচ্চাকে বাঁচালে। আবার ওইদিন রাতে এতোগুলো ছেলেকে পি’টিয়ে সোজা করে দিলে। তাই বলছিলাম। তোমার মতো সাহস যদি সবাই ভালো কাজে লাগাতো।”

রূপাঞ্জনার মুখের রঙ পাল্টালো। ভালো কাজ? লোকটার তো ধারণাও নেই সে যা যা করেছে সবটাই নিজের স্বার্থে। রূপাঞ্জনা জবাব দিল না। খুঁজে পেল না কোনো শব্দ। অভিরূপ আবারও বলল,
“তোমাদের এখানে নাকি একটা টেরো’রিস্ট টিম এসেছে। যাদের কাজ শুধু জনগনের মনে সংশয় তৈরি করা। তারা ভয় দেখাতে কী মজা পায় আমি জানি না। তাদেরও কিন্তু অদম্য সাহস আছে। সাহসটাকে তারা কাজে লাগায় না। আরেকটা কথা! মানুষের প্রা’ণ নেওয়ার চেয়ে কারোর প্রাণ বাঁচানোর মধ্যে যে কী আনন্দ তারা যদি একবার জানতো তবে আর জীবনেও কারোর প্রা’ণ নেওয়ার চেষ্টাও করতো না।”

চকিতে তাকালো রূপাঞ্জনা। মনে একটাই প্রশ্ন এলো। সত্যিই বুঝি কাউকে বাঁচাতে আনন্দ লাগে? সুখ লাগে? শান্তি লাগে? সে তো কখনো কাউকে যেচে বাঁচাতে যায়নি। তাই এই আনন্দ বুঝি কখনোই পায়নি। অভিরূপ থামে না। একনাগাড়ে বলে,
“আমার বাবা একজন ডক্টর। উনি যেদিন সার্জারি করে সাকসেসফুল হন সেদিন উনার মুখের হাসি ধরে না। বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে আসেন খুশিতে।”

রূপাঞ্জনা ঢক গিলে ব্যাগের দিকে তাকায়। হাতে আর মাত্র কিছু মিনিট। হয় তাকে ব্যাগ রেখে নদীতে ঝাপ দিতে হবে। নয়ত অভিরূপের সাথে ম’রতে হবে। আরো একটা পথ খোলা আছে। সেটা এই ব্যাগটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া। লোকটাকে কি তবে বাঁচিয়ে নেওয়া উচিত? যে তাকে কোনোকিছুর পরোয়া না করে সেই রাতে আগলে নিলো তাকেই কিনা হৃদয়হীনার মতো মা’রবে রূপা? এটা কি ঠিক হচ্ছে? আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে চোখমুখ অন্ধকার হয়ে এলো তার। মনে জাগলো তৃষ্ণা। কাউকে বাঁচিয়ে কেমন আনন্দ পাওয়া যায় সেটা অনুভব করার তৃষ্ণা। দুটো বড় বড় শ্বাস ফেলল সে। ঘড়ির দিকে আবারও চাইলো। অনেক সময় পেরিয়ে গিয়েছে। একবার অভিরূপের দিকে তাকালো সে। ঝাঁকড়া চুলগুলো আনন্দিত হয়ে উড়ছে যেন। রূপাঞ্জনা দম নিয়ে নিজের হাতের ব্যাগটা দুলাতে থাকল। মনে মনে বলল, ‘সরি ডার্ক ম্যাক্স। এই প্রথম আমি চাই হেরে যেতে। যে আমায় সুন্দর রাখতে নিজের প্রাণের পরোয়া করেনি তার সুন্দর চেহারা বিভৎস অবস্থায় আমি দেখতে পারব না।’

ব্যাগটা দুলাতে দুলাতে ফেলে দিল হুট করে। ফেলে দিতেই চমকে উঠল অভিরূপ।
“আরে কী করলে? ব্যাগটা পড়ে গেল তো।”

রূপাঞ্জনা নির্লিপ্তে উত্তর দিল,
“যাক। মামা, আপনি নৌকা ঘুরান। সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে। আমি আর এখানে থাকতে চাই না।”
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪১

চেয়ারে সোজা হয়ে বসে থাকা নির্জন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে সাহানার দিকে। মাথার উপরে ঝুলতে থাকা লাইট কমলা রঙের আলো ছড়াচ্ছে। সেই আলোয় দৃশ্যমান হচ্ছে সাহানার হালকা চামড়া জড়িয়ে যাওয়া মুখ। বয়সটা এই মহিলার কম নয়। তবুও এতো বড় ক্রা’ইমের সঙ্গে যুক্ত থাকতে তার বাঁধেনি। সাহানার ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা র’ক্ত থুঁতনিতে এসে থামে। কপালটা ফোলা। গুছিয়ে করা খোঁপা এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। পুরোটাই বি’ধ্বস্ত অবস্থা। হবে না-ই বা কেন? সরাসরি রি’মান্ডে নেওয়া হয়েছে তাকে। লেডি পুলিশ তাকে উত্তম’মধ্যম ইতিমধ্যে দিয়ে ফেলেছে। এখনো লা’ঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নির্জনের পাশেই। ব্যস…নির্জনের শুধু একটা ইশারা চাই আর আবারও শুরু হবে ধো’লাই। নির্জন অন্য কোনোরকম কথা না বলে সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
“রাগিনী কোথায়?”

সাহানা জবাব দিল না। টলমল চোখে চেয়ে রইল। নির্জনের ধৈর্য ভাঙ্গছে এবার। তবুও নিজেকে দমিয়ে চুপ রইল। সাহানা আগের মতোই নির্বিকার রইল। মাথা ঘুরছে তার। এটা কি এই ধোলা’ইয়ের সাইড ইফেক্ট? নাকি অন্যকিছু? নির্জন প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করল,
“কার জন্য কাজ করছেন? কেন করছেন? কে আপনাকে রাগিনীর বাড়িতে পাঠিয়েছে? আপনাদের বস কে?”

“ব…বলব না।”

বেশ কিছুক্ষণ পর মহিলাটি জবান খুললেও এমন উত্তর শুনে মনে হলো যেন নীরবতায় ভালো ছিল। রাগ চাপাতে না পেরে চেয়ারের হাতলে নিজেই আ’ঘাত করে বসল নির্জন। তার পাশে থাকা লেডি পুলিশ রাগি চোখে সাহানার দিকে এগোতেই সাহানা ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে যখন পিছিয়ে গেল তখনই নির্জন অদ্ভুত কিছু একটা লক্ষ্য করে সেই লেডি পুলিশকে ইশারায় থামিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে। মহিলাটি কেমন যেন কাঁপছে। সময়ের সাথে কাঁপুনি বাড়ছে তার। উঠে দাঁড়াল নির্জন। ভ্রু কুঁচকে ভারাক্রান্ত হয়ে বলল,
“এটা কী হচ্ছে উনার? কোনো থেরাপি দেওয়া হয়েছিল নাকি?”

“এখনো অবধি না। বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে।”

লেডি পুলিশের মুখ থেকে কথা শেষ হতে না হতে গড়গড় করে ব’মি করে দিলেন সাহানা। চমকে উঠল নির্জন সঙ্গে লেডি পুলিশ। অস্থিরতা সামলাতে না পেরে নির্জন চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,
“হোয়াট দ্যা…! হোয়াট হ্যাপেন টু হার?”

আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ল সাহানার পুরো দেহ। কেমন যেন শেষ বারের মতো ঝাঁকুনি দিলেন। অতঃপর দৃষ্টি স্থির হলো তার। আর নড়াচড়া করল না। নির্জন হতবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে কোনোভাবে দ্রুত এগিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে নিচু হয়ে মহিলার নাকের সামনে নিজের আঙ্গুল ধরল। গরম নিঃশ্বাস পড়ছে না। নির্জনের মনের মাঝে হওয়া ছটফটানি বাড়ল। দ্রুত সাহানার বাম হাত চেপে ধরে পার্লস পরীক্ষা করতেই হতবিহ্বল হয়ে থেমে থেমে বলল,
“সী ইজ ডে’ড!”

মাথায় আপনা-আপনি হাত চলে গেল নির্জনের। শক্ত করে চেপে ধরল নিজের চুলগুলো। অসহ্য লাগছে এবার। মনে যে ঝড় উঠেছে সেটা থামানোর উপায়টাও হাতছাড়া হলো তার। কানে এলো রায়ানের কণ্ঠ।
“কী হয়েছে, অফিসার নির্জন?”

এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকাল নির্জন। হার হিম করা সুরে বলল,
“ডোন্ট নো। তাকে জিজ্ঞেসাবাদ করা হচ্ছিল হঠাৎ তার অদ্ভুত সিম্পটম চোখে পড়ল। আর কিছু বুঝে উঠার আগেই…”

“বাট হাউ ইজ ইট পসিবল?”

নির্জন এবার চুপ রইল। রায়ান তাকাল একবার সাহানার দিকে। বমি দেখে বোঝা গেল সমস্যাটা বি’ষক্রিয়া ধরনের হবেই। তবে সিউর বলা যাচ্ছে না। সে একটা কনস্টেবলকে ডেকে বলল,
“ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করো বডিটাকে। দ্রুত আইডেন্টিটিফাই করতে হবে।”

কনস্টেবল মাথা ঝাঁকাতেই একটা কথা মাথায় এলো রায়ানের। ফট করে বলে বসল,
“অফিসার নির্জন, একটা কথা খেয়াল করেছেন? আমি বলেছিলাম অভিরূপ চৌধুরী দেশে আসার পর যেই টেরো’রিস্টি অ্যা’টাক হয় সেখানে যাকে যাকে আট’ক করা হয় তারাও ঠিক এভাবেই মা’রা যায়? আর তাদের পো’স্টম’র্টেম রিপোর্টে এসেছিল তাদের মৃ’ত্যু রা’ইসিন নামক একটা কেমিক্যালের জন্য। যেটা তাদের শরীরে খুবই অল্প পরিমাণে ছিল।”

নির্জন চুপ থেকে কিছুটা পরে উত্তর দিল,
“ইয়াপ! বাট আই হ্যাভ নো টাইম। এই মহিলার মৃ’ত্যুর রহস্য খুঁজে বের করার সময় নেই আমার হাতে। রাগিনীকে খুঁজে বের করা প্রয়োজন ইন্সপেক্টর রায়ান। ইটস অলরেডি লেট।”

নির্জনের কণ্ঠে এক অন্য ব্যাকুলতা ধরা দিল। রায়ানের বুঝতে সময় লাগল না এই পুরুষের এক অন্য দুর্বলতা সেই ঝামে’লায় জড়ানো নারীর প্রতি। মেহরাজের আগমন ঘটে তৎক্ষনাৎ।
“স্যার, রাগিনী ম্যাডামের ফোনের লাস্ট লোকেশন উনার বাড়িতেই। লোকেশন ট্র্যাক করে প্রথমে মাওয়া ঘাটে গিয়েছিল পুলিশ ফোর্স। বাট লোকেশনটা স্থির ছিল না। শেষমেশ শেষমেশ রাগিনী ম্যাডামের বাড়িতে লোকেশন ট্র্যাক করা হয়েছে। অভিরূপ চৌধুরীর ফোনের লোকেশনও এক।”

নির্জন একটু চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সাহানার মেলে রাখা চোখের দিলে। প্রা’ণ চলে গিয়েছে অনেকক্ষণ। তবে চোখটা খোলা এখনো অবধি। নির্জন গমগমে সুরে বলল,
“ওয়েট আ মিনিট! আই থিংক রাগিনীকে তার বাড়িতেই রাখা হয়েছিল। কারণ ওটাই একমাত্র জায়গা যেখানে কোনো প্রবলেম হলেও কেউ ধরতে পারবে না। ওখানে রাগিনী থাকবে সেটা কারোর মাথাতে আসবে না। সবাই সবখানে খুঁজবে শুধু তার বাড়ি ছাড়া। উই হ্যাভ টু সার্চ দেয়ার। মেহরাজ, গাড়ি বের করো। আমি যাব সেখানে।”

“বাট স্যার, কেউ জানে না আপনি কে! মি. শাহ্ রাশেদ আপনাকে এখনো মেন্টাল পেশেন্ট হিসেবে চেনে। ওখানে সার্চ করতে গেলে আপনার পরিচয়টা জানাতে হবে যে!”

মেহরাজের কথার প্রতিত্তোরে রায়ান গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল,
“আমি যাচ্ছি। নো প্রবলেম।”

নির্জন বাধ সাধে। নিজের কোটের কলার ঠিকঠাক করতে করতে বলে,
“নো নিড। বাড়ি সার্চ করতে গেলে যা করতে হয় আমি করব। যদি প্রয়োজন পড়ে নিজেকে সামনে নিয়ে আসব। চোর পুলিশ অনেক খেলেছি। এই সমস্ত প্রবলেম ক্রিয়েট আমার দ্বারা হয়েছে। আমি যদি আরো কিছুদিন আগে রাগিনীকে সমস্তটা জানাতাম সে কেয়ারফুল থাকত। মেহরাজ দেরি করো না।”
মেহরাজ আগে বেরিয়ে যায়। পিছু পিছু রায়ানের পাশ কাটিয়ে যায় নির্জন।

কাঠগোলাপের গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে নির্জন। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। আকাশে জ্বলছে মিটমিটিয়ে তাঁরা। সুন্দর ব্যাপার হলো জোনাকিরাও যেন এই গাছে ভীড় করে। লাইট জ্বালানো হলো। মৃদু বাতাস স্পর্শ করল নির্জনের সর্বাঙ্গ। লাইট জ্বালাতে বিরক্ত হলো কিছুটা নির্জন। অন্ধকারের নিস্তব্ধতায় সেই জোনাকির খেলাতে অন্যরকম মুগ্ধতা ছিল। শুধুমাত্র পাশে প্রয়োজনবোধ করছিল সেই রাগিনী নামক নারীর। মনে মনে নির্জন আওড়ালো, ‘একসময় তোমায় আমার প্রয়োজন ছিল রাগিনী তাজরীন! কেইসের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় ছিলে তুমি। কিন্তু আজ আমি বুঝি, তুমি আমার সারাজীবনের জন্য প্রয়োজন। আমার প্রতিটা মূহুর্ত সুন্দর করে তুলতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’

“স্যার, এখানে তো তেমন কিছুই নেই।”

ধ্যান ভাঙল নির্জনের। মেহরাজের কথায় আশেপাশে তাকাল। আসলেই কিছু নেই। সে সোজা উত্তর দিল এবার।
“অবশ্যই এখানে ফেলে রাখবে না রাগিনীকে। ওই লোকটা কোথায়? কী যেন নাম! বাড়ি পাহাড়া দেয়। মি. সায়েদুল?”

সায়েদুল ধীর পায়ে এসে দাঁড়াল। গোলগোল আঁখিদুটিতে ধরা পড়ল নির্জনের ফর্মাল লুক। তবে মুখভঙ্গিটা বেশ অস্থির। এখনো তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না যাকে একদিন পাগল বলে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই পাগলটা সাহেব রূপে তার সামনে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে। যখন নির্জনের গাড়িটা এসে থেমেছিল তখন তাকে দেখেই প্রথমে বিশ্বাসই করতে চান নি সে একজন পুলিশ টিমের কেউ। অতঃপর নির্জন না পেরে নিজের আইডি কার্ড দেখায় তাকে। তারপর নিজেই নিজের কপাল চাপড়ানোর অবস্থা হয় তার।

“বাড়িতে কেউ নেই?”

নির্জনের শান্ত প্রশ্নে সায়েদুল হকচকিয়ে উত্তর দিলেন,
“না। সৈয়দ ছাড়া বাড়িতে কেউ নাই। রাশেদ স্যার তো চেম্বারে। আর যারে নিয়ে এতো মাতামাতি সে গেছে কনসার্টে। আমি তো রাগিনী মারে সচক্ষে দেখলাম। রিকশা থেকে নামলো। আমার সামনে দিয়া গেট দিয়া ঢুকলো। কিন্তু তারপর কই উধাও হইলো বাড়ি থেকে?”

“যে রাগিনী নয় সে তো উধাও হবেই। যাকে দেখেছেন সে রাগিনী নয়। পালিয়ে গিয়েছে। কিন্তু একটা জিনিস কিছুতেই মাথায় আসলো না যে ওই মেয়েটা অভিরূপের ক্ষ’তি করতে পারল না কেন? এত সময় পেয়েছে সে। তাও অভিরূপকে আ’ক্রমণ করার চেষ্টা করল না?”

সায়েদুল চকিতে তাকাল। উনার মস্তিষ্কে কিছুই ঢুকছে না। হুবহু রাগিনীকে দেখেছেন তিনি এটা নিশ্চিত। রাগিনীর মুখ চিনতে সে ভুল করবেই না তাও কেন এই কথা?
“আচ্ছা, এই বাড়িতে গ্যারেজ, স্টোররুম বাদে কোনো রুম নেই যেখানে মানুষের যাওয়াআসা কম থাকে? বা তালাবদ্ধ থাকে?”

সায়েদুল খানিকটা ভাবলো। তার চুপ থাকা বাড়িয়ে দিল নির্জনের মনের চাঞ্চল্যতা। একে তো শান্ত থাকা সম্ভব হচ্ছে না তার উপর এত সময় নিলে কী চলে? এভাবে করে যেন দম বন্ধ হয়ে কখন যেন মাটিতে লু’টিয়ে পড়বে সে! রাত বাড়ার সঙ্গে বোধহয় জ্বরের মাত্রা বেড়েছে। দাঁড়িয়ে থাকতে প্রয়োজন হচ্ছে শক্তি। সারা শরীরে যেন ধরেছে ভঙ্গুর। মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠলে কাঠগোলাপের গাছটায় হাত রাখে সে। চোখটা বন্ধ করে নেয়। মেহরাজ সঙ্গে সঙ্গে এসে তাকে ধরে। আর চিন্তিত হয়ে বলে,
“স্যার, আপনার হাতটাই তো ভীষণ গরম। টেম্পারেচার অনেক হবে। শরীর তো খারাপ হচ্ছে আপনার।”

“হক। আই ডোন্ট কেয়ার। আমি শুধু রাগিনীর খোঁজ চাই। হোয়ার ইজ সী?”

গলার কণ্ঠস্বর ভেঙে এলেও তেজ এখনো স্পষ্ট। ইতিমধ্যে নির্জনের কর্ণকুহরে আসে সায়েদুলের মিনমিন করে বলা কথাগুলো।
“একটু সামনে গিয়ে ঘুরে গ্যারেজের পাশে একটা ছোট্ট চিলেকোঠার মতো ঘর আছে বাহিরের সিঁড়ির সাথে লাগানো। ওখানে বাড়ির পুরোনো নষ্ট গাড়ি অনেকদিন ধরে পড়ে আছে। কেউ যায় না ওইদিক।”

নির্জনের টনক নড়ে। হাতটা গাছ থেকে সরিয়ে কাঠকাঠ গলায় বলে,
“নিয়ে চলো।”

চিলেকোঠার তালাটা বেশ পুরোনো। তালাটার চাবি খুলতে গিয়ে সায়েদুল দেখল তালাটা আগের থেকেই খোলা। অর্থাৎ ভাঙা। ভড়কে গিয়ে নির্জন আর তার টিমের দিকে তাকাল সায়েদুল। ভ্রু কুঁচকে তালায় হাত দিয়ে সেটা দ্রুত ফে’লে দিল মাটিতে। কারোর প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করার সময় নেই তার। তালা ভাঙা দেখেই সে বুঝে নিয়েছে কোনো গন্ডগোল তো আছেই। হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকতেই ধুলোবালির রেশ এসে নাকে সরাসরি নাকে। ভেতরটা অন্ধকার পুরোটাই। চোখ দিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। নির্জন দ্রুত পকেট হাতিয়ে ফোনটা বের করে ফ্লাশ জ্বালায়। পেছনে মেহরাজও একই কাজ করে নির্জনের পিছু পিছু হাঁটে। সামনে দেখা যায় একটা গাড়ি। বেশ পুরোনো মডেল। গাড়ির ভেতরটা দেখার চেষ্টা করল নির্জন। লাভ হলো না। হতাশ মনে এলোমেলো পায়ের ধাপ ফেলতেই মাথাটা টলমল করতে থাকল তার। কয়েকবার কাশি দিয়ে উঠল। গাড়ির পেছনে আলো ধরতেই চকচক করে উঠল কিছু একটা। ভালো করে লক্ষ্য করতেই বুঝল ওটা একটা সাদা রঙের ঘড়ি। একটা মেয়েলি চিকন হাতটা দেখেই বুকটা ধক করে উঠল নির্জনের। অস্থিরতা, অসুস্থতায় ঠিক রাখতে পারল না নিজেকে। সবটা এলোমেলো হয়ে গেল। ব্যস্ত পায়ে ছুটল গাড়ির পেছনটা। কাঙ্ক্ষিত স্থানে দাঁড়িয়ে আলো ধরতেই চোখ বুঁজে রাখা ঘর্মাক্ত সেই মুখশ্রীর দেখা পেয়ে যেন অনেকক্ষণ পর দম নিতে পারল নির্জন। গলা কা’টা মুরগীর ন্যায় ছটফট করতে থাকা প্রা’ণটা যেন স্বস্তি পেল। খুঁজে পেল প্রশান্তি। তবে মেয়েটার চোখ বন্ধ কেন? হুড়মুড়িয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে সবার আগে নাকের কাছে নিজের আঙ্গুল রাখতেই নির্জন অনুভব করল গরম শ্বাস। তার শ্বাসে মিলল শান্তি। সর্বপ্রথমেই বড় শ্বাস নিয়ে নিজের শান্তিটা ভালোমতো অনুভব করল নির্জন। তবে রাগিনীর এমন করুণ অবস্থা দেখে মস্তিষ্কে যেন উঠে গেল র’ক্ত। মুখটা কী শক্ত করেই না বেঁধে দিয়েছে! সেই সঙ্গে হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। ফোন হাত থেকে নামিয়ে দ্রুততার সাথে প্রথমে হাত তারপর পায়ের দড়ি খুলে জ্ঞান হারা রাগিনীকে তুলে কোনো কিছু না ভেবেই নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিল নির্জন। যতটুকু তৃষ্ণা বাকি ছিল তা পুরোটাই যেন পরিপূর্ণ হলো তার। সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ল উষ্ণতা! একহাতে রাগিনীর মাথা চেপে ধরে অন্যহাতে মুখে বাঁধা রুমালটা খুলে ছুঁড়ে মা’রল সে। এরপর দেরি করল না আর। সামলে উঠতে পারল না নিজেকে। মাথা এবং কপালে নিজের শুষ্ক ঠোঁটের স্পর্শ লাগালো লাগামহীনভাবে। কিছুটা দূরেই যে মেহরাজ দাঁড়িয়ে তার কোনো হুঁশ নেই নির্জনের। তবে মেহরাজের চোখে পড়েনি এখনো কিছু। নির্জনকে চুপ দেখে এবার দুইধাপ এগিয়ে দেখতেই যেতে যেতে বলল,
“স্যার, রাগিনী ম্যাডামকে পেয়েছেন নাকি?”

গাড়ির পেছনটাই চোখ যেতেই রোবটের মতো স্থির হলো মেহরাজ। বারংবার চোখের পলক ফেলে ঢক গিলতেই কাশি বেরিয়ে এলো ভুলক্রমে। এতক্ষণ নিজের ঠোঁটের ছোঁয়া দিতে ব্যতিব্যস্ত থাকা নির্জন চোখ গরম করে তাকাল। ফ্লাশ লাইটে মেহরাজের মনে হলো যেন স্বয়ং বাঘমামা তাকিয়ে। নির্জন যান্ত্রিক গলায় বলল,
“কী হয়েছে? ডিস্টার্ব করছো কেন? আশ্চর্য!”

মেহরাজ কী বলবে ভেবে পায় না। বেতাল হয়ে বলল,
“স…স্যরি স্যার।”

নিজের চোখে হাত রাখে মেহরাজ। পেছনদিকে হাঁটা শুরু করে। নিজের টিমের কাছে এসে শুকনো মুখে তাকাতেই তার টিমের একজন জিজ্ঞেস করে,
“কী হলো? ভেতরে কেউ নেই? আমরা সার্চ করি? কিছু পেলেও পেতে পারি।”

বলে সামনে এগিয়ে হাঁটতে উদ্যত হতেই মেহরাজ ধমক দিয়ে বলল,
“ওতো গভীরে যাওয়ার দরকার নেই। সার্চ করতে গেলে এখন কেউটে বেরিয়ে পড়বে জানো তো?”

“কেউটে? কী বলছেন আপনি?”

মেহরাজ বিরক্ত হয়ে জবাব দেয়,
“আরে ধুর! কাবাবে এত হাড্ডি হলে কাবাব খাবে কেমনে? তোমরা তো সবগুলা হাড্ডি। তার থেকে মাংস আর মাংস একত্রে থাক। আমরা বিদায় নিই। চলো তো!”

কারোর কিছুই বোধগম্য হলো না। তার আগেই মেহরাজ তাদেরকে ঠেলে বের করল সেখান থেকে। পারলে যেন দরজাটাও লাগিয়ে দিতো। কিন্তু আবার যদি নির্জন রেগে যায়? তার থেকে থাক সেভাবে।

“রাগিনী! এই রাগিনী!”

অবচেতন রাগিনীকে বারংবার নিচু সুরে ডেকে চলেছে নির্জন। কিন্তু রাগিনীর কোনো সাড়াশব্দ নেই। মেয়েটার গালে দাগ পড়ে গিয়েছে শক্ত করে রুমাল বাঁধায়। গালের দুপাশটা বসে গিয়েছে। ঘর্মাক্ত কপাল বৃদ্ধা আঙ্গুলি দিয়ে সুন্দর মতো মুছে দিল নির্জন। চুলে আলতো করে হাত বুলালো। তারপর হাতটা এলো গালে। মেয়েটার জ্ঞান ফিরছে না কেন? কী করেছে তারা ওর সাথে? সেন্সলেস রাগিনীর সাথে নির্জন আনমনেই কথা বলা শুরু করল।
“আমার জ্বর, আমার অসুস্থতার, আমার দুর্বলতার একটাই প্রতিষেধক তৈরি হয়েছে পৃথিবীতে। সে হলো রাগিনী তাজরীন।”

নির্জন থামে ভাঙা গলায় কেঁপে কেঁপে বলে,
“একবার বিরক্ত হয়ে আমার তাকাও। সেই চাহনি কতক্ষণ ধরে দেখি না। তোমার নিস্তব্ধতা আমায় জ্বালিয়ে মা’রছে এবার রাগের রানী। প্লিজ ওপেন ইউর আইস।”

নির্জন সযত্নে হাত বুলায় রাগিনীর দাগ পড়ে যাওয়া হাতে। আস্তে করে চুমু খায় সেই জায়গায়। ঠোঁটের কাছেই ধরে বিড়বিড়িয়ে পাগলের মতো বকে,
“জানি, কোনো নারীকে অবচেতন অবস্থায় চুমু খাওয়া ভয়াবহ অপ’রাধ। কিন্তু কেন জানি না আজ সেই অ’পরাধে অপ’রাধী হতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। করেই ফেলি অপ’রাধ? রাগ করবে? ঠিক আছে! রাগ করলে না হয় আমার নামে কে’ইস করে দিও। তবুও আমি মানছি না কোনো রুলস।”

কথা সম্পূর্ণ হওয়া মাত্র রাগিনীর হাতে পড়ে অগুনতি চুম্বন। হাত ছেড়ে পাগলের ন্যায় তার দুটো গালেও একে দিল গভীর ঠোঁটের পরশ। সর্বশেষ রাগিনীর ঘামে ভেজা ললাটে পড়ল নির্জনের পাগলামির শেষ চিহ্ন। নিশ্চিত রাগিনী জাগ্রত থাকলে গালে কয়েকটা থা’প্পর জুটে যেতো নির্জনের। আর নয়তবা লজ্জামাখা মিইয়ে যাওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে পরিমাপ করার চেষ্টা করতো সেইসব স্পর্শের গভীরতা! মেয়েটা ঘামছে বেশ। না জানি কতক্ষণ ধরে এখানে রয়েছে। নির্জনও আর সময় পেল না। এখানেই নিজের উন্মাদনা দেখানো শুরু করে দিয়েছে? পরক্ষণেই রাগ উঠল নিজের ওপর। দুর্বল শরীরে কোলে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করল রাগিনীকে। কষ্ট হলো কিছুটা। সে তো নিজেই ঠিকঠাক চলতে পারছে না। তবুও বড় দম নিয়ে সবশেষে কোলে নিয়েই ধীর পায়ে হাঁটা ধরল গেটের দিকে। গেটের কাছে আসতেই চোখে পড়ল মেহরাজ সহ সায়েদুল আর তার টিমকে। সবার এমন উটকো চাহনিতে বিব্রত বোধ করল বেশ নির্জন। সেটাও যেন যথেষ্ট ছিল না। তার টিমের একজন না বুঝেই জিজ্ঞেস করে ফেলল,
“স্যার, এতক্ষণ সময় লাগল যে!”

থেমে গিয়ে আবারও মেহরাজকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“মেহরাজ স্যার তো কীসব কাবাব, হাড্ডি, মাংসের কথা বলছিলেন। আমরা বুঝিনি।”

এবার নির্জন নিজের কর্মকান্ডে মাটিতে মিশে যায় এমন অবস্থা হলো। গলা খাঁকারি দিতে দৃষ্টি মেলানোর চেষ্টা করল। মেহরাজও থতমত খেল। ইচ্ছে করল অতিরিক্ত কথা বলা লোকটাকে রা’মধমক দিতে! কিন্তু পারল না। অপরপাশে ঠোঁট কামড়ে নিশ্চুপই রয়ে গেল নির্জন।
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪২

অবচেতন রাগিনীর হাতের পার্লস চেক করছেন ডক্টর। গুমোট সেই চিলেকোঠার ছোট্ট ঘরে থেকে করুণ অবস্থা হয়ে গিয়েছে মেয়েটার। শরীরটা ভিজে গিয়েছে ঘামে। এসির বাতাসে সবে তার লাল আভায় মিশ্রিত মুখশ্রীর বর্ণ মিশতে শুরু করেছে। তবে রুমাল দিয়ে বেঁধে রাখা গালের দাগটা এখনো তেমনই আছে। এতটাই শক্ত করে বাঁধা হয়েছিল তাকে। হাতের দাগটা আরো প্রগাঢ় হয়েছে। কালসিটে পড়ে যাবে বোধহয়। রাগিনীর অন্যপাশে সোজা হয়ে মলিন দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন রাশেদ সাহেব। মুখে কোনো কথা নেই। শুধু দেখছেন নিজের মেয়েকে। বারংবার আফসোস করছেন। নিজেকে মনে মনে দোষারোপ করছেন। কেন উনি বাহিরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন? আর কেনই বা সাহানার সেই কাঁদো কাঁদো মুখ এবং মনগড়া কাহিনী শুনে এ বাড়িতে কাজে রাখলেন! সবই উনার ভুল। তার জন্যই বোধহয় তার একমাত্র আদরের মেয়েটার আজ এই হাল। মেয়েটার কিছু হলে তো উনি শূন্য হয়ে যাবেন। মেয়েটাকে আঁকড়ে ধরেই তো উনার বাঁচা। রাগিনীর কিছু হয়ে গেলে উনি বাঁচবেন কীভাবে? এসব ভেবেই বুকের ভেতরের ব্যথা হচ্ছে তীব্র থেকে তীব্রতর।

নির্জন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাগিনীর বিছানা থেকে খানিকটা দূরে। মাথাটা করে রেখেছে নত। অপলক নেত্রপল্লব শুধু এবং শুধু রাগিনীর দিকে চেয়েই কাটছে। ডক্টর আরো কিছুক্ষণ চেক করে জবান খুলতেই সকলে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাল উনার দিকে।
“আমার মনে হয় না যে শুধু সামান্য ঘুমের ঔষধ বা ক্লোরোফর্ম জাতীয় কিছু দিয়ে ক্ষ্যান্ত থাকা হয়েছে। আরো এমন কিছু রাগিনীর শরীরে প্রবেশ করানো হয়েছে যে তার জ্ঞান ফিরতে আরো সময় লাগবে। হয়ত কোনো ইনজেকশন বা ড্রা’গ জাতীয় কিছু পুশ করা হয়েছে।”

“রাগিনীর সেন্স সত্যিই ফিরবে তো?”

রাশেদ সাহেবের ভয়ে ভয়ে করা প্রশ্নের উত্তরে ডক্টর আবারও ভাবুক হয়ে বললেন,
“আই থিংক সো! ওর পার্লস রেট, হার্টবিট রেট সব ঠিকঠাক আছে। শুধু প্রেশারটা ফল করেছে। এখন আপনি যদি ওকে যেকোনো হসপিটালে নিয়ে যানও তবে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না। তারা রিজন তো জানতে চাইবে। আর বিষয়টা তো সুবিধার নয়। এতে শুধু সবার প্রেশার বাড়বে। অন্য কোনো লাভ হবে না। তার চেয়ে অপেক্ষা করুন। অন্তত সকাল অবধি দেখুন। আর আমি তো বলছি অল ইজ রাইট। রাতের মধ্যেই জ্ঞান এসে যাবে।”

“আপনি সিউর তো ডক্টর?”

নির্জনের উত্তেজনায় বলা কথাগুলো শুনে এবার নির্জনের দিকে এক পলক তাকালেন রাশেদ সাহেব। তার মুখচোখের বিবর্ণ রঙ! চুপসে যাওয়া মুখ দেখে মনে হলো সেও বেশ চিন্তিত। রাশেদ সাহেবের গম্ভীর দৃষ্টি নিজের দিকে দেখে কিছুটা থতমত খেল নির্জন। তবে কিছু বলল না। ডক্টর তার বলা কথার জবাবে বললেন,
“ইয়েস, ওফকোর্স। বলা যায় সে এখন ঘুমোচ্ছে। তাকে বিরক্ত করতে হবে না। যা ওর শরীরে দেওয়া হয়েছে সেটার প্রভাব কাটলেই তার জ্ঞান ফিরে আসবে।”

“থ্যাংক ইউ, ডক্টর।”

উঠে দাঁড়ালেন রাশেদ সাহেব। ডক্টরও যাওয়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরলেন। তাকে এগিয়ে দিতে রাশেদ সাহেবও যেতে লাগলেন। ঘরে রইল শুধু মেহরাজ, নির্জন, সৈয়দ এবং বিছানায় পড়ে থাকা রাগিনী। ঘর খালি হতেই উসখুস করতে শুরু করল মেহরাজ। ফট করেই কিছু একটা ভেবে নির্জন সৈয়দের উদ্দেশ্যে বলল,
“গলা শুঁকিয়ে গিয়েছে। ঠান্ডা পানি হবে?”

চকিতে তাকানো সৈয়দ দ্রুত মাথা নাড়িয়ে প্রস্থান করলেন ঠান্ডা পানি আনার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠল মেহরাজ। নির্জন কড়া গলায় বলল,
“কী সমস্যা? যক্ষ্মা রোগী হওয়ার ইচ্ছে আছে?”

মেহরাজ দ্রুত মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল না নেই তার ইচ্ছে। অতঃপর আবারও আগের ন্যায় নির্জন বলল,
“তোমাকে কি বাহিরে যাওয়ার জন্য আলাদা করে ইনভাইটেশন কার্ড দিতে হবে?”

এবার না বুঝেই মেহরাজ মাথা নাড়িয়ে হালকা হেসে বলে,
“জি স্যার।”
পরক্ষণেই বুঝে উঠতে পেরে হকচকিয়ে উঠে বলল,
“আই মিন না স্যার।”

বলেই দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল মেহরাজ। ঘরে শুধুমাত্র রাগিনী আর নির্জন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত চোখে তাকায় সেই সুদৃঢ় এবং সুদর্শন পুরুষ। আরো একটু একান্তে সময় চাইছিল সে খুব করে। ইচ্ছে ছিল নিজের মনের অনুভূতি উগড়ে দিতে। এজন্যই বোধহয় ঘর ফাঁকা হওয়ার জন্য দুষ্টু পাখির মতো চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল সে। তার যে সাধ মিটছে না। সে ধীর পায়ে গিয়ে বসল রাগিনীর পাশে। ডান হাতটা নিলো নিজের হাতের মুঠোর। হাতটা এখনো গরম রাগিনীর। নির্জন যত্ন করে বুলিয়ে যেতে লাগল মেয়েটার হাতের দাগ পড়া জায়গাটায়। কোমল হাতের কী অবস্থা! রাগিনীর অন্যহাতটাও ধরল নির্জন। দুটো হাত একত্র করে নিজের দাড়ি যুক্ত গালে আলতো করে লাগিয়ে নিলো সে। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“আই এম স্যরি! সব আমার ভুল। আমি সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করে উঠতে পারিনি। নির্জন আহমেদ অনেক বড় একটা কার্লপ্রিট। তুমি কখন জাগবে? জেগে আমাকে শা’স্তি দেবে সেই অপেক্ষায় আছি। তবুও যেন আমাকে দূরে ঠেলে দিও না প্লিজ। তোমার ওই ঘৃণাভরা দৃষ্টি আমার কাছে অসহনীয় হয়ে দাঁড়াবে।”

চোখ বুঁজে রাখা রাগিনীর কাছ থেকে এলো না কোনো উত্তর। সে নির্বিকার যেন। তবুও প্রলাপ বকতে থাকল নির্জন।
“বেশি চেয়ে ফেলছি? কী করবে বলো? আমার ডিমান্ড আগে থেকেই বেশি। একটু বেহায়া টাইপ আমি। সেকারণেই হয়ত বলতে পারছি এতকিছুর পরেও যে তোমার বিষা’ক্ত দৃষ্টি আমার কাছে মোটেও সহ্যকর হবে না। এই বেহায়া লোকটাকে মেনে নিও একটু।”

বলেই হালকা মলিন হাসে নির্জন। এলোমেলো হয়ে যাওয়া রাগিনীর চুল হাত দিয়ে পেছন দিকে ঠেলে দিতে থাকে সে। আনমনে আবারও নিজের মনের চাওয়া থেকে কপালে আস্তে করে চুমু খেয়ে বসে সে। তারপর ভাবে, দিন দিন বুঝি সে সত্যিই লজ্জাহীন হয়ে যাচ্ছে! তবে প্রেয়সীর সামনে লজ্জাহীন হওয়াটা ক্ষতির নয়। এটা তার ব্যক্তিগত মতামত। মনে ঝেঁকে বসা অনুভূতিগুলো খুব করে চায় রাগিনীকে। সবসময় ছুঁয়ে দিতে সুযোগ খুঁজতে থাকে মস্তিষ্ক। আর সুযোগ যেন একটাও হাতছাড়া করতে চায় না সে। আকাশপাতাল চিন্তাভাবনার মাঝে নিজের কপালের সাথে রাগিনীর কপাল লাগিয়ে রাখে সে। রাগিনীর মুখে পড়তে থাকে নির্জনের তপ্ত শ্বাস। আর নির্জনের মুখশ্রীতে চলে আসে মৃদুভাবে রাগিনীর গরম শ্বাস। এমনভাবেই কেটে যায় কিছু মূহুর্ত। নির্জন নিজেই বকবক করে বলে,
“ভাগ্যিস তোমায় খুঁজে পেয়েছি। নয়তবা আর কিছু মূহুর্ত তুমি বিহীন কেটে গেলেই হয়ত আমাকে সত্যি সত্যিই মেন্টাল হসপিটালে জায়গা হতো!”

কথা বলার মাঝে হুট করেই কানে আসে অন্যরকম এক ডাক। তবে নির্জন নড়চড় করল না। সেভাবেই চোখ বুঁজে থাকল। ফট করেই একটা আকস্মিক কান্ড ঘটে গেল। গালে অনুভব করল ভীষণ জ্বলুনি। হুড়মুড়িয়ে সোজা হয়ে গালে হাত দিয়ে বসল সে। চোখ বড় বড় করে তাকাল রাগিনীর পাশেই থাকা ছোট্ট তুলতুলে রিও এর দিকে। রিও যেন তৎক্ষণাৎ চোখ দ্বারা ধম’কানি দিল। সামনের একটা পা তুলে তেড়ে এসে থেমে গেল। চেঁচিয়ে উঠল নিজ ভাষায়। নির্জনের ভাবনায় বিরাজ করল এ আবার কখন এলো? টের তো পেল না। বিড়াল বাচ্চা হলে কী হবে? এর তো দেখা যায় পেটে পেটে শয়তানি! সৈয়দ ও মেহরাজের আগমনে দ্রুত উঠে দাঁড়ায় নির্জন। গালে রয়ে যায় হাত। ভেজা কিছু অনুভব করে। বুঝতে সময় লাগে না র’ক্ত নামক জিনিসটা হাতে ভরেছে। রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রিও এর দিকে। সৈয়দ তড়িঘড়ি করে পানি এনে এগিয়ে দেয় নির্জনের দিকে। অপরদিকে মেহরাজ কিছু বুঝে উঠতে না পেরে সরু চোখে তাকিয়ে তার স্যারের গালে হাত দেওয়ার কারণ বোঝার চেষ্টায় আছে। অতঃপর মেহরাজ রাগিনীর দিকে তাকায়। রাগিনীর জ্ঞান ট্যান ফিরে আবার থাপ্প’র দিয়ে ফেলেছে নাকি? তবে তো মহা সর্ব’নাশ! পরপরই মনে হলো, নাহ। রাগিনী তো এখনো চোখ বন্ধ করেই স্থির হয়ে শুয়ে। তবে ব্যাপার কী?
পানি এগিয়ে দেওয়ার নির্জন এবার কোনোরকমে বলে উঠল,
“লাগবে না, ধন্যবাদ। পানি খাওয়ার শখ আমি মিটে গিয়েছে।”

“দুঃখিত। আসলে ঠান্ডা পানি তো ছিল না। তাই ঠান্ডা পানি তুইলা নিয়ে আসলাম।”

সৈয়দের নিচু সুরে বলা কথাগুলো শুনে নির্জন ফের নম্রভাবে বলার চেষ্টা করল,
“বললাম তো লাগবে না। কষ্ট করে আনার জন্য ধন্যবাদ।”

ব্যস…আর দেরি করে না নির্জন। গালে হাত রেখেই হনহনিয়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে সেখানে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে গালে চেপে ধরে। তীব্রভাবে জ্বলছে। পিচ্চি একটা বিড়াল কিনা আজ তাকে এভাবে খা’মচে দিল তাও আবার শুধুমাত্র রাগিনীর কাছে যাওয়ার জন্য? কী হিংসুটে হয়ে গিয়েছে আজকাল বিড়ালও! ভাবা যায়? রুমালটা জোরে চেপে ধরতেই হাজির হলো মেহরাজ। উত্তেজনার সঙ্গে প্রশ্ন করল,
“স্যার! আপনার কী হয়েছে? গালটা কি খাল হয়ে গিয়েছে?”

“তোমার ননসেন্স কথাবার্তা স্টপ করো। বিড়াল খাম’চে দিয়েছে।”

“সে কী! ওই ছোট্ট ছানার সাহস হলো কী করে আপনাকে খাম’চে দেওয়ার!”

“তার মালকিনের যেমন সাহস হয়েছে আমাকে সার্বক্ষণিক অস্থির রাখার ঠিক তেমন!”

কথাবার্তার মাঝেই ধীর পায়ে এসে উপস্থিত হন রাশেদ সাহেব। উনার গম্ভীর ও বিমূঢ় মুখটা ভেসে ওঠে নির্জনের সামনে। কথোপকথন বন্ধ হলো মেহরাজ ও তার মাঝে। একধ্যানে চেয়ে রইল নির্জন সেই মানুষটির দিকে। রাশেদ সাহেব চশমা ঠিক করে বললেন,
“আপনাদের আর কোনো কাজ আছে এখানে?”

মাথা নাড়ায় নির্জন। অর্থাৎ নেই। রাশেদ সাহেব আবারও আগের কণ্ঠে বললেন,
“তবে আসুন আমার সঙ্গে। আপনাদের সাথে কিছু কথা আছে।”

হাঁটা ধরেন রাশেদ সাহেব। মেহরাজ একবার নির্জনের দিকে চেয়ে নিজেও পিছু পিছু যেতে শুরু করে। রুমালটা গাল থেকে নামিয়ে নেয় নির্জন। সাদা রুমালে খুব একটা বেশি নয় হালকা র’ক্তের ছাপ। খুব একটা বেশি কাটেনি তবে। রুমাল মুড়িয়ে দরজা একটু সরিয়ে জ্ঞানহারা সেই প্রেয়সীর দিকে চেয়ে শেষবারের মতো একবার নিজের দুটো সুদৃঢ় দর্শনেন্দ্রিয়ের তৃষ্ণা ঘুচিয়ে নেয়।

হলরুমে এসে সোফায় বসেন রাশেদ সাহেব। বেশ ভদ্র ভঙ্গিতে ইশারা করে নির্জন ও মেহরাজকেও বসতে বললে তারা বসে যায়। রাশেদ সাহেব দেরি না করে সরাসরি প্রশ্ন করে ওঠেন,
“আমার আমার হসপিটালে এতকিছু হয়ে গেল! অথচ আমাকেই জানানো হলো না কেন? অফিসার নির্জন আপনি রাইট?”

“ইয়েস। কিন্তু কোহিনূরও আমার নামই। সেই নামেই ডাকতে পারেন।”

“তবে বলুন, আমাকে কেন জানানো হলো না? দিনের পর দিন আমার মেয়েটার সঙ্গে এক্টিং করে যাওয়ার কারণটা কি শুধুমাত্র ওই আত’ঙ্কবাদী আমার মেয়ে সেটা সন্দেহ করা?”

নির্জন মাথা দুলিয়ে বলে,
“ইয়েস। আই এম স্যরি ফট দ্যাট। আপনাকে জানানোর কারণ ছিল একটাই। আপনার মেয়ে রাগিনী। আপনি কোনোদিক থেকেই বিশ্বাস করতেন না।”

“হ্যাঁ করতাম না। কারণ আমার মেয়েকে আমার চেয়ে ভালো আর কেউ চেনে না। ও র’ক্ত দেখে অবধি ভয় পায়। অতিরিক্ত শ’ব্দে ওর ফোবিয়া আছে। ও কাউকে অসহায় অবস্থায় দেখতেও পারে না। আর সে কিনা টেরো’রিস্ট?”

“আমাদের কাছে আর অন্য কোনো রাস্তাও ছিল না বিশ্বাস স্যার। আপনি নিজে হয়ত নকল রাগিনীকে দেখেছেন। এত নিখুঁত চেহারায় মিল সবার ভুল হবে।”

রাশেদ সাহেব কিছুটা ক্ষ্যান্ত হলেন এবার। আসলেই তো! ভুলটাও কিছু বলেনি নির্জন। সে তো নকল রাগিনী তাজরীনকে দেখে নিজেই প্রথমে থতমত খেয়ে গিয়েছিল। নিজেকে ধাতস্থ করে জবাব দিলেন,
“ঠিক আছে। আপনার কথা যুক্তিযুক্ত অফিসার। বাট আই ওয়ান্ট ফুল সেফটি ওফ মাই ডটার!”

নির্জন উনাকে আশ্বস্ত করে বলল,
“নির্জন আহমেদ নিজে রাগিনী তাজরীনের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিল।”

“আপনার কাজটা কি শুধুই আমার মেয়ের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করা? আই ডোন্ট থিংক সো!”

রাশেদ সাহেবের কথায় কিছুটা ভ্যাকাচেকা খায় নির্জন। পাশে থাকা শ্রোতা ও নীরব মেহরাজও শূন্য হয়ে চেয়ে রয়েছে। বোঝার আপ্রাণ চেষ্টা করছে রাশেদ সাহেবের বলা কথাটির মর্মার্থ। তৎক্ষনাৎ উনি আবার থমথমে গলায় বলেন,
“আপনার কি আমার মেয়ের প্রতি দুর্বলতা আছে?”

দুটো হাত মুঠো করে ফেলে নির্জন। মুখ নিচু হয়। প্রচন্ড গরম লাগতে শুরু করে মূহুর্তেই। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। এ কেমন প্রশ্ন? এই প্রশ্নের উত্তরে কী বলবে সে বুঝে উঠতে যে পারে না। আর এমন অর্ধবয়স্ক মানুষের সামনে এর জবাব কিই বা দিতে পারে সেটা মস্তিষ্কে খেলে উঠবে না। সে কী করে বলবে, যে সে রাগিনীকে সার্বক্ষণিক নিজের খুব কাছে চায়? হৃদয়ের কপাটে শুধু রাগিনী তাজরীন নামটি লিখে দিয়েছে? এসব বলার আগে বোধহয় এখানেই জ্ঞান হারাতে হবে। রাশেদ সাহেব এতক্ষণ স্থির নয়নে তাকিয়ে ছিলেন নির্জনের দিকে। কিছু বুঝে উঠে বললেন,
“আমি আমার প্রশ্নের জবাব পেয়ে গিয়েছি। জবাবের প্রতিত্তোরে আমি বলব প্লিজ এই বিষয়টার সমাপ্ত এখানেই করুন। বেশি দূর এগোতে যাবেন না। আপনার মনের অনুভূতির ইতি টানুন অফিসার নির্জন।”

নির্জন স্তব্ধ, হতবিহ্বল। কিছু বলার আগেই সরাসরি মানা করাটা যেন বুকে তীরের ন্যায় বিঁ’ধে। কেন রাগিনীর বাবার এই আবদার? কারোর জন্য মনে সুন্দরতম অনুভূতি জন্মানো কি খারাপ?
“এমনিতেই জানি না রাগিনীর সঙ্গে কীসব হচ্ছে। এই একটা কেসেই আমার মেয়েটাকে একেবারে ভেঙে দিয়েছে। আর ও যদি আপনার মতো জীবনসঙ্গীকে পায় যার জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই তবে… ”

কথার মাঝে রাশেদ সাহেব থেমে গেলেন। আর বলতে পারলেন না। উনারও দ্বিধাবোধ হলো বেশ কিছুটা। ইতস্তত বোধ করে আবারও বলা শুরু করলেন,
“হয়তো আপনার কাছে আমার কথাগুলো বোকা বোকা লাগতে পারে। এটা ঠিক যে আপনার মতো মানুষও সংসার করে। তারাও পরিবার গড়ে তোলে। কিন্তু আমি বাবা হিসেবে কিছুটা স্বার্থপর মানুষ। মেয়েটাকে নিয়ে ওভার পজেসিভ। তাই এখানেই সব কিছুর সমাপ্তি ঘটুক। অন্য কাউকে নিয়ে ভাবুন। তবে আমার মেয়ে নয়।”

হুট করেই উঠে দাঁড়ায় নির্জন। তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে আসে। বাহিরে থাকা গুমোট পরিবেশের সঙ্গে মিশে যায়। মুখ দিয়ে কোনোরূপ কথা না বলে দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে যায় সদর দরজা দিয়ে। মেহরাজ নিজেও থমকেছে আজ। একবার রাশেদ সাহেবের দিকে কিছুটা অস্বস্তির দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর সে নিজেও প্রস্থান করে।

ঘরের সব জিনিসপত্র এলোমেলো। কোনো জিনিস ঠিক জায়গাতে নেই। কয়েকটা শোপিচ ভেঙেচুরে পড়ে আছে ফ্লোরে। সেই সঙ্গে সেই ভাঙা জিনিসপত্রের মতোই ফ্লোরে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে আছে রূপাঞ্জনা। অগোছালো চুলগুলোতে মুখ ঢেকে গিয়েছে অর্ধেকটা। বড় বড় শ্বাস ফেলে চলেছে বারংবার। গালটায় পড়েছে পাঁচটা আঙ্গুলের দাগ। টনটন করছে ব্যথায়। আচমকা চুলে টান পড়ায় সে কুঁকড়ে ওঠে। চোখমুখ খিঁচে ধরতেই কুর্ণকুহরে ভেসে আসে ডার্ক ম্যাক্সের গলা।
“শা* বে*ন্মা! আমার কথা অমান্য করার সাহস কে দিল তোকে? সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করলি কেন আজ? মনে কি রঙ লেগেছে?”

চলবে…

[বি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here