গল্প :- গোধূলী বেলায় তুমি
পর্ব :- ০৪
লেখিকা :- তাসনিম রাইসা।
.
.
.
-: আগামী সাতদিন তুমি আমার স্ত্রীর মতো হয়ে থাকবে। যা বলবো তাই করবে। ” ভয় পেয়ো না স্বামীর অধিকার চাইবো না। আর কোনদিন তোমার সামনে এ মুখ নিয়ে দাঁড়াবো না। আর হ্যাঁ আজ অফিস থেকে আসার সময় ডির্ভোস লেটার নিয়ে এসেছি। সাতদিন পর সই করে দিবো। এখন বলো তুমি শর্তে রাজি কি না?”
”আচ্ছা আমি তোমার শর্তে রাজি।”
” তাহলে কাল সকাল থেকে সাতদিন শুরু।
” আচ্ছা, তবে আবারো বলে দিচ্ছি স্বামীর অধিকার তুমি কখনো পাবে না আমার থেকে।”
” রাজ মুচকি হেসে বললো,’ চিন্তা করো না ওসব কিছু করবো না। এখন ঘুমিয়ে যাও। ”
” ফজরের আযানের সময় রাজ, জয়াকে ডেকে দিতেই জয়া বললো,’ আমি নামায পড়বো না আমাকে ঘুমাতে দাও। কেন শুধু শুধু বিরক্ত করো?”
” জয়া ভুলে যেয়ো না এ সাতদিন আমার কথা মতো চলবে। যাও অযু করে আসো। রাজ জয়াকে অযু করতে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেও অযু করে নামায পড়ে নিন।
– সকালে জয়া যখন রান্না করছে, তখন রাজ জয়ার সাথে থেকে হেল্প করে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও জয়া এসব সহ্য করে যায়। আর মনে মনে ভাবে সাতদিনই তো। ”
– এদিকে প্রতিদিনের মতো, ‘ রাজ আজকেও অফিস থেকে আসার সময় বেলী ফুলের মালা নিয়ে এসে নিজ হাতে জয়ার খোঁপায় পরিয়ে দেয়! জয়া না করতে পারে না। ”
– রাতে জয়া আর রাজ ডিনার করতে বসছে। রাজ খেয়াল করলো জয়া খাচ্ছে না। ‘
– এই তুমি খাচ্ছো না কেন?”
– হাত কেটে গেছে দুপুরে ফল কাটতে গিয়ে। ”
– ওহ্ আচ্ছা তাই বুঝি? আচ্ছা হা করো। ”
-না আমি খেতে পারবো। আপনার খাইয়ে দিতে হবে না। ”
– এ সাতদিন কোন কৈফিয়ত শুনতে চাই না। হা করো, জয়া রাজের দিকে চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে আর খাবার খাচ্ছে।”
– তিনদদিন খুব ভালো কাটল। তৃতীয় দিন রাজ অফিসে এমন সময় বৃষ্টি নামল! জয়া ছোটবেলা থেকেই বৃষ্টি পাগল। বৃষ্টি শুরু হলেই, জয়া ছাদে গিয়ে ভিজতে লাগে। প্রায় ঘন্টাখানেক ভিজার পর রুমে এসে কাপড় চেঞ্জ করতেই। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসে যায়!
রাজ বাসায় এসেই দেখে জয়া বিছানায় শুয়ে আছে। জয়াকে দু’বার ডাক দিতেও যখন বিছানা থেকে উঠছিল না তখন মাথায় হাত দিয়ে দেখে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে!
রাজ কি করবে বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ জলপট্টি দিয়ে দেখলো জ্বর কমছে না। তাই আর দেরী না করে রাতেই, হসপিটালে নিয়ে যায়। হসপিটাল দুই দিন রাজ জয়ার পাশেই থাকে। তিনটা দিন এক মুহূর্তের জন্যও রাজ জয়ার চোখের আড়াল হয়নি। জয়াকে খাইয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে মেডিসিন দেওয়া সব করেছে। দুই দিন পর হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরে আসে।
– বাড়ি ফিরার পর রাজ জয়াকে রান্না করতে দেয়নি। এদিকে রাজ রান্না করতে গিয়ে তার হাত পুড়ে ফেলে। এর আগে কোনদিন তো রান্না করেনি সে জন্য। দুপুরে রাজ যখন জয়াকে খাইয়ে দিতে যায়। তখন জয়া খেয়াল করে রাজের ডান হাতে ফুসকা পড়েছে অনেকগুলো। রাজকে জিজ্ঞেস করতেই বলে, ‘ ওই একটু খানি হাত তেলের ছিটা লেগেছিল। ” তুমি কিছু ভেবো না ঠিক হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ তুমি তো গোসল করোনি। আমি পানি তুলে কাপড় রেখে আসছি তুমি গোসল করে আসো। ঠিকমত গোসল না করলে তো শরীর আরো খারাপ লাগবে।
– জয়া গোসল করে বের হতেই রাজ বিছানায় বসিয়ে, জয়ার মাথায় চুল আঁচড়ে তেল লাগিয়ে দেয়। জয়ার এসব সহ্য হয়না কিন্তু সহ্য করা ছাড়া এ মুহূর্তে কোন উপায় নেই। আর কয়েকটা দিনই তো মাত্র!
আর বাকি দু’দিন জয়া এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। এদিকে জয়ার দিনগুলি যেন যাচ্ছে না। আর মাত্র দু’টি দিন তারপরেই সে জারিফ কে পেতে যাচ্ছে! কিন্তু এ দু’টি দিন জয়ার কাছে দু’টি মাসের সমান লাগছে।
– দেখতে দেখতে ছয়দিন চলে যায়। আজকের রাতটা পেরুলেই কাল সকালে অপেক্ষার সাতদিন পূর্ণ হবে। রাজ জয়ার মাথায় হাত বুলাচ্ছে, জয়ার বড্ড রাগ হচ্ছে তবুও কিছু বলছে না। সে নতুন সকালের নতুন একটি সুন্দর ভোরের আশা করছে। যে ভোরে থাকবে না কোন খুনির ছায়া!
– এদিকে রাজ জয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,’ জয়া সত্যিই কি জারিফ আমার চেয়ে তোমাকে বেশি ভালোবাসে?’
– রাজ দেখলো জয়া ঘুমিয়ে গেছে। চাঁদের আলো জানালার কাচ ভেদ করে জয়ার মুখে পড়ছে। এমনিতেই রুপকথার রাজকুমারীর মতো দেখতে জয়া, চাঁদের আলোতে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। রাজের মন চাচ্ছে জয়ার কপালের চুলগুলো সরিয়ে তার কপালে চুমু এঁকে দিতে। কিন্তু না।
– এদিকে জয়ার মাঝরাতে কারো কান্না শুনে ঘুম ভেঙে যায়! জয়া বুঝতে পারে পাশের রুমে কে যেন কাঁদছে। তাড়াহুড়া করে ঘুম থেকে উঠে পাশের রুমে উঁকি দিতেই দেখে রাজ জায়নামাযে বসে মোনাজাত ধরে কান্না করছে আর কি যেন বলছে।
– জয়া, একটু মনোযোগ দিয়ে শুনতে পেল। রাজ বলছে,’ হে আল্লাহ রাত্রি যতই গভীর হয় ততই তোমার দরজা বান্ধার জন্য উন্মুক্ত হয়। তুমি না শেষ রাতে বান্দার ফরিয়াদ শোনার জন্য শেষ আসমানে আসো। ও আল্লাহ আমি আমার প্রিয়তমা স্ত্রীকে তোমার পথে আনার জন্য, চেষ্টা করেছি। হেদায়াত দানের মালিক তুমি। আমি আমার কর্মের জন্য তোমার কাছে তওবা করছি। ও আমার আল্লাহ তুমি জয়াকে আমার জন্য কবুল করে নাও। ” তুমি তো জানো কতটা ভালোবাসি আমি তাকে। তুমি তো সত্যিটাও জানো। ও আল্লাহ জয়াকে আমার করে দাও।”
-জয়ার কাছে রাজের কান্না অসহ্য লাগছে। তাই তাড়াতাড়ি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
– রাজ সারারাত ওভাবেই কাটিয়ে দিল।
– সকাল বেলা ভোরের আলো পড়তেই জয়ার ঘুম ভেঙে যায়! ঘুম ভাঙতেই তার খুব খুশি লাগে। আজ থেকে সে মুক্ত। কিন্তু কোথাও রাজকে দেখতে পাচ্ছে না। রাজ কী তাকে ডির্ভোস দিবে না? হঠাৎ খেয়াল করলো টেবিলের উপর ডির্ভোস পেপার। তার পাশেই একটা চিরকুট। জয়া দেখলো ডির্ভোস পেপারে রাজ সাইন করে দিয়েছে। সাইনটা দেখেই ঈদের চাঁদ দেখার আনন্দ হচ্ছে। ডির্ভোস লেটারের পাশে থাকা চিরকুট খুলে পড়তে শুরু করলো ‘
তোমাকে কি বলে সম্বোধন করবো সে ভাষা আমার জানা নেই,
আজ থেকে তোমার প্রতি আমার কোন অধিকার রইল না। আজ থেকে তুমি মুক্তি। তুমি তো এটাই চেয়েছিলে। আজকের পর থেকে আর কেউ বেলী ফুলের মালা নিয়ে এসে তোমাকে বলবে না ভালোবাসি। বলবে না তোমাকে নীল শাড়িতে অনেক সুন্দর লাগে। আর কেউ তোমাকে জোর করে খাইয়ে দিবে না। আর কেউ হয়তো তোমার জন্য হাত পুড়ে রান্না করবে না। বলবে না নামায পড়তে। জানো খুব করে চেয়েছিলাম জান্নাতে তোমাকে নিয়ে একসাথে থাকতে। জানি তোমার রাত্রে উঠতে কষ্ট হতো, তারপরেও সাতটা দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ানোর চেষ্টা করেছি।
জানো জয়া আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসতাম, তুমি যতক্ষণ আমার পাশে থাকতে মনে হতো পুরো পৃথিবীটাই আমার পাশে। কিন্তু আমি এ জিনিসটা বুঝতাম না জোর করে ভালোবাসা হয় না। তুমি তো আমাকে ভালোবাসতে একটা সময় কলিজা ছাড়া ডাকতেই না। কিন্তু আজ বুঝতে পারলাম তুমি আমাকে ঘৃণা করো প্রচন্ড ঘৃণা করো। আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো জোর করে তোমাকে বিয়ে করার জন্য। আর হ্যাঁ আজকের পর থেকে বিরক্তিটা আর কোনদিন তোমার সামনে আসবে না। ভালো থেকো। আর হ্যাঁ তুমি না বলেছিলে,’ কবুল কবুল কবুল তিনবার বললেই বিয়ে হয় না? ‘ তুমি হয়তো ভুলে গেছো বিয়ে হয় আল্লাহর পবিত্র কালাম পড়ে। আর পবিত্র কালামের একটা বন্ধন থাকে। এ বন্ধনটাই একদিন তোমাকে খুব করে কাঁদাবে।
ভালো থেকো বিরক্তিটা আর তোমার জীবনে আসবে না।
– চিঠি পড়া শেষ হলেই, জয়ার চোখের সামনে তার বোনের সুসাইড করার চেহারাটা ভেসে উঠল। জয়া মনে মনে বললো,’ যাক অবশেষে খুনির হাত থেকে বাঁচলাম।”
– জয়া ডির্ভোস লেটার টা নিয়ে সোজা জারিফের বাসায় চলে যায়। জারিফের রুমের কাছে যেতেই শুনতে পায়,
-আরে কি বলিস ওই বিয়ে করা মেয়েকে আমি আবার বিয়ে করবো? শুনেছি আজ ডির্ভোস নিবে। ভাবছি হোটেলে নিয়ে ব্যবহার করে ছেড়ে দিবো। মেয়েটা সুন্দর তাই একটু বেশিই সময় দিতে হচ্ছে। ”
– আরে দোস্ত তুই একলাই খাবি না কি? আমাদের নিবি না?
– আরে তোরাও আসিস, আগে আমি যাবো তারপর তোরা। আর হোটেল বুক করার টাকা কিন্তু তুই দিবি।”
-জারিফের কথা শুনে জয়ার পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। জারিফ তাকে নয় তার শরীরটাকে ভালোবাসে। জয়া জারিফের সাথে কথা না বলেই তার বাসা থেকে বের হয়ে যায়। বাসা থেকে বের হতেই ফোনটা ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠে,’ ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা মেয়ে বলে, ‘ আপু আপনি একটু ইবনেসিনা হসপিটালে দেখা করেন। ”
– জয়া হসপিটালে গেলে নার্স একটা রোগীর সামনে নিয়ে যায়। বিছানায় শুয়ে আছে মুখে অক্সিজেন মাক্স থাকা সত্ত্বেও লোকটাকে চিনতে ভুল হয় না জয়ার এটা আপুর ফেন্ড হাবীব!
– জয়াকে দেখেই হাবীব বললো,’ আমি আর বাঁচবো না হয়ত। তাই সত্যিটা বলে যেতে চাই। তোমার আপু সুসাইড করিনি, আমি ধর্ষণ করে মেরেছি। ”
.
.
চলবে………………….♥♥♥
.