#ঘুণপোকা
#পর্ব_১৭
– দুপুরে রুপু কয়েকবার ডেকেছে খাওয়ার জন্য। আমি কোনো উত্তর দেইনি৷ বিকেলে সাবিহার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আসার আগ মুহূর্তে বাবা এসে ডেকে বলে গেলো, ঐ বাড়ির লোকেরা বাসা থেকে রওয়ানা হয়েছে। আমি যেনো তাদের সামনে উপস্থিত থাকি৷
বাবার এমন আবদারে কি যে বিরক্ত ধরে আসছিলো! আমার নিজের বিয়েই আমি সামলে রাখতে পারছি না, অন্যের বিয়ে নিয়ে ভাবার সময় আছে নাকি আমার! বসে রইলাম নিজের মত। এই বাসায় কে আসলো, কে গেলো ঐসবে আমার কিছুই আসে যায় না৷ সব ভেসে যাক, শুধু রুপু আমার হয়ে থাক। পুরো দুপুর ফ্লোরে-বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম রুপুর সঙ্গে কথা বলা জরুরি। রাগ করে বসে থাকলে সমাধান হবে না। আগে সমস্যার সমাধান করি, রুপুকে ঘরে ফিরিয়ে আনি তারপর পুরো একসপ্তাহ ধরে আমি রুপুর সঙ্গে রাগ করে কথা বলবো না৷
– ভাবীর শোকে আধমরা হয়ে যাচ্ছেন, একসপ্তাহ কথা না বলে থাকতে পারবেন?
– পারবো। রুপুর সঙ্গে কথা না বলে আমি থাকতে পারি যদি সে আমার চোখের সামনে থাকে। মেয়েটা আমার চোখের আড়াল হলেই রাজ্যের সমস্ত বিষন্নতা আমাকে গ্রাস করতে থাকে প্রতি মুহূর্তে। রুপুকে না দেখে আমি থাকতে পারি না৷ নিজের মাঝে পুড়তে থাকি অবিরত।
– ভাবীর সঙ্গে সেদিন আর কথা হয়নি?
– হুম হয়েছে। বাবা চলে যাওয়ার ১০-১৫ মিনিট পর রুপু এলো আমাকে ডাকতে। ওর কন্ঠস্বর শোনা মাত্রই ছুটে গিয়ে দরজা খুলে, ওর হাত টেনে ঘরে ঢুকিয়ে আবার দরজা আটকে দিলাম। রুপুকে বিছানায় বসিয়ে আমি বসে পড়লাম ফ্লোরে। রুপুর হাত আমি তখনও ছাড়িনি৷ ধরে রেখেছিলাম শক্ত করে। আমি কখনো রুপুর হাত ওভাবে ধরেছি বলে মনে পড়েনা। রুপু কেমন বোকা বোকা চেহারা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। আমি বললাম,
– নাদিম তোমাকে একা স্টেশনে রেখে চলে এসেছিলো। ভয়ংকর বিপদ হতে পারতো তোমার৷ সেই খেয়াল ঐ ছেলেটা একদম করেনি৷ নিজের কথা শুধু ভেবেছে। এতগুলো বছর ঐ ছেলেটার জন্য তুমি কতকিছু সহ্য করেছো, কখনো তো সে স্বীকার করেনি৷ ও একটা সেলফিশ। তোমাকে ও কখনো ভালোবাসেনি৷ ওর সমস্ত অন্যায় তুমি ভুলে গেলে রুপন্তি! কিভাবে সম্ভব! কষ্ট আর অপমান তো কম সহ্য করলে না এই ছেলের জন্য। মানছি আমি খারাপ। অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাকে। কিন্তু নাদিমের মত অন্যায় তো করিনি। তবুও এই ছেলেটাই তোমার আপন হয়ে রইলো! আর আমি কেউ না! তুমি আমাকে ছেড়ে ওর কাছে যেতে চাচ্ছো!
ভ্রু কুঁচকে এলো রুপুর৷ ওর হাতটা আমার হাতের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিতে চাচ্ছিলো, আমি ছাড়িনি৷ ধমক দিয়ে বললাম,
– হাত ছাড়িয়ে নিতে চাচ্ছো কেন? সমস্যা কি? ডিভোর্স কি হয়ে গিয়েছে? নাদিমের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তোমার? হয়নি তো৷ এখনও তো তুমি আমারই আছো। আমি হাত ধরলে সমস্যা কোথায়?
– বারবার নাদিম-নাদিম করছো কেন? নাদিম আসলো কোত্থেকে?
– আমারও তো একই প্রশ্ন। নাদিম আমাদের মাঝে আসলো কোত্থেকে? কেন আসলো? তোমার আমার মাঝে যা কিছুই সমস্যা চলছে আমরা নিজেরা তো মিটিয়ে নিতে পারতাম তাই না? আমাদের মধ্যে নাদিম এসে ঝামেলা ডিভোর্স পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছে।
– আমাদের মধ্যে নাদিম এসেছে এটা তোমাকে কে বললো?
– আসে নি? আমি নিজের চোখে দেখেছি।
– কি দেখেছো? ও আমাকে হাবিজাবি ম্যাসেজ দিচ্ছে, রাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে আবারও প্রেম নিবেদন করছে এসব দেখেছো?
– হ্যাঁ।
– সেটা ছিলো শুধুমাত্র নাদিমের তরফের ঘটনা৷ আমার তরফ থেকে কিছুই নেই। বারবার ওকে ইগনোর করে যাচ্ছি। যদি আমি ওর প্রস্তাবে সায় দিতাম তাহলে তুমি বলতে পারতে ও আমাদের দুজনের মাঝে চলে এসেছে৷
– তোমার নীরব সম্মতি আছে। নয়তো তুমি অবশ্যই নাদিমকে বকাঝকা করতে।
ও তোমার রিকশা আটকানোর সাহস কোথায় পায়? সাহস তুমি দিয়েছো। তুমি চিৎকার করলেই ও তোমার রিকশা আটকে রাখার সাহস পায় না৷ ও তোমাকে মেসেজ দিয়ে কল করে বিরক্ত করছে এই ব্যাপারগুলো বাসায় জানালে শুরুতেই সব থেমে যায়। তুমিই চাওনি এসব থেমে যাক। তুমি চাচ্ছো ও আরেকটু আদর যত্ন দিয়ে তোমার রাগ ভাঙাক। ও ফিরে এসেছে বলেই তুমি আমাকে ডিভোর্স দিতে চাচ্ছো। আর নয়তো তুমি কখনোই আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইতে না৷
– নিজে নিজে এতকিছু ভেবে ফেললে? কোনো কিছু না জেনেই হুটহাট বলে দিলে আমি নাদিমের হাত ধরে চলে যাবো! কিভাবে পারো আমাকে নিয়ে এত ফালতু মন্তব্য করতে! তোমার সংসারে যতদিন ছিলাম ততদিন যা খুশি বলেছো। এখন তোমার সংসার ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি এর মাঝেও আরেক লোককে নিয়ে না ভেবেচিন্তে একটা বাজে কথা বলে দিলে। তোমার কাছে কেন মনে হলো আমি আমার অতীত ভুলে যাবো? তুমি আমাকে ছ্যাচড়া ডাকো। হ্যাঁ আমি সত্যিই ছ্যাচড়া স্বভাবের মানুষ। যে যা খুশি বলুক আর করুক অতকিছু মনে রাখিনা৷ তাই বলে এতটাও ছ্যাচড়া হয়ে যাইনি যে নাদিমের কাছে ফিরে যাবো৷ ওর জন্য কতটুকু ঘৃণা মনে পুষে বেড়াচ্ছি তা দেখতে পেলে হয়তো বুঝতে! বাসায় জানাতে বলছো? এই ছেলেটার জন্য আমি কতকিছুর মুখোমুখি হয়েছি! কতগুলো বছর অসহনীয় যন্ত্রণায় দিন কাটিয়েছি! তবুও আমি একবারের জন্যও নাদিমের নাম উচ্চারণ করিনি শুধুমাত্র বাবা আর ফুফুর সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কথা ভেবে৷ একই বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও ভাইবোন কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না, ভেবে দেখো তো ব্যাপারটা কেমন জঘন্য দেখায়। ভুল আমি আর নাদিম করেছি, খেসারত বাবা আর ফুফু কেন দিবে? ঐরকম বাজে অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও আমি কাউকে কিছু বলিনি, আর এই সামান্য ঘটনাটা বাসায় জানাতে বলছো?
– নাম্বারও তো ব্লক করোনি।
– করেছিলাম। ফুফুর কাছে নাদিম নালিশ করেছে, ফুফু আমাকে বকাঝকা করে সেই সূত্র ধরে আমি নাদিমকে ব্লক করেছি। এই ঘটনা নিয়েও বাসায় ঝামেলা হয়েছে৷ ফুফু আমার ঘরে এসে অনেক কথা শুনিয়ে গিয়েছে। বাবার কাছেও যতখানি সম্ভব বাড়িয়ে বিচার দিয়েছে। আমি ঝামেলা পছন্দ করি না। একটু শান্তি চাই, ব্যস। আর রইলো কথা ডিভোর্সের। ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ আমার একার৷ কারো কথায় তোমাকে ডিভোর্স দিচ্ছি না। তোমার কেন মনে হলো আমি তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারবো না? হাসিমুখে সব মেনে নেই, সম্পর্কগুলো বুকে আঁকতে ধরে বাঁচতে চাই তাই? কতটুকু জানো আমাকে? আমার মন পড়ার ক্ষমতা তোমার আছে? নেই। কেউ পারবে না আমার মন পড়তে। আমি হাসিমুখে অনেক কিছু লুকাতে জানি সৈকত। আমার হাসির আড়ালে কি চলছে সেই খবর আমি ছাড়া কেউ জানেনা৷ আমি হাসতে হাসতে অনেককিছু এড়িয়ে যেতে জানি, আবার হাসতে হাসতে কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে জানি৷ অযথা নাদিমকে নিয়ে আজেবাজে কথা ভেবে সময় নষ্ট করলে। তোমার স্ট্রেস একটু কমিয়ে দেই, মজার একটা খবর শেয়ার করি। নাদিমের আজরাতে ওর চাচাতো বোনের সঙ্গে আকদ। গতকাল রাতে রাহাত ফুফুর বাসায় গিয়ে সব কথা বলে দিয়েছে। ফুফুর মতে ১০ বছর আগে তার ছেলের মাথা নষ্ট করে আমি তার কাঁধে ঝুলতে পারিনি। আল্লাহ তার ছেলেকে আমার মত জাদুকরী মেয়ের কাছ থেকে হেফাজত করেছে। ১০ বছর পর সেই অপূর্ণ কাজটা আবার পূর্ণ করার জন্য তার ছেলের মাথা আমি আবার খারাপ করে দিচ্ছি। ছেলেকে আমার কাছ থেকে দূরে রাখার একটাই পথ হলো ঘরে বউ আনা৷ ফুফু সেই পথে ছেলে নিয়ে গতরাতেই হাঁটা শুরু করলেন৷ একরাতের মধ্যে উনার দেবরের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ফিক্স করে ফেললেন। তুমি স্ট্রেস ফ্রি থাকো৷ নাদিমের সঙ্গে আমার কিছুই চলছে না।
পাহাড়সম ভার আমার বুকের উপর থেকে সরে গেলো৷ কতটা স্বস্তি পাচ্ছিলাম তা কেউ বুঝবে না। আমি ছাড়া রুপুর জীবনে অন্য কেউ নেই, এটা ছিলো আমার অস্থিরতা কমানোর টনিক। রুপুর প্রতি আমার সমস্ত অভিমান এক মুহূর্তেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। সিদ্ধান্ত নিলাম একদম অভিমান করবো না রুপুর সাথে। এখন শুধু ভালোবাসা চলবে। হ্যাঁ, আমি ভালোবাসার কথা বলতে পারিনা, খুব যত্নে আগলে রাখতে জানি না। কিন্তু রুপুকে আমি প্রতিমুহূর্তে ভালোবাসার কথা বলবো, ভীষণ যত্নে আগলে রাখবো। খুব অস্বস্তি হবে, বুকে পাথর চেপে আমার সমস্ত অনুভূতি ওকে জানাবো। মায়ার সুতোয় আমার সঙ্গে রুপুকে চিরতরে বেঁধে ফেলবো। আমাকে ছেড়ে রুপু যেতে পারবে না, এটা অসম্ভব!
~চলবে~
#মিম