#চন্দ্রপুকুর
||৩য় পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
মেহমাদ শাহ এগিয়ে আসে বিছানার দিকে। যামিনী বিছানার মোলায়েম চাদর শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ত্রাসে। তার শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে যায় অনতিবিলম্বেই। যুবক তার দিকে ঝুঁকে চিবুক ধরে মুখ উঠিয়ে বলে উঠে,
“তোমাকে আমি চন্দ্রমল্লিকা বলে ডাকবো। চন্দ্রমল্লিকা!”
এতোটাই নিকটবর্তী বাবু মশাই, যে তার প্রতিটি শ্বাস ছিটকে পড়েছে যামিনীর মুখশ্রীতে। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত চলে যায় তার।
অস্ফুটভাবে উচ্চারণ করে,
“চন্দ্রমল্লিকা?”
“হ্যাঁ, কোনো আপত্তি আছে তোমার চন্দ্রমল্লিকা?”
ছোটো ছোটো চোখ করে তাকায় মেহমাদ যামিনীর দিকে। কিশোরী নিজের মামা-মামীর হাল মনে করতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ার দশা ভীতিতে।
“ন-না, না, বাবু মশাই। আমার কোনো আপত্তি থাকবো ক্যা? আমার কোনো সমস্যা নাই, আপনি যেই নামেই ডাকেন।”
“হুম, ঐ সিন্দুকে হিরের ও স্বর্ণের দুটো হার আছে, মোহরানা স্বরূপ। সামলে রেখো।”
নিরুত্তাপ যামিনী। মেহমাদ শাহ ভীষণ ক্রোধান্বিত হয় পড়ে উপেক্ষিত হয়ে। রমণীর শীর্ণ বাহু শক্তভাবে ধরে পালঙ্ক থেকে টেনে হিচড়ে নিচে নামায়। ডান হাত পিছনে মুচড়ে নিজের বুক বরাবর মিশিয়ে দাঁড় করায় যুবক।
হিসহিসিয়ে বলে,
“আর কোনো দিন এক মুহূর্তের জন্যও আমাকে উপেক্ষা করার সাহস করবে না। কোনোদিনও না! আমি জমিদার নবাব মেহমাদ শাহ, এই ধরনীর বুকে দাঁড়িয়ে আমাকে অবজ্ঞা কিংবা প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে না কেউ! মেহমাদ শাহকে উপেক্ষা করার অর্থ নিজের সর্বনাশ নয় ধ্বংস ডেকে আনা। ধ্বংস! বুঝেছো?”
যামিনী উত্তর দিবে কী, সে ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্ময়াভিভূত। উত্ত্রাসে তার গা ঠাণ্ডা পড়ে গেছে। তার হৃৎপিন্ড থেকে নির্গত ধুকপুক শব্দ যা প্রকাশ করে দিচ্ছে।
মেহমাদ শাহের জন্য এই ধুকপুকানিই যেন মহৌষধী হলো। সমুদ্রের প্রকাণ্ড ঢেউয়ে যেমন হারিয়ে যায় সেখানে বিদ্যমান সব তেমন ভাবেই হৃদয়ের সব ক্রোধ মিলিয়ে যায় বায়ুতে। নিজের রোষানলের বিনাশ সূচনা ও সীমাকে আজও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলো না যুবক।
নিজেকে শান্ত করে ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে সে পুনরায় মুখ খুলে,
“ভালো থাকতে চাইলে আমার আর নবাব বাড়ির রীতিনীতিতে নিজেকে সিদ্ধ করে ফেলো। ছোটো থেকে ছোটো ভুলও আমার নিকট পাপ, যার কোনো ক্ষমা নেই। সামান্য ভুলেও নিমিষেই শাস্তি পেয়ে যাবে, ভয়ানক শাস্তিই হয়তো। আমার ক্রোধের অন্ত আছে, তবে সীমা নেই। কথাগুলো এই ছোট্ট মস্তিষ্কে ঠিকভাবে এঁটে নেও।” কিছুক্ষণের বিরতি।
“খাদিম! খাদিম! মরেছো না জবাবে তালা লাগিয়ে বসেছো সকলে?”
যামিনী কেঁপে উঠে মেহমাদ শাহের গলা ফাটানো চিৎকারে। ভয়ে গুটিয়ে মিশে যায় পালঙ্কের সাথে।
পরক্ষণেই প্রহরী দরজা খুললে কক্ষে উপস্থিত হয় ভৃত্যবর্গ। মাথা নিচু করে একজন মার্জনার আবেদন করে উঠে,
“বিলম্বের জন্য দুঃখিত জমিদার বাবু। আমরা রাত্রির ভোজন পরিবেশনের ব্যবস্থা করছিলাম উত্তর পাশের আঙিনায়।”
ইশারায় সায় দিয়ে আড়চোখে যামিনীর দিকে একপলক তাকায় যুবক।
“নবাববাড়ির অন্দরমহলের মহাপরিচারিকাকে খবর দাও, আগামীকালই যেন এসে পড়ে। বেগমকে নবাব বাড়ির রীতিনীতিতে সিদ্ধ হতে হবে। আর মিনারকে ডেকে…”
বাক্যটি শেষ করার পূর্বেই হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে মেহমাদের খাস ভৃত্য মিনার। মাথা নত করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় জানায়,
“শাহ, নবাব বাড়ি থেকে খবর পাঠানো হয়েছে আপনাকে এই মুহূর্ত বাড়ির পথে রওনা হওয়ার জন্য।”
একটু বুঝে উত্তর দেয়,
“আচ্ছা, তবে গাড়ি বের করো মিনার। আমি আসছি।”
মিনার নত দৃষ্টিতে সালাম জানিয়ে তাকে সম্পাদিত কার্য সম্পন্ন করতে প্রস্থান করে। ভৃত্যবর্গ তখনো সেখানে দাঁড়িয়ে।
“আমাকে একা ছাড়া হোক।”
তারা সালাম জানিয়ে চলিত নিয়ম অনুযায়ী কক্ষ থেকে বের হয়। যামিনী তা দেখে ভাবে,
-এরা এভাবে পিছনে দু’কদম হেঁটে বের হচ্ছে কেন?
“আগামীকাল মহাপরিচারিকা, সাথে নবাববাড়ির শিক্ষিকাও আসবেন। তাঁদের থেকে সঠিকভাবে শিক্ষা গ্রহণ কোরো। আমি পরবর্তী বার এখানে আসলে পরিবর্তন চাই তোমার আচার-ব্যবহারে নতুবা পরিণাম তোমার চিন্তা-ভাবনার বাহিরে হবে।”
যামিনী ভীতচিত্তে তাড়াতাড়ি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানায়। যা দেখে বাঁকা হাসি দিয়ে বের হয়ে যায় মেহমাদ শাহ। রমণীর স্বস্তির শ্বাস ফেলে তার বিদায়গ্রহণে।
বিড়বিড়ায়,
“এই রূঢ়ভাষী মানুষটার ক্রোধানলেই না পুড়ে ভস্ম হয়ে যাই আমি।”
___
বিছানায় গা এলিয়ে বসে চন্দ্র আর মেঘের লুকোচুরি দেখছিল যামিনী। এই কক্ষের এক বিশেষত্ব হলো গোটা এক দেওয়াল জুড়ে জানালা, আর সেই জানালার থেকে খুব কাছ ঘেঁষেই পালঙ্ক। আহা কী মনোরম এক দৃশ্য! চাঁদনি বিলাস করছে যেন কিশোরী।
রাত গভীর হয়েছে, শোনা যাচ্ছে শেয়াল সহ অন্যান্য জীবজন্তুর ডাক শ্রবণগত হচ্ছে। এমন কালে দরজায় কড়াঘাত করে কেউ। যামিনী বিছানা থেকে উঠে বসে। বুঝতে পারছে না কী করবে।
এদিকে বাহিরে অপেক্ষারত দিলরুবা অনেকটা সময় সাড়া না পেয়ে মুখ দিয়েই অনুমতি চায়,
“বেগম, আমি দিলরুবা। আসতে পারি?”
“জী, আসেন।”
প্রহরী দরজা খুলে দেয়। কক্ষের অভ্যন্তরে হাসিমুখে প্রবেশ করে দাসী।
“বেগম, আমি আপনার সেবায় নিয়োজিত দাসী দিলরুবা। আপনি ভোজন কি এখানেই করবেন না কি আঙিনায় বা ভোজনশালায় খানা পরিবেশন করবো?”
“যদি সমস্যা না থাইকা থাকে, তাহলে এখানেই দিন।”
“অবশ্যই বেগম। আমরা আপনার সেবায় নিয়োগপ্রাপ্ত দাসী, আপনি শুধু আদেশ করবেন। তবে আমাকে বা অন্যান্য দাস-দাসীদের ‘আপনি’ বলে সম্বোধন না করে ‘তুমি’ করে ডাকবেন দয়া করে, জমিদার বাবু বা অন্যকেউ শুনলে রাগ করবেন আপনার উপর।”
যামিনীর অস্বস্তি কাটলো। স্মিত হাসি ফুটে উঠে। এই যুবতীকে বেশ ভালো, আন্তরিক ও আপন লেগেছে তার।
দাসীরা কক্ষের মধ্যিখানে ছোটো এক চৌকি পেতে মখমলের কাপড় বিছিয়ে তার উপর প্রায় সাত পদের খাবার সাজিয়ে রাখে। এতো পদ চিত্তাকর্ষক খাবার দেখে যামিনীর মুখে পানি এসে যায়। তার ভাত ও লবণ দিয়ে পেটপুরে খাওয়া পড়েনি বহুদিন, ভালো খাবার তো দূরে থাক।
“সব আমার জন্য?”
“হ্যাঁ, বেগম।”
সাথে সাথেই চৌকির সম্মুখে বিছানা পাটিতে বসে খেতে শুরু করে কিশোরী। তার কুম্ভকর্ণের ন্যায় খাওয়া দেখে চাপা হাসে দিলরুবা। গলায় খাবার ঠেকে যায় যামিনীর তাড়াহুড়ো করার দরুন।
দিলরুবা দ্রুত যেয়ে পানি এগিয়ে দেয়।
“ধীরে-সুস্থে খান বেগম। তাড়াহুড়ো করবেন না।”
যামিনী ধীরে ধীরে আহার সমাপ্ত করে। অতিরিক্ত আহারের কারণে তার হাত-পা যেন অসার হয়ে আসে। বিছানায় লুটিয়ে পড়ে সে।
দিলরুবা শরবত এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এটা পান করুন ভালো লাগবে। তা সময় কেমন কাটলো আজ বেগম নবাবের সাথে? আর আজ নিম্নে রাতটার জন্য তো আপনার জমিদার বাবুকে বেধে রাখা উচিত ছিল। অবশ্য আপনার যা শীর্ণ দেহ, নির্ঘাত চাপ নিতে পারেননি।”
যামিনী মুখমণ্ডলে সাজানো বিস্তৃত হাসি ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় এ কথা শুনে। বিমর্ষতাপূর্ণ চাহনি তার।
“জোরজবরদস্তির বিয়ে দিয়ে, এই কালো কুৎসিত রূপ দিয়ে কী করে আটকাবো বাবু মশাইকে দিলরুবা?”
দিলরুবার প্রশ্নসূচক চাহনি। কিশোরী একে একে খুলে বলে তার বিবাহের বাস্তবতা।
সব শুনে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে দিলরুবা শুধায়,
“তবে তো সামনে আপনার বড়োই বিপদ। জমিদার পরিবার, বিশেষ করে বড়ো বেগম লুৎফুন্নেসা তো দিন-রাত এক করে ফেলবে আপনাকে জমিদার বাবুর জীবন থেকে বের করতে। উনি আজ পর্যন্ত কোনো সাধারণ ঘরের স্ত্রীলোককে বেগমের গদিতে টিকটে দেননি, যতোই স্বামীর সমর্থন থাক। সেখানে যদি জমিদার বাবুই আপনার পাশে না থাকে… তবে তো একদম আশ্রয়হীন হয়ে পড়বেন। যতো দ্রুত সম্ভব জমিদার বাবুর হৃদয় বন্দী করুন, নাহলে আপনাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।”
যুবতীর কথা শ্রবণগোচর আতঙ্কে শিউরে উঠে যামিনী। মেহমাদ শাহের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একবার নিজের দেহকে তো নিরাপদ করেছে, এবার নিজের আশ্রয় বাঁচাতে যুবকের মন যোগাবে কী করে?