চন্দ্রপুকুর পর্ব -৪৭ও শেষ

চন্দ্রপুকুর
||শেষপর্ব|| (প্রথম ভাগ)
– ঈপ্সিতা শিকদার
মহল হতে প্রায় দশ মিনিটের দূরত্বে কূপ খনন করা হয়েছে। সেখান হতেই নবাব বাড়ির উদ্দেশ্যে জল আসে।

বর্তমানে আলখাল্লা, হিজাব, নিকাব পরিধান করে কলস নিয়ে গ্রামীণ নারীদের ন্যায় সেদিকে যেতে রওনা হচ্ছে যামিনী।

আজ প্রায় সাত দিন হয়ে গিয়েছে রোহিণীর মৃত্যুর। এতোদিন সবাই আড়াল হয়ে যোহরের ওয়াক্তের পরে বের হলেও আজ সবার সম্মুখেই যাচ্ছে সে। কলস কোলে তুলে অন্দরমহল থেকে তাকে বের হতে দেখে অবাক হয় প্রতিটি খাদিম। দাসীরা কানাঘুষা শুরু করে দেয়। যামিনীর ভঙ্গিমা নির্লিপ্ত।

জনাব আরহান করিম বাহিরের দিক হতে মহলের কিছু দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করছে। কিছুটা নজরও রাখছে এদিক-ওদিক যদি আঁধারিয়া সৌন্দর্যমণ্ডিত নারীটির দর্শন পায়।

হুট করে মহলের সীমানাদেয়ালের মধ্যখানে দেখতে পায় যামিনীকে সে। রৌদ্রময় দুপুরে এই বাঙালি রমণী কলস ভর্তি জল নিয়ে মহলে প্রবেশ করছে।

মৃদু বাতাসে নিকাবটা বেশ কিছুটা সরে গিয়েছে, হিজাব দিয়ে ঘাম মুছতে ব্যস্ত যামিনী। আড়াল হতে ছবি তোলার প্রচেষ্টা করে যুবক। কিন্তু অসফল সে।

“স্যার! স্যার! ঐদিকে কী করছেন? এখানে আসুন। এইখানকার শটটা কোন এঙ্গেল থেকে নিলে ঠিক হবে বোধগম্য হচ্ছে না।”

দিনারের ডাকে আরহানের দৃষ্টি সরার সময়েই মহলে প্রবেশ করে ফেলে যামিনী। কাঙ্ক্ষিত রমণীকে না পেয়ে হতাশায় “ধুর” বোধক শব্দ উচ্চারণ করে নিজের দলের দিকে এগিয়ে যায় সে।

“কী হয়েছে স্যার? আপনাকে এমন হতাশ এবং বিষণ্ণ লাগছে ক্যানো?”

“ঐ মেয়ে, ঐ আঁধারিয়া সৌন্দর্য মূর্তিটিকে আবারও পেয়েছিলাম আমি। তবে আবারও হারিয়ে ফেললাম। একটি ছবি, শুধুমাত্র একটি ছবিই ভালো ভাবে তুলতে পারলেই হতো। কিন্তু না, এবার আমি আর অনুমতি ব্যতীত আড়াল হতে ছবি তোলার প্রচেষ্টা করব না। তার সম্মুখেই যাবো।”

আঁতকে উঠে আহিল। আতঙ্কিত ভঙ্গিমায় প্রশ্ন করে,
“আপনার মাথা ঠিক আছে, স্যার? আপনি একটা প্রজেক্টের জন্য নিজে তো মরণফাঁদে পা রাখছেনই, আমাদেরও নিয়ে নিচ্ছে সাথে।”

‘চ’ বোধক ধ্বনি নির্গত হয় জনাব আরহান করিমের মুখ হতে। বিরক্তে মাখামাখা তার চাহনি।

“আরে অহেতুক কথা বোলো না তো। তেমন কিছুই হবে না। ঐ রমণী কোনো নবাব বংশের সদস্য নয়। নিজ হাতে পানির কলসি টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো, এতো এতো দাসী থাকতে কোনো সম্ভ্রান্ত নারী তা করবে? যাই হোক আমি চুক্তিবদ্ধ হবো ঐ নারীর সাথে। অর্থ, সম্ভ্রমের লালসা হতে কোন নারী মুক্ত আর?”

ফিচেল হাসি ফুটে উঠে পুরুষটির মুখশ্রীতে। যেন খুব ধূর্ততার সহিত শক্তভাবে নিজের পরিকল্পনা করেছে।

যামিনী অন্দরমহলে ফিরে আসলে শ্রবণগত হয় দাসীদের কিছু কথোপকথন। কলস মেঝেতে রেখে আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে সে।

“দেখেছিস শাহাজাদি মেহনূর এসে ডুবিয়ে দিয়েছে বেগম চন্দ্রমল্লিকার ভালোবাসার তরী।”

“তা যা বলেছিস! পূর্বে রাজ-রানীর ন্যায় থাকতো, এখন নিজের জলটাও নিজের টেনে আনতে হচ্ছে। আমার তো মনে হচ্ছে কতোদিন বাদে তো মহল হতেও বাহিরে চলে যাবে।”

“হুম, এখন হতে তো শাহাজাদিকে ‘বেগম’ বলে সম্বোধন করার অভ্যাস করা উচিত।”

যুবতী জমিদারনি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না।

“বেয়াদব, বদমাশ কন্যা! তোমাকে খুন করে ফেলবো আমি!”

চিৎকার করে গলা টিপে ধরে দাসীটির যামিনী। তার চেঁচানোতে অনেকেই ছুটে আসে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসার সাহস করে না।

দিলরুবা ও মোহিনী যেয়ে বাধাদান করে।
“বেগম কী করছেন এসব? ছাড়েন তাকে! ছাড়েন! বেগম লুৎফুন্নেসা বা অন্যকেউ জানলে অনর্থ হয়ে যাবেন।”

একদফা রক্তচক্ষু নিয়ে দাসী দুটোর দিকে তাকিয়ে জলের কলস পুনরায় তুলে নিয়ে স্থান ত্যাগ করে। দিলরুবা ও মোহিনীও তাদের কড়া মেজাজে খাণিক বকে মনিবের পিছন পিছন যায়।

যামিনী নিজের কক্ষে এসে ক্রোধে প্রতিটি বস্তু ছুঁড়ে ফেলছে। দেহে আঘাত লাগছে কি না তাতেও ধ্যান নেই তার। দিলরুবা ছুটে এসে ধরে তাকে।

“মোহিনী ঘড়া থেকে জল এনে দাও বেগমকে। বেগম আপনি শান্ত হন।”

ক্রোধেও সন্দেহ করা হতে বাদ গেল না যামিনী। আড়চোখে দেখলো মোহিনীর কলস হতে জল পানপাত্রে ঢালাকে। দ্বিধাহীন ভাবে ডগডগ করে জল টুকু পান করে নেয় রমণী।

“বেগম, আপনি শান্ত হন। এতোটা ভেঙে পড়লে কী করে মোকাবেলা করবেন শত্রুদের? গোটা নবাববাড়ি আপনার শত্রু, আপনার অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে দিচ্ছে শাহাজাদি মেহনূরকে।”

“হ্যাঁ, যা বলেছো দিলরুবা আপা। আমার তো মনে হয় এখন সবাইকে বিশেষ করে ঐ শহুরে বাবুদের জানিয়ে দেওয়া উচিত আমাদের বেগমই শেরপুরের আসল জমিদারনি।”

“তবে এমন ভাবে জানাতে হবে যেন সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে।”

বাক্যটি শেষ করতেই ধমক দিয়ে উঠে যামিনী,
“বের হও! বের হও আমার কক্ষ হতে! এই মুহূর্তে আমার নজরের সামনে হতে বিদায় হও নাহলে আমি কি করবো আমিও জানি না।”

তার ধমকে যেন কম্পিত হয় প্রতিটি দেয়ালও। দ্রুতো বের হয়ে যায় দুই খাঁস দাসী।

যামিনীর নিজেকে বদ্ধ উন্মাদ বোধ হচ্ছে। কী হচ্ছে বা কী করবে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার। শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। পরক্ষণেই প্রতিশোধ ও ক্রোধের তাড়না তাকে জড়িয়ে ফেলে, চোখের জল দু’হাতে মুছে ফেলে সে।

“বাবু মশাই, আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। আর ভরসা রাখতে পারছি না আপনার উপর। আর না! না, আর অপেক্ষা নয়। এখন এমন কিছু করতে হবে যাতে শুধু গোটা শেরপুর ক্যানো ঐ শহুরে বাবুরা, এমন কী গোটা দুনিয়ে যেন জানে আমি বাবু মশাইয়ের বেগম।”

___

মেহমাদ শাহ সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে কামরায় ফিরে। দ্বার খুলতেই দেখতে পায় শাহাজাদি মেহনূরকে।

শীতল ভঙ্গিমার সহিত এগিয়ে যায় যুবক তার দিকে। রমণী সাথে সাথে দৃষ্টি নত করে উঠে দাঁড়ায়।

“আসসালামু আলাইকুম, আমার শাহ। কেমন আছেন?”

“তুমি এখানে কী করছো মেহনূর? আর সারাদিনের প্রায় পুরোটাই তো আজকাল তোমার সাথেই থাকা পড়ছে বাধ্যতামূলক ভাবে। এই প্রশ্নের অর্থ কী?”

ছলছল দৃষ্টির সহিত তার চোখে চোখ রাখে শাহাজাদি। অপ্রাপ্তি, বিরহবেদনার এক তীব্র আর্তনাদ যেন ছলকে পড়ছে তার আঁখি হতে। ঠোঁটের কোণে কোমল হাসি।

“আর কতো এমন উপেক্ষা করবেন শাহ? আর তো দিন দুয়েক তারপর তো চলে যাবোই শেরপুর ত্যাগ করে। আপনার তো প্রিয় বন্ধু ছিলাম আমি, আবারও সেই স্থানটুকু দিন না আমায়।”

যুবককে যদিও ছুঁতে পারে না তার নমনীয় কণ্ঠ, আক্ষেপসূচক কথাবার্তা। হয়তো ভালোবাসা নেই বলেই তার জন্য এতো কঠোর হৃদয়। তবে অবাক হয় ভিষণ। মেয়েটাকে এতো কোমল, এতো ভাঙাচুরা ভাবে কখনও দেখেনি সে।

“তুমি নিজেই সেই স্থান হতে পদত্যাগ করেছিলে আমার বিশ্বাস ভেঙে। দাদীজান, আম্মিজান না বুঝুক, না জানুক তুমি তো জানতে আমি আমি কতোটা ভালোবাসি আমার চন্দ্রমল্লিকাকে।

তুমি জানতে দাদীজান আমার থেকে কথা নিয়েছিলেন যদি আমি তোমায় বিবাহ করি তবেই এই মহলে জায়গা পাবে আমার চন্দ্রমল্লিকা। অন্যথায় তাকে খুন করতেও হাত কাঁপবে না দাদীজানের।

আমি বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সবাই আমায় হতাশ করলেও আমার ছেলেবেলার প্রিয় বন্ধুটি আমার হস্তখানা কখনোই ত্যাগ করবে না। তুমি আমাকে ওয়াদা করলে তুমি এই বিবাহ করবে না কোনোক্রমেই।

আমি বিশ্বাস করে রাজি হলাম। অথচ, তুমি কী করলে? তুমি আমার ভালোবাসাকে আমার হতে ছিনিয়ে নেওয়ার ধ্বংসলীলায় মেতে উঠলে? তখন বন্ধুত্বের কথা মনে পড়েনি তোমার?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে যুবতী। অনুতাপে মাখামাখি ভঙ্গিমা তার।

“আমি জ্ঞাত আমার পথ ভুল ছিল, তবে বিশ্বাস করো আমার ভালোবাসায় এক বিন্দু খাঁদ কখনোই নেই। আমি আমার সবটুকু দিয়ে তোমায় নিজের করে চেয়েছি আমার শাহ, এতোটা ভালোবেসেছি তোমায় যে নিজেকেও হারিয়ে ফেলেছি।

যাকে যখন ভালোবাসা কী বা কেমন বোধ করতে পারিনি তখন হতে চেয়েছি তাকে কী করে অন্যের হতে দেখে সহ্য করে নিতাম? তুমি পারবে চন্দ্রমল্লিকাকে অন্যের হতে দেখতে? আমি সহ্য করতে পারিনি। তোমার প্রতি আসক্তি আমায় অন্ধ করে তুলেছিল। আমি দুঃখিত, অনুতপ্ত তার জন্য আমায় ক্ষমা করো।”

অবিরাম ধারায় আঁখিজল বেয়ে পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে কপোল। মেহমাদ শাহ তবুও কঠোর ও নীরব। হয়তো এই নারীটির স্থানে তার প্রেয়সী হলে এতোক্ষণে স্থান হতে বক্ষে। ভালোবাসা এক অতি বিশেষ নেশা, যা সবার উদ্দেশ্যে জন্ম নেয় না।

“তুমি নিজের কক্ষে ফিরো মেহনূর। বেশ রাত্রি হয়েছে।”

চরণতলে মাথা রেখে ফেলে শাহাজাদি মেহনূর ভালোবাসার তাড়নায়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে জানায়,

“আমি সত্যি অনেক ভালোবাসি আপনাকে, আমার শাহ। আপনি হয়তো জানেন না আব্বাজান ও দাদীজানের সাথে কী চুক্তি হয়েছে আমায় এখানে পাঠানোর বিপরীতে। এখান হতে প্রস্থান করলেই আমার বিবাহ হয়ে যাবে শহুরে এক বিশিষ্ট ধনী পুরুষের সাথে।

আমি আমার মন-প্রাণ দিয়ে সদা আপনাকে স্বামী বলে মেনেছি। আমি কী করে সহ্য করবো অন্যকারো স্পর্শ? সারাজীবন বেগম চন্দ্রমল্লিকার দাসী রূপে এই অন্দরমহলে কাটিয়ে দিব, তবুও আমায় আপন করে নিন। দয়া করুন।”

যুবক মনে মনে ক্রোধান্বিত হলেও নিজেকে সামলে নেয়। বাহু ধরে দাঁড় করায় নারীটিকে। কণ্ঠ যথাসম্ভব নমনীয় রেখে বলে,

“দেখো মেহনূর, তুমি যা বলছো তা কখনো সম্ভব নয়। তোমার জন্য এ বিবাহ করাই উত্তম নাহলে তুমি কখনও সামনে এগিয়ে যেতে পারবে না। এখন তুমি নিজের কামরায় ফিরে। বিদায়।”

শেষ দুই বাক্য কিছুটা কঠোরতার সাথেই উচ্চারণ করে মেহমাদ শাহ। মুখে আঁচল চেপে ছুটে বেরিয়ে যায় মেহনূর। মনে মনে প্রার্থণা করে হৃদয় ভাঙার এই করুণ আর্তনাদ এই পুরুষটিও যেন একদফা বোধ করতে পারে।

___

দিলরুবা সবার হতে লুকিয়ে মহলের পিছনের ভাগে এসেছে। সেখানে অপেক্ষারত একজন খাদিম রূপী সম্ভ্রান্ত নারী।

“আসসালামু ওয়ালাইকুম বেগম।”

মোর্শেদা খাতুন সালামের জবাব দেওয়ায় সময় ব্যয় করতে অনিচ্ছুক। তাই সরাসরি প্রশ্ন করেন,

“ঐদিকের কী অবস্থা? মেহমাদের উপর কি পুরোপুরি বিতৃষ্ণা এসেছে চন্দ্রমল্লিকার?”

“হ্যাঁ, প্রায় অনেকটাই বেগম। আমার মতে এখনই মোক্ষম সময় শেষ চাল দেওয়ার। তবে মানতে হবে বেগম চন্দ্রমল্লিকার বোকামিকে। মহলে আসতে না আসতেই আমার মতো একজন অতিরিক্ত চাটুকারিতা করা দাসীকে পেয়ে গেল, বিশ্বাসযোগ্য ভাবলো। অথচ, একবারও ভাবলো না এই নবাববাড়িতে বছরের পর বছর কেটে যায় কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য একজন মানুষ পাওয়া যায় না।”

“আমি তো জানতাম আমার দিলরুবা। তাই তো এই বিবাহের সংবাদ শুনতেই তোমাকে পাঠালাম শিকার দালান। আমি তো জানতাম যতোই নবাব বংশের রক্ত হোক বুদ্ধি তো চাষারই হবে। তার উপর তোমার মিথ্যে আনুগত্যের অভিনয়ও তো লাজবাব। যাকগে মোহিনী দেখেনি তো তোমায় আসতে?”

“না, বেগম। আমি তো জ্ঞাত তাকে আরমান বাবু রেখেছে বেগম চন্দ্রমল্লিকার উপর নজরদারি করতে।”

“ঠিক আছে। চিঠিটা লিখা হলে পৌঁছে দিয়ো এমনভাবে যেন সন্দেহ না জন্মায়।”

“অবশ্যই বেগম। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমার চার প্রজন্ম আপনার বংশের নুন খেয়েছে, আপনাকে হতাশ হওয়ার সুযোগ আমি দিব না।”

“আমি জানি আমার দিলরুবা।”

দুই নারী এবার আলোচনা করতে বসে চিঠিটা কীভাবে সাজাবে যেন এই ফাঁদে পা রাখেই যামিনী।

___

মোহিনী, গুলবাহার খাতুন ও এসপি সাহেব তার থানায় এসেছেন। গোপণ আলোচনায় বসতে। টেলিফোনের অপরপাশে আরমান শাহও স্থির।

“আসসালামু আলাইকুম, বেগম এবং এস.পি সাহেব। কেমন আছেন আপনারা?”

“ভালো আর থাকতে দিলে কোথায় তোমরা? তোমরা না কি আরও বখশিশ দাবী করছো জানালো মোর্শেদা।”

“আস্তাগফিরুল্লাহ্ বেগম। এ তো সরাসরি ডাহা মিথ্যে কথা! কে করেছে এই অভিযোগ আমাদের বিরুদ্ধে! আমাদের কেউ একটুও অধিক অর্থ দাবী করেনি।”

শুনে তিনজনের ললাটেই সূক্ষ্ম ভাঁজ স্থির হলো। গুলবাহার খাতুন আরমান শাহকেও জানায়।

“কিন্তু মোর্শেদা তো আমায় উলটো কথাই বলল। ভাবীজান, এসপি সাহেবকে টেলিফোনটা দেন।”

“আসসালামু আলাইকুম, সাহেব। আমি তো আপনাকে পূর্বেই বলেছিলাম ঐ নারী পূর্ণরূপে ছলনাময়ী। কোনো ভৃত্যই অধিক অর্থের দাবি করেনি। নিশ্চয়ই সকল অর্থ ঐ নীলকণ্ঠ দাসের পিছনে ঢালছেন।”

‘নীলকণ্ঠ দাস’ নামটি কর্ণগোচর হলে বুক ধ্বক করে উঠে যামিনীর। অতীতের তীব্র ক্ষতগুলোতে পুনরায় জ্বালাতন শুরু হয়।

“নীলকণ্ঠ দাস? কে সে? আর ক্যানোই বা তাকে অর্থ দেয়?”

“মেহমাদ শাহের স্ত্রী চন্দ্রমল্লিকা তথা যামিনীর মামাজান সে। ক্যানো অর্থ দেয় ঠিক-ঠাক জানতে পারিনি, তবে যতোটুকু বোধগম্য করতে পেরেছি যামিনীর পরিচয় আড়াল করতেই অর্থ প্রদান করেন তিনি বাবু।”

“এস.পি আমার যামিনী নামক কন্যার ছবি ও সকল তথ্য চাই। দ্রুতো।”

“আমি খুব দ্রুতো সময়ের মধ্যেই পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব। তবে ছবি পাঠাতে একটু ঝামেলা তো হবেই।”

“আমি কোনো কথা শুনতে চাই না, এসপি। কাজ দেখতে চাই।” অস্থির হয়ে আদেশ করেন আরমান শাহ। তাঁর ক্যানো যেন মানুষটিকে খুব করে চেনা মনে হচ্ছে।

___

এতো বছর পর আবারও ঐ অজ্ঞাত চিঠিদাতার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। আবারও চিঠি এসেছে যামিনীর উদ্দেশ্যে।

তবে এবারের চিঠিটা বেশ ছোটো-খাটো। চিরকুট বলাই শ্রেয়।

পড়া শুরু করে সে,
“প্রিয় চন্দ্রমল্লিকা,
আমাকে নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি? আমি জানি এখন কতোটা বিপর্যস্ত অবস্থায় তুমি। অতীতেও বহুবার তোমায় বিপদ হতে বাঁচিয়েছি, এবারও সহায়তা না করে পারলাম না। জমিদার নবাব শাহের বিশেষ কামরাটি সম্পর্কে তো তুমি জ্ঞাত। সে কামরায় বিশেষ একটি লাল মলাটের ফাইলে বিভিন্ন কাগজ-পত্র আছে, তাতে তোমাদের বিবাহের সকল তথ্য উল্লেখিত।

যদি তুমি কোনোভাবে সে কাগজটি জনাব আরহান করিম হকিংসের হাতে তুলে দিতে পারো, তবে সাপও মরবে না, লাঠিও ভাঙবে না। অর্থাৎ, সবাই জেনেও যাবে তুমিই বেগম চন্দ্রমল্লিকা। আবার তোমার উপর দোষারোপও যাবে না। ক্যানো না, জনাব আরহান করিম হকিংস কখনও এই উদঘাটনের কৃতিত্বে অন্যকাউকে অংশীদার করবে না।

ইতি,
তোমার শুভকাঙ্ক্ষী।”

চিঠিটা পড়ে এক গোলকধাঁধায় পড়ে যায় রমণী। একদিকে তার মস্তিষ্ক বলছে এই শুভকাঙ্ক্ষীর কোনো পরিকল্পনা বা প্রস্তাব আজ অবধি তার উদ্দেশ্যে অহিতকর হয়নি, আর হৃদয় বলছে নিজের জন্য লাভজনক কিছু করতে যেয়ে বাবু মশাইয়ের সাথে বেইমানি না হয়ে যায়।

মাথা ধরে বসে পড়ে যামিনী মেঝেতে। কোন পথে পা বাড়াবে সে এবার কে জানে।

কোনোদিকে না তাকিয়ে সে ছুটলো মেহমাদ শাহের কামরার দিকে। গতানুগতিক ভাবেই সেখানে মিনার দাঁড়িয়ে।

“আসসালামু আলাইকুম, বেগম।”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি বাবু মশাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছি।”

“দুঃখিত, বেগম। জমিদার বাবু এখন শহুরে বাবুদের সাথে কথা বলছেন। এই মুহূর্তে কারো অভ্যন্তরে প্রবেশ নিষেধ, বিশেষ করে আপনার। কারণ আপনি তো জাননেনই…”

আর বলতে না দিয়েই যামিনী হনহন করে চলে আসে নিজের কামরায়। এতোটাই অযোগ্য বোধ করে তাকে নবাব! মেনে নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে বিড়বিড়ায়,
“ভালোবাসা, বিশ্বাস সব পুড়ে ছারখার,
শেষ নিঃশ্বাস নিচ্ছে পিছুটানও,
আর থাকবে না কিছু আমাদের মাঝে,
জয় হবে ক্ষমতার যে কোনো শর্তের বিপরীতে।”

___

গভীর রাত্রি, যামিনী মেহমাদ শাহের কামরায় প্রবেশ করে। মানুষটি গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আছে। একদফা সরল চেহারার এই হৃদয়ঘাতকের দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে ফেলে। আর রাখবে না কোনো পিছুটান।

এই কামরার প্রতিটি কোণা তার পরিচিত। তার চাবির তোড়া অতি সহজেই পেয়ে যায়। খুব সতর্কতার সাথে তা আড়াল করে প্রহরীদের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যায়।

পরদিন ফজরের আযান দিতে ঘণ্টা খাণেক বাকি। ধীরে ধীরে অন্দরমহল হতে বের হয় যামিনী। বিশেষ এই কামরায় সম্মুখে পাহারারত প্রহরীরা ঝিমাচ্ছে ঘুমে।

“এ কী দশা! তোমরা এভাবে তন্দ্রাবিষ্ট হয়ে পাহারা দিচ্ছো মহলের!”

জমিদার গিন্নির ধমকে কম্পিত হয়ে উঠে দাঁড়ায় প্রহরীরা। ভয়ে তটস্থা তারা।

“যাও তোমরা! যেয়ে দ্রূতো চোখে-মুখে জল দিয়ে আসো! অকর্মের ঢেঁকি যত্তসব!”

তাৎক্ষণাৎ দৌড় লাগায় প্রহরীরা। যামিনী বিজয়ীর হাসি দেয়। তারা যতোক্ষণে আসবে ততোক্ষণে তার কার্য সম্পূর্ণ হয়ে যাবে।

একের পর এক চাবি দিয়ে খোলার চেষ্টা করলে চতুর্থ প্রচেষ্টাতেই দরজা খুলে যায়। রমণী প্রবেশ করে অবাক। একদম ভিন্ন এক কামরা। এক পাশে বিশাল উঁচু তাকে বিভিন্ন ধরনের বই রাখা।

আরেকপাশে বেশ কয়েকটি চৌপায়ায় বেশ কিছু কাগজ-পত্র ঠাঁসা। আছে প্রায় সাত-আটটি টেলিফোন, রেডিও। আছে ক্যামেরা। আছে বিভিন্ন জাতীয় বস্তু ও যন্ত্র, যা চেনা নেই যামিনীর।

বিস্ময়ে ঠোঁট গোল হয়ে যায় তার। তবুও নিজেকে সামলে নেয়। চোখ বুলায় কাঙ্ক্ষিত লাল রঙা ফাইলটির উদ্দেশ্যে। খাণিকটা সময় খোঁজাখুঁজি করতেই দেরাজের মধ্যে তা পেয়েও যায়। তার উপরে খুব স্পষ্ট ভাবে লিখা ‘চন্দ্রপুকুর’।

আঁচলের নিচে আড়াল করে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দ্রুতো স্থান ত্যাগ করে সে। আড়াল হতে এ দৃশ্য দেখে মোর্শেদা খাতুনের দেহে শীতল স্রোত বয়ে যায় প্রতিশোধ পূরণের।

চাবির তোড়া জায়গা মোতাবেক রেখে কামরায় ফিরে আসে যামিনী। এখন প্রধান চিন্তা, জনাব আরহান করিমের নিকট কী করে এই কাগজ-পত্র হস্তান্তর করবে?

___

ভরা দুপুরবেলা, কাঠফাটা রৌদ্রে দাঁড়িয়ে যামিনীর উদ্দেশ্যে অপেক্ষা করছে জনাব আরহান। আজ যে করেই হোক এই কন্যার সাথে ‘ব্ল্যাক বিউটি’ প্রজেক্টের বিষয়ে কথা বলতে হবে তার। কারণ আগামীকাল ভোরেই শেরপুর ত্যাগ করবে তারা।

তার অপেক্ষার অবশান হয়। কলস কোলে যামিনী আসে। তার কোমরে গুঁজা আছে সেই ফাইলটিও। মহলের সীমানা পেড়িয়ে ফেললেই যুবক ছুটে যায় তার দিকে।

“এই যে রমণী! একটু দাঁড়ান!”

আওয়াজ পেয়ে পিছনে ঘুরে যুবতী। এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। যে মানুষটির সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছে, সে-ই তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। #চন্দ্রপুকুর
||শেষপর্ব|| (২য় ভাগ)
– ঈপ্সিতা শিকদার
তার চিন্তা-ভাবনার মাঝে কাছাকাছি চলে আসে আরহান। চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“এই যে! কোথায় হারালেন?”

ঘোর ভাঙে যামিনীর। সাথে সাথে ফাইলটি বের করে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে শুধায়,

“আমিই বেগম শেরপুরের, নবাবের স্ত্রী বেগম চন্দ্রমল্লিকা।”

জিভে কামড় দেয় যুবক। যামিনীর কথা তার বিশ্বাস করতে একবিন্দু সন্দেহ হয় না। কারণ সে তো প্রকৃতপক্ষে বেগম চন্দ্রমল্লিকার চেহারা দেখেনি। দেখেছে আলখাল্লা, হিজাব, নিকাবে আড়াল হয়ে থাকা এক রমণীকে।

“আমি দুঃখিত বেগম। আমি আসলে জানতাম না।”

“ঠিক আছে। আপনি এই ফাইলটি পড়ে দেখুন। আপনার কাজের।” বলতে বলতেই এদিক-ওদিক তাকায় রমণী। ভীতিতে তার হাত-পা শীতল হয়ে যাচ্ছে।

ভ্রু কুঁচকে ফেলে যুবক। হাতে নিয়ে ফাইলের কয়েকটা কাগজে চোখ বুলাতেই চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায় তার।

“এতো বড়ো রহস্য! এটা খোলাসা করতে পারলে তো…! আপনি জানেন না আপনি কতো বড়ো সহায়তা করলেন চন্দ্রমল্লিকা। আমি যাচ্ছি। আর আপনি চিন্তা করবেন না, আপনার ক্রেডিটও আপনিই পেয়ে যাবেন।তাছাড়া আপনি এই কার্ডটি রাখুন, যে কোনো প্রয়োজনে আমায় কল দিতে পারবেন তাতে লিখা নম্বরে।”

পকেট হতে একটি কাগজ বের করে দিয়ে উত্তেজনায় কোনো দিকে না তাকিয়ে অন্দরমহলে প্রবেশ করে। তার মুখশ্রীতে চওড়া হাসি প্রাপ্তির।

যামিনী ভীতিগ্রস্ত হয়। অজান্তেই কোনো ভুল কদম নিয়ে ফেলেনি তো সে!

এই কাগজ-পত্রের ফাইলটি নিয়ে দুপুর গড়ানোর পূর্বেই শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে মিস্টার হকিংস তার দলবল নিয়ে।

___

একটু একটু করে আঁধার নেমেছে গগণের শুভ্র বক্ষে। শাহাজাদি জান্নাতুল আজ প্রচণ্ড রেগে আছেন। ক্রোধে রীতিমতো সর্পের ন্যায় ফোঁস ফোঁস করছেন তিনি।

যে মানুষটি তাঁর জীবন ধ্বংস করেছে তিনি তাঁর রক্তের জীবন নিয়েও ধ্বংসলীলায় মেতেছেন। বয়সটা যখন আঠারো তখন তাঁর বিবাহ হয় আমির হাওলাদারের সাথে। অথচ, কিশোরী অবস্থায় ভালো তিনি বেসেছিলেন মসজিদের ইমামকে।

যদিও মানুষটিকে কখনোই বলা হয়নি ‘ভালোবাসি’ শব্দটি। তবে রোজ নিয়ম করে যেতেন মসজিদে ফজরের ওয়াক্তে কোরআন তিলাওয়াত করার বাহানায় মানুষটির একদফা দর্শন পেতে।

কিন্তু মোর্শেদা খাতুন কোনো কালেই পছন্দ করতেন না শাহাজাদি জান্নাতুলকে। ঈর্ষা করতেন। হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পারে তিনি এই ঘটনা। কান ভাঙানো শুরু করেন জমিদার নবাব আলিবর্দি শাহের। ছিলেন কি না জমিদারের পিতা-মাতা হীন প্রিয় ভাগ্নী, তাই তিনিও বিশ্বাস করতে দ্বিধা করেননি।

ভাগ্নীর পরামর্শ অনুযায়ী কাউকে জানানো ব্যতীত বিয়ে ঠিক করেন নেশাখোর ও বদমেজাজি আমির হাওলাদারের সাথে। সেই যে শাহাজাদি জান্নাতুনের আনন্দ ও সুখের সূর্য অস্ত গিয়েছিল, তারপর আর কখনও উদয় হয়নি এই ধরনীর বক্ষে।

কতো দফা আমির হাওলাদারের মানসিক অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে এ বাড়িতে ফিরেছেন। শারীরিক অত্যাচারিতও কম হয়নি। তবে স্থান পাননি, ভাগ্নীর কথা বিশ্বাস করে তাঁকেই দোষোরোপ করেছেন তাঁর আব্বা হুজুর। যদিও মৃত্যুর সময় বহুবার ক্ষমা চেয়েছিলেন, তবুও কি এই ক্ষতির ক্ষতিপূরণ আর হবে কভু?

কথাটা ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে যান মোর্শেদা খাতুনের কামরায়। চুলের মুঠি টেনে ধরেন।

“শাহাজাদি!”

আতঙ্কিত ভঙ্গিমায় চিৎকার করে উঠেন মোর্শেদা খাতুন। শাহাজাদি যেন আরও তেঁতে উঠেন।

“সর্বনাশী! অজ্ঞাত হওয়ার অভিনয় করছিস! চল আমার সাথে শয়তান নারী, তোর ফয়সাল আজ আমি করবোই।”

তাঁর চুলের মুঠি ধরেই তিনি এগিয়ে যান বেগম লুৎফুন্নেসার ব্যক্তিগত দরবারে। কারণ এই সময় তিনি সেখানে অন্দরমহলের অর্থনৈতিক সহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসেন আয়েশা খাতুনের সাথে।

___

বেগম লুৎফুন্নেসার দরবারে জরুরি তলবে এসেছে মেহমাদ শাহ।

“আমি শুনেছি তুমি দু’দিন পর যামিনীকে নিয়ে শেরপুরের বাহিরে যাচ্ছো।”

“যা শুনেছেন দাদীজান, সত্য শুনেছেন৷ যামিনীকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি। তার চিকিৎসা প্রয়োজন।”

“আজকাল শাসক হতে অধিক প্রেমিক হয়ে ভাবছো। এই চিকিৎসার জন্য বহুদিন তোমার বাহিরে থাকতে হতে পারে, ততোদিন জমিদারি কে সামলাবে চিন্তা করেছো?”

“যেই আপনার জমিদারি, সবই তো কপটতা। আমাদের পূর্বপুরুষের তৈরি করা কপটতার জাল। যাতে এখনও ফেঁসে আছে শেরপুর বাসী।” তাচ্ছিল্যের সুর যুবকের।

“মেহমাদ! আজকাল বড্ড বেশিই বিদ্রোহী হয়েছো! আমাদের পূর্বপুরুষেরা যা করেছে আমাদের জন্যই করেছে। নাহলে আজ জমিদারের মতো রাজত্ব না করে রাস্তায় থাকতে তুমি। আর শেরপুর বাসীকে মন্দ রেখেছি আমরা? হাসপাতাল, খাবার, পড়াশোনা, শান্তি, কোন দিক দিয়ে কমতি আছে?”

“না নেই। বিদ্যালয় ঠিকই তৈরি করেছেন। তবে সে বিদ্যালয়ে আমাদের পড়ানো হয়নি ক্যানো? কারণ আপনারাও জ্ঞাত শহরে আরও ভালো ব্যবস্থা আছে।”

এর মাঝেই ঝড়ের বেগে দ্বার খুলে প্রবেশ করেন শাহাজাদি জান্নাতুল মোর্শেদা খাতুনের চুলের মুঠি ধরে। বেগম লুৎফুন্নেসা ও মেহমাদ শাহ উভয়ের চক্ষুশূল এ দৃশ্য দেখে বাক্যহারা।

“আম্মাজান! ফুপিজান! এ কী অবস্থা! ফুপিজান আপনি আম্মাজানের সাথে এমন আচারণ করছেন ক্যানো?”

শাহাজাদি জান্নাতুল উত্তর প্রদান করেন না। আয়েশা খাতুনের দিকে দৃষ্টিপাত করেন তিনি।

“আয়েশা খাতুন, বেগম চন্দ্রমল্লিকা যেই অবস্থায় থাকুক না ক্যানো, তাকে এই মুহূর্তে আম্মিজানের কক্ষে নিয়ে আসুন।”

“যথা আজ্ঞা শাহাজাদি।”

আয়েশা খাতুন আদেশ পালনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

“কী হয়েছে আমার জান? তুমি এতো উত্তেজিত ক্যানো?”

আরও যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেন মধ্যবয়স্ক শাহাজাদি। মেঝেতে ধাক্কা মারেন অপ্রিয় কলুষিত এই নারীটিকে।

“কী হয়েছে জিজ্ঞেস করছো? তোমার এই পুত্রবধূ তথা তোমার স্বামীর প্রিয় ভাগ্নির আমার আর আমার ভাইদের জীবন ধ্বংস করে স্বস্তি মিলেনি। এখন আমার অসহায় ভ্রাতুষ্পুত্রীর জীবনটা নিয়েও ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছে!”

দ্বার খুলে যামিনী এ দৃশ্য দর্শন করে এবং এই উক্তি শুনে আশ্চর্যান্বিত হয়। তার আগমনের আভাস পেতেই ফুপিজান দৌড়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে।

“আমার আদুরে কন্যা। আমার চন্দ্রিমা। আমাদের বংশের একমাত্র কন্যা।”

মেহমাদ শাহ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

“এসব কী বলছেন আপনি ফুপিজান? যামিনী এ বংশের কন্যা!”

“হ্যাঁ রে মেহমাদ। এটা তোর আরমান চাচাজানের একমাত্র কন্যা যামিনী। এ এক অপরিবর্তনীয় সত্য, যা এই নারীর জন্য এতোকাল আড়াল হয়েছিল। আমি আমার লোক দিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি এ তথ্য।”

বেগম লুৎফুন্নেসা কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে পড়েন। পরক্ষণে বড়ো বড়ো পা ফেলে জড়িয়ে ধরে চুমু খান পৌত্রীর ললাটে।

“আমার আকসা, আমার আরমানের কন্যা, আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো দাদু। দাদীজান না বুঝে তোমার সাথে কতো অপরাধ করে ফেলেছি।”

যামিনী স্তম্ভিত হয়ে আছে। সে বোধগম্য করতে পারছে না এখানে কী হচ্ছে। আর একজনও তার দলে শামিল, সে হলো মেহমাদ শাহ।

“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না আপনারা কী বলছেন। চন্দ্রমল্লিকা কী করে আরমান শাহের কন্যা হয়? আর আম্মাজানই বা কী করে দোষী।”

“নাটের গুরু তিনিই আমার মেহমাদ। তুমি জানো না সে কতো বড়ো ছলনাময়ী। এতোকাল তোমার সম্মুখেও ভালো সাজার অভিনয় করেছে। এমন কী যে তোমার আব্বাজানের যে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর উদ্দেশ্যে তুমি নিজেকে ও সবাইকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে আসছো, তার মূল দোষীও এই নারী। এই হৃদয় বিদারক বিষয়ে নিয়ে কথা বলতে চাইতাম না আর আব্বাহুজুর ওয়াদা নিয়েছিলেন বলে এতো সময় সম্পূর্ণ সত্য প্রকাশ করিনি আমরা। তবে এখন আর কোনো বাধা নেই।”

“আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে এখানে!” মৃদু কণ্ঠে উচ্চারণ করে যামিনী।

“এখন হতে প্রায় একুশ কী বাইশ বছর পূর্বের কথা। আমাদের সুখী পরিবার ছিল। আব্বাহুজুর তথা তোমাদের দাদাজান জমিদার নবাব আলিবর্দি শাহ কর্তৃত্ব খুব ভালোভাবেই চলছিল আমাদের ছয় সদস্যের সংসার।

তবে আব্বাহুজুর হতে আমি বা আমরা পিতার ভালোবাসা কখনও পুরোপুরি পাইনি। তার কারণ ছিল এই নারী, মোর্শেদা! আব্বা হুজুরের প্রিয় পরলোকগত বোন ও ভগিনীপতির একমাত্র কন্যার দিকে তাঁর মমত্ববোধটাই অধিকই ছিল সর্বদা।

আম্মিজানের নিকট এ দৃশ্য দৃষ্টিকটু লাগলেও আব্বা হুজুরের ভয়ে নীরব থাকতেন। মোর্শেদাকেও কম আদর করতেন না তিনি। আমি, আরমান ভাইজান, লোকমান ভাইজান ও আলিউল ভাইজান কখনও বাজে আচারণ করিনি তার সাথে। সবসময় আপন ভেবেই চলেছিল।

কিন্তু এই সর্বনাশী সদাই যেন ঈর্ষাই করে গিয়েছে আমাদের। আব্বা হুজুরের নিকট তো ক্ষণে ক্ষণে আমাদের নামে মিথ্যে অপবাদই দিতেন। তবে একজনকে তার একটু অধিকই পছন্দ ছিল, তিনি ছিলেন আরমান ভাইজান। আব্বাহুজুরকে ফুসলিয়ে রাজি করায় সে এই বিবাহের জন্য।

আরমান ভাইজান বারবার বলেছিলেন তিনি অন্যকাউকে ভালোবাসেন, এই বিয়ে করতে ইচ্ছুক নন। কিন্তু আব্বাহুজুর ভাগ্নীর মিষ্টি কথায় আর মায়ায় অন্ধ হয়ে একপ্রকার আম্মিজানের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বিবাহ করায় দু’জনের।

এই বিবাহের পরও স্বামীর সুখ পায়নি মোর্শেদা। তিনি ভালোবাসতেন যামিনীর মাতাকে, অবৈধ সম্পর্কও গড়েছিলেন। গর্ভবতী হয়ে যান তিনি। যার মাশুলই দিতে হয়েছিল সবাইকে।”

“কী মাশুল ফুপিজান?”

“নবাব বংশের নিয়ম ছিল যে অবধি শাহাজাদাদের মাঝে যোগ্য নবাব না পাওয়া যাবে সে অবধি কোনো শাহাজাদা লোকচক্ষুর সম্মুখে আসবে না। আর যাকে যোগ্য মনে হবে একমাত্র সেই-ই একমাত্র শাহাজাদা স্বরূপ শেরপুরে থাকবে। বাকিরা শহুরে যেয়ে ব্যবসা সামলাবে। তবে আরমান ভাই যেহেতু সবার বড়ো ছিলেন, তাই তাঁরই হক ছিল বেশি। এই বিষয়টির জন্যই প্রিয় ছিলেন কি না তিনি এই মোর্শেদার নিকট কে জানে?

আরমান ভাইজান বড়ো হলেও তিনি এতোকাল রাজি না হওয়ায় লোকমান ভাইজান ও আলিউল ভাইজানেরও বিয়ে হয়েছিল তার আরও পূর্বে। তোমার বড়ো চাচীমা গুলবাহার খাতুন ছিল সন্তানহীনা, আর তোমার মাতা নূর বাহার বেগম তোমার জন্ম হলে তাকে বেশ তাচ্ছিল্য করতেন। গুলবাহার ভাবীজানও কখনও ছাড় দেননি।

তবে ভাইজানদের কাউকেই চিনতেন না গ্রামবাসী। যেহেতু শাহাজাদাদের পরিচয় করানো নিষেধ ছিল। তাঁরা সাধারণ ভাবে গ্রামে ঘুরে বেরাতেন, গ্রামবাসীদের কোথাও কোনো সমস্যা হতো কি না দেখতেন কৈশোর অবস্থা হতেই। আমাদের অজান্তেই কোনো এক কালে গ্রামে যেয়ে আরমান ভাইজান যামিনীর মাতাকে দেখে এক দর্শনে প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। যামিনীর মাতাও ছিলেন কৃষ্ণকায়া রূপসী, মায়ার অরণ্য। এজন্যই হয়তো বিয়ের নাম শুনতেই গাইগুই করতেন আরমান ভাইজান।

যাকগে ভাইজান ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে সবাইকে লুকিয়ে যামিনীর মাতার নিকট নিজের পরিচয় আড়াল রেখে এই অবৈধ সম্পর্ক চলমান রাখছিলেন। এই বিষয়টি জেনে যান মোর্শেদা খাতুন। তবে কীভাবে নবাবের সম্মুখে প্রমাণ করবেন বোধগম্য হচ্ছিলো না। কারণ তার মনে হতো যামিনীর মাতা তো কখনোই ভাইজানের জন্য অহিতকর সাক্ষী দিবেন না।

তোমার হাত ধরে এই সুযোগ পায় সে মেহমাদ। তুমি ও লোকমান ভাইজান একদিন সন্ধ্যাবেলা তাঁকে দেখে ফেলেছিল সকলের আড়ালে এক কন্যার সাথে মাটির এক ঘরে ঢুকতে। লোকমান ভাইজান এ বিষয়ে আরমান ভাইজানের নিকট জিজ্ঞেসাবাদ করলে তিনি আর লুকান না। সবই বলে দেন।

আমাদের সবার মাঝে লোকমান ভাইজান একটু অধিকই পরোপকারী ছিলেন, তাঁর ভালোবাসাটাও ছিল বেশি। তাই তিনি বিষয়টি জেনেও চেপে যান। আম্মিজান অবশ্য বেশ পূর্ব হতেই জানতেন তবে ছেলেকে ফিরাতে না পেরে পুত্র হারানোর ভয়ে তিনিও চুপ ছিলেন।

কিন্তু ভুলটা করো তুমি। অবুঝ তুমি না জেনে এ তথ্য জানিয়ে দাও এই মোর্শেদাকে। কারণ ছেলেবেলায় একমাত্র বংশেরবাতির খেয়াল রাখার দায়িত্ব আব্বাহুজুর এই বিষাক্ত নারীটিকেই দিয়েছিলেন। তুমি মানো তোমার আম্মিজান তোমাকে বলেছিলেন তোমার দেখা দৃশ্য তোমার দাদাজানকে জানাতে। তবে একবারও ভাবোনি তোমার আম্মিজানকে কে বলেছে তুমি কী দেখে এসেছো? অবশ্য তোমারও দোষ না, বয়সটাই বা কতো হবে তোমার তখন।

আমি বলছি, বলেছিলেন তোমার প্রিয় আম্মাজান। যামিনীর মাতাকে তোমার চাচাজান তন্দ্রাঘোরে সব তথ্য বলে ফেলেছিল, এমন কী নবাব বাড়ির গোপন রহস্য। তবে এ আর বলেননি যে এই সম্পর্কের কথা জানলে সকলের মৃত্যু হবে। এই পরিস্থিতিকে মুখ্যম সময় ভেবে ফায়দা তুলে মোর্শেদা। যামিনীর মাতাকে যেয়ে জানায় আরমান ভাইজান তাকে বিবাহ করেছেন এবং তাকে নিয়ে শহরে চলে যাচ্ছেন। অন্তঃসত্ত্বা তিনিও বোকার ন্যায় ভাইজানকে না জানিয়ে নিজের হক চাইতে এসে পড়েন নবাববাড়ির দরবারে।

আব্বাহুজুর প্রথমে বিশ্বাস করছিলেন না। সেই বিশ্বাস জয় করতে এই পরিকল্পনায় শামিল করে তোমার মাতা নূর বাহারকে। নূর বাহার ভাবীজানও ছিলেন ক্ষমতা লোভী, উত্তরাধিকার কমবে বুঝে তিনি এক পায়ে দাঁড়া হয়ে যায়। তোমার প্রিয় খাবারের লোভ দেখিয়ে তোমায় পাঠায় সত্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে। অবুঝ তুমিও… আব্বাহুজুরের তোমার কথা অবিশ্বাস করার সুযোগ ছিল না।

আরমান ভাইজান ও লোকমান ভাইজান সেই মুহূর্তে বাড়ি ছিলেন না। কাজে বাহিরে ছিলেন। সেখান হতে আব্বাহুজুরের লোকজন তাঁকে তুলে আনেন। আতঙ্কিত হয়ে আসেন লোকমান ভাইজানও। যামিনীর মাতা হুমকি দিচ্ছিলেন নবাববাড়ির রহস্য উন্মেচন করে দিবেন তাঁকে স্থান না দিলে। আব্বাহুজুর প্রচণ্ড রেগে যান, জীবন নিয়ে নিতে তৎপর।

দরবারে এসে পরিস্থিতি বিপরীতে দেখে লোকমান ভাইজান সকল দোষ নিজের কাঁধে তুলে নেন। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন আব্বাজান খুব বেশি হলে তাকে বহিষ্কার করবেন। আম্মিজান আঁতকে উঠলেও চুপ থাকেন, কারণ তার ভয় ছিল এই মুহূর্ত প্রকৃত সত্য জানলে জমিদার দুই পুত্রকেই হত্যা করবে। আর আব্বাহুজুর? তিনি স্বীকারোক্তি দেওয়ার সাথে সাথে এক আঘাতে তাকে হত্যা করে ফেলেন।

পরিস্থিতির গম্ভীরতা এতোক্ষণে বোধ হয় যামিনীর মায়ের। আতঙ্কে চিৎকার করে মাটিতে বসে পড়েন তিনি। এরপর আর একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি। স্তব্ধ হয়ে পড়েন আরমান ভাইজানও। কেউই এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আশা করেনি। আম্মিজান, ভাইজান কেঁদে এগিয়ে যেতে নেয়। আব্বাহুজুর আটকে দেন তাদের।

বলেছিলেন, ‘এই অপরাধীর কলঙ্কিত দেহ স্পর্শ করবে না লুৎফুন্নেসা। তবে তোমাদেরও আমি কী অবস্থা করবো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই ছেলে প্রেমে এতোটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল নিজের বংশ রক্ষা ভুলে গিয়েছিল। আমি অন্যদের মৃত্যু শাস্তি দেই পরকীয়া বা অবৈধ সম্পর্কে, সে কেন বাদ যাবে?’

আরমান ভাইজান অনুতপ্ত ছিলেন, ক্রুব্ধ ছিলেন। তিনি শাব্দিক বিরোধিতা করেন আব্বাহুজুরের। আব্বাহুজুর পুনরায় পুরো দমে রেগে যাচ্ছিলেন। আম্মিজানের আর একজন স্বজনের মৃত্যু দেখার ক্ষমতা ছিল না। তাই তিনিই কঠোর গলায় শাস্তি দিয়েছিলেন, ‘এতো দুঃসাহস তোমার! তোমাকে বহিষ্কার করলাম আমি এই শেরপুর হতে। তুমি আর কখনোই শেরপুরে আসতে পারবে না। আলিউল হবে নবাব, আর তুমি শহরে আমাদের কাজ সামলাবে’।

তাৎক্ষণাৎ আরমান ভাইজানকে শহরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর জীবন রক্ষা পায়। তবে তিনিও ভুল বুঝেন আম্মিজানকে, মিথ্যে দোষারোপ করেন আম্মিজান ও এ বাড়ির সকলকে। আর যামিনীর মাতাকে আব্বাহুজুর প্রচণ্ড ভয় দেখিয়ে বের করে দেন মহল হতে। পরিচিত বাসস্থানে আর তাঁর হদিস মিলেনি। অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন বলেই বোধহয় আব্বাহুজুর জানে মারেননি। সেদিন এই কলুষিত নারীর জন্য সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এবারও যামিনীর তথ্য লুকিয়ে রাখতে চেয়েছে সে, এতোটাই তার ঈর্ষা।”

এক টানা অতীত বলে মেহমাদ শাহ ও যামিনীর পানে তাকায় শাহাজাদি জান্নাতুল। উভয় মানুষই কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

“আম্মাজান, আপনি? আপনি এমনটা কী করতে পারেন?”

খিলখিল করে হেসে উঠেন মোর্শেদা খাতুন।

“হ্যাঁ, আমি সব করেছি। আর আমার এতে কোনো আফসোস নাই। আর তুমি মেহমাদ, তোমাকে তো আমি কখনও দুই চক্ষুতে দেখতেই পারিনি। সবটাই ছিল মামাজানের নিকট ভালো সেজে থাকার প্রচেষ্টা। আর আমি করবো না ক্যানো এসব? আমিও শাহাজাদি ছিলাম, এই জান্নাতুলও শাহাজাদি ছিল। তবুও সে সর্বদাই অধিক মূল্য পেতো সবকিছুতে। ক্যানো?

আরমানকে বিবাহ করে ভেবেছিলাম বেগমের মর্যাদা পাবো। না, সে অন্যের প্রেমে মেতে। এতো পরিকল্পনা করে সত্য ফাঁস করলাম যেন যামিনীর মাতার ফাঁসি হয়। অথচ, ঐ বলদ বুড়োটা নিজের পুত্রকে হত্যা করে আমায় আরও বেকায়দায় ফেললো। এমন কী আরমান যাওয়ার পর আমার পুত্র সন্তান প্রতিবন্ধী রূপে ভূমিষ্ঠ হলে তাকেও ত্যাগ করতে বাধ্য করলো আমায়!

একবারও ভাবেনি আমার মমতার কথা। এতোটা বছর ধরে দাসীর ন্যায় থেকেছি আমি শাহাজাদি হয়ে। এতো অপমান সহ্য করেছি দাঁতে দাঁত চেপে। শুধু এই প্রতিশোধের তাড়নায়। তবে আজ আমি সফল। আমি সফল। তোমাদের ধ্বংস শুরু হয়ে গিয়েছে। আর কিছুটা সময় বাকি তারপর জমিদারি আর জমিদার কিছুই থাকবে না।

শাহাজাদি জান্নাতুল, যে ভ্রাতুষ্পুত্রীর জন্য আমায় এতো অপমান করলে সে নিজ হাতে তোমাদের জমিদারির ইমারতে আগুন লাগিয়েছে। এখন দাউদাউ করে জ্বলে ছারখার হওয়ার পালা। নবাববংশের অন্ধকারচ্ছন্ন অতীত চন্দ্রপুকুর ফাইল এখন মিস্টার আর.কে. হকিংসের হস্তে। চন্দ্রমল্লিকা নিজ হাতে তুলে দিয়েছে।”

বজ্রপাত হয় যেন সকলের মাথায়। যামিনীও তার ব্যতিক্রম নয়। ভাবে,

– চিঠিদাতা তবে মোর্শেদা খাতুন!

মোর্শেদা খাতুন ক্রোধে ও প্রতিশোধ নেওয়ার উত্তেজনায় খুলে বলে প্রতিটি ঘটনা। কীভাবে শুরু হতে চিঠিদাতা রূপে তো কখনও দিলরুবা, মোহিনীর সহায়তায় বিভ্রান্ত করেছে যামিনীকে।

আরও বলেন,

“আমি যখন হতে জানতে পেরেছি এই বেজন্মার সাথে মেহমাদের বিবাহের কথা তখনই পরিকল্পনা করে ফেলেছিলাম। যেই কন্যার মাতা ও পিতা আমার স্বপ্নে ধ্বংস নামিয়েছিল, তার দ্বারাই এই নবাব বংশকে ধ্বংস করবো আমি। এজন্যই তো দিলরুবাকে প্রেরণ করি তোমার নিকট, মেয়েটার আনুগত্যের অভিনয়ও লাজবাব!

মেহমাদ কাজের ব্যস্ততায় তাকে সময় দিতে পারছিল না। আবার ছিল পূর্বের মান-অভিমান। আমি জানতাম যামিনী তার মাতৃত্বের সত্য গোপন করেছে এ তথ্য পেলে মেহমাদ রাগবেই। এই যোগাযোগের অবনতির সূক্ষ্ম বিষয়টিরই ফায়দা নিয়েছি আমি। ধীরে ধীরে তার হৃদয়ে সন্দেহের দ্রবণ গাঢ় করেছি মেহমাদ আর মেহনূরকে নিয়ে। যাতে সে নিজেকে অবহেলিত, উপেক্ষিত বোধ করে। আর হয়ও তা। মেহমাদের উপর তার বিশ্বাস নড়বড়ে হতেই আমি শেষ চাল দেই চিঠিদাতা হয়ে।

আর আরমান শাহ? গুলবাহার? তাদের মতোন বোকা তো কেউ নেই। তাদের তোমরা সত্য কখনও পুরোপুরি বলোনি। তাই আমার সত্য-মিথ্যের মিশ্রণ এবং নিজের চোখের দর্শনই তারা বিশ্বাস করেছে। তারা ভেবেছে ঐ আলিবর্দি শাহের ইশারায় সব হয়েছে, নিজের বংশমর্যাদার দম্ভে সে এ কার্য করেছে। আর আপনারাও নিজেদের দাম্ভিকতায় প্রতিবাদ বা বাধাদান করেননি। আপনার নিজের পুত্রই এই ধ্বংস চালনা করার চালিকাশক্তি তথা অর্থ প্রদান করেছে আমায়।”

শাহাজাদি জান্নাতুল নিজেকে শক্ত রেখে প্রহরীদের আদেশ করেন,

“এই নারীকে বন্দীশালায় বন্দী করো। জলও যেন তার গলা দিয়ে না নামে।”

মোর্শেদা খাতুন যেতে যেতে শুধান,

“করো আমায় বন্দী। আমি মরবো, তবে তোমারাও বাঁচতে পারবি না। সবার প্রথমে ফাঁসবে তোমাদের প্রিয় জমিদার বাবু। সব ধ্বংস হয়ে যাবে, সব! আর যামিনী তোমার গর্ভবতী না হওয়ার পিছনের কারণটাও এই আমি! আমার নির্দেশেই দিলরুবা তোমায় খাবারের সাথে জন্মনিয়ন্ত্রণ ঔষধি আহার করাচ্ছিল।”

যামিনী নিঃস্তব্ধ। সে বোধ করতে পারছে না কী হচ্ছে বা কোন এমন প্রলয় ডেকে এনেছে সে। এ কেমন জটিলতর ধাঁধাময় পরিস্থিতি!

এদিকে এ সকল কথা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না বৃদ্ধার বয়স্ক হৃদয়। মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতে নেন বেগম লুৎফুন্নেসা। মেহমাদ শাহ দৌড়ে যেয়ে তাঁকে ধরে। যামিনীও এগিয়ে যায়।

“দাদীজান, নিজেকে শান্ত করুন! শান্ত করুন!”

যুবক তাঁর প্রিয় দাদীজানকে শিঘ্রই পালঙ্কে বসায়। যামিনী পানপাত্র এগিয়ে দেয়। গটগট করে পানি পান করে নেন বৃদ্ধা।

“তোমাকে বলেছিলাম মেহমাদ প্রেমে ডুবে মরো না। এই কন্যার আমাদের বংশের হলেও বেগম হওয়ার গুন তার মাঝে নেই। দেখো, আজ আমাদের এতোদিনের তৈরি সবকিছু এক মুহূর্তে ধ্বংস করে ফেললো পরের বুদ্ধিতে। তারও কী দোষ? বড়ো হয়েছে পরের আশ্রিতা হয়ে, নবাব বংশের মারপ্যাঁচ সে কী করে বোধগম্য করবে? কিন্তু তুমি কী করে এতোটা অসতর্ক হলে মেহমাদ?

ঐ কামরার চাবির উপর আমাদের ভাগ্য নির্ভর করে তুমি জানতে। তা অন্তরালে রাখার দায় তোমার ছিল। তাহলে চাবি কী করে যামিনীর হস্তে গেল? ঐ কামরায় সে কীভাবে প্রবেশ করলো? তুমি অসফল মেহমাদ, অসফল! এই অপরাধের জন্য ক্ষমা তুমি কখনোই পাবে না। কখনোই না! তোমাকে বিশ্বাস করাই আমাদের সবচেয়ে বড়ো ত্রুটি ছিল।”

আহত হয় মেহমাদ শাহ। অনুতাপসূচক তার চাহনি।

“দাদীজান, অনুগ্রহ করে এভাবে বলবেন না। আমি সহ্য করতে পারছি না।”

তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠে দাদীজানের মুখশ্রীতে। প্রিয় পৌত্রের মুখশ্রীর দিকে তাকানও না তিনি।

“সহ্য করার অভ্যাস করে নেও আমার প্রিয় পৌত্র। আগামীকাল এ বংশের নাম ধুলোর মিশতে দর্শন করতে হবে। এই বৃদ্ধ বয়সে এ দিনও দেখতে হচ্ছে, মৃত্যু যেন আসে এই বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখার পূর্বে। আয়েশা খাতুন, আমাকে আমার কামরায় নিয়ে চলো। প্রহর গুনতে থাকি সর্বনাশের অপেক্ষায়।”

আয়েশা খাতুন বেগম লুৎফুন্নেসাক নিয়ে বের হয়ে যান। যামিনী বেদনাদায়ক দৃষ্টিতে দেখে যায় সবটা নীরবে। এ কী কর্মকাণ্ড করলো সে! যাকে ভালোবাসলো তার চিতাও নিজে হস্তে সাজালো!

নিজের প্রিয় পুরুষটির দিকে তাকিয়ে কোনোরকম উচ্চারণ করে, “বাবু মশাই?”

মানুষটির দৃষ্টি মেঝেতে স্থির, মাথা নত। এই কঠোর পুরুষটি আজ কাঁদছে, মেঝেতে টপটপ কয়ে বেয়ে পড়ছে স্বচ্ছ নোনাজল।

তার দিকে না তাকিয়েই মেহমাদ শাহ বলে উঠে,

“দোষটা তোমার একার নয়, আমিই অধম এখনও তোমার বিশ্বাস পুরোপুরি অর্জন করে নিতে পারিনি। তবুও মনের মাঝে আর্তনাদ করে কেউ জিজ্ঞেস করে, আমাকে আর একটু বিশ্বাস করা যেতো না? তবে তুমি খুশি হও। লোকচক্ষুর নজরে তুমিই কাল বড়ো হতে চলেছো, সবাই জানবে তুমিই উন্মেচন করেছে শেরপুরের নবাববংশের এই কালো অতীত ও রহস্য। আর আমি হতে চলেছি সবার সম্মুখে নরকের কীট অপক্ষের অধম!”

রমণী কী বলবে ভেবে পায় না। তবুও কিছু বলতে নেয়, তবে না শুনেই ক্রোধে হনহন করে বের হয়ে যায় মেহমাদ শাহ।

স্থির থাকে শুধু যামিনী আর শাহাজাদি জান্নাতুল। যুবতী জমিদারনির আজ প্রকৃতপক্ষেই নিজেকে অযোগ্য মনে হচ্ছে ‘বেগম’ পদবীর।

শাহাজাদি জান্নাতুলের মায়ের হৃদয় বোধগম্য করতে পারি প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রীর হৃদয়ের অবস্থা। সান্ত্বনার ভঙ্গিমায় কাঁধে হাত রাখে।

আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না কন্যা। ঝরঝর করে কেঁদে দেয় নিজের ফুপিজানকে জড়িয়ে ধরে।

“ফুপিজান এমন কী কার্য সম্পাদন হয়েছে আমার দ্বারা যে সবাই এতো নারাজ? আমি কীভাবে নিজের বংশের নিজের স্বামীর উপর তাণ্ডবলীলা আনলাম? কী আছে ঐ কাগজ-পত্রে যা ঐ শহুরে বাবুদের হাতে পড়ায় পতন হতে চলেছে শেরপুরের নবাব বংশের?”

সুদীর্ঘ এক শ্বাস ফেলেন মধ্যবয়স্ক মানুষটি। ক্লান্তির ভঙ্গিমায় জানান,

“এই যে জমিদারি দেখছো তা কিছুই আসলে আমাদের থাকার ছিল না। ছলনা, মিথ্যে, গ্রামীন মানুষদের অক্লান্তকর্মের উপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জমিদারি। এই ছলনা, মিথ্যের প্রমাণই ছিল ঐ ফাইলে। যা এখন গোটা দুনিয়া জেনে যাবে। যার জন্য গোটা দুনিয়ার নিকট আসামী হবো আমরা। পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে আমাদের। তবে নায়িকা হবে তুমি সকলের চোখে। সকলে জানবে মহৎ বলে তোমায় আমাদের রহস্য উন্মেচন করেছো জেনে। যাই হোক এ বিষয়ে আর ভেবে বা জেনে এ মুহূর্তে কোনো লাভ নেই।”

তিনিও দরবার ত্যাগ করেন। তবুও সম্পূর্ণ একাকি হয়ে যায় না যামিনী। আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা লোকমান শাহের বিধবা গুলবাহার খাতুনও ইতিমধ্যে মেঝেতে নিঃস্তব্ধ হয়ে বসে পড়েছেন।

___

আরমান শাহ অপেক্ষারত। অবশেষে তাঁর অপেক্ষার অবশান হয় টেলিফোনের ঘণ্টাধ্বনিতে। বিলম্ব না করে কলটি তুলেন তিনি

“এস.পি. খোঁজ নিয়েছো নীলকণ্ঠ দাসের আর চন্দ্রমল্লিকার? কী জানতে পেরেছো?”

এস.পি. সাহেবের মাঝে বিড়ম্বনা। যা সে জানতে পেরেছে তা শুনে মানুষটি ক্রোধান্বিত হবে কি না…

“কী হলো! কথা বলছো না ক্যানো এস.পি.?”

তাঁর ধমকে কম্পিত হয় পুরুষটি। ললাট হতে চিকন ঘাম বেয়ে পড়ছে।

“আসলে সাহেব, আমি অন্য একটি বিষয় জানতে পেরেছি। আমার তদন্ত মতে যামিনী আপনারই কন্যা। আপনি যেই নারীটির খোঁজ নিতে আমায় বলেছিলেন। নীলকণ্ঠ দাসকে উত্তম মাধ্যম দিয়ে জানতে পারি যামিনীর মাতা তিনিক। আর তাঁকে এতোকাল পাইনি কারণ তিনি মৃত।”

হাত হতে ধীরে ধীরে খসে পড়ে যায় টেলিফোনের হ্যান্ডসেট। আকস্মাৎ এ বজ্রপাত মেনে নিতে পারছেন না আরমান শাহ। শেষে কি না নিজের কন্যার জীবনটা নিয়েই প্রতিশোধের খেলায় মেতেছিলেন? নিজের কন্যার স্বামীকে ছিনিয়ে নেওয়ার জঘন্য পরিকল্পনা করছিলেন?

“ড্রাইভার! ড্রাইভার! গাড়ি বের করো! এখনই শেরপুর যাবো আমি।”

কোনোরকম চেঁচিয়ে কথাটা বলতে বলতে নিজের গায়ের চাদর নিয়ে বেরিয়ে যান তিনি। তবে এ যাওয়ায় কি কোনো লাভ আছে? ধ্বংসের সূচনা তো হয়েই গিয়েছে। রোধ করার আর উপয় কোথায়?

___

আকাশের বক্ষে গভীর রাত নেমেছে। বইছে ঝড়ো বাতাস। আছড়ে পড়ছে আকাশ হতে বজ্র, বর্ষণ হচ্ছে বৃষ্টির। প্রকৃতিও যেন জ্ঞাত আজকের রাত্রি কতোটা বেদনায় ভারি এই নবাব বংশের সদস্যদের জন্য।

কারো চোখে নেই নিদ্রা, নেই একটু খানি স্বস্তি। চোখ বদ্ধ করে, অবিরাম ধারা জল ফেলছে প্রতিটি নরনারী।

অনুতাপের জ্বলন্ত অনলে পুড়ছে যামিনী। তবুও কি ফেরানো যায় তার নেওয়া পদক্ষেপ?

আগামীকাল সকাল হতেই আসবে কতো শতো সাংবাদিক, পুলিশ। আসামীর ন্যায় ধরে নিয়ে যাবে তারই চোখে সামনে তার বাবু মশাইকে। অভিনন্দন জানাবে তাকে অপরাধীদের ধরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এ দৃশ্যের কথা ভাবতেই বক্ষ কাঁপে তার।

বারংবার মনে মনেই প্রশ্ন করছে সে নিজেকে কোনো কি উপায় নেই? পরিস্থিতি যেন চিৎকার করে উত্তর দিচ্ছে, ‘না, নেই রে সর্বনাশী! নেই!”। অতঃপর ক্রন্দনরত অবস্থাতেই নিজের ভালোবাসাকে হারানোর অপেক্ষার প্রহর গুনে যায়।
#চন্দ্রপুকুর
||শেষপর্ব|| (ইতি)
– ঈপ্সিতা শিকদার
বছরের সেরা সমাজকর্মীর পুরস্কার হাতে নিচ্ছে এক নারী। পরনে বোরখা ও হিজাব, কৃষ্ণাঙ্গ মুখমণ্ডল বৈকি কিছুই দৃশ্যমান নয়। উপস্থিত ভিনদেশী জনতা অবাক হয়ে দেখছে, এই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সাধারণত নারীদের সুনামধন্য কোনো ডিজাইনারের তৈরি গাউন এবং পুরুষদের স্যুটে দেখা যায়।

“কনগ্র‍্যাচুলেশন মিসেস. আকসা শাহ। what’s your feeling after getting this precious award?(এই মূল্যবান পুরস্কার পাওয়ার পর আপনার অনুভূতি কি?)”

“I just wanted to do something for the suffering people, especially for my people in my homeland. I am not as happy with this award as I am happy to be able to do something for them.

But yes this award, this stage has given me a platform to give a message to the whole world and I am thankful to the authorities for that. I just want to say Allah is the creator and owner of the world. We are all equal to him, rich and poor.

If God has given you money more then you need, then surely the poor, the destitute, the needy have a right to your money. Give it to them. Then one day no one will be found as poor.
(আমি শুধু দুঃখী মানুষের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলাম, বিশেষ করে আমার জন্মভূমির মানুষের জন্য। আমি এই পুরস্কার পেয়ে যতটা খুশি নই, তাদের জন্য কিছু করতে পেরে আমি খুশি। তবে হ্যাঁ এই পুরস্কার, এই মঞ্চ আমাকে পুরো বিশ্বকে একটি বার্তা দেওয়ার একটি প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে এবং এর জন্য আমি কর্তৃপক্ষের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি শুধু বলতে চাই আল্লাহ পৃথিবীর স্রষ্টা ও মালিক। আমরা তার কাছে ধনী-গরীব সবাই সমান। আল্লাহ যদি আপনাকে টাকা বেশি দিয়ে থাকেন তাহলে আপনার প্রয়োজন, তাহলে অবশ্যই আপনার টাকায় গরীব, নিঃস্ব, অভাবী মানুষের অধিকার আছে। তাদের এটা দিন। তাহলে একদিন কাউকে গরীব হিসেবে পাওয়া যাবে না।)”

কৃষ্ণকায়ার নারীটির কথায় কড়তালির স্রোত বয়ে যায় বিশাল ঘরে। দূর থেকে একজন তা দর্শন করে মৃদু হাসে। মানুষটি আর কেউ নয়, জনাব আরহান করিম হকিংস।

উপস্থাপক প্রশ্ন করে উঠে,
“You are a very brave woman. We all know how you took the initiative to tell the world about the truth of Sherpur Zamindar or Zamindar Nawab Alivardi Shah of Bengal and also revealed the black truth of Shah Group & Company. But I really wanted to know if you felt any fear or suspicion before doing this?(আপনি খুব সাহসী মহিলা। আমরা সবাই জানি আপনি কীভাবে শেরপুরের জমিদার বা বাংলার জমিদার নবাব আলীবর্দী শাহের সত্যতা বিশ্বকে জানানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং শাহ গ্রুপ অ্যান্ড কোম্পানির কালো সত্যও প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু আমি সত্যিই জানতে চেয়েছিলাম যে আপনি এই কাজ করার আগে কোন ভয় বা সন্দেহ অনুভব করেছিলেন?)”

“No, because I had, have and will have a person who supports me, believes in me more then anything.(না, কারণ আমার এমন একজন ব্যক্তি ছিল, আছে এবং থাকবে যে আমাকে সমর্থন করে, আমাকে যে কোনো কিছুর চেয়ে বেশি বিশ্বাস করে।)”

উত্তর দিতে দিতে দর্শকদের মাঝে বসে থাকা একজনের দিকে তাকিয়ে হাসে সে। তার দৃষ্টিতে শুধুই কৃতজ্ঞতা।

“But if you can be the most famous model of this era, then why not be a model? Why choose a full-time social worker and book writer?(কিন্তু আপনি যদি এই যুগের সবচেয়ে বিখ্যাত মডেল হতে পারেন, তাহলে মডেল হবেন না কেন? কেন একজন পূর্ণ-সময়ের সমাজকর্মী এবং বই লেখক বেছে নিবেন?)”

“That was never my goal. I just liked the concept of Mr. Hawkins project so I agree to work just for once.(সেটা কখনোই আমার লক্ষ্য ছিল না। আমি মিঃ হকিন্স প্রকল্পের ধারণাটি পছন্দ করেছি তাই আমি একবারের জন্য কাজ করতে রাজি।)”

বিভিন্ন ধারার ও ধরনের প্রশ্নে প্রায় দেড় ঘণ্টার কথোপকথন হলো জনপ্রিয় উপস্থাপক এডিসন ডে এবং যামিনীর মাঝে। সমাপ্ত হতেই রমণী খেয়াল করলো দর্শক শ্রেণীতে আর প্রিয় পুরুষটি নেই। চিন্তিত ভঙ্গিমায় স্টেজ হতে নেমে পড়লো সে।

কারো দিকে তার দৃষ্টি স্থির হলো না, কারো ডাক শ্রবণগত হলো না। উৎসুক চাহনি সমৃদ্ধ চোখজোটা চারদিকে বুলাতে বুলাতে বের হয়ে পড়লো বিশালাকার হলটি থেকে।

বাহিরে পার্কিং লটে নিজের গাড়িটির সামনে দাঁড়ালো। ভিতরে চোখ রাখলো সে। মানুষটি তো নেই। শুধু চালকের আসনে বসা আহিল।

“তোমার ভাই কোথায়? কতোক্ষণ পূর্বে তো বসে থাকতে দেখেছিলাম, এখন দেখছি না।”

“ভাই তো নিজের গাড়ি আনিয়ে চলে গেলেন বাড়িতে।”

হতাশ হলো কন্যা। এই পুরুষটিকে চোখে হারায় সে, দৃষ্টির আড়াল হওয়া সহ্য হয় না। তার কোনো উত্তরে রাগ করেনি তো আবার?

“বাসায় নিয়ে চলো আমায়, আহিল।”

“কিন্তু ম্যাম আপনার না অনুষ্ঠান আছে? আপনার বিজয় উপলক্ষে পার্টি তো আজ।” অবাক হয়ে প্রশ্ন করে আহিল।

“উফঃ আহিল! এতো প্রশ্ন কোরো না নিজের স্যার নামক ভাই আরহানের ন্যায়। পার্টি তুমি, দিনার সামলে নিয়ো। বোলো আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। এখন চলো।”

গাড়িতে চড়ে বসে যামিনী। লন্ডনে ট্রাফিক জ্যাম খুব একটা দেখা যায় না। বাড়িও কাছে হওয়ায়, খুব তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেল যামিনী। শুভ্র রঙার অট্টালিকার দ্বারে যেয়ে থামে গাড়ি।

রমণী নেমে যায়। অভ্যন্ত প্রবেশ করতে করতে জমিদারনির ন্যায় আদেশ করে,
“এক বিন্দু দাঁড়াবে না এখানে। সোজা পার্টিতে যাবে। আর কেউ আমার আর তোমার ভাইয়ের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে আমি যেটা বলেছি সেটাই বলবে।”

আহিল ভেঙচি কাটে। বিড়বিড়ায়,
“এতো বছর লন্ডনে জমিদারি এখনও ছাড়ে নাই।”

গোটা অট্টালিকায় গা ছমছম করা নীরবতা। আজ বাড়িতে কোনো মানুষ নেই। খানসামা এবং দুজন চাকরও ছুটিতে।

তরুণী জ্ঞাত তার প্রিয় মানুষটির এখন কোথায় থাকার কথা। কোনোদিকে না তাকিয়েই সে চলে যায় বাড়ির পিছনের আঙিনায়।

চোখ জুড়িয়ে যায় তার। পুকুরে ভাসছে গোলাপের পাপড়ি ও প্রদীপ। মনোরম এক দৃশ্য। তবে তার তিনি কোথায়?

আঙিনার এক প্রান্তে উলটো দিকে ঘুরে আকাশ পানে তাকিয়ে পানীয় পান করছে। যামিনী ছুটে যেয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে। উন্মুক্ত সদ্য ভেজা পিঠে মিশে যায় তার দেহ, ভিজে যায় পরনের বোরখাটি।

“আপনি চলে আসলেন ক্যানো? আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এতো পোড়ান ক্যানো বলেন তো?”

পিছনে ঘুরে তরুণ। নিজের বাবু মশাইয়ের চেহারা হৃদয় উজাড় করে দর্শন করে সে।

মেহমাদ শাহ ব্যঙ্গ করে বলে উঠে,
“পুড়তে ভালোবাসো বলেই তো পোড়ো, দোষটা তবে দোষটা ক্যানো শুধু আমার ললাটেই দেও?”

শব্দ করে হেসে দেয় যামিনী। মানুষটির এখনও এতোটা স্পষ্ট ভাবে মনে আছে তাকে জুড়ে থাকা সকল ঘটনা। গলা জড়িয়ে ধরে ললাটে চুমু খায়।

তখনই একদল চেঁচিয়ে উঠে,
“দেখে ফেলেছি! দেখে ফেলেছি!”

আঁতকে উঠে সরে আসে যামিনী। পিছনে তাকায়। বেগম লুৎফুন্নেসা, বেগম নূর বাহার, গুল বাহার খাতুন, শাহাজাদি জান্নাতুল, আরমান শাহ, জনাব আরহান, আহিল, মিনার, দিনার আপন সকলে দাঁড়িয়ে।

“আপনারা এখানে…?” আনমনেই মুখ থেকে নির্গত হয় যামিনীর।

তখন মেহমাদ শাহের সাথে সকলে একই সুরে গেয়ে উঠে,
“হ্যাপি বার্থডে টু ইউ,
হ্যাপি বার্থডে টু ইউ,
হ্যাপি বার্থডে টু ইউ
ডিয়ার চন্দ্রমল্লিকা।”

আরমান শাহ কেক নিয়ে এগিয়ে আসেন তার দিকে। যামিনী কেক একটু খানি কেটে খায়িয়ে দেয় বাবাকে। বাবাও আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা জানান জন্মদিনের।

“শুভ জন্মদিন আমার রাজকন্যা। বাবা তোমায় অনেক মনে করেছি।”

দাদীজান নিজ হাতে তার উদ্দেশ্যে ক্ষীর করে নিয়ে এসেছেন, তা-ই আগে আহার করানোর তাড়া তাঁর মাঝে।

“আরে সামনে থেকে সরো তো আরমান। মেয়েটাকে আগে একটু মিষ্টি মুখ করাই। কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে আমার জাহানের আলো, আমার আকসা।”

যামিনীর চোখে নোনাজল এসে ভিড় জমান। এতোটা সুখ বুঝি তার ললাটে ছিল! মনে মনে ভাবে সেদিন রাত্রিতে যদি ঝড়টা থামাতে নিজেকে না জাগ্রত করতো তবে এই সুখী পরিবার আজ কোথায় পেতো!

অতীত,

রাত প্রায় দেড়টা। হুট করে নিজের মধ্যে এক অন্যরকম স্ফূর্তি বোধ করে যামিনী। তার মনে হলো এভাবে হাতে হাত রেখে বসে ধ্বংসের অপেক্ষা করার কোনো অর্থ হয় না।

একটা প্রচেষ্টা তো করা উচিত নিজের প্রিয় ও আপন মানুষদের রক্ষার্থে। আর একটি সুযোগ তো নিজেকে দেওয়া উচিত। তবে এর জন্য সবার পূর্বে প্রয়োজন সেই আঁধার রহস্য উদঘাটন করার তথা নিজে জানার।

সে জানে কার নিকট এখন তার যাওয়া উচিত। কার নিকট গেলে এ তথ্য সে পাবে।

শাহাজাদি জান্নাতুল সালাতে বসে কাঁদছেন, আল্লাহর নিকট ভিক্ষে চাইছেন মার্জনার। যামিনী অনুমতি ব্যতীতই কক্ষের দ্বার খুলে প্রবেশ করে।

কোনোরকম ভূমিকা ব্যতীত জিজ্ঞেস করে,
“ঐ লাল চন্দ্রপুকুর ফাইলে কী ছিল?”

হুট করে মেয়েলি কণ্ঠে এ প্রশ্নে বিস্মিত হন মধ্যবয়স্ক নারী। দ্রুতো মোনাজাত সমাপ্ত করে উঠে দাঁড়ান।

“এখন আর এসব জেনে কী লাভ? বিনা কারণে অতীতের আবর্জনা ঘাটলে শুধু গন্ধই বের হবে।”

“আমি তবুও জানতে চাই ফুপিজান। আপনার কাছে এ প্রথম ভ্রাতুষ্পুত্রী রূপে কিছু চাইলাম। ফিরিয়ে দিবেন না দয়া করে।”

মাথা দুলিয়ে সায় জানায় শাহাজাদি। জায়নামাজ ও হিজাব ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখতে রাখতে রাখতে বলতে শুরু করেন লাল ফাইলটির কালো রহস্যের বিষয়ে।

“জমিদারের নিকট সবচেয়ে অধিক প্রাধন্য পায় জমিদারি, নবাবের নিকট রাজত্ব। যুগে যুগে এই জমিদারি, রাজত্ব বাঁচিয়ে রাখতে শুধু ত্যাগই করতে হয় না, নিতে হয় আশ্রয় কপটতার, ধূর্ততার, অনৈতিকতার। আমাদের নবাব বংশও তার ব্যতিক্রম নয়।

আমাদের পূর্ব পুরুষ নিজেদের শাসনকাল স্থায়ী রাখতে বহুবার কলুষিত করেছে আমাদের গা। ব্রিটিশ রাজত্বকাল, ১৭৯৩ সালে সূর্যাস্ত আইন প্রণয়ন হয়। সাত বছরের মধ্যেই দিতে হতো রাজস্ব কর। তখন জমিদারপ্রথাই কোনোরকম শেষ শ্বাস নিচ্ছে রাজতন্ত্র প্রায় বিলুপ্ত।

আমাদের বংশও নবাবী ত্যাগ করে জানা যেতো জমিদার হিসেবে। হুট করে এমন সংবাদ জেনে বাংলার অন্যান্য নবাবদের সহিত তৎকালীন শেরপুরের জমিদার আমাদের পূর্বপুরুষ তথা জমিদার মাহতাব শাহও কম্পিত হন।

গোটা শেরপুরের রাজস্ব কর, এতো অর্থ একত্রে জোগাড় করা সহজ কথা নয়। তবে সৌভাগ্যবশত আমার দাদাজান মাহতাব শাহের ব্যবসা বাংলা পর্যন্তই স্থির ছিল না, ছিল ব্রিটিশ অবধি। ইউরোপে ঢুকে গিয়েছিলেন, যদিও এর জন্য ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের খুশি করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।

সেই ব্যবসার হাত ধরেই বিদেশী বাজার থেকে করের অর্থ তুলে সাত বছরে কর পরিশোধ করেন। কী যে ঋণের বোঝা তখন আমাদের বংশের উপর! ভাবতেই বুক কম্পিত হয় আমার।

প্রায় পঞ্চাশ বছর এই ঋণের বোঝা সহ্য করে বেড়ায় আমাদের বংশধরেরা। আল্লাহর সহায়ে অতঃপর ঋণ মুক্তি। ততোদিনে ভারত ভাগ হয়ে স্বাধীন হলো, পাকিস্তানি আমল। তখন জমিদার আলমগির শাহ জমিদার, আরও বিপদ।

সরকার না নিজের অধীনে নিতে চায় এসব জমি স্বল্প কিছু অর্থের বিনিময়ে। হলোও তাই। দুঃস্বপ্ন দেখলেন যেন আমাদের জমিদার। বহু ঝড়-ঝামেলার পর, সরকারি কর্মকর্তা মন্ত্রীদের অর্থ কোটি কোটি রুপি খাওয়াতে হয়।

আবারও ঋণের বোঝায় পড়ি আমরা। এই ঋণ শোধ করতে অধিক পরিমাণ কৃষকদের অল্প আয়ে খাটাতে হতো। তখনও কৃষকরা ও গ্রামবাসী আমাদের ভক্তি করতো প্রচুর। তাই শহুরে যায়নি ভালো সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পরও। তবে এ ভরসা বেশি দিন টিকেনি। তারা শহুরে যাওয়া শুরু করে। দুইবার এতো অর্থের ঝড়ে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এমনিতেই শোচনীয়, তার উপর কৃষক হারা হয়ে পড়ায় আমাদের জন্য মরার দশা। ঐ সময় নিজেদের বাঁচাতে প্রচণ্ড জঘন্য এক কাজ করে নবাব।

আব্বাহুজুর শহুরে যাওয়া গ্রামবাসীদের ধরে ধরে অপহরণ করে হত্যা করে ফেলতেন। তখনকার গ্রামের মানুষজন প্রচণ্ড কুসংস্কারচ্ছন্ন ছিল, সুবিধাই হয় জমিদারের তথা আব্বাহুজুরের। এক মিথ্যে পীরের দ্বারা গুজব ছড়ালেন এক জ্বীন গোষ্ঠী অভিশাপ দিয়েছে এই শেরপুরের গ্রামবাসীরা শেরপুরের সীমানা হতে পেড়িয়ে গেলেই মারা যাবে।

এই হত্যাকাণ্ডে প্রায় শত খাণেক মানুষ মারা যায়। আব্বাহুজুর এ অপকর্মের জন্যই অদ্ভুৎ সব নিয়ম করেছিলেন। যেমন যোগাযোগ ব্যবস্থা এতো স্বল্প রাখা ও উন্নত ব্যবস্থা না গ্রহণ , শাহাজাদাদের সবার সামনে না আনা, শহরে এবং বিদেশ ও শেরপুরে নবাববংশের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিনিধি রাখা, একাধিক স্ত্রী বা সঙ্গী না রাখা যেন রহস্য অধিক মানুষের নিকট না যায় ও ফাঁস না হয়। কারণ সাংবাদিকদের কানে বা উপরিমহলের কানে পুরোপুরি খবরটি গেলে, সত্য ঠিকই বেড়িয়ে আসতো।

কিন্তু আব্বাহুজুর যখন এই শাসন রক্ষা করতে নিজের পুত্রকেই ক্রোধে হত্যা করে ফেলেন তখন মাস না পেড়োতেই অপরাধবোধ পুরোপুরি কুড়ে কুড়ে খেতে শুরু করে তাঁকে। ঐ ফাইলে তাঁর স্বীকারোক্তি চিঠিই ছিল, সাক্ষর ও শিলমোহর সহ। মৃত্যু নিকটে বুঝতে পেরে হয়তো লিখেছিলেন। সেখানে তিনি আমাদের নিকট ও শেরপুর বাসীর নিকট ক্ষমা চেয়েছিলেন এবং বলেছিলেন এই চিঠি যেন কখনও না বিনষ্ট হয়। তাই কাগজটি চেয়েও নষ্ট করিনি আমরা তাঁর কথার সম্মানে।

আরও একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ট্যাক্স বা কর দেওয়ায় অনেক গাফলতি আছে। যা কিছু কর্মচারীদের দিয়ে টাকার জোরে চাপিয়ে রাখা হয়। আমাদের করা গড়মিল তথা প্রকৃত কাগজপত্রগুলো ঐ ফাইলে। যা কারো হাতে পড়লেই কোম্পানির চেয়ার পার্সন হিসেবে মেহমাদের এবং আরও কয়েকজনের জেল হতে সময় লাগবে না।”

“ছিঃ! দাদাজান এতো নিষ্ঠুর ছিল।”

মাথা নত করে ফেলেন শাহাজাদি জান্নাতুল। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। সাধারণত পিতাকে নিয়ে একটি মন্দ মন্তব্যই ক্রোধ বাড়িয়ে দিতে পারে, তবে তাঁর এমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তিনি যে বাস্তবতা জানার সাথে সাথে মানেনও।

অত্যন্ত তাড়াহুড়োর সহিত দৌড়ে কামরায় প্রবেশ করেন আয়েশা খাতুন। এতোটা উর্ধ্ব গতিতে তিনি দৌড়ে এসেছেন যে হাঁপানির জন্য ঠিক ভাবে কথাও বলতে পারছেন না।।

“কী হয়েছে আয়েশা খাতুন? আপনি এভাবে…? কোনো সমস্যা?”

“শাহাজাদি, আজ আপনাদের আকাশের চাঁদ আবার ফিরেছে। আরমান বাবু এসেছেন এতো বছর বাদে।”

শব্দহীন হয়ে পড়ে শাহাজাদি জান্নাতুল ও যামিনীর শব্দভাণ্ডার। যামিনী তো কিছুতেই বোধ করতে পারছে না তার বাবা এসেছে। হ্যাঁ, কিছু কাল পূর্বেই সে জেনেছে নিজের পিতৃপরিচয়, যে পিতার পরিচয়ের জন্য সারা ছেলেবেলা সে মানুষের কথা শুনেছে আজ তাকে সচক্ষে দেখবে সে।

“তুমি কি মজা করছো? সত্যি আরমান ভাইজান এসেছেন?”

“নাউজুবিল্লাহ শাহাজাদি, আপনার সাথে দুষ্টুমি করার ত্রুটি আমি করতে পারি? কখনোই না।”

শাহাজাদি জান্নাতুন অতঃপর যামিনীত হাত ধরে বেগম লুৎফুন্নেসার কামরার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।।কারণ আয়েশা খাতুনের তথ্য মতে সেখানেই আরমান শাহ উপস্থিত।

গুলবাহার খাতুন, আরমান শাহ অপরাধীর ভঙ্গিমায় বসে আছেন। এখানে আসলে সর্বপ্রথম সাক্ষাৎ হয় গুলবাহার খাতুনের সাথে। কথা বলে বোধ করেন কতো বড়ো ত্রুটি করেছে তাঁরা।

আরমান শাহ সকলের সামনে হাতজোড় করে ক্ষমার অনুরোধ করে ভাঙা গলায়,

“শোকে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। বারবার মনে হচ্ছিলো আমার, যামিনীর মায়ের, লোকমান ভাইজান ও ভাবীজানের অপরাধী আব্বাহুজুর, এই বংশের অনড় দম্ভ, আপনারাও। কারণ আমি জ্ঞাত ছিলাম না এই সবে চাল ছিল মোর্শেদার। আমি ভেবেছিলাম আব্বাহুজুরই সব ঘেঁটে বের করে তুলে এনেছিল আমার প্রিয়তমাকে মিথ্যে দম্ভের জন্য। প্রিয়তমা যে এসে হুমকি দিচ্ছিলো মোর্শেদার উলটোপালটো বোঝানোতে তা অজানা ছিল। লোকমান ভাইজানকে হত্যার সময় যখন আপনারা কেউ এগিয়ে আসেননি, তখন আপনাদের উপরও ক্রোধ জমা হয়ে গিয়েছিল। আর আম্মিজানের উপর তো ঘৃণাই। বিশেষ করে যখন সে আমি প্রতিবাদ করলে তা অগ্রাহ্য করে আমায় শাস্তি দেয়। গুলবাহার ভাবীজানও ভেবেছিলেন তার স্বামীর মৃত্যুতে আপনারা দায়ী। আমরা মোর্শেদার ফাঁদে পা রেখে এতো বড়ো অপকর্ম করে ফেলেছি।”

তাঁর আকুতি কারো কর্ণগোচর হয় না। সবাই বিবর্ণ মুখে বসে। যামিনী স্মিত হাসি দেয় বাবার দিকে তাকিয়ে।

“যা করেছে, ভালোই করেছেন। আমার হাতে আমার স্বামীকে ধ্বংস করার ইতিহাস গড়তে চেয়েছেন।”

“আমাকে ক্ষমা করো মা। বাবা হিসেবে তোমার প্রতি কোনো কর্তব্য পালন করতে পারিনি। যখন তোমায় পেলাম, তখন কি না বোধ হলো অজান্তেই তোমার কত বড়ো ক্ষতি করে বসে আছি। তুমি যেভাবে বলবে আমি সেভাবে আমার অপরাধের শাস্তি পেতে রাজি, প্রায়শ্চিত্ত করতে রাজি। শুধু আমায় তুমি ক্ষমা করো।”

“সত্যি রাজি আব্বাজান?” তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায় যামিনী।

বিচলিত হয় উপস্থিত সকলে যামিনীর এমন আচারণে। তবে আরমান শাহ চোখ-মুখ মুছে খুশি হয়ে কন্যার পানে তাকায়।

“অবশ্যই আমার আম্মিজান, তুমি যা বলবে।”

“তবে মাথা পেতে নিবেন সকলের সামনে যে মেহমাদের ভরসায় ফয়দা উঠিয়ে মোর্শেদা খাতুনের ইশারায় ট্যাক্সে টাকায় আপনি গরমিল করেছেন। সেই অর্থ মোর্শেদা খাতুনকে দিয়েছেন।”

বজ্রপাত হয় সকলের মাথায়। এ কী বলছে এই কন্যা! বেগম লুৎফুন্নেসা ভ্রু কুঁচকে ফেলেন।

“এসব কী বলছো তুমি আকসা? তোমার মাথা ঠিক আছে?”

“অবশ্যই ঠিক আছে দাদীজান।”

ধীর পদচারণায় মেহমাদ শাহের নিকটে যায় সে। ছেলেটা নির্লিপ্ত ভাবে মেঝেতে বসে। তার হস্ত খানা নিজের হাতের মুঠিতে নেয়।

“আমি জানি আমি আপনার বিশ্বাস খুব বাজেভাবে ভেঙেছি। তবে এই শেষবার বিশ্বাস করে দেখুন আমায়, আফসোস করার সু্যোগ দিব না।”

অন্যরকম কিছু একটা ছিল যামিনীর কণ্ঠে, যার আভাস আগে কখনও পায়নি, যা যুবককে বাধ্য করে প্রেয়সীর কথা মানতে।

অতঃপর যামিনীর কথা অনুযায়ী মেহমাদ শাহ, যামিনী এবং আরমান শাহ রওনা হয় জনাব আরহান করিম হকিংসের কার্ডে দেওয়া ঠিকানায়।

আরহান দারোয়ানের মুখে বেগম চন্দ্রমল্লিকার আগমনের তথ্য পেয়ে নিদ্রা হতে উঠে চলে আসে বসার ঘরে। সাথে আরও পরিচিত দু’টি মুখশ্রী দেখে অবাক হয়।

“আমি চাই না আপনি ঐ ফাইলটির রহস্য সবার সামনে উন্মোচন করুন।”

অকপট কথা রমণীর। আঁধার রাতে তাদের সাক্ষাৎ পাওয়ার ধাক্কা সামলাতে সামলাতে এমন কথায় আরও অবাক যুবক। তার হাসি চলে আসে, ফিচেল হাসি।

“আপনার ক্যানো মনে হলো বেগম চন্দ্রমল্লিকা আমি আপনার কথা শুনবো? আর আশ্চর্য মানুষ তো আপনি! প্রথমে নিজেই হাতে তুলে দিলেন, এখন আবার বিড়ালের হাতে দুধ তুলে দিয়ে দুধ ফেরত চাচ্ছেন।”

“আমার বোঝায় ভুল ছিল।”

ফোঁস করে শ্বাস ফেলে উত্তর দেয় যামিনী। একে একে খুলে বলতে শুরু করে সকল ঘটনা কীভাবে তার জন্ম, কী করে লোকমান শাহের হত্যা, কী করে তার ও মেহমাদ শাহের বিবাহ হয় এবং কী করে তাকে ফাঁসানো হয়েছে।

সবকিছু শুনে জনাব আরহান করিমকে একটু নমনীয় হতে দেখা গেলেও খুব একটা ভাবান্তর তার মাঝে নেই।

“দেখুন, যতো যাই হোক বাস্তবতা তো এটাই জমিদার আলিবর্দি শাহ একজন খুনী ও দোষী। সত্য তো একসময় প্রকাশ হবেই। তাছাড়া আমি নিজের লাভ ছেড়ে তো আপনার লাভ দেখবো না। অযথা এখানে সময় নষ্ট না করে চলে যেতে পারেন।”

“হ্যাঁ, তিনি দোষী। সত্যি জানার হক দুনিয়া বাসীর আছে, আর তা আমরাই জানাবো। তবে এতে আমার বা বাবু মশাইয়ের তো কোনো ত্রুটি নেই। দেখুন, আমার বাবা-মায়ের অবৈধ সম্পর্ক ছিল কিন্তু শাস্তি পেয়েছি আমি ছেলেবেলা হতে, শ্বশুরালয়ে যেয়ে স্বামীসঙ্গ পেয়ে মনে হলো সুখের দেখা পেলাম কিন্তু লড়তেই হলো সারাটা সময়। মরণফাঁদে পা দিয়ে তা আর কোথায় সম্ভব হলো?”

যামিনী কথা শুনে শুধু আরহান নয়, মেহমাদ শাহ এবং আরমান শাহও অবাক। তাঁরা বোধগম্য করতে পারছে না এ কন্যা চাচ্ছেটা কী।

“আপনি একটু খোলাসা করে বলুন তো জনাবা। আপনারা সত্য জানাবেন অর্থ?”

“আগামীকাল একটা সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে আমার ও বাবু মশাইয়ের। যেখানে আমরা বলবো যে আমরা দু-তিন ধরে দাদাজানের চিঠিটা আবিষ্কার করেছি মোর্শেদা খাতুনের কামরা হতে। হয়তো তিনিও জড়িত ছিলেন বা তিনিই শুধু জানতেন। তাই আমরা বিশ্ববাসীর নিকট সত্য জানাতে ও শেরপুর বাসীর নিকট ক্ষমা চাইতে এই সাক্ষাৎকারের আয়োজন করেছি৷ আমরা সত্যিই দুঃখিত এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি জেনে। এজন্য আমরা একটি মোটা অঙ্কের অর্থ গ্রামবাসীর মাঝে বিলিয়ে দিচ্ছি। আরও জানাবো আমাদের কোম্পানিতে এতোকাল ধরে ট্যাক্সে গরমিল হচ্ছিলো, যার করছিলেন জনাব আরমান শাহ মোর্শেদা খাতুনের নির্দেশনায়। আমরা তাদের উভয়কেই পুলিশে ধরিয়ে দিব সেখানেই।

এতো বড়ো একটা ঘটনা ও রহস্য উন্মেচন করতে পেরে আপনি যেমন সাংবাদিক হিসেবে সফলতা পাবেন তেমনই আমাদের খুব একটা বদনামি হবে না। আর মেহমাদ জেলে যাওয়া হতে বের হয়ে যাবে।”

আরমান শাহ মুখ খুলেন এবার,
“এসব তুমি কী বলছো মা? মোর্শেদার বিরুদ্ধে প্রমাণ কোথায় পাবে তুমি?”

“প্রমাণ ক্যানো লাগবে? সে তো সোজা স্বীকারোক্তি দিবে। আসার পূর্বেই তাকে এসপি সাহেবের শরণাপন্ন করে এসেছি, বলেছি মেরে হোক, কেটে হোক, যেভাবেই হোক স্বীকারোক্তি লিখিয়ে নিতে।”

আরহান অবাক মেয়েটার সরল ভঙ্গিমা দেখে। মেহমাদ শাহ নির্বাক হয়ে দেখেই যাচ্ছে মেয়েটিকে।

“কিন্তু সাহেবা আপনার কেন মনে হলো আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি হবো? আর আপনি নিজেই নিজের পিতাকে জেলে দিবেন?”

“আমার মাতাকে দিনের পর দিন মিথ্যে বলে ঠকিয়েছেন। এতোটুকু তাঁর প্রাপ্য। তাছাড়া বেশি দিনের জন্য না তো, স্বীকারোক্তিতে মোর্শেদা নিজেই বলবে তিনি প্রাণের ভয় দেখিয়ে ও ক্ষমতার জোর খাটিয়ে আরমান শাহকে ব্যবহার করেছেন, তিনি দোষ। আর বিচারক তো আমাদের ক্রয় করাই থাকবে। দ্বিতীয়ত আসার পূর্বে আপনার দেওয়া নম্বরে কল করেছিলাম আমি, দাদাজানের এই সত্য নিজে জানারও পূর্বে।

ভেবেছিলাম যদি আকুতি করে আপনাকে ফিরানো যায়। কিন্তু নম্বরটা হয়তো অফিসের ছিল তাই রিসিভ করে আপনার কর্মচারী আহিল। তিনি আমি চন্দ্রমল্লিকা জানতেই শুধান, আপনি না কি যেতে যেতে সারা পথ আমার কথা বলে আক্ষেপ করেছেন। বলেছেন আপনার ‘আঁধারিয়া সৌন্দর্য ‘প্রজেক্টের জন্য আমার চেয়ে অধিক ভালো কেউ হতেই পারে না। আমি ঐ প্রজেক্ট করতে রাজি, অবশ্যই ছবিগুলো আমার চাহিদা অনুযায়ী হবে।

আর এই প্রজেক্টটা আমি করলে আপনার আরেকটা লাভ হবে, শেরপুরের খবরটা শুধু এদেশেই সবার আকর্ষণে দৃষ্টিতে আসবে বাহিরে না। তবে আমি যদি আপনার ঐ প্রজেক্টটায় কাজ করি, তাহলে কিন্তু আমার সূত্র ধরে এই প্রজেক্টটাও প্রশংসা কুড়াবে সকলের। তাছাড়া আপনি এখন বাংলায়, ব্রিটেইনে না, এখানে মানুষের জীবনের গ্যারান্টি আরও নেই। ক্ষমতার জোরে যে কেউ যে কাউকে উপরে উঠাতে পারে। আল্লাহ না করুক এই ফাইল নিয়ে অফিসে যাওয়ার পূর্বেই আপনি উপর… আমি আসলে শান্তি চাচ্ছি।”

জনাব আরহান করিম হকিংস শেষবাক্যের হুমকিটাও অতি সহজে অনুধাবন করে নিল। অনেক ক্ষণ ভাবলো, সে হিসাবী ও স্বার্থপর ধরনের মানুষ। নিজের লাভটাই প্রথমে বুঝে। আজও ভিন্ন পথে যাবে না। ঘণ্টা খাণেকের মাঝেই রাজি হয়ে গেলেন।

কিন্তু শর্ত জুড়ে দিলেন,
“আমি রাজি। কিন্তু আপনাকে আগামী মাসেই লন্ডন চলে আসতে হবে প্রজেক্টের কাজে।”

স্মিত হাসলো যামিনী। আর ভাবাভাবিতে যেতে হয়নি তাকে। যদিও তার প্রস্তাব নিয়ে বেগম লুৎফুন্নেসা কিছুটা সন্দিহান ছিলেন। তবে মেহমাদ শাহ তার উপর অনড় বিশ্বাস রেখেছিল। আর হয়েছিলও সব তার পরিকল্পনা মতে। প্রথম দিকে বেশ কয়েকজন ভৎসনা করলেও, অর্থ বিলিয়ে দিলে তাদের মুখ বন্ধ হয়। বাকিরা কালের পরিবর্তনের সাথে ভুলে যায়।

চুক্তি মোতাবেক একমাস পর যামিনী লন্ডন যায়। আরহানের ইচ্ছের বিরুদ্ধে সে ছবি তুলেছিল মডেল হিসেবে বোরখা-হিযাবে এবং রাণী বেশে রাজকীয় শাড়ি, মাথায় মোটা ওড়না ও নিকাবে। সেই সাথে যামিনীর জোরাজুরিতে মডেল হিসেবে নেওয়া হয় দুই জন আফ্রিকান নারীকেও। প্রজেক্টটি আশা হতেও অধিক সফলতা ও প্রশংসা কুড়ায়। এরপর হতে যামিনীকে বেশ শ্রদ্ধার চোখে দেখে আরহান।

লন্ডনে একমাস থেকে যামিনী জানতে পারে সে গর্ভিবতী। তার আর ঐ জমিদারির মারপ্যাঁচের দুনিয়ায় ফিরার ইচ্ছে হয় না। মেহমাদ শাহও ক্লান্ত, তাই শর্তহীন ভাবে মেনে নেয় তার ইচ্ছে। এখানে শাহ বংশের ব্যবসা ছিল পূর্ব হতেই তাই বাসিন্দা হতে কোনো সমস্যা হয়নি।

আর দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সামলাতে মিনার, আরমান শাহ, দাদীজান সহ সকলে তো আছেনই।

বর্তমানে,
কানে আলতো ব্যথা অনুভব হওয়ায় ঘোর ভাঙে যামিনীর। খেয়াল করে দেখে তার বাবু মশাই। বাকিরা যে যার মতো সময় উপভোগ করতে ব্যস্ত। তার আদুরে দুই সন্তান পরিবারের সাথে খেলায় ব্যস্ত।

“এতো ক্যানো ভালোবাসেন? এতো ক্যানো বিশ্বাস করেন?”

নাক টেনে মেহমাদ শাহ শুধায়,
“এতো ক্যানো ভালোবাসা চাও? এতো ক্যানো বিশ্বাস চাও?”

হেসে দেয় যামিনী। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার বাবু মশাইকে। “ভালোবাসি বাবু মশাই, অনেক ভালোবাসি” উচ্চারণ করে এক প্রেমাঘোরেই।

যামিনী তার চন্দ্রপুকুর পেয়ে গিয়েছে জীবনে। আর কিছু নেই চাওয়ার। চন্দ্রপুকুর হলো এক অবাস্তব কল্পনায় আঁকা স্থান, যেমনটি তার নিকট ছিল সুখ ও পরিবার৷ অবশেষে এ অবাস্তব কল্পনা, এখন প্রতিমুহূর্তে জীবনের বাস্তবতা৷

__সমাপ্ত__

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here