#চন্দ্রপুকুর
||৫ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
“না, বাবু মশাই আমাকে ছেড়ে যাবেন না আপনি। একটু অনুগ্রহ দেখান আপনার চন্দ্রমল্লিকার উপর।”
যামিনীর অভিমানী কণ্ঠ শ্রবণগত হতেই মেহমাদ শাহ কাগজপত্র থেকে চোখ উঠিয়ে তার ক্রন্দনরত মুখশ্রীর উপর দৃষ্টি স্থির করে। তার চন্দ্রমল্লিকা শিশুদের ন্যায় ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে। এমন শিশুসুলভ আচারণে স্মিত হাসে যুবক।
কিশোরীর নরম, শীর্ণ হস্ত খানা ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজের পাশে নরম গদিতে বসায়। যামিনী আদুরে বিড়ালের ন্যায় আরও গা ঘেঁষে বসে৷
বুকে মাথা রেখে বলে,
“বিয়ের দেড়মাস পর প্রথমবারের মতো আপনাকে নিকটে পেলাম। চারটে দিনও ঠিক-ঠাক কাটলো না, আর আপনি চলে যাবেন বলছেন। বাবু মশাই আর ক’টা দিনই থেকে যান না আমার শয্যায়, আমার বক্ষে।”
মেহমাদ শাহ তার মুখশ্রী বক্ষ থেকে তুলে দু’হাতে আগলে নেয়। দু’চোখের কোণে জমিত মুক্ত দানার ন্যায় ঝলমলে অশ্রু মুছে ধীর স্পর্শে।
“আমার মায়াবী হরিণী, আমার এলোকেশী, রাজকন্যা, সোনালি পক্ষী এভাবে নাবালকের সদৃশ কেঁদো না। আমাকে যেতে হবে চন্দ্রমল্লিকা। বহু কাজ পড়ে আছে, জমিদারদের জমিদারিই প্রথম অগ্রাধিকার। আমি আবার আসবো, বেশ খাণেক সময় নিয়ে আসবো।”
“তবে আপনার নিকটে নিয়ে যান। যেখানে সারাটা সময় নিজ নয়নযুগল ধন্য করতে পারি আপনাকে দেখে। আপনি হীনা আমি এক তৃষ্ণার্ত চাতক পাখি, যে ব্যাকুল আপনার একদফা দর্শন পেতে।”
ছলছল চাহনি ও অশ্রুভেজা কণ্ঠ যামিনীর। যুবকের হৃদয় ছুড়ি আঘাত করে যায় এরূপ প্রেমময় ও মাধুর্য পূর্ণ বাণীতে। হৃদয়ের সবটুকু অনুভূতি নিংড়ে ঢেলে দেয় কিশোরীর অধরে।
স্বীয় মনমোহিনীকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে শুধায়,
“নিয়ে যাবো তো, তোমার যোগ্য স্থানে তোমায় রাখতে হবে না? তুমি দোয়া কোরো আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট। আর হ্যাঁ, নবাব মেহমাদ শাহের স্ত্রীকে আঁখিজলে নয়, ঔদ্ধত্যে (গর্ব/অহং) মানায়।”
শেষ বাক্যটি শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করতেই যামিনীর ক্রন্দনরত মুখশ্রীতেই একগাল হাসি ফুটে উঠে। আরও গভীর ও দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে নিজের স্বপ্নপুরুষকে।
মেহমাদ শাহ তার থেকে বিদায় নিয়ে নবাববাড়ির জন্য যাত্রা শুরু করে ঘোড়ার গাড়ি করে। যামিনী সেই অবধি তাকিয়ে থেকে তার যাওয়ার পথে যেই অবধি গাড়িটি অদৃশ্য না হয়ে যায়।
___
উঠানে চাদর বিছিয়ে চৌকি পেতে বসে যামিনী তসবিহ পড়ছে, দিলরুবাও নিচে বসে আছে। সন্ধ্যালোকের আবছা আলো, মৃদু বাতাসে শীতল আবহাওয়া বেশ মন মাতানো পরিবেশই। তবে রমণী উদাস মনে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে। ভাবছে নিজের এই আলো-আঁধার সংসারের কথা।
সময় চলছে আপন গতিতে, এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে যামিনীর সংসারও। নয় মাস, সাধারণ হিসেবে প্রায় দুইশত সত্তর দিন কেটে গিয়েছে তাদের বিবাহের, অথচ সর্বমোট পঁয়তাল্লিশ দিনও হয়তো যামিনী তার বাবু মশাইকে পায়নি। নিজের মন্দ ভাগ্যের প্রতি উপহাস করে নিজেই হাসলো। আবার এক ফোঁটা অশ্রুও ফেললো।
বিড়বিড়ালো,
“আল্লাহ, আমি কতোটা মেহমাদকে চাই। তিনি শুধু আমার ভালোবাসা ও স্বপ্নই নয়, প্রয়োজনও। তবে এখন তিনি আমার নেশাতে পরিণত হয়েছে। না তাকে ছাড়া আমার দিন কাটতে চায়, আর শয্যাতে বিভীষিকাময় হয়ে উঠে রাত্রির অন্ধকার।
তিনি আমার জীবনের আশার চন্দ্রপুকুর। তুমি তো সবচেয়ে আপন তোমার বান্দার, সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী। উনাকে আমার নিকটে আনার তবে ব্যবস্থা করো না খুব দ্রুতো। আমি যে জীবনীশক্তিহীন হয়ে পড়ছি আমার বাবু মশাইকে ছাড়া।”
সেই মুহূর্তেই গোটা শিকার দালানে গুঞ্জন পড়ে যায় মেহমাদ শাহের আগমনের। অবিশ্বাস্য বোধ হয় রমণীর। এত সত্বর (দ্রুত) বুঝি দোয়া কবুল হয়?
সে অবিলম্বে দালানে ঢোকার সংকীর্ণ পথে যেয়ে দাঁড়ায়। হাতের ইশারায় স্থান শূণ্য করতে আদেশ করে সকল খাদিম ও দাসীদের। তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে কাঙ্ক্ষিত পুরুষটির আগমন হয়। তবে প্রতিবারের ন্যায় এবার মেহমাদ শাহের প্রাণচঞ্চল এক গালি হাসি বিদ্যমান মুখমণ্ডল দেখতে পায় না। শুধু দর্শন করে এক ক্লান্ত যুবককে।
মেহমাদ শাহ এগিয়ে এসে তার সম্মুখে দাঁড়াতেই রমণী ‘বাবু মশাই’ বলে হাতের পিঠে চুমু খায়।
“আসসালামু আলাইকুম। আপনি কেমন আছেন? সেই যে গেলেন আর তো এলেন না আপনার এই অধম চন্দ্রমল্লিকার নিকট। এতোটাই মুছে ফেলেছেন আমায় হৃদয়ের কিতাব হতে?”
যুবক নিঃশব্দে বক্ষে মিশিয়ে নেয় তাকে। আবেগ ভরা কণ্ঠে বলে উঠে,
“আমি ক্লান্ত চন্দ্রমল্লিকা। প্রচণ্ড ক্লান্ত এক সৈনিক। যে আঁধারের সাথে লড়তে লড়তে হারতে প্রস্তুত, তবে তুমি আমার এক ফালি চন্দ্রসুধা হয়ে লড়ার বল দাও। তুমি আমার প্রাণশক্তি ও প্রেরণার উৎস তুমি, চন্দ্রমল্লিকা। ভালোবাসি, চন্দ্রমল্লিকা।”
“আমিও ভালোবাসি। মাত্রা ছাড়ানো প্রিয় আপনি আমার।”
কয়েক মুহূর্ত উষ্ণ বন্ধনে পেড়িয়ে গেল। মেহমাদ শাহ নিজের থেকে সরিয়ে ফেলল যামিনীকে।
“এই কড়া রৌদ্রে এখানে আসতে আসতে ঘেমে-নেয়ে শরীর আঠালো হয়ে গিয়েছে। স্নান করতে হবে। আমি কক্ষে যাচ্ছি। তুমি দাসীদের বলো হাম্মাম খানা তৈরি করতে আমার স্নানের জন্য।”
হৃদয় মুচড়ে উঠে কিশোরী। মেহমাদ শাহকেও তার ন্যায় দাসীরা স্নান করাবে না কি সেই শঙ্কায়। এ যে একদমই তার চাওয়া ভিন্ন।
কিছুটা বিড়ম্বনা ও লজ্জা নিয়ে সে প্রস্তাব রাখে,
“আপনি যদি কিছু মনে না করেন বাবু মশাই আজ আপনাকে আমি স্নান করতে সহায়তা করি?”
দুষ্টু হাসে মেহমাদ শাহ।
“এতোটা অধৈর্য্য হয়ে পড়েছো কেন চন্দ্রমল্লিকা? তোমার শয্যাতেই তো রাত্রি পাড় হবে আজ আমার।”
অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে যামিনী। লাজুক হাসি খেলানো মুখে ঝুঁকে কোনোরকম বিদায় জানিয়ে চলে গেল।
এই রজনীটি ভয়ংকরতম সুন্দর কাটালো যামিনী মেহমাদ শাহের সঙ্গ পেয়ে। তবে সুখের সমাপ্তি করে ফজরের নামাজের পরেই বিদায় জানালো তার বাবু মশাই।
বিদায়ের লগ্নে মেহমাদ শাহের বক্ষে মিশে কেঁদে দেয় যামিনী। মেহমাদ শাহ রমণীর অশ্রু মুছে তার ডান হাতে লালচে রত্নে সজ্জিত স্বর্ণের তৈরি কঙ্কন পরিয়ে দিয়ে হাতের পিঠে গভীর চুম্বন করে।
“আমাদের খানদানী কঙ্কন আজ তোমায় দিলাম। আমার সকল ভালোবাসা, অনুভূতি মেশানো এই কঙ্কনে। যতোবার আমার স্মৃতি, প্রণয়ে দগ্ধ হবে ততোবার ছুঁয়ে দিয়ো এই কঙ্কনকে, মনে করবে আমাকেই ছুঁয়ে দিলে। করতে পারবে না আমায় ভালোবেসে আমার উদ্দেশ্যে অপেক্ষা?”
“আপনার চুম্বনরস, এমন কী একটা দর্শনই যথেষ্ট আমার জন্য এক যুগ পাড় করার জন্য। যন্ত্রণাদায়ক ভীষণ! তবে সবশেষে যখন আপনার নিকটে যাই বাবু মশাই তখন সব ভুলে যাই।”
অনুভূতিকে মাটি দিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে উঠে বসে মেহমাদ শাহ। তবে ব্যাকুলা পক্ষীর ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে যামিনী।
___
আজ প্রায় আড়াই মাস মেহমাদ শাহের আগমন হয়নি যামিনীর কক্ষে। চিঠি এসেছে এ অবধি তিনটে, তাও বেশ ক’দিন পূর্বে। তবে কিশোরী মানিয়ে নিয়েছে, প্রেমভক্তি নিয়ে অপেক্ষা করে আছে প্রিয়তমের আসার।
হিরের তাজটিকে মাথায় সাজিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছে যামিনী। আর চাপা হাসছে। এই তাজটি যখন মেহমাদ শাহ পঞ্চমবার এসেছিল তখন উপহার দিয়েছিল, রমণীর অত্যন্ত প্রিয় এটি।
তার আয়নায় নিজেকে পর্যবেক্ষণ করার মাঝেই দিলরুবা প্রবেশ করে। তাকে কেমন যেন উদ্বিগ্ন ও দ্বিধান্বিত দেখাচ্ছিল।
“কী হয়েছে দিলরুবা? কিছু বলতে চাও তুমি আমাকে?”
“বেগম, ক্ষমা করবেন। কীভাবে বলবো জানা নেই, তবে আপনাকে জানানো আবশ্যক। দালানে এবং সবার মাঝে গুঞ্জন চলছে জমিদার বাবুর না কি তার ফুপির দ্বিতীয় কন্যা মেহনূরের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
যামিনী স্তম্ভিত, দুঃখিত ভীষণ। মুহূর্তেই অসাড় হয়ে পড়ে, তার হাত থেকে পড়ে যায় প্রিয় তাজটি।
“দিলরুবা! তোমার স্পর্ধা কী করে হয় এমন উপহাস করার? আমি জানি আমার বাবু মশাইয়ের স্ত্রী তো আমি। সে অন্যকাউকে কেন বিয়ে করবে?”
“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন। বিশ্বাস করুন আমি মিথ্যে বলছি না, যা শোনা যাচ্ছে তা-ই বলছি শুধু।”
রমণী ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়ে। তার মন্দ ভাগ্যে এতোটা সুখ দেওয়ার পরে কেন ছিনিয়ে নিচ্ছে উপরওয়ালা? তীব্র বেদনায় চিৎকার করে কেঁদে উঠে। ক্রন্দনধ্বনিতে কেঁপে উঠে যেন গোটা দালানই। দিলরুবা চেয়েও থামাতে পারে না। তার হৃদয়ের ক্ষত যে এতো সহজে উপশম হওয়ার নয়।
|