#চাঁদোয়া_মহল
পর্বঃ১৬
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
শীতের আগমনী বৃষ্টির ছোয়া পেতে প্রকৃতি যেন উন্মাদ হয়ে আছে।এলোমেলো দক্ষিণা হাওয়া নিশ্বাসের সাথে দেহের গভীরে প্রবেশ করছে।সাথে সাথে অদ্ভুত শীতলতায় বুক ভরে উঠছে!হাল্কা আওয়াজে বজ্রপাত হচ্ছে।অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অগণিত পানির কণা জমিনের দিকে তড়িৎ বেগে ছুটে এলো।ভূমিতে বিলীন হওয়ায় জন্য যেন তাদের জন্ম!আরিফের মাঝে কোনো হেলদোল নেই।তার ভীষণ ইচ্ছে করছে বৃষ্টি হতে!ইচ্ছে করছে নওশিনের কায়ার প্রতিটি ভাঁজে বিশুদ্ধতার বর্ষণ করতে।বেলকনিতে দরজায় হেলান দাঁড়িয়ে আছে নওশিন।এক ধ্যানে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।আরিফ কাউচে বসে আছে।ফুলের গন্ধ নাকে ধাক্কা মারতেই বিছানার দিকে তাকালো।সাদা রঙের চাদরের মাঝে সাদা গোলাপের পাপড়িগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।মোমবাতির আবছা আলোয় দূর থেকে পাপড়িগুলো উপস্থিতি বোঝা না গেলেও,সুবাসে মাতোয়ারা করে তুলছে।আড়চোখে নিজের সদ্য বিবাহিত অর্ধাঙ্গিনীকে অবলোকন করছে আরিফ।নওশিন ঘুরে দাঁড়ালো।আরিফ ধরা পরে যাওয়ার ভয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।নওশিন একদম শান্ত হয়ে আছে।স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে আরিফের সামনে এসে উপস্থিত হলো।কোনো ভনিতা ছাড়াই বলে উঠলো,
-‘আমি ধর্ষিতা।’
——-
আজ সকাল থেকে আরিফ ও নওশিনের বিয়ের তোড়জোড় চলছিলো। তাদের বিয়ের খবরে প্রথমে সবাই কিছুটা হকচকিয়ে গেলোও,সুধা মির্জার সম্মতিতে সব হওয়ায় কেউ বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করে নি।মূলত বাঁধা দেওয়ার তেমন কোনো কারণও নেই।এ বিয়েতে সবচেয়ে বেশি খুশি হলো নওশিনের মা বাঁধন হক আর তৃণা মির্জা!যোহর নামাজের পর পরই তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।সেই সময় তিনবার কবুল বলার পর,পুরো দিনে এই মাত্র নওশিনের মুখ দিয়ে শব্দ বের হলো।আরিফের মনে হলো এই ধরার সবচেয়ে বিষাক্ত দুটি শব্দ তার কর্ণগোচর হয়েছে।নওশিন এতো সময় চুপ ছিলো এই তো ভালো ছিলো!কি দরকার ছিলো এসব কিছু বলার?আরিফের বুকে যে তীব্র দহন হচ্ছে,সেটা কি নওশিন দেখতে পাচ্ছে না!দেখবে করে সে তো আরিফকে সহ্যই করতে পারে না।
-‘আমি জানি।’
বহুকষ্টে মুখ আরিফের থেকে দুটি শব্দ বের হলো।নওশিন স্থির দৃষ্টিতে আরিফের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
-‘জেনে শুনে একজন ধর্ষিতাকে কেন বিয়ে করেছেন?সহানুভূতি দেখাতে,নিজেকে বড় প্রমাণ করতে নাকি আপনিও সুধা মির্জার হুকুমের গোলাম?’
-“আপনার মনকে উপার্জন করতে।”
-‘মানে?’
নওশিন ভ্রু কুঁচকালো।আরিফের কথা তার বোধগম্য হয় নি।আরিফ উঠে দাঁড়াল,নওশিনের চোখে নিজের চোখ মিলালো।
-‘আমি জানি আপনি পুরুষ জাতিকে ঘৃণা করেন।নিজেকে অপবিত্র ভাবেন।আমি আপনার সেই অপবিত্রতার পরিত্রাণ হতে চাই।আপনার রঙহীন হৃদয়কে রঙিন রঞ্জকে পরিপূর্ণ করার দায়ভার আজ থেকে আমার।’
নওশিনের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো।সে নতুন একটা বিষয় খেয়াল করলো আরিফ তাকে,শারাফের মতো আপনি বলে সম্মোধন করছে।আরিফের মুখনিঃসৃত মোহনীয় বাক্যের অতল গভীরে হারিয়ে গেল সে।ঘোর লাগা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো।
-‘এর বিনিময়ে আমার থেকে কি চান আপনি?’
-‘আমি যদি আমার কাজ যথার্থভাবে সম্পন্ন করতে পারি,উপার্জন স্বরূপ আপনি না হয় আমাকে আপনার মন রাজ্যের রাজা ঘোষণা করলেন।’
-‘এই কায়ায় এক নরপশুর অশুচি লেগে আছে।ভবিষ্যতে ঘৃণা হবে না তো!’
-‘আপনি অনুমতি দিলে এই মূহুর্তেই আপনার কায়ায়,আমার স্পর্শের প্রলেপ ছড়িয়ে দিতে চাই।’
নওশিন হুট আরিফকে গলা ঝাপটে ধরলো।পা দুটি ভূমি থেকে খানিকটা উপরে,আরিফের গলায় এক প্রকার ঝুলে আছে।আকস্মিক ঘটনায় আরিফ কিছুটা পিছিয়ে গেল।নিজের কাঁধে উষ্ণ পানির কণার গড়িয়ে পড়া উপলব্ধি করলো।দু’হাতে নওশিনকে সামলে নিলো।সেই অবস্থায় নওশিনকে পুষ্প সজ্জিত বিছানায় সযত্নে শুইয়ে দিলো।পাশে সুয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো।নওশিনের মুখটা নিজের সুবিধা মতো কিছুটা কাছে টেনে নিলো। কপাল জুড়ে এলোপাথাড়ি চুমু খেল।নওশিন চোখ বন্ধ করে আছে,নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে তার।কোথায় যেন পড়েছিলো কপালে চুমু খাওয়া হলো বিশুদ্ধ ভালোবাসার লক্ষণ।তাদের ভালোবাসাকে পূর্ণতা দিতে,নিজেও আরিফকে জড়িয়ে ধরলো।সে আজ বিবাহ নামক বিশুদ্ধ বন্ধনের কাছে বন্দী।
———
পুরোপুরি না থামলেও,বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমে এসেছে।বৃষ্টির কারণে রাতের তীব্রতা বেশ গভীর হয়ে জেঁকে বসে আছে। বেলকনির খোলা দরজা দিয়ে শীতল সমীরণ প্রবেশ করছে।ঘুমের মাঝে নওশিন কেঁপে উঠলো।আরিফ নওশিনকে ভালো করে ঢেকে দিলো।নিজেকে বেশ সুখী সুখী মনে হচ্ছে।পর মূহুর্তেই মনে পরলো,নওশিনের দেহের অপবিত্রতা ঘুচিয়ে দিলেও,মনের ব্যথার কি করে সারাবে?সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।আট বছর হয়ে গেছে তাও নওশিনের মন অশান্ত।জেদও কমে নি।নওশিনকে যে করেই হোক মির্জা ইন্ডাস্ট্রি থেকে দূর রাখতে হবে।সেখানে যেতে দেওয়ার মানে বিপদকে ডেকে আনা।কাল রাতে সুধা মির্জার বলা কথাগুলো আরিফের মনে পরলো।
—–
-‘মাসুকের মামা নাজিম হক,নওশিনের মা বাঁধন হকের দ্বিতীয় স্বামী।নওশিন বাঁধনে প্রথম ঘরের সন্তান।নওশিনের বাবা মারা যাওয়ার পর আজ থেকে দশ বছর আগে, নাজিমের সাথে বাঁধনের বিয়ে হয়।নওশিন তখন মন থেকে তাদের বিয়েটা মেনে নেয়।প্রথম দুবছর ভালো গেলেও।নওশিনের যখন আঠারো বছর হয় তখন তার সাথে ভয়ংকর এক ঘটনা ঘটে যায়।’
এ পর্যায়ে এসে সুধা মির্জা থেমে গেলেন।মনে মনে কথা গুছিয়ে নিয়ে আরিফের দিকে তাকালেন।তার অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করলেন।আরিফের চোখ জ্বলজ্বল করছে।সুধা মির্জা স্বাভাবিকভাবেই বললেন,
-‘সি ওয়াজ রেপড বাই হিজ স্টেপ ফাদার!’
আরিফ চোখজোড়া অদ্ভুত রকমের শীতল।তাকে দেখে বোঝায় উপায় নেই। ভিতরে ভিতরে সে ভীষণ অস্থির হয়ে গেছে।
-‘কেবল মাত্র আমি নওশিনের এই ইন্সিডেন্টের বিষয়ে অবগত।তুমি যেহেতু নওশিনকে বিয়ে করবে,সে হিসেবে তোমাকে জানানো আমি প্রয়োজন মনে করেছি।’
নিজেকে যথাসম্ভব ঠিক রেখে আরিফ কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-‘আর সেই ঘটনার পর আপনি নাজিম হককে নিরুদ্দেশ করে দেন!আর নিজ থেকে নওশিনের পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে নেন…..তাই তো?
সুধা মির্জার ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো।মৃদু হাসি বজায় রেখে বলে উঠলেন।
-‘কিছুটা তাই।সবার জন্য সে নিরুদ্দেশ হলেও আমার আর নওশিনের জন্য সে আছে।আমার টর্চার সেলে সপ্তাহের একদিন তার বেশ খাতির করা হয়।নওশিন নিজের হাতে তার যত্ন করে।’
-‘আইন নিজের হাতে নেওয়াটা কি ঠিক?বুঝলাম সে অন্যায় করেছে,তাই বলে আটটি বছর একটা মানুষকে আঁটকে রাখার কোনো মানে হয়?শারাফ ভাই এ কারণে আপনার ওপরে ক্ষুদ্ধ তাই না?’
-‘তোমাকে এসব ভাবতে হবে না।তুমি হয়ত ভুলে যাচ্ছো!তোমার মা বাবা মারা যাওয়ার পর আমি তোমাকে চাঁদোয়া মহলে নিয়ে এসেছিলাম।প্রতিদান স্বরূপ তোমাকে নওশিনকে বিয়ে করতে হবে।’
-‘আপনার প্রতিদানের জন্য না,নওশিনকে আমি ভালোবাসি।নওশিনের যতো খারাপ অতীত থাকুক না কেন,আমি সবসময় তার পাশে থাকবো।আপনি আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করুন।’
সেই রাতে কথা শেষ করে আরিফ সাথে সাথেই সুধা মির্জার কক্ষ ত্যাগ করেছিলো।
——-
-‘মাসুক ভাই সিমি আপুকে পছন্দ করে।’
-‘উহু…ভালোবাসে।’
-‘আপনি এ ব্যাপারে আগেই জানতেন?কিন্তু কি করে?’
-‘আমার অপ্সরা যেভাবে জেনেছে ঠিক সেভাবে।’
-‘মাসুক ভাইয়ের চোখ দেখলেই বোঝা যায়!আমি সিমি আপার দিকে মাসুক ভাইয়ের চাহনি দেখে সব বুঝে নিয়েছি।’
-‘আমি ব্যতিত সবার খবর আছে আপনার!তা চোখ দেখে কি মনে হয় আপনার?আমার উপচে পরা অনুভূতি আপনার নজরে পড়ে না?’
শারাফের কথায় চন্দ্ররেখার গাল লাল হয়ে গেল।ইস,এই লোক খালি কথায় কথায় তাকে লজ্জা দেয়।চন্দ্ররেখা সব বুঝে কেবল, স্বীকার করতে চায় না।প্রসঙ্গ বদলাতে চন্দ্ররেখা বলে উঠলো,
-‘জানেন আমার মায়ের বাড়ি ঝিল্লিপুরেই।কিন্তু কোথায় সেটা আমি জানি না।আপনি আমার মাকে খুঁজে বের করতে পারবেন?আমার বিশ্বাস সে আমার খুব কাছাকাছি আছে।’
শারাফ রেখার কাছাকাছি যেয়ে দাঁড়ালো। বৃষ্টি থামার পর পরই তারা দুজনে ছাদে এসেছে।নিকষ গভীর আধার।ঘোর অমাবস্যা।শরীর পশম দাঁড়িয়ে যাওয়ার মতো বাতাস বইছে।উড়নচণ্ডী হাওয়ায় শাড়ির আঁচল সামলানো দ্বায়।শারাফ নিকটে আসায় চন্দ্ররেখা নিজের শরীরে কিছুটা উষ্ণ পেল।আর একটু উষ্ণতা লাভের আশায় সে নিজেই শারাফের সাথে সেঁটে দাঁড়ালো।শারাফ চন্দ্ররেখার ব্যান্ডেজ ওপরে নিজের রুক্ষ ঠোঁট জোড়া ছুঁয়ে দিলো।তারপর ফিসফিস করে মাদকাসক্ত কন্ঠে বললো,
-‘আপনি যা চাইবেন সব দিবো।তার বদলে উপঢৌকন সরূপ আপনাকেও আমাকে কিছু দিতে হবে।’
-‘কি চাই আপনার?’
শারাফ চন্দ্ররেখার ঠোঁটের দিকে ইশারা করলো।চন্দ্ররেখা লজ্জা পাওয়ার বদলে, ড্যাবড্যাব করে শারাফের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার ঘোর লেগে গেল।দুই সেকেন্ড সময় নিলো।হুট করে পা জোড়া উঁচু করে শারাফের ওষ্ঠের মাঝে নিজেকে সমর্পণ করলো।পর মূহুর্তে সরে আসতে চাইলো।বহু চেষ্টা করেও তার বেসামাল স্বামীকে সামলাতে পারলো না।শারাফ ততক্ষণে চন্দ্ররেখার ওষ্ঠ নামক মহুয়াতে ডুবে গিয়েছে।তাদের সাথে তাল মিলিয়ে হওয়া যেন উত্তাল হয়ে উঠলো।ফার্ম হাউজের প্রাচীর ঘেঁষে দাড়িয়ে থাকা নারকেল গাছ গুলো বাতাসের তোড়ে জোরালো ভাবে নড়তে লাগলো।গাছের গায়ের লেপ্টে থাকা অমসৃণ বাকলগুলো খসে খসে ভূমিতে অর্পিত হতে লাগলো।
চলবে