চাদোঁয়া মহল পর্ব -১৯

#চাঁদোয়া_মহল
পর্বঃ১৯
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা

-‘আমার বাবা কোনো প্রতারক নন।’
চন্দ্ররেখার গলার আওয়াজ কানে পৌঁছতেই,সকলের দৃষ্টি সিঁড়ি ওপরের দিকে স্থির হলো।তার পরনে সাদা রঙের হ্যান্ড প্রিন্ট শাড়ি।জমিনে হালকা সবুজ রঙের ছোট ছোট ফুল।শাড়ির আঁচল টেনে মাথা ঘোমটা দিয়ে রেখেছে।চোখ কার্নিশ রক্তিম হয়ে আছে।নোনা পানি গড়িয়ে কপোলে পড়ছে।মনে মনে বেশ আঘাত পেলেও,নিজেকে বেশ শান্ত রেখেছে। হামিদ মির্জা চন্দ্ররেখাকে দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন।এ যেন কিশোরী সুধা-নিধির প্রতিরূপ!একবার সিঁড়ি গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা সুধা মির্জার দিকে তাকিয়ে,পুনরায় চন্দ্ররেখার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন তিনি।চন্দ্ররেখা ইতিমধ্যে নিচে নেমে এসেছে।পাশাপাশি দুটো সিঁড়ি হওয়ায় সুধা মির্জার ঠিক পাশের সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে চন্দ্ররেখা।দূর থেকে মনে হচ্ছে পারফেক্ট মা-মেয়ে জুটি।সুধা মির্জার পরনেও সাদা রঙের শাড়ি।যার কারণে তাদের মাঝে মেল প্রকটভাবে দেখা দিচ্ছে।হামিদ মির্জা ধীর পায়ে হেঁটে চন্দ্ররেখা সামনাসামনি এসে দাঁড়ালেন।মেয়েটিকে দেখে মনে মনে একটা অনুশোচনা কাজ করছে।তাজওয়ার চৌধুরীর ওপর ক্ষুদ্ধ হয়ে মেয়েটিকে সেদিন না দেখেই এসে পড়েছিলেন।এতোবছরে একবার খোঁজ খবর নিয়েও দেখেন নি।রেখা তো কেবল তাজওয়ার চৌধুরীর নয়,তার বোনেরও তো অংশ ছিলো।এতোবছর মা ছাড়া মেয়েটি এক প্রকার অবহেলায় বড় হয়েছে।হামিদ মির্জা বুকটা ভার হয়ে এলো।সেদিন তিনি একদমই ঠিক কাজ করেন নি।চন্দ্ররেখাকে বিয়ে করে,ছেলে তার সেই ভুল শুধরে দিয়েছে।

-‘আপনি আমার বড়।সে হিসেবে আপনাকে আমি যথেষ্ট সম্মান করি।কিন্তু আমার বাবাকে অহেতুক মিথ্যা অপবাদ দিলে,আমি একদমই সহ্য করবো না।একদমই না!’

চন্দ্ররেখা গলার স্বর অত্যন্ত শান্ত ও কঠিন।হামিদ মির্জা চমকে উঠলেন।তার সামনে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটির কন্ঠ থেকে যেন স্ফুলিঙ্গ ঝরছে।নিধির তো বরাবরই শান্ত ছিলো,এভাবে চোখে চোখ রেখে কোনোদিনই কারো সাথে কথা বলে নি।হামিদ মির্জা তার বোনের দিকে তাকালেন।সুধা মির্জা মাথা নিচু করে মেঝের দিয়ে তাকিয়ে আছেন।বুকটা ভীষণ দুরুদুরু করছে।হাত,পা তালু ঘেমে একাকার।তিনি ভাবছেন,শারাফের তখনকার সেই চাহনিতে কিছু একটা তো ছিলো!কিন্তু কি ছিলো?হামিদ মির্জা ভেবেছিলেন সুধা মির্জা চন্দ্ররেখা কিছু একটা বলবে।বোনের এরূপ বিমূঢ়তাতে তিনি বেশ অবাক।নিজ থেকেই বললেন,

-‘তুমি বলতে চাইছো তোমার বাবা নির্দোষ?’

-‘হ্যাঁ।আমার বাবা নির্দোষ।আমার বাবার যদি অন্য কোনো ইনটেনশন থাকতো,তাহলে কি সে নতুন করে জীবন শুরু করতো না?তাকে বাঁধা দেওয়ার মতো তো কেউই ছিলো না,চাইলে তিনি অনায়াসে আরেকটা বিয়ে করে নতুনভাবে নিজের জীবন সাজাতে পারতেন।অথচ বাবা কেবল আমাকে নিয়ে ভেবেছেন।আমার ভবিষ্যত ভেবে,কখনো নিজের জীবনে কাউকে জড়ানোর চিন্তাও করেন নি।মায়ের ভালোবাসা কি জিনিস আমি জানি না,কিন্তু আমার বাবার ভালোবাসার কোনো সমকক্ষ হবে না।’

চন্দ্ররেখারে চোখ থেকে অবিরাম অশ্রু ঝরছে।বাহিরে নিজেকে শক্ত খোলসে আবৃত করে রাখালেও ভেতরটা ভেঙে আসতে চাইছে।মনে অজস্র ভাবনারা কড়া নাড়ছে।এই পরিবারের একজন মানুষ বিগত উনিশ বছরের একদিন ও তাদের খবর নেয় নি।রেখা এ কয়দিনেই পরিবারের মানুষদের সাথের কতো সহজে মিশে গেছে।সে আসলেই অনেক বোকা!এতোদিন ভেবেছিলো এতো এতো ভালোবাসা তার কপালে সইবে কি না?কিন্তু সত্যি বলতে তো এই ভালোবাসা তার বহু আগে পাওনা ছিল।তখন এরা সবাই কোথায় ছিলো!চন্দ্ররেখার ঠোঁটের কোনে বিদ্রুপে হাসি ফুটে উঠলো।সবাই যে ভীষণ স্বার্থপর!তার মা ছিলো না বিধায় কি তাকে একবার দেখবেও না?সে যেন তার মা-বাবা ভালোবাসার মাঝের কাঁটা!শারাফের জন্য চন্দ্ররেখার হৃদয়স্থলে বেশ অভিযোগ জমেছে।মানুষটা জেনে শুনেই চন্দ্ররেখাকে এই চাঁদোয়া মহলে নিয়ে এসেছে।এদিকে হামিদ মির্জা চন্দ্ররেখার কথার বিপরীতে বলার মতো কোনো কিছু খুঁজে পেলেন না।আসলেই তো,তাজওয়ার শুধু শুধু কেন তার বোনের ক্ষতি করবে। দু’জন তো এক অপরকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলো।এসব চিন্তা ভাবনা সেদিন কেন আসেনি?যেদিন তাজওয়ারকে অপমান করেছিলো?তাজওয়ার তো সেদিন তেমন কোনো কৈফিয়ত দেয় নি।মুখটা বেশ মলিন হয়ে ছিলো।কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন নিধি কোথায় হারিয়ে গেল!সত্যি কি নিধি ….।হামিদ মির্জা প্রসঙ্গ বদলে,নমনীয় স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

-‘তাহলে নিধি কোথায় তুমিই বলো?এতো বছর খুঁজেও কেন,তাকে পেলাম না আমি?ঠিক কিসের ভিত্তিতে তুমি নিজের বাবাকে নির্দোষ বলসো!তুমি হয়ত ভুলে যাচ্ছো,আমার বোন তোমার মা হয়।তার বিষয়ে সবটা না জেনে,নিজের বাবাকে এভাবে অন্ধবিশ্বাস করাটা কি তোমার ঠিক হচ্ছে?’

চন্দ্ররেখাকে এবার কিছুটা দ্বিধান্বিত দেখা গেলো।সত্যি তো তার মা কোথায়?ঠিক কিসের ভিত্তিতে,এতোক্ষণ সে এসব বলে আসছে।সে তো এখন অবদি তার মাকে দেখেই নি।রেখা চট করে সুধা মির্জার দিকে তাকাল।এ নারীটি তার মায়ের জমজ বোন অর্থাৎ তার মায়ের প্রতিচ্ছবি।চন্দ্ররেখার শরীর আচমকা কেঁপে উঠলো। হলরুমে সকলের মাঝে পিনপতন নীরবতা।সম্পূর্ণ বিষয়টি ধীরে সুস্থে যেন নিজেদের মাথায় সেট করতে চাইছে তারা।পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে সেটা দেখার পালা।হামিদ মির্জা চন্দ্ররেখার দিকে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।শারাফ সুধা মির্জার দিকে এখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।হুট করেই সে ধপধপ শব্দে হেঁটে এগিয়ে এলো।সুধা মির্জা সামনে এসে তার দু’হাত আঁকড়ে ধরলো।সুধা মির্জা চোখ তুলে শারাফের দিকে তাকালেন।নয়নে জুড়ে আংশকা অনেক কিছু হারানোর দ্বিধা বিরাজ করছে।

-‘ফুপুমা,এই মূহুর্তে আপনার এই নির্লিপ্ততা আমি মেনে নিতে পারছি না।আমি চাই সবাই সম্পূর্ণ সত্যিটুকু সবাই আপনার কাছ থেকে জানুন।’

সুধা মির্জা ঢোক গিলে গলা ভেজালেন।ভেতরটা কেমন শুকিয়ে আসছে।গলা ভীষণ কাঁপছে। সকলের দৃষ্টি এবার তাদের দিকে।হামিদ মির্জা ও হাফিজ মির্জা তাদের এই বোনকে আজকে কেন জানি চিনতে পারছেন না!তাদের প্রতিবাদী,স্পষ্টভাষী ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই বোনকে কেমন অচেনা লাগছে।এরূপ বিমূর্ততা তো কখনোই ছিলো না সুধার!

-‘চন্দ্ররেখা যা বলসে সব সত্যি। তার বাবার এসবে ব্যাপারে নির্দোষ।এমনকি উনিশ বছর আগে তাদের বাড়িতে যেয়ে যা কিছু শুনেছেন সবই সত্যি ছিলো।’

হামিদ মির্জা বজ্রহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।এমনকি মোহিনী মির্জা ও তৃণা মির্জার চোখে রাজ্যের বিস্ময়।হাফিজ মির্জা এগিয়ে এলেন।শারাফের হাত থেকে বোনের হাত সরিয়ে নিজের দিকে টেনে আনলেন।

-“কি বলছেন আপনি এসব?আপনি তো সে-সময় দু’বছর দেশেই ছিলেন না।নিধির খবর পেলেন কোথা থেকে?আমাদের নিধি পরকী…

-‘ফুপুমা দেশেই ছিলেন।আর সেই আড়াই বছর এবরোডে থাকার কথা বলে,তাজওয়ার চৌধুরীর বাড়িতেই ছিলেন।’

শারাফের কথায় হামিদ মির্জার মাথা ঘুরে উঠলো।এবার তিনিও সুধা মির্জার কাছে এগিয়ে এলেন।সুধা মির্জার ডান হাত তার মাথার ওপরে রেখে বললেন,

-‘তোকে আমার কসম…সব সত্যি বলবি।আমাদের অগোচরে ঘটে যাওয়া সব সত্যি।’

সুধা মির্জা তার বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।ভেতরটা চিৎকার করে কাঁদছে।এতো বছরের লুকানো সবকিছু উদঘাটন করবেন কি করে!একবার চন্দ্ররেখার দিকে তাকালেন।এই পুতুলটা যে ভীষণ কষ্ট পাবে!এমনিতেই মুখটা কেমন মলিন হয়ে আছে।ইতিমধ্যেই কেঁদে কেঁদে চোখ লাল করে ফেলেছে।ভাইয়ের মাথার ওপর থেকে ধীরে ধীরে হাত নামিয়ে নিলেন।ভেতরে কথা গুছিয়ে বলতে লাগলেন,

-“বাবার মৃত্যুর পর আমার সাথে নিধির যোগাযোগ ছিলো।মাঝে মাঝেই খোঁজ খবর নেওয়া হতো।তাদের বিয়ের তিন বছর পর,নিধি আমাকে একদিন ইমারজেন্সিতে ডেকে পাঠালো।সেখানে যেয়ে জানতে পারলাম নিধির ফিজিক্যাল ইস্যু আছে।সে কখনো মা হতে পারবে না।তাই ডক্টর তাদের আইভিএফ পদ্ধতিতে বাচ্চা নেওয়ার পরামর্শ দিলেন। আইভিএফ পদ্ধতি সারোগেসির অন্যতম এক মাধ্যম।এ জন্য অন্য এর নারীকে সারোগেট মা হিসেবে ভাড়া নিতে হয়।একজন নারীর গর্ভে অন্য দম্পতির সন্তান ধারণের পদ্ধতিই হলো সারোগেসি।আইভিএফ পদ্ধতিতে নিধির দেহ ডিম্বাণু ও তার স্বামীর দেহ হতে শুক্রাণু দেহের বাইরে টেস্টটিউবে নিষিক্ত করে তা সারোগেট নারী হিসেবে আমার গর্ভাশয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়।নিধি অন্য কারো পেটে নিজের বাচ্চা রাখতে রাজি হচ্ছিলো না।বাধ্য হয়েই আমি তার বাচ্চার সারোগেট মা হওয়ায় জন্য রাজি হয়ে যাই।দেশের বাহিরে থাকার নাম করে আমি আড়াই বছর সেখানেই ছিলাম।চন্দ্ররেখাকে আমি আমার পেটে ধারণ করেছিলাম।আমি চন্দ্ররেখার অঘোষিত মা।”

সুধা মির্জা রক্ত বর্ণ চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে।এ পর্যায়ে এসে তিনি থেমে গেলেন।বাকি কথা মুখ থেকে বের হচ্ছে না।কারো দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহসও পাচ্ছেন না তিনি।হৃদয়ে তীব্র দহন হচ্ছে।সত্যিই তিনি চন্দ্ররেখারই মা।ফিজিক্যাল কমপ্লিকেশন থাকার পরও ন’মাস এই পুতুলটাকে নিজের মাঝে রেখেছিলেন।চন্দ্ররেখাকে কোলে নিয়েই তো প্রথম মা হওয়ার স্নিগ্ধ অনুভূতি পেয়েছিলেন।চন্দ্ররেখা আচমকা দৌড়ে এসে সুধা মির্জা বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।সুধা মির্জার শরীরের মা মা গন্ধ নাকে পৌঁছতেই চন্দ্ররেখা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।সুধা মির্জা দু’হাতে চন্দ্ররেখাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলেন।কান্নার দমকে তাদের উভয়ের শরীর কাপছে।হামিদ মির্জা ও হাফিজ মির্জা সুধা মির্জার দিকে হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছেন।চন্দ্ররেখা ফিসফিস করে বললো,

-“মা,আমার মা।তুমিই আমার মা!”

চলবে
কোথাও কোনো ভুল হলে বা বুঝতে অসুবিধা হলে অবশ্যই জানাবেন।পরের পর্ব ইনশাআল্লাহ তিনদিন পরে দিবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here