চাদোঁয়া মহল পর্ব -২৪

#চাঁদোয়া_মহল
পর্বঃ২৪
#অত্রি_আকাঙ্ক্ষা

মস্ত প্রয়োজনীয় কাজকর্মকে মাঝে মাঝে বেশ তুচ্ছ মনে হয়।সবকিছুকে একপাশে রেখে কেবল গভীর ভাবনায় মজে থাকতে ইচ্ছে করে।ইমাজিনেশনের যথাযথ প্রয়োগ করে,নতুন জগৎ তৈরির আকাঙ্ক্ষা জাগে।হতাশা,নিরাশা, দুঃখ, কষ্ট বিহীন এক ধরা!আদোও কি অসম্ভব?উহু….একেবারেই না!সুখের পাশে দুঃখ, হাসির পাশে কান্না,আশার পাশে নিরাশা আছে বলেই মানুষ জীবন উপভোগ করছে।কিন্তু দিনশেষে অব্যক্ত কষ্টগুলো যখন মস্তিষ্কে হানা দেয়,শরীর জুড়ে তীব্র জ্বালা বয়ে যায়।এই তীব্র জ্বালা বয়ে জীবনের পঁচিশ বছর একাকী কাটিয়ে দিয়েছেন সুধা মির্জা।এতো মানুষের ভীড়েও, তিনি আজ একাকী।বাবা থাকতে কষ্ট কি জিনিস বুঝি পারেন নি!বাবার মৃত্যুর দিন,একুশ বছরের জীবনে প্রথম অসহায় বোধ করেছিলেন।সত্যি তো এই যে,জীবিত অবস্থায় বাবা নামক ছায়াটি সবসময় তার অংশের কষ্ট নামক তাপটুকু বিনা দ্বিধায় নিজের মাঝে শুষে নিয়েছে।বছরের পর বছর দিয়ে গেছেন প্রশান্তি নামক ছায়া।চন্দ্ররেখার বাবাও তো তার মেয়ের জন্য একই ভাবে ত্যাগ করেছেন।দু’জন মানুষের জেদ,মিথ্যা গরিমা,অযাচিত আত্মসম্মান এতোগুলো জীবন তছনছ করে দিয়েছে।কেউ কি সুখী হতে পেরেছে!সুধা মির্জা ভেবে পান না,তারা দু’বোন তো একই মায়ের পেটে জন্ম নিয়েছিলো।তাহলে তাদের মা দোয়া মির্জার দু’বোনের প্রতি দুরকমের মনোভাব কেন তৈরি হয়েছিলো?কেনই বা তিনি ছোট বেলা থেকে তার মায়ের কাছে অবহেলিত,চক্ষুশূল এক বস্তু?এ প্রশ্নের যথাযথ উত্তর তিনি আজও খুঁজে পান নি!মাঝে মাঝে মনে হয় দোষ তার নিজের।তিনি আসলে ব্যর্থ সন্তান,তাই তো মায়ের মনে জায়গা করে নিতে পারেন নি।শুধুই কি ব্যর্থ সন্তান!তিনি মা হিসেবেও ব্যর্থ।

কেবিনে বামপাশে,দরজার ঠিক বিপরীত দিকে ফ্লোর টু সিলিং উইন্ডো।উইন্ডোর ওপরে থাকা ভার্টিক্যাল ব্লাইন্ডটি ডানপাশে সরানো।মূলত ব্লাইন্ডের স্ল্যাটগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়,যাতে প্রয়োজনীয় আলো কামরায় প্রবেশ করতে পারে।সূর্য প্রায় ডোবার পথে।অপরাহ্নে হালকা লালচে বর্ণের রশ্মি স্ল্যাটগুলো ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করছে।ক্ষীণ আলোয় কেবিনের পরিবেশকে ভুতুরে করে তুলেছে।সুধা মির্জা ব্লাইন্ডটির দিয়ে জানালার ডানপাশ ভালো করে ঢেকে,বাম পাশ থেকে পুরোপুরি সরিয়ে দিলেন।এতেই কাজ হলো!আলোর কণাগুলো সংখ্যায় বেড়ে গেল।মূহুর্তেই ভুতুড়ে ভাব কেটে গেল!কেবিনে থাকা অফিস ইকিউপমেন্ট গুলো চকচক করে উঠলো।জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন সুধা মির্জা।হাত বাড়িয়ে আলোর কণাগুলোকে স্পর্শ করার চেষ্টা করলেন।প্রাকৃতিক নিয়মের কারণে নিরর্থক হলেন!কেবল হাতের তালুতে মিহিরের মৃদু তাপ অনুভব করতে পারলেন।খট করে দরজা খোলার শব্দ হলো।ধপধপ শব্দ তুলে কেউ একজন প্রবেশ করলো।কান খাঁড়া করলেন তিনি।পেছনে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন মনে করলেন না,শুধু হাত নামিয়ে নিলেন।

-“সারোয়ার কোথায়?কি করেছেন তার সাথে?”

শারাফের তীক্ষ্ণ কন্ঠ কানে বেজে উঠলো।সুধা মির্জা ভেবে পান না,এতো সাবধানতার সাথে কাজ করার পরেও;এই ছেলের কাছে কি করো এসব খবর পৌঁছে যায়?এই যে সারোয়ারের বিষয়টা শুধুমাত্র তিনি,বজলু আর সাবইন্সপেক্টর আকরাম বাদে কেউই জানে না।সেটাও শারাফ জেনে গেলো।কিন্তু কি করে!সুধা মির্জা চোখ বন্ধ করলেন।উফফ,আরিফ…… জাস্ট ডিজগাস্টিং! সুধা মির্জার মনে এখন রীতিমতো ভয় কাজ করছে।ইন্সপেক্টর মশিউর রহমানের তাদের কোম্পানিতে আসার উদ্দেশ্যে কথা কানে গেলে,এই ছেলে না জানি কি করে!যদিও আকরাম আশ্বাস দিয়েছে সম্পূর্ণ বিষয়টি সে নিজের মতো হ্যান্ডেল করে নিবে।তারপরেও একটা কিন্তু থেকে যায়!

-“আমি কিন্তু আমার উত্তর এখনো পাই নি….ফুপুমা। ”

সুধা মির্জা ঘুরে দাঁড়ালেন।শাড়ির আঁচল টেনে সামনে আনলেন।শারাফের দিকে তাকিয়ে বুকটা মুচড়ে উঠলো।ছেলেটাকে বেশ এলোমেলো মনে হচ্ছে।মুখে মলিনতার ছোঁয়া।কপালের দু’পাশের রগ ফুলে আছে।চোখের কিনারা কিঞ্চিত লাল।চোয়াল শক্ত।চাহনি বরাবরের মতোই শান্ত।সুধা মির্জা এগিয়ে এসে শারাফের মুখোমুখি দাঁড়ালেন।হিমশীতল গলায় বললেন,

-“তুমি খুব ভালো করেই জানো তার সাথে আমি কি করেছি!পুনরায় কেন জিজ্ঞেস করছো?”

-“আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।ভেতরকার বর্বরোচিতার প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ চাই।নিজের ভেতর আপনি যে বিষাক্ততা পুষে রেখেছেন,তার মাত্রা আজ আমি নিজ চোখে অবলোকন করতে চাই।”

সুধা মির্জার চোখ ধপ করে জ্বলে উঠলো।শারাফ মুখনিঃসৃত বচন তার শরীরে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।মুখে তীব্র কাঠিন্য ভর করলো।দাঁত কিড়মিড় দিয়ে উঠলেন তিনি।ডান সাইডে থাকা এল শেপের এক্সিকিউটিভ টেবিলের দিকে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে গেলেন।সেখানে থাকা লেপটপ,ফাইল,কফি মগ,এলইডি টেবিল ল্যাম্প এক ঝটকায় আঁছড়ে ফেলে দিলেন।দু’হাতে মাথার চুল আঁকড়ে ধরলেন।চিৎকার করে উঠলেন,

-“হে নিজের মাঝে আমি বিষাক্ত বিষ পুষিয়ে রেখেছি।আর সেই বিষে সবাইকে নিঃশেষ করে দিবো।যারা নিজের আপনজনদের সাথে অন্যায়-অত্যাচার করেছে,তাদের সবাইকে আমি গোডাউনে বন্দি করে রেখেছি।টর্চার সেলে রেখে শাস্তি দিচ্ছি।আবার সময়ে সময়ে খাবারও দিচ্ছি।রাতের আঁধারে হাতে,পায়ে শিকল পড়িয়ে বাহিরে নিয়ে আসি।দিনের আলো দেখার সৌভাগ্য তাদের নেই তো কি হয়েছে!বিভাবরীর বিবর্ণতা উপভোগ করার সুযোগ প্রত্যহ দিচ্ছি।বেঁচে থাকতে হবে তো তাদের!এতো পীড়া সহ্য করতে না পেরে অনেকে আমার কাছে মৃত্যু ভিক্ষা চাইছে।এতো সহজে আমি তাদের মারবো না।আস্তে আস্তে শেষ করবো।ইতিমধ্যে ক্যামিকেলের সাইড ইফেক্টে তাদের অনেকের শরীরেই ঘা হয়ে গেছে। তারপরও আজীবন তাদের সেখানেই কাটাতে হবে।বিনা চিকিৎসায়,সংসার, সমাজ,পরিজন সবার থেকে দূরে।কি দুঃবির্ষ অবস্থা তাদের!

সুধা মির্জা আচমকা উচ্চ স্বরে হেঁসে উঠলেন।হাসতে হাসতে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। মাথা থেকে হাত সরিয়ে দু’হাতে নিজের গাল খামচে ধরলেন।হুট করে হাসি থামিয়ে বিড়বিড় করে কিছুটা একটা বললেন।বোঝা গেল না।তাকে এই মূহুর্তে শারাফের কাছে ভয়ংকর রকমের বিকারগ্রস্ত মনে হলো।যেকোনো সময় কারো উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।শারাফ নিজেকে স্বাভাবিকভাবে রাখার চেষ্টা করলো।সুধা মির্জা কন্ঠস্বর আগের চেয়ে দ্বিগুণ মোটা হয়ে এসেছে।এ যেন কোনো অশরীরীর কন্ঠ!চোখ দুটি থেকে যেন আগুন ঝরছে।এতো বছরের জমে থাকা মনোকষ্ট আবৃত শক্ত খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে।তাকে দিশেহারা মনে হলো।কেবিন পায়চারি করতে করতে বললেন,

-‘সুধা মির্জার মেয়ের দিকে কু-দৃষ্টিতে তাকানো?সেই জানোয়ারকে আমি কেটে টুকরো করিনি তাই তো অনেক।ওর জন্য আমি কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তির ব্যবস্থা করবো।হাত,পা কেটে টুকরো টুকরো করবো।চিরকালের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করবে সে।যেখানে নিজের বোনকে শাস্তি দিতে আমি পিছপা হয় নি,সেখানে বাকি সবাই আমার কাছে চুনোপুঁটি।’

শারাফ চমকালো।অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল তার ফুপুমায়ের দিকে। এতোটা নিষ্ঠুরতা সে কখনোই আশা করে নি।শারাফ অনুভব করলো,তার ফুপুমা নামক মানুষটির হৃদয় পাথর হয়ে গেছে। দয়া,মায়া,মমতা,স্নেহ সবকিছু মন থেকে মুছে গেছে।পাপীদের শাস্তি দিতে যেতে তার ফুপুমা নিজে পাপীষ্ঠের খাতায় নাম লেখাচ্ছে।সে এগিয়ে গেল।তার ফুপু মায়ের ডান হাত আলতোভাবে আঁকড়ে ধরলো।নরম স্বরে বললো,

-“চন্দ্রপ্সরা ভীষণ কষ্ট পাবে,ফুপুমা।তার ভেতরটা দগ্ধ হবে।সত্যি কখনো লুকিয়ে থাকে না।আপনার এই নিষ্ঠুরতা তার নিষ্পাপতার সামনে একদিন ভীষণ ভারি ঠেকবে।আপনি কি আদোও তার ঘৃণাভরা চাহনি সহ্য করতে পারবেন? ”

শারাফের কথায় সুধা মির্জা স্তদ্ধ হয়ে গেলেন।বুকের ভেতর উথাল-পাতাল ঢেউ খেলে গেল।ভীষণ হাসফাঁস লাগছে তার।মরে যেতে ইচ্ছে করছে।সত্য একদিন সবার সামনে আসবেই।এর আগের বার না হয় চন্দ্ররেখাকে কোনোরকম ছয়/নয় বুঝ দিয়েছিলেন।কতোবার মিথ্যা বলবেন?মেয়েটা সব জানলে যে মনে ভীষণ আঘাত পাবে।চন্দ্ররেখার কথা ভাবলে সব ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু চাইলেও এসব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবেন না।মরা ছাড়া কোনো উপায় নেই।তিনি যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ!সুধা মির্জার চোখ দুটো থেকে অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়ছে।চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে।ইচ্ছে করছে আট বছর আগে ফিরে যেতে।যেদিন তিনি প্রথম তার বর্বরতা রাজ্যের পরিচালনা করেছিলেন।সুধা মির্জা বিড়বিড় করে বললেন,

-“ইশশ…..অতীতের ভুলগুলো যদি শোধরানো যেত?অভিশাপ লাগুক সেই দিনক্ষণের!ধ্বংস হোক এই নিষ্ঠুরতম দিবস।উচ্ছন্নে যাক সুধা মির্জা ও তার নিষ্ঠুরতার রাজ্য।”

শারাফ তার ফুপু মায়ের অসহায়ত্ব অনুভব করতে পারলো।নিজ হাতে চোখের পানি মুছে দিলো।আলতোভাবে জড়িয়ে ধরে আশ্বস্ত করলো।মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো।যা যা করা প্রয়োজন সে করবে।সবার অগোচরে সবকিছু ঠিক করে দিবে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here