চুক্তির বিয়ে পর্ব ৬+৭+৮

###__চুক্তি_বিয়ে__###
পর্ব- ৬+৭+৮

সোহা পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়লো। তারপর বাগানে গিয়ে বসলো। ভোরের নির্মল, পবিত্র বাতাস আর সবুজ প্রকৃতি সবসময়ই সোহার ভালো লাগে, তাই সোহা সবসময় ভোরে উঠার চেষ্টা করে। আর ভোরে মানুষের ব্রেইন ও ফ্রেস থাকে।
সোহা বসে ভাবতে লাগলো এখানে আসার পর কি কি বিষয় তার কাছে রহস্যময় মনে হয়েছে।
সবগুলা ক্রমান্বয়ে মনে মনে চার্ট করতে লাগলো-
১. দেশে বিদেশে এত মেয়ে থাকতে সোহাকে এখানে নিয়ে আসা এবং সোহার চেহারার সাথে কোনকিছুর সম্পর্ক।
২. সোহাকে দেখলে তন্ময় কখনও নিরব থাকে, কখনও রাগে ভয়ংকর হয়ে উঠে। এবং সোহা খেয়াল করেছে ঔষদ খাওয়ার পরই তন্ময় ভয়ংকর হয়ে উঠে।
৩. এ বাড়ির মালিক -মালকিন থেকে শুরু করে কাজের লোক গুলাও পর্যন্ত আর ও একটা বিষয় লুকিয়েছে। যে বাড়ির পিছনের কটেজে থাকে।
৪. তন্ময় সবসময় নীরা নীরা ডাকে, কে এই নীরা?
৫. এবং সর্বশেষ তন্ময়ের পাগল হওয়ার বিষয়।

প্রথম গুলোর রহস্য উন্মোচন করলে শেষটা বেরিয়ে আসবে।
আরও একটা বিষয়, সবাই বললো তন্ময় বিবাহিত, কিন্তু ওর বউর কোন ছবি বা বিয়ের ছবি এ বাড়ির কোথাও দেখেনি।
প্রথম থেকে শুরু করলে ওকে আজ কটেজে যেতে হবে যেভাবে হোক। আর ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন চেক করতে হবে কি ধরনের ঔষদ ওকে দেওয়া হয়।

সোহা দেখলো এখন সকাল ৭টা বাজে, কেউ ঘুম থেকে উঠার আগে তাকে কটেজে যেতে হবে। সোহা তাড়াতাড়ি কটেজের দিকে রওয়ানা দিল।

কটেজের চারপাশ ঘুরেও কোন দরজা জানালা খোলা পেল না। এত সকাল এখানে কেউ উঠে নি। ও আবার জানালা গুলো দেখার চেষ্টা করলো, হয়তো খোলা থাকতে পারে। অবশেষে একটা জানালা খোলা পেয়ে সেদিক দিয়ে ঢুকলো। ও ঢুকার পরে একটা দিক থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনে সেদিকে এগিয়ে গেলো। সেখানে গিয়ে দেখলো একজন ন্যানি একটা বাচ্চার কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না। ও এগিয়ে গিয়ে বললো, – দিন আমার কাছে দিন। সোহাকে দেখে ন্যানি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। সোহা উনার কাছ থেকে বাচ্চা টাকে কোলে নিল, ওর কোলে যাওয়ার পর ওর মুখ দেখে বাচ্চাটা কান্না থামিয়ে দিল দেখে সোহাও অবাক হয়ে গেলো।
– ম্যাম আপনি এখানে এত সকাল কিভাবে এলেন? আপনাকে এখানকার কথা কে বললো?
– কেউ বলেনি, কিন্তু আপনি আমাকে চিনেন কিভাবে?
– চিনি তো আপনি ছোট স্যার এর স্ত্রী। আপনার এখানে আসা ম্যাডাম জানলে রাগ করবেন, আপনি যান।
– আমি যাবো, তার আগে বলেন ম্যাডাম কেন রাগ করবেন? আর এই বাচ্চা টা কার?
– আমি এসব বলতে পারবো না। ম্যাডামের নিষেদ আছে। কিন্তু বাচ্চা টা আপনার কোলে গিয়েই দেখি কান্না থামিয়ে দিল। আর আমরা ওকে এক মুহুর্তের জন্য থামাতে পারিনা।
– এটাই তো প্রশ্ন, প্লিজ আপনি বলেন, এ বাচ্চা কার? আর আমার কোলে এসে কেন শান্ত হলো?
– আপনার চেহারার সাথে এ বাড়ির ছোট বউ এর হুবহু মিল। আর এই বাচ্চা ছোট স্যার এর ম্যাম।
সোহা অবাক হয়ে গেলো এসব কি শুনছে ও..?
কিছুক্ষন পর সোহা বললো ঠিক আছে, ওহ আচ্ছা আপনার নাম কি?
– জ্বি আমি জুলি।
– আপনি কি বাংলাদেশি?
– জ্বি আমাকে ম্যাডাম বাচ্চা দেখার জন্য দেশ থেকে আনিয়েছেন।
– ওকে জুলি আপু, আমি আপনাকে আপু বলেই ডাকবো প্লিজ না করবেন না।
আর যতদিন না আপনার ম্যাডাম আমাকে বেবিটার কথা বলছেন আমি প্রতিদিন সকালে আসবো। আপনি উনাকে কিছু বলবেন না।
– ওকে ম্যাম আপনি এখন যান। আমি সকালে দরজা খোলে রাখবো তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করবেন কেউ যেন না দেখে।
সোহা ন্যানিকে কথা দিয়ে তাড়াতাড়ি কটেজ থেকে বেরিয়ে আসলো।

সোহা তার রুমে এসে ভাবলো, সমস্যার সমাধান হওয়া দূরে থাক আরও জট পাকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি হাল ছাড়বো না।
একটু পরে এলিসা নাস্তা নিয়ে রুমে আসলো।
– আপনি কোথায় ছিলেন ম্যাম আগে এসে দেখে গেলাম আপনাকে পেলাম না।
সোহা এলিসা কে ধরে এনে পাশে বসিয়ে বললো, এলিসা, আসার পরেই তোমাকে আমার ভালো মনে হয়েছে। তুমি কি আমাকে বোনের মতো দেখে হেল্প করতে পারো না? তুমি কি চাও একটা মেয়ে এখানে সব রহস্যের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকুক?
– কি বলছেন ম্যাম? আমি এসব কোন সময় চাইনা। কি হেল্প চান বলুন।
– তাহলে বলো তুমি তো এ বাড়ির ভাল চাও, চাও তো?
যদি চাও আর আমাকে বিশ্বাস করো তাহলে আমি যা বলবো তা করবে বলো।
এলিসা একটু সময় চুপ থেকে বললো, ঠিক আছে ম্যাম, আমার সাধ্য মত সাহায্য করবো।
– ওকে এখন বলো এ বাড়িতে যে ডাক্তার রাখা হয়েছে উনারা কি আগেও ছিলেন? আর উনারা সব কি স্যার মানে মিনহাজ সাহেবের পরিচিত?
– আপনার আসার ২/৩ দিন আগে নতুন একজন ডাক্তার এসেছেন বদলি হয়ে। কিন্তু উনি আসার পর থেকে স্যার বেশি পাগলামি শুরু করেছেন।
– আচ্ছা নীরা কি তন্ময়ের স্ত্রী ছিল?
– জ্বি।
– ওর কি কোন ছবি আমাকে দেখাবে?
এলিসা বললো, ম্যাম যেদিন ছোট ম্যাম বাড়ি থেকে চলে যান, সেদিন স্যার ও পিছু পিছু গিয়েছিলেন। আসার পর সব ছবি কোথায় যে গায়েব করলেন আর ধীরে ধীরে উনার পাগলামী শুরু হলো।

সোহা এলিসার হাত ধরে বললো এলিসা, ঔষদে কোন সমস্যা আছে, আমার সাথে অন্য কোন মানসিক ডাক্তারের কাছে তোমাকে যেতে হবে। আমি তো এখানের কাউকে চিনিনা।
এলিসা অবাক হয়ে বললো কি বলছেন ম্যাম আপনি এসব?
– হ্যা এলিসা এটাই ঠিক। তুমি মাকে নিয়ে আসো, আমি তন্ময়ের রুম এ যাচ্ছি।

সোহা তন্ময়ের রুম এ ঢুকে দেখলো নার্স তন্ময় কে ঔষদ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। তন্ময় খেতে চাচ্ছে না।
সোহা নার্স কে বললো, -আপনি ঔষদ খাওয়াতে হবেনা, আপনি সরুন আর এখানে নতুন ডাক্তার কে এসেছেন?
আমি বলে একজন এগিয়ে আসলেন।
সোহা বললো, আপনারা সবসময় এখানে থাকেন?
– হ্যা নিচে আমাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
– আচ্ছা আপনারা এখন নিচে যান। আমি উনাকে ঔষদ খাওয়াবো। এ কথা শুনে নতুন ডাক্তার বাধা দিয়ে বললো, না ম্যাম এক্ষুণি উনাকে ঔষদ খাওয়াতে হবে।
– আমি সেটা দেখবো, আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।
ওদের চেঁচামেচি শুনে তন্ময়ের মা এসে ঢুকলেন।
ডাক্তার এগিয়ে গিয়ে বললো ম্যাম ঔষদ খাওয়াতে দিচ্ছেন না ম্যাডাম।
ডাক্তার এমন ভাবে বলছেন যেন ঔষদ খাওয়ানো এখন তার জন্য জীবন মরনের প্রশ্ন।
সোহা বললো মা আমি বলছি আমি পরে খাওয়াচ্ছি, না করিনি। বলছি উনারা যেন নিচে গিয়ে বিশ্রাম করেন।
এ কথা শুনে তন্ময়ের মা ও বললেন, ঠিক আছে আপনারা নিচে যান।

যাওয়ার সময় ডাক্তার সোহার দিকে এমন ভাবে তাকালো যেন সোহাকে পারলে এক্ষুণি চিবিয়ে খায়।
সোহা ও বুঝে ফেললো ডাক্তারের চাহুনী তে, যে এই ডাক্তারের মধ্যে কোন গড়বড় আছে।
তন্ময়ের মা সোহার পাশে এসে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে সোহা? তুমি নাকি ঔষদ ডাক্তার সবকিছুতে সন্দেহ করছো?
– মা আপনি কি আমাকে বিশ্বাস করেন?
– অবশ্যই মা, এই কয়দিনের ব্যবহারে আমি তোমাকে চিনে ফেলেছি তুমি কেমন মেয়ে।
– তাহলে আমি এলিসা কে নিয়ে বাইরে যাচ্ছি, আপনি তন্ময়ের খেয়াল রাখবেন। আর কোন ঔষদ খাওয়াতে দেবেন না।
এতক্ষণ থেকে তন্ময় সোহার দিকে নিরবে তাকিয়ে ছিল, কোন পাগলামি করেনি। সোহা ওর পাশে গিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে বললো, মা দোয়া করবেন আজ আপনার ছেলের একটা রহস্য উন্মোচন করেছি। এখন যেন আরেকটা করতে পারি।

চলবে….

– মেহজাবিন মুন।

চুক্তি বিয়ে”

পর্ব -৭

সোহা প্রেসক্রিপশন নিয়ে এলিসাকে সাথে নিয়ে শহরের নামকরা একজন ডাক্তারের কাছে গেল।
সোহা ওইখানে গিয়ে ডাক্তার কে প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো দেখুন তো এই প্রেসক্রিপশন এর সব ঔষদ একজন মানসিক রুগিকে দেওয়া ঠিক হচ্ছে কিনা?
ডাক্তার রোগী আর ঔষদের নাম দেখে চমকে গেলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন,
– রোগী আপনার কি হয়?
– জ্বি আমার স্বামী, সোহা বাধ্য হয়ে উত্তর দিল। যতই হোক চুক্তি বিয়েতে তো স্বামী তার।
– যে ডাক্তার চিকিৎসা করছেন উনারা কি আপনার শশুরের পরিচিত? ডাক্তার সাহেব আবার জিজ্ঞাসা করলেন।
– একজন পরিচিত, অন্যজন কে বদলে দেওয়া হয়েছে।
কেন ডাক্তার? কোন সমস্যা?
– আপনি কি উনার বিশ্বস্ত ব্যক্তি?
– জ্বি আপনি নিশ্চিন্তভাবে বলেন।
ডাক্তার সাহেব নড়েচড়ে বসলেন, তারপর ২টা ঔষদের নাম দেখিয়ে বললেন, এই ঔষদের মধ্যে যে ধরনের পদার্থ রয়েছে তার মধ্য একটি একজন মানুষকে ভয়ংকর, পাগল আর স্মৃতিশক্তি বিনষ্ট করে দেওয়ার জন্য যতেষ্ট। আর ওপর টি তে এমন এক ধরনের ভাইরাস যা একজন মানুষের শরীরের কোষগুলো নষ্ট করে দিয়ে মানুষকে মেরে ফেলে, যা অত্যন্ত ধীর প্রতিক্রিয়া। ১০ বছরের ভিতরও যা ধরা পড়েনা। এই ঔষদ গুলো যে দিয়েছে আমার মনে হয় সে অত্যধিক চালাক এবং এই ছেলেটিকে জীবন্ত ধ্বংস করে দিতে চায়।
এসব কথা শুনে সোহা বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। ও তো ভাবছিল কোন গড়বড় এখন তো দেখা যায় মারাত্মক ঘটনা গঠছে এখানে।
সোহা বললো ডাক্তার সাহেব এখন কি করা যায়? আপনি তো ডাক্তার, প্লিজ আপনি একটা পদ্ধতি খুজে বের করুন।
ডাক্তার বললেন আগে ঔষদ গুলা খাওয়ানো বন্ধ করতে হবে, তারপর রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে ঔষদ দিতে হবে।
ডাক্তার কে সোহা বললো, আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই, যদি আপনি বিষয়টা গোপন রাখেন। আপনি তো মিনহাজ চৌধুরীকে চিনেন উনার জন্য প্লিজ আমাদের হেল্প করেন।
-জ্বি বলুন?
– মিনহাজ চৌধরীর বাড়িতে একটা বড় রহস্য আছে মনে হয়। আর তা উনার ছেলেকে নিয়ে, তাই কেউ পরিকল্পনা করে এরকম করছে। আপনি যদি উনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন কৃতজ্ঞ থাকবো।
– দেখুন, আমার কাজ রোগীর চিকিৎসা করা, রহস্য নয়। আর রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হলে রোগীকে দেখতে হবে।
– আমি নিয়ে আসার চেষ্টা করবো। আপনি এখন লিখিতভাবে এই ঔষদ গুলার ক্ষতিকর দিক বর্ণনা করুন এবং ঔষদের বিকল্প ঔষদের ব্যবস্থা করুন।
ডাক্তার ঔষদের বাতিলপত্র ও ক্ষতিকর দিক লিখে নতুন ঔষদের ব্যবস্থা করলেন।

সব ব্যবস্থা করে সোহা বাড়ি ফিরলো। কিন্তু কটেজের দিকে চিৎকারের আওয়াজ শুনে দৌড়ে ওখানে গেলো। গিয়ে দেখে বাচ্চা টাকে সামলানো যাচ্ছে না। তন্ময়ের বাবা মা দুজনই এখানে আছেন। সোহা কোনদিকে না তাকিয়ে গিয়ে বাচ্চা টাকে তন্ময়ের মায়ের কোল থেকে নিল। তন্ময়ের বাবা মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন তুমি এখানে? আর বাচ্চাটার কথা কিভাবে জানো?
ততক্ষনে সোহা বাচ্চার কান্না থামিয়ে বাচ্চাকে ফিডারের দুধ খাওয়াতে লাগলো। ও দেখলো বাচ্চা টা ৩/৪ মাস বয়সের একটা ছেলে। এত ছোট বাচ্চাকে কেউ রেখে যায়?
সোহা উত্তর দাও? আবার তন্ময়ের মা জিজ্ঞেস করলেন।
– কেন মা? আপনারা কি ভাবছিলেন লুকিয়ে রাখতে পারবেন? সেদিন এলিসার সাথে আপনার কথা শুনে, পরে আবার আঙ্কেলের সাথে কথা শুনে সন্দেহ জাগে, তাই সেটা খুজতে এসে দেখি বাচ্চা। কেন আপনারা আমার কাছ থেকে এসব লুকালেন?
আমতা আমতা করে তন্ময়ের মা বললেন, যদি তুমি চলে যাও তাই বলিনি মা। কিন্তু পরে অবশ্যই বলতাম। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম তুমি সোহা। তুমি সব রহস্যের কিনারা করো।
– আমার জীবন তো একটা বিবেকের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ মা, না পারছি সেটা ভাঙ্গতে, না পারছি পেরিয়ে যেতে।
আর জেনেই যখন গেছি আজ থেকে ছেলেটা আমার কাছে বাড়িতে থাকবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তন্ময়ের মা বললেন, “তুমি আমাকে অনেক বড় বিপদ থেকে রক্ষা করলে মা।” এমনতি ছেলেটাকে নিয়ে কত চিন্তায় আছি।

চলুন বাড়িতে আপনাদের সাথে কিছু কথা আছে আমার। উনারা নিরবে সোহার পিছু নিলেন।

ঘরে এসে সোহা উনাদেরকে সব জানাল। সব শুনে উনারা স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
তন্ময়ের বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কে করতে পারে এসব? আমার ছেলের সাথে কার এত শত্রুতা?
– সেটা তো আমি জানিনা আঙ্কেল। সেটা জানতে হলে আমাদের প্ল্যানমত কাজ করতে হবে।
– ঠিক আছে মা আমাকে কি করতে হবে বলো। তুমি আমাকে বাবা ডাকতে পারো না? এত ঘৃণা করো আমায়?
– ঘৃণা কেন করবো? আমি কাউকে নিজের ভাগ্যের জন্য দোষ দেই না। যতটুকু লিখা আছে ততটুকুই হবে। আর চুক্তিতে তো কোথায়ও লিখা হয়নি যে চুক্তি বিয়ের শশুর শাশুড়ি কে বাবা মা ডাকতে হবে।
এ কথা শুনে মিনহাজ সাহেব মাথা নিচু করে ফেললেন।
উনার কাঁধে হাত রাখলো সোহা , ” এখন আমাদের আবেগী হওয়ার সময় নয় আঙ্কেল আমাদের আগে তন্ময়ের জীবন বাচাতে হবে। আপনি তন্ময়ের রুমে সিসি টিভি ক্যামেরা ফিট করুন। আর ডাক্তার দের বলে দিবেন এখন থেকে ঔষদ আমি খাওয়াবো।
– “ওকে আমি আজই ব্যবস্থা করছি” বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন।

বিকালের দিকে মিনহাজ সাহেব লাইন ঠিক করবেন বলে মিস্ত্রী এনে লুকিয়ে সিসি টিভি ক্যামেরা ফিট করলেন। আর ডাক্তার দের বললেন , সোহা আজ থেকে ঔষদ খাওয়াবে।
সোহা রাত্রে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে তন্ময়ের রুমে গেলো। সে বাচ্চাটার প্রতি তন্ময়ের প্রতিক্রিয়া জানতে চায়।
তন্ময় বাচ্চাকে দেখে প্রথমে রাগে ফুঁসতে লাগলো, পরে কান্না শুরু করলো। সোহা বাচ্চা কে এলিসার কোলে দিয়ে তন্ময়ের পাশে বসে বললো, তন্ময় বাচ্চাটা তোমার, বাচ্চাটা আমাদের। তোমার কিছু মনে পড়ে?
মনে করো তুমি পাগল না, তুমি ভাল একজন ডাক্তার। কথা বলো তন্ময়, কে তোমাকে মারতে চায়? বলো আমাকে?
হঠাৎ তন্ময় সোহাকে জড়িয়ে ধরে বলতে শুরু করলো তুমি আমাকে বাঁচাও, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে, বাচ্চাকে মেরে ফেলবে, ওরা সবাইকে মারবে। ওই হাসপাতালে সবাই মরবে।
– কোন হাসপাতাল? কারা মারবে? বলো তন্ময় বলো.? কিন্তু তন্ময় আর কিছু বলতে পারলো না মাথার চুল খামছে ধরে অজ্ঞান হয়ে গেলো।
সোহা ওকে যত্ন করে শুইয়ে দিল। দুইবেলা থেকে সোহা ঔষদ খাওয়ানো বন্ধ করে দিছিলো, তাই অজ্ঞান হয়ে গেছে ভেবে সোহা জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করলো। ওইদিকে ঐ ডাক্তার লুকিয়ে সব কিছু দেখছিল।
সোহা তন্ময়কে ঔষদ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। ততক্ষণে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
ও রুমে এসে চিন্তায় ডুবে গেল, কে এমন করছে? কাউকে তো এমনি সন্দেহ করা যায়না।
ওইদিকে তন্ময়ের রুমে ঘটছে আরেক ঘটনা। ডাক্তার রুমের ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ডুকে তন্ময়কে ঔষদের বদলে ইনজেশন পুস করে চলে গেলো রুম থেকে।

সোহা এমনিতে ভোরে ঘুম থেকে উঠে, আজ বাচ্চাটার জন্য আরও আগে উঠে গেলো। বাচ্চা কে খাইয়ে, ময়লা পরিস্কার করে নামাজ শেষ করলো। তারপর বাচ্চাকে নিয়ে তন্ময়ের রুমে রওয়ানা হলো।
সোহা ভাবছিল তন্ময় এখনও ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু তখন যে তার আর বাচ্চাটার জন্য তন্ময়ের রুমে মরন ফাঁদ অপেক্ষা করছে সোহা তা ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি।

দুঃখিত দেরীতে দেওয়ার জন্য। একটু অসুস্থ ছিলাম। ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

চলবে..

– “মেহজাবিন মুন”

“চুক্তি বিয়ে”

পর্ব – ৮

সোহা রুমে ঢুকামাত্র তন্ময় দৌড়ে এসে বাচ্চাটাকে কেড়ে নিতে গেলো ওর একহাতে বড় চাকু, মুখের ভঙ্গি ভয়ংকর।
সোহা এই দৃশ্য দেখে আতঙ্কে এত জোরে চিৎকার দিলো যে তন্ময় ও এক মুহুর্তের জন্য থেমে গেলো।
সোহার জ্ঞান বুদ্ধি এই মুহুর্তে লোপ পেলো। ও হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু তন্ময়ের আসা দেখে সোহা ভাবলো এখন ভয় আমাকে ভয় পেলে চলবে না, এখন শক্তি নয় বুদ্ধি দিয়ে কাজ করতে হবে।। ও দৌড়ে রুম থেকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার আগে দরজার সামনে তন্ময় এসে দাঁড়ালো। তন্ময় সোহার দিকে আসছে দেখে সোহা পিছু হঠতে লাগলো। তখন মনে পড়লো এলার্ম বাজাতে হবে, ও সুইচ বোর্ডের দিকে দৌড় দিল। কোনমতে এলার্ম বাজাল, তন্ময় পিছে পিছে আসছে দেখে আবার দৌড় দিলো। তন্ময় সোহার দিকে আসছে আর বলছে, – ডাইনী বাচ্চাটা আমার কাছে দিয়ে দে, তুই আমাকে মারতে চাস, বাচ্চাটাও আমাকে মারতে চায়, আমার কাছে দে, আমি ওকে আগে মারবো, দিয়ে দে নইলে তোকে আগে মারবো। সোহা তন্ময়ের এই অবস্থা দেখে বাচ্চা টাকে আকড়ে ধরে দৌড়াতে লাগলো আর বাঁচাও বাচাঁও বলে চিৎকার করতে লাগলো। সোহার চিৎকার, বাচ্চার কান্না আর তন্ময়ের ভয়ংকর গর্জন সব মিলিয়ে ঘরের ভিতর এক নারকীয় অবস্থা। হঠাৎ পিছন থেকে সোহার মাথায় তন্ময় টব ছুড়ে মারলো। সোহা বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে “হে আল্লাহ! তুমি এই নিষ্পাপ বাচ্চাকে রক্ষা করো” বলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।

একটানা তিন ঘন্টা পর সোহার জ্ঞান ফিরল। প্রথমে বুঝার চেষ্টা করলো কোথায় আছে সে। দেখলো তন্ময়ের মা পাশে বসে আছেন, ডাক্তার, এলিসা ও রুমে আছে।
“বাচ্চা…., আমার ছেলে কই ” বলে উঠে বসার চেষ্টা করলো।
– তন্ময়ের মা বললেন, তোমাকে উঠতে হবেনা মা। তুমি মারাত্মক আহত। তুমি চিন্তা করোনা বাচ্চাটার কিছু হয়নি। ভাগ্য ভাল আমরা সময়মত এসে গিয়েছিলাম, নাহলে বাচ্চা সহ তুমিও মারা যেতে তন্ময়ের হাতে।
– মা তন্ময় কেমন আছে?
– এখন ভাল আছে, ওকে বেধে রাখা হয়েছে। এখন ঘুমুচ্ছে। কেন যে হঠাৎ এত উন্মাদ হয়ে গেল বুঝলাম না।
মাথা ভারী লাগছে দেখে মাথায় হাত দিয়ে দেখলো ব্যান্ডেজ বাধা।
– কি হয়েছে মা? ব্যান্ডেজ কেন আমার মাথায়.?
– সোহা তোমার মাথায় তন্ময় ফুলের টব ছুড়ে মেরেছিল। তাই মাথার অনেক জায়গা ফেটে গেছে, অনেক রক্ত গেছে তোমার শরীর থেকে তোমাকে এখন বিশ্রাম করতে হবে।
বিছানায় শুয়ে সোহা ভাবলো, হঠাৎ করে কেন এমন করলো তন্ময়। রাতে তো ও ভালই ছিল। আর বাচ্চা, ওই বাচ্চাটার প্রতি ওর এত বিদ্বেষ কেন?
মনের অজান্তেই বাচ্চাটার প্রতি একটা টান অনুভব করলো।
বাচ্চার কথা আবার মনে পড়তেই সোহা মা কে বলল, ” মা ছেলে টাকে আমার কাছে এনে দিন আমি ওকে দেখবো। আচ্ছা মা এখন ও তো বললেন না ওর নাম কি ?”
তন্ময়ের মা বললেন, – যেদিন বাচ্চাটার জন্ম হয় সেদিন নীরা ওকে হসপিটালে রেখে চলে যায়, এরপর থেকে তন্ময় ওর দিকে তাকালেই কেমন যেন গম্ভীর হয়ে যেত। ওকে দেখলেই রেগে যেত, মাঝে মাঝে কান্না করতো। তাই আমরা মনে করেছি ওই নীরা আর বাচ্চাটাই আমার ছেলের পাগল হওয়ার কারন। তন্ময়ের চোখের আড়ালে রাখার জন্য আমরা কটেজে একজন ন্যানির তত্তাবধানে রেখে দেই। এরপর থেকে তন্ময়ের পাগলামির জন্য আমরা এতটা ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে নাম রাখার কথা আর মনেই আসেনি।

সোহা এসব শুনে বললো, এতে তো বাচ্চার কোন দোষ নেই, ও তো নিষ্পাপ একটা ছেলে। এটা ঠিক নয় মা।
এ কথা শুনে তিনি মাথা নিচু করে ফেললেন।
সোহা আবার বললো, তন্ময়ের পাগল হওয়ার পিছনে অন্যকোন কারন আছে মা। আপনি আঙ্কেল কে নিয়ে আসুন, আমার কিছু কথা আছে। আর বাচ্চা টাকেও নিয়ে আসবেন।
তন্ময়ের মা সবাইকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

একটু পরে মিনহাজ সাহেব আরর তন্ময়ের মা বাচ্চাকে নিয়ে ঘরে আসলেন।
সোহা উনার কাছ থেকে বাচ্চা টাকে কোলে নিয়ে বললো, আঙ্কেল কাল রাতের সিসিটিভি ফোটেজ টা তন্ময়ের রুম থেকে নিয়ে আসেন।
– কেন সোহা? কোন সমস্যা?
– আঙ্কেল আমার মনে হয় কাল রাত্রে কিছু একটা ঘটেছিল। তাই তন্ময় এত উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। কারন কাল দিনের বেলা থেকে আমিই ঔষদ খাওয়াচ্ছি তন্ময়কে।
– কি বলছো এসব..!? আচ্ছা ঠিক আছে আমি এক্ষুণি নিয়ে আসছি।

সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো রাত্রে সেই ডাক্তার তন্ময়কে ইনজেকশন দিচ্ছে, তারপর ওর ঔষদের মধ্যে কি ঘাটাঘাটি করছে।
এটা দেখে সোহা বললো আমি আগে থেকেই ওকে সন্দেহ করছিলাম। ও কিছু একটা সয়তানি কাজ করছে ভাবছিলাম। আপনি এক্ষুনি পুলিশ কে ফোন করুন, আর এই নিন কার্ড, এই ডাক্তারকে তন্ময়ের চিকিৎসার জন্য আনুন। উনি অনেক ভাল আর বিশ্বাসী মানুষ।
মিনহাজ সাহেব ফেল ফেল করে তাকিয়ে রইলেন ওর মুখের দিকে।
– তোমার ঋন আমরা কোনদিন শোধ করতে পারবো না মা। তুমি আমাদের জন্য এত কিছু করছো।
– আঙ্কেল, এটা আমার কর্তব্য। তাছাড়া আমি এই কাজের জন্য চুক্তির মাধ্যমে টাকা নিয়েছি।
– মা তুমি আমাকে ক্ষমা করো।
– প্লিজ আঙ্কেল, আপনি এখন এসব বাদ দেন। তাড়াতাড়ি পুলিশ আর ডাক্তার কে ফোন করে আসতে বলুন।
চোখ মুছতে মুছতে মিনহাজ সাহেব বেরিয়ে গেলেন।

আধা ঘন্টার ভিতরে পুলিশ আসলো। ডাক্তার ও এমন সময় আসলেন। মিনহাজ সাহেব বললেন আগে আমার সাথে চলুন ওই ডাক্তারকে এরেস্ট করেন যাতে পালাতে না পারে। পুলিশ নতুনন ডাক্তারকে এরেস্ট করলো।

মিনহাজ সাহেব ডাক্তারকে নিয়ে তন্ময়ের রুমে গেলেন। ডাক্তার তন্ময়ের ঔষদের মধ্যে বিষাক্ত সিডাকটিভ, ভয়াবহ ক্যারসিনোজেন পেলেন। পুলিশ ও নতুন ডাক্তারের রুম সার্চ করে সেই উপাদান গুলো এবং রাতের সেই ইনজেকশন সিরিন্জ খুজে পেল যেটাতে সিডাকটিভ সহ ভয়ংকর উন্মাদের ঔষদ মিশিয়ে তন্ময়কে ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল। সার্চ করে আরও পাওয়া গেল নীরার একটা কার্ড, কিছু ভাইরাস জাতীয় ঔষদের লিস্ট এবং তন্ময়ের ঔষদের লিস্ট। ডাক্তার তন্ময়কে পরীক্ষা করলেন, ঔষদ প্রেসক্রিপশন দেখলেন। তারপর পুলিশের হাতে তন্ময়ের রুমে পাওয়া উপাদান গুলো দিয়ে বললেন, তন্ময় পাগল হয়নি, খুব প্ল্যান করে তন্ময়কে ধীরে ধীরে পাগল করা হয়েছে। খুব ধীরে ধীরে তন্ময়কে সেই ঔষদ দেওয়া হচ্ছিল, পাশাপাশি শরীরে ঢুকানো হচ্ছিল বিষাক্ত ক্যারোসিনোজেন। যা ১০ বছরে একজন মানুষ কে ক্যান্সারে আক্রান্ত করে মেরে ফেলার একটা ধীর পক্রিয়া।
একথা শুনে সোহা ও বাকি সবাই শিউরে উঠলো।
কে এমন কাজ করলো? কার সাথে তন্ময়ের এত শত্রুতা? এসব কি নীরা করছে? কিন্তু কেন..?
এসব শুনে, সিসি ক্যামেরা ফুটেজ নিয়ে, একটা রিপোর্ট লিখে পুলিশ নতুন ডাক্তার কে নিয়ে চলে গেলো।
– ডাক্তার, আমার ছেলে কি ভালো হবেনা, তন্ময়ের মা কেঁদে ফেললেন।
– কোন চিন্তা করবেন না। এই ঔষদ বেশিদিন দেওয়া হয়নি, সঠিক চিকিৎসা আর নিবিড় পর্যবেক্ষণ পেলে তন্ময় তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠবে। আপনাদের একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
সবাই রুম থেকে বেরিয়ে আসার পর সোহা গিয়ে তন্ময়ের পাশে বসলো। তন্ময় তখন জেগে উঠেছে তন্ময় সোহার মুখের দিকে নিরবে চেয়ে আছে। কি মায়াবী মুখ, কত ভাল মানুষ মনে হচ্ছে।
ভিতর থেকে কে যেন সোহাকে বলে উঠলো তন্ময়কে বাঁচাতে হবে, ভালো করতে হবে, ওর পাশে থাকতে হবে। কিন্তু একরাশ অভিমান ও কাজ করলো তন্ময়ের উপর।
ও কেন আমাকে মারতে চায়, ডাইনী বলে.? আমার সাথে ওর কিসের শত্রুতা?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here