#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-১৭
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
চারিদিকে প্রকৃতির মাতাল করা হাওয়া বইছে,এ যেন সৃষ্টিকর্তার আরেকটি নিয়ামতের অংশ বিশেষ। নেই কোন যান্ত্রিক কোলাহল’এর শব্দ দূষণ। চারিদিকে সুনসান নীরবতা। প্রকৃতির এই অপরুপ সুন্দর্যের মাঝে, পুকুর পাড়ের পাকা সিঁড়ি’তে আমি আর রাহাত বসে আছি। শুধু বসে নয় একে অপরের কাঁদে মাথা রেখে বসেছি।মা জানিয়েছেন দু’দিন পর আসবেন।আর আমাদের
বলেছেন বড় আপুর বাসায় মানে রাহাতের আপুর বাসায় যাওয়ার জন্য।আপু কতোবার কল করে বললেন যেতে।
চারিদিকে গাছপালায় ভরা, মাঝে মাঝে পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
একটা কাক খুব করে ডাকছে, তখন আম্মুর কথা খুব মনে পড়লো যখন কোন কাক ডাকতো তখন আম্মু বলতো আল্লাহ’রে ডাক আল্লাহ’রে ডাক।এর কারণ আম্মু মনে করতো কাকে’রা কোন বিপদ সংকেত পেলে এভাবে ডাকে। তখন আমি বলতাম এগুলো সব বানোয়াট কথা আম্মু। ওদের ডাক ই কা কা করা।যা প্রকৃতি প্রদত্ত। কিন্তু আম্মু আমার কথা মানতে নারাজ।সে তার বিশ্বাস ই অটুট থাকতো।
আম্মু কে যখন ই কোন কথা নিয়ে বলতাম আম্মু এটা কোন হাদীসে বর্ণিত নেই তখন আম্মু রেগে যেত আর বলতো এগুলো সবাই মানে সবাই জানে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার কথা বিশ্বাস ই করতো না। খুব সহজ সরল ছিল আম্মু আমার। একদিন আমরা সবাই এই পথে চলে যাবো তবুও একজন আরেকজনের চলে যাওয়া মেনে নিতে পারি না, কষ্ট হয় খুব।
চোখের পানি কিছুতেই বাদ মানছে না।নিরবতার মাঝে হঠাৎ আমার কান্না দেখে বিচলিত হয়ে যায় রাহাত। আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
– আয়রা কি হয়েছে তোমার? হঠাৎ এভাবে কাঁদছো যে?
আমি কেঁদে কেঁদেই বললাম,
– আম্মুর কথা খুব মনে পড়ছে আমার, আম্মু কেন আমাকে এখন আর নাম ধরে ডাকে না? কেন আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরে না? কেন খেতে না চাইলে নিজ হাতে খাইয়ে দেয় না? কেন শাসন করে বলে না,আর কতো মোবাইল টিব্বি? এবার একটু খ্যামা দে। পাশের বাড়িতে কি হয়েছে না হয়েছে কেন আর বলে না? কেন বলে না পরের মায় পিছার বারি দিব এমনে অলসতা করলে! বলতে পারো তুমি?
রাহাত তার সাথে আমায় মিশিয়ে নিয়ে বললো,
– তোমার কষ্টটা আমি বুঝতে পারি আয়রা। কিন্তু তোমাকে তো আল্লাহ তা’আলার পরিকল্পনার প্রতি শ্রদ্ধা থাকতে হবে। আমরা তো জানি আল্লাহ তা’আলা উত্তম পরিকল্পনাকারী।তার কাছে এই নিয়ম উত্তম মনে হয়েছে বলেই তিনি এই পরিকল্পনা করে আমাদের দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। এই দুনিয়া তো শুধু একটা পরীক্ষা কেন্দ্র, সেই পরিক্ষার্থী আমরা সবাই।
দুনিয়াতে মানুষের আগমন ও জীবনের লক্ষ্য হলো আল্লাহ তাআলার বিধি-বিধানের বাস্তবায়ন তথা তাঁর ইবাদত-বন্দেগি করা। আল্লাহ তাআলা কুরআনে মানুষ সৃষ্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুষ্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরেছেন-
‘আমি জিন ও মানবজাতিকে শুধুমাত্র আমার ইবাদত ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি। অর্থাৎ ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা যারিয়াত : আয়াত ৫৬)
– আচ্ছা আমরা দুজনেও তো দু’জন কে ছেড়ে চলে যেতে হবে। যেকোন একজন কিভাবে থাকবো আমরা? কেন এতো নিষ্ঠুর নিয়ম?
– সর্ব মহলের স্বীকৃত বিষয় মানুষের চাহিদা সমূহের মধ্যে বিবাহ হচ্ছে সব চেয় বেশী চাহিদাসম্পন্ন বস্তু,এবং এটা জান্নাতে পুরুষ-মহিলার উভয়ের ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হবে,মহিলাকে আল্লাহ তা’আলা জান্নাতে তার দুনিয়ার স্বামীর সাথে বিবাহ দিবেন(যদি ঐ স্বামী ও জান্নাতি হয়)।
যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
হে আমাদের পালনকর্তা, আর তাদেরকে দাখিল করুন চিরকাল বসবাসের জান্নাতে, যার ওয়াদা আপনি তাদেরকে দিয়েছেন এবং তাদের বাপ-দাদা, পতি-পত্নী ও সন্তানদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করে তাদেরকে। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
(মাজমু’উ ফাতাওয়া ওয়া রাসাঈল ইবনে উসাইমিনঃ২/৫১
আল্লামা আলুসি বাগদাদী রাহ বলেনঃ
জান্নাতি পুরুষদেরকে তার পৃথিবীর স্ত্রী দেওয়া হবে।
তাই আমরা সর্বদা চেষ্টা করবো আল্লাহ তা’আলার ইবাদত পালন করার।যাতে আমরা দুজন একসাথে জান্নাতে থাকতে পারি।একে অপরকে সাহায্য করবো ইবাদত এর কাজে কেমন?
– ইনশা আল্লাহ, আল্লাহ কবুল করুন আমীন।
– সুম্মা আমীন।
_________
সম্পূর্ণ পর্দায় নিজেকে আবৃত করে নিলাম। রাহাত শরবতের মতো হালকা রঙের সার্ট পরেছে ইন করে।মা শা আল্লাহ,সুদর্শন পুরুষদের থেকে কোন অংশে কম নয়। আমি আগে তৈরি হয়ে বসে বসে তার তৈরি হওয়া দেখছি। একদম পরিপাটি করে নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত সে। আর্মি ছেলেরা এভাবে নিজেদের পরিপাটি করে রাখে বলেই তাদের বয়স বেশি একটা বোঝা যায় না। ওদের চলাফেরা খুবই স্ট্রং হয়ে থাকে। রাহাত ও কিন্তু আমার থেকে অনেকটা বড়।হাবিব ভাইয়া যেমন তার বাড়ি গাড়ি টাকা পয়সা সব কিছু রেডি ছিল বলে দ্রুত বিয়ে করে নিয়েছে। সেখানে রাহাতের কিছুই ছিল না, জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়ে তারপর তাকে বিয়ের কথা ভাবতে হয়েছে। অবশ্য হাবিব ভাইয়া বিয়েটা তাড়াতাড়ি ই করেছিলেন,ডিগ্রিতে পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করেছেন। তখন ধরা যায় তার অনুমানিক বয়স চব্বিশ। তারপর বিদেশে চলে যায় হাবিব ভাইয়া। বিদেশে যাওয়ার এক বছর পর আপুকে নিয়ে যান।
রাহাত আর হাবিব ভাইয়ার বয়স প্রায় সেইম, হয়তো মাসের বড় ছোট হতে পারে।তো সে অনুযায়ী রাহাতের বয়স এখন সাতাশ বছর।আর আমার বিশ। মানে রাহাত আমার থেকে গুনে গুনে সাত বছরের বড়।সে তুলনায় আমাদের বন্ডিং টা খুবই ভালো আলহামদুলিল্লাহ।কিছুটা বয়স্ক জীবনসঙ্গী থাকা দাম্পত্য জীবনে আরও স্থিতিশীলতা আনতে পারে। তাই স্বামী-স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য ৫-৭ বছর হওয়াই আদর্শ বলে বিবেচিত। বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও একটি সফল বিবাহের চাবিকাঠি হলো যোগাযোগ, পারস্পারিক শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও স্থিতিশীলতা।
এক ধ্যানে মগ্ন হয়ে বসে আছি বলে রাহাত এসে বসলো আমার পাশে। তারপর বললো,কি ম্যাডাম সেই কখন থেকে লক্ষ্য করছি আপনি কিছু একটা নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন।কি এমন ভাবছেন বলেন তো?
আমি রাহাত’কে আবারো ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বললাম, আপনার কথাই ভাবছিলাম।তো আর্মি সাহেব আপনি যেভাবে সাজুগুজু করেছেন, বাহিরে বের হলে তো মেয়েরা পাগল হয়ে যাবে!
– আচ্ছা তো আমার বউ পাগল হয়েছে? আমার বউ পাগল হলেই হবে।
– তাহলে তোমার উচিৎ বাহিরে অগোছালো হয়ে বের হওয়া আর রুমে আমার সামনে সেজেগুজে বসে থাকা হা হা হা,,,,
– আচ্ছা এবার চলো বের হতে হবে, অলরেডি বারোটা বেজে গেছে।আর তুমি এভাবে যাবে না! তোমাকে অনেক সুন্দরী লাগছে, আমি চাই না আমি ছাড়া অন্য কেউ তোমার সুন্দর্যো দেখুক।
ওর কথা শুনে বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম আমি। কি বলে এই ছেলে? এভাবে কালো বোরকা ছয় পার্ট হিজাবে নিজেকে আড়াল করার পরেও কিনা বলছে এভাবে যেতে পারবো না! তাহলে কিভাবে যাবো?
সে আমাকে অবাক করে দিয়ে পিছন থেকে ছয় পার্ট এর এক পার্ট এনে চোখের উপর দিয়ে দিল। তারপর বললো,এবার ঠিক আছে।জানো তো কালো বোরকার মধ্যে দিয়ে, তোমার ছোট ছোট কালো চোখের মণি গুলো খুব আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে।তাই আমি চাই অন্য কেউ আমার মতো দূর্বল হোক তোমার প্রতি। এবার চলো চলো।
তার কথার উত্তরে আমি আর কিছু বললাম না। একদিন কলেজে ইমরান ভাইয়া বলেছিলেন,আয়রা জানো তুমি নিজেকে কালো পর্দা দিয়ে সম্পূর্ণ আবৃত করতে পারোনি! তোমার ঐ দুটি চোখ ই যথেষ্ট আমাকে গায়েল করার জন্য। সেদিন ইমরান ভাইয়া কে পাগল ছাড়া কিছুই মনে হয়নি আমার। আজকে সেই একই কথা রাহাত ও বললো ।
________
দের ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছালাম আপুর বাসায়।এক তলা বাকা দালান বাড়ী তাদের। বাড়িতে গাছপালা খুব কম,যেগুলো আছে সেগুলো ছোট ছোট। বুঝতে পারলাম নতুন বাড়ি করে এসেছে তারা। রাহাতের দুলাভাই সিংগাপুর থাকেন।তাই তাদের অবস্থা সচ্ছল ই বলা যায়। আপুর দুইটা ছেলে। ছোট টা স্কুল থেকে মাত্র ফিরলো,বড়’টা এখনো ফিরেনি। ছোট জন এসেই আমাকে খুব মিষ্টি করে বললো,
– মামি কেমন আছো?
আমি তাকে কাছে নিয়ে বললাম,
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।তুমি কেমন আছো বাবা?
সেও মিষ্টি করে জবাব দিলো, তারপর কোন ক্লাসে পড় জিজ্ঞাসা করতে বললো, নার্সারি তে পড়ে।মা শা আল্লাহ খুব শান্ত ছেলেটা।এই বয়সের বাচ্চারা খুব দুষ্টু প্রকৃতির হয়ে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ আমাদের সাফা আর মারওয়া। দুটো কে খুব মিস করি, মাঝে মাঝে ভিডিও কলে কথা হয়। তখন আমাকে বলে, আমি যেন তাদের বাসায় যাই। অবুঝ মন ওদের, আমি কিছুতেই বোঝাতে পারি না যে আমি চাইলেও তাদের কাছে পৌঁছাতে পারবো না। সেদিন আপু শিখিয়ে দিচ্ছে আর তারা পাকামো করে বলছে,
– বাবু কবে আসবে? আমরা একটা ভাইয়া বাবু চাই। তুমি তাড়াতাড়ি একটা ভাইয়া বাবু নিয়ে আসো, আমরা এসে খেলবো ভাইয়া বাবুর সাথে।
তখন আমি বললাম, ভাইয়া বাবু কোথায় থেকে আনবো আমি? তখন তারা নিজ থেকে বলে, তোমার পেট থেকে আনবে!যেমন করে রোসিয়া’র আম্মুর পেট থেকে রোসিয়ার জন্য ভাইয়া বাবু নিয়ে এসেছে!
ওদের এরকম কথা বার্তায় আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকি,কি বলবো এদের। ডিজিটাল বাচ্চা গুলো আমার থেকেও বেশী জেনে বসে আছে।
খুব মনে পড়ছে ওদের কথা। আপুর ছেলে জিহান বললো,মামি তুমি একটু এই রুমের বাহিরে যাবে? আমি বললাম কেন বাবা?সে বললো,
– আমি স্কুল ড্রেস গুলো চেঞ্জ করবো তাই।
ওর কথা শুনে আরো একবার অবাক হলাম আমি। এইটুকুনি ছেলে সে আমার সামনে চেঞ্জ করতে লজ্জা পাচ্ছে?যাক এটা খুব ভালো।প্রত্যেকটা মানুষের লজ্জা থাকা জরুরি।যে মানুষদের লজ্জা থাকে সে অন্যায় কাজ করতে সংকোচ বোধ করে,ফলে অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকে।
________
রুমের বাহিরে বের হতেই আপুর শ্বাশুড়ি আম্মা আমাকে তার কাছে যেতে বললেন। বৃদ্ধা পান চিবোতে চিবোতে এটা ওটা জিজ্ঞাসা করছেন।এক পর্যায়ে বললেন,
– তো বউ বাচ্চা কাচ্চার খবর কি? শুনছি তোমাগো বিয়া হইছে মেলা দিন হইছে। এইবার একটা বাচ্চা নিয়া নাও বুঝঝো?
বুঝলাম না সবাই এভাবে বাচ্চা নিয়ে পরেছে কেন?….
#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-১৮
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
আল্লাহ তা’আলা যেদিন চাইবে সেদিন হবে খালামনি।
– তার ফরেও তোমাগো ইছছা থাহন লাগবো না?তুমগো ইছছা থাকলে না আল্লাহ বাচ্চা কাচ্চা দিব। আমাগো কালে তেরো চইদ্দো বয়সে বাচ্চা কাচ্চা হইয়া গেছে।অনে তুমাগো নিয়ুম কানুন বুঝি না বাপু।
বৃদ্ধার কথার উত্তরে আমি আর কোন জবাব দিলাম না, হয়তো আমার ভালোর জন্যই বলছেন তিনি। ভাবছি রাহাতের সাথে কথা বলবো এই বিষয় নিয়ে। সবার মতো আমিও চাই আমার একটা ছোট্ট সোনামণি যার ছোট্ট শরীর টাতে আদরে আদরে ভরিয়ে দেব আমি। তার ছোট অধর দুটি ছুঁয়ে দেবে আমায়। আমিও তখন তার আঁখিপল্লব দুটো তে নিজের অধর ছুঁয়ে দেব। ধীরে ধীরে সে কথা বলবে, তখন আমাকে মাম্মা আর রাহাত কে বাবা বলে ডাকবে। পৃথিবীর প্রত্যেকটা নারী একবার হলেও এই সুখ অনুভব করতে চায়।
– কি হইলো বউ কিছু কইতাছো না ক্যান?
আমি উনার হাত দুটো ধরে বললাম,
– খালামণি আমাদের জন্য দো’আ কইরেন, আল্লাহ তা’আলা যেন খুব তাড়াতাড়ি আমার কোল আলো করে দেয়।
তারপর উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
– দো’আ করি বউ তোরে যেন আল্লাহ একটা নাতি দেয়।
আপু এসে বললো,
– আয়রা খেতে আসো। আম্মা আপনি ও আসেন।
তারপর ডাইনিং রুমে এসে দেখি রাহাত আসে নাই,আপু বললো রাহাত ঘুমিয়ে আছে।আপু কতো বার ডেকেছে তাও উঠে নাই।তাই আমি গেলাম ডাকার জন্য।
রুমে এসে দেখি সে আরামে ঘুমিয়ে আছে, এদিকে দুপুর দুটো বেজে গেছে তবুও উনার খাওয়ার খবর নেই। পাশে বসে কন্ঠস্বর ছোট করে ডাকলাম রাহাত উঠো, সবাই খেতে যেতে বলছে।তার কোন পাত্তাই নেই।গরম বলে সার্ট খুলে চিকন স্লিপের সাদা গেঞ্জি পরে ঘুমিয়ে আছে। আমি একটু ঝুঁকে তার চুল গুলো নেড়েচেড়ে বললাম এই রাহাত উঠো সবাই অপেক্ষা করছে তো। সে আচমকা আমার গলা জড়িয়ে তার একদম কাছে নিয়ে আসলো। তারপর ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো,
– এভাবে মানুষ কে আদর করে ডাকতে আসলে, উঠার বদলে মানুষ আরো আরাম করে ঘুমাবে।
আমি তখন বললাম,
– তো কিভাবে ডাকবো শুনি?
– জোরে চেঁচিয়ে ডাকতে হবে, তাহলেই ঘুম দৌড়ে পালাবে।
– উহু এভাবে ঘুমের মানুষ কে জাগ্রত করা উচিৎ নয়। আকস্মিক চেঁচামেচি শুনে তার মস্তিষ্কে আঘাত লাগতে পারে।এক হাদিস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, “ঘুম হলো মৃত্যুর ভাই।” উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের শরীর থেকে আত্মা উঠিয়ে নেওয়া হয়। প্রধান পার্থক্য হলো- ঘুমের ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত আত্মা ফিরিয়ে দেয়া হয় কিন্তু মৃত্যুর ক্ষেত্রে আত্মা শরীর থেকে চিরদিনের জন্য আলাদা হয়ে যায়। তাই, এই যে প্রতিদিন আমরা জাগ্রত হই, এর মানে হলো আমাদের প্রকৃত অর্থেই আবার জীবন দেয়া হয়। এ জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুম থেকে জেগে উঠার পর বলতেন- “সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদের মৃত্যু দেয়ার পর আবার জাগ্রত করেছেন। আর পরিশেষে আমরা তাঁর নিকটেই ফিরে যাব।” প্রতিটি দিনই এক একটি নব জীবন, নব সূচনা।
তাই আমাদের উচিৎ ঘুমন্ত ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে ডেকে জাগ্রত করা।
আমার কথা গুলো রাহাত মনোযোগ দিয়ে শুনে, তাকিয়ে রইলো অপলক দৃষ্টিতে। আমি ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি এভাবে তাকিয়ে কি দেখছো?
– আমার সুন্দরী এবং জ্ঞানী বউ কে দেখছি।জানো তুমি না বয়সের তুলনায় বেশি ই বুঝো, মা শা আল্লাহ।
– হুম হয়েছে আর পাম দিতে হবে না, আমি পামে ফুলি না।
– তাই না??
ব্যাস শুরু হয়ে গেল তার ভালোবাসা নামক অত্যাচার! তবে এটা একটা পবিত্র বন্ধনের অংশ বিশেষ, যেখানে কোন কলঙ্ক নেই। যেখানে স্ত্রীকে ভালোবাসা সুন্নাত। আলহামদুলিল্লাহ।
কিছুক্ষণ পর আমাকে ছাড়লেন তিনি, আমি তার কান মলে দিয়ে বললাম,
– ফাজিল ছেলে কোথাকার,দরজা খুলে রাখা যদি কেউ চলে আসতো?
সে কান ডলতে ডলতে বললো,
– আরে আমি জানি কেউ আসবে না,তাইতো তোমার মিষ্টি অধরে টুপ করে ডুবে গেলাম হা হা হা,,
– হইছে এবার তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসো আমি যাই ওখানে, না জানি তারা কি ভাবছেন?
রাহাত বাথরুমে চলে গেল, আর আমি ডাইনিং রুমে আসলাম। এসে দেখি খালামণি আর জিহান খেয়ে চলে গেছে।আর আপু আমাদের জন্য বসে আছে। আমি চেয়ার টেনে বসে বললাম,
– আপু আপনি খেয়ে নিতেন, কয়টা বেজে গেছে এখনো অবধি আমাদের জন্য বসে আছেন। আপনার ভাই কে ডাকতে ডাকতে শেষ আমি। উঠতে ছিলই না।
– আরে সমস্যা নেই, তোমাদের রেখে আমি খাই কি করে।ভাই এরকম ই, অফিসে প্রচুর পরিমাণে কাজ করে তো সে জন্য ছুটি পেলে ঘুমিয়ে নেয়। কারণ আবার কাজে জয়েন হলে তো ঘুমাতে পারবে না তেমন।
– জ্বি বুঝতে পেরেছি আপু।
তারপর রাহাত আসলে খাওয়া শুরু করি।আপু অনেক কিছু তৈরি করেছেন_পাট শাক,মাছ ভাজা,মাছ ভুনা,ডিম ভাজা, গরুর গোশত, মুরগির রোস্ট,ডাল।আপু আমাদের দুজনের প্লেট ভরে খাবার দিল। আমি অল্প খেয়ে আর খেতে পারছি না, রাহাত আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বললো, আজকে এগুলো খেয়ে তবেই উঠবে তুমি না হয় খবর আছে। ঠিক মতো খাবার না খেয়ে দিন দিন পাতলু হয়ে যাচ্ছ। শেষে না পেরে একটা একটা করে ভাত মুখে দিচ্ছি। রাহাত নিজের খাবার শেষ করে, আমার খাবার প্লেট নিয়ে গেল।যা দেখে আমি খুব খুশি হয়ে উঠতে যাবো তখনি রাহাত বললো,
– কোথায় যাচ্ছ? বসো এখানে।
এই বলে আমার খাবার গুলো মাখিয়ে লোকমান ধরলো আমার মুখের সামনে। আমি করুন চোখে তাকালাম, কিন্তু সে কোন পাত্তাই দিল না। উল্টো চোখ রাঙিয়ে ইশারা করলো খাওয়ার জন্য।
শেষে না পেরে খেতে হলো সব গুলো খাবার। খাবার শেষে আপু দই দিল, সেগুলো ও আমাকে খাওয়ালো বেয়াদব ছেলেটা। ইচ্ছে করছে কামড়ে দেই,আপু বলে কিছু করতে পারছি না। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে চলেছে তিনি।
খাবার খাওয়া শেষে আমি জিহান এর রুমে চলে গেলাম। রাহাত জোর করে খাইয়ে দিয়েছে বলে ওর রুমে গেলাম না আমি।
গিয়ে দেখি জিহান চিপস, চকলেট,ডাল ভাজা,জোস এগুলো দুই ভাগে বিভক্ত করছে। যেগুলো ওদের জন্য ওর মামা এনেছে। আমি গিয়ে ওর পাশে বসলাম। জিজ্ঞাসা করলাম দুই ভাগ কেন? বললো,এক ভাগ ওর আরেক ভাগ ওর ভাইয়ের। খেয়াল করে দেখলাম একদম সমান করে ভাগ করেছে। হঠাৎ জিহান বললো,
– মামি,মামা কি তোমার সাথে খুব বেশি দুষ্টুমি করে?
ওর এরকম কথায় বরকে গেলাম আমি। সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন এমন মনে হলো তোমার?
ও বললো,
– তখন দেখলাম তুমি মামার কান মলে দিচ্ছ তাই।
আমি বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কি বলে এই ছেলে?ও আবার আমাদের দু’জনকে একসাথে দেখে ফেলে নি তো?যদি দেখে থাকে! হায় আল্লাহ!এখন কি করবো আমি? কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম,
– তুমি কিভাবে জানলে জিহান? তুমি কি দেখেছো?
বড় বড় পাপড়ি গুলো মেলে,চোখের কালো মণি গুলো আমার দিকে স্থির রেখে জিহান বললো,
– আম্মু তখন তোমাদের খাবার খেতে ডাকার জন্য আমাকে পাঠিয়েছিল, আমি গিয়ে দেখি তুমি মামার কান মলে দিচ্ছ।
– তাহলে যে তুমি আমাদের ডাকলে না?
– মামা দুষ্টুমি করেছে,আর তুমি শাসন করছো। আমি গেলে মামা লজ্জা পেত তাই চলে আসি।
আমি শুধু অবাক হয়ে ওর কথা গুলোই শুনলাম,মা শা আল্লাহ এইটুকুনি ছেলে ওর এতো জ্ঞান? আমি সাথে সাথে ওর গাল দুটো টেনে দিলাম।জিহান অনিমেষ চাহনিতে তাকিয়ে রইলো। আমি তখন বললাম,
– আমার বিজ্ঞ বাবাটা কি দেখছে এভাবে?
জিহান এক গাল হেসে বললো,
– মামি তুমি খুব সুন্দর।
আমিও হেসে বললাম,
– উহু আমি সুন্দর নই, তুমি সুন্দর।
– ছেলেরা সুন্দর হয় নাকি?মেয়েরাই সুন্দর হয়।
– কেন এমন মনে হয় তোমার?
– আমার ক্লাসমেট রিমু ও খুব সুন্দর।ও বলেছে ছেলেরা সুন্দর হয় না।মেয়েরাই সুন্দর হয়। মেয়েদের খুব বড় বড় চুল হয় চুল গুলো সুন্দর সুন্দর ফ্রান্স ক্লিপ দিয়ে বেঁধে রাখা যায়। কিন্তু ছেলেদের এই সুন্দর্যোটা নেই। তাছাড়া ওরা কতো সুন্দর সুন্দর ড্রেস পরতে পারে, ছেলেদের সার্ট প্যান্ট ছাড়া আর কিছুই নেই তেমন।
জিহানের কথা শুনে বুঝতে পারলাম, এই নিয়ে কথাকাটাকাটি হয়েছে তার সুন্দরী ক্লাসমেট রিমুর সাথে।তাই জিহান কে বললাম, তোমার ক্লাসমেট রিমু কে বলবে মেয়েরা কখনোই সুন্দর হয় না! মেয়েরা হয় সুন্দরী।আর ছেলেরা সুন্দর।
জিহান ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– সত্যি মামি? তবে কেন মেয়েরা সুন্দর হয় না?
– এটা তুমি বড় হলে এমনিতেই বুঝতে পারবে,কজ আমার জিহান অনেক বুদ্ধিমান।
মামা তুমি এভাবে উকি ঝুকি মারছো কেন? রুমের ভিতরে আসছো না কেন? তুমি কি ভয় পাচ্ছ মামি কে?
আমি পিছনে ফিরে দেখলাম, রাহাত জিহানের কাছে ধরা পরে এখন বোকা হেসে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওরে দেখে ভেংচি কেটে অন্য দিকে তাকিয়ে আছি। সে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে জিহানের সাথে বসে বললো,
– কি করছো তোমরা?
জিহান গাড় ঘুরিয়ে মাথা উঁচু করে বললো,
– মামা তুমি অনেক দুষ্টুমি করো মামির সাথে।পচারা দুষ্টুমি করে তুমি জানো না?
রাহাত এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– তোমার মামি আমার কথা একদম শুনে না, সেই জন্যই তো আমাকে দুষ্টুমি করতে হয়। এই দেখ আমি কতোবার ডাকলাম তাও তোমার মামি শুনলো না, এখানে এসে বসে আছে। তুমি ই বলো এখানে কি আমার দোষ?
জিহান বিপদে পড়ে গেল কি বলবে এখন?তাই সে বিছানার অন্য পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। এদিকে রাহাত মুচকি মুচকি হাসছে। তারপর আমাকে টেনে রুমে নিয়ে এসে দরজা লাগিয়ে দিল। লাগিয়ে বললো, দুপুর বেলা না ঘুমিয়ে অন্যের ঘুমে ডিস্টর্ভ করছো। পিচ্চি কোথাকার,চলো ঘুমাবে চলো। তারপর জোর করে নিয়ে শুইয়ে দিল, সাথে নিজেও। আমি ঘুমানোর ট্রাই করছি আর সে আমাকে ঘুম পারানোর নাম করে উল্টো ঘুমের তেরোটা বাজিয়ে দিচ্ছে।,,,,,,
#চলবে,,, ইনশা আল্লাহ।
(