#ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর
#লেখিকা_হৃদিতা_আহমেদ
পর্ব-১২
মিসেস মধুমিতা বিছানায় বসে গভীর মনোযোগে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর ‘মানব জমিন’ বইটা পড়ছিলেন।মি. মাহবুব একটা ইমপোর্টেন্ট ফোন কল আসায় বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন।পুতুলকে দৌড়ে রুমে ঢুকতে দেখে দ্রুত ফোন রেখে রুমের দিকে পা বাড়ায়। হঠাৎ ঝড়ের বেগে কেউ এসে জাপটে ধরাই চমকে যান মিসেস মধুমিতা।পুতুলকে দেখে দ্রুত বইটা রেখে ব্যস্ত হয়ে বললেন,
-” কি হয়েছে মামনি?”
-” বড় আম্মু তোমার ছেলে আমাকে কামড়ে দিচ্ছে।”
ততক্ষণে সূর্য আর ছন্দও মায়ের রুমে এসে হাজির হয়েছে।পুতুলের কথা শুনে মি.মাহবুব কাশতে কাশতে ছেলের দিকে তাকালেন।ছন্দ চোখ গুলো গোল গোল করে পুতুলের দিকে তাকিয়ে আছে।সূর্য ঠিক কী এক্সপ্রেশন দিবে বুঝতে পারছে না।তার মনে হচ্ছে মাথাটা বলছে, আনফরচুনেটলি ইউর সিস্টেম হ্যাজ বিন স্টপড।
মিসেস মধুমিতা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললেন,
-“কী!! কে কামড়াচ্ছে!!”
-” তোমার ছেলে।”
মিসেস মধুমিতা দ্বিগুণ বিস্মিত হয়ে বলল,
-” অবাক!! অবাক কেন কামড়াবে তোমাকে!!”
বড় আম্মুর প্রশ্নে পুতুল গরগর করে ভাইয়া বলার অপরাধে তার নাক কামড়ে দেয়ার হিস্টোরিকাল কাহিনী শুনিয়ে দিল।
সূর্যের রাগে,দুঃখে,লজ্জায় নিজের চুল টেনে ছিড়তে ইচ্ছে করছে।তার-ছিঁড়া মেয়ে, সে তো অভিক আহমেদ সম্পর্কে জানতে এসেছিল।আর এই নির্বোধ মেয়ে বাবা-মার সামনে তার প্রেস্টিজের খিচুড়ি পাকাচ্ছে।সূর্য কিরমির করে বলল,
-” এই মেয়ে, এই! আমি তোমাকে কামড়ে দিয়েছি আর তুমি, তুমি কী করেছ?,,,,, মা দেখো তোমাদের আদরের পুতুল আমার হাতের কি হাল করেছে, দেখো,,,,,ভালো করে দেখো।”
বলেই মায়ের সামনে বাম হাতটা তুলে ধরে।দুজনের কাহিনী দেখে মিসেস মধুমিতা বাকশূণ্য হয়ে হতাশ ভঙ্গিতে মি.মাহবুবের দিকে তাকান যার অর্থ এরা কী বাচ্চা!! সূর্যের হাতের দাগ দেখে পুতুল কাচুমাচু হয়ে বলল,
-” বড় আম্মু আমি ইচ্ছে করে করিনি।তোমার ছেলেই তো আগে আম,,,,,,।”
-” এই মেয়ে, এই! আমি কি তোমাকে কিছু বলেছি তুমি মাকে নালিশ দিচ্ছো।”
ছেলে মেয়েকে থামাতে এপর্যায়ে মি. মাহবুব মুখ খুললেন,
-” অবাক কী হচ্ছে কী?তুমি কি বাচ্চা হয়ে গেছো? আর পুতুলকে রাগ দেখাচ্ছে কেন? দোষ তো তোমারই, ওর সাথে একদম রেগে কথা বলবে না।এন্ড সে সরি টু হার।
-” বাবা,,,,”
-” আমি কিচ্ছু শুনতে চায় না, ওকে সরি বলো।”
বড় আব্বুর কথায় পুতুল পট কর বড় আম্মুকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে।সূর্য পুতুলের হাসি হাসি মুখ দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
-” ওকে সরি।”
বলেই রুম থেকে গটাগট পা ফেলে বেরিয়ে যায়।পুতুল সূর্যর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভেঙচি দিল।এতক্ষণে ছন্দ কথা বলল,
-” আমি তো ভাবতাম এ বাড়িতে আমিই সবথেকে ছোট,( পুতুলের দিকে তাকিয়ে) তোমরা তো আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করলে।আর আম্মু দেখলে তো আমি কত্ত ভালো মেয়ে।”
সূর্য নিজের রুমে পায়চারি করতে করতে পুতুলের তুষ্টি করছে।গাধা, মাথামোটা, তার-ছেড়া মেয়ে একটা, মাকে গিয়ে কামড় কাহিনী বলা দাড়াও তোমার ব্যবস্থা করছি।এক গ্লাস পানি খেয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে কিছু একটা ভেবে শয়তানি হাসি দিয়ে উঠে দাড়ায় সূর্য।
পুতুল বড় আব্বু আর বড় আম্মুকে গুড নাইট জানিয়ে ফুরফুরে মেজাজে নিজের রুমে চলে আসে।দরজা লক করে সামনে ঘুরতেই ধড়াম করে কারো সাথে ধাক্কা খায়, নাকে হাত দিয়ে সামনে তাকাতেই তার চোখ গুলো অটোমেটিক ছোট সাইজের ডিমের মতো হয়ে যায়।সূর্যের ঠোঁট কামড়ে হাসি দেখে মূহুর্তেই তার নাকের ব্যাথা, আশেপাশের সবকিছু গায়ের হয়ে যায়।খানিকক্ষণ আগের কথা ভেবে কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলল। দ্রুত দরজার দিকে ঘুরতে গেলেই সূর্য ফট করে পুতুলকে কোলে তুলে নেয়।পুতুল ছটফট করে চিল্লাতে শুরু করে।
-” বড় আম্মু!বড় আব্বু! বাচাও আমাকে,,,,, ”
-“চুপ, একদম চুপ।আর একটা কথা বললে একদম বেলকনি থেকে নিচে ফেলে দেব।”
কে শোনে কার কথা পুতুল আরো জোরে চিল্লাতে শুরু করে,
-” বড় আম্মু বাচাও, অবাক ভা,,,,,”আহ মাম্মা!”
সূর্য সত্যি সত্যি পুতুলকে ফেলে দিয়েছে তবে বেলকনি থেকে নিচে নই ফ্লোরে ফেলেছে।পুতুল ব্যাথা পেয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে সূর্যের দিকে তাকায়।সূর্য কিছু না বলে আবারও পুতুলকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেয়।
-” কি হলো চিল্লাও, চিল্লাচ্ছ না কেন? বলদ কোথাকার, তুমি কি জানোনা তোমার রুমটা সাউন্ড প্রুফ?”
সূর্যের কথা শুনে পুতুলের এবার সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলার অবস্থা, এই রাক্ষস টা মনে হয় আজ তাকে একদম গিলে নেবে।ভেবেই কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
-” কে্ কেপ্টেন আমার ভুল হয়ে গেছে আর কখনো ভাইয়া বলবো না।”
পুতুলের ফেস দেখে সূর্যের গড়াগড়ি খেয়ে হাসতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু হাসা যাবে না ভেবে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
-” সমস্যা নেই, ভাইয়া বলে ডেকো তবে এবার এমন জায়গায় কামড়ে দেব আম্মুকে কেন কাউকে দেখাতে পারবে না।”
সূর্যের কথা শুনে পুতুল ইয়া বড় একটা ফাঁকা ঢোক গিলে বলল,
-” মা ম্ মানে?”
সূর্য শয়তানি হাসি দিয়ে পুতুলের দিকে ঝুকে কানে ফিসফিস করে বলল,
-“নাভির বাম পাশে যে তিলটা আছে ঠিক ওখানে কামড় পরবে পিচ্চি।” বলেই চোখ টিপ দিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসি দেয় সূর্য।
সূর্যের কথায় পুতুলের চোখ ছানাবড়া হয়ে ঠোঁট জোড়া অটোমেটিক আলাদা হয়ে যায় আর হাতটা নিজের পেটে চলে যায়।পুতুলের অবস্থা দেখে এবার আর সূর্য নিজের হাসি ধরে রাখতে পারে নি, পেট ধরে হুহা করে হেসে দেয়।
সূর্যের হাসি দেখে পুতুলের চোখে ভয়,বিস্ময় কেটে অদ্ভুত মুগ্ধতার উপস্থিতি ঘটে।আর সেই মুগ্ধতা নিয়ে পলকহীন ভাবে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে পুতুল।সূর্য হাসতে হাসতে সামনে তাকিয়ে দেখে পুতুল ভীষণ কিউট ভাবে তার দিকে চেয়ে।সূর্য হাসতে হাসতেই কিছু না ভেবেই পট করে পুতুলের নাকে একটা চুমু বসিয়ে দেয়।
ঘটনার আকস্মিকতায় পুতুল হতবাক হয়ে নিজের নাকে হাত দিয়ে বসে থাকে।সূর্য নিজের ভুল বুঝতে পেরে পুতুলের দিকে তাকিয়ে দেখে পুতুল নাকে হাত দিয়ে তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।সূর্য নিজেকে সামলে একটু জোরে বলল,
-” বোকার মতো তাকিয়ে আছো কেন? পিচ্চিদের পিটুনি দেওয়ার পর এভাবেই আদর করতে হয়।তাই আদর দিয়েছি বুঝতে পেরেছো?
পুতুল লজ্জা,ভয়,বিস্ময়ের মিশ্র অনুভূতি নিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে।পুতুল কোন উত্তর না দেওয়ায় সূর্য আবারও জোরে বলল,
-” কীহ,বুঝতে পেরেছো?”
সূর্যের ধমকে পুতুল দ্রুত গতিতে মাথা ঝাকিয়ে বোঝালো সে বুঝতে পেরেছে।
-” হুম গুড গার্ল।” বলে পুতুলের চুল গুলো এলোমেলো করে দিল।সূর্যের কাজে পুতুলের এবার সত্যি সত্যি নিজেকে চার পাঁচ বছরের পিচ্চি মনে হচ্ছে।
-” ওকে গুড নাইট পিচ্চি।” বলে সূর্য রুম থেকে বের হয়ে যায়।
আর পুতুল তার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে ঠাঁই বসে থাকে।
সময় চলছে তার আপন গতিতে,দেখতে দেখতে পুতুলের দেশে আসার একমাসের বেশি সময় কেটে যায়। কলেজে নতুন নতুন বন্ধু,বড় আব্বু, বড় আম্মু, ছন্দ আর সূর্য সবাইকে নিয়ে এক নতুন পৃথিবী তৈরি হয়েছে পুতুলের।কলেজে বন্ধুদের সাথে আড্ডা,কলেজ শেষে ছন্দর ছুটি হবার আগ পর্যন্ত সূর্যর সঙ্গে রোজ নতুন নতুন জায়গা বেড়াতে যাওয়া।ছুটির দিনে পরিবারের সাথে আনন্দঘন সময় কাটানোই এখন পুতুলের নতুন পৃথিবী।যেখানে সবাই তাকে ভীষণ ভীষণ ভালবাসে।তবে সেই ভীষণ ভালবাসার মাঝেও সে মাম্মার ভালবাসাটা ভীষণ ভাবে মিস করে।আর মাম্মার কথা মনে হলেই বাবার প্রতি মিলিয়ন মিলিয়ন অভিমান জমা হয় পুতুলের।তখন সে নিরবে কেঁদে বাবাকে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কথা শোনায়।
আজ ছুটির দিন হওয়ায় ঘুম থেকে লেইট করে উঠেছে পুতুল।ফ্রেশ হয়ে একটা সাদা শর্ট টপস আর স্কাই কালারের স্কার্ট পড়ে পায়ে স্লিপার চাপিয়ে ঘুমে ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে হেলেদুলে নাস্তার টেবিলে আসে।টেবিলে ছন্দকে একা একা বিরস মুখে জ্যাম পাউরুটি খেতে দেখে পুতুল তার পাশের চেয়ার টেনে ধপ করে বসে বলল,
-” গুড মর্নিং টুকটুকি, বাকি সবাই কোথায়? নাকি আজ আমরা দ্যা লেইট লতিফ হয়েছি।”
ছন্দ মুখ পাউরুটি নিয়েই উত্তর দিল,
-” গুড মর্নিং আপু, জানিনা কি হয়েছি তবে আম্মু বলে গেল খেয়ে রেডি হতে সবাই মিলে কোথাও যাবে মেবি।”পুতুল খেতে খেতে বলল,
-” কোথায় যাবে? ঘুরতে? ”
-” জানিনা, তোমাকেও রেডি হতে বলেছে।”
পুতুল মাথা নেড়ে হুম বলল।তার সামনের চেয়ারের দিকে তাকিয়ে ভাবলো ইডিয়ট কেপ্টেনটার আবার কী হলো, সবসময় তো আমাদের সাথেই নাস্তা করে আজ বান্দা গায়েব কেন? আপেলে কামড় দিয়ে মনে মনে হেসে বলল, অবশ্য ভালোই হয়েছে আজ আর রাক্ষস টা পা ঠুকাতে পারবেনা।
#ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর
#লেখিকা_হৃদিতা_আহমেদ
পর্ব-১৩
নাস্তা শেষ হবার সাথে সাথেই স্বপ্না দুইটা শপিং ব্যাগ হাতে হুরপার করে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়।পুতুল আর ছন্দ চমকে ভ্রু কুঁচকে স্বপ্নার দিকে তাকায়। তারপর পুতুল বলল,
-” স্বপ্না আপু, এরকম সিডরের মতো আসছো কেন?”
স্বপ্না একটু দম নিয়ে ব্যাগ দুটো এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“আপামনি, বড়ো মা আপনাগো এই গুলা পড়তে কইছে।আর তাড়াতাড়ি তৈরি হইতে কইছে।”
-” ঠিক আছে দাও।”
সাদা চুরিদারের সাথে সাদা ওড়না জামা পড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে হঠাৎই মাম্মার কথা মনে পড়ে পুতুলের।মাম্মা সবসময় বলতো সাদাতে নাকি তাকে পরী পরী লাগে শুধু ডানা লাগালেই সে পুরোপুরি পরী হতে পারবে।ভেবেই মৃদু হেসে বাচ্চাদের মতো গোল জামাটা ধরে একবার ঘুরে দেখলো।তারপর ফোন টা নিয়ে মাম্মাকে ফোন দেয়, কিন্তু ফোন অফফ বলছে।পুতুলের ভ্রু কুঁচকে যায়, গতকাল রাত থেকে মাম্মার ফোন অফফ দেখাচ্ছে।কিছু একটা ভেবে দ্রুত অর্ককে ফোন করে।কিছুক্ষণ পরেই ফোন রিসিভ করে অর্ক।
-” হুম পুতুল বল।”
-” অক্কো ভাইয়া, মাম্মা কোথায় বলতো? মাম্মার ফোন অফফ কেন?”
অর্ক একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল,
-” তুই কী আজকের ডেটটা ভুলে গেছিস? খালামনি রুম লক করে বসে আছে কাল থেকে।”
অর্কর কথায় ফট করে পুতুলের মন খারাপ হয়ে যায়। হঠাৎই তার মনে হলো তাইতো সে তো ভুলেই গেছিল।আজকের এই দিনে প্রত্যেক বছর মাম্মা নিজেকে ঘর বন্দি করে রাখে, যদিও তার কারণটা কী সে জানে না।ভেবে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলল,
-“ঠিক আছে রাখছি আমি।”
মন খারাপ হওয়ায় আর কোনো সাজুগুজু করলো না পুতুল।তার এখন মাম্মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে, ভীষণ করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।সে তো জানে মাম্মা আজ ভীষণ কাঁদবে আর ক্লোজেট থেকে একটা ছোট বক্স বের করে তার মধ্যে থেকে দুইটা খাম নিয়ে জাপটে ধরে খুব কাদবে।যদিও সে লুকিয়ে লুকিয়ে খাম দুটো কিসের দেখার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু লাভ হয়নি বক্সটা তালা লাগানো থাকে।ড্রয়িং এর সোফায় বসে এসব ভেবে চোখ টলটল করে উঠে পুতুলের।ঠিক তখনই ছন্দ লাফ দিয়ে তার পাশে বসে টুপ করে পুতুলের গালে চুমু একে বলল,
-” ইসস আপু তোমাকে বরফ দেশের প্রিন্সেস দেখাচ্ছে।” বলে আবারও চুমু দেয়। ছন্দর কথায় পুতুল তার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে বলল,
-“আর তোমাকে লিটল ফেইরি লাগছে টুকটুকি।” বলেই ছন্দকে জড়িয়ে ধরে।
বড় আম্মুকে দেখে পুতুল হেসে বলল,
-” বড় আম্মু আজ কী আমাদের ড্রেস কোড সাদা রাখা হয়েছে? আইডিয়া টা কিন্তু দারুণ।”
মিসেস মধুমিতা মলিন হেসে মাথা নাড়লেন।হঠাৎই পুতুলের ভীষণ কান্না পাচ্ছে, কিন্তু কেন পাচ্ছে?তার কি মাম্মার জন্য কান্না পাচ্ছে? কিছু না ভেবেই পুতুল বড় আম্মুকে জাপটে ধরে বলল,
-“বড় আম্মু আমাকে একটু আদর করে দাও তো, আমার খুব মাম্মার কথা মনে পড়ছে, খুব মনে পড়ছে।”
পুতুলের কথায় মিসেস মধুমিতা চোখে টইটম্বুর পানি নিয়ে পুতুলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাথায় ভালবাসার পরশ একে দেন। পুতুল বড় আম্মুকে জড়িয়ে ধরেই ফিসফিস করে বলল,
-” বড় আম্মু আমাকে এতো ভালবাসো কেন বলতো?” মিসেস মধুমিতা পুতুলকে ছাড়িয়ে তার সামনাসামনি বসে টলটলে চোখে তাকিয়ে বললেন,
-” ভালবাসতে কোন কারণ লাগে না মামনি।তবে তোমাকে ভালবাসার একটা বিশেষ কারণ আছে আমার কাছে।”
বড় আম্মুর কথায় পুতুল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।মিসেস মধুমিতার চোখ থেকে টুপ করে একটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো, সাথে সাথে চোখটা মুছে পুতুলের কপালে চুমু দিয়ে বললেন,
-” ভালবাসার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন তোমার বাবা।আর সেই ভালবাসার অসীম ক্ষমতাবান ব্যক্তিটির দেওয়া সবথেকে মূল্যবান উপহার হলে তুমি।তাই আমি চাইলেও তোমাকে না ভালবেসে থাকতে পারিনা।”
বলে মিসেস মধুমিতা পুতুলকে জাপটে ধরে ডুকরে কেঁদে দেন।ছন্দ কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
-” এই আম্মু তুমি কাঁদছো কেন?”
বড় আম্মুর ডুকরে কাঁদা দেখে পুতুল অবাক হয়ে বসে আছে, তার বুকের ভেতর কষ্টেরা কেমন দলা পাকিয়ে আসছে।এই পরিবারের প্রত্যেক টা ব্যক্তি যে তার বাবাকে ভীষণ ভালবাসে সে এ বাড়িতে পা রেখেই বুঝতে পেরেছিল।কিন্তু তারা যে এতোটা বছরেও তার বাবাকে মনে করে কাঁদে সেটা সে আজ বুঝতে পারছে।উফফ তার নিশ্বাস ফেলতে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে।হঠাৎই তার বাবার জন্য কষ্ট হচ্ছে, নাহ তাকে এখনই একবার বাবার ফটো টা দেখতে হবে।
ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটে কারো ডাকে।সূর্য মেইন ডোর দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে তার মাকে ডাকলো,
-” মা! মা! কোথায় তোমরা?রেডি হয়েছো?”
মিসেস মধুমিতা দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে বললেন,
-” আমরা সবাই রেডি, তোর বাবা কোথায়?”
সূর্য একপলক পুতুলের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল,
-” বাবা গাড়িতেই আছে, এখন আর ভেতরে আসবে না।তোমরা তাড়াতাড়ি আসো তো।”
-” হুম চল।”
পুতুল হাটতে হাটতে সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে।সূর্য সাদা পাঞ্জাবির সাথে সাদা গেবাডিং প্যান্ট টাকনুর উপরে সুন্দর করে ভেঙে রেখেছে আর পায়ে সিম্পল স্লিপার পড়ে আছে।মনে হয় নামাজ পড়তে গেছিল।কিন্তু মুখটা এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন?
এসব ভাবতে ভাবতে গাড়ির কাছে আসতেই দেখতে পায় বড় আব্বু ড্রাইভিং সিটে বসে একধ্যানে সামনের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।সকলে গাড়িতে উঠে বসলেও বড় আব্বু একটাও কথা বলছে না দেখে পুতুল বেশ অবাক হয়।তার বড় আব্বু সবসময় মিষ্টি হেসে কথা বলে অথচ আজ সবাই এতো চুপচাপ কেন? আজ কী সবার একসাথে মন খারাপ?
সূর্য ড্রাইভ করছে,বড় আব্বু তার পাশে চুপ করে বসে আছেন।বড় আম্মু বাইরে তাকিয়ে আছেন আর টুকটুকি আম্মুর হাত পেচিয়ে ঘুমিয়ে গেছে।সকলের নিরবতায় পুতুলের কেমন দমবন্ধ অনুভূতি হচ্ছে। অস্থিরতা কমাতে চুপচাপ সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে পুতুল।এতো কেন অস্থির লাগছে তার? আচ্ছা তারা কোথায় যাচ্ছে সেটাই তো জানেনা পুতুল! জিজ্ঞেস করবে ভেবে ফট করে চোখ খুলে তাকায় পুতুল।ঠিক তখনই গাড়িটা থামাতেই সামনে গেইটে ‘ক্যান্টনমেন্ট কবরস্থান’ নেইম-প্লেট দেখে পুতুল স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।হঠাৎই তার নিজেকে অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছে, তবে কী আজ সেই বিশেষ দিনটা যার জন্য মাম্মা সবকিছু ছেড়ে তাকে নিয়ে দূরে চলে গেছিল।এই দিনটার জন্যই আজকের দিনে মাম্মা নিজেকে ঘর বন্দি করে রাখে আর এই মানুষ গুলো এতো কষ্ট পাচ্ছে। এতো কঠিন কষ্ট মাম্মা আর এই মানুষ গুলো কী করে সহ্য করে, উফফ,,,,, এতো কষ্ট সহ্য করা যায় নাকি!
ভাবনার মাঝেই বড় আম্মু যে কখন তাকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেইট থেকে একটু দুরে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারেনি পুতুল।ভাবলেশহীন ভাবে সামনে তাকাতেই গেইট থেকে একটু ভেতরে বড় আব্বু আর সূর্যকে দেখতে পায় পুতুল।তাদের সামনে থাকা জ্বলজ্বলে অক্ষরে লেখা ‘লেইট কেপ্টেন মিহির জামান খান’ নামটা দেখেই পুতুল দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। মিসেস মধুমিতা দ্রুত পুতুলকে শক্ত করে নিজের বুকের মাঝে জাপটে ধরে।
উফফ,,,,কষ্ট এতো কষ্টের কেন? তার এতো দমবন্ধ হয়ে আসছে কেন? নাহ এতো কষ্ট সহ্য করতে পারবে না সে। তার এখনই বাবাকে দরকার,অল্প একটু সময়ের জন্য হলেও দরকার।বাবাকে অল্প একটু জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে তার, শুধু অল্প একটুখানি।ভেবেই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে পুতুল।
পুতুলের কান্নার শব্দে মিসেস মধুমিতা কী করবেন বুঝতে পারছেন না।পুতুলকে জড়িয়ে ধরে নিজেও নিরবে কেঁদে দেন।অন্যদিকে সূর্য ছোট বাবার কবর জিয়ারত করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।ছোট বাবার মৃত্যু বার্ষিকীতে বাবার এই বাচ্চাদের মতো কান্না দেখলে তার ভীষণ অসহায় লাগে।মনে হয় পৃথিবীর কোন কিছুর বিনিময় যদি ছোট বাবাকে ফিরিয়ে আনতে পারতো তবে সে অবশ্যই সেটার বিনিময় ছোট বাবাকে ফিরিয়ে আনতো।মি. মাহবুব টলটলে চোখে ভাইয়ের কবরের পাশে বসে নেইম-প্লেটে হাত বুলিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেন।সূর্য দ্রুত বাবাকে উঠানোর চেষ্টা করতেই তিনি কেঁদে সূর্যকে বললেন,
-” তোর ছোট মা একদম ঠিক বলে এই মিহির টা খুব স্বার্থপর বুঝলি, খুব স্বার্থপর।” বলেই বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।সূর্য ফট করে বাবাকে জড়িয়ে ধরে নিরবে কেঁদে দেয়।
চলবে
উফফ আজ একটু ছোট হয়ে গেল। সরি😣
চলবে
গতকাল একজনের কমেন্ট পড়ে আমি সত্যি মুগ্ধ হয়েছি।তার কমেন্ট পড়ে আমার মনে হলো গল্পটা হয়তো আসলেই ভালো হচ্ছে। ধন্যবাদ রিডার্স এন্ড হ্যাপি রিডিং 😍😍