ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর পর্ব শেষ

#ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর
#লেখিকা_হৃদিতা_আহমেদ

পর্ব -৪৫

-” টুকটুকির কিছু হলে তোমাদের কাউকে ছাড়বো না আমি, বলে দিলাম।,,,(যেতে যেতে দাড়িয়ে আবারও বলল) মা, টুকটুকিকে না পেলে তোমরা কিন্তু আমাকেও ফিরে পাবে না।”
কথাটুকু বলেই টলটলে চোখে মুহূর্তেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায় সূর্য।
অন্যদিকে ছেলের কথায় ধপ করে পাশে থাকা চেয়ারে বসে পড়েন মিসেস মধুমিতা।জীবনের টানাপোড়নে নিজেকে এতটা অসহায় কখনো মনে হয়নি । সামান্য একটুকরো কাগজ, একটা চিঠি, মা হিসেবে তাকে এতটা অসহায় করে দেবে সেটা কখনো ভাবতেও পারেননি মিসেস মধুমিতা।হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে তার, তার একটা ভুলের জন্য তার সন্তানেরা হারিয়ে যাচ্ছে।সেদিন যদি মুরাদের দেওয়া উপহার গুলো টুকটুকিকে না দিতো তাদের জীবনে আজকের এই ঝড়টা কখনোই আসতো না। মুরাদ বার বার তাদের সুখের জীবনটা কেন এলোমেলো করে দেয়? মারা গিয়েও সে আরেকটুকরো সুখ এলোমেলো করে গেল। মৃত্যুর আগে টুকটুকির উদ্দেশ্য সামান্য বই, চকলেট উপহার স্বরূপ দিয়ে যায় মুরাদ।যদিও তিনি সবকিছু চেক করেই টুকটুকির হাতে উপহার গুলো দেন। কিন্তু বইয়ের ভাজে রাখা একটা চিঠি অগোচরে পৌঁছে যায় টুকটুকির হাতে। চিঠিটাও হয়তো ওতোটা বিশ্বাসযোগ্য হতো না যদিনা মুরাদ টুকটুকির মা তনিমার ছবি দিতো।টুকটুকি যে হবহু মায়ের চেহারার ভাগ পেয়েছে।

পুতুলকে নিয়ে প্রীতি বিদেশ পাড়ি দেওয়ার ছয়মাস পরেই তনিমাকে বিয়ে করে মুরাদ। নিজে অনাথ থাকায় বাপ-মা হারা তনিমাকে প্রথম দেখায় পছন্দ করে বিয়ে করেছিল মুরাদ।মিহিরের শোক কাটাতে মুরাদ ছায়ার মতো তাদের পাশে থাকতো।বিয়ের আড়াই বছর পরে তনিমা কনসিভ করে।কিন্তু পাপ কখনো পিছু ছাড়েনা।মুরাদের জীবনের কালো অধ্যায় খুলে যায় যখন তনিমা আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা।আর্ম জুডিশিয়াল বোর্ড এর তদন্তে সব সত্য প্রমাণিত হয়ে মুরাদের যাবজ্জীবন জেল হয়।পৃথিবীতে একমাত্র আপনজনের মুখোশ সামনে আসায় অসহায় হয়ে পড়ে তনিমা।ডেলিভারির সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মারা যায় তনিমা।কিন্তু রেখে যায় ফুটফুটে টুকটুকিকে।যদিও মি. মাহবুব বাচ্চাটাকে মেঘবৃষ্টি আশ্রমে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু সূর্যর জন্য পারেননি।সেই বারো বছরের সূর্য কি সুনিপুণ ভালবাসায় মুড়ে বাচ্চাটাকে আগলে রাখতো ভেবেই চোখ দুটো ভরে ওঠে মিসেস মধুমিতার।পাশে কারো উপস্থিতি পেয়ে দ্রুত চোখ মুছে চোখ তুলে তাকান মিসেস মধুমিতা।মিসেস শীতি আহমেদ মলিন হেসে পাশে বসলেন।

মা কে হসপিটালে নামিয়েই টুকটুকির খোঁজে ছুটেছে অর্ক।টুকটুকির চিঠির কথা জানার আগেই হঠাৎই খালামনি অবচেতন হওয়ায় সকলের ছোটাছুটির মধ্যে কখন যে টুকটুকি হসপিটাল ছেড়ে বেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। অর্কর নিজেকে ভীষণ দোষী মনে হচ্ছে,বাচ্চা মেয়েটাকে এরকম সেনসিটিভ একটা সময় একা রেখে যাওয়া একদম উচিত হয়নি।কোথায় আছে, কি করছে কে জানে? তিনঘণ্টা হয়ে গেল কোনো খবর পাওয়া গেল না। কিছু জানা গেলে তো আঙ্কেল জানাতেন, তিনি তো সেই তখনই বেরিয়ে গেছেন টুকটুকিকে খুজতে।তারপরও আশা নিয়ে মি. মাহবুব কে ফোন করলো অর্ক।

ড্রাইভ করতে করতে বার বার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে সূর্যর।বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা ডানা ঝাপটা দিচ্ছে বার বার। একদিকে মৃত্যুপারে দাড়ানো ভালবাসার মানুষটা, অন্যদিকে জীবনের আরেক টুকরো ভালবাসা। ছোট টুকটুকির পিটপিট তাকানো, খিলখিল হাসি, আধো বলিতে ভাইয়া ডাকা, একপা একপা করে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরা সবকিছু যেন চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠছে।এসব ভেবে এতোটাই মগ্ন হয়ে আছে সূর্য যে পাশে বসা কল্লোলের একটা কথাও কানে যাচ্ছে না তার। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও সূর্যকে থামাতে না পেরে এবার জোরে ধাক্কা দিয়ে বলল,
-” সূর্য, এদিকে কোথায় যাচ্ছিস আমি বললাম তো রক্তিম খবর পাঠিয়েছে টুকটুকি সাউথের বাসে উঠেছে।”
-” রক্তিম জানলো কি করে?”
-” সেসব পরে বলছি তুই দয়া করে তোর ফোনটা রিসিভ কর, সেই কখন থেকে বাজছে।পিক কর জরুরি হতে পারে। আর দয়া করে আমাকে ড্রাইভ করতে দে।”
কল্লোল আর কিছু বলবে তার আগেই ফোন রিসিভ করার ত্রিশ সেকেন্ডের মাথায় সূর্য ঝট করে গাড়ি ঘুরিয়ে হাইস্পীডে ড্রাইভ শুরু করে।কল্লোলের কোনো কথায় কানে না তুলে আপনমনে গাড়ি চালাতে থাকে।

“মাগো তোমার কাছে অনুরোধ করার সাহস বা যোগ্যতা কিছুই নেই আমার তবুও চাইছি যাদের জীবনের সব সুখ আমি ছিনিয়ে নিয়েছি তাদের কে পৃথিবীর সকল খুশি দিও, তাদের কে কখনো কষ্ট দিও না। তারা যেন তোমার থেকে জীবনের সকল সুখের দেখা পায় দোয়া করি।”

পুরো চিঠির এই একটা লাইন টুকটুকি বারবার পড়ে।কেন পড়ে জানেনা কিন্তু পড়ে, আবারও দু’তিনবার পড়ে মায়ের ছবিটা দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে টুকটুকি।তার এখন আম্মুর কথা মনে পড়ছে, সে মোটেই এই চিঠির বা ফটোতে থাকা মানুষ গুলোর মেয়ে নই।সে মি.এন্ড মিসেস মাহবুব এর মেয়ে, অবাক মাহবুবের একমাত্র বোন ছন্দ মাহবুব। কথাগুলো ভেবে আবারও হাটুতে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠে টুকটুকি।

মেঘবৃষ্টি আশ্রমে ঢুকেই মাদার ডোনার রুমের দিকে দৌড়ে যায় সূর্য।রুমে ঢোকার আগেই বারান্দার কোণে বসা টুকটুকিকে দেখে দৌড়ে সেখানে গিয়ে দাড়ায় সূর্য। কথা বলতে গিয়ে বুঝতে পারলো গলা দিয়ে কথারা বের হচ্ছে না। নিজেকে সামলে বাজখাঁই গলায় বলল,
-” এই তোর সাহস হলো কি করে একা একা এখানে আসার? কাউকে কিছু না বলে এখানে এসে বসে আছিস। খুব সাহস বেড়েছে না, দাড়া বাড়ি নিয়ে তোর পা কেটে শুটকি বানাবো। তারছিড়া ফেল করা বান্দর।”
ভাইয়ার গলা শুনে মুখ তুলে তাকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে দেয় টুকটুকি।হাতের চিঠি আর ছবিটা এগিয়ে বলল,
-” ভাইয়া বলনা এসব মিথ্যা, সবকিছু মিথ্যা। সব বানানো,আমাকে ভয় দেখাচ্ছে ওই লোকটা বলো।”
সূর্য টুকটুকিকে জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল,
-” এগুলো সব মিথ্যা টুকটুকি, তুই আমার বোন শুধুমাত্র আমার বোন।এই চিঠি, ছবি সব মিথ্যা।”
মায়া-বাধনের সেই দৃশ্যপটে কেঁদে ফেলেন আরো দুজন, একজন মাদার ডোনা আরেকজন হলো কল্লোল।

★★★
সিটি কলেজের রসায়ন শিক্ষিকা মিসেস প্রিয়ন্তিকা জামান মেইন গেইটের দিকে এগিয়ে আসতেই দারোয়ান রহমত আলী হাসিমুখে এগিয়ে এসে দরজা খুলতে খুলতে বললেন,
-” আইজ এতো সকাল সকাল বের হইয়া যাচ্ছেন যে ম্যাডাম?”
-” দরকারি কাজ আছে, তাই ছুটি নিলাম রহমত ভাই।”
হাসিমুখে জবাব দিয়ে বাইরে আসতেই পাচঁ বছরের প্রহর দৌড়ে কাছে এসে বলল,
-” মামমাম ”
-” প্রহর! এখানে কি করছো? কে নিয়ে এসছে?”
-” আমি তো তোমায় নিতে এসেছি, ( ড্রাইভার কে দেখিয়ে) বকুল চাচুর সাথে এসছি মামমাম।”
-” ওরে বাবা, আমাকে নিতে এসছে! আমি কি ছোট? আমাকে নিতে আসতে হবে? আর তোমার বাবা কোথায়? ”
-” বাবাই ই তো আমাকে পাঠিয়েছে তোমাকে নিয়ে যেতে। বাবাই এর ফোন আসায় আসতে পারেনি তাই আমাকে পাঠালো।বলেছে যাও তুমি তোমার মামমাম কে নিয়ে আসো আমি আমার মামমাম কে নিয়ে আসি।”
বলেই খিলখিল করে হাসতে শুরু করলো প্রহর।পুতুল প্রহরের গালে ঠোট ছুয়িয়ে বলল,
-” তবে চলুন মহারাজ,আপনার পিতাশ্রীর সম্মানার্থে যাওয়া যাক।”
-“ওকে মামমাম। ”
বলেই মায়ের হাত ধরে ছুটে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায় প্রহর।গাড়িতে বসে পুতুলের ছয় বছর আগের সেই হুট করে আসা সুখের দিনের কথা ভেসে ওঠে স্মৃতিপটে। হসপিটাল থেকে বাড়ি আসার পরদিন সন্ধ্যায় একদম অনাড়ম্বর ভাবে হঠাৎই তার বিয়ে হয়ে যায় তার সেই রাগী, বদমেজাজি অবাক মাহবুব সূর্যের সাথে।হাতে- পায়ে ব্যান্ডেজ সহ সে রাতেই পুতুলকে নিয়ে আসা হয় বাড়িতে।সবকিছু অনাড়ম্বর হলেও সূর্যর বন্ধুরা বাড়িঘর সাজিয়ে একদম ধুমধাম আয়োজন করেছিল। মাম্মা কখনো এ বাড়িতে আসেনি তবে বড় আব্বুর থেকে চেয়ে নিয়েছিল টুকটুকিকে।বিয়ের পর থেকে টুকটুকি চলে গেছিল মাম্মা’র কাছে, মাঝেমাঝে সবাই এখানে জড়ো হতো।তবে দূরে চলে যায় টুকটুকি যখন সেনাবাহিনী তে সিলেক্ট হয়।মাম্মা আর টুকটুকি চলে যায় রাজশাহী তে।তারপর থেকে মাম্মা আর টুকটুকি রাজশাহীতেই থাকে মাঝেমাঝে বাড়িতে আসে, আবার বাড়ির সকলেও যায়।এভাবেই কত সুখেরা চলে গেছে, নতুন সুখ হিসেবে তাদের জীবনে প্রহর আসে। সুখের দিনগুলি এখন কেন জানি হাতের মুঠোয় ভরে থাকে।

ক্যান্টনমেন্ট গেইট পেরিয়ে অডিটোরিয়ামে ঢুকতেই প্রথম সারি থেকে হাত উঁচিয়ে প্রহরকে কাছে ডাকলো টুকটুকি।ফু-মনি কে দেখে মায়ের হাত ছেড়ে দৌড়ে কাছে যায় প্রহর।আশেপাশে চোখ বুলতেই দেখা গেল স্টেডিয়ামের পাশে জটলা পাকিয়ে দাড়িয়ে আছে সূর্যরা পাচঁজন।কল্লোল পুতুলকে দেখতেই সূর্যকে খোঁচা দিয়ে পুতুলকে দেখালো।পুতুলের দিকে তাকিয়ে হেসে প্রথম সারিতে বসার ইশারা করলো সূর্য।বাকিরা পুতুলকে ইশারায় হাই বললো।পুতুল গিয়ে মি.মাহবুব এর পাশে বসতেই মি. মাহবুব হেসে বললেন,
-” এসেছিস, আরে এখানে হঠাৎ কাজ পড়ে গেল রে মা আমি যেতে পারলাম না, এদিকে প্রীতি আর টুকটুকিকে নিতে সূর্য টাও চলে গেল।”
-” কোনো ব্যাপার না বড় আব্বু। ”
বলে মিসেস প্রীতির দিকে তাকিয়ে বলল,
-” মা তোমাদের বললাম গতকাল এসো, তা না আজ ছুটাছুটি করে আসতে হলো তো।”
মিসেস প্রীতি শুধু হাসলেন।পাশ থেকে টুকটুকি প্রহরকে কোল থেকে নামিয়ে বলল,
-” ভাবি আমি কিন্তু কালই আসতে চেয়েছিলাম ছোট মা ই রাজি হলো না।”
পুতুল টুকটুকির সাথে কথা বলতে বলতে আশেপাশে বসা শ্রেয়া দিশিকার সাথে ইশারায় হাই হ্যালো করে নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই এওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল।পুতুল ভালো করে চোখ বুলিয়ে প্রহরকে খুঁজতেই দেখলো সূর্যের কোলে উঠে চশমা ধরে টানাটানি করছে।সূর্য না পেরে চশমা টা খুলে ছেলের চোখে পড়িয়ে এগিয়ে এসে মিসেস মধুমিতার কাছে প্রহরকে রেখে আবারও নিজের জায়গায় ফিরে যায়। একটু পরেই “মোস্ট টেলেন্টেড এন্ড ইয়াং ক্যাপ্টেন” এর সম্মাননা পায় অবাক মাহবুব সূর্য।এবং সবথেকে শেষে “বেস্ট লেডিস ট্রেইনি” সম্মাননা পায় টুকটুকি।এওয়ার্ড নিয়ে টুকটুকি প্রথম বাবা-মার দিকে তাকিয়ে তারপর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল,
-” আমার আজকের এই কীর্তিতের হকদার আমার ছোট মা মিসেস মিহির জামান খান।যার অনুপ্রেরণায় আমি আজকের ছন্দ মাহবুব আপনাদের মাঝে উপস্থিত হতে পেরেছি।”
মিসেস প্রীতি স্টেজে দাড়ানো মেয়েটার দিকে টলটলে চোখে একঝাঁক মায়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।মি.মাহবুব, মিসেস মধুমিতা, সূর্য, কল্লোল অনেকেই মায়া ভরা দৃষ্টিতে দু এক ফোটা চোখের জলের সাথে করতালিমুখর করে তুলে পুরো অডিটোরিয়াম।আর তা কেবল বিস্ময় ভরে তাকিয়ে দেখে পুতুল।এতো আনন্দেও যে এরা এতো কাদেঁ কেন কে জানে? পুতুল কখনো বুঝে না এদের কান্ড কারখানা, আজব! কই তার তো কান্না পাচ্ছে না বরং আনন্দ হচ্ছে, একরাজ্য আনন্দ।

সমাপ্ত

সকলকে ধন্যবাদ পাশে থাকার জন্য।ভালবাসা অবিরাম 💖💖💖

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here