ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর পর্ব ৩৯+৪০

#ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর
#লেখিকা_হৃদিতা_আহমেদ

পর্ব-৩৯

টিফিন টাইমে কলেজের করিডোর দিয়ে হেঁটে প্রিন্সিপালের রুমে যাচ্ছিল অর্ক, প্রিন্সিপাল কোনো দরকারে ডেকে পাঠিয়েছেন।ফাঁকা ক্লাসে টুকটুকিকে একলা বসে থাকতে দেখে সেদিকে এগিয়ে যায় অর্ক।
-” কি ব্যাপার টুকটুকি একা বসে আছো কেন? ”
অর্কর গলা পেয়ে টুকটুকি টিফিন বক্স থেকে নজর সরিয়ে একবার অর্কর দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে উঠে দাড়ায়।কোনরকম মিনমিন করে বলল,
-” এমনিতেই।”
-” টিফিন তো শেষ প্রায়, এখানো খাও নি কেন?”
-” এমনিতেই।”
টুকটুকি কে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিঞ্চিত ভ্রু কুঁচকে ফেলে অর্ক।কলেজে ভর্তি হওয়া চঞ্চল মেয়েটার সাথে তার সামনে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটার আকাশ-পাতাল তফাৎ।বেশ কয়েক মাস যাবত টুকটুকি কে একদম অন্যরকম লাগছে।মেয়ে টা হঠাৎই কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে।অন্য সময় হলে অর্ক ভাইয়া বলে মাথা নষ্ট করে দিতো।টিফিনে চেম্বারে যেয়ে এটা সেটা খাওয়ার জন্য বায়না করতো। কিন্তু প্রায় দুতিন মাস যাবত টুকটুকি প্রয়োজন ছাড়া তার সাথে কথাও বলে না। ক্লাসেও বেশ অমনোযোগী হয়ে থাকে।
-” তুমি কি কোন কিছু নিয়ে আপসেট?”
টুকটুকি মাথা নিচু করেই ডানে বামে ঘুরিয়ে না বোঝালো।অর্ক আর কিছু বলবে তার আগেই পিয়ন এসে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিল।আগত্য টুকটুকি কে খেতে বলে প্রিন্সিপালের অফিসের দিকে এগিয়ে যায়।

তিনদিন জ্বরে ভুগে ক্লান্তি বিষাদ নিয়ে ড. মো. শাহাবুদ্দিন রহমান স্যারের ক্লাসে বসে আছে পুতুল।স্থির দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।নিজেকে দিকশূন্য মনে হচ্ছে।কেন এই পড়াশোনার দরকার, কেন ক্লাস করছে,কেন বেচে আছে? ক্লাসে বসলেই এসব কিছু মাথার মধ্যে খিচখিচ করে।পৃথিবীর সবকিছু অহেতুক মনে হচ্ছে।সবকিছু ছেড়ে ছুটে পালাতে ইচ্ছে করছে তার।
-” কিরে বসে আছিস কেন? যাবি না?”
মৃদুলার ডাকে চোখ তুলে তাকায় পুতুল।ফাঁকা ক্লাস রুমে একবার চোখ বুলিয়ে চুপচাপ উঠে দাড়ায় পুতুল।ক্লাস থেকে বের হয়ে পুতুলকে বাইরের দিকে যেতে দেখে মৃদুলা পিছন থেকে জোরে বলল,
-” এই প্রিয়ন্তি,এখন ৩৫১ তে ক্লাস। ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস।আরে এই ক্লাস করবি না?”
পুতুলের কোনো সাড়া না পেয়ে ফোঁত করে নিশ্বাস ফেলে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে মৃদুলা।

ভবন থেকে বের হয়ে সামনে তাকাতেই দুটি হাস্যজ্বল মুখ পুতুলের সামনে এসে দাঁড়ায়।পুতুল চোখ তুলে তাকাতেই দুজনেই হেসে বলল,
-” সারপ্রাইজ ভাবিজান।”
পুতুল মৃদু হেসে আশেপাশে তাকিয়ে সকলকে দেখার চেষ্টা করলো।এটা মোটেও তার জন্য সারপ্রাইজ নয়।চার বছরে সূর্যর থেকেও বেশি তার বন্ধু গোষ্ঠী পুতুলের সাথে দেখা করেছে,প্রত্যেক মাসে না হলেও দেড় মাস অন্তর অন্তর সকলে এসে দেখা করে যায়।পুতুলকে বোঝাতে নিজেদের সর্ব্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ছে এই লোক গুলো, পুতুল চাইলে এরা চাঁদও এনে দিতে দুদণ্ড দেরি করবেনা।সূর্যর বন্ধু গোষ্ঠী যে তাকে কতটা ভালবাসে এই চারবছরে পদে পদে বুঝতে পেরেছে পুতুল।কথা গুলো ভাবতে ভাবতে আশেপাশে চোখ বুলাতেই দুরে একটা বেঞ্চে কল্লোল আর শ্রেয়াকে গল্প করতে দেখা গেল।
রক্তিম আর সামিরের সাথে কথা বলতে বলতে সেদিকে পা বাড়ায় পুতুল।কল্লোল পুতুলের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
-” বেবিডল, কেমন আছো?”
উত্তরে মৃদু হাসলো পুতুল।শ্রেয়া দাঁড়িয়ে পুতুলকে জাপটে ধরে বলল,
-” এতো শুকিয়ে গেছো কেন বলতো? খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছো নাকি?”
উত্তরে পুতুলও শ্রেয়াকে হালকা জড়িয়ে ধরে বলল,
-” কেমন আছো আপু?”
-” ভালো।”
-” আমিও ভালো আছি। ”
কথাটা শুনে পুতুল পিছনে তাকাতেই দেখে দিশিকা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।পুতুল এগিয়ে গিয়ে দিশিকার সাথে আলিঙ্গন করে বলল,
-” ভাইয়া কই? ”
-” কোথায় আবার ছেলেকে নিয়ে সুন্দরী মেয়েদের দেখে বেড়াচ্ছে, নির্লজ্জ লোক একটা।”
দিশিকার কথা শেষ হতেই সামির বলল,
-” ভাবি, এই জন্যই ভাইয়া তোমাকে সন্দেহ বোম বলে ডাকে।”
সামিরের কথায় সকলে একযোগে হাসি শুরু করে।দিশিকা সামিরের দিকে কটমট চোখে তাকাতেই সামির হাসি বন্ধ করে আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
-” ওই তো ভাইয়া।”
সামিরের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় পিয়াস বর্ণকে কোলে নিয়ে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।পুতুল এগিয়ে গিয়ে পিয়াসের থেকে বর্ণকে নিজের কোলে নিয়ে আদর করতে শুরু করে। পিয়াস মলিন কন্ঠে বলল,
-” বাবাই চাচিমনির আদর নিস না, ফিরিয়ে দে।চাচি মনি তোর জন্মদিনে যায়নি। একটা উইশও করেনি এমনকি ফোনও বন্ধ করে বসে ছিল।”

পিয়াসের কথায় পুতুল অনেকক্ষণ ভেবেও আজকের তারিখ টা মনে করতে পারলো না।শুধু মনে পড়লো গত বছর শীতে কুয়াশা মোড়ানো ভোরে সূর্য এসে তাকে জোর করে শিশু হাসপাতালে নিয়ে গেছিল বর্ণকে দেখতে।আর বর্ণকে কোলে দিয়ে বলেছিল,
-” টুনটুনি, চল বিয়ে করে নিই।তোর মত একটা পিচ্চি পুতুল হলে বর্ণকে জামাই বানাবো, বুঝলি?”
বলে সবসময়ের মতো নাকটা টেনে দিয়েছিল সূর্য।
ভাবনার সুতো কাটে কারো ডাকে।
-” কি হলো পুতুল ওঠো,দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
শ্রেয়া রিকশায় বসে তাকে উঠে বসার জন্য তাগাদা দিচ্ছে।পুতুল উঠে বসে পিছনের দুটি রিকশা দেখে শ্রেয়াকে প্রশ্ন করলো,
-” কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
-” বটতলা, ভর্তা খেতে।”
-” ওহ ”
বলেই চুপ করে বসে থাকে পুতুল।কিছুক্ষণ পরে নিজের হাতের উপর শ্রেয়ার স্পর্শ পেয়ে চোখ তুলে তাকায় পুতুল।
-” আর কতকাল এভাবে চলবে পুতুল? তোমরা কী এভাবেই সারাজীবন পার করতে চাইছো?”
-” আমি ভালো আছি আপু।আর আমি যা চাই সেটা তোমরা সকলেই জানো।”
-” লাস্ট ইয়ার তোমার পাগলামির জন্য সূর্য সত্যি সত্যি জবটা ছাড়ার চেষ্টা করেছিল পুতুল।কিন্তু সেনাবাহিনীর অনেক রুলস, কেউ চাইলেই জব ছাড়তে পারে না।আর সেখানে ও তো স্পেশাল ফোর্সের একজন দক্ষ ক্যাপ্টেন।ওর জন্য ব্যাপারটা ইম্পসিবল।”
-” আমি এসব কিছুই বুঝতে চায় না আপু।আমার শুধু ওকে চায়, ওর জব ওর ব্যান্ডেজ এসব চায় না আমার।”

খেতে বসে পুতুল জানতে পারলো গতকাল বর্ণর জন্মদিন ছিল আর তার থেকেও বড় খবর শ্রেয়া প্রেগন্যান্ট।কল্লোল হেসে বলল,
-” পুতুল, সূর্যকে খবর টা বলার পরে কী বলেছে জানো?”
পুতুল কল্লোলের দিকে একবার তাকিয়ে ফটো দেখায় মনযোগ দিল।কল্লোল নিজেই হেসে বলল,
-” বলেছে কংগ্রাচুলেশনস বেয়াই সাহেব।আপনারও ছেলে হবে আশা করি।আর আমার জমজ দুইটা পিচ্চি পুতুল হবে বুঝলি।তোর ছেলে আর বর্ণকে জামাই বানাবো।আইডিয়া টা দারুণ না?”
কথা গুলো ঠিক পুতুলের কানে গেল কিনা বোঝা গেল না।সে রক্তিমের ফোনে বার্থডের ফটো গুলোতে সূর্যকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।এই ছেলেটা কে এতো কেন ভালবাসে সে নিজেই জানে না।একে না ভালবাসলে সে দমবন্ধ হয়ে মারা যায়, একে না দেখতে পেলে বুকে ব্যাথা করে।উফফ,,,,তার আবারও মরে যেতে ইচ্ছে করছে।শ্রেয়া তখন কী বলল সূর্য জব ছাড়ার চেষ্টা করেছে, সে কী আরেকটু পাগলামো করবে?

টুকটুকির মিডটার্মের রেজাল্ট শিট নিয়ে গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে অর্ক।ছুটির পরে সবার পিছনে টুকটুকি কে ধীর পায়ে বের হতে দেখে সেদিকে এগিয়ে যায় অর্ক। টুকটুকি অর্ককে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।
-” আমার সাথে চলো,আজ আমি পৌঁছে দেবো তোমাকে।”
-” কেন? ”
-” চলো বলছি।”
-” কিন্তু বাবা,,,,,, ”
-” আসবে না আমি বলে দিয়েছি,চলো।”
টুকটুকি আর কথা না বাড়িয়ে অর্কর পিছনে হাঁটা শুরু করে।
অর্ক গাড়ি চালাতে চালাতে একপলক টুকটুকির দিকে তাকিয়ে সামনে তাকিয়ে বলল,
-“কী সমস্যা টুকটুকি?”
অর্কর প্রশ্নে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় টুকটুকি।অর্ক বাম হাতের মার্ক শিটটা তার দিকে এগিয়ে দেয়।টুকটুকি রেজাল্ট দেখে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে থাকে।
-” কী সমস্যা বলো তো, যে ফাস্ট কেটেগরির স্টুডেন্ট দুই সাবজেক্টে ফেইল করে গেল।”
টুকটুকি তখনও চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে।অর্ক আবারও বলল,
-” ফেমেলি প্রবলেম নই সেটা আমি জানি।কিন্তু তোমার সমস্যা টা কী একটু বলবে প্লিজ। লাস্ট দুতিন মাস তুমি এতো এবনরমাল বিহেভ করছো কেন টুকটুকি? ভাইয়া হিসেবে আমাকে বলো,আমি হেল্প করবো তোমাকে।”
উত্তরে ফুপিয়ে কান্না ছাড়া কিছুই বললো না টুকটুকি।
#ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর
#লেখিকা_হৃদিতা_আহমেদ

পর্ব-৪০

দেড় ঘন্টার পথটা পার করতে একযুগ মনে হচ্ছে সূর্যর কাছে।তারউপর এই ঢাকা শহরের জাতীয় ট্রাফিক জ্যাম তো আছেই, একটু ফাঁকা পেতেই হাওয়াই গতিতে গাড়ি ছুটালো সূর্য।
বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল এর সামনে গাড়ি থামিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ভেতর দিকে দৌড় লাগায় সূর্য।মেডিকেলের ভেতরে ঢুকে এগিয়ে যেতেই দেখে ইমারজেন্সি রুমের সামনে কল্লোলকে একটা ছেলে চিন্তিত হয়ে কিছু বোঝাচ্ছে।
-” ভাই উনি হঠাৎই সামনে চলে এসেছেন।আমি ব্রেক করার টাইম টাও পাইনি।আপনি ওনার কাছেই শুনে দেখুন।”
ইমারজেন্সি রুমে ঢুকতে ঢুকতে ছেলেটার এই কথাটুকুই কানে আসে সূর্যর।

ইমারজেন্সি রুমের রিকোভার বেডে ডান পায়ের গোড়ালি,ডান হাতে ব্যান্ডেজ আর কপালে ইনজুরি টেপের সাথে বাম হাতে স্যালাইনের ক্যানলা হাতে বসে আছে পুতুল।সূর্যকে ঢুকতে দেখেই একটা রহস্যময় হাসি ছুড়ে দিল পুতুল।পুতুলের রহস্যময় হাসি দেখে আসল ব্যাপার বুঝতে এক মিনিটও লাগলো না সূর্যর।সাথে সাথেই মেজাজেরা লাফিয়ে তুঙ্গে উঠে সূর্যর।সোজা গিয়ে মেজাজটা কে তুঙ্গ থেকে পুতুলের গালে বসিয়ে দেয় সূর্য।পুতুল থাপ্পড় খেয়েও তার রহস্যময় হাসি বজায় রেখে সূর্যর দিকে তাকিয়ে আছে।সূর্য আবারও কিছু করবে শ্রেয়া তার আগেই সূর্যকে থামিয়ে বলল,
-” দিস ইজ জাস্ট এন এক্সিডেন্ট সূর্য।”
শ্রেয়ার কথায় সূর্য রেগে চেচিয়ে বলল,
-” এটা মোটেও কোনো এক্সিডেন্ট নয় শ্রেয়া, ও ইচ্ছে করে এসব করেছে।লাস্ট ইয়ারের কথা মনে নেই তোদের? আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য, শুধুমাত্র আমাকে কষ্ট দেবে বলে হাত কেটে কী অবস্থা করেছিল।ওকে আজ আমি খুন করে ফেলবো।”
-” এক্সকিউজ মি, আপনারা এভাবে চেচামেচি করেবেন না।”
মহিলা ডাক্তারের কথায় চুপ হয়ে যায় সূর্য। ডাক্তার পুতুলের হাতের ক্যানলা খুলতে নিলেই সূর্য চট করে পুতুলের পাশে গিয়ে ডান হাত ধরে দাড়িয়ে যায়।পুতুল তার ব্যান্ডেজে মোড়া হাত দিয়ে সূর্যর হাত ধরে শক্ত করে চোখ বন্ধ করে নেয়।

বাসা থেকে দুই মিনিটের দুরত্বে গাড়ি থামিয়ে টুকটুকির দিকে তাকিয়ে বসে আছে অর্ক।বিগত আধা ঘণ্টা যাবত বাসায় যাবে না ছাড়া একটা কথাও বলেনি টুকটুকি। এখনো মাথা নিচু করে একইভাবে কেঁদে চলেছে। অর্ক ফোঁত করে একটা নিশ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল,
-” আচ্ছা বাসায় রেজাল্টের কথা বলবো না আমি, ঠিক আছে?”
টুকটুকি মাথা নেড়ে না বোঝালো, কাঁদতে কাঁদতে কোনরকম বলল,
-” আমি বাসায় যাবো না,ছোট মা’র কাছে যাবো।”
-” আন্টি টেনশন করবে তো,তোমার বাসায় জানিয়ে আসি।”
-” না, আমি ছোট মা’র কাছে যাবো।”
টুকটুকি শব্দ করে কেঁদে কথাটা বলতেই অর্ক বলল,
-” আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে।তোমার বাসায় যাচ্ছি না।”

দরজা খুলে টুকটুকির টমেটো ফেস দেখে মিসেস প্রীতি ব্যস্ত গলায় বললেন,
-” কী হয়েছে টুকটুকি?কাঁদছিস কেন?”
উত্তরে টুকটুকি ছোট মাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে শুরু করে।মিসেস প্রীতি অর্কর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।অর্ক ইশারায় পরে বলবে বুঝিয়ে নিজের রুমে চলে যায়।
কিছু কিছু মানুষের সাথে কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎই আমাদের আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠে।কারণ ছাড়াই ভীষণ ভালবাসা,মায়া কাজ করে।দেশে ফেরার পর এই বাচ্চা মেয়ে টার সাথে কারণ ছাড়াই একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে মিসেস প্রীতির। এই বাচ্চাসুলভ মেয়েটার প্রতি ভীষণ ভালবাসা কাজ করে।এই যে মেয়ে টা তাকে জাপটে ধরে কাঁদছে তার ভীষণ মায়া লাগছে।
টুকটুকি কে শান্ত করে ফ্রেশ হতে পাঠিয়ে মিসেস প্রীতি চললেন অর্কর রুমে উদ্দেশ্য কান্না রহস্য উন্মোচন।

সন্ধ্যার আজানের মধুর ধ্বনি কানে আসছে।চটচটে মেজাজ নিয়ে পুতুলের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সূর্য, বাকিরাও দাঁড়িয়ে আছে।বর্ণ সামিরের কোলে গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে।
-” রক্তিম ভাইয়া, আমাকে রিকশা ডেকে দেন নইলে তুষ্টি আপুকে ফোন করে বলবো আপনি মৃদুলার সাথে হেসে হেসে কথা বলেছেন।”
পুতুলের কথায় রক্তিম অসহায় দৃষ্টিতে সূর্যর দিকে তাকালো।সূর্য কপালে দু আঙুল স্লাইড করে শ্রেয়ার হাত থেকে পুতুলের ব্যাগটা নিয়ে বলল,
-” তোরা যা আমি ওকে নিয়ে আসছি।”
বলেই ঝট করে পুতুলকে কোলে তুলে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।পুতুল তার আধা ভাঙা হাত-পা ছুড়েই নামার ব্যর্থ চেষ্টা চালালো।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে কিছুদূর আসতেই পুতুল ফট করে কপাল থেকে ইনজুরি টেপ টা তুলে সূর্যর দিকে ছুড়ে ফেলে বলল,
-” আমাকে হল এ না দিয়ে আসলে আমি সব ব্যান্ডেজ খুলে ফেলবো বলে দিলাম।”
বলেই বাম হাত দিয়ে ডান হাতের ব্যান্ডেজ খুলতে গেলেই সূর্য জোরে ব্রেক কষে ধরে।পুতুলের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে একটানে পুতুলের হল থেকে একটু দূরে গাড়ি থামিয়ে বলল,
-” নামো।”
পুতুল মৃদু হেসে সূর্যর দিকে তাকিয়ে বলল,
-” কষ্ট হচ্ছে মি. ক্যাপ্টেন?”
পুতুলের কথায় সূর্য রেগে তাকায়।পুতুল তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ব্যান্ডেজ করা হাতটা সামনে ধরে বাম হাতের আঙুল দিয়ে সূর্যের বুকে খোঁচা দিয়ে বলল,
-” এখানে ব্যাথা হচ্ছে মি. ক্যাপ্টেন?”
একটু থেমে আবারও বলল,
-” প্রাকটিস করছি, তোমার শহরে তো এগুলোই চলে তাই,,,,,,, ”
-” নামো।”
সূর্যর কথায় পুতুল নামার বদলে চট করে সূর্যর কোলের উপর বসে।সূর্য জোরে একটা নিশ্বাস নেয়।চার বছরে পুতুলের এসব পাগলামি দেখতে দেখতে অভ্যস্থ হয়ে গেছে সূর্য।
-” আমি এই শুক্রবার অর্ক ভাইয়াকে বিয়ে করবো।তাকে এভাবে আদর করবো।”
বলেই ফট করে সূর্যর ঠোঁটে চুমু দিলো।সূর্য চট করে পুতুলের ঘাড় ধরে মুখটা কাছাকাছি এনে অধর যুগল মিলিয়ে নিজের তিক্ত মেজাজ টা ঝেড়ে দিল।পুতুলের চোখের পানি মুছে বলল,
-” বরকে এভাবে আদর করবি, ঠিক আছে? আর ভুলে গেলে আমাকে ফোন দিস আমি আবার শিখিয়ে দেবো, কেমন?”
সূর্যর কথায় পুতুল কিছুক্ষণ সূর্যর চুল টেনে ঠুসঠাস কিল বসিয়ে কাঁদলো।তারপর হেঁচকি তুলে বলল,
-“পরের বার ল্যাবের সবগুলো এসিড গুলিয়ে খেয়ে নেবো আমি, সবগুলো খাবো।”
বলে কাঁদতে কাঁদতে গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করে বলল,
-” সত্যি সত্যি খাবো। তবুও তোমার ওই ফালতু শহরে যাবো না আমি, যাবো না।”
সূর্য ফোন টা রেখে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে হল গেটের সামনে দাড় করালো।তারপর গা থেকে ব্লু জ্যাকেট টা খুলে পুতুলকে ঠেসেঠুসে পড়িয়ে দিলো।পুতুল তখনও কাঁদতে কাঁদতে বলছে,
-” আমি সত্যি সত্যি মরে যাবো অবাক, আমি সত্যি সত্যি সুইসাইড করবো বলে দিলাম।”
সূর্য কিছুক্ষণ পুতুলের দিকে তাকিয়ে থেকে বা গালে হাত বুলিয়ে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে বলল,
-” আই লাভ ইউ।”
উত্তরে পুতুল ফুপিয়ে কাঁদলো।সূর্য গাড়ি থেকে নেমে পুতুলকে ধরে নিয়ে হল গেটের সামনে যেতেই তিতিয়া এগিয়ে আাসলো।

-” পাঁজি মেয়ে, বাসায় আয় তোকে আস্ত রাখবো না।দুদিন পরপর ওই বাসায় যাওয়া বের করছি ফাজিল।”
ফোনের ওপাশ থেকে আম্মুর কথা শুনে চোখ টলটল করে উঠে টুকটুকির।সে তো জানে রোজ রাতে ঘুমানোর আগে আম্মু তাকে ঔষধের মতো নিয়ম মাফিক কপালে চুমু দিতে পারবে না তাই রাগ করছে।
-” আম্মাজান, তোমার দজ্জাল মায়ের কথা বাদ দাও।আমি কি আগামীকাল তোমাকে নিতে যাবো?”
ফোনের ওপাশ থেকে বাবার কন্ঠ পেয়ে টলটলে চোখেই ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি উপস্থিত হয় টুকটুকির। সে বাবাকে নিষেধ করলেও বাবা যে তাকে দেখতে আসবে সে জানে।কন্ঠটা স্বাভাবিক করে বলল,
-” আব্বু আমি ইংরেজি আর ফিজিক্স এ ফেইল করেছি।তাই আমি ছোট মা’র কাছে তিনদিন থাকবো,ফেইল করার শোক পালন করতে হবে আমাকে।”
-” মাত্র দুইটায় তিনদিনের শোক পালনের কি দরকার আম্মু? তুমি বরং কাল বিকাল পর্যন্ত শোক পালন করো।”
বাবার কথায় ফিক করে হেসে উঠে টুকটুকি।
দরজায় দাঁড়িয়ে টুকটুকির এই রোদ্দুরে বৃষ্টি এক্সপ্রেশন দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে অর্ক।এই বয়সের মেয়ে গুলো এতো অদ্ভুত আচরণ করে কেন কে জানে? তবে টুকটুকি কে একটু বেশিই অদ্ভুত লাগছে তার কাছে।এই যে মেয়েটা গালটা বুড়িগঙ্গা বানিয়ে এক কড়াই হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে ঠোঁটে, ব্যাপারটা অদ্ভুত বড়ই অদ্ভুত।

চলবে
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here