#জনৈক_প্রেমিক
পর্ব- ০৯
শ্রাবণ সত্যি সত্যিই আমাদের এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে নিলেন। তারপর থেকেই ওনার আমাদের বাড়িতে হুটহাট করে আসার উৎপাত বেড়ে গেল। মা না পারেন কিছু বলতে আর না পারেন ফেলে দিতে। রিহাকে তো উনি বশ করে ফেলেছেনই। এখন মা’কে বশ করতে উঠে পরে লেগেছেন। গতকাল মা’কে জোর করে কোথায় যেন নিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন ডজনখানেক কাঁচের জিনিসপত্র নিয়ে। রোজ রিহাকে নিজের প্রাইভেট কার করে কলেজে দিয়ে আসেন। ইদানীং বাবার পেছনেও পড়েছেন। অকারণে বাবার দোকানে গিয়ে বসে থাকেন। বাবার সঙ্গে খোশগল্প করেন। বাবার কাজে সাহায্য করেন বাবা না চাইলেও। নিজের অফিস ছেড়ে, কাজকর্ম ছেড়ে কেন এখানে এভাবে পড়ে আছেন উনি!
ওনার এতসব ছলাকলা কীসের জন্য তা অবশ্য আমার বুঝতে বাকি নেই। উনি নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন আমি তার সঙ্গে কিছুতেই ফিরে যাব না। তাই আমার পরিবারকে মানাতে উঠেপড়ে লেগেছেন। যাতে তারা অনেকটা জোর করে হলেও আমাকে ও বাড়িতে পাঠান।
মা, রিহাকে নিজের বশে করে নিলেও বাবাকে উনি কখনোই বশীভূত করতে পারবেন না আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
.
সেদিন লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম বই কিনতে। থার্ড ইয়ারে ভর্তিই হয়েছিলাম শুধু। কোনো বই কেনা হয়নি, ক্লাসও করা হয়নি। ফেরার সময় গাড়ির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখনি শ্রাবণ এসে হাজির। এসেই জোরাজোরি করতে লাগলেন গাড়িতে ওঠার জন্য। কিন্তু আমি কিছুতেই উঠব না। শেষে একটা অটোরিকশা করে বাসায় ফিরি। পুরোটা রাস্তা উনি আমাকে ফলো করতে করতে এসেছেন। শুধুমাত্র একদিনই এমন হলে হয়তো ব্যাপারটা আমাকে ভাবাত না। কিন্তু তিনি রোজই এমন করতে লাগলেন। বই কেনার পর আমি রোজ ক্লাস করতে শুরু করি। রোজ যাবার সময় তিনি আমাকে ফলো করতে করতে যান। ফেরার সময় ফলো করতে করতে ফেরেন।
আর সহ্য করা যাচ্ছে না ওনার উপদ্রব। আমি একদম অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। আজ ওনাকে কড়াকড়ি ভাবে জানাবো আমি ওনার সঙ্গে কখনোই ফিরবো না এবং ফিরতে চাই না।
অবশেষে সে সুযোগটা এল। দুপুরে রিহাকে কলেজ থেকে আনতে গিয়েছিলেন তিনি। মায়ের কথায় ঘরে ঢুকে বসার ঘরে বসে ছিলেন। মা’কে বলে খাবারের ট্রে’টা আমি নিজেই নিয়ে গেলাম। এই অযুহাতে ওনার সঙ্গে কথা বলা যাবে।
আমাকে দেখেই ওনার চোখদুটো চকচক করে উঠল। আমাকে ট্রে হাতে নিয়ে এগোতে দেখে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললেন, ‘তুমি নিজের হাতে আমার জন্যে খাবার এনেছো হৃদি!’
হাত থেকে ট্রে’টা টেবিলের ওপর রেখে বললাম, ‘এতে এত সারপ্রাইজড হবার কী আছে!’
উনি ঈষৎ হেসে বললেন, ‘না তুমি তো কখনো আনো না তাই আর কি।’
আমি বললাম, ‘ আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।’
উনি গাল ভরে হাসলেন। ‘বলো!’
আমি গুরুতর ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলাম, ‘আমি চাইনা আপনি আর এ বাড়িতে আসুন।’
উনি তড়িৎ গতিতে বলে উঠলেন, ‘কেন হৃদি? আমিতো কাউকে বিরক্ত করছি না!’
‘আপনি করছেন না কিন্তু সবাই হচ্ছে।’
উনি বিদ্রুপ করে হাসলেন। ‘সবাই না-কি তুমি?’
‘ধরুন আমিই।’
শ্রাবণ হঠাৎ দু’হাত জোড় করলেন, ‘প্লিজ হৃদি! অন্তত তোমাকে দেখার অধিকারটুকু আমার কাছ থেকে কেড়ে নিও না!’
আমি এবার বিরক্তির চরম সীমানায় পৌঁছে গেলাম। ‘আমিই আপনার কাছে হাতজোড় করছি! আপনি প্লিজ আমাকে যন্ত্রণা দেওয়াটা বন্ধ করুন! আপনি কেন বুঝতে পারছেন না আপনি যতো যাই করুন না কেন আমি আর কখনো আপনার কাছে ফিরব না!’
শ্রাবণ ঠান্ডা স্বরে বললেন, ‘আমি কি একটা সেকেন্ড চান্সও ডিজার্ভ করি না, হৃদি!’
‘আমি জানিনা আপনি ডিজার্ভ করেন না-কি করেন না! আমি শুধু জানি, আপনার প্রতি শ্রদ্ধা জিনিসটা আমার আর নেই। আর যার প্রতি শ্রদ্ধা নেই তাকে সারাজীবন চেষ্টা করেও ভালোবাসা সম্ভব না।’
শ্রাবণ বলে উঠলেন, ‘কী করলে আমার প্রতি তোমার শ্রদ্ধা ফিরবে হৃদি? আমাকে বলো। আমি তা-ই করবো। ‘
আমি তপ্ত শাস ফেললাম। ‘আপনি চলে যান। তাহলেই হবে।’
‘আমি এখান থেকে চলে গেলে তুমি আমার কাছে ফিরে যাবে? ‘
‘ আচ্ছা, আপনি কি সোজা কথা সোজা ভাবে বুঝতে পারেন না? আমি একবার বলেছি, আরেকবার বলছি। যাই হয়ে যাক না কেন আমি আপনার কাছে কখনোই ফিরব না!’
আচমকা শ্রাবণের মুখচ্ছবির পরিবর্তন ঘটল। কয়েক সেকেন্ডেই ভয়ংকর মূর্তি ধারণ করলেন তিনি। বসা থেকে উঠে এগিয়ে এসে আমার গাল চেপে ধরলেন। ‘কেন তোর ওই আশিককে এখনো ভুলতে পারিসনি? কী করলে ভুলতে পারবি? ওকে মেরে ফেললে?’
আমি ঝটকা মেরে ওনার হাত সরিয়ে দিলাম। ‘এবার বুঝতে পেরেছেন কেন আমি আপনার কাছে ফিরতে চাই না? আপনার এই অফেন্সিভ বিহেভিয়ারের কারনে!’
শ্রাবণ হঠাৎ শান্ত হয়ে বসে পড়লেন। ‘তুমি আমার কাছে ফিরছো না বলেই তো এমন করছি। ফিরলে কি আর..!
‘যে স্বামী তার স্ত্রীকে বিয়ের দিনই সবার সামনে চড় মারে শুধুমাত্র বিয়ের আগে তার চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে স্ত্রীর প্রেম ছিল বলে, বিয়ের দু’দিন পর্যন্ত রুঢ আচরণ করে সেই একই কারনে, নিজের শ্বশুরের সামনেই রাগ দেখিয়ে সে বাড়ির শোকেস ভাঙে, আবার এখন স্ত্রী সেসব সংগত কারণে তার সাথে যাবে না বলে অফেন্সিভ আচরণ করে সে স্বামীর কাছে ফেরাটা কতটা স্বাভাবিক? ‘
‘আমি আর কোনোদিনই কোনোরকম ভায়োলেন্স সৃষ্টি করবো না, অফেন্সিভ বিহেভিয়ারও না। তুমি শুধু আমাকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখো হৃদি!’
আমি জবাব দিলাম না। ওনাকে বোঝাতে বোঝাতে আমি ক্লান্ত।
শ্রাবণ আবার বললেন, ‘ সেদিন আমি তোমাকে ওভাবে চড় মেরে অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছি। সেজন্য আমি অনুতপ্তও! কিন্তু ওমন একটা শুনে আমি নিজের মাথা ঠিক রাখতে পারিনি।’
আমি বললাম, ‘প্রত্নর সাথে তো আমার বর্তমানে কোনো সম্পর্ক নেই! অতীতে বিয়ের আগে ছিল। সেটা শুনে এতটা রিয়েক্ট করার মানে আমি বুঝতে পারছি না। যদি এমন হতো বর্তমানে বিবাহিত অবস্থায় আমার ওর সাথে সম্পর্ক আছে তাহলে আপনার রাগটা যুক্তিসঙ্গত হত। কিন্তু সেদিনেরটা মোটেও নরমাল বিষয় ছিল না।’
শ্রাবণ বললেন, ‘আমি তোমাকে সেজন্যে মারিনি।’
আমি বিস্মিত হলাম, ‘তাহলে কেন মেরেছেন?’
শ্রাবণ ইতস্তত করতে লাগলেন। ‘বিয়ের দিন তোমাকে দেখার পর প্রত্ন আমাকে বলে, নিজের ছোট ভাইয়ের এক্স গার্লফ্রেন্ডকে বিয়ে করছো! এর সঙ্গে তো আমি শুয়েছিও!
এ কথা শোনার পর থেকেই মাথা গরম হয়ে ছিল। সারাদিনই কানে এই সেন্টেন্স দুটো বেজেছে। কখন কী করে ফেললাম বুঝতেই পারিনি। যখন বুঝতে পারলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।’
রাগে, ঘৃণায় আমার গা রি রি করে উঠল। প্রত্ন এত জঘন্য মিথ্যে কথাগুলো এভাবে বানিয়ে বানিয়ে বলেছে!
‘ ও কীভাবে বলতে পারল এই নোংরা কথাগুলো! প্রত্নর সাথে আমার কখনোই ওরকম কোনো সম্পর্ক ছিল না। ও খুব ভালো করেই জানতো বিয়ের আগে এসব আমি ভুলেও পছন্দ করব না। তাই ও কখনো অন্যায়ভাবে দাবিও করতো না। আমি জানিনা কেন ও এসব কথা আপনাকে বানিয়ে বানিয়ে বলেছে!’
শ্রাবণ বললেন, ‘যাতে আমি তোমার ওপর রাগ করে বিয়ে ভেঙে দেই। ও বোধহয় আগে জানতো না আমার হবু স্ত্রী তুমি!’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে বিয়েটা ভাঙলেন না কেন? আপনি যেহেতু ওর কথা প্রায় বিশ্বাসই করে নিয়েছিলেন!’
‘ঠিক বিশ্বাস করিনি। হঠাৎ অমন একটা কথা হজম করতে পারিনি। তোমাকে তো আগে থেকেই খুব ভালোভাবে চিনতাম। আমি জানতাম তুমি কখনোই কোনোরকম অনৈতিক সম্পর্কে জড়াবে না। কিন্তু প্রত্নতো তোমাকে বাধ্যও করতে পারে! তাই! আসলে কী ঠিক কী মন্দ তখন আমার মাথাই কাজ করছিল না! আর বিয়ে ভাঙার তো প্রশ্নই ওঠে না! এত দিন এত সাধনার পর তোমাকে নিজের করে পেতে চলেছিলাম। সেটাকে আমি ওভাবে ভেস্তে দিতাম!’
আমি শ্রাবণের কথার কোনো আগামাথা খুঁজে পেলাম না। শুধু তিনটা কথাই মাথায় ঘুরতে লাগল। চিনতাম, এত দিন, এত সাধনা!
আমাকে কিছু একটা ভাবতে দেখে শ্রাবণ বললেন, ‘কী ভাবছো?’
‘আপনার কথার মানে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না!’
‘তোমাকে কীভাবে চিনতাম সেটা?’
আমি মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ ‘ বললাম।
শ্রাবণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘সেগুলো আর জেনে কী লাভ! তুমি আগেও আমাকে ঘৃণা করতে, এখনো করবে!’
বলে আর বসলেন না। উঠে চলে যাবার জন্যে পা বাড়ালেন। আমি পেছন থেকে ডাকলাম, ‘তবুও বলুন!’
শ্রাবণ চলে যেতে যেতেই বললেন, ‘যেভাবে শুরুটা হয়েছিল সেভাবেই নাহয় বলবো! ‘
এবারো ওনার কথা বোধগম্য হলো না আমার। আমি ভাবতে লাগলাম, শুরুটা কীভাবে হয়েছিল!
চলবে…
লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা