#জলছবি
#পার্ট_২৪
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
দখিনা বাতাস এসে লাগে লুবনার চোখে, মুখে খোলা চুলে। তার রুমের এই দক্ষিণ পাশের খোলা বারান্দাটা তার খুব পছন্দের। ঠোঁটের কোণের হাসি নিয়ে দূরে কোথাও তাকায়, কি যেন ভাবে আনমনে।
“কি ভাবছো একা একা?”
লুবনা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পাশে তাকায়। পরক্ষণেই মিষ্টি করে হেসে বলে,
“কিছু না বাবা। তুমি কখন এলে?”
পঞ্চাশ পেরোনো ভদ্রলোক কিছুটা গম্ভীর ধরনের। বদরাগী হিসেবে বেশ নাম আছে। তবে মেয়ের কাছে এলেই তার সকল রাগ গলে জল হয়ে যায়। আমিনুল হক নিজের গাম্ভীর্য ভেঙে নরম কন্ঠে বলে,
“মাত্রই এলাম। তোমার সঙ্গে গল্প করতে।
তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে মা?”
“পড়াশোনা ভালো চলছে বাবা। কিন্তু তোমার সাথে তো আমি মোটেও গল্প করবো না। আমি খুব রেগে আছি তোমার উপর।”
লুবনার শেষের কথাটাতে রাগের চেয়ে অভিমানের মাত্রা বেশি স্পষ্ট। আমিনুল হকের কাছে মেয়ে তার পৃথীবি। মেয়ের মলিন মুখ মোটেও কাম্য নয় তার কাছে। তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“কেন মা? আমি আবার কি করলাম? রাগ কেন?”
লুবনা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে,
“গত এক সপ্তাহ তুমি আমার সঙ্গে ঠিক ভাবে কথা বলোনি। যখনই দেখা হয়েছে, তখনই দেখেছি কানে একটা ফোন নিয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছো! এটা খুবই জঘন্য একটা দৃশ্য বাবা। তুমি আমায় ইগনোর করেছো।”
আমিনুর হক হো হো করে হেসে উঠে। মেয়েকে কাছে টেনে আহ্লাদ করে বলে,
“স্যরি আম্মাজান। একটুও ইগনোর করিনি, সত্যি বলছি। তুমি ভুল ভাবছো। ব্যাপারটা হলো, নতুন একটা প্রজেক্ট নিলাম না? ওইটা নিয়েই একটু ব্যস্ত ছিলাম। এই প্রজেক্টটা আমাদের কোম্পানিরর জন্য মোস্ট ইম্পরট্যান্ট। কোটি টাকার কারবাররে মা। এইতো আর দুদিন পর ফ্রি হয়ে যাবো। তখন বাপ-বেটি মিলে জম্পেশ আড্ডা দিবো, ঠিক আছে?”
লুবনার খুব রাগ লাগে। সে ক্ষিপ্ত হয়ে বলে,
“না, একদমই ঠিক নেই বাবা। তুমি সবসময়ই সেইম কথা বলো। আম্মুর সাথেও তো দশ মিনিট গল্প করতে দেখিনি কখনো। দিজ ইজ নট ফেয়ার, বাবা। এত টাকাপয়সা দিয়ে কি হবে? টাকা পয়সা কি মানুষকে সুখি করতে পারে?”
আমিনুল হক বুদ্ধিদীপ্ত হেসে বলে
“এককভাবে টাকাপয়সাও যেমন সুখ দিতে পারে না, তেমনি টাকাপয়সা অভাব দেখা দিলেও কেউ সুখি হতে পারে না। আমি তা নিজ চোখে দেখেই বড় হয়েছি মা। তাই টাকাপয়সার মুল্য একটু বেশি-ই আমার কাছে। পেটে ভাত না থাকলে সুখ কোন দিক দিয়ে পালাবে নির্ণয়ও করতে পারবা না। শুধু টাকা পয়সা যেমন সুখ দিতে পারে না, তেমনি পর্যাপ্ত টাকা পয়সা না থাকলে সুখি হয় না কেউ।”
“কে বলেছে তোমায়, টাকা-পয়সা ধনদৌলত ছাড়া কেউ সুখি হতে পারে না? চাইলেই পারে। এই টাকা-পয়সা, ধনী-গরিব বিভেদ গড়ে তুলে আমারাই জীবনটাকে জটিল করে তুলি। আমার মাঝে-মধ্যে খুব ইচ্ছে করে, গরিব হয়ে গিয়ে একটা ছোট্ট ঘরে, একমুঠো ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারতাম যদি! তুমি যদি ধনী না হয়ে মধ্যবিত্ত কিংবা দরিদ্র কেউ হতে?”
আমিনুল হক হাসেন। মেয়ের কথাগুলো বাচ্চাদের কথা হিসেবে ধরে নেয়ার হাসি। তিনি বললেন,
“এসব তোমার ফ্যান্টাসি। রিয়ালিটি ভিন্ন।একটু ম্যাচিউর হও, নিজেই সব বুঝতে পারবা। যাহোক, মন দিয়ে পড়াশোনা কর, কেমন?”
লুবনা মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। মনে মনে বলে,
‘এই ফ্যান্টাসিকেই রিয়েলিটি হিসেবে দেখার খুব ইচ্ছে বাবা!’
আমিনুল হক কিছুদূর গিয়ে আবার ফেরত এসে বলে,
“ওহ একটা কথা বলতে ভুলে গেলাম। যে কারণে আসা।”
লুবনা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিটি চায়। আমিনুল হক বলেন,
“তোমার একটা বন্ধু আছে না? কি যেন নাম?”
লুবনা বুঝতে না পেরে বলে,
“কার কথা বলছো?”
আমিনুল হক খানিক চিন্তাভাবনা করে বলে,
“আরেহ, ঐযে….কালো মতো দেখতে, লম্বাচওড়া!”
লুবনা বুঝতে পারে। মৃদু হেসে বলে,
“ফয়সাল?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ! ঐ ফয়সাল না টয়সাল!”
লুবনা আহত হওয়ার মতো ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
“টয়সাল না বাবা! ওর নাম ফয়সাল। সুন্দর করে বলো।”
“ঐ হলো একই। ছেলেটাকে আমার মোটেও পছন্দ নয়। কেমন যেন উগ্র চলাফেরা। একজন ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলের চলাফেরা এমন হবে কেন? কোনো নম্রতা-ভদ্রতা নেই। প্রায় সময় দেখি, পাড়ার মোড়ের টং দোকানটায় পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকে আর চা-টা খায়। আবার দেখি বাইক নিয়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে। বেপরোয়া ছেলেপেলে। ওর থেকে দূরে দূরে থাকবা, কম মিশবা। ঠিক আছে?”
লুবনা মুখ নিমিষেই চুপসে যায়? শেষ পর্যন্ত ওকেই অপছন্দ করতে হলো? লুবনা ফয়সালের পক্ষ নিয়ে বলে,
“বাবা তুমি ওকে যেমন ভাবছো ও কিন্তু আসলে তেমন নয়। তুমি ভুল ভাবছো।”
“হয়েছে, তোমার আর ওকে নিয়ে সাফাই গাইতে হবে না মা। তোমাকে আমি যা বলেছি তা করো। আমার ধারনা মতে ওর ব্যাকগ্রাউন্ড খুব একটা ভালো হবে না।….”
আমিনুল হক আরো কিছু বলতে যাবেন তার আগে উনার ফোন বেজে উঠলো। তিনি ফোন কানে নিয়ে, মেয়েকে ইশারায় বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন।
লুবনা কাঁদোকাঁদো মুখ করে ঠোঁট উল্টে আকাশের দিকে চাইল। যার অর্থ, আল্লাহ্ আমায় রক্ষা করো, প্লিজ!
.
চিকমিক করছে রোদ। নোলক রোদের আড়াল হতে একটু দূরে সরে বসলো। প্রশাসনিক অনুষদের এই দিকটা নোলকের ভালো লাগে। ফাঁকা কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকাতেই একটা শুকনো পাতা এসে পড়লো নোলকের কোলের কাছে। কোল থেকে পাতাটা হাতে নিবে তার আগেই ঝড়ের গতিতে কোত্থেকে ছুটে এসে ফয়সাল বসলো ওর পাশে। নোলকের মাথায় ঠুয়া মেরে বলল,
“কিরে ফকিন্নি? ক্লাস না করে এইখানে কি করস? ছ্যাঁকাখোর, না, ছ্যাঁকাখোর তো পোলাগোরে কয়। মাইয়া মানুষ ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হইলে কি কয় রে? ছ্যাঁকাখোরনী? হু, তো এইরাম ছ্যাঁকাখোরনীগো মতো মুখ কইরা বইসা আসিছ ক্যা? কে ছ্যাঁকা দিছে ক? খালি নামডা ক, পিডাইয়া হসপিটালে পাঠিয়ে দেয়ার কাম আমার।”
নোলক তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে হুংকার দেয়,
“ফয়সাইল্লা…!”
ফয়সাল দন্ত বিকশিত হাসি দিয়ে খানিক হেলে পড়ে নোলকের দিকে। হাতে থাকা জবা ফুলটা নিজের কানেই গুঁজে দিয়ে বলে,
“তোরে নাচানাচি, আই মিন, লাফালাফি ছাড়া দেখতে ভাল্লাগে না। কী হইছে বল তো? কয়দিন যাবত দেখতেছি, কেমন থম মাইরা থাকিস সারাদিন! কে কি করছে বল?”
“কেউ কিছু করে নাই। সর তো, জ্বালাচ্ছিস কেন?”
“তাইলে এমন গুইলের মতো মুখ করে আছস ক্যান?”
নোলক ওর মন খারাপকে মাটি চাপা দেয় খানিকক্ষণের জন্য। কারণ এই ফাজিলের সামনে মন খারাপ করে থাকা সম্ভব না। মূল কারণ ফয়সালের অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা। এসব আজগুবি কথা এই ছেলে কই পায়, কে জানে! নোলক ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘গুইলের মতো মুখ’ মানে কী? গুইল কী?”
ফয়সাল কিছু বলবে তার আগেই লুবনা এসে উপস্থিত হয়। ফয়সালকে ঠেলেঠুলে ওর কাছ ঘেঁষে বসতে বসতে বলে,
“তোরা দুইটায় ক্লাস বাদ দিয়ে এখানে কী করিস, হু? ফাঁকিবাজ!”
ফয়সাল বাঁকা হেসে বলে,
“এহ! আইছে আমার পড়ুয়া রে! চোরের মায়ের বড় গলা। আয়, এদিক আয়, গলাটা কেটে ছোট করে দেই। নয়তো দূরে সর। ঘেঁষাঘেঁষি করস ক্যা এত? সর।”
“না, সরুম না। এখানেই বসে থাকমু। তুই পাড়লে সরা।” লুবনার তেজ।
ফয়সাল তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
“হে হে! চ্যালেঞ্জ করছিস? শোন, বুচি? তোরে আমি এক হাতেই একটা আছাড় মারতে পারবো। সো ভাব কম, ওকে? নয়তো আছার তো দিবোই সাথে বোনাস হিসেবে ঐ বোঁচা নাকটাতে ঘুষি মেরে আরো বোঁচা বানিয়ে দিমু।”
লুবনা ফয়সালের কথায় দুঃখ পেলো কম, এতক্ষণে এসে ফয়সালের কানে জবা ফুল দেখে হাসি পেলো বেশি। ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,
“এক্কেবারে মিস জরিনা খাতুনের মতোই লাগছে। হি হি!”
ফয়সাল চোখ দুটো ছোটছোট করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চায়। তারপর বলে,
“এই মাইয়া তুই হাসিস ক্যান? তুই কি ‘কানে ফুল পড়া’ একমাত্র মাইয়া মানুষের জন্মগত অধিকার ধইরা নিছিস?”
লুবনা জোর দিয়ে বলে,
“অবশ্যই।” বলেই ফয়সালের কান থেকে ফুল নিয়ে নিজের কানে পড়ে। ফয়সাল ‘এই?’ বলে হুংকার দিয়ে থাবা মারবে তার আগেই লুবনা নাগালের বাইরে চলে যায়। চোখ, মুখ, শরীর বেয়ে মেয়েটার হাসি উতলে পড়ে। কি সুন্দর, কি সুন্দর!
নোলক অনেক আগেই স্থান ত্যাগ করেছে। মন ভালো না থাকলে আশেপাশের কিছুই ভালো লাগে না। ক্যাম্পাসের ভিতর থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামলো। এদিক-সেদিক তাকিয়ে কিছু দেখলো-কি-দেখলো না ঠিক বুঝা গেলো না। শরীরটাও হালকা দূর্বল লাগছে। অনেক্ষণ রোদে থাকায় বোধহয়।
ক্যাম্পাস পেরিয়ে কিছুদূর হাঁটার পর আকস্মিক নোলকের ব্যাগ হ্যাঁচকা টানে নিয়ে নিলো কেউ! নোলক কিছু বোঝার আগেই ছিনতাইকারী নাগালের বাহিরে চলে গেলো। যখন বুঝতে পারলো তখন হঠাৎ-ই নোলক আর্তনাদ করে উঠলো, ‘এই আমার ব্যাগ, আমার চিঠি, নূপুর। এই বেয়াদপ! প্লিজ নিও না।’
কে শুনবে নোলকের এই অনুরক্তি?
নিষাদ সেই পথ ধরেই আসছিলো। নোলক এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে অড়িঘড়ি কাছে এসে ধরলো। বাহুতে নিয়ে বলল,
“এই? কি হয়েছে?”
নোলক ফুঁপিয়ে উঠে। চোখেমুখে হাত রেখে বলে, আমার চিঠিটা দোস্ত! নিয়ে গেলো”
নিষাদ আগামাথা কিছুই ঠাহর করতে পারলো না। নোলককে ধরে রেখেই সে ফয়সাল, সৃজন সকলকে কল করে জানিয়ে দিলো। দু’মিনিটের মাথায় সকলেই সেখানে এসে উপস্থিত হলো। এত করে জানতে চাইলো, কি হয়েছে? নোলক কিছুই বলতে পারছিলো না। শুধু বলতে লাগল, আমার নূপুর, চিঠি।
পাশ থেকে যারা দেখেছে ঘটনাটা তাদের কেউ কেউ বলল,
“ছিনতাই হইছে।”
ফয়সাল সৃজন আর নিষাদকে বলল,
“তোরা একটু সামনে এগিয়ে দেখ তো।”
তারপর ফয়সাল নোলকে আগলে নিয়ে বলল,
“আরেহ! বোকা নাকি? নূপুর আমি বানিয়ে দিবোনে। এই জন্য এভাবে কাঁদতে হয়? বোকা।”
শ্রেয়ার আর লুবনা বোধহয় নোলকের কান্না দেখেই হতভম্ব। কি বলে শান্তনা দেওয়া উচিত তাই ভুলে গিয়েছে।
নোলক বলল,
“আমার অন্য নূপুর চাই না। আমার চিঠিটা দোস্ত!”
ফয়সাল শান্তনা দিতে দিতে বলল,
“কিসের চিঠি? কার চিঠি?”
নোলক ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। আর কিছুই বলে না। এমন কেন হলো! হাতের উল্টোপাশ দিয়ে ভেজা গাল মুছে বলে,
“দোস্ত বাসায় দিয়ে আয়, আমাকে। প্লিজ!”
(চলবে)…..#জলছবি
#পার্ট_২৫
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
হাতের রিপোর্ট গুলো নিয়ে ইশান হতবিহ্বল চোখে এদিক সেদিক তাকালো।
সকাল থেকে আদ্র ভীষণ রকম অসুস্থ হয়ে পড়েছে। না, সকাল থেকে বললে ভুল বলা হবে। মাঝরাত থেকেই বলা চলে। ইশান তখনও ঘুমায়নি। আগের দিনের করা ফটোগ্রাফি গুলোই দেখছিলো। এডিটিং করছিলো। রাত তখন দুটো কি তিনটে বাজে।
আদ্র উঠে বসলো। হাটুর উপর দু’হাতের ভরে মাথা রেখে বলল,
“দোস্ত জেগে আছিস?”
ইশান ভাবলো মজা করে প্রশ্নটা করেছে। কারণ তখনও রুমের লাইট অন করা। ইশান নিজের খাটে বসেই ছিলো। এপাশ থেকে ওপাশ স্পষ্টই সব কিছু দেখা যায়। তারপরও এই প্রশ্ন রসিকতার মতোই লাগে। ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে বলে,
“না, জেগে জেগে ঘুমাচ্ছি। হা হা হা!”
আদ্র ইশানের এই রসিকতার বিপরীতে বলল,
“দোস্ত? মাথাটা কেটে ফেলে দেই? কি হবে, কেটে ফেলে দিলে?”
মাঝরাতে আদ্রর বলা সেই অদ্ভুত কথাটা ইশান মোটেও মজা হিসেবে নিলো না। কারন ভয়ানক মাইগ্রেশনের ব্যাথা উঠলেই আদ্র এমন উদ্ভট কথা বলে।
ইশান কিছু প্রতিত্তুর করার আগের হরবর করে বমি করে দিল। মাঝরাতে হসপিটাল না নিয়ে সেবাযত্ন করে ঘন্টাখানিক এর জন্য ঘুম পারালেও সকাল হতে না হতেই সেই যন্ত্রনা!
পরপর দুবার বমি করল। ইশান সামনে থাকার পরও বলছিলো, সে ইশানকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। মাইগ্রেনের ব্যাথা হচ্ছে। সাথে চোখ ব্যাথা। চোখ লাল হয়ে যাচ্ছিলো।
ইশানের চিন্তা লাগে। আদ্রকে নিয়ে হসপিটাল আসে দ্রুত। যদিও আদ্র আসতে চায়নি প্রথমে। বারবার বলছি ও জানে, ওর কি সমস্যা হয়েছে। ডক্টর-ফক্টর দেখিয়ে লাভ নেই।
কিন্তু ইশান এক প্রকার জোর করেই নিয়ে এসেছে। ছেলেটা হঠাৎ এমন অসুস্থতার রেশ এতক্ষণ কেবল চিন্তা হিসেবে থাকলেও এবার সেই চিন্তাটাই বাস্তবে রূপ নিলো।
আদ্রকে কেবিনে রেখে ইশান-ই ডক্টরের সঙ্গে কথা বলেছে। ডক্টর যখন বলেছিলো, ‘এতো সেন্সেটিভ একটা বিষয় এতদিন হেলাখেলা করাটা মোটেও ঠিক হয়নি। এত ইর-রেসপন্সিবল আর কেয়ারলেস হলে রোগ তো চেপে বসবেই! এখন তেমন কিছুই করার নেই। যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে।’
তখন ইশানের নিজেকে সবচাইতে অপদার্থ বন্ধু মনে হচ্ছিলো। আদ্র তো কখনো নিজের প্রতি যত্নাশীল ছিল না। কিন্তু সে নিজে কি করে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের প্রতি এতোটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে পারলো?
এই অনুতাপ বোধ মস্তিষ্কে পিড়া তৈরি করে বসলো।
আদ্র’র কাছে যাওয়ার পর আদ্র বলল,
“দেখি রিপোর্টগুলো?”
ইশান দিলো। কিন্তু আদ্র খুব চেষ্টা করেও কিছুই পড়তে পারলো না। ইশান এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কেবল। এই কষ্ট, এই অপারগতা আদ্রকে যতটা না কষ্ট দিলো তার থেকে বেশি দিলো ইশানকে।
এক টানে আদ্রর থেকে রিপোর্ট গুলো ছিনিয়ে নিয়ে বলল,
“তোর পড়তে হবে না, দে।”
আদ্র হেসে উঠলো। কি অদ্ভুত সেই হাসি! চোখের চশমাটা খুলে চোখ দুটো দু আঙুলে পরিষ্কার করে বলে,
“চোখ আর মাথা দুটোই বোধহয় বরবাত হতে চলল। চলল বলছি কেন? হয়ে গিয়েছে অলরেডি, হা হা হা! ভালোই হয়েছে, বল?”
হাসি লেগে থাকে আদ্রর ঠোঁটে, গালে, চোখে। ইশান আর সইতে পারে না। এক পলক আদ্রর হাসি লেগে থাকা চোখে তাকায় তারপর বেরিয়ে আসে কেবিন থেকে।
হসপিটাল ভর্তি মানুষ, তবুও তার মনে হচ্ছে সে নির্জন কোনো মরুভূমিতে চলে এসেছে। গলা শুকিয়ে আসছে। পাশের বেঞ্চটাতে বসে হাত দিয়ে গলা মোছে, কপাল মোছে। পরপর দুবার কল করে নোলককে। ফোন বন্ধ। শেষে ফোন করে নবনীকে। নবনী ফোন ধরতেই বলে,
“ভাবী নোলক আছে? ওকে…ওকে একটু দেয়া যাবে? একটু দরকার ছিলো প্লিজ।”
ওপাশ থেকে ভেসে আসে,
“নোলক তো নেই। ও তো ভার্সিটিতে।”
ইশানের খুব অসহায় লাগে। অসহায় কন্ঠেই বলে,
“ও! রাখি তবে।”
বলে ফোন রেখে দেয়। কি করবে? কাকে বলবে? অমন করেই বসে থাকে অনির্দিষ্ট সময় অব্দি।
.
নোলক যখন বাসায় ফিরলো তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেলে নামছে। বিধ্বস্ত ভগ্ন মন নিয়ে বাসায় প্রবেশ করতেই নবনী বলল হন্তদন্ত হয়ে কাছে এসে বলল,
“নোলক? তোর ফোন অফ কেন? সেই কখন থেকে কল দিচ্ছি।”
নোলক নবনীকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকতে বলল,
“চুরি হয়ে গিয়েছে। আপু একটু পানি দাও।”
নবনী প্রথমে পানি আনলো তারপর পানির গ্লাস নোলকের হাতে দিয়ে বলল,
“চুরি হয়ে গিয়েছে মানে? কিভাবে চুরি হলো?”
পরে বুঝলো নবনীর প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি। নিজের ভুল শুধরে নিয়ে বোনকে শান্তনা দেয়ার মতো করে বলল,
“আচ্ছা, কোনো ব্যাপার না। এই তো দুদিন পর বেতন পাবো। তখন নাহয় নতুন একটা কিনে নিবো। ওকে? মন খারাপ করিস না।”
নোলক কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। নবনী বলে,
“বাদ দে তো। শোন? ইশান কল করেছিল আমায়। তোকেও কল করেছিল বোধহয়। পায়নি দেখে আমায় করলো। কথা বলবি? আমার ফোন দিব?”
“না। আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি এখন ঘুমাবো।”
বলেই নিজের রুমে আসে। আসলেই তার ঘুম পাচ্ছে। অতি মন খারাপ তার রাগে পরিনত হয়েছে। ভয়ানক রাগ জন্মালো ইশানের প্রতি, আরশির প্রতি এবং সব শেষে আদ্রর প্রতি।
বারবার মনে হতে লাগলো, তার আত্মসম্মানেও আঘাত করা হয়েছে। ছিনতাই হওয়ার কারনে এতক্ষণ মন খারাপ থাকলেও এই পর্যায়ে এসে মনে হলো, খুব ভালো হয়েছে সব হারিয়ে গিয়েছে! কাউকে লাগবে না, কিছু লাগবে না।
এটা রাগ নাকি, অভিমান? ভালোবাসার অভিমান?
.
নোলককে ওর বাসায় দিয়ে এসেই নিজের বাসায় ফিরে ফয়সাল। জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরা, ঝলসে যাওয়া রংহীন দুই রুমের বাড়িটাতেই মা-ছেলের বসবাস। বাপের রেখে যাওয়া ওই আধ ফাটল বাড়ি আর এই একটুখানি জমিতেই কাটিয়ে দিলেন এক মহীয়সী নারীর সংসার জীবন, আর এক প্রখর আত্মসম্মান সম্পূর্ণ ছেলের বেশ অনেক খানি জীবন।
ফয়সাল বাড়ির সামনের কল থেকে মুখ ধুতে ধুতেই হাঁক ছাড়ে,
“আম্মা? ও আম্মা? খাইতে দাও। ক্ষুধা লাগছে।”
ভেতর থেকে আওয়াজ আসে,
“বাপ আইছিস? আজ এত দেরি করলি যে?”
বলতে বলতেই সে ঘড়ে দরজায় এসে দাঁড়ায়। ফয়সাল তার অর্ধেক গোটানো হাতাটায় মুখ মুছতে মুছতে বলে,
“একটু ঝামেলা হইছিলো আম্মা। তুমি খাইছো?”
কোহিনূর বেগম পৃথীবির অন্যতম সুন্দর হাসিটা হেসে বলেন,
“তোরে রাইখা আমি খাইছি কোনোদিন?”
ফয়সাল কাছে এগিয়ে আসে। মাকে কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“ফালতু অভ্যাস! খুব রাগ লাগে আম্মা! কোনো একদিন যদি না ফিরি? খাইবা না তুমি? না খাইয়া থাকবা? এইসব কেমন অভ্যাস আম্মা? চারটা বাজে এখনও খাও নাই!”
তিনি অপরাধী ভঙ্গিতে হেসে বলেন,
“সে আমার অভ্যাস আছে। একলা একলা গলা দিয়া খাওন নামে না বাপ। রাগ করিস কেন?”
ফয়সাল তখনও মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,
“এটাই শেষবার আম্মা। আর কখনো এমন করবা না। আমার কত কাম থাকতে পারে না? দেরি হইতে পারে না? তাছাড়া আমি তো ক্যাম্পাসে খাই। পেট ভরাই থাকে। আমার চিন্তা করো ক্যা? বয়স হইতাছে না তোমার? অনিয়ম করলে চলবো আম্মা? আল্লাহ বেরাজ হয়, রুহুরে কষ্ট দিলে। সাথে আমিও হই। বুঝ না ক্যান?”
বলেই জড়িয়ে ধরে। কপালে চুমু দিয়ে বলে,
“তোমারে আমি কত ভালোবাসি তুমি জানো না? তুমি আমার কলিজা আম্মা, আমার জান, আমার অন্তর, আমার পরান। এমন কইরো না তো। দুঃখ লাগে। দেখ তো, মুখটা কেমন শুকাইয়া ফেলছো?”
বলেই আরেকটা চুমু দিল।
কোহিনূর বেগমের চোখ ভিজে যায়। ছেলে তারে সত্যি ভীষণ ভালোবাসে সে কথা সে অস্বীকার করতে পারবে না। ছেলে ছাড়া তাঁর, সে ছাড়া ছেলের যে কেউ নেই!
দুজন ঘরে ঢুকবে তখনই ফয়সালের ফোন বেজে উঠে। ওপাশ থেকে কে কি বলে, স্পষ্ট বুঝা যায় না। ফয়সাল একটা গালি দিয়ে বলে,
“তুই ওইখানেই থাক। আমি আইতাছি। এত বড় সাহস ওর। দুই মিনিটে আসতেছি, থাক তুই। আজ ওর একদিন কি আমার একদিন। জাস্ট গাইরা ফালামু। তুই বাইক নিয়া মোরে থাক আমি এক মিনিটে আসতেছি।”
বলেই হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে আসতে লাগলে কোহিনূর বেগম বিচলিত হয়ে বলে,
“কি হইছে বাপ? কই যাস? আবার কোন গ্যাঞ্জামে জড়াতে চাইছিস? দেখ, কোনো গ্যাঞ্জামে জড়াবি না কইলাম। শোন আমার কথা…!”
ফয়সাল ততক্ষণে কিছুদূর এগিয়ে আসে। না দাঁড়িয়েই বলে,
“চিন্তা করো না আম্মা। গ্যাঞ্জামের দফারফা করতেই যাইতেছি। তুমি খাইয়া নেও, আমি আসতেছি। আইসা যদি শুনি এখনও খাও নাই, তবে তোমার সাথে আমি আর কথা বলবো না আম্মা। তুমি আমার একটা কথাও শোনো না।”
“তুই শুনিস?”
কোহিনূর বেগমের কথা শুনতে পেলো কি পেলনা কে জানে? অনেকদূর এগিয়ে যায় সে। কোহিনূর বেগম আতংকিত হয়ে আকাশের দিকে তাকায়। জড়ানো কন্ঠে বলে,
“আবার কোন ঝামেলা করতে চাইতাছে পোলাডা! আল্লাহ তুমি রক্ষা করো। বাপের মতো এই উগ্র মেজাজটাই না আবার ওর কাল হয়ে দাঁড়ায়! এত চিন্তা আমার আর ভাল্লাগে না। পোলাডা ক্যান ওর বাপের মতো হইলো?”
সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে নবনী এসে নোলককে ব্যস্তগতিতে জাগিয়ে বলে,
“এই? এই নোলক? ফয়সাল…ফয়সাল হসপিটালে। এই উঠ!”
নোলকের ঘুম হালকা হয়ে আসার ফলে সে প্রথমবারেই শুনতে পায়। হুড়মুড় করে উঠে বসে বলে,
“কি? মা…নে? ফাইজলামি করছিস আপু? ফাইজলামি একদমই ভালো লাগছে না এখন। যা তো।”
নবনী হাতের ফোনের দিকে নির্দেশ করে বলে,
“নিষাদ…নিষাদ ফোন করলো। বোন? ও কি প্রাঙ্ক করছে কিনা জিজ্ঞেস করে শিওর হয়ে নে তো!”
এতটুকু বলে নবনী নোলকের দিকে ভীত চোখে চায়। নোলক ধরেই নিয়েছে প্রাঙ্ক। বিকেলে দিয়ে গেলো ওকে আর সন্ধ্যায় হসপিটাল মানে?
নোলক নবনীর থেকে ফোন নিয়ে নিষাদকে ফোন লাগায়। নিষাদ ফোন তুলতে কান্নার কন্ঠ শোনা যায়। নোলক কিছু বলার সুযোগই পায় না। নিষাদ বলে,
“নোলক…. নোলক! আমাদের ফয়সাল….!”
(চলবে)