#জলপদ্ম
#কুরআতুল_আয়েন
|২১|
তনায়া আপুর গা’য়ে হলুদের প্রোগ্রাম শেষ হতে প্রায় তিনটা বেজে গেলো।বাসার বড়রা অনেক আগেই চলে গিয়েছে।তনায়া আপু হাতে মেহেদী নিয়ে নিজের গা’য়ে হলুদে একদফা নেচে ক্লান্ত হয়ে রিমিকে নিয়ে রুমে চলে গেলো।শাড়ি খুলতে সাহায্য করার জন্য।ছাঁদের পরিবেশ টা এখন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।মরিচ বাতি গুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।স্টেজের পাশে বিভিন্ন ফুলের পাপড়ি পড়ে আছে।তার মধ্যে কমন একটা ফুল গাঁদা!এমনকি তনায়া আপুকে গাঁদা ফুল দিয়েই সাজানো হয়েছে।গাঁদা ফুলের কিছুটা সংকট হয়ে গিয়েছিলো!আসলে শীতকাল ছাড়া এই ফুলের অনেক ডিমান্ড।পাওয়া টাই মুশকিল হয়ে যায়।সিঁড়ির ঘর থেকে নেমে আসলাম।করিডোর পুরো ফাঁকা হয়ে আছে।কিছুটা সামনে যেতেই আপত্তিকর একটা দৃশ্য দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলাম।লজ্জায় উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।কিছুটা সামনেই তনু আপু আর বাবলু ভাইয়া খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।কিস করার পূর্বমুহূর্ত।যতোই হোক!আমাদের সবার বড় তনু আপু।তাকে এইভাবে দেখতে গিয়ে কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছে।কিছুক্ষণ পর তনু আপু আর বাবলু ভাইয়া রুমে ঢুকে দরজা টা বন্ধ করে দিলো।আজকে সারা বাসা রোমান্সে ভরপুর।দুপুরের ঘটনা টা মনে পড়তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।রক্তিম ভাই দিনদিন পাগল হয়ে যাচ্ছেন।রক্তিম ভাইকে মনে মনে পাগলের উপাধি দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম।দেখা হলো তারিন আপুর সাথে।আমাকে দেখেই চোখজোড়া ছোট করে নিলেন।সেদিকে কোনো পাত্তা দিলাম না।যে যার মতো থাকতে চায় থাকুক।সেদিকে না তাকানোই ব্যাটার।তবে,এই মাঝরাতে রক্তিম ভাইকে হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে আমার সামনে দাঁড়াতে দেখে কিছুটা অবাক হলাম।এমতাবস্থায় রক্তিম ভাই কড়া গলায় বললেন,
‘ইমিডিয়েটলি আমার রুমে আয় রিমঝিম।তোর না খেয়ে থাকার স্বভাব টা আজকে আমি পরোক্ষ করে দেখতে চাই।দিনদিন শুকনো হয়ে যাচ্ছিস।আমি আমার প্রিয়তমা কে শুকনো হতে দেখতে চাই না।তাই খেয়ে খেয়ে নাদুসনুদুস হতে হবে।যাতে করে আমি প্রতিনিয়ত আলতো হাতে তোর নরম নরম গাল গুলো টিপে দিতে পারি।’
রক্তিম ভাইয়ের কথায় আমি ভীষণ লজ্জা পেলাম।তবে,আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তারিন আপু রাগান্বিত হয়ে তাকালেন রক্তিম ভাইয়ের দিকে।আর,রক্তিম ভাইটাও খুব একরোখা।তারিন আপুর সামনে এইসব বলার এই বা কি ছিলো।কিন্তু,এইসব কথা শুনতে আমার খুব ভালো লাগছে।উপলব্ধি করতে পারছি রক্তিম ভাইয়ের ভালোবাসা, কেয়ার!!
‘কিরে রিমঝিম কোথায় হারিয়ে গেলি।’
‘আপনার মাঝে রক্তিম ভাই।এতো ভালোবাসেন কেনো আমাকে?’
আচমকাই মনে হলো রক্তিম ভাইকে কি আবোলতাবোল বলে দিলাম।তারিন আপু আর দাঁড়ান নি।চলে গেলেন গটগট করে।সেদিকে আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।আমার একমাত্র ধ্যান-ধারণা রক্তিম ভাই।রক্তিম ভাই আমার হাত ধরে রুমে নিয়ে গেলেন।বিছানার এককোণায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পড়লেন।মুখের সামনে খাবার ধরে বললেন,
‘সবাইকে মেহেদী পড়িয়ে দিলি অথচ তুই নিজে পড়লি না।’
‘সময় পায় নি রক্তিম ভাই।’
রক্তিম ভাই মুচকি হাসলেন।খাওয়ানো শেষ করে হাত টা ধুয়ে আমার পাশে শরীর ঘেঁষে বসলেন।পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা মেহেদী বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘আমার সামনে এখন তুই মেহেদী পড়বি।আর,সেখানে সুন্দর করে আমার নাম লিখে নিবি।মনে পড়ে,আমাদের বিয়েতে তুই সুন্দর করে মেহেদী পড়েছিলি,আর সেই মেহেদীর ঘ্রাণ নিতে নিতে আমার বাসরের অর্ধেক রাত পার হয়ে গিয়েছিলো।তবে,এখন শুধু আমি তোর হাতের মেহেদীর ঘ্রাণেই নিবো এর বেশি কিছুই করবো না।আমি ভালো ছেলে রিমঝিম!!’
রক্তিম ভাইয়ের কথা শেষ হতে না হতেই আমি ফিক করে হেসে দিলাম।কি বাচ্চামো টাই না করেন!রক্তিম ভাইয়ের কথামতো মেহেদী পড়া শুরু করে দিয়েছি।শুধু তাই নয়,মেহেদী দেওয়ার বিশ মিনিট পরেই রক্তিম ভাই জোর করে আমার হাত ধুয়ে দিলেন।আমার হাত দুটো ধরে বললেন,বাহ্!এতো অল্পতেই এতো সুন্দর রঙ হয়েছে।এই রঙ টা বেশ মিষ্টি লাগছে রিমঝিম।ঘ্রাণ টাও মনে হয় অদ্ভুত রকমের মিষ্টি হবে।’
‘ঘ্রাণ আবার মিষ্টি হয় নাকি রক্তিম ভাই।আপনি মাঝেমধ্যে খুবই অদ্ভুত কথা বলেন।’
‘তুই আমার কাছে থাকলে সব কিছুই গুলিয়ে যায় রিমঝিম।সেই দিক দিয়ে এইরকম অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত কথাও চলে আসে।’
আমি মুচকি হেসে রক্তিম ভাইয়ের বুকে মাথা গুঁজে দিলাম।সেদিন রাত টাও আমাদের ভালোবাসায় কেটেছে।দু’জনে মত্ত ছিলাম দু’জনের মধ্যে।রক্তিম ভাইয়ের ভালোবাসায় আমি যেনো পাগল হয়ে গিয়েছিলাম।শুধু তাই নয়,রক্তিম ভাইয়ের প্রতিটি স্পর্শে ভালোবাসা ছিলো।আচ্ছা!!আজও কি রক্তিম ভাই আমাকে ভালোবাসেন?উঁহুহু!রক্তিম ভাই আমাকে ভালোবাসেন না।রক্তিম ভাইয়ের ভালোবাসার নিঁখুত অভিনয়ে আমার ভালোবাসা হেরে গিয়েছিলো।প্রতিটি মুহূর্ত আমি বিশ্বাস করেছিলাম রক্তিম ভাইকে!!
||
ডায়েরি টা বন্ধ করে দিয়ে রিমঝিম কান্নায় ভেঙে পড়লো।আজকে তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে।ঘড়ির টিকটিক আওয়াজে রিমঝিম ছলছল চোখে সেদিকে তাকালো।রাত তিনটে বেজে পনেরো মিনিট।সেই সন্ধ্যা থেকে এখন পর্যন্ত অতীতে ডুবে ছিলো কথাটা ভেবেই রিমঝিম ফিঁচলে হাসলো।রক্তিমের সাথে হওয়া এক একটা ঘটনা ডায়েরিতে লিখে কষ্ট কমাতে গিয়ে যেনো উল্টো বেড়ে গেলো।কিন্তু,পরের হওয়া ঘটনা গুলো রিমঝিম কিছুতেই লিখার সাহস পাচ্ছে না।ভিতর থেকে দমকা হাওয়ার মতো কান্নার বেগ আসছে।রিমঝিম টেবিল থেকে উঠে পড়লো।জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পর্দা টা মেলে দিলো।তুষারপাত হচ্ছে।যার ফলে,বাসার সামনে রাখা গাড়ি টা তুষারে ভরপুর।রাশিয়া যেনো শীতপ্রধান দেশের মধ্যে অন্যতম।এদেশে যেনো ঠান্ডা লেগেই থাকে।রিমঝিম একমনে তাকিয়ে রইলো বাহিরের দিকে।বাহিরের লাইট টা শুধু জ্বলজ্বল করছে।তবে,সামনের ডান পাশের বাসা টা থেকে মৃদু আলো ভেসে আসছে।কি মনে করে,রিমঝিম সেদিকে তাকালো।তাকিয়ে সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে ফেললো।জানালার ধারে দাঁড়িয়ে দুটো রাশিয়ান ছেলে-মেয়ে মনের সুখে লিপ কিস করছে।যা দেখে রিমঝিম তাড়াতাড়ি পর্দা টেনে দিলো।মাথাটা চেপে ধরে বিছানার কোণায় বসে মনে মনে বিরবির করে বলতে লাগলো,’এইসবই যখন করবি তাহলে জানালাটা বন্ধ করেই কর না।’
রিমঝিম আর কিছু ভাবলো না।কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে পড়লো।সকালে তার ভার্সিটি যেতে হবে।গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্লাস আছে।
—-
খাবার টেবিলে মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন সাদিক আহমেদ।রিমঝিমের জন্য অপেক্ষা করছেন।মেয়ের পরিবর্তন সাদিক আহমেদকে বিষিয়ে তুলেছে।বাংলাদেশ থেকে রাশিয়া তে আসার পর রিমঝিম অনেকটা পাল্টে গিয়েছে।চঞ্চল রিমঝিমের সাথে চুপচাপ রিমঝিমকে মানায় না।সাদিক আহমেদ ভিতরে ভিতরে অনেক টা জখম হয়েছেন।দুই’ভাইয়ের মধ্যে যে হঠাৎ করেই এইরকম একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাবে তা বিন্দুমাত্র বুঝতে পারেন নি।সেলিনা আহমেদ রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে এসে টেবিলে সাজাচ্ছেন।আর,একটু পর পর রিমঝিমের রুমের দিকে তাকাচ্ছেন।সাদিক আহমেদ কে ডিঙিয়ে রিমঝিমের রুমের দিকে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না।তবে,একটু পরেই তো রিমঝিমের ভার্সিটি।কিন্তু,এখনো রিমঝিমের আসার কোনো হুশ নেই।সেলিনা আহমেদ ডাইনিং টেবিলের থেকে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন।বাংলাদেশে থাকাকালীন সবাই কতোটা মিলমিশেই না ছিলো।কিন্তু,তনায়ার বিয়ের পর সব যেনো ঝড়ের গতিতে উলোটপালোট হয়ে গিয়েছে।ভাই-ভাইয়ের সম্পর্ক যেনো এক নিমিষেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে।এখানেই থেমে নেই,আরো অনেক কিছু ঘটেছে।সেসব সেলিনা আহমেদ ভাবতে চান না।রিমঝিমকে কষ্ট পেতে দেখেছেন নিজের চোখে।একমাত্র মেয়ে যখন কষ্টে জর্জরিত হয়ে গিয়েছিলো তখন তিনি মা হয়ে নিজেকে আঁটকে রাখতে পারেন নি।সাদেক আহমেদের সাথে কথা বলে রাশিয়াতে শিফট হয়ে গেলেন।দুই বছরের উর্ধ্বে হয়ে গেলো।আজও রিমঝিমের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসলো না।সবকিছু কি আদোও স্বাভাবিক হবে তাও জানেন না।
রিমঝিম গলায় মাফলার পেঁচিয়ে নেমে আসলো।বাহিরে তুষারপাত যেনো চলছেই।অবশ্য,তা নিত্যদিনই চলে।রিমঝিম চলে যেতেই সাদিক আহমেদ বলে উঠলেন,
‘খেয়ে যাও!তোমার জন্য,আমি আর তোমার মা অপেক্ষা করছি।’
রিমঝিম একপলক তাকালো মা বাবার দিকে।দু’জনের মুখটা যেনো শুকিয়ে আছে।খুব মায়া কাজ করলো।দৌড়ে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়লো।অলরেডি ভার্সিটির অনেক টা দেরি হয়ে গিয়েছে।তাও,আজকে সে বাবা মা’র সাথে ব্রেকফাস্ট করবে।সাদিক আহমেদের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।সেলিনা আহমেদ কেঁদে দেবেন এমন ভাব।তা দেখে সাদিক আহমেদ চোখ দিয়ে ইশারায় কান্না করতে না বুঝালেন।সেলিনা আহমেদ তাও পারলেন না!চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু দানা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো।হাসিমুখে খাবার পরিবেশন করলেন।অন্যদিকে,সাদিক আহমেদ ভাবতে লাগলেন,আজকে অফিসে যাবেন না।অফিসের সব দায়িত্ব এমডি মাজহারুল কে বুঝিয়ে দিয়ে আসবেন।ছেলেটাকে খুব পছন্দ করেন।কাজের দিক দিয়ে খুব পারদর্শী।বিদেশের মাটিতে এইরকম বিশ্বস্ত ছেলে পাওয়া খুবই মুশকিল।এই কোম্পানির পিছনে সাদিক আহমেদের অনেক পরিশ্রম আছে।সেই শুরু থেকে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে এই কোম্পানি করেছেন।সাদিক আহমেদ এতেই অনেক খুশি!
—-
ভার্সিটির মাঠে বসে আছে রিমঝিম।হাতে একটি ইংলিশ বই।উইলিয়াম শেকসপিয়ারের বিখ্যাত একটি বই,”In search of lost time.”বইটির একটার পর একটা পেইজ উল্টিয়ে যাচ্ছে।এহসান দূর থেকে রিমঝিমকে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলো।রিমঝিমের পাশে ধুপ করে বসে পড়লো।রিমঝিমের কাঁধে টোকা দিয়ে বললো,
‘হোয়াট হ্যাপেন্ড রিমঝিম?’
রিমঝিম এহসানকে দেখে মুচকি হাসলো।ঠোঁট দুটো গোলাপি হয়ে আছে।চুলগুলো কপাল ছুঁইছুঁই করছে।বাঙালী একটা ভাব আছে চেহারায়।এহসানের মা বাঙালী ছিলেন বলে বোধহয় এহসান দেখতে এমন হয়েছে।শুধু তাই নয় বাংলা বলাতেও অনেকটা দক্ষ।ভার্সিটির বেস্ট ফ্রেন্ডদের মধ্যে এহসান একজন।বাকিরা ক্যান্টিনে আছে।খাওয়ায় ব্যস্ত।এহসান নিজের দিকে রিমঝিমকে তাকিয়ে থাকতে দেখে চোখ দিয়ে ইশারা করে কী বুঝালো।রিমঝিম পুনরায় বইয়ে চোখ গুঁজে দিয়ে বললো,
‘নাথিং এহসান।’
‘সিরিয়াসলি!তোর কিছু হয় নি রিমঝিম।’
‘উঁহুহু!আমি একদম ঠিক আছি।’
এহসান বিশ্বাস করলো না রিমঝিমের কথা।সেই শুরু থেকেই রিমঝিমকে এইভাবে দেখে আসছে।মাঝেমধ্যে হাসে তো মাঝেমধ্যে গোমড়া হয়ে থাকে।এর কারণ,জানতে চাইলে রিমঝিম এড়িয়ে গিয়েছে।প্রপারলি কিছুই বলে নি।রিমঝিমের নাকচ করা দেখে এহসানও কিছু বলার সাহস পায় নি।রিমঝিম হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিলো।বাসার দিকে রওনা দিতে হবে।এইখানে বসে থাকতে তার একদন্ড ভালো লাগছে না।বইটা বন্ধ করে সাইড ব্যাগ টা নিয়ে উঠে পড়লো।রিমঝিমকে উঠতে দেখে এহসানও উঠে দাঁড়ালো।গলার মাফলার টা নিচে পড়ে আছে দেখে এহসান তা তোলে নিয়ে রিমঝিম কে দিতে গেলেই রিমঝিম একপ্রকার অবলীলায় বলে উঠলো,
‘এইটার দরকার নেই।আমার ঠান্ডা লাগবে না।’
‘তুই এতো কেনো কেয়ারলেস রিমঝিম।সবসময় এইভাবেই চুপ থাকিস।হাসতে গিয়েও যেনো হাসিস না।তুই জানিস রিমঝিম!তোকে হাসলে কতটা সুন্দর লাগে।ইচ্ছে করে তোর দিকে তাকিয়েই থাকি।’
‘জীবনের সুন্দর মুহূর্ত গুলো শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমারও হাসি মিহিয়ে গিয়েছে।তাই,চাইলেও আমি এখন হাসতে গিয়েও হাসতে পারি না।’
রিমঝিম আর দাঁড়ালো না।কালো কোটের বড় বড় পকেটে হাত গুটিয়ে চলে গেলো।আর,কয়েক কদম পার হলেই ভার্সিটির গেইট পেরিয়ে মেইন রাস্তায় চলে আসবে।এহসান দূর থেকে দেখছে রিমঝিমকে।রিমঝিমকে যতোই দেখে ততই অবাক হয়।বারবার জানতে ইচ্ছে করে রিমঝিমের মন খারাপের কারণ!!কিন্তু,সাহস করে উঠতেই পারে না।
—-
মাঝরাত!রকিং চেয়ারে বসে আছে রক্তিম।হাতে চুরুট।সামনের দেয়ালে রিমঝিমের একটা হাসি উজ্জ্বল ছবি।রক্তিম চোখ লাল করে একধ্যানে রিমঝিমের ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে।রক্তিমের কেনো জানি রিমঝিমের হাসিটা দেখেই মাথাটা গরম হয়ে গেলো।পাশে রাখা ফুলদানি টা নিয়ে রিমঝিমের ছবিটার দিকে ছুঁড়ে মারলো।মুহুর্তেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো ছবির কাঁচ টা আর সেই সাথে ফুলদানি টাও।রক্তিম দাঁতে দাঁত পিষে বলতে লাগলো,
‘আমি ছাড়বো না তোকে রিমঝিম।তুই আমার সাথে অন্যায় করেছিস।কি ভেবেছিলিস,আমার থেকে দূরে গিয়ে তুই সুখে থাকবি।আর,আমি এইখানে কষ্টে মরে যাবো।তাহলে তুই ভুল ভাবছিস রিমঝিম।আমি তোকে ছাড়বো না।’
রক্তিম রকিং চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো।বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো।চোখের কার্ণিশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।তবুও নিজেকে শক্ত রেখেছে।
—-
রিমঝিম রাস্তা দিয়ে আনমনে হেঁটে যাচ্ছে।রাস্তার কিছুটা সামনে আগালেই একটা পার্ক পড়ে।পার্ক থেকে দশ মিনিটের মতো সময় লাগে বাসায় পৌঁছতে।রিমঝিমের বাসায় যেতে ভালো লাগছে না।পার্কের দিকে এগিয়ে গেলো।চারপাশ নিস্তব্ধ।গাছ গুলো তুষারের ফলে সাদা হয়ে আছে।রিমঝিম গাছগুলোর দিকে একবার পরোক্ষ করে স্টিলের বেঞ্চিটায় বসে পড়লো।পাশে ব্যাগটা রেখে সেখান থেকে ডায়েরি টা বের করে নিলো।ডায়েরির উপরে বড় করে লিখা জলপদ্ম।এই ডায়েরিটার নাম জলপদ্ম তা রিমঝিম দিয়েছে।কাঁপা কাঁপা হাতে ডায়েরিটা খুলতেই রিমঝিম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।গতকাল রাতে যেখানে লিখা শেষ করেছিলো সেই পৃষ্ঠার নাম্বার টায় হাত বুলিয়ে মনে মনে আওড়াতে লাগলো,
‘আপনার সাথে আমার জীবনের শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত থাকা হলো না রক্তিম ভাই।গুণে গুণে মাত্র তিনশো পঁয়ষট্টি পৃষ্ঠা অব্দি থেকেছেন।বাকি পৃষ্ঠাতেও তো আপনার ভালোবাসা পেতে চেয়েছিলাম,কিন্তু ভালোবাসার বদলে আপনি দিয়েছেন ধোঁকা,আর একরাশ অবহেলা।আপনি কীভাবে পারলেন,আমার সাথে মিথ্যা ভালোবাসার অভিনয় করতে।’
রিমঝিম একদফা কেঁদে নিজেকে শক্ত করে নিলো।কলমটা হাতে তোলে নিয়ে আবারও লিখতে লাগলো,
🍁🍂
ভোরে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে রক্তিম ভাইয়ের বুকে আবিষ্কার করলাম।রক্তিম ভাইয়ের নগ্ন বুকটা দেখে লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।এইভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর অনুভব করলাম,রক্তিম ভাই আমার কাঁধে ঠোঁট বুলাচ্ছেন।পিঠে শুকনো চুমুর বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন।তড়িঘড়ি করে নিজেকে ঠিক করে উঠতে নিলেই রক্তিম ভাই পা দিয়ে আমাকে আঁটকে দিলেন।একটানে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন।গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে বললেন,
‘এইভাবে আরো কিছুক্ষণ থাকতে চাই রিমঝিম।রাতের মতো তোমার সঙ্গ চাই।আবারও তোমাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিতে চাই।’
‘আপনি কথা দিয়ে কথা রাখেন নি রক্তিম ভাই।বলেছিলেন,আজকে শুধু মেহেদীর ঘ্রাণ নিবেন,অন্যকিছু করবেন না।’
‘বলা সহজ হলেও করাটা কঠিন ছিলো।তুমি পাশে থাকলে ভালো না বেসে উপায় নেই।’
রক্তিম ভাইয়ের কথার পিঠে কিছু বলার সাহস পেলাম না।আস্তে আস্তে আমিও রক্তিম ভাইকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলাম।ঠোঁটে বিস্তর হাসি।রক্তিম ভাইয়ের ভালোবাসা যে আমাকে মাতাল করে তোলে।
—-
তনায়া আপুর বিয়ের কার্যক্রম একটু পরেই শুরু হবে।আবির ভাই খুব দৌড়াদৌড়ি করছেন।আবির ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম,মুখটা একদম ছোট হয়ে আছে।তনায়া আপু চলে যাবে বলে আবির ভাই যে নিজেকে ভিতরে ভিতরে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছে তা বুঝতে আর বাকি রইলো না।বোনদের জন্য ভাইদের বুঝি এমনেই কষ্ট হয়।বাগানের দিকটায় দাঁড়িয়ে রিমির জন্য অপেক্ষা করছি।আমাকে এইখানে দাঁড় করিয়ে দিয়ে নিজে গিয়েছে বাসার ভিতরে।কি কাজে গিয়েছে তাও বলে যায় নি।তারিন আপু কোথা থেকে এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন।ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন,
‘খুব সুখে আছো তাই না রিমঝিম।আমাকে কষ্টে থাকতে দেখে তোমার খুব আনন্দ হচ্ছে।তুমি খুব লোভী রিমঝিম!খুব লোভী।’
তারিন আপুর কথা পিঠে মুচকি হেসে বললাম,
‘এতোদিন কেনো ম্যাসেজ পাঠিয়ে নিজের টাকা খরচ করলেন তারিন আপু।আজকে যেভাবে সামনে এসে বলে দিয়েছেন ঠিক একইভাবে যদি ম্যাসেজের কথাগুলো সামনে এসে বলতেন তাহলে,আর আপনার টাকাগুলো খরচ হতো না।’
তারিন আপু কিছুটা থতমত খেয়ে গেলেন।আমার দিকে তাকিয়ে আমতাআমতা করে বললেন,
‘কিসের ম্যাসেজের কথা বলছো তুমি রিমঝিম।আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘আপনার তাহলে মনে নেই তারিন আপু!ঠিক আছে আমি দেখাচ্ছি,একটু অপেক্ষা করুন।’
তারিন আপু আর দাঁড়ালেন না।তাড়াহুড়ো করে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন।দূর থেকে তারিন আপুর যাওয়া দেখে রঞ্জন ভাই,সিফাত ভাই সহ বাকিরা সবাই হেসে দিলো।সবাইকে দেখতে পেলেও রক্তিম ভাইকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।আশেপাশে তাকিয়ে রক্তিম ভাইকে খুঁজে ব্যর্থ হলাম।উল্টো ঘুরে বাসার দিকে যেতে নিলেই দেখতে পেলাম,রক্তিম ভাইকে।গাঢ় খয়েরী রঙের একটা পাঞ্জাবী পড়ে আছেন।গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে তদারকি করছেন আর,বড়’বাবার সাথে মাঝেমধ্যে কথা বলছেন।তবে,বড়’বাবার মুখটা অন্যদিনের তুলনায় কিছুটা গম্ভীর হয়ে আছে।রক্তিম ভাইয়ের চোখে চোখ পড়তেই রক্তিম ভাই সাথে সাথে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।ব্যাপার টাকে তেমন একটা পাত্তা দিলাম না।বড়’বাবা আছে বলেই হয়তো আমার দিকে তাকালেন না।
চলবে..
[লেখিকার কিছু কথাঃপ্রথমত,,কিছু কারণে মন খারাপ ছিলো বলে,আমি সাবাইকে বলেছিলাম জলপদ্ম শেষ করে দিবো।গল্পের প্লট লিখার আগে থেকেই ভাবা ছিলো,তবে মাঝখানে মন খারাপ থাকার কারণে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম।কিন্তু,লাস্ট পর্ব কিছুতেই গোছালো হচ্ছিলো না বলে,যেভাবে ভেবে রেখেছিলাম সেভাবেই লিখতে হলো।
দ্বিতীয়ত,,আজকের পর্বে অনেক ধোঁয়াশা কাজ করবে তা জানি।আমি সবকিছুই ক্লিয়ার করবো।তা আমার ভাবা আছে।একটু ধৈর্য ধরতে হবে।
অবশেষে,,জানি না গল্পটা সবার কাছে কেমন লাগছে,বা আজকের পর কেমন লাগবে।গল্পে একটা জিনিস নিয়ে খুব হিমশিম খেয়েছি।সারনেইম টা আহমেদ ছিলো নাকি অন্যকিছু ছিলো তা ভুলে গিয়েছি।আগের পর্বে কোথাও একবার সারনেইম লিখেছিলাম,তবে ভুলে গিয়েছি আমি।এখন খুঁজতে গেলেও পাবো না।আরো একটা কথা,ভুল-ভ্রান্তি গুলো ক্ষমার চোখে দেখবেন।]