জলপদ্ম পর্ব -২৫

#জলপদ্ম
#কুরআতুল_আয়েন

|২৫|
রিমঝিমদের আসতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে দেখলো আবির,বাবু,গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আবির রিমঝিমকে দেখেই দৌড়ে এসে জাপটে ধরলো।আকস্মিক ঘটনায় রিমঝিম প্রথমে চুপ থাকলেও তার কিছুক্ষণ পরেই ডুকরে কেঁদে উঠলো।আবির কাঁদছে নিঃশব্দে।এতোদিন পর রিমঝিমকে দেখে আবির অনেকটাই আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়েছে।কখনো তাদের ভাইবোন রা আলাদা হয় নি।দুভার্গ্যবশতঃ এই প্রথমেই আলাদা হয়েছে।বাবুর চোখেও পানি চিকচিক করছে।বাবু ভাবছে তনায়া কে নিয়ে।প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকেই বমি করে একদম হযবরল অবস্থা।তার মধ্যে রিমঝিমকে দেখে তো কান্না করবেই।ফোনে কথার বলার পরই কেঁদেকেটে বারোটা বাজিয়ে দেয়,আর এখন তো সামনাসামনি রিমঝিমকে দেখবে।বাবু দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বিরবির করে বললো,তনায়া যেনো বেশি কান্না না করে।অবশ্য,আমি কি বলছি বেক্কেলের মতো।রিমঝিম আসবে শুনে যে মেয়েটা সন্ধ্যায় জোর করে চলে এসেছে তাকে দেখে আবার কাঁদবে না!আবির হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের কোণে লেগে থাকা পানিটা মুছে নিলো।রিমঝিমের মুখটা আগলে ধরে বললো,’এতো অভিমানী হয়ে গেলি তুই রিমঝিম।বাংলাদেশে আসতেই চাস নি।আমি সব জানি!ছোটবাবা আর ছোটমা তোকে অনেক কসরত করে নিয়ে এসেছে।আমাদের সেই ছটফটে রিমঝিম কতোটা শান্ত হয়ে গেলো।মুখের মধ্যে আর বাচ্চামো ভাব টা নেই।ম্যাচুরিটি ভাব এসে গিয়েছে।’
রিমঝিম ঠোঁট বাঁকালো।আঁড়চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘মোটেও না আবির ভাই।তুমি একটু বেশিই ভাবছো।’

আবির রিমঝিমের কথার পাত্তা না দিয়ে সাদিক আহমেদ এবং সেলিনা আহমেদের দিকে এগিয়ে গেলো।দু’জনের সাথে কুশল বিনিময় করে জড়িয়ে ধরলো।ততক্ষণে বাবুও সামনে এসেছে।রিমঝিমের সাথে কিছুক্ষণ খুনশুটিময় আলাপ করে তাঁদের দিকে এগিয়ে গেলো।সেখানেই দাঁড়িয়ে সবাই একদফা কথাবার্তা শেষ করে গাড়িতে উঠে বসলো বাসার উদ্দেশ্যে।

রাত দশটা বেজে পনেরো মিনিট।রক্তিম অফিসে বসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল দেখছে।অন্যদিন বাসায় আগে চলে গেলেও আজকে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে।এক বান্ডিল ফাইল দেখে শেষ করতে পারলো না তার মধ্যেই আরেক বান্ডিল ফাইল দেখার অর্ডার দিয়ে দিলেন সিদ্দিক আহমেদ।রক্তিম বেশ খানিকটা অবাক হলো।আগে এতো রাত করে অফিসে থাকতে দেখে নি তার বাবাকে।অর্ধেক ফাইল দেখে রক্তিম চেয়ার টায় মাথা এলিয়ে দিলো।কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত করার পর কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়লো।সিদ্দিক আহমেদের কেবিনে ঢুকে গিয়ে বললো,
‘কোনো সমস্যা বাবা!আজকে এতোরাত পর্যন্ত অফিসে বসে আছো।বাসায় যাবে না নাকি?’

সিদ্দিক আহমেদ চিন্তায় আছেন।সেই সাথে ভয়ও পাচ্ছেন।রিমঝিমদের আসার খবর অনেক আগেই পেয়েছেন।তবে,রক্তিম এখন পর্যন্ত জানে না।তিনি কড়া গলায় সবাইকে বলে দিয়েছিলেন,রক্তিমের সামনে যেনো রিমঝিমদের আসার তারিখের কথা না তোলা হয়।তখন সবাই মানলেও,এখন কি করবেন তাই ভাবছেন।একই বাসায় থাকবে দেখা না হয়ে তো আর উপায় নেই।কোনোমতে তারিনের সাথে বিয়েটা দিয়ে দিলেই আরো কয়েক কোটি টাকার ডিল পাবেন।তখন,এই কোম্পানি আরো কিছুটা সামনে এগিয়ে যাবে।রক্তিম হতাশা নিয়ে পুনরায় বললো,
‘কি হলো বাবা!এইরকম শক্তপোক্ত হয়ে বসে আছো কেনো?তুমি বাসায় যাবে না?’
সিদ্দিক আহমেদ গম্ভীর গলায় বললেন,
‘না!’
‘কিন্তু কেনো বাবা?কি হয়েছে তা বলবে তো।’
‘আমার ইচ্ছে করছে না আজকে বাসায় যেতে।অফিসেই থাকতে মন চাইছে।তুমিও থাকবে আমার সাথে।ফাইল গুলো দেখে শেষ করবে।’
রক্তিম ব্লেজার টা খোলে হাত নিয়ে নিলো।দূর্বল কণ্ঠে বলে উঠলো,
‘আমি খুব ক্লান্ত বাবা।ফাইল গুলো দেখার সাধ্যি আমার নেই।কাল দেখে নিবো।আমি গেলাম।তুমি থাকো।’
রক্তিম বের হতে নিলেই সিদ্দিক আহমেদ জোর গলায় ডেকে বললেন,
‘না রক্তিম তুমি যাবে না বাসায়।আমার সাথেই থাকবে।’
রক্তিম কিছুটা সন্দেহের সুর টেনে বললো,
‘বাসায় গেলে তোমার সমস্যা কোথায় বাবা।আগে তো কখনো এমন করো নি।তাহলে?’

সিদ্দিক আহমেদ কিছুটা দম নিলেন।হাত টাকে মুঠো করে রাগ টাকে সামলে নিয়ে বললেন,
‘আমি বলছি তাই তোমাকে শুনতে হবে রক্তিম।কারণ,আমি তোমার বাবা।তোমার ভালো চাই আমি।’

রক্তিমের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো।সিদ্দিক আহমেদ কে ঠেস দিয়ে বললো,
‘তাই তো,তুমি আমার সবচেয়ে বড় সর্বনাশ টা করে দিয়েছো।আমার ভালোবাসার চোখে আমাকে খারাপ বানিয়ে দিয়েছো।তাই,প্লিজ এমন কোনো কথা বলো না যার জন্য পুরনো কাসন্দি টানতে হয়।’

রক্তিম আর দাঁড়ালো না।হনহনিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলো।সিদ্দিক আহমেদ রক্তিমের যাওয়ার পানে রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছেন।পাশে থাকা শোপিস টা দেয়ালে ছুঁড়ে মারলেন।মনে হচ্ছে,সবকিছু যেনো হাতের বাহিরে চলে যাচ্ছে।

রক্তিম গাড়িতে বসে স্টার্ট দিতে যাবে তখনি ফোন টা বেজে উঠলো।আবিরের নাম্বার দেখে ভ্রুঁকুটি কুঁচকিয়ে ফেললো।ফোনটা কানে চেপে ধরতেই আবির আহ্লাদী গলায় বলে উঠলো,
‘বাসায় আসছিস কখন?’
‘এইতো সবেমাত্র গাড়ি স্টার্ট দিবো।কিন্তু কেনো?’
‘তোকে দরকার ছিলো খুব এইজন্য।’
‘আমাকে দিয়ে তোর কাজ কি আবির?শিলাজনিত ব্যাপার হলে,আমি কিন্তু হাওয়াইমিঠাই।’

‘তোর হাওয়াইমিঠাইয়ের মতো মিহিয়ে যেতে হবে না।শিলা তো শিলা বৃষ্টির মতো আমার ঘরের চালে এসে পড়বে।ঠিক তখনি আমি তাকে নিজের আয়ত্ত্বে করে নিবো।তোর কোনো সাহায্য লাগবে না।আমি একাই যথেষ্ট।নো টেনশন ডু ফূর্তি।’
‘কি ডায়লগ দিলি ভাই।দু’বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিস কিন্তু ফলাফল সেই শূন্যই।না হচ্ছে শিলা বৃষ্টি আর না পারছিস তাকে তোর ঘরের চালে আনতে!’

‘ঠেস দিয়ে একদম কথা বলবি না রক্তিম।ওইটা ঘরের চালের কথা বলি নি,নিজের মনে আয়ত্ত্বে করে নিবো তার কথা বলেছি।তোরা দুই বন্ধুই এক ধাঁচের।একজন কানা হয়েও কি ভাব!দেখছে না দু’বছর তার পিছনে কীভাবে ঘুরছি!উফফ!দেখবে কীভাবে!আমিও কতো বোকা।দেখলে কি আর চশমা পড়তো।বেয়াদব মহিলা।’

‘তোর প্যাঁচাল-ক্যাঁচাল শোনার মুড বা ইচ্ছে দুটোর একটাও নেই আমার।ফোন রাখ বলছি!’

‘লাস্ট একটা কথা মামু!প্লিজ তোর কানা বান্ধুবী কে একটা ভালো চোখের ডক্টর দেখাতে বলিস।যাতে করে চোখে একটু দেখতে পারে।সেই সাথে আমাকেও।’
কথাটা বলেই ফট করে কেঁটে দিলো আবির।রক্তিম আহাম্মকের মতো কতক্ষণ থম মেরে বসে রইলো।আবিরকে মনে মনে কয়েকশো গালি দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো।নিস্তব্ধ রাস্তা।কম ভলিউমে হাবিদ ওয়াহিদের ডুব গানটি বাজছে।চোখের সামনে ভেসে উঠছে রিমঝিমের মুখটা।রক্তিম দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে আওড়িয়ে বললো,কবে দেখতে পাবো আমি তোর সেই মুখটা রিমঝিম!পরক্ষণেই চোখে,মুখে রাগ ফুটে উঠলো।নাক ফুলিয়ে বলতে লাগলো,
‘তুই আমাকে রিজেক্ট করেছিস রিমঝিম।আমি তোকে আগের মতো কাছে পেতে চেয়েছিলাম!আর তুই কিনা সেদিন রাতে আমাকে ধাক্কা দিয়ে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলিস।শুধু তাই নয়,আমার মুখের উপর দরজাও আঁটকিয়ে দিয়েছিলিস।তোকে আমি কখনোই মাফ করবো না রিমঝিম!!

নিজের রুমের প্রতিটি জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে রিমঝিম।কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই রুমে।ছোট থেকে বড় হওয়া সবই তো এখানে আঁটকে আছে।রিমঝিম বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো।বিছানায় শুতেই পরম এক শান্তি অনুভব করলো।রিমঝিমের চোখের কার্ণিশ বেয়ে উপচে পানি পড়ছে।আগের প্রত্যেক টি স্মৃতি তার চোখে ভাসছে।এখনো সবকিছু আগের মতোই আছে।বাসার প্রতিটি মানুষও আগের মতো আছে।গাড়িতে বসা অব্দি ঠিক থাকলেও যতই বাসার সামনে আগাতে লাগলো ততই বুকের ঢিপঢিপ আওয়াজ যেনো বাড়তে লাগলো।বাসার সামনে আসতেই রিমঝিম ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।মেইনগেটের সামনে সাবাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাথাটা নিচু করে চোখ দুটো খিঁচিয়ে বন্ধ করে নিলো।বিরবির করে বলেছিলো,আমি যেতে চাই না!কারোর সামনে পড়তে চাই না।তখন আবির এসে রিমঝিমের মাথায় টোকা দিয়ে বলেছিলো,তোর কারোর সামনে পড়তে হবে না যার কথা বলছিস সে এখন অফিসে আছে।নির্দ্বিধায় বাসায় যেতে পারবি।আবিরের কথা শুনে রিমঝিমের মুখ দিয়ে হুট করেই বেরিয়ে এসেছিলো,রক্তিম ভাই অফিস জয়েন করেছেন।ভার্সিটি পঁড়ুয়া ছেলেটা তাহলে বড় হয়ে গিয়েছে।কথাটা শেষ হতে না হতেই আবির গলা ফাটিয়ে হেসে উঠেছিলো!আর রিমঝিম আমতাআমতা করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলো।একটু আগের ঘটনা গুলো ভাবতেই রিমঝিম চোখ বন্ধ করে আলতো হাসলো।চোখ দুটো ব্যথা করছে অনেক।আজকে,সবাই মিলে অনেক কেঁদেছে।বিশেষ করে দাদির কান্না তাকে অনেকটা দূর্বল করে দিয়েছে।বুক অবধি কাঁথা টা টেনে নিলো।বুকের ঢিপঢিপানি এখনো কমে নি।রিমঝিম নিজেই যেনো সেই ঢিপঢিপ আওয়াজ টা শুনতে পাচ্ছে।হাত দুটো মুঠো করে জোরে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,রক্তিম নামের কাউকে তুই চিনিস না।দূষিত বস্তু ভেবে সবসময় এঁড়িয়ে চলবি।সেই সাথে,তোকে অনেক শক্তও থাকতে হবে রিমঝিম।দূর্বল হলে চলবে না।

বাসায় আসতে আসতে রক্তিমের প্রায় বারোটা বেজে গিয়েছে।কলিং বেল চাপ দিতেই তার কিছুক্ষণ পর বাবু এসে দরজা টা খোলে দিলো।বাবু,এসেছিলো জগে করে রুমে পানি নিয়ে যেতে।তনায়ার রাতে পানি খাওয়ার অভ্যাস আছে।একটু আগেই কেঁদেকেটে ঘুমিয়েছে।বাবু,তো আগে থেকেই জানতো তনায়া রিমঝিমকে সামনে দেখে কাঁদবে।দরজার সামনে রক্তিম বাবুকে দেখে বললো,
‘কখন এলি বাসায়?তনায়া কি ঠিক আছে বাবু?খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতো করে তো?’
‘আজকে,সন্ধ্যায় এসেছি।তনায়া এখন ঘুমিয়ে আছে।’
‘সবাই কি ঘুমিয়ে গেছে?’
‘হ্যাঁ!কিছুক্ষণ আগেই ঘুমিয়েছে।সবাই খুব ক্লান্ত!’
রক্তিম বাবুর দিকে তাকিয়ে বললো,
‘কি এমন করেছে যার জন্য সবাই একদম ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলো।’
বাবু ঠোঁট বেঁকিয়ে বললো,
‘তা বড়দের কাছ থেকেই জেনে নিস।আমি বলে সময় নষ্ট করতে পারবো না।পোঁয়াতি বউ টা আমার একা শুয়ে আছে।আমি গেলাম রক্তিম।’
রক্তিম ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে তাকালো বাবুর দিকে।সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেলো নিজের রুমের দিকে।লম্বা করিডোর দিয়ে হাঁটছে আর ধীর গলায় বলছে,সবাই খুব অদ্ভুত প্রকৃতির।বাবুটাও দিনদিন কেমন হয়ে যাচ্ছে।ইনিয়েবিনিয়ে দুনিয়ার রস মিশানো সব কথা বলে দিবে,অথচ মেইন পয়েন্ট টাই স্কিপ করে যাবে।হাদারাম একটা!

সকালে পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজে রিমঝিমের ঘুমটা ভেঙে গেলো।পর্দার আঁড়াল ভেদ করে হালকা আলো রুমের ভিতর জায়গা করে নিলো।রিমঝিম আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ট্রাউজার আর একটা টি-শার্ট পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল গুলোকে উপরে বেঁধে নিলো।মেইনগেইট পেরিয়ে পিচঢালা রাস্তার মধ্যিখান দিয়ে আপনমনে হাঁটতে লাগলো।রিমঝিমের কাছে সবকিছুই আগের মতো লাগছে।সকালের মিষ্টি ফুরফুরে বাতাসে তার কষ্ট কিছুটা কমে আসলো।রাশিয়ায় ঠান্ডার কারণে সকালে জগিং করতে তেমন একটা বের হতো না।বের হলেও,শীতের অনেক গুলো পোশাক পরে বের হতে হতো।রিমঝিমের কাছে এগুলো পড়তে খুবই বিরক্তি লাগতো।যারকারণে,প্রায় সময় বেরই হতো না।কিন্তু,বাংলাদেশে এসে রিমঝিম মনে মনে ভেবে নিয়েছে যতদিন থাকবে ততদিনই সকালে জগিং করতে বের হবে।রাশিয়ায় গিয়ে নতুন অনেক কিছুরই অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।রিমঝিম কিছুটা দৌড়ে হাঁপিয়ে উঠলো।সামনেই বাচ্চাদের একটা পার্ক পড়ে।সেখানে গিয়ে দোলনায় বসে পড়লো।মুচকি হেসে আকাশ পানে তাকিয়ে রইলো।ঠিক সেই সময়ে এক ঝাঁক পাখি উড়ে গেলো।রিমঝিম ভেবে নিয়েছে এখানে কিছুটা সময় অতিবাহিত করে পুনরায় আরেকদফা দফা দৌড়ে বাসায় চলে যাবে।

রক্তিম নিচে নেমে দেখলো লিভিং রুম একদম ফাঁকা হয়ে আছে।আবিরের খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো বাসায় নেই।কিছু কিনার জন্য বাজারে গিয়েছে।রক্তিম লিভিং রুমে এসে চুপচাপ বসে রইলো।জাহানারা আহমেদ রান্নাঘরের প্রয়োজনীয় কাজ গুলো সেরে ফেলছেন।রক্তিম রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে বললো,
‘মা!আমাকে খাবার দাও।কাল রাতেও কিছু খাওয়া হয় নি।প্রচুর খিদে লেগেছে।’

জাহানারা আহমেদ মাংসের বাটিটা নিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন।রক্তিমকে বসতে বলে প্লেটে পরোটা দিতে লাগলেন।রক্তিম ফোন টিপে টিপে চেয়ার টেনে বসে পড়লো।জাহানারা আহমেদ রক্তিমের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘খেয়ে নে ঠিকমতো।’

রক্তিম এখনো ফোনে মগ্ন হয়ে আছে।জাহানারা আহমেদ এই ফাঁকে বারবার শুধু দরজার দিকে চাইছেন।রিমঝিমের আসার অপেক্ষায় আছেন।রক্তিম জাহানারা আহমেদ কে দরজার বাহিরে উঁকিঝুঁকি বাইতে দেখে বললো,
‘বাবার আসার জন্য অপেক্ষা করছো মা?’
জাহানারা আহমেদ অন্যমনস্ক হয়ে বলে উঠলেন,
‘আরে না!আমি তো ইয়ের জন্য অপেক্ষা করছি।মেয়েটা যে কখন গেলো এখনো তো আসছে না?’
রক্তিম খাওয়া থামিয়ে দিয়েছে।মা’র কথার আগামাথা কিছুই বোধগম্য হলো না তার।অবাক কণ্ঠে বললো,
‘কোন মেয়ে মা?কার আসার জন্য অপেক্ষা করছো?’

রক্তিমের গলা শুনে থতমত খেয়ে গেলেন জাহানারা আহমেদ।নিজে যখন বুঝতে পেরেছেন কি বলতে গিয়ে কি বলে দিতে চেয়েছিলেন তখনি নিজেকে নিজেই কয়েকশো বকা দিয়ে শান্ত হলেন।রক্তিমের প্লেটে মাংসের কয়েক টুকরো দিয়ে বললো,
‘আজকে কি অফিসে যাবি রক্তিম?’
‘যাবো।তবে একটু পর।’
‘একটু পরটা কখন?’
‘এইতো দশটার পরে।কেনো বলোতো?’
জাহানারা আহমেদ বিশ্বজয়ের হাসি হাসলেন।রক্তিমের থুঁতনী ধরে শব্দ করে চুমু খেয়ে বললেন,
‘কিছু না রক্তিম।এমনেই জিজ্ঞেস করেছি আর কি।’

রক্তিমি কিছু বললো না।শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো মা’র দিকে।মাঝেমধ্যে যে তার মা’র কি হয় তা রক্তিম নিজেও বুঝতে পারে না।তবে,অন্যদিনের তুলনায় রক্তিম আজকে মা’কে হাসিমুখে দেখছে।যাক,মা’কে এতোদিন পর মনখোলে হাসতে তো দেখেছে এটাই অনেক।

দৌড়ানোর ফলে রিমঝিমের শরীর ঘেমে একাকার হয়ে আছে।টি-শার্ট টা লেপ্টে বুকের সাথে লেগে আছে।গলা বেয়ে ঘাম পড়ছে।রিমঝিম টি-শার্ট টা ঝাড়তে ঝাড়তে মেইন দরজা পেরিয়ে বাসার ভিতর ঢুকে গেলো।মাথা নিচু করেই জাহানারা আহমেদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো,
‘বড়’মা!ঠান্ডা পানি হবে।খুব পিপাসা পেয়েছে।’

রক্তিম পানি খাচ্ছিলো।নিস্তব্ধ পরিবেশে চেনা-পরিচিত সুমধুর কণ্ঠটা শোনে সামনে তাকালো।সামনে তাকিয়ে নিজের সামনে রিমঝিমিকে দেখে বড়সড় একটা বিষম গেলো।হাত থেকে টুপ করে গ্লাস টা নিচে ধপাস করে পড়ে ভেঙে গেলো।ভাঙার শব্দ পেয়ে রিমঝিম দ্রুত মাথা তোলে তাকালো।সামনে রক্তিমকে দেখে কয়েকপা পিছিয়ে গেলো।রক্তিমকে এইখানে একদন্ডও আশা করে নি।রিমির মুখে শুনেছিলো,রক্তিম অফিসে আছে।রাতে আসবে না হয়তো।কিন্তু,এখন তার উল্টো হলো।রিমঝিম মুখ-চোখ কঠিন করে নিলো।রক্তিমের থেকে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।অন্যদিকে,রক্তিম এখনো একটা ঘোরের মধ্যে আছে।তার বিশ্বাসই হচ্ছে না সামনে রিমঝিম দাঁড়িয়ে আছে।স্বপ্ন ভাবতে গিয়েও পারলো না।কারণ,স্বপ্নের রিমঝিমের সাথে এই রিমঝিমের কোনো মিল নেই।এই রিমঝিমের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে।আগের থেকে লম্বাও হয়েছে।রক্তিম রিমঝিমকে উপর থেকে নিচ অব্দি স্ক্যান করে নিলো।পরমুহূর্তেই বারকয়েক শুকনো ঢোক গিললো।জাহানারা আহমেদ মনে মনে অনেক খুশি হলেন।এটাই তো চাচ্ছিলেন!রিমঝিম আর রক্তিম যেনো আবারও সামনাসামনি হয়।আর,সেটাই হলো।কিন্তু,রক্তিমের চাহনি দেখে জাহানারা আহমেদ মিনমিনে গলায় বললেন,ছেলেটা আমার কীভাবে তাকিয়ে আছে।মনে হচ্ছে এখনি রিমঝিমকে গিলে খাবে।পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য জাহানারা আহমেদ গলা কেশে রিমঝিমের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘তুই এসেছিস রিমঝিম।বস!আমি তোকে পানি দিচ্ছি।’
রিমঝিম আশপাশ না তাকিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো।ফ্রিজ থেকে একটা আপেল নিয়ে কাঁমড় বসালো।জাহানার আহমেদের থেকে পানি খেয়ে নিয়ে বললো,
‘মা,বাবা কোথায় বড়’মা?’
‘মা’র রুমে বসে আছে।গল্প করছে।কাল সন্ধ্যায় আসার পর তো তেমন একটা কথা হয় নি।তাই,সকাল থেকেই গল্প করছে।’
‘ঠিকাছে বড়’মা।আমিও রুমে গেলাম।’
রিমঝিম দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে আসলো।রক্তিম এতোক্ষণ শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো।রিমঝিমের ইগনোর তার মোটেও সহ্য হয় নি।রক্তিমের এবার মাথায় কাজ করলো,কেন তার বাবা কালকে তাকে বাসায় আসতে দেয় নি।হঠাৎ করেই রক্তিমের খুব খারাপ লাগলো।রিমঝিমের আসার খবর কেউ-ই তাকে দেয় নি সেইটা ভেবে।রক্তিম না খেয়ে উঠে পড়লো।জাহানারা আহমেদ তা দেখে বললেন,
‘কোথায় যাচ্ছিস না খেয়ে?’
‘দাদির ঘরে যাচ্ছি।ছোটবাবা আর ছোটমা’র সাথে দেখা করতে।আমাকে তো একটিবারও বললে না তোমরা ছোটবাবা আর ছোটমা এসেছে।’
‘বললে কি হতো?কি করতিস তুই?যা করার তো আগেই করে দেখিয়েছিস।আমি সব জানি রক্তিম।রিমঝিমের কান্নার আওয়াজ আমিও শুনেছি।’
রক্তিম মাথা নিচু করে সেখান থেকে চলে আসলো।তার কিছুই ভালো লাগছে না।জাহানারা আহমেদ রক্তিমের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।
🍁🍂
বিছানায় হেলান দিয়ে ফোনে গেমস খেলছে আবির।রক্তিম থমথমে পা’য়ে আবিরের রুমে ঢুকে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো।আবির গেমস খেলার ফাঁকে একপলক তাকালো রক্তিমের দিকে।দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
‘কিরে!এই অবেলায় আমার রুমে!কি দরকারে এসেছিস।’
রক্তিম জোর গলায় বললো,’ফোনটা রেখে আমার কথার উত্তর দে আবির।’আবির তাও ফোনে ব্যস্ত হয়ে আছে।রক্তিম তাকে কি বলতে এসেছে তা তার অজানা নয়।টপিক্স যে রিমঝিমকে নিয়ে তা আবির রক্তিম আসার সাথেসাথেই টের পেয়েছে।রক্তিম তেড়ে এসে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বললো,’ছোটবাবা যে আসলো আমাকে একবারও বললি না কেনো?মা’র মুখে শুনলাম কাল রাতে নাকি এসেছে।’আবির লম্বা একটা হাই তুললো।মাথা নাড়িয়ে বললো,’বড়মা ঠিকই বলেছে!কাল রাতেই এসেছে ছোটবাবা,ছোটমা আর রিমঝিম।রিমঝিম বলার সময় ইচ্ছে করেই একটু টেনে বলেছে।রক্তিম ধপাস করে বসে পড়লো আবিরের পাশে।রিমঝিমকে দেখার পর থেকেই তার বুকে তোলপাড় বয়ে যাচ্ছে।হাতগুলো শুধু কিলবিল করছে রিমঝিমকে বুকে টেনে নেওয়ার জন্য।কিন্তু,রক্তিম তা কখনোই করবে না।তার কারণ একটাই!রিমঝিম সেদিন তাকে রিজেক্ট করেছে।ওইদিন যদি রিমঝিম তাকে ফিরিয়ে না দিতো তাহলে আজকে সবকিছু অন্যরকম থাকতো।তারা দু’জনেই একসাথে থাকতো।তাদের জীবন থেকে দুটো বছর নষ্ট হয়ে যেতো না।সেইদিক দিয়ে দেখতে গেলে তারও মনে ক্ষত কম না।কিন্তু,এই ক্ষত কতোদিন পর্যন্ত মনে ধরে রাখতে পারবে তা নিয়ে খুব চিন্তিত।কারণ,রিমঝিমকে দেখলেই তার সবকিছু উলোটপালোট হয়ে যাচ্ছে।আবির রক্তিমকে কিছু একটা ভাবতে দেখে তুড়ি বাজিয়ে বললো,’এতো ভেবে কি হবে আর।চল ছাঁদ থেকে ঘুরে আসি।বিশাল আড্ডা জমেছে।’

ছাঁদের এককোনায় দাঁড়িয়ে রিমঝিম এহসানের সাথে ভিডিও কলে কথা বলছে।এহসান রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে রিমঝিমের দিকে।রিমঝিম এহসানের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘এইভাবে নাক ফোলাবি না এহসান।গন্ডার গন্ডার দেখা যায়।’

এহসান এবার অসহায় মুখ করে তাকিয়ে রিমঝিমকে বললো,
‘আমাকে একবারও বলে গেলি না বাংলাদেশে।যখন শুনেছি তুই রাশিয়াতে নেই তখন আমার কি হয়েছিলো তা একমাত্র আমিই জানি।’
রিমঝিমের খুব বিরক্তি লাগছে এহসানের কথা শুনে।কিন্তু বাহিরে প্রকাশ করছে না।একটু দূরে সবাই বসে হাসাহাসি করছে।তাদের হাসির আওয়াজ টা রিমঝিমের কানে এসে লাগছে।তনু কাল আসবে।তার এক’বছরের একটা ছেলে আছে।এহসান ডাকতেই রিমঝিম ফোনের স্ক্রিনে তাকালো।রিমঝিম ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই এহসান পরপর শব্দ করে কয়েকটা চুমু দিয়ে ফোনটা দ্রুত গতিতে কেটে দিলো।রিমঝিম নাক কুঁচকিয়ে উল্টো ঘুরে আড্ডার আসরে যেতে নিলেই চোখ পড়লো ছাঁদের দরজার দিকে।রক্তিম ঠায় হয়ে সেদিকে দাঁড়িয়ে আছে।রক্তিমকে দেখেও যেনো দেখলো না।হেলেদুলে চলে গেলো ছাঁদের ওই পাশটায়।রক্তিম রাগে হাত দুটো মুঠো করে নিলো।ছাঁদে আসতেই তার চোখ পড়লো রিমঝিমের উপর।রিমঝিমকে একটা ছেলের সাথে ভিডিও কলে কথা বলতে দেখে রাগে তার মাথা বিগড়ে গেলো।তার উপর লাস্টে চুমুও দিয়েছে।রক্তিম দাঁত কটমট করে সবার দিকে এগিয়ে গেলো।রিমঝিমের পাশটায় খালি হয়ে আছে।এতো কিছু না ভেবে সেদিকেই বসে পড়লো।নিজের পাশে রক্তিমকে বসতে দেখে রিমঝিম সটান করে উঠে দাঁড়ালো।ঝড়ের গতিতে সরে আসতেই রক্তিম নিজের নাকে কড়া একটা পারফিউমের গন্ধ পেলো।পাশে তাকিয়ে দেখলো রিমঝিম উঠে দাঁড়িয়ে গিয়েছে।রিমঝিম সবার উদ্দেশ্যে তাড়া দিয়ে বললো,’আমার যেতে হবে এখনি।একটা ইম্পর্ট্যান্ট কল করার ছিলো।তোমরা কন্টিনিউ করো।’রিমঝিম আর একমুহূর্তের জন্যও দাঁড়ালো না।দৌড়ে চলে আসলো নিচে।রিমঝিম চলে আসতেই রিমি মুখটাকে ভোঁতা করে বললো,’রিমঝিম টা কেমন পাল্টে গিয়েছে।আগের রিমঝিমের সাথে এখনের রিমঝিমের অনেক তফাৎ।’
কিন্তু,রক্তিম ভাবনায় পড়ে গেলো।রিমঝিম কার সাথে কথা বলতে গিয়েছে তাই ভাবছে।পরমুহূর্তেই চোখ,মুখ অন্ধকার করে বলে উঠলো,
‘তোদের রিমঝিম নতুন কাউকে পেয়েছে।দেখলি না কথা বলার জন্য দৌড়ে চলে গেলো।কার সাথে এতো কথা বলার আছে?কই একবারো তো আমার সাথে কথা বললো না।’
রক্তিম কথাটা বলেই যেনো বিপদে পড়ে গেলো।সবাই তার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে।

চলবে..
[রিচেক করা হয় নি।ভুল থাকতে পারে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here