জলপদ্ম পর্ব -৩৬

#জলপদ্ম
#কুরআতুল_আয়েন

|৩৬|
রাতের নিস্তব্ধতা যেনো আবিরের মনে মিশে একাকার হয়ে আছে।সাদা টাইলস যুক্ত ফ্লোরটায় পা গুলো গুটিয়ে বসে আছে।সামনেই শিলার হাজারো রকমের ছবি পড়ে আছে।কিছু ছবি মুচকি হাসির আবার কিছু ছবি রাগান্বিত মুখশ্রীর।আবির এক এক করে ছবিগুলোতে হাত বুলিয়ে দেখছে।সময় করে শিলার অগোচরে এইরকম হাজারো ছবি ক্যাপচার করে নিয়েছিলো।আর,কিছু ছবি রক্তিমের ফোন থেকে জোগাড় করেছে।এখন বসে বসে সেই ছবিগুলোকে এলবামে আবদ্ধ করবে।ভেবেছিলো,এই এলবাম টা গিফট করে শিলাকে নিজের মনের কথা জানাবে,নিজের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে।অথচ,আজকে তার উল্টো কিছু ভাবতে হচ্ছে।এই যে,সামনে সপ্তাহেই শিলার আকদ হবে।শিলার উডবি হাসবেন্ড কানাডায় স্যাটেল।পড়াশোনার সূত্রে কানাডায় গিয়েছিলো।বিয়ের পর শিলাকেও নিয়ে চলে যাবে।রক্তিমের অসুস্থতা শুনে সবাই এসেছিলো।তখনি শিলা তার নিজের বিয়ের খবর টাও সবাইকে জানিয়েছে।শিলার বিয়ের কথা শুনে বন্ধুমহলের সবাই কিছুক্ষণ অবাক হয়ে থাকলেও পরে ঠিকই খুশি হয়েছে।তবে,আবিরের মনে অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করেছে।মনে হচ্ছে,তার হৃদপিন্ডে কেউ ছুরি দিয়ে সজোরে আঘাত করছে।শ্বাস-প্রশ্বাস আঁটকে আসছিলো বারংবার।তবুও হাসিমুখে শিলাকে অভিনন্দন জানিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলো।তারপর থেকেই নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছে।রক্তিম অনেকবার ডেকেও ব্যর্থ হয়ে চলে যেতে হয়েছে।রিমঝিমও অনেকবার চেষ্টা করেছে কিন্তু কিছুই করতে পারলো না।শিলার একেকটা ছবি দেখে বিরবির করে হাজারো কথা বলে যাচ্ছে আবির।চোখের কোণে পানি জমে আছে তবুও ঠোঁটে হাসি বিদ্যমান।শিলার আকদের দিন এই এলবাম টা গিফট করবে।এলবাম টা সুন্দর করে গুছিয়ে সাইড বক্সের উপর রেখে দিলো।সেদিকেই কতক্ষণ চেয়ে থেকে বললো,

‘ভালোবাসা এমনই হওয়া উচিত।দূরে গেলেও যত্ন করতে হয়,আর কাছে থাকলেও যত্ন করতে হয়।না হলে,সম্পর্ক তে ফাটল ধরতে বেশিক্ষণ সময় লাগবে না।তুমি দূরে গেলেও আমি তোমার যত্ন মনে মনে করে নিবো।তবে এতে একটা বেদনা থেকে যাবে,তুমি আমার ধরা ছোঁয়ার অনেকটা দূরে চলে যাবে।মনের অনুভূতি আর প্রকাশ করা হলো না।মনেই থেকে গেলো।অবশ্য না করে ভালোই হলো,তার কারণ তুমি হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছো শিলা,আমি তোমাকে ভালোবাসি।এতেই আমি তোমার দু’চোখের উঁহুহু,চার চোখের বিষ!আর প্রকাশ করলে হয়তো ফোঁসফোঁস করে উঠতে।তাও,তো তোমার নাক ফুলানো টা একটিবারের জন্য হলেও দেখতে পেতাম।ভালো থেকো তুমি শিলা!তবে,তোমার প্রতি আমার একটাই অভিযোগ তুমি এই হাসি উজ্জ্বল ছেলেটাকে বিষিয়ে তুলেছো।এই ছেলেটার মুখে হয়তো সহজে হাসি ফুটবে না।আর,ফুটলেও ভেবে নিবে সেই হাসিতে নেই কোনো প্রাণ।খুব কি দরকার ছিলো এই ক্ষণিকের জন্য আসার!!’
🍁🍂
দেখতে দেখতে এক সপ্তাহর মতো কেটে গিয়েছে।আজ বিকালে শিলার আকদ।আবির পেট ভরে খেয়ে ঢেঁকুর তুললো।নিজের রুমে এসে অনেক উলোটপালোট করে সুন্দর সাদা শুভ্র রঙের একটা পাঞ্জাবী বেছে নিয়ে পড়ে নিলো।চুল গুলো জেল দিয়ে পরিপাটি করে নিজেকে আরেকবার আয়নায় দেখে নিলো।গলায় গুনগুন গানের আওয়াজ তোলে হাতে এলবাম টা নিয়ে বেরিয়ে আসলো।রিমঝিম,রিমিও ততক্ষণে তৈরি হয়ে পড়েছে।রক্তিম রুমে আছে,পাঞ্জাবীর বোতাম লাগাচ্ছে।কালকে আবার কেমোথেরাপির জন্য হাসপাতালে যেতে হবে।রিমঝিমের খুব গরম লাগছে,এক শাড়ি পড়েছে তার উপর পেট টাও কিছুটা উঁচু লাগছে।হাতে ফোনটা নিয়ে সিঁড় দিয়ে নামার সময় চোখ গেলো রক্তিমের দিকে।রক্তিম রুম থেকে বেরিয়েছে।কি সুন্দর লাগছে পাঞ্জাবীতে।কিন্তু মুখটাকে গোমড়া করে রাখায় রিমঝিমের মুখটা কালো হয়ে গেলো।তবুও,তা বাহিরে প্রকাশ করলো না।নিজেকে শক্ত করে নিলো রক্তিমের জন্য।রক্তিমের সামনে যে করেই হোক শক্ত থাকতে হবে।রক্তিম রিমঝিমকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে কিছুই বললো না।পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই রিমঝিম রক্তিমের হাত টা আঁকড়ে ধরে নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে নিলো।রক্তিমের কাঁধ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো,
‘আমাকে কেমন লাগছে রক্তিম ভাই।’

রক্তিম একপলক তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিতে গেলেই ব্যর্থ হলো।এখন যেনো চোখের পলকেই পড়ছে না।রিমঝিম চোখ টিপ্পনী দিয়ে বললো,
‘কি মিষ্টার!আঁটকে গেলো তো চোখ।জানতাম আমি।’

রক্তিম হঠাৎ চুপ থেকে বলে উঠলো,
‘আমি কি বাঁচবো রিমঝিম।তোর কাছে আবার সুস্থভাবে ফিরে আসতে পারবো।আমার সন্তানকে কোলে নিতে পারবো!বাবা ডাক শুনতে পাবো!জানিস রিমঝিম,এই চুল আমার কাছে একটা সময় খুব স্টাইলের ছিলো আর আজকে মাথায় হাত দিতেই একগাছি চুল চলে এসেছে।খেয়াল করলে দেখিস তো আমার ভ্রুজোড়াও কেমন নেতিয়ে পড়ছে।ভ্রুজোড়া গুলো নিজেদের মতো পড়ে যাচ্ছে।আয়নায় নিজেকে দেখলে খুব ভয় হয়।এখন তো চিনতেই বেগ পেতে হচ্ছে।’

রিমঝিমের চোখ দুটো টলমল করছে।রক্তিমের এই পরিবর্তন গুলো তারও চোখে পড়েছে।তবে,রক্তিম কষ্ট পাবে বলে বাহিরে তা প্রকাশ করে নি।নিজের মনের মধ্যেই রেখে দিতো।কিন্তু,আজ রক্তিমের মুখে এইসব কথা শুনে রিমঝিম নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলো না।উপায় না পেয়ে এখন শব্দ করে কেঁদে উঠলো।রক্তিম তা দেখে মুচকি হেসে বললো,
‘এইজন্যই বলেছিলাম আমাকে ছেড়ে চলে যা।তোর কান্না আমি সহ্য করতে পারবো না।আর,তাই আমিও চাই না আমার এই রঙিনহীন জীবনের সাথে তোর জীবনটাও মিশে যাক।’

রিমঝিম চোখের পানিটা মুছে নিয়ে কটমট চাহনিতে তাকালো রক্তিমের দিকে।এমতাবস্থায় বললো,
‘এইসব কথা ভুলেও আর মাথায় আনবেন না রক্তিম ভাই।আমি শুধুই আপনার কাছে থাকবো।আমাকে আর দূরে যাওয়ার কথা বলবেন না!!এই কথাটা মাথায় রাখবেন!’

রক্তিমের মুখের উপর এই কথাগুলো বলে রিমঝিম গটগট করে বেরিয়ে আসলো।এখানে থাকা মানে আরো ইমোশনাল হয়ে যাওয়া।আর এখন ইমোশনাল হয়ে কেঁদেকেটে চোখের কাজল লেপ্টাতে চায় না।কাজল লেপ্টে গেলেই সর্বনাশ।তোলার কোনো স্কোপই থাকে না।আর,তুলতে গেলেই বিশ্রী কান্ড লেগে যায়।তার থেকে এখান থেকে চলে আসাই শ্রেয় মনে করেছে রিমঝিম।

সুন্দর লাল একটা বেনারসি পড়ে সোফার এককোনায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে শিলা।মুখে হাসি ঝুলে আছে।পরিবারের খুশিতেই নিজে খুশি।পাশেই বসে আছে নাফি।তারও মুখে হাসি বিদ্যমান।দূর থেকে আবির এইসব লক্ষ্য করছে।শিলার মুখের হাসি দেখে আবির বিরবির করে বলতে লাগলো,
‘তুই ভুল ছিলি আবির,শিলা তোকে কখনো ভালোবাসতো না।আর,না থাকতো মুখে এই হাসির খেল।’

আবিরের বিরবির করে বলা কথাগুলো রক্তিম ঠিকই খেয়াল করছে।আবিরের কাঁধে হাত রেখে বললো,
‘আমি ভাবি নি তুই এতো টা সিরিয়াস হয়ে যাবি শিলার জন্য।আর,শিলার যে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তা আমিও জানতাম না।’

‘তোর চশমিশ বান্ধুবী কিন্তু জব্বর সারপ্রাইজ দেখিয়েছে আমাদের।’

‘আমার থেকে তোর দুঃখ,কষ্ট আঁড়াল করতে পারবি না আবির।আমি বুঝি তোকে!আর,তোর যে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে অসহ্য রকমের কষ্ট হচ্ছে তাও জানি।’

‘ভালোবাসা হারানোর কষ্টে এতো যন্ত্রণা অনুভব করতে হয় কেনো রক্তিম।’

রক্তিম নিষ্পলক চেয়ে রইলো আবিরের দিকে।হাসি উজ্জ্বল চেহারা টা বিষন্ন হয়ে আছে।জোর করে হাসার চেষ্টা চালাচ্ছে,কিন্তু চেহারায় দুঃখ,কষ্ট স্পষ্ট বিদ্যমান।আবির ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।রক্তিমের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আমার এখন খুব কষ্ট হচ্ছে রক্তিম।নিজের চোখের সামনে এসব আমি কিছুতেই নিতে পারছি না।’

রক্তিম আবিরকে নিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় চলে গেলো।নিস্তব্ধ পরিবেশ পেতেই আবির রক্তিমকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।ভিতরের অসহ্য যন্ত্রণা গুলো একসাথে দলা পাঁকিয়ে কান্নাতে পরিণত হচ্ছে।রক্তিম চুপ করে আবিরকে নিজের সাথে চেপে ধরে রেখেছে।তারও খুব কষ্ট হচ্ছে।

বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে রক্তিম।রিমঝিম ঢিলেঢালা একটা জামা পড়ে রক্তিমের পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।রক্তিম আবেশে চোখ বন্ধ করে নিয়ে রিমঝিমকে জড়িয়ে ধরলো।রিমঝিমের বুকে মুখ গুঁজে রয়েছে।এমতাবস্থায় বললো,
‘আমি কি সুস্থ হবো রিমঝিম।’

‘রক্তিম ভাই প্লিজ আপনি এইভাবে বলবেন না।আপনার আমাদের জন্য হলেও সুস্থ হতে হবে।’

‘খুব ভয় হয় আমার রিমঝিম।’

‘উফফ!রক্তিম ভাই আমি এইসব কথা শুনতে চাই না আর।চলুন না একটু বারান্দায় যাই।আজকে আকাশে চাঁদ টা অন্যরকম লাগছে।’

রক্তিম রিমঝিমকে হঠাৎ করে কোলে তোলে নিলো।বারান্দার গিয়ে চেয়ারে বসে বাহিরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলো।রিমঝিমও রক্তিমের বুকে ঠেস দিয়ে আছে।অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করছে দু’জনের মধ্যে।তবে,রক্তিমের মনে চিন্তা আর ভয় ক্রমশই হানা দিচ্ছে।বারংবার মনে হচ্ছে,ক্যান্সার তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিচ্ছে।খুব শীঘ্রই প্রিয়জনদের ছেড়ে চলে যেতে হবে।

ওয়াশরুমের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শিলা।আকদের শাড়িটা এখনো গায়ে জড়ানো।রুমের ভিতর নাফি বসে আছে।শিলার জন্য ওয়েট করছে।কিন্তু শিলা অনেকক্ষণ যাবত ধরে ওয়াশরুমে দাঁড়িয়ে আছে।শুধু তাই নয়,আবিরের দেওয়া সেই এলবাম টা বুকে জড়িয়ে রেখেছে।না চাইতেও এলবাম টা আজকে তার বুকে জায়গা করে নিলো।চোখ দিয়ে আপনাআপনি পানি পড়েই যাচ্ছে।শিলার চোখে ভাসছে আবিরের সেই বিষন্ন মুখটা।আবির যখন এলবাম টা দিতে এসেছিলো তখন বুকের ভিতর টা হঠাৎ করেই হাহাকার করে উঠলো।না চাইতেও শিলার এখন খুব কষ্ট হচ্ছে আবিরের জন্য।দরজার বাহিরে নাফি আঘাত করতেই শিলা কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো।তাড়াহুড়ো করে চোখ দুটো মুছে নিয়ে গলাটা ঠিক করে বললো,
‘আমার একটু দেরি হবে আসতে,তুমি শুয়ে পড়তে পড়ো নাফি।’

নাফি জোর গলায় হেসে বললো,
‘আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য শিলা।তোমার দেরি হলেও আমার কোনো সমস্যা নেই।’

নাফির কথা শুনে শিলা বিষাদে চোখ,মুখ কুঁচকে নিলো।অসহ্য লাগছে সবকিছু তার।ঝড়না টা ছেড়ে দিয়ে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠলো।

অন্যদিকে,আবির নিকোটিনের ধোঁয়ায় নিজের কষ্টগুলোকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।শিলাকে মুছে ফেলার এই এক পদ্ধতি বেছে নিয়েছে।আজকের দিনটা ভুলে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।

চলবে..
[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here