জলপদ্ম পর্ব -৩৭

#জলপদ্ম
#কুরআতুল_আয়েন

|৩৮|
সবকিছু ব্যবস্থা করতে করতে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে।রক্তিমের শরীরও যেনো দিনদিন অবনতির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।আপাতত হাসপাতাল থেকে এখন বাসায় আনা হয়েছে।রিমঝিমের শরীরও তেমন একটা সুবিধার না।মন,শরীর দুটোর দিক দিয়েই খুব দূর্বল।তার উপর দিনগুলো যেনো কাটতেই চায় না।সিঁড়ি বেয়ে ধীর গতিতে নেমে আসলো রিমঝিম।রক্তিম ঘুমিয়ে আছে।গন্তব্য রান্নাঘর।রক্তিমের জন্য নিজে হাতে পছন্দের খাবার গুলো রাঁধবে।তনায়াও আসছে।একটু আগে ফোন দিয়ে জানিয়েছে।তনায়ার মেয়েটা আগের থেকে অনেকটাই বড় হয়েছে।রান্নাঘরে আওয়াজ পেয়ে জাহানারা আহমেদ ছুটে আসলেন।রিমঝিমকে রান্নাঘরে দেখে কড়া গলায় বললেন,
‘এইসব আমি করে নিতে পারবো রিমঝিম।তুই রক্তিমের কাছে যা।’

‘বড়মা!রক্তিম ভাই ঘুমোচ্ছেন।আমি আজকে রক্তিম ভাইয়ের প্রিয় খাবার গুলো বানাতে চাই।’

‘তোকে একা এইভাবে কাজ করতে দেওয়া যাবে না।আমিও সাহায্য করছি।’

রিমঝিম না করতে গিয়েও করলো না।এই শরীর নিয়ে একা হাতে এতো কিছু করা সম্ভব না।জাহানারা আহমেদের সাহায্যে রিমঝিম রক্তিমের জন্য এক এক করে সবগুলো খাবারই রান্না করলো।আগুনের তাপে মুখটা লাল হয়ে আছে।ঢিলেঢালা জামাটা ঘামের তাড়নায় শরীরের সাথে লেপ্টে আছে।জাহানারা আহমেদ রিমঝিমকে একপ্রকার জোর করে রুমে পাঠিয়ে দিলেন।অনেকটা সময় নিয়ে এখানে ছিলো,,এবার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন।রিমঝিম কথা মতো রুমে চলে আসলো।রুমে ঢুকে দরজাটা হালকা আওয়াজে লাগিয়ে দিলো,যাতে করে রক্তিমের ঘুম যেনো না ভাঙে।বিছানার মধ্যিখানটায় রক্তিম বাচ্চাদের মতো মুখ করে ঘুমিয়ে আছে।চুল,ভ্রু কিছু না থাকায় মুখটা কেমন পানসে হয়ে আছে।দেখতেই অন্যরকম লাগে।রিমঝিম মন খারাপ করে তাকালো রক্তিমের দিকে।মনে পড়ে গেলো রক্তিমের হাসপাতাল থেকে বাসায় আসার দিনের ঘটনাটা।আয়নায় নিজেকে এরূপ অবস্থায় দেখে রক্তিম নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না।দেয়ালে টাঙানো আগের সব গুলো ছবি বাহিরে ফেলে দিয়েছিলো।প্রত্যেক টা ছবি রক্তিম খুব শখ করে তুলেছিলো।আর,এখন সেই ছবিগুলো তার কাছে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।অবশ্য,রুমে এখন একটাও ছবি নেই শুধুমাত্র রিমঝিমের ছবিগুলো ছাড়া।রিমঝিমের ছবিগুলো রক্তিম নিজের হাতে শখ করে টাঙিয়েছে।ওইদিনের কথাগুলো ভাবতেই রিমঝিমের মন টা আরো খারাপ হয়ে গেলো।এমতাবস্থায় এগিয়ে গেলো আলমারির দিকে।সুতি কাপড়ের একটা জামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

গুনগুন গানের আওয়াজে রক্তিমের ঘুমটা ভেঙে গেলো।এপাশ ওপাশ করে দেখতে পেলো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রিমঝিম।চুল মুছছে আর গুনগুন গলায় গান গাইছে।মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো রক্তিম।অন্যরকম এক শুভ্রতা এসে ভীড় করেছে রিমঝিমের মাঝে।রক্তিম ধীর গতিতে উঠে দাঁড়ালো বিছানা ছেড়ে।রিমঝিমের নিকটে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ করে চোখ পড়ে গেলো আয়নায়।আয়নায় নিজেকে দেখে পুনরায় উল্টো ঘুরে বারান্দার দিকে চলে গেলো।বাহিরের রোদ টা যেনো ঝিলিক মারছে।চোখ মেলে তাকাতেই কষ্ট হচ্ছে।তবুও,কষ্ট করে হলেও রক্তিম চোখ দুটোকে হালকা খোলে তাকিয়ে রইলো বাহিরের ঝকঝকে পরিবেশ টার দিকে।

হাতাশার সুর টেনে রিমঝিম পিছন ফিরে তাকালো রক্তিমের দিকে।আয়নায় রক্তিমের প্রতিচ্ছবি এড়ায়নি।ইচ্ছেকরে না দেখার ভান করে ছিলো,ভেবেছিলো রক্তিম পিছন থেকে জড়িয়ে নিয়ে ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিবে।অথচ,তার কিছুই হলো না।রিমঝিম তোয়ালে টা রেখে দিয়ে বারান্দায় চলে গেলো।রক্তিমের ঘা ঘেঁষে দাঁড়ালো।রক্তিম বুঝেও তাকালো না।সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।রিমঝিম মুচকি হেসে রক্তিমের মুখটা দু’হাতের ভাঁজে নিতেই রক্তিম বাচ্চাদের মতো শব্দ করে কেঁদে উঠলো।হাঁটুগেঁড়ে বসে রিমঝিমকে জাপটে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো,
‘আমার সাথেই কেনো এমনটা হতে হল বল।আমি আগের মতো সবকিছু নিয়ে সুখী থাকতে চাই।আমার খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে।’

রিমঝিম এতোদিন রক্তিমের সামনে শক্ত থাকলেও আজকে পারলো না।ঝড়ের বেগে নিজেও কেঁদে উঠলো।কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি উঠার উপক্রম।তবুও কষ্ট করে বারান্দার ফ্লোর টায় বসলো।রক্তিমের হাতজোড় আঁকড়ে ধরে বললো,
‘আপনার কিছু হবে না রক্তিম ভাই।সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’

‘সবকিছু ফিঁকে আর মিথ্যে।আমার অনুভব হয়,এই বুঝি আমি সবকিছু ছেড়ে চলে যাচ্ছি।’

রিমঝিম আর কিছু বলার আগেই রক্তিম চলে গেলো।রক্তিমের কাছে রিমঝিমের একেকটা কথা মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না।রিমঝিম ছলছল চোখ নিয়ে রক্তিমের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।

হাতে একগাদা বই নিয়ে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে পড়লো আবির।এতোক্ষণ ধরে লাইব্রেরীতেই বসে ছিলো।কিন্তু,পাশের বাসার জোৎস্না আন্টির মেয়ের জন্য সুন্দর নিরিবিলি জায়গা টা থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছে।রাগে মাথা চড়ে আছে আবিরের।সবে মাত্র স্কুলে পড়ে।স্কুলের গন্ডি না পেরিয়েই কতো প্রেমের কথা।আসলে এখনকার বাচ্চারা বয়স টয়স দেখে না।যেই একটু টসটসে চেহারার ছেলে দেখবে,তাতেই হয়ে গেলো কাজ।তাকে যেভাবেই হোক পেতেই হবে!কথাগুলো বলে আবির খানিকটা সময় নিয়ে দম নিলো।লাইব্রেরীর সামনে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে।দুপুরের কড়া রোদ।মাথার তালুয় এসে পড়ছে।আবির একবার মাথায় হাত রেখে ছোট ছোট চোখ করে আকাশের দিকে তাকালো।এমতাবস্থায় সামনের দিকে হাঁটা ধরলো।কিছুটা দূর আগালেই সামনে বিশাল একটা মার্কেট পড়ে।ঠিক সেই জায়গা টা ক্রস করতেই অনাঙ্ক্ষিত কিছু একটা দেখে তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো আবির।শুধু তাই নয়,আবিরের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ টিও আবিরের মুখপানে তাকিয়ে আছে।আবির জোরেশোরে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো।কিন্তু কিছুটা দূরে গিয়ে পুনরায় তাকে থামতে হলো শিলার ডাকে।শিলা দৌড়েই গেলো আবিরের সামনে।আবিরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
‘কেমন আছেন আপনি?’

আবির তাচ্ছিল্যের হাসি টানলো ঠোঁটের কোণায়।কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,
‘এইটা বলার জন্য কি এইভাবে ডেকেছো তুমি শিলা।’

শিলা কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো।আমতা আমতা করে বললো,
‘না আসলে,হঠাৎ আপনাকে দেখেছি তো তাই আর কি।’

‘আমি ভালো আছি।খুব ভালো আছি।এমনকি বিন্দাসেই আছি।’

আবির শিলাকে পাত্তা না দিয়ে সামনের দিকে চলে আসতে নিলেই পুনরায় শিলা বলে উঠলো,
‘আমি কেমন আছি তা তো জিজ্ঞেস করলেন না আপনি।’

‘খারাপ তো দেখছি না।’

আবির গটগট পা’য়ে সামনে হাঁটতে লাগলো।শিলাকে দেখে মেজাজ টা আরো খারাপ হয়ে গিয়েছে।কিছুদূর আগানোর পর শুনতে পেলো শিলা জোর গলায় বলছে,
‘আমি ভালো নেই আবির।সত্যি বলছি আমি একদমই ভালো নেই।’

আবির উল্টো ঘুরে শিলাকে একবার ভালো করে পরোক্ষ করে নিলো।ততক্ষণে শিলাও আবিরের একদম নিকটে চলে এসেছে।আবিরের হাতজোড়া আকঁড়ে ধরে কেঁদে উঠলো।আবির আহাম্মকের মতো তাকিয়ে শুধু দেখছে।শিলা ক্রন্দনরত গলায় বলতে লাগলো,
‘আমি খুব ভুল করেছি আপনাকে কষ্ট দিয়ে।আমি তো ভেবেছিলাম,নাফি আমাকে অনেক ভালোবাসে,পরিবারের মানুষ জন গুলো আমার জন্য সঠিক মানুষ টাকেই বিবেচনা করেছে।আমার বড় বোন যখন পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে কয়েকদিনের মাথায় লাশ হয়ে ফিরেছিলো তখন আমার বয়স ছিলো পনেরো।আপার লাশ টা বিধস্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিলো জঙ্গলের ঝোঁপঝাড়ে।শরীরে কাপড় ছিলো না।শুধু তাই নয় সারা শরীরে অনেক আঘাতের দাগ ছিলো।একটা পনেরো-ষোলো বছরের মেয়ের বোঝার জ্ঞান ভালোই ছিলো।গভীর রাতে আপাকে খেয়াল করে দেখতাম,ফোনে কারোর সাথে ফিসিরফিসির করে কথা বলতে।এমনকি,মাঝরাতে নানান বাহানায় ছাঁদে গিয়ে ছাঁদের চিলেকোঠার ঘরটায় সারারাত কাটাতে।তখন এতোকিছু না বুঝলেও আপাকে মারার পর সবটা মাথায় আস্তে আস্তে ঢুকেছে।তখন থেকেই প্রেম,ভালোবাসা কথাটা শুনলেই আপার রক্তাক্ত মুখটা ভেসে উঠতো।পরিবার যেখানেই বিয়ে দিবে সেখানেই আমি হাসি-খুশি মুখ করে চলে যাবো।কয়েকদিন সবকিছু ভালো ছিলোও বটে,কিন্তু,বিদেশে যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম নাফি হাজারো মেয়ের সাথে লিপ্ত।মাঝরাতে আমারই বেডরুমে অন্য মেয়ে নিয়ে এসে মগ্ন হয়ে থেকেছে,এমনকি তা আমারই সামনে।প্রতিনিয়ত এইসব সহ্য করতে করতে আমি এখন হাঁপিয়ে গিয়েছি।’

আবির মায়াভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো শিলার দিকে।নাকটা লাল হয়ে আছে।দেখেই মনে হচ্ছে,কান্না আঁটকানোর বৃথা চেষ্টা করছে।অথচ,চোখের কার্ণিশ ভিঁজে উঠেছে।সব কিছু যদি মনের মতো হতো তাহলে এখন আর কারোরই চোখের পানি ফেলতে হতো না।তবে,বাস্তবতা হলো ওইটা,যেটা মানুষ চায় সেটা কখনোই পায় না।
________________________________________
দিনটি শুক্রবার!!সাদা পাঞ্জাবীতে সাত বছরের ছোট্ট বাচ্চা ছেলেটিকে যেনো অন্যরকম লাগছে।মাথায় টুপিটাও যেনো ভালো করে পড়ে নি।ঠিক তার সামনেই রয়েছে দুটো বড় ফ্রেমের ছবি।যেখানে আবদ্ধ হয়ে আছে দুটো মানুষ।যাদেরকে ছবিতেই ছোঁয়া যায়,বাস্তবে তাদের নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়।বাচ্চা ছেলেটি অনেকক্ষণ চুপ থেকে ডুকরে কেঁদে উঠলো।অবুঝ ছোট মনটায় কষ্টের দেখা পেলো।শুধু এতোটুকুই জানে তার বাবা মা তার থেকে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছে।দরজার সামনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে আবির।তারও চোখে পানি।মনে মনে বিরবির করে বলতে লাগলো,
‘কেনো চলে গেলি তোরা।তোদের ছাড়া আমরা কেউ ভালো নেই রক্তিম,রিমঝিম।’
আবির ধীর গতিতে এগিয়ে গেলো বাচ্চা ছেলেটির দিকে।দু’হাত দিয়ে আগলে নিলে।গালে চুমু খেয়ে বললো,
‘বাবাই তোমার কষ্ট হচ্ছে।’

বাচ্চা ছেলেটি আবিরের গলা জড়িয়ে ধরলো।বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে নিঃশব্দে রইলো।আবির আঁড়ালে চোখের পানি টুকু মুছে নিয়ে রক্তিম আর রিমঝিমের রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।করিডর দিয়ে হাঁটছে আর বলছে,
‘কি করলে আমার বাবার মনটা ভালো হবে?’

‘ছোট বাবাই আমি মা,বাবার কাছে যেতে চাই।’

আবির হাঁটা থামিয়ে দিলো।বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

‘ঠিকাছে আমি আজকে নিয়ে যাবো।’
——
দুটো কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আবির আর বাবাই।রক্তিম আর রিমঝিমের ভালোবাসার অংশ বাবাই।আবির আর বাবাই ঘাসে বসে পড়লো।ছোট্ট বাবাই আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ছোট বাবা!মা,বাবা কেনো আমাকে ছেড়ে চলে গেলো।কি হয়েছিলো তাদের।’

‘গল্পটা কি আজকেই শুনতে হবে?’

‘তুমি বলেছিলে,আমাকে মা,বাবার গল্প শুনাবে।আর এটাও,বলবে কেনো তারা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে।’

আবির দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করলো প্রায় কয়েক বছরের ঘটে যাওয়া সেই অনাঙ্ক্ষিত ঘটনা টা–

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here