#জোনাকিরা_জ্বলে_নিভে (পর্ব -৫)
#লেখিকা #রেহানা_পুতুল
নিরব পায়ে কাজলের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল শুভ্র। দুটো জোনাকিপোকা মুঠোবন্দী করলো।
কাজল ধরো। এই নাও।
আচমকা পুরুষ গলা শুনে কাজল ঘাবড়ে গেলো। ওমা! বলতেই পা পিছলে মাটির পাড় থেকে পড়ে যেতে লাগল। অমনি খপ করে শুভ্র কাজলকে হ্যাঁচকা টানে টেনে তুলল। অপ্রত্যাশিতভাবে শুভ্রের বুকের সাথে কাজল অনেকটাই আটকে গেল। আমি না ধরলেতো পড়েই যেতে।
আপনার জন্যইতো। বলে শুভ্রর বুক আর হাত থেকে নিজেকে আলগা করে নিল কাজল।
মানলাম আমার জন্য।
কাজলের হাতের মুঠোয় জোনাকিপোকা দুটো দিয়ে শুভ্র বলল,
সামান্য একটা পোকার প্রতি তোমার এত অনুরাগ? খুব পছন্দ করো না?
হুম। আপনার যেমন লুবনা আপুর প্রতি বিশেষ অনুরাগ। আচমকা মুখ ফসকে বেসামালভাবে কথাটি বলে কাজল গোপনে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো।
শুভ্র ও অপ্রস্তুত হয়ে গেল। কে বলল তোমাকে এই কথা?
কেন? যেদিন তুলে আনলেন আমাকে। গাড়ি থেকে নেমেইতো উরমি আপুর মুখে শুনলাম।
ওরে উরমিরে তোকে দেখিস কি করি রাত পোহালে। মনে মনে উচ্চারণ করলো শুভ্র।
ওটা ভুল শুনেছ কাজল। কারো প্রতিই আমার অনুরাগ নেই।
ওহ আচ্ছা। বলে কাজল জোনাকিপোকাগুলো নিয়ে ঘরের ভিতর চলে গেল।
নব মোহনীয় স্পর্শ পেয়ে শুভ্রর হৃদয় এক অজানা আবেশে তলিয়ে গেল। শুভ্র মাথা তুলে আকাশপানে একবার চাইল। কিছু তারা ছোটাছুটি করছে ইচ্ছেমতো। শুভ্র ভেবে পায়না আজকের তারাগুলো দেখতে হঠাৎ তার এত ভালো লাগছে কেন। আজকের এই তিমির, দূর হতে ভেসে আসা নিশাচর পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ, তাকে যেন কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।
নিজের মাথায় টোকা মেরেই শুভ্র ঘরে চলে এলো। দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। কল্পনার অথই সমুদ্রে ডুব দিল এক লহমায়।
এক সপ্তাহের ভিতরেই কাজল হোস্টেলে উঠে গেল। সবকিছুর ব্যবস্থা শুভ্র করে দিল। কাজলকে শুভ্র সবার অগোচরে একটি মোবাইল ফোন কিনে দিল। রোজ ফোন করে কাজলের খোঁজ খবর রাখছে শুভ্র। শুভ্র মনে মনে কাজলকে পছন্দ করে। কিন্তু কিছুতেই তা বুঝতে দিচ্ছেনা।
হোস্টেলে উঠার দুইদিন না যেতেই শুভ্র অনেক সুন্দর একটা কাজল কিনে উপহার দিল কাজলকে।
মুখের উপর হাসির আবরণ ছড়িয়ে বলল, কিছু মনে করোনা। মানুষের মন কত কি চায়। বুঝলে। কেন জানি তোমার কাজল টানা চোখ দুটো দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। আমি কাল বিকেলে আসব তোমার কাজল কালো দুটি নয়ন দর্শন করার জন্য।
শুভ্রের মুখে কথাটা শুনেই কাজলের সমস্ত অনুভূতি বিবশ হয়ে গেল। বুকের ভিতর কিছু একটা মোচড় দিয়ে উঠল কলার মোচার মতন।
পরের দিন শুভ্র হোস্টেলের পাশে গিয়ে কাজলকে ফোন দেয়। কাজল হেলেদুলে নেমে আসে রাশি রাশি সুখ সুখ রোমাঞ্চকর অনুভূতি নিয়ে।
কাজল লজ্জায় গুটিসুটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক ঝলক শুধু শুভ্রের চোখে চোখ রাখল। পরক্ষণেই দৃষ্টি নামিয়ে নিল। শুভ্র কাজলের চিবুক ধরে আরেকবার চোখের দিকে চাইল। বলল আমার এ চোখ দুটোর দৃষ্টি আজ মনে হয় সার্থক হলো। এতদিন যা দেখছি। কি দেখলাম। সব পানসে আর ধূসর লাগছে এখন।
একটা বড় প্যাকেট কাজলের হাতে দিল শুভ্র। ধরো। তোমার জন্য কিছু ফুড আছে এতে। ক্ষুধা লাগলেই খাবে।
আর একটা রিকুয়েষ্ট রাখবে?
কাজল মুখে কিছু বলতেই পারছেনা। দলা পেকে আসছে শব্দরা। জড়িয়ে যাচ্ছে সব। চোখের ভাষায় বলল কিই?
তুমি কোনদিন কাজল দিবেনা চোখে৷ শুধু আমি যখন বলব তখন দিবে।
কাজল গোপনে নিজেকে সংবরন করলো। কোমল হেসে বলল,
ভাইয়ার যা কথা। এখন না হয় দিলাম না৷ কিন্তু বিয়ের পরে বর বললে?
তখন অবশ্যই দিবে। আমি আর তোমার বরের জন্য দিবে শুধু।
শুভ্র চলে এলে কাজল বুঝে নিল কিছু।
কাজলের ও শুভ্রকে ভালোলাগে কিন্তু তা তার মনের কুঠুরিতেই এই উদয় হয় আবার এই অস্তমিত সূর্যের মতো মেঘের আড়ালে লুকিয়ে যায়। তার কাছে শুভ্রকে চাওয়া মানেই ব্রাহ্মণ হয়ে চাঁদ ধরার বৃথা চেষ্টা করার মতো। কিংবা ছেঁড়া কাথায় শুয়ে লক্ষ টাকার স্বপ্ন দেখার মতো।
শুভ্রের ছোট ভাই অভ্র তার মাকে ফোন করলো বরাবরের মতো। জেসমিন বেগম পুত্রের সাথে কুশলাদি বিনিময় করে কাজলের বিষয়ে সব জানালেন।
অভ্র একটু মনমরা হয়ে বলল,
আমাদের বাসায় চাইলেই ওকে রাখতে পারতে আম্মু। এখানে থেকেও পড়াশোনা চালিয়ে যেত পারতো মেয়েটি।
না পারতোনা। আমাদের যৌথ সংসার। তোর চাচী নাক তুলে নানাকিছু বলতে থাকে, অন্ন ধ্বংস হচ্ছে বলে। আর তার চেয়েও বড় কথা জোয়ান একটা মেয়ে এভাবে অন্যের বাড়িতে সব সময় পড়ে থাকা বেমানান। বিষয়টা পাড়া প্রতিবেশীর নজরে ভালো ঠেকবেনা। কারণ ঘরে আমাদের ও জোয়ান ছেলে রয়েছে।
খানিকক্ষন চুপ থেকে অভ্র বলল,তা অবশ্য ঠিক বলছ আম্মু। আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয় আম্মু?
কি কাজ?
ভাইয়ার জন্যতো মেয়ে দেখছ। তুমি বলছ এ মেয়েটা খুব ভালো। খানদানি বংশের মেয়ে। আদব কায়দার কোন ঘাটতি নেই। ঘরের কাজেও নিপুণা। তাই বলছি কি ভাইয়ার সাথে বিয়ে হলে কেমন হয় মেয়েটার?
ছেলের কথা শুনে জেসমিন বেগম রিতীমত ভীমড়ি খেলেন। নাক মুখ খিঁচিয়ে বললেন, বুঝলাম না অভ্র। তুই দেখিসনি শুনিসনি। তবুও এই মেয়েটার প্রতি শুরু থেকেই তোর কেমন আগ্রহবোধ লক্ষ্য করছি।
আরেহ আম্মু। তোমার কথার উপর ডিপেন্ড করেই আমি একথা বলছি। আচ্ছা বাদ দাও খাল্লি বাল্লি।
না শুন। খাল্লি বাল্লি না। তুই বলাতে এই এক্ষুনি বিষয়টা আমার মাথায় গাঁথল। দেখি অন্যদের সাথে আলাপ করে।
অভ্র বিদুৎ শক খেল মায়ের কথা শুনে। মাথা চক্কর দিতে লাগল তার। মাকে বাজিয়ে দেখতে গিয়ে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারতে গেল নাকি।
নিজেকে একটু ধাতস্থ করে নিল ফোনের ওপাশে। ফের বলল,
আম্মু আমি দুষ্টমি করেছি। ভাইয়ার জন্য মেয়ের আকাল পড়ছে নাকি। ভুলেও এই মেয়ের কথা মাথায় আনবেনা। অন্য মেয়ে দেখ।
জেসমিন বেগমের মাথায় একবার কিছু বড়শীর মতো গেঁথে গেলে বের করার সাধ্য কারো নেই। তিনি গলায় দৃঢ়তা এনে বললেন,
আরে সেটা তোর ভাবতে হবেনা। আমি কাজলের বিষয়টা বিবেচনায় রাখলাম নিঃসন্দেহে।
আমাকে ভূতে ধরছে। কেন যে তোমাকে এটা বলতে গেলাম। রাখি বলে ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো অভ্র।
সাথে সাথে বোন উরমিকে ফোন দিল অভ্র।
হ্যাঁ ভাইয়া বল। আম্মুর সাথে না দেখলাম একটু আগে অনেকক্ষণ কথা বললা?
আজব তো তুই উরমি। আম্মুর সাথে কথা বলার পর তোকে ফোন দেওয়া যাবেনা এটা কি তোর নিউ রুলস নাকি?
নাতো ভাইয়া। ঝেড়ে কাশ বলছি কাহিনি না করে।
তুই একলা হ বোন। আমি ফেঁসে গিয়েছিরে।
উরমি নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দিল। খাটের এক কোনায় চেপে বসল। ঠোঁটের সাথে মোবাইল চেপে ধরলো। ফিসফিসিয়ে বলল,
আমি আমাদের উত্তর পুকুর পাড়ের বাঁশঝাড়ের ভিতরে আসছি। বল শুনছি।
তুই আমার একটা উপকার করতে পারবি? বিনিময়ে যা চাস তাই পাবি।
ওরে আল্লাহ। বল।
শুন আম্মু বলছে কাজল মেয়েটার সাথে ভাইয়ার বিয়ে দিবে। তুই এনি হাউ এটা হতে দিবিনা। আমি দুই মাস পর দেশে আসছি। তারপরে তোর আর কিছুই করতে হবেনা। যা করার আমিই করবো।
উরমির চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। মোবাইলটাকে এক পলক চোখের সামনে এনে ড্যাবড্যাব করে চাইল। ভুল কিছু শুনল নাকি সে।
বুঝলাম না। তা না হয় করব। কিন্তু এতে তোমার কি বেনিফিট?
আশ্চর্যন্বিত কন্ঠে শুধালো উরমি।
আছে উরমি আছে। আমি চ্যালেঞ্জ এ হেরে যাবো। আর হেরে গেলে আমার অনেক বড় লস হয়ে যাবে। এই মেয়েকে নিয়ে চ্যালেঞ্জ ধরেছি দুই বন্ধুর সাথে। সো প্লিজ হেল্পমি মাই ডিয়ার সুইট সিস্টার।
কিসের চ্যালেঞ্জ ভাইয়া? তুমি কি কাজল আপুকে আগে থেকেই চিনতে? বোকা বোকা সুরে জিজ্ঞেস করলো উরমি।
হ্যাঁ চিনি আমি তাকে। আর মূল কাহিনি আমি দেশে আসলেই তোকে জানাব। এখন সমস্যা আছে। মাটির ও কিন্তু কান আছে। এই বিষয় তুই ছাড়া যেন দ্বিতীয় কান না হয়।
অভ্র ফোন রেখে দিলে উরমি নিজেকেই প্রশ্ন করলো। কিসের চ্যালেঞ্জ নিল ভাইয়া কাজল আপুকে নিয়ে ? চিনেই বা কিভাবে?
চলবেঃ ৫