জোনাকিরা জ্বলে নিভে পর্ব -৬

#জোনাকিরা_জ্বলে_নিভে (পর্ব -৬)
#লেখিকা #রেহানা_পুতুল
অভ্র ফোন রেখে দিলে উরমি নিজেকেই প্রশ্ন করলো। কিসের চ্যালেঞ্জ নিল ভাইয়া কাজল আপুকে নিয়ে ? চিনেই বা কিভাবে?

জেসমিন বেগম বলি বলি করেও শুভ্র’র কাছে কাজলের বিষয়ে আশানুরূপ প্রসঙ্গটি তুলতে পারছেন না। এভাবে প্রায় পনেরদিন অতিক্রম হয়ে গেল।
তিনি এই ভিতরে একদিন সবার অলক্ষ্যে শহরে অবস্থিত স্বামীর সাথে আলাপ করলেন। শুভ্রের বাবা বিস্তারিত শুনে কোন আপত্তি করলেন না। আবার খুব যে পছন্দ হয়েছে তাও বললেন না।

শুধু জানালেন, শুভ্রের পছন্দ হলেই চলবে। জীবন তার। সুতরাং সিদ্ধান্ত ও তার। চাপিয়ে দেওয়ার মতো বিষয় নয় এটা।

জেসমিন বেগম শুনে আস্বস্ত হলেন অনেকটাই। উরমির সাথেও বিষয়টা নিয়ে আলাপ করলেন।

উরমি শান্তভাবে টেনে টেনে মাকে বলল,
আম্মু কিছুদিন পর ছোট ভাইয়াও লন্ডন থেকে আসবে। তখন অবধি অপেক্ষা করি আমরা। ভাইয়া আসুক। তখন বড় ভাইয়ার মত জেনে আমরা কাজল আপুর আম্মুর কাছে বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে যাব। এখন চুপ থাক। ছোট ভাইয়ার অনুপস্থিতিতে বড় ভাইয়া বিয়ে করবেনা। এটাতো নিশ্চিত।

তুই মন্দ বলিসনি। তবে শুভ্রের কেমন লাগে কাজলকে। এটাতো জানতে সমস্যা নেই। কি বলিস?

সেটার দায়িত্ব আমার উপর অপর্ণ করো জননী। এক সপ্তাহ সময় নিচ্ছি।

শুভ্রের মুঠোফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটি দেখতে পেয়ে নিজের অজান্তেই মনের গহীনে পুলক জেগে উঠলো। আকুল করা ব্যকুলতা থাকা সত্ত্বেও শুভ্র কখনোই কাজলকে অহেতুক ফোন করেনি একটি বারও। কোন না উপলক্ষ তৈরি করেই ফোন দিত। অতিরিক্ত আলাপ ও করেনি যেচে। যতই ভালোলাগুক কাজলকে। নিজের ব্যক্তিত্ববোধকে বির্সজন দিতে সে নিতান্তই অপারগ। কেটে দিল কাজলের ফোন। খানিক পরেই ব্যাক করলো।

হ্যালো শুভ্র ভাইয়া কেমন আছেন?

কাজলের নেশা জাগানিয়া কন্ঠ শুনে শুভ্রের ইচ্ছে করছে বলতে,
ভাইয়া বাদ দিয়ে শুভ বলবে জাস্ট। কিন্তু তা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। শুভর চরিত্রের সাথে এসব হ্যাংলামো একদম অশোভনীয়।

হ্যাঁ কাজল আছি। হঠাৎ তলব?

কেন আমি কি ফোন দিতে পারিনা আপনাকে?

অজস্রবার পারো। বাট তুমিতো খুব দরকার না হলে ফোন দাওনা। তাই বললাম। হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে বলল শুভ্র।

ভাইয়া আপনি কি ঢাকার জিন্দাপার্ক চিনেন?

না চেনার কি আছে? আমাদের ব্যবসার কাজে প্রায়ই আমার ঢাকায় যাওয়া হয়। বন্ধুরা সহ গিয়েছি কয়েকবার। কেন কাজল?

না আমার কয়েকজন ক্লাসমেট বন্ধু বলল খুউব সুন্দর নাকি এই লোকেশনটা। তাই জেনে নিলাম সত্যি নাকি ওদের বলাটা। তাহলে কখনো ঢাকায় গেলে এখানে যাব৷

আমার সাথে যাবে কাজল?

জানিনা।

আচ্ছা ঠিকাছে৷ যেদিন জানবে। সেদিন জানাবে। দেখি কি করতে পারি। রাখি বাই।

এই কয়দিনে কাজল টের পেয়েছে শুভ্রের অনুভূতি অনুরাগ। কিন্তু সে যে উপলব্ধি করতে পেরেছে, এটা শুভ্রকে বুঝতে দিচ্ছেনা। এদিকে শুভ্র ও জানেনা কাজল ও তাকে গোপনে চায়। হারাতে চায় গোপন অভিসারে। করতে চায় জোছনাবিলাস। কারণ কাজল তাকে বোঝার সুযোগটুকু দিচ্ছেইনা। কাজল আরো নিশ্চিত হতে চায় শুভ্রের বিষয়ে। কেননা ধনীর ছেলেদের ভালোলাগার রূপ বদল হওয়াটাই নরমাল গিরগিটির মতন।

উরমি ইনিয়ে বিনিয়ে নানাভাবে নানাকৌশলে শুভ্রের কাছ থেকে কাজলের বিষয়ে নিশ্চিত হলো।

মাকে জানাল গিয়ে,
ভাইয়াতো কাজল আপুকে খুওব পছন্দ করে।

কাজল করে কিনা এটা জানিস? বলল জেসমিন বেগম।

ওহ হো! ঠিক বলছ। এটাও জানা জরুরী। নয়তো এক পাক্ষিক প্রেম হয়ে যাবে এটা।

যা এটা জানার চেষ্টা কর।

এক বিকেলের অবসরে শুভ্রের চাচীর মত জানতে চাইলো তার মা। সে তিনহাত নাক সিঁটকে বলল,
পথ থেকে কুড়িয়ে আনা ধুতুরা ফুলকে যদি গোলাপ ভেবে ফুলদানিতে রাখতে রূচিতে না বাঁধে আপনাদের। তাহলে আমার আর কিইবা বলার থাকে ভাবি। আমার শুনতেই চিত্ত রি রি উঠলো। রুবানা গ্যাল বাঁকিয়ে চলে গেল অন্যদিকে।

জেসমিন বেগল মোটিভেটেড হয়ে গেলেন কিছুটা। রুবানা মনে হয় ঠিকই বলছেন। একবার ভেবে উঠলেন।

কাজলের সাথে সপ্তাহে একদিন দেখা হয় শুভ্রের। এটা নিয়মের মত হয়ে গিয়েছে। রোজ দেখতে ইচ্ছে করলেও সেটা কাজলের সামনে মুখ ফুটে প্রকাশ করেনা। কিন্তু আকার ইঙ্গিতে বুঝাতে চায় শুভ্র কাজলের প্রতি টান অনুভব করে। শক্ত করে হাত দুটো ধরে রাখতে চায় জনমভর।

এক অলস দুপুরে শুভ্র কাজলের কলেজের সামনের পথ ধরে অন্যদিকে যাচ্ছে কোন কাজের তাগিদে। মাঠের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল আনমনেই। দেখতে পেল কাজল ফুচকার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। একটি ছেলের সাথে হেসে হেসে ফুচকা খাচ্ছে।
পা চালিয়ে শুভ্র সেখানে গেল। ছেলেটা এখন নেই। অন্যদিকে চলে গিয়েছে।

ভাইয়া আপনি এই অসময়ে এখানে?

ভর দুপুরে কলেজের মাঠের একপাশে শুভ্রকে আকস্মিক দেখে জিজ্ঞেস করলো কাজল।

তোমাকে দেখেই এগিয়ে এলাম।বিল দিয়েছ?

না দিব।

আমি দিয়ে দিচ্ছি বলে শুভ্র দুই প্লেট ফুচকার দাম মিটিয়ে দিল।

কাজল বাধা দিয়েও পারলোনা।

তোমাকে না বললাম চোখে কাজল দিবেনা আমি না বললে। দিলে কেন?

আংশিক রাগত স্বরে জানতে চাইলো শুভ্র।

মন চেয়েছে। তাই দিয়েছি। আপনি দিয়েছেন বলেই শুধু আপনাকে দেখানোর জন্যই পরব। অন্য সময়ে পরতে পারবোনা। এটা কেমন কথা?

এটাই কথার কথা। একদম পরবেনা। পানিতে ভেসে উঠা মরা মাছের মতো করে রাখবে তোমার চোখ দুটোকে।

মেন্টালের মত বলছেন কেন আপনি। লাগবেনা আপনার কাজল। দিয়ে দিবে ফেরত। বিরক্ত গলায় বলল কাজল।

শুভ্রর খুউব ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে কাজলের বাম গালে। চুপিচুপি বাম হাতের পাঁচ আঙ্গুলকে মুঠোবন্দি করে ফেলল তৎক্ষনাৎ। মুহুর্তেই আবার ছেড়ে দিল আঙ্গুলগুলো।

কাজলের হাত ধরে কলেজের মাঠের পিছনে নিয়ে গেল শুভ্র। জিন্সের প্যান্টের পকেট থেকে দুটো টিস্যু বের করে নিল। নলকূপ থেকে ভাঁজ করা টিস্যুটি ভিজিয়ে নিল। নিজ হাতে কাজলের দুচোখের কাজল ঢলে মুছে দিল টিস্যু দিয়ে।

কাজল নিজের ভিতর ঘাপটি মেরে থাকা অদম্য কৌতুহলকে আর দমন করতে পারলোনা। হড়হড় করে জিজ্ঞেস করলো,
সমস্যা কি শুভ্র ভাইয়া? ক্লিয়ার করেন প্লিজ। সাইকো নাকি আপনি?

শুভ্র শিকারী চোখে কলেজের পিছনের চারপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। দেখল বেশ ফাঁকা। সবাই ক্লাসের ভিতরে। কাজলের দুহাত ধরে শক্ত চোয়ালে বলল,
আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাই কেউ তোমার কাজলটানা চোখের প্রেমে পড়ে যাক তা চাইনা। তুমি চাইলেই আমার হয়ে যেতে পার। তপ্ত মরুর বুকে এক পশলা বৃষ্টির মতো পড়তে পারো অবিরাম ধারায়।

কাজল ভাবলেশহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নরম গলায় বলল। আমিতো আপনাকে লাইক করিনা ওভাবে। আস্তে করে বলল কাজল।

আমিতো চোর, ডাকাত বা গুন্ডা নই কাজল। যে জোর করে ছিনিয়ে বিয়ে করব। তোমার চাওয়া পাওয়ার মর্যাদা অবশ্যই আমি দিব। তুমি না চাইলে কিছুই হবেনা। তবে জেনে রেখ। আমি কেবল তোমাকেই চাই। ক্লাসে যাও। লেট হয়ে যাচ্ছে।

শুভ্র উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলে হেঁটে চলে যাচ্ছে কলেজ প্রাঙ্গণের সবুজ চত্বর ছেড়ে৷

কাজল দাঁড়িয়ে থাকা থেকে জোর পায়ে শুভ্রের কাছে আসল৷ গা ঘেঁষে দাঁড়ালো ছোট্ট হাঁসের ছানার মতো।

আমি সারাজনম শুধু আপনার জন্যই দুচোখে কাজল পরতে চাই। আর কারো জন্যইনা। বলে এক দৌড়ে কলেজের ভিতরে চলে গেল।

শুভ্র আচমকা শুকনো মাটিতে আছাড় খাওয়ার মতো দাঁড়িয়ে গেল। যেন টাল সামলাতে পারছেনা। বারবার মনে করলো কাজলের বলা বাক্য দুটি। ভীষণ মন চাচ্ছে সেতারের বীণার মতো কাজলের এ কথাটি তার বুকের অতলে প্রতিধ্বনিত হতে থাকুক মুহুর্তের পর মুহুর্ত।

আমার কাজল বউ৷ পারলে তোমাকে এখন কোলে নিয়ে এভারেস্টের চূড়ায় উঠে যেতাম মনের আনন্দে।

কাজলের ক্লাসে একদম মন বসছেনা। কেমন যেন উদাস উদাস লাগছে। বিবাগী হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে তার। তসবিহর ন্যায় মনে মনে গোপনে জপতে লাগল,
আমার শুভ্র বর টা। আমার চির অসুখ টা। আমার সাইকোটা।

আজ অভ্র বাড়িতে এসেছে। সারাঘরজুড়ে উল্লাস আর উচ্ছ্বাস। যেন উৎসবমুখর কোন পরিবেশ। দুইদিন পর উরমি থেকে কাজলের বিষয়ে খোঁজ খবর নিল অভ্র।

উরমি বলল, আমার আইফোন কই ঘুষ হিসেবে?

তুই ঘুষ খাবি আমার বোন হয়ে ?

এই ভাইয়া ভালো হবেনা বলছি। অনেক সংগ্রাম করে করে তুমি আসা অবধি ভাইয়ার আর কাজল আপুর বিয়ে আটকে রেখেছি। এখন নয়ছয় করলে হবেনা।

আগে সফল হই। তারপর দিব বনু।

কিসের সফল?

আমি কাজলকে বিয়ে করবো।

উরমির মাথা চরকির মতো ঘুরতে লাগল। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,এ দেখি একটি ফুলে দুটি ভ্রমর। ত্রিভুজ প্রণয়।

উরমির ঝুঁটি করা চুলের মাথা ধরে টান মেরে বলল অভ্র ,
কোন প্রেমটেম না। কিছুই না। মুখ বন্ধ রাখ এখন। এটা অন্যরকম প্রতিশোধ।

চলবেঃ ৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here